হঠাৎ একদিন

হঠাৎ একদিন

বেশ যাচাই বাছাই করে আমার বিয়েটা হয়েছে।ছেলে উচ্চশিক্ষিত,ভালো পদে চাকরী করে,দেখতে শুনতেও নম্র ভদ্র,ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডও ভীষণ ভালো।এরকম পরিবারে একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের বিয়ে হওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার,এমনটা মনে করেই পরিবারের সিদ্ধান্তে আমার এখানে বিয়ে হয়।

আমার লেখাপড়া শেষ করেই বিয়েটা হয়েছে।বিয়ের কয়েকমাস খুব ভালোভাবেই কেটেছে।দুই ননদ, দেবর,ভাসুর,শ্বশুর শাশুড়ি নিয়ে ভালোই সময়গুলো কেটে যাচ্ছিলো।আমি বাড়ির মেজো বউ।ননদ দুইজন সবার ছোট।সবাইকে নিয়ে একসাথেই আমার সংসার।বেশ আদরে রেখেছিলো সবাই। বিয়ের প্রায় ছয়/সাতমাস যাওয়ার পর দুর্ভাগ্যবশত আমার বরের চাকরীটা চলে যায়।কিন্তু পরবর্তীতে খেয়াল করলাম যে,ওর চাকরী করার বা দ্বিতীয়বার চাকরী খোঁজার কোনো ইন্টারেস্ট নেই।

যে পরিবারে একটা মেয়ের স্বামীর চাকরী থাকেনা একমাত্র সেই মেয়েটাই জানে তাকে পরিবারে কতটা গাধার মত খাটতে হয়।তখন পরিবারের সেসকল মানুষের কথা তাকে উঠতে বসতেই শুনতে হয়।আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি।আমাকে নানাভাবে ওদের কথা শুনতে হতে।তবে ওরা ওদের ছেলেকে কিচ্ছু বলতো না।কেবল আমাকেই বলতো।কারণ আমি তো পরের মেয়ে,কথা শোনার এমন ধৈর্য্যশক্তি পরের মেয়েদের থাকতেই হবে।এমনটাই আমাদের সমাজের, পরিবারের, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কথা।

এসবের মধ্যে দিয়ে আমার বাচ্চা কনসিভ হয়ে যায়।এই কথাটা জানার পর তাদের এক একজনের বিভিন্ন রুপ বের হতে থাকে। শত কষ্টের মধ্যে দিয়েও মানিয়ে গুঁছিয়ে চলছিলাম।ওর সাথে সংসার করার আশায় ওর পাশে ছিলাম। বর্তমান সমাজে মানিয়ে গুঁছিয়ে চলা মানে হলো,আমি মুখ,হাত, পা বেঁধে রেখেছি।আসো, তোমরা আমাকে মেরে যাও। মানিয়ে গুঁছিয়ে ব্যাপারটা না এভাবে হয় না।অপর প্রান্তের মানুষগুলোকে বুঝতে হবে যে,এই চুপ থাকা মানে তারা অনবরত টর্চার করা না।এই চুপ থাকা মানে হলো ব্যাপারটার সমাপ্তি ঘটা।একটা সমাধান বের হওয়া।সুস্থ মস্তিষ্কের সমাধান।একটা সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখার সমাধান।

কিন্তু একটা পর্যায় আর সেই সমাধানটা বের হয়ে উঠে না।জানেনতো,বিয়ের পর মেয়েদের একান্ত ব্যক্তিগত আপন মানুষটা হচ্ছে তার স্বামী।সেই স্বামী যদি পাশে না থাকে তাহলে মেয়েটা কিভাবে অনুপ্রেরণা পাবে, বলতে পারেন ? ওরা নিয়মিত টর্চার করতো আমার উপর।কারণ ছিলো বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে স্বামীর ব্যবসায়ের জন্য ওর হাতে তুলে দেওয়া।সবাইতো বলতোই, সাথে আমার স্বামীও ওদের সাথে তাল মেলাতে শুরু করলো।

প্রতিটি মানুষই জানে তার নিজের পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ড কি রকম। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা সাধারণ মেয়ে। চার ভাই বোনের মধ্যে সবার বড়।অনেক কষ্টে সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে বাবা আমাকে বিয়ে দিয়েছেন।আমি তো জানি, আমার বাবার কি আছে?এই মুহূর্তে আমি কিভাবে বাবার কাছে টাকার জন্য যাই ! মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হওয়াটা আসলেই এক একটা অস্তিত্বের জন্য আশীর্বাদ নয় বরং অভিশাপ।না পারছি বলতে আর না পারছি সইতে !

পরবর্তীতে ওকে বলি, আমি যেহেতু নিজেই উচ্চশিক্ষিত সেহেতু বাবার কাছে যাওয়ার কি দরকার ? আমরা দু’জনে চাকরী করবো।এতে করে আমিও নিজের পরিবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো এবং ওর হাতে টাকা তুলে দিতে পারবো।কিন্তু তার কথা হলো,সে একত্রে নগদ টাকা চায় যেটা দিয়ে ব্যবসায় করবে।যেহেতু আমি টাকাটা এনে দিতে পারছি না সেহেতু আমার এখানে থাকা চলবে না।আমার বেরিয়ে যেতে হবে ওদের বাড়ি থেকে।

হ্যাঁ,বেরিয়ে এসেছিলাম। আইনের সাহায্য নেওয়ার ইচ্ছায় গিয়েছিলাম থানায় কিন্তু সেখানেও টাকার দরকার।আসলে টাকা ছাড়া না বর্তমানে কোনো সমস্যার সমাধানই হয় না।টাকা আছে মানেই সব আছে টাকা নাই তো, নিজের রাস্তা মাপো। কোনো কিছুই হলো না।বাবার বাড়িতেই চলে আসলাম।অনেকটা মাস পেরিয়ে গেলো। আমার একটা ছেলে হলো।ছেলে হওয়ার পরপরই ওর দেওয়া ডিভোর্স লেটারটা হাতে পেলাম।প্রতিবাদ করিনি।নিঃশব্দে একটা কাগজের টুকরো আলাদা করে দিলো একটা সম্পর্ককে।যদিও সেটা কাগজে কলমে হওয়ার আগেই দৃশ্যমান হয়েছে।

ছোটোখাটো একটা চাকরী করে ছেলেকে পুরোদমে মানুষ করার কাজে লেগে পড়লাম। আমার ছেলে আজ মাস্টার্স পরীক্ষা দিবে।অনেক বড় হয়ে গেছে।ছেলের পরীক্ষার হলের পাশে আমার চাকরীর স্থান।সেই সূত্রে মা ছেলে একসাথে যাচ্ছিলাম।পথে রাফি’কে দেখলাম।আমার স্বামীর নাম রাফি।ওকে দেখে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলাম।কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে।

–কেমন আছো ? বেশ আকৃষ্ট হয়ে জিজ্ঞেস করলাম রাফি’কে ।
–মেয়েকে নিয়ে এসেছি পাশের থানায়।হ্যাঁ,ভালোই আছি।
–মেয়ে ! বিয়ে করেছো ?অবাক হয়ে প্রশ্নটা করলাম।
–হ্যাঁ।
–ওহ্, তা থানায় কেন ? বেশ কৌতুহল হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম।
–মেয়েকে ওর বর মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে,তাই।
–যৌতুকের জন্য ?
–সেইসব দিনগুলোর জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিও।

আমার প্রশ্নে ওর উঁচু মাথা নিচু হয়ে, হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো। আমি ঝরঝর করে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছি দাঁড়িয়ে।আর ও সেই নিচু মাথাটা নিচু করেই এগিয়ে যাচ্ছে থানার দিকে। সময়ের পুনরাবৃত্তি ঠিকই হয়।কেবল চরিত্রগুলো পাল্টে যায়।মানুষ বুঝতে শিখে,কিন্তু তখন অনেকটা দেরি হয়ে যায়। সম্পর্কগুলো শেষ হয়ে গেলেও সম্পর্কের যে টানটা থাকে সেটা এক মুহূর্তের জন্যও কমে না।বরং সময় অনুপাতে বাড়ে, দ্বিগুণ, তিনগুণ, হাজারগুণ বেড়ে যায়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত