অনেকক্ষণ থেকে খেয়াল করছি, লুনা ঠিক পড়ছে না। অথচ দশটা থেকে ওর পরীক্ষা । আমি শাওন। লুনা আমার ছোট বোন। আমি ক্লাস নাইনে পড়ি, আর লুনা ক্লাস সিক্সে পড়ে । আমি পড়াশোনায় মোটামুটি । কিন্তু লুনা ভীষণ জিনিয়াস। এখনো পর্যন্ত কোনদিন দ্বিতীয় হয়নি সে। আমার রোল দশের ভিতরে থাকলেও, কোনদিন ফার্স্ট হইনি আমি। অথচ লুনা কোন স্যার, ম্যাডামের কাছে পড়ে না। আমাদের দুই ভাই বোনকে টিচার দিয়ে পড়ানোর সামর্থ্য আমার বাবার নেই। আমার বাবা ছোট খাটো একজন সরকারী কর্মচারী। তারপরও সপ্তাহে একদিন আমরা মাংস খেতে পারি। শুক্রবারে বাবা খুব আগ্রহ করে হাফ কেজি গরুর মাংস আনে। আমার মা পরম যত্ন করে সেটা রান্না করে ।
সেদিন চালও একটু বেশি দেয় মা। জানে, লুনা আর আমি দুজনই মাংস হলে এক প্লেট ভাত বেশি খাই। সপ্তাহে একদিন আমাকে আস্ত একটা মুরগীর ডিম দেওয়া হয় আর একদিন লুনা কে। প্রায় দিনই লুনার যেদিন আস্ত মুরগীর ডিম খাওয়ার কথা থাকে, সেদিন সে মাকে বলে, ” আমার ডিম খেতে ভালো লাগে না মা। আমারটা থেকে অর্ধেকটা ভাইয়া কে দিয়ে দাও। ” বাকি অর্ধেকটাও এমনভাবে খায়, যেন বাধ্য হয়েই খাচ্ছে । অথচ সেদিন যখন পাশের বাসার খালাম্মারা চার জনের জন্য চারটা ডিম রান্না করে পাঠিয়েছে, তখন দেখি, খুব মজা করে করে খাচ্ছে । তার মানে ওর ভাগেরটা খেতে যাতে আমার খারাপ না লাগে, সেই জন্যই ও অপছন্দের ভান করে । তো যেটা বলছিলাম, মনে হচ্ছে লুনা ঠিক পড়ছে না ।
দাদার রেখে যাওয়া এই বাড়িটায় দুইটা রুম, একটা রান্নাঘর আর একটা বাথরুম আছে। এই রুমটায়, আমি আর লুনা পড়ি। দুজনের জন্য দুইটা ছোট ছোট টেবিল আছে এ ঘরে। পড়া শেষ হয়ে গেলে, রাতের বেলা আমি আর বাবা এ ঘরে শুই। লুনা আর মা শোয় পাশের রুমে। মনে হলো, লুনা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে । ঘটনা কি? রিভিশন দেওয়া শেষ হয়নি ? তাতো সম্ভব নয়। পরীক্ষার আগের রাতেই, সে একবার শেষ করে তারপর ঘুমায়। সকালে উঠে আর একবার রিভিশন দেয়। গতকালকের পরীক্ষা খারাপ হলো নাকি ? কেমন জানি, মন মরা করে ফিরেছিল স্কুল থেকে । নাকি কেউ কিছু বলেছে ? আমি ওর পিছনে যেয়ে দাড়ালাম । দেখি, ওর চোখের পানিতে সমাজ বইয়ের একটা পৃষ্ঠা ভিঁজে গেছে ।
– কি হয়েছে রে ? লুনা চমকে পিছে ফিরে তাকালো।
– কিছু না ভাইয়া ।
– কিছু না, তাহলে কাঁদছিস কেন? দুই ঘন্টা পরেই তো তোর পরীক্ষা । কেউ কিছু বলেছে ?
– না।
– তাহলে ?
– গতকাল পরীক্ষা শেষে ভুলে নতুন কলমটা ফেলে এসেছি ।
মাঝ রাস্তায় এসে খেয়ালকরেছিলাম । ফিরে যেয়ে দেখি রুমে তালা লাগিয়ে দিয়েছে । খালাকে জিজ্ঞাসা করলাম, খালা বললো, সে কোন কলম দেখেনি। কোন বেঞ্চেই নাকি কিছু ছিল না । পুরানো কলমটাই এতটুকু শুধু কালি আছে। এটা দিয়ে আজকের পরীক্ষার অর্ধেকও লেখা যাবে না । আরো তো কাল একটা পরীক্ষা আছে । এবার অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষায় নির্ঘাত ফেল করবো আমি । লুনা এবার কান্নায় ভেঙে পড়লো।
– এতে কান্নার কি আছে ? বাবা কে বল, পাশের দোকান থেকে আর একটা কিনে এনে দেবে।
– ভুলে গেছিস, আজ ২৮ তারিখ?
