শাহনাজ ও ক্যাপ্টেন ডাবলু

শাহনাজ ও ক্যাপ্টেন ডাবলু

পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে শাহনাজ হেঁটে হেঁটে স্কুলের এক কোনায় লাইব্রেরি বিল্ডিঙের সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে বসল। তার পরীক্ষা শেষ, এখন তার মনে খুব আনন্দ হওয়ার কথা। এতদিন যে হাজার হাজার ফরমুলা মুখস্থ করে রেখেছিল এখন সে ইচ্ছে করলে সেগুলো ভুলে যেতে পারে। বড় বড় রচনা, নোট করে রাখা ব্যাখ্যা, গাদা গাদা উপপাদ্য, প্রশ্নের উত্তরের শত শত পৃষ্ঠা মাথার মাঝে জমা করে রেখেছিল; যেগুলো সে পরীক্ষার হলে একটার পর একটা উগলে দিয়ে এসেছে–এখন সে তার সবগুলো মস্তিষ্ক থেকে উধাও করে দেবে, কোনোকিছুই আর মনে রাখতে হবে না–এই ব্যাপারটা চিন্তা করেই আনন্দে তার বুক ফেটে যাবার কথা। শাহনাজ অবশ্য অবাক হয়ে আবিষ্কার করল তার ভিতরে আনন্দ–দুঃখ কিছুই হচ্ছে না, ভিতরটা কীরকম যেন ম্যাদা মেরে আছে! পরীক্ষা শেষ হবার পর যেসব কাজ করবে বলে এতদিন থেকে ঠিক করে রেখেছিল, যে গল্পের বইগুলো পড়বে বলে। জমা করে রেখেছিল তার কোনোটার কথা মনে পড়েই কোনোরকম আনন্দ হচ্ছে না। এ রকম যে হতে পারে সেটা সে একবারও চিন্তা করে নি, কী মন–খারাপ–করা একটা ব্যাপার!

শাহনাজ একটা বিশাল লম্বা নিশ্বাস ফেলে সামনে তাকাল, তখন দেখতে পেল মীনা আর ঝিনু এদিকে আসছে। মীনা তাদের ক্লাসের শান্তশিষ্ট এবং হাবাগোবা টাইপের মেয়ে, তাই সবাই তাকে ডাকে মিনমিনে মীনা। ঝিনু একেবারে পুরোপরি মীনার উল্টো, সোজা। ভাষায় বলা যায় ডাকাত টাইপের মেয়ে। যদি কোনোভাবে সে কলেজ শেষ করে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত যেতে পারে তা হলে যে সেখানে সন্ত্রাসী আর চাদাবাজি শুরু করে দেবে সে ব্যাপারে কারো মনে কোনো সন্দেহ নেই। তাকে সবাই আড়ালে ঝিনু–মস্তান বলে ডাকে এবং ঝিনু মনে হয় ব্যাপারটা বেশ পছন্দই করে। মীনা এবং ঝিনুর একসাথে থাকার কথা নয় এবং দুজনে কাছে এলে বুঝতে পারল ঝিনু মীনাকে ধরে এনেছে। কাঁচপোকা যেভাবে তেলাপোকা ধরে আনে অনেকটা সেরকম ব্যাপার। শাহনাজ দেখল মীনার নাকের মাঝে বিন্দু বিন্দু ঘাম, মুখ রক্তহীন, আতঙ্কিত এবং ফ্যাকাসে।

মিনু হেঁটে হেঁটে একেবারে শাহনাজের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ওঠ।

শাহনাজ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কেন?

কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিটা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলব।

শাহনাজ চোখ কপালে তুলে বলল, কী করবি?

ঢেলা মেরে কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিটা গুঁড়ো গুঁড়া করে ফেলব, তারপর আগুন ধরিয়ে দেব।

শাহনাজ সরু চোখে ঝিনুর দিকে তাকিয়ে রইল। সত্যি কথা বলতে কী, তার কথা শুনে সে খুব বেশি অবাক হল না। যে স্যার তাদের কেমিস্ট্রি পড়ান তার নাম মোবারক আলী। মোবারক স্যার ক্লাসে কিছু পড়ান না, শুধু গালিগালাজ করেন, সবাইকে একরকম বাধ্য করেন তার কাছে প্রাইভেট পড়তে। কেমিষ্ট্রি ক্লাসে এবং এই ল্যাবরেটরিতে তাদের যত যন্ত্রণা সহ্য। করতে হয় তার লিস্টি লিখলে সেটা ডিকশনারির মতো মোটা একটা বই হয়ে যাবে। যদি স্কুলে। একটা গণভোট নেওয়া হয় তা হলে সব মেয়ে একবাক্যে সায় দেবে যে কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিটা ঢেলা মেরে গুঁড়ো গুড়ো করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হোক, যদি সম্ভব হয় তা হলে মোবারক আলী স্যারকে ল্যাবরেটরির ভিতরে রেখে। সব মেয়েরা তাকে আড়ালে মোরব্বা স্যার বলে ডাকে, তিনি দেখতে খানিকটা মোরবার মতো সেটি একটি কারণ এবং মেয়েরা মোরার মতো তাকে কেচে ফেলতে চায় সেটি দ্বিতীয় এবং প্রধান কারণ! এই স্যারকে কেউ দেখতে পারে না বলে কেমিস্ট্রি বিষয়টাকেও কেউ দেখতে পারে না। কে জানে কেমিস্ট্রি বিষয়টা হয়তো আসলে ভালোই। মোবারক স্যার আর কেমিস্ট্রি বিষয়টুকু কেউ দেখতে পারে না বলে পুরো ঝালটুকু কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরির উপরে মেটানো তো কাজের কথা নয়। রাগ তো থাকতেই পারে কিন্তু রাগ থাকলেই তো সেই রাগ আর এভাবে মেটানো যায় না।

ঝিনু এগিয়ে এসে শাহনাজের কাঁধ খামচে ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করে বলল, নে, ওঠ!

শাহনাজ নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, তোর মাথা খারাপ হয়েছে?

কী বললি? ঝিনু–গুণ্ডী ঠিক গুণ্ডার মতো চেহারা করে বলল, আমার মাথা খারাপ হয়েছে?

হ্যাঁ। তা না হলে কেউ এ রকম করে কথা বলে? জানিস, যদি ধরা পড়িস তা হলে দশ বছরের জন্য তোকে বহিষ্কার করে দেবে?

ধরা পড়ার কথাটি ঝিনুর মাথায় আসে নি, সে চোখ ছোট ছোট করে বলল, ধরা পড়ব কেন? তুই বলে দিবি নাকি??

শাহনাজ কী বলবে বুঝতে পারল না, ঝিনু আরো এক পা এগিয়ে এসে ঘুসি পাকিয়ে বলল, বলে দেখ, তোর অবস্থা কী করি! এক ঘুসিতে যদি তোর নাকটা আমি ভিতরে ঢুকিয়ে না দিই!

মিনমিনে মীনা আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঝিনু এক ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আর ধরা পড়লেই কী? আর আমাদের স্কুলে আসতে হবে না। শুধু কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরি কেন, পুরো স্কুলটাই জ্বালিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।

মিনমিনে মীনা শেষ পর্যন্ত সাহস করে বলল, পরীক্ষার রেজাল্ট আর টেষ্টিমনিয়াল নিতে আসতে হবে না?

শাহনাজ বলল, আর যদি ফেল করিস?

ঝিনু–গুণ্ডী এত যুক্তিতর্ক পছন্দ করছিল না, মীনাকে ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলল, আয় যাই। আগে কয়টা ঢেলা নিয়ে আয়।

শাহনাজ বিপদের ঝুঁকি নিয়ে বলল, যাস নে মীনা। কেউ দেখে ফেললে নালিশ করে দেবে, তখন একেবারে বারোটা বেজে যাবে। সোজা জেলখানায় চলে যাবি।

জেলখানার তয়েই কি না কে জানে, মীনা শেষ পর্যন্ত সাহস করে ঝিনুর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসে বলল, আমি যাব না।

ঝিনু চোখ লাল করে দাঁত কিড়মিড় করে নাক দিয়ে স্টিম ইঞ্জিনের মতো ফোঁসফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে হুঙ্কার দিয়ে বলল, কী বললি, যাবি না?

মীনা ভয়ের চোটে প্রায় কেঁদে ফেলে বলল, না।

ঝিনু মীনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল, শাহনাজ আর সহ্য করতে পারল না, গলা উচিয়ে বলল, ঝিনু তুই গুণ্ডামি করতে চাস একা একা কর গিয়ে, মীনাকে কেন টানছিস?

কী বললি? ঝিনু কেঁদো বাঘের মতো মুখ করে বলল, কী বললি তুই? আমি গুণ্ডা?

না। আমি তা বলি নাই। আমি বলেছি–

শাহনাজ কী বলেছে সেটা ব্যাখ্যা করার আগেই ঝিনু তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নাকের ওপর একটা ঘুসি মেরে বসল। শাহনাজ একেবারেই প্রস্তুত ছিল না, আচমকা ঘুসি খেয়ে সে চোখে অন্ধকার দেখল। দুই হাতে নাক চেপে ধরে সে পিছন দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ঝিনু এগিয়ে এসে চুল ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলল, আমার সাথে রংবাজি করিস? এমন পেজকি লাগিয়ে দেব যে পেটের ভাত চাউল হয়ে যাবে। তারপর একটা খারাপ গালি দিয়ে দুই নম্বর ঘূসিটা বসানোর চেষ্টা করল। শাহনাজ এইবার প্রস্তুত ছিল বলে সময়মতো সরে যাওয়াতে ঘুসিটা ঠিক জায়গায় লাগাতে পারল না। মিনমিনে মীনা অবশ্য ততক্ষণে তার খনখনে গলায় এত জোরে চেঁচাতে শুরু করেছে যে তাদের ঘিরে অন্য মেয়েদের ভিড় জমে গেল। সবাই মিলে ঝিনুকে টেনে সরিয়ে নিতে চেষ্টা করেও কোনো সুবিধে করতে পারল, ঝিনু হুঙ্কার দিয়ে বলল, আমার সঙ্গে মস্তানি? পরের বার একেবারে চাকু মেরে দেব!

ঠিক এ রকম সময় কেমিস্ট্রির স্যার মোবারক আলী লম্বা পা ফেলে হাজির হলেন এবং ভিড়টা হালকা হয়ে গেল। ঝিনু অদৃশ্য হল সবার আগে, শাহনাজ তার নাক চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইল এবং মোবারক আলী ওরফে মোরব্বা স্যার তাকেই প্রধান আসামি বিবেচনা করে বিচারকার্য শুরু করে দিলেন। স্যারের বিচার খুব সহজ, হুঙ্কার দিয়ে বললেন, তোর এতবড় সাহস? মেয়েলোক হয়ে স্কুলের ভিতর মারামারি করিস?

প্রথমত মেয়েদের মেয়েলোক বলা এক ধরনের অপমানসূচক কথা, দ্বিতীয়ত শাহনাজ মোটেও মারামারি করে নি, তৃতীয়ত মারামারি করা যদি খারাপ হয় তা হলে সেটা স্কুলের ভিতরে যতটুকু খারাপ, বাইরেও ঠিক ততটুকু খারাপ। এই মুহূর্তে অবশ্য সেটা নিয়ে আলাপ–আলোচনার কোনো সুযোগ নেই, কারণ মোবারক স্যার বিচার শেষ করে সরাসরি শাস্তি–পর্যায়ে চলে গেলেন। নাক ফুলিয়ে চোখ লাল করে দাঁত বের করে হিংস্র গলায় বলতে লাগলেন, তবে রে বদমাইশ মেয়ে, তোর মতো পাজি হতচ্ছাড়া বেজন্মা মেয়ের জন্য দেশের এই অবস্থা। মেয়েলোক হয়ে যদি স্কুলের কম্পাউন্ডে স্যারদের সামনে মারামারি করিস তা হলে বাইরে কী করবি? রাস্তাঘাটে ছিনতাই করবি? মদ গাঞ্জা ফেনসিডিল খেয়ে মানুষের মুখে এসিড মারবি? বাসের ভিতরে পেট্রোলবোমা মারবি? …ভাদর ভ্যাদর ভ্যাদর ভ্যাদর ভ্যাদর ভ্যাদর…

শাহনাজ নাক চেপে ধরে বড় বড় চোখ করে মোবারক ওরফে মোরব্বা স্যারের দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনতে লাগল। ভ্যাগ্যিস স্যারের গালিগালাজ একটু পরে আর শোনা যায় না, পুরোটাকে একটা টানা লম্বা ভ্যাদর–ভ্যাদর জাতীয় প্রলাপ বলে মনে হতে থাকে!

.

শাহনাজ যখন বাসায় ফিরে এল ততক্ষণে খবর ছড়িয়ে গেছে। আম্মা তার দিকে তাকিয়ে সরু চোখে বললেন, স্কুলে নাকি মারামারি করেছিস?

আমি করি নাই।

আম্মা শাহনাজের লাল হয়ে ফুলে ওঠা নাকটার দিকে তাকিয়ে বললেন, তা হলে?

শাহনাজ শীতল গলায় বলল, তা হলে কী?

তোর এইরম চেহারা কেন?

শাহনাজ নাকের ওপর হাত বুলিয়ে বলল, ঝিনু–গুণ্ডী আমাকে ঘুসি মেরেছে।

আম্মা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে শাহনাজের দিকে তাকিয়ে রইলেন। শাহনাজ যদি বলত ঝিনু তাকে খামচি মেরেছে কিংবা চুল টেনেছে, চিমটি দিয়েছে তা হলে আম্মা বিশ্বাস করতেন, একটা মেয়ে যে অন্য একটা মেয়েকে ঘুসি মারতে পারে সেটা আম্মারা এখনো বিশ্বাস করতে পারেন না। আজকালকার মেয়েরা যে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে পকেটমার পর্যন্ত সবকিছু হতে পারে সেটা দেখেও মনে হয় তাদের বিশ্বাস হয় না। আম্মা কাঁপা গলায় বললেন, ঘুসি মেরেছে?

হ্যাঁ।

এত মানুষ থাকতে তোকে কেন ঘুসি মারল?

কারণ আমি মিনমিনে মীনাকে যেতে দেই নাই।

কোথায় যেতে দিস নাই?

শাহনাজ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি এটা বুঝবে না আম্মা। যদি বোঝানোর চেষ্টা করি তুমি বিশ্বাস করবে না।

আম্মা নিশ্বাস আটকে রেখে বললেন, কেন বিশ্বাস করব না?

পুরো ব্যাপারটা বুঝতে হলে তোমার পুরো ইতিহাস জানতে হবে। শুরু করতে হবে। আজ থেকে তিন বছর আগের ঘটনা দিয়ে।

আম্মা এবারে রেগে উঠলেন, চিৎকার করে বললেন, স্কুলে মারামারি করে এসে আবার বড় বড় কথা? স্কুলে পাঠানোই ভুল হয়েছে। রান্না, সেলাই আর বাসন ধোয়ানো শিখিয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। শাশুড়ির খন্তার বাড়ি খেয়ে এতদিন সোজা হয়ে যেত।

শাহনাজ পাথরের মতো মুখ করে বলল, এসব দিন ফিনিস। শাশুড়ি খন্তা দিয়ে বাড়ি দিলে তার হাত মুচড়ে সকেট থেকে আলাদা করে নেব।

আম্মা হায় হায় করে মাথায় থাবা দিয়ে বললেন, ও মা গো! কী বেহায়া মেয়ে পেটে ধরেছি গো। কী বলে এই সব!

.

সন্ধেবেলা শাহনাজের বড়ভাই ইমতিয়াজ এসে পুরো ব্যাপারটা আবার গোড়া থেকে শুরু করল। ইমতিয়াজ ইউনিভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে, এবং তার ধারণা সে খুব উঁচু ধরনের মানুষ। ঘর থেকে বের হবার আগে আধাঘণ্টা সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলকে ঠিকভাবে উষ্কখুষ্ক করে নেয়। শাহনাজের সাথে এমনিতে সে বেশি কথা বলে না, যখন তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে হয় কিংবা টিটকারি করতে হয় শুধু তখন সে কথাবার্তা বলে। আজকে শাহনাজকে দেখে সে জোর করে মুখে এক ধরনের ফিচলে ধরনের হাসি ফুটিয়ে বলল, তোর নাকটা দেখেছিস? এমনিতেই নিয়েন্ডারথল মানুষের মতো ছিল, এখন মনে হচ্ছে উপর দিয়ে একটা দোতলা বাস চলে গিয়েছে। হা হা হা।

এই হচ্ছে ইমতিয়াজ। পৃথিবীতে নাক চ্যাপ্টা মানুষ অনেক আছে কিন্তু সে উদাহরণ দেবার সময় এমন একটা শব্দ উচ্চারণ করল যেটা উচ্চারণ করতেই দাঁত ভেঙে যায়। আর। শাহনাজের নাক মোটেও চ্যাপ্টা নয়। তা ছাড়া নাক চাপা হলেই মানুষ মোটেও অসুন্দর হয় না। তাদের ক্লাসে একজন চাকমা মেয়ে পড়ে, নাকটা একটু চাপা কিন্তু দেখতে এত সুন্দর। যে শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। শাহনাজ দাঁতে দাঁত চেপে ইমতিয়াজের টিটকারিটা সহ্য করে বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। চোখের দৃষ্টি দিয়ে কাউকে ভস্ম করা হলে এতক্ষণে ইমতিয়াজ ভুনা কাবাব হয়ে যেত।

ইমতিয়াজ চোখেমুখে একটা উদাস উদাস ভাব ফুটিয়ে মুখের এক কোনায় ঠোঁট দুটোকে একটু উপরে তুলে বিচিত্র একটা হাসি হেসে বলল, তুই নাকি আজকাল রাস্তাঘাটে মারপিট করিস?।

শাহনাজ কোনো কথা বলল না। ইমতিয়াজ গলার স্বরে খুব একটা আন্তরিক ভাব। ফুটিয়ে বলল, চাদাবাজিও শুরু করে দিয়েছিস নাকি?

শাহনাজ নিশ্বাস আটকে রাখল, তখনো কোনো কথা বলল না। ইমতিয়াজ তখন উপদেশ দেবার ভঙ্গি করে বলল, যখন তুই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবি তখন তোর কোনো চিন্তা থাকবে না! হলে ফ্রি খাবিদাবি। কন্ট্রাক্টরদের কাছ থেকে চাঁদা নিবি। বেআইনি অস্ত্র নিয়ে ছেলেপিলেদের ধামকি–ধুমকি দিবি। আর একবার যদি জেলের ভাত খেতে পারিস দেখবি ধাঁধা করে উঠে যাবি। মহিলা সন্ত্রাসী! শহরের যত গডফাদার তোকে ডাবল টাকা দিয়ে ভাড়া করে নিয়ে যাবে!

শাহনাজের ইচ্ছে করল ইমতিয়াজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আঁচড়ে কামড়ে একটা কাণ্ড করে দেয়, কিন্তু সে কিছুই করল না। আস্তে আস্তে বলল, সবাই তো আর আমার মতো হলে চলবে না, আমাদেরও তো ঠ্যাঙ্গানি দেওয়ার জন্য তোমার মতো লুতুপুতু এক–দুইটা মানুষ দরকার।

ইমতিয়াজ চোখ বাঁকিয়ে বলল, কী বললি? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা!

শাহনাজ না–শোনার ভান করে বলল, যত হম্বিতম্বি আমার ওপরে! বিলকিস আপু যখন শাহবাগের মোড়ে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখে–

ইমতিয়াজ আরেকটু হলে শাহনাজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত, কোনোমতে সে দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। শুনতে পেল বাইরে থেকে ইমতিয়াজ চিৎকার করে বলল, বেয়াদপ পাজি মেয়ে, কান টেনে ছিঁড়ে ফেলব।

শাহনাজ ঘরে বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইমতিয়াজ আর বিলকিস এক ক্লাসে পড়ে, দুজনে খুব ভাব, কিন্তু ইমতিয়াজ মনে হয় বিলকিসকে একটু ভয়ই পায়। ইমতিয়াজকে শায়েস্তা করার এই একটা উপায়, বিলকিসকে নিয়ে একটা খোটা দেওয়া। কিন্তু একবার খোটা দিলে তার ঝাল সহ্য করতে হয় অনেকদিন।

আব্বা এলেন সন্ধেবেলা এবং তখন শাহনাজের সারা দিনের রাগ শেষ পর্যন্ত ধুয়েমুছে গেল। আম্মা এবং ইমতিয়াজের মুখে ঘটনার বর্ণনা শুনিয়েও আবাকে ঘাবড়ে দেওয়া গেল না। অট্টহাসি দিয়ে বললেন, শাহনাজ মা, তুই নাকি গুণ্ডী হয়ে যাচ্ছিস?

শাহনাজ মুখ গম্ভীর রেখে বলল, আব্বা এইটা ঠাট্টার ব্যাপার না।

কোনটা ঠাট্টার ব্যাপার না?

এই যে আমার নাকে ঘুসি মেরেছে।

কে বলেছে এইটা ঠাট্টার ব্যাপার? আমি কি বলেছি?

তা হলে হাসছ কেন?

হাসছি? আমি? আমি মোটেই হাসছি না– এই বলে আবা আবার হা হা করে হাসতে লাগলেন।

শাহনাজ খুব রাগ হওয়ার চেষ্টা করেও মোটেও রাগতে পারল না। তবুও খুব চেষ্টা করে চোখেমুখে রাগের একটা চিহ্ন ফুটিয়ে বলল, আব্বা, কাউকে মারলে তার ব্যথা লাগে, তখন সেটা নিয়ে হাসতে হয় না।

আব্বা সাথে সাথে মুখ গম্ভীর করে শাহনাজের গালে হাত বুলিয়ে ছোট বাচ্চাদের যেভাবে আদর করে সেভাবে আদর করে দিলেন। শাহনাজ কোনোভাবে আবার হাত থেকে ছুটে বের হয়ে এল। ভাগ্যিস আশপাশে কেউ নেই। যদি তার বান্ধবীরা কেউ দেখে ফেলত তার মতো এতবড় একজন মেয়েকে তার বাবা মুখটা সুচালো করে কিচি কিচি কু কুচি কুচি কু বলে আদর করে দিচ্ছে তা হলে সে লজ্জায় আর মুখ দেখাতে পারত না। আব্বা বললেন, তোর ব্যথা লাগছে বলে আমি হাসছি না রে পাগলী, আমি হাসছি ঘটনাটা চিন্তা করে। একটা মেয়ে পাই পাই করে আরেকজনের উপরে ঘুসি চালাচ্ছে এটা একটা বিপ্লব না?

বিপ্লব?

হ্যাঁ। আমরা যখন ছোট তখন ছেলেরা মারপিট করলে সেটা দেখেই এক–দুইজন মেয়ের দাঁতকপাটি লেগে যেত।

আম্মা আবার কথাবার্তা শুনে খুব বিরক্ত হলেন। একটা মেয়ে এ রকম মারপিট করে এসেছে, কোথায় তাকে আচ্ছা করে বকে দেবে তা নয়, তাকে এভাবে প্রশ্রয় দিয়ে মাথাটা পুরোপুরি খেয়ে ফেলছেন। আম্মা রাগ হয়ে আব্বাকে বললেন, তোমার হয়েছেটা কী? মেয়েটাকে এভাবে লাই দিয়ে তো মাথায় তুলেছ। এই রাজকুমারী বড় হলে অবস্থাটা কী হবে চিন্তা করেছ?

আব্বা জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললেন, রাজকুমারী বড় হলে রাজরানী হবে, এর মাঝে আবার চিন্তা করার কী আছে?

আম্মা একেবারে হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করে মাথা নাড়তে নাড়তে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। আব্বা আবার শাহনাজকে কাছে টেনে এনে বললেন, আমার রাজকুমারী শাহনাজ, বাবা তোমার পরীক্ষা কেমন হয়েছে?

শাহনাজ মুখে রহস্যের ভাব করে বলল, শেষ হয়েছে।

ভালোভাবে শেষ হয়েছে নাকি খারাপভাবে?

তোমার কী মনে হয় আব্বু?

নিশ্চয়ই ভালোভাবে।

শাহনাজ মাথা নেড়ে বলল, আব্বু, আমার পরীক্ষা ভালো হয়েছে, এখন তুমি আমাকে কী দেবে?

আব্বা মুখ গম্ভীর করে বললেন, তোর এই মোটা নাকে চেপে ধরার জন্য একটা আইসব্যাগ।

যাও! শাহনাজ তার আব্বাকে একটা ছোট ধাক্কা দিল। আব্বা নিজেকে রক্ষা করার জন্য হাত তুলে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোর এই বিশাল নাকের জন্য একটা বিশাল নাকফুল।

এবারে শাহনাজ সত্যি সত্যি রাগ করল, বলল, যাও আব্বু। তোমার সবকিছু নিয়ে শুধু ঠাট্টা।

আব্বা এবারে মুখ গম্ভীর করে বললেন, ঠিক আছে মা, বল তুই কী চাস?

যা চাই তাই দিবে?

সেটা নির্ভর করে তুই কী চাস। এখন যদি বলিস লিওনার্দো দ্য কাপ্রিওকে এনে দাও, তা হলে তো পারব না!

না সেটা বলব না।

তা হলে বল্।

শাহনাজ চোখ ছোট ছোট করে খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, আমি সোমা আপুদের বাগানে বেড়াতে যেতে চাই।

আব্বা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হাত নেড়ে বললেন, তথাস্তু।

সোমা হচ্ছে শাহনাজের আম্মার ছোটমামার একজন দূর-সম্পর্কের বনের মেয়ে। সম্পর্ক হিসাব করে ডাকাডাকি করলে শাহনাজকে মনে হয় সোমা খালা–টালা–এই ধরণের কিছু একটা ডাকা উচিত কিন্তু এত হিসাব করে তো আর কেউ ডাকাডাকি করে না। সোমার আব্বা শাহনাজের আব্বার খুব ভালো বন্ধু। অফিসের কাজে একবার ঢাকা এসে কয়দিন শাহনাজদের বাসায় ছিলেন। তখন থেকেই পরিচয়। সোমা বয়সে শাহনাজ থেকে একটু বড়, তাই তাকে সোমা আপু বলে ডাকে।

সোমা একেবারে অসাধারণ একজন মেয়ে। কেউ যদি সোমাকে ল্যাং মেরে ফেলে দেয়, সে তা হলে পড়ে গিয়েও খিলখিল করে হেসে উঠে বলবে, ইস্! তুমি কী সুন্দর ল্যাং মারতে পার! কোথায় শিখেছ এত সুন্দর করে ল্যাং মারা? রাস্তায় যদি কোনো ছিনতাইকারী তার গলার হার ছিনিয়ে নিয়ে যায় তা হলেও খুশিতে ঝলমল করে বলে উঠবে, লোকটার নিশ্চয়ই আমার বয়সী একটা মেয়ে আছে, মেয়েটা এই হারটা পেয়ে কী খুশিই না হবে! কেউ যদি সোমার নাকে ঘুসি মেরে বসে তা হলে সোমা ব্যথাটা সহ্য করে হেসে বলবে, কী মজার একটা ব্যাপার হল! ঘুসি খেলে কী রকম লাগে সবসময় আমার জানার কৌতূহল। ছিল, এবারে জেনে গেলাম! যারা সোমাকে চেনে না তারা এ রকম কথাবার্তা শুনে মনে। করতে পারে সে বুঝি বোকাসোকা একটা মেয়ে, কিছুই বোঝে না, আর বুঝলেও না বোঝার ভান করে সারাক্ষণ ন্যাকা ন্যাকা কথা বলে। কিন্তু একটু ঘনিষ্ঠতা হলেই বোঝা যায় আসলে সোমা একেবারেই বোকা নয়, তার মাঝে এতটুকুও ন্যাকামো নেই। সোমা সত্যি সত্যি পণ করেছে পৃথিবীর সবকিছু থেকে সে আনন্দ খুঁজে বের করবে। একটা ব্যাপারে অন্যেরা যখন রেগেমেগে কেঁদেকেটে একটা অনর্থ করে ফেলে, সোমা ঠিক তখনো তার মাঝখান থেকে আনন্দ পাবার আর খুশি হবার একটি বিষয় খুঁজে বের করে ফেলে।

সোমারা থাকে চট্টগ্রামের একটা পাহাড়ি এলাকায়। তার আব্বা সেখানকার একটা ছবির মতো দেখতে চা–বাগানের ম্যানেজার। চা–বাগানে যারা থাকে তারা মনে হয় একটু একা একা থাকে, তাই কেউ বেড়াতে গেলে তারা ভারি খুশি হয়। সোমা কয়দিন পরে পরেই শাহনাজকে চিঠি লিখে সেখানে বেড়াতে যেতে বলে। শাহনাজেরও খুব ইচ্ছে, কিন্তু পরীক্ষার জন্য সবরকম জল্পনা–কল্পনা বন্ধ করে রাখা ছিল। পরীক্ষা শেষ হয়েছে বলে আব্বা এখন তাকে যেতে দিতে রাজি হয়েছেন। আনন্দে শাহনাজের মাটিতে আর পা পড়ে না।

পৃথিবীতে অবশ্য কোনো জিনিসই পুরোপুরি পাওয়া যায় না। আম খেলে ভিতরে আঁটি থাকে, চকোলেট খেলে দাঁতে ক্যাভিটি হয়, পড়াশোনায় বেশি ভালো হলে বন্ধুবান্ধবেরা। ভ্যাবলা বলে ধরে নেয়। ঠিক সেরকম সোমার কাছে বেড়াতে যাওয়ার আনন্দটুকু পুরোপুরি পাওয়া গেল না, কারণ আম্বা ইমতিয়াজের ওপর ভার দিলেন শাহনাজকে সোমাদের বাসায় নিয়ে যেতে। ইমতিয়াজ প্রথমে অবশ্য বলে দিল সে শাহনাজকে নিয়ে যেতে পারবে না, কারণ তার নাকি কবিতা লেখার ওপরে একটা ওয়ার্কশপ আছে। আব্বা যখন একটা ছোটখাটো ধমক দিলেন তখন সে খুব অনিচ্ছার ভান করে রাজি হল। শাহনাজকে নিয়ে যাবার সময় পুরো রাস্তাটুকু ইমতিয়াজ কী রকম যন্ত্রণা দেবে সেটা চিন্তা করে শাহনাজের প্রায় এক শ দুই ডিগ্রি জ্বর উঠে যাবার মতো অবস্থা, কিন্তু একবার পৌঁছে যাবার পর যখন সোমার সাথে দেখা হবে তখন কতরকম মজা হবে চিন্তা করে সে নিজেকে শান্ত করল।

সোমাদের বাসায় যাবার জন্য সে তার ব্যাগ গোছাতে শুরু করল। বেড়ানোর জন্য জামা–কাপড়, চা–বাগানের টিলায় টিলায় ঘুরে বেড়ানোর জন্য টেনিস শু, রোদ থেকে বাচার জন্য বেসবল টুপি এবং কালো চশমা, ছুটিতে পড়ার জন্য জমিয়ে রাখা গল্পের বই, বেড়ানোর অভিজ্ঞতা লিখে রাখার জন্য নোটবই এবং কলম, ছবি আঁকার খাতা, ফটো তোলার জন্য আব্বার ক্যামেরা, সোমার জন্য কিছু উপহার, সোমার আব্বার জন্য পড়ে কিছু বোঝা যায় না এরকম জ্ঞানের একটা বই আর সোমার আম্মার জন্য গানের সিডি। ইমতিয়াজ। ভান করল পুরো ব্যাপারটিই হচ্ছে এক ধরনের সময় নষ্ট, তাই মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব। করে রাখল, কিন্তু নিজের ব্যাগ গোছানোর সময় সেখানে রাজ্যের জিনিস এনে হাজির করল।

নির্দিষ্ট দিনে আব্বা–আম্মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শাহনাজ আর ইমতিয়াজ রওনা দিয়েছে, কমলাপুর স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠেছে সময়মতো। ট্রেনে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে শাহনাজের খুব ভালো লাগে, একেবারে সাধারণ জিনিসগুলো তখন একেবারে অসাধারণ বলে মনে হয়। ব্যাগ থেকে সে একটা রগরগে এ্যাডভেঞ্চারের বই বের করে আরাম করে বসল। ইমতিয়াজ মুখ খুব গম্ভীর করে চুলের ভিতরে আঙুল ঢুকিয়ে সেগুলো এলোমেলো করতে করতে একটা মোটা বই বের করল। বইটার নাম খুব কটমটে, শাহনাজ কয়েকবার চেষ্টা করে পড়ে আন্দাজ করল : মধ্যযুগীয় কাব্যে অতিপ্রাকৃত উপমার নান্দনিক ব্যবহার! এ রকম বই যে কেউ লিখতে পারে সেটা একটা বিস্ময় এবং কেউ যে নিজে থেকে সেটা পড়ার চেষ্টা করতে পারে সেটা তার থেকে বড় বিস্ময়।

ট্রেন ছাড়ার পর শাহনাজ তার সিটে হেলান দিয়ে মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে তাকাতে তার এ্যাডভেঞ্চারের বইটি পড়তে থাকে। ইমতিয়াজ তার বিশাল জ্ঞানের বইটি নিয়ে খানিকক্ষণ ধস্তাধস্তি করে, পড়ার ভান করে, কিন্তু শাহনাজ বুঝতে পারল সে এক পৃষ্ঠাও আগাতে পারছে না। কেউ যদি তার দিকে তাকিয়ে থাকত তাহলে মনে হয় আরো খানিকক্ষণ এ রকম চেষ্টা করত কিন্তু ট্রেনের যাত্রীরা সবাই নিজেকে নিয়ে নিজেরাই ব্যস্ত, কাজেই ইমতিয়াজ বেশিক্ষণ এই জ্ঞানের বই পড়ার ভান চালিয়ে রাখতে পারল না। বই বন্ধ করে উসখুস করতে লাগল। খানিকক্ষণ পর যখন একজন হকার কিছু ম্যাগাজিন নিয়ে হাজির হল তার কাছ থেকে সে একটা ম্যাগাজিন কিনল, ম্যাগাজিনটার নাম : খুন জখম সন্ত্রাস, প্রথম পৃষ্ঠায় একজন মানুষের মাথা কেটে ফেলে রাখার ছবি, উপরে বড় বড় করে লেখা : আবার নরমাংসভুক সন্ত্রাসী। ইমতিয়াজ গভীর মনোযোগ দিয়ে ম্যাগাজিনটা গোগ্রাসে গিলতে থাকে।

.

শাহনাজ আর ইমতিয়াজ ট্রেন থেকে নামল দুপুরবেলার দিকে। সেখান থেকে বাসে করে তিন ঘণ্টা যেতে হল পাহাড়ি রাস্তা ধরে। সবশেষে স্কুটারে করে কয়েক মাইল। সোমাদের বাসায় যখন পৌঁছাল তখন সন্ধে হয়ে গেছে।

শাহনাজকে দেখে সোমা যেভাবে ছুটে আসবে ভেবেছিল সোমা ঠিক সেভাবে ছুটে এল না, এল একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কাছে এসে অবশ্য জাপটে ধরে খুশিতে চিৎকার করে উঠে বলল, তুই এসেছিস? আমি ভাবলাম তুই বুঝি ভুলেই গেছিস আমাকে।

শাহনাজও সমান জোরে চিৎকার করে বলল, তুমি ভালো আছ সোমা আপু?

হ্যা ভালো আছি বলেই সোমা আপু থেমে গেল, হাসার চেষ্টা করে বলল, আসলে বেশি ভালো নেইরে।

শাহনাজ দুশ্চিন্তিত মুখে বলল, কেন? কী হয়েছে?

জানি না। বুকের ভিতর হঠাৎ অসম্ভব ব্যথা হয়। তখন হাত–পা অবশ হয়ে যায়, মাঝে মাঝে একেবারে সেন্সলেস হয়ে যাই।

শাহনাজের মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ভয়–পাওয়া গলায় বলল, ডাক্তার দেখাও নি?

দেখিয়েছি।

ডাক্তার কী বলে?

ঠিক ধরতে পারছে না। কখনো বলে হার্টের সমস্যা, কখনো বলে নার্ভাস সিস্টেম, কখনো বলে নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার। সোমা কিছুক্ষণ ম্লানমুখে বসে থাকে এবং হঠাৎ করে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, বুঝলি শাহনাজ, সবসময় আমার জানার কৌতূহল ছিল সেন্সলেস হলে কেমন লাগে! এখন জেনে গেছি!

শাহনাজ অবাক হয়ে সোমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সোমার আম্মা বললেন, শাহনাজ মা, ভিতরে আস। ভালোই হয়েছে তুমি এসেছ, সোমার একজন সঙ্গী হল। কী যে হল মেয়েটার!

শাহনাজ তার ব্যাগ হাতে নিয়ে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ভালো হয়ে যাবে চাচি।

দোয়া কোরো না।

ইমতিয়াজ পিছনে পিছনে এসে ঢুকল, মুখে সবজান্তার মতো একটা ভান করে বলল, আমার কী মনে হয় জানেন চাচি?

কী?

সোমার সমস্যাটা হচ্ছে সাইকোসোমেটিক।

সোমার আম্মা ভয়ার্ত মুখে বললেন, সেটা আবার কী?

এক ধরনের মানসিক রোগ।

সোমা চোখ বড় বড় করে বলল, মানসিক রোগ? তার মানে আমি পাগলী? তারপর হি হি করে হেসে বলল, আমি সবসময় জানতে চেয়েছিলাম পাগলীরা কী করে। এখন আমি জানতে পারব।

ইমতিয়াজ আরো কী একটা জ্ঞানের কথা বলতে যাচ্ছিল, শাহনাজ বাধা দিয়ে বলল, সোমা আপু, তুমি ভাইয়ার সব কথা বিশ্বাস কোরো না।

কেন?

কারণ সবকিছু নিয়ে একটা কথা বলে দেওয়া হচ্ছে ভাইয়ার হবি। অমর্ত্য সেনের সাথে দেখা হলেও তাকে একটা কিছু উপদেশ দিয়ে দেবে।

ইমতিয়াজ চোখ পাকিয়ে শাহনাজের দিকে তাকাল, শাহনাজ সেই দৃষ্টি পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে বলল, ভাইয়ার সাথে যদি কোনোদিন বিল গেটসের দেখা হয় তা হলে সে বিল গেটসকেও কীভাবে কম্পিউটারের ব্যবসা করতে হয় সেটার ওপরে লেকচার দিয়ে দিত।

আরেকটু হলে ইমতিয়াজ খপ করে শাহনাজের চুলের মুঠি ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দিত কিন্তু শাহনাজ সময়মতো সরে গেল। নেহায়েত সোমা, তার আব্বা–আম্মা কাছে ছিলেন তাই ইমতিয়াজ ছেড়ে দিল। তবে কাজটা শাহনাজের জন্য ভালো হল না, ইমতিয়াজ যে তার ওপর একটা শোধ নেবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শাহনাজ অবশ্য ব্যাপারটি নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তিত হল না। এখন সে সোমাদের বাসায় আছে, ইমতিয়াজ তাকে কোনোরকম জ্বালাতন করতে পারবে না।

রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সোমা শাহনাজকে নিয়ে কী কী করবে তার একটা বিশাল লিস্ট তৈরি করল। সেই লিস্টের সব কাজ শেষ করতে হলে অবশ্য শাহনাজকে তার পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে এখানেই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে হবে, কিন্তু সেটা নিয়ে সোমা কিংবা শাহনাজ কারো খুব মাথাব্যথা আছে বলে মনে হল না।

.

পরদিন ভোরে অবশ্য হঠাৎ করে অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেল–সকালবেলা নাশতা করতে করতে হঠাৎ করে সোমার মুখ কেমন জানি ফ্যাকাসে হয়ে যায়। শাহনাজ ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, সোমা আপু, কী হয়েছে?

সোমা কোনো কথা বলল না, সে তার বুকে দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে। শাহনাজ ভয় পাওয়া গলায় বলল, সোমা আপু!

সোমা কিছু একটা কথা বলার চেষ্টা করল কিন্তু বলতে পারল না, তার সারা মুখে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে। শাহনাজ উঠে গিয়ে সোমাকে ধরে চিৎকার করে ডাকল, চাচি!

সোমার আম্মা রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন, দুজনে মিলে সোমাকে ধরে কাছাকাছি একটা সোফায় শুইয়ে দিল। শাহনাজ সোমার হাত ধরে রাখল। সোমা রক্তহীন মুখে ফিসফিস করে বলল, তোমরা কোনো ভয় পেয়ো না, দেখবে এক্ষুনি ঠিক হয়ে যাবে।

শাহনাজ কাঁদো–কাঁদো গলায় বলল তোমার কেমন লাগছে সোমা আপু? ব্যথা। সোমা অনেক কষ্ট করে বলল, বুকের মাঝে ভয়ানক ব্যথা।

শাহনাজ কী করবে বুঝতে না পেরে কাঁদতে শুরু করল। সোমা জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, কাদিস না বোকা মেয়ে বেশি ব্যথা হলেই আমি সেন্সলেস হয়ে যাব তখন আর ব্যথা করবে না।

সত্যি সত্যি একটু পর সোমা অচেতন হয়ে পড়ল। চা–বাগানের অফিস থেকে ডাক্তারকে নিয়ে সোমার আব্বা ছুটে এলেন। সোমাকে নানাভাবে পরীক্ষা করা হল এবং ঠিক করা হল তাকে এক্ষুনি শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে।

কিছুক্ষণের মাঝে একটা জিপ এনে হাজির করা হল, সেখানে সোমাকে নিয়ে তার আব্বা–আম্মা আর চা–বাগানের ডাক্তার রওনা দিয়ে দিলেন। জিপ স্টার্ট করার আগে সোমা চোখ খুলে শাহনাজকে ফিসফিস করে বলল, একটা অভিজ্ঞতা হবে, কী বলিস? কখনো আমি হাসপাতালে যাই নি!

সোমাকে নিয়ে চলে যাবার পর শাহনাজ আবিষ্কার করল পুরো বাসাটা একেবারে একটা মৃতপুরীর মতো নীরব হয়ে গেছে। বাসায় দেখাশোনা করার জন্য অনেক লোকজন রয়েছে, এখানে থাকতে কোনো অসুবিধে হবে না, কিন্তু হঠাৎ করে শাহনাজের বুকটা ফাঁকা হয়ে গেল। কত আশা করে সে এখানে বেড়াতে এসেছে, সোমার সাথে তার কতকিছু করার পরিকল্পনা, কিন্তু এখন সবই একটা বিশাল দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে।

এর মাঝে ইমতিয়াজ পুরো ব্যাপারটা আরো খারাপ করে ফেলল। সোমাকে হাসপাতালে নেবার পর ইমতিয়াজ একটা বড় হাই তুলে বাসার কাজের মানুষটিকে বলল, আমার জন্য ভালো করে এক কাপ চা বানিয়ে আনন। চা–বাগানে বেড়াতে এসেছি, আমাদের ভালো চা খাওয়াবে না? কী রকম আজেবাজে চা বানাচ্ছ?

কাজের মানুষটি অপ্রস্তুত হয়ে ইমতিয়াজের জন্য নতুন করে চা তৈরি করতে যাচ্ছিল তখন ইমতিয়াজ তাকে থামাল, বলল, ভালো চা তৈরি করতে দরকার ভালো পানি। এখানে স্প্রিং ওয়াটার নাই?

কাজের মানুষটি ইমতিয়াজের কথা বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ইমতিয়াজ বিরক্ত হয়ে বলল, স্প্রিং ওয়াটার মানে বোঝ না? পাহাড়ি ঝরনার পানি। নাই?

কাজের মানুষটা ভয়ে ভয়ে বলল, কাছে নাই। দুই মাইল দূরে একটা ঝরনা আছে।

গুড। আজ বিকালে সেখানে যাবে, বালতি করে ঝরনার পানি আনবে। সেই পানিতে চা হবে।

মানুষটি মাথা নেড়ে শুকনো মুখে চলে গেল। শাহনাজ একেবারে হতভম্ব হয়ে ইমতিয়াজের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, একজন মানুষ কেমন করে এ রকম হৃদয়হীন হয়? এইমাত্র সোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তার কী হবে কে জানে, আর ইমতিয়াজ কীভাবে ঝরনার পানি দিয়ে তার জন্য চা তৈরি করা হবে সেটা নিয়ে হম্বিতম্বি করছে! শাহনাজের পক্ষে সহ্য করা কঠিন হয়ে উঠল, কোনোমতে চোখের পানি সামলানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, ভাইয়া, তোমার ভিতরে কোনো মায়াদয়া নাই?

ইমতিয়াজ কেনো আঙুল দিয়ে কান চুলকাতে চুলকাতে বলল, কেন? কী হয়েছে?

সোমাকে এইমাত্র হাসপাতালে নিয়েছে আর তুমি ঝরনার পানিতে চা খাওয়া নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ?

ইমতিয়াজ যেন ব্যাপারটা বুঝতে পারে নি সেরকম একটা মুখের ভাব করে বলল, সোমাকে হাসপাতালে নিলে আমি চা খেতে পারব না?

শাহনাজ কোনো কথা বলল না। কিছুতেই ইমতিয়াজের সামনে কাঁদবে না ঠিক করে রাখায় সে কষ্ট করে চোখের পানি আটকে রাখল। ইমতিয়াজ মনে হয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে খুব মজা পেয়ে গেল, মুখ বাঁকা করে হেসে বলল, এখন তুই ফিচ ফিচ করে কাঁদতে শুরু করবি নাকি?

শাহনাজ কোনো কথা বলল না। ইমতিয়াজ গভীর জ্ঞানের কথা বলছে এ রকম একটা ভাব করে বলল, আমি সবসময়েই বিশ্বাস করতে চাই যে মেয়ে এবং ছেলের মাঝে কোনো পার্থক্য নাই। একটা ছেলে যেটা করতে পারে, একটা মেয়েও নিশ্চয়ই সেটা করতে পারে। কিন্তু তোদের দেখে এখন আমার মত পাল্টাতে হবে। ছোট একটা বিষয় নিয়ে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদবি।

শাহনাজ আর পারল না, চিৎকার করে রাগে ফেটে পড়ল, এইটা ছোট বিষয়? সোমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল, এইটা ছোট বিষয়?

ইমতিয়াজ ঠোঁট উন্টে বলল, পরিষ্কার সাইকোসোমেটিক কেন্স। নিউজ উইকে এর ওপরে আমি একটