মৃত্তিকা

মৃত্তিকা

জেনি স্পষ্ট দেখতে পেল তার সামনে একটা মহিলা দাঁড়িয়ে আছে, গায়ে একটুকরো কাপড় নেই। ফর্সা শরীর, এলোমেলো রুক্ষ জটবাঁধা চুল। অনেকদিন গোসল করা হয়নি বোধহয়। ফর্সা শরীরের ভাঁজে ভাঁজে ময়লা আটকে আছে, কালচে দাগ হয়ে। মহিলা দাঁড়িয়ে আছে একটা ভঙ্গুর চালাঘরের সামনে। চিকন একটা বাঁশের খুঁটি একহাতে প্যাঁচিয়ে ধরে। অসহায় দৃষ্টি। কিছু একটা বলতে চায় সম্ভবত।

একটা ঘ্রাণ পেল জেনি, কিসের একটা ঘ্রাণ যেন। ভেজা ভেজা। সোঁদা গন্ধ। জেনি এক পা এগিয়েই চমকে উঠে থমকে দাঁড়াল। মহিলাটির নগ্ন উরু বেয়ে একটা কালচে রক্তের ধারা গড়িয়ে নামছে নিচের দিকে। জেনির বমি পেল। দমবন্ধ করে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে। রক্তের ধারা ডান উরু বেয়ে হাঁটু পেরিয়ে টাকনুর পাশ দিয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়তেই মহিলাটি ক্ষীণ স্বরে তাকে ডাকল, ‘মৃত্তিকা, আয় না কাছে একটু। ছুঁয়ে দেখ আমায়। আয় অস্পষ্ট একটা শব্দ করে বিছানায় উঠে বসে হাঁপাতে লাগল জেনি। ততক্ষণে বাড়ির সমস্ত লাইট জ্বলে উঠেছে। দু’টো ধবধবে ফর্সা চামড়ার মানুষ অস্থির চিত্তে ছুটে আসলো রুমে। জেনির বিরক্ত লাগল। এই এক্ষুনি মানুষ দু’টো ইংরেজীতে ফটর ফটর শুরু করবে। জেনির অসহ্য লাগছে আজকাল। সবাইকেই। রাতদিন এক করে বাংলা শিখছে সে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভাবে বলতে পারে অল্প অল্প। এই যে ধবধবে ফর্সা মহিলাটি আতংকিত চোখে তাকিয়ে যখন জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে তার। তখন জেনি উত্তর দিল বাংলায়, ‘কিছু হয়নি।’

ফর্সা মহিলাটি বাংলা ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে উচ্চারিত শব্দ দু’টো না বুঝলেও বিছানায় উজ্জ্বল শ্যামলা রঙের যে মেয়েটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘোঁ ঘোঁ আওয়াজ করতে করতে হকচকিয়ে ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসে প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে এখন তাকিয়ে আছে তাদের দিকে, তাকে বুঝলেন। একহাত বাড়িয়ে লম্বা এলোমেলো চুলের মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে পাশে দাঁড়ানো ভীত পুরুষটাকে মৃদু স্বরে বললেন, ‘যাও। শুয়ে পড়। আমি আছি এখানে জেনি কাত হয়ে ফর্সা মহিলার কোলে শুয়ে পড়ে৷ তাকিয়ে থাকে চোখে। বেশ কিছুদিন আগে জেনেছে, এই মহিলাটি তাকে গর্ভে ধারণ করেনি। অথচ জেনি স্পষ্ট দেখতে পায়, দু’টো চোখে তার মাতৃত্বের গন্ধ। যীশু এই চমৎকার মহিলাকে একটা সন্তান উপহার দেয়নি কেন? ‘মাকে খুঁজে নিয়ে আসি?’ জেনি ভেজা স্বরে জিজ্ঞেস করে।

ফর্সা মহিলার চোখে চট করে জল জমে। মায়েরা সন্তান ভাগ করতে রাজি হয়না। যদিও পঁচিশ- ত্রিশ বৎসর পর অজানা অচেনা একটা দেশে অতো অতো মানুষের ভিড়ে, নথিপত্র খুঁজে, আত্মীয়- স্বজন খোঁজ করে মাকে খুঁজে পাবার সম্ভাবনা দশ পার্সেন্ট। অথচ বাকি নব্বই পার্সেন্ট খুঁজে না পাওয়ার বিশাল সম্ভাবনাটাও ফর্সা মহিলাটিকে খুশি করাতে পারছেনা। জেনি দু’হাতে আঁকড়ে ধরে মাকে। একটা ভেজা ভেজা গন্ধ খুঁজে কোলের আনাচে কানাচে। পায়না। কোথায় পাবে সে ঐ গন্ধ? ‘শাহীদ, বাংলাদেশে যাচ্ছি। দুই দিন পর।’ ছোট্ট টেবিলের ওপাশে যে ছেলেটা বসে আছে, বয়স ত্রিশ অথবা একত্রিশ, মুখে চাপ দাঁড়ি, মায়াকাড়া চোখ আর বেশ সুদর্শন। সেই বোধহয় শাহীদ। কারণ জেনির ড্যাবড্যাব করা চোখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি অথচ ভরাট স্বরে স্পষ্ট ইংরেজীতে জিজ্ঞেস করল সে, ‘মাকে খুঁজতে?’ জেনি মাথা নাড়ায়। হ্যাঁ। শাহীদ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসে, ‘আমি যাই সাথে?’

জেনি মাথা নাড়ায়। না। বেশ কয়দিন ধরে ওদের মধ্যে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। কথাবার্তা অল্প অল্প, প্রেম নেই ওতে- যতটুকু আছে, নিতান্তই কৌতুহল। যদিও বেশ কিছুদিন আগে এমন ছিল না। শাহীদ মুসলিম, প্রেমটা যদিও ভিন্ন ধর্মালম্বী কারো সাথে। তবে জেনি সম্পর্কটা বিয়ে অবধি গড়াতে নিজ ধর্ম ছাড়তে রাজী ছিল। কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ নামক একটা দেশ আছে, জানতো না জেনি। ইন্ডিয়ার এক কোণায়, চেপ্টে থেঁতলে আছে ক্ষুদ্র অথচ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ একটা ব-দ্বীপ! জেনি জেনে বিস্মিত হলো। পঁচিশ বৎসর লাগলো এটা জানতে তার। এটাই ওর জন্মস্থান! আশ্চর্য! ঐদিন ফর্সা চামড়ার ঐ মানুষ দু’টির গলা চেপে ধরতে ইচ্ছে করেছিল দু’হাতে, প্রচণ্ড রাগে। কেন জানালো তাকে? না জানালেই বা কি হতো? দত্তক! এরচেয়ে ভয়ংকর অসহ্য কষ্টের শব্দ আর আছে পৃথিবীতে? একটু ইন্টারনেট ঘাঁটলো সে।

সময়টা ১৯৭১ সাল। জেনি পড়ল, প্রচুর পড়ল। ঘেঁটে ঘেঁটে দেখল পুরনো সব পত্রিকা, হিস্টোরি, উইকিপিডিয়া। নয়টা মাস মাত্র, এর মধ্যেই এতো গণহত্যা, ধর্ষণ! অপরাধ কী? কথা বলতে চেয়েছিল নিজ ভাষায়। এই তো। মানুষ এমন কেন হয়? পড়তে পড়তে চোখ মুছল, আবার পড়ল। কান্না এসে দলা বেঁধে গলায় আটকে রইল তার। ঐ রাতেই জ্বর আসলো, একশত চার ডিগ্রী! ফর্সা চামড়ার মানুষ দু’টি অস্থির চিত্তে অসুস্থ জেনির পাশে জেগে রইল। তিন দিন পর জেনি শাহীদের মুখোমুখি হলো।

জেনি জানে, শাহীদ ভালো ছেলে। কিন্তু? ‘হয়ত আমার বাবা দাদা মন্দ কাজ করেছে। তার জন্য আমিও কি মন্দ হব? জেনিফার, কি বলছ তুমি এসব?’ জেনি চুপ করে তাকিয়ে থাকে সামনে। টেবিলের ওপাশে একটা পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত যুবক। শাহীদ আসগর। এই দেশে পড়াশোনা করতে আসছে। জেনি শাহীদের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। মাকে খুঁজে বের করা দরকার। বড্ড দুঃস্বপ্ন দেখা হচ্ছে আজকাল। দুঃস্বপ্নে মায়ের গায়ে কাপড় থাকেনা, নগ্ন পুরো শরীর! আবার চেহারাটাও স্পষ্ট না। শুধু একটা গন্ধ। ভেজা ভেজা। আর একটা ডাক, মৃত্তিকা। আচ্ছা, মৃত্তিকা অর্থ কী?

জমির সাহেব উঠোনে চেয়ারে বসে বিড়ি ফুঁকছেন। আগে ঘরে বসে ফুঁকতেন। ঘরে মেহমান আসছে। মেহমানের সামনে বিড়ি ফুঁকা ঠিক নয়। তাও আবার ভিনদেশী মেহমান। বিড়ির অপর নাম বেয়াদবী। ভিনদেশী মেহমান অসন্তুষ্ট হবেন। জমির সাহেব মেহমানের নাম মনে করার চেষ্টা করলেন। বৃদ্ধ হচ্ছেন, স্মৃতিশক্তি কমে আসছে।
মেহমান এসেছে মাকে খুঁজতে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে একটা মেয়ে এই গাঁয়ের ইউ.সি. হাসপাতালে একটা বাচ্চা জন্ম দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছেন। মানবিক দিক বিবেচনা করে বাচ্চাটাকে একটা সংস্থা থেকে বিদেশের একটা পরিবার দত্তক নিয়েছিল। অনেক বৎসর পর বাচ্চাটা মাকে খুঁজতে এসেছে এখন, পরিবার নিয়ে। মেয়েটির সাথে আসছে সাদা চামড়ার দু’টো মানুষ, কারো নাম মনে পড়ছে না জমির সাহেবের। নিমাই বাবুকে খবর দেয়া হয়েছে। জেনিফারকে একমাত্র উনিই সাহায্য করতে পারবেন।

জমির সাহেব আনন্দিত বোধ করলেন, হুট করেই নাম মনে পড়েছে তার। জেনিফার; মেয়েটির নাম জেনিফার ক্যাথেরিন। ডাকনাম, জেনি। মিষ্টি নাম। মেয়েটাও মিষ্টি। জমির সাহেব এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের প্রধান বলেই ভিনদেশী মেহমানদের সমাদর করার সৌভাগ্য প্রতিবার তার কপালেই জুটে। এতে অবশ্য নাদের, মোবারক আর ইদরীস সাহেব হিংসা করেন না। গ্রামে গঞ্জে ধান গম চাষ হয়, হিংসার চাষ হয় শহরে। জেনি মুগ্ধ চোখে গ্রাম দেখছে। বৃদ্ধ নিমাই বাবু পাশে। প্রায় ধনুকের মতো বাঁকা একটা লাঠি হাতে ঠকঠক করে হাঁটছে। জেনি এক হাতে বৃদ্ধের গা জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে হাঁটছে। বৃদ্ধ জেনির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলে, ‘কত্ত বড় হইছো কত্ত সুন্দর। ঠিকানা পাইছো কই আম্মা?’

জেনি বাংলা বুঝতে পারছে সব, বলতে গিয়ে শুধু একটু সমস্যা হচ্ছে। থেমে থেমে বললো, ‘এতিমখানা থেকে। পুরাতন নথিপত্র, তালিকা। খুঁজে খুঁজে হয়রান। চাচা, মাকে আপনি চেনেন?’ নিমাই বাবু লাঠিতে ভর দিয়ে উপরে তাকালেন। বিস্তৃত নীল আকাশ, মানুষ এমন বিশাল হয়নি কখনো। আকাশ তাদের শেখাতে পারেনি কিছুই। এমনই একটা দিন ছিল। জুনের মাঝামাঝি। নিমাই বাবুর বয়স তখন পঁয়তাল্লিশ। অস্থির দেশ। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে একপাল হায়েনা। নিমাই বাবু একলা মানুষ, বিপত্নীক। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝেন নি। মিলিটারীরা হাই স্কুলে ক্যাম্প করার পর তিনি বুঝতে পারলেন, ভুলটা কত বিপদজনক। আরো আগেই বর্ডার ক্রস করা উচিৎ ছিল। যে রাতে তার চুপিচুপি ঘর ছাড়ার কথা, তার আগের রাতে একটা ঘটনা ঘটল। গভীর রাতে কেউ দরজায় নক করল। ঠক ঠক।

নিমাই বাবুর সমস্ত শরীরে ঠাণ্ডা একটা শিহরন নেমে আসল। মিলিটারী না তো? খুঁজে খুঁজে হিন্দু মারছে ওরা। দরজার বাইরে থেকে একটা মেয়ের গলার স্বর শুনতে পেলেন, ‘দরজাটা খুলুন দরজা খুলতেই একটা মেয়ে এসে ঢুকলো ভেতরে। পানি খেতে চাইলো। ঢকঢক করে পানি খেয়ে বিছানায় বসে কাঁপতে লাগল। নিমাই বাবু তাকিয়ে রইলেন। ভারী ফর্সা, কি অদ্ভুত সুন্দর পরীর মতোন একটি মেয়ে। চুল কাঁধ পর্যন্ত অসমান করে কাটা। বয়স পঁচিশ- ছাব্বিশ হবে। ছেঁড়া ব্লাউজ, কোন রকম ময়লা একটা চাদরে পুরো শরীর ঢেকে রাখার অনর্থক চেষ্টা। নিমাই বাবু একটা চাদর এনে দিলেন। মেয়ে সেটি পুরো শরীরে ঢেকে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘আমায় একটু বাঁচাবেন?’ নিমাই বাবু ঢোক গিলেন।

ক্যাম্প থেকে পালিয়েছে মেয়েটা। প্রতি রাতে খুবলে খাচ্ছে মেয়েদের। তের জন ছিলো। একটা মেয়ে… ঐ রাতে জানোয়ারেরা তার যৌনাঙ্গ বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষত করলো! স্তনে আঁচড়, নিপল কামড়ে ছিঁড়ে নিল। মেয়েটা গত রাতে নিজের চুল গলায় বেঁধে আত্মহত্যা করলো। তারপর জানোয়ারগুলো মেয়েদের সবার চুল কেটে দিল। এখন বার জন, মেয়েটি পালিয়ে এসেছে। বাবা ভাইকে মেরে ফেলছে, কেউ বেঁচে নেই। মেয়েটি ভেজা স্বরে বলে, ‘আমায় একটু বর্ডার পার করে দেবেন আপনার সাথে?’ নিমাই বাবু চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। মাথা নেড়ে অভয় দিলেন। ভয় নেই। তারপর ভীত অর্ধ জীবিত মেয়েটিকে নিয়ে ঘুরতিপথে পৌঁছলেন হাইস্কুলে, মিলিটারীর ক্যাম্পে। টেনে হিঁচড়ে মেয়েটিকে মিলিটারীর হাতে তুলে দিলেন।

জেনি বিষ্মিত চোখে হা করে তাকিয়ে আছে বৃদ্ধ মানুষটির দিকে। এ কেমন মানুষ? একটা অসহায় মেয়েকে মিলিটারীর হাতে তুলে দিল! নিমাই বাবু লাঠি হাতে বেশ কয়বার মাটিতে ঠক ঠক করে আবার উপরে তাকালেন। একপাল হায়েনার সাথে চট করে সখ্যতা গড়ে নেয়ার দারুণ সুযোগ হাতছাড়া করেন নি ঐদিন। পুরো ক্যাম্পে মিলিটারীর সংখ্যা, অবস্থান জেনে নিলেন। ঐ রাতেই একটা ছোট্ট জনা পাঁচেকের গেরিলা হামলা হলো। মিলিটারীরা বুঝে উঠতেই পারলোনা, তাদের অবস্থান, ক্যাম্পের নতুন নকশা, অস্ত্র কিংবা মিলিটারীর সংখ্যা জেনে নিঁখুত আক্রমণ কি করে করল ওরা? গভীর রাতে গুলিবিদ্ধ আহত মিলিটারীর আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়লো অনেক দূর। ক্যাম্প মুক্তিযোদ্ধার দখলে আসল। পরপর ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে ভীত সন্ত্রস্ত গ্রামবাসী যেন প্রাণ ফিরে পেল।

এগারটা মেয়েকে উদ্ধার করা হলো ক্যাম্প থেকে, বিবস্ত্র অবস্থায়। নিমাই বাবুর বুকটা কেঁপে উঠল। ঐ মেয়েটি নেই। গেরিলা আক্রমণের আগেই আবার সুযোগ বুঝে পালিয়েছে। নিমাই বাবু থামলেন, জেনি চুপচাপ। ‘তারপর অনেক খুঁজেছি আম্মা। মাইয়াটারে নিজের হাতেই তুইলা দিছি ওদের হাতে। কি যে কষ্ট হইত। খাইতে পারতাম না, ঘুমাইতে পারতাম না। আমি আর বর্ডার পার হই নাই। ঠিক করেছি, যতদিন মাইয়াটারে খুঁইজা পাব না ততদিন দেশ ছাইড়া যাব না।’ নিমাই বাবু নয় মাসের ঐ একটুকরো বাংলাদেশের চিহ্ন, মেয়েটিকে খুঁজে পেয়েছিলেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর। ১৯৭২ সাল, ফেব্রুয়ারীর শেষের দিকে। প্রেগন্যান্ট আর মানসিক সমস্যাজনিত অবস্থায়। নিমাই বাবু একিইসাথে প্রচণ্ড আনন্দিত আর দুঃখী হলেন। মেয়েটির এই অবস্থার জন্য তিনিও কি দায়ী নন?

প্রায় অপ্রকৃতস্থ আর প্রচণ্ড অসহায় মেয়েটিকে সাথে নিয়ে আসেন তিনি। মার্চের শেষের দিকে একটা বাচ্চা জন্ম দেয় মেয়েটি। বাচ্চার জন্মের আগে নিমাই বাবুর কানে কানে ফিসফিস করে বলেছিল, ‘এই বাচ্চারে খুন করতে পারি নাই আমি। মেয়ে হলে নাম রাখবেন মৃত্তিকা। এই মাটিতে বেয়নেটের খোঁচায় আমার যৌনাঙ্গের ক্ষত, রক্ত লেগে আছে। গর্তে চাপা আছে বাবা আর ভাই। অথচ আমি এই মাটিরেও ঘৃণা করতে পারি নাই কখনো।’ মৃত্তিকার জন্মের পর মেয়েটি হাসপাতাল ছেড়ে পালায়। সেই শেষ দেখা ছিল নিমাই বাবুর সাথে। নিমাই বাবু বাচ্চাটিকে নিজের কাছেও রাখতে পারেন নি। এমন অসংখ্য বাচ্চা ছিল। বীরাঙ্গনা তখনো কিংবা কখনোই বীরাঙ্গনা হয়ে উঠেনি। ছিল ভাগ্য বিড়ম্বিতা, নষ্টা নারী! ওদের ওই সর্বস্ব ত্যাগের নতুন নামকরণ করা হলো, জারজ, যুদ্ধশিশু। মৃত্তিকাকে দত্তক নিল ভীনদেশী একটা পরিবার। নিমাই বাবু থামলেন, তার চোখ ছলছল করছে।
.
জমির সাহেব পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে জেনিকে একটা মাঠ দেখালেন। সবুজ ঘাসের চাদর বিছানো। ধরা গলায় বললেন,
‘যুদ্ধের সময় এইখানে পুঁতে রাখা হইছে অনেকগুলো লাশ। এখনো একটু খুঁড়লে হাড্ডি পাবা। তুমি তোমার আম্মারে এইখানে খুঁজো। ওই যে মাঠের ওপাশে গ্রামটা, মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে ওটা জ্বালায়ে দিছিলো। তুমি তোমার আম্মারে ওইখানে খুঁজো। মাঠের পর মাঠ, গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর তোমার আম্মা মিশে আছে এইখানে ওইখানে; সবখানেই। তোমার আম্মা একটা বাংলাদেশ। জেনি, তুমি বাংলাদেশ খুঁজো, তোমার আম্মারে পাবা।’
জমির সাহেবের গলায় কান্না আটকে জড়িয়ে আসে স্বর। এক পা, দুই পা করে সামনে এগোয় জেনি।

মাঠের মাঝখানে এক হাঁটু মুড়ে বসে সবুজ ঘাসের চাদরের ফাঁকে উঁকি দেয়া মাটি স্পর্শ করে হাতে। চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু গাল গড়িয়ে পড়ে মাটি ছুঁতেই জেনি চমকে উঠে। একটা ঘ্রাণ পাচ্ছে জেনি। ওই পুরনো পরিচিত ঘ্রাণ। ভেজা ভেজা, সোঁদা গন্ধ। মায়ের কোলের গন্ধ। জেনি মাটি ছুঁয়ে শরীর কাঁপিয়ে হু হু করে কাঁদে। জমির সাহেব পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকেন। ছয় দিন পর। শাহীদ টেবিলের ওপাশে বসে আছে। জেনি সামনে তাকিয়ে উদাস স্বরে বলল, ‘অস্ট্রেলিয়ার একজন ডাক্তার, জিওফ্রে ডেভিস। WHO এর পক্ষ থেকে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন যুদ্ধ শেষে। গর্ভপাত করাতে। বীরাঙ্গনার গর্ভপাত। শুনতে কেমন যেন লাগছে না? ছয় মাসে তিনি প্রায় এক লাখ বীরাঙ্গনার গর্ভপাত করান। তারপরেও অসংখ্য প্রেগন্যান্ট মেয়ের গর্ভপাত সম্ভব হয়নি, ত্রিশ সপ্তাহ পার হয়ে গিয়েছিল বলে। এত এত প্রেগন্যান্ট মেয়ে! শাহীদ জানো, এটা কেন?’

শাহীদ বিব্রত চোখে তাকিয়ে থাকে। জেনি ঘৃণ্য স্বরে বলে, ‘তোমার জন্মদাতারা চেয়েছিলেন একটা শুদ্ধ পবিত্র প্রজন্ম বাস করুক বাংলাদেশে। সেটাই হয়েছে। এই নষ্টা নারীদের বাংলাদেশ মেনে নেয়নি। স্বাধীনতা পরবর্তী একটা শুদ্ধ পবিত্র বাংলাদেশ। আহা! নষ্টা মেয়ে ছুঁলেই যে অপবিত্র হবে ওটা। আমি তোমায় জানি শাহীদ। তুমি কেমন। কিন্তু আমি তোমায় একসেপ্ট করব না কখনোই আর।’ শাহীদ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে পাথরের মতোন। ধরা গলায় জিজ্ঞেস করে,  ‘কেন জেনি?’ ‘তুমি সামনে আসলেই আমার মায়ের কথা মনে পড়বে যে। যৌনাঙ্গে বেয়নেটের খোঁচা, ক্ষত। একটা রক্তাক্ত ইতিহাস। আমি মাকে খুঁজে এনেছি শাহীদ। জেনি নয়, এখন থেকে- মৃত্তিকা জেনিফার ক্যাথেরিন। আমার মা নিজেকে স্যাক্রিফাইস করেছিলেন ওই মাটির জন্য, আমি করলাম তোমায়। চাচ্ছি আমাদের আর দেখা না হোক…’

জুনের শেষের দিকে। মৃত্তিকা ঘুম থেকে উঠে ঘুম ঘুম চোখে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আগের সেই চটপটে অস্থির যুবতী মেয়েটি নেই এখন সে আর। শান্ত, পরিপূর্ণ। বয়সও যে একচল্লিশ হয়ে এল। শেষবার বাংলাদেশে গিয়েছেন প্রায় বিশ বৎসর আগে। দেশটার উপর তার বড্ড অভিমান। আজ থেকে নেই। টিভিতে একটা বাংলা চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ দিচ্ছে, ‘বীরাঙ্গনারা পাচ্ছেন সর্বোচ্চ স্বীকৃতি।’

মৃত্তিকা হাসি হাসি মুখে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয় দু’হাতে। গলগল করে সকালের নরম রোদ ঢুকে পড়ে রুমে। জানালার ওপাশেই একটা সবুজ বৃক্ষ। জেনি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। চমৎকার সকাল। সবুজ পাতার ফাঁকে ভোরের লাল সূর্যটা কি সুন্দর করে উঁকি দিচ্ছে আজ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত