মা-বাবা, আর ছোট বোন রোদেলা সহ আমার বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে এসেছি। পাত্রী মাশাল্লা সবার-ই পছন্দ হয়েছে। বিশেষ করে ছোট বোনটার। ওর একটাই কথা আমার বান্ধবী চাই। আমার বউকে নাকি সে বান্ধবী বানাবে। কখনো ভাবি বলবেনা, বান্ধবী বলে ডাকবে। অদ্ভুত বিষয়, পাগলি একটা মেয়ে। যখন আমাদের সবার সামনে জান্নাতকে (পাত্রীর নাম) আনা হলো রোদেলা উচ্চস্বরে বলে উঠলো, আমার ভাবি পছন্দমত হয়েছে একেই আমি বান্ধবী বানাবো। রোদেলার কথা শুনে সবাই প্রায় লজ্জায় চুপসে গেলো। আম্মা মুচকি হেসে বললেন….
–ও বাচ্চা মানুষ ওর কথায় কিছু মনে করবেননা। অমনি রোদেলা ভেংচি কেঁটে বলল….
-কে বলছে আমি বাত্তা হু? এই দেখো আমার কত্তগুলো দাঁত। আমি বাত্তা না, আমি বড় হয়ে গেছি। তাইতো আমার এখন বড় বান্ধবী লাগবে। হি হি হি….
রোদেলার কথা শুনে সবাই হেসে দিলো। শুধু জান্নাত ছাড়া। আমার অবচেতন মন জান্নাতের দিকে লক্ষ্য করছে। খেয়াল করে দেখলাম জান্নাত মাথা নিচু করে মুচকি মুচকি হাসছে। শব্দহীন যেই হাসি। তবে সেই হাসিতে যে কেউ খুন হতে প্রস্তুত। আব্বা-আম্মা প্রথম দেখাতেই জান্নাতের প্রশংসা শুরু করলেন। আম্মাতো পারলে মনে হয় এখন-ই বউ করে নিয়ে যায়। রোদেলা দৌঁড়ে গিয়ে জান্নাতের হাত ধরে বলল….
–চলো বান্ধবী আমরা রুমে গিয়ে গল্প করবো। তারপর টেনে নিয়ে গেলো। রোদেলার এমন কাণ্ড দেখে সবাই মোটামুটি অবাক। আমারো অনেক অবাক লাগছে। আম্মা আবারো বললেন….
–মেয়েটা বড্ড মিশুক, এমনি কিছু মনে করবেন না।
-আরে না ঠিক আছে। (জান্নাতের বাবা) কিছুক্ষণ পর জান্নাতের বাবা বললেন….
–আমাদেরতো আলহামদুলিল্লাহ ছেলেমেয়ে পছন্দ। এখন ওদের সম্মতি আছে কিনা? তা বাবাজি তোমার কি কোন আপত্তি আছে?
-না মা..মা..মানে আসলে…..
–আচ্ছা আমার মনে হয় ওরা একে অপরের সাথে একটু কথা বলুক কি বলেন বেয়াই সাহেব?
–হুম তা অবশ্য ঠিক।
-আচ্ছা বাবা তুমি ঐ রুমে যাও, কথা বলো।
তারপর এক প্রকার জোর করেই আমাকে জান্নাতের রুমে দিকে পাঠানো হয়। খেয়াল করে দেখলাম বুকটা কাঁপছে। মনে হচ্ছে কেউ হাতুরি পিটাচ্ছে। অদ্ভুত! এর আগেতো কখনো এমন হয়নি। নাকি পাত্রী দেখতে আসলে সবার-ই এমন হয়? হয়তো আমি জান্নাতের দরজার কাছে গিয়ে গলা খাকড়ি দিলাম। রোদেলা টের পেয়ে বলল….
–ভাইয়া আসো।
-তোকে মা ডাকছে, যা।
–এহহহ মিথ্যে কথা বলছো কেন হু? তুমি ভাবির সাথে কথা বলবা আমি বুঝি জানিনা?
রোদেলা পাক্নামি কথাবার্তা শুনে নিজের কাছেই লজ্জা লাগলো। না জানি মেয়েটা (জান্নাত) কি ভাবছে আল্লাই জানে। আমি আবারো বললাম….
–তুই আসবি নাকি মাইর খাবি।
আমার বলা শেষ হতেই রোদেলা রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো। ভেংচি কেটে ‘বিলাই বিলাই’ বলে দৌঁড়ে চলে গেলো। আমি আস্তে আস্তে টিপটিপ পায়ে জান্নাতের রুমে প্রবেশ করলাম। আমাকে দেখে জান্নাত মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা দিলো। মাথাটা নিচু করে ফেলল। আমার কপাল ঘামছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কথা বলতে যাব কেমন জানি গলাটা আটকে আসছে। মিনমিনিয়ে বললাম….
–এক গ্লাস পানি দিবেন?
জান্নাত ওর টেবিলের উপর থাকা জগ থেকে এক গ্লাস পানি দিলো। আমি ডকডক করে পানি খেয়ে গ্লাসটা জান্নাতকে দিতেই জান্নাত টপ করে আরেক গ্লাস পানি আমার হাতে দিলো। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম….
–আরেক গ্লাস কেন?
-না মা মা মানে…সরি।
তারপর জগ গ্লাস সুন্দর করে এক পাশে রেখে দিলো। এই মেয়ে যে নার্ভাস সেটা ওর কর্মকাণ্ড দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কেমন জানি তাড়াহুড়ো করছে একটু। ভিতরে ভিতরে ভয় পাচ্ছে অনেকটা। আমি কি বলব বুঝতে পারলাম না। কোন কথা না পেয়ে বললাম….
–রোদেলা খুব দুষ্টু তাইনা? ওর কথা বা কাজে কিছু মনে করবেন না।
-না না কিছু মনে করিনি। রোদেলাকে প্রথম দেখায় আমারো অনেক পছন্দ হয়েছে। কিউট একটা মেয়ে সবসময় হাসে।
–হুম থ্যাংকসস।
-সেটা কেনো?
–রোদেলার প্রশংসা করলেন খুব তাই।
-বোনকে খুব ভালোবাসেন তাইনা?
–হুম নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি।
-ইশশশ অন্যদের বুঝি হিংসে হয়না।
–আপনার হয়?
-নাহ, তবে আফসোস হয়। কেউ যদি এভাবে একটু অন্য ভাবে আমায় ভালোবাসতো।
–সেটা কিভাবে?
-তার জীবনসঙ্গিনী করে।
–কারো পক্ষে কি সম্ভব এভাবে ভালোবাসা?
-উহু জানিনা আমি। তবে আমি চাই কেউ আমাকে এভাবে ভাললবাসুক।
–তাতে লাভ?
-আপনি সুদকষা অংক বুঝি খুব ভালো পারতেন?
–মানে? বুঝলাম না।
-সববিষয়ে লাভ ক্ষতি হিসেব করেন কেন?
জান্নাতের কথা শুনে লজ্জা পেলাম। মাথা চুলকিয়ে মুচকি হেসে মাথা নিচু করে ফেললাম। আমতা আমতা করে বললাম….
-না মানে আসলে তা না। তবে কথার পৃষ্ঠে কথার বলার অভ্যেস আছে আমার, সরি….
–উহু সরি বলতে হবেনা।
-আচ্ছা বলবনা। দুজনেই চুপচাপ। কেউ কোন কথা বলছিনা। জান্নাত হাত নড়াচড়া করছে। জান্নাত বলল….
–একটা কথা বলব?
-হু বলুন।
–না মানে রোদেলা খুব মিষ্টি।
-তাই বুঝি? খুব পছন্দ হয়েছে?
–হু প্রচুর, কত সুন্দর করে কথা বলে মেয়েটা। আচ্ছা ওর নামটা কি আপনিই রেখেছেন?
-হুম আমিই রেখেছি।
–আমার একটা কথা রাখবেন?
-কি কথা?
–আমি না রোদেলাকে রোদ বলে ডাকব। রাগ করবেন কি তাতে?
-কতদিন ডাকবেন?
–যতদিন বাঁচব।
-তার জন্য তো একটা সম্পর্ক দরকার। জান্নাত আর কিছু বললনা। হুট করে লজ্জা পেলো। জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল….
–ঐ আরকি, আমি জানিনা। আমার রোদ বলে ডাকতে ইচ্ছে করে।
-আর কি?
–উহু, রোদ-ই বেস্ট।
এরপর একটু কথাবার্তা। দুজন দুজনকে একটু জানা। কথার কথায় জানতে পারলাম জান্নাতে কাঁশফুল আর কদম খুব পছন্দের। প্রিয় উপন্যাস ‘শেষের কবিতা।’ ঘুরতে নাকি প্রচণ্ড ভালোবাসে। আমি আর কিছু বললাম না। বাকিটুকু নাহয় বিয়ের পরই যেনে নিব। একটু বিনিময় করে রুম থেকে বেড়িয়ে আসলাম। তারপর মা-বাবাকে আমার মতামত জানালাম। জান্নাতদের বাসা থেকে বের হওয়ার আগে জান্নাত রোদেলাকে ডাক দিয়ে ওর রুমে নিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর রোদেলা জান্নাতের রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো।
বাসায় এসে বিছানায় শুয়ে আছি। রোদেলা নাঁচতে নাঁচতে রুমে চলো আসলো। ‘বিলাই তোর চিঠি নে, বান্ধবী দিছে’ বলেই চিঠি হাতে দিয়ে রোদেলা আবার দৌঁড়ে চলে গেলো। আমি অবাক হয়ে হাতে থাকা চিঠির দিকে তাকিয়ে রইলাম। চিঠি খুলে পড়া শুরু করলাম। চিঠিতে সুন্দর করে লেখা….
“উহু, শুনুন…আপনার চোখ গুলো খুব সুন্দর। আমার ভালো লাগছে খুব। এরপর থেকে চোখ গুলো ঢেকে রাখবেন। নাহয় সবসময় চোখে কালো সানগ্লাস পরবেন। আমি ছাড়া অন্য কোই যেন ঐ চোখ না দেখে বুঝলেন। আর হ্যাঁ, আমি আর বান্ধবী আপনাকে অনেক জ্বালাবো একদম রাগ করবেন না। মাঝেমাঝে সকালে ইচ্ছে করেই গায়ে পানি ঢেলে দিব হিহি। আরেকটা কথা শুনুননা…না মানে ইয়ে আমাকে ‘বউমনি’ বলে ডাকবেন প্লিজ প্লিজ। আর সবটুকু নায়হ পরে চেয়ে নিব।”
ইতি
আপনার বউমনি।