তাইতো। আমার বাবার মন মাসের প্রথম দিকে খুব উদার থাকে । কিন্তু মাসের শেষের দিকে কেমনজানি খিটখিটে মেজাজের হয়ে যায় বাবা। কথায় কথায় আমাদেরকে ধমকায়, মাকে ধমকায়। কিছু চাইলে তো কথাই নেই । আগে আমার অভিমান হতো। এখন হয় না । মা একদিন বলেছিল, মাসের শেষে বাবার হাতে তেমন টাকা থাকে না । তাই রাগ করে, ভালো মানুষটা তার কষ্ট লুকায়। আমার যে কলমটা আছে, তা দিয়ে অনায়েসে ওর আজ আর কালকের পরীক্ষা হয়ে যাবে । তিনদিন পরেই তো বাবা বেতন পাবে । তখন বাবা দুজনের কলমই কিনে দিতে পারবে। ওকে বললাম,
– আমার কলমটা নিয়ে যা।
– তুই ক্লাসে যেয়ে কি দিয়ে লিখবি ?
– আরে বড় ক্লাসে এত লেখালেখি করতে হয় না।
তুই আমারটা নিয়ে যা।লুনা মনে হলো, জানে পানি ফিরে পেলো।স্কুলে যাওয়ার পরে, প্যালপিটেশন শুরু হলো। ক্লাসে লিখবো কি দিয়ে? কয়েকজন বন্ধুর কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, এক্সট্রা কলম এনেছে কিনা। কিন্তু কেউ ই এক্সট্রা কলম আনেনি। প্রথম তিনটা ক্লাস নির্বিঘ্নে কাটলো। কিন্তু চতুর্থ পিরিওড এ হলো ঝামেলা । আরিফ স্যার আমাদের অংকের টিচার । নতুন এসেছেন । খুব রাগী । কথায় কথায় সাজা দেন আর অপমান করে কথা বলেন। স্যার অংক করতে দিলেন। আমি খাতাটা খুলে, খাতার এক সাইড উচু করেলেখার ভান করছি । আমার সামনের জনের আড়ালে বসে মাথা নিচু করে লেখার ভান করছি। হঠাৎ কে জানি, হ্যাঁচকা টান দিয়ে খাতাটা কেড়ে নিলো। তাকিয়েদেখি, স্বয়ং স্যার ! কখন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, টের পাইনি।
স্যার হুংকার দিয়ে বললেন, ” উত্তম কুমার হওয়ার খুব শখ নাকি আপনার? ” আমার খাতার সাদা পেইজটা উচু করে ধরে সবাই কে বললেন, ” দেখো সবাই । সে অংক করার অভিনয় করছে ! নিজেকে নায়ক উত্তম কুমার ভাবে। ” ক্লাসে একটা হাসির রোল পড়ে গেলো । স্যার আবার একটা হুংকার দিয়ে বললো, ” অংক করিসনি কেন ? ” এই বয়সে নিজের পরিবারের দারিদ্রতার কথা সবার সামনে বলতে লজ্জা লাগে । তাই কাঁচুমাচু করে বললাম, ” ভুল করে বাসায় কলম রেখে এসেছি স্যার ।
” স্যার বললেন, ” কেন ? কোন সুচিত্রা সেনের প্রেমে পড়েছো নাকি ? ” ক্লাসে আবার হাসির রোল পড়লো। আমি বুঝি না, বিপদে পড়লে বন্ধুরা এমন হাসে কেন ? স্যার আমাকে কান ধরে বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে দিলেন । খুব লজ্জা এবং কষ্ট লাগছিলো। মাঝে মাঝেই স্যারের চোখ এড়িয়ে, কান থেকে হাত সরিয়ে, চোখটা মুছে নিচ্ছিলাম। বাকি ক্লাস গুলোতে আর ঝামেলা হয়নি। কিন্তু মন খারাপটা কোন ক্রমেই কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না। সত্যি কথা বলতে কি, এ ধরনের সাজা আমার জীবনে প্রথম । তাই নিজেকে খুব অপমানিত মনে হচ্ছিলো । বাড়িতে আসার পরে দেখি, লুনা ভীষণ খুশিতে আছে। বললো, ” ভাইয়া, পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে । এবারও ইনশাআল্লাহ আমিই ফার্স্ট হবো।
ভাগ্যিস, তোর কলমটা দিয়েছিলি। তিনটা প্রশ্নের উত্তর লেখার পরেই ঐ কলমের কালি ফুরিয়ে গিয়েছিল । তারপর তোরটা দিয়ে লিখেছি। তোর ক্লাসে তোর কোন সমস্যা হয়নি তো ভাইয়া? লুনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে, সে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ । ওর মুখের এই হাসি দেখবার জন্য, পৃথিবীর সকল রকম অপমান মুখ বন্ধ করে সহ্য করা যায়। আর একটা দিনই তো। আগামীকাল কান ধরে বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে, আমার একদমই খারাপ লাগবে না । হেসে দিয়ে বললাম, ” পাগল হয়েছিস ? বড় ক্লাসে এত লেখালেখি করতে হয় না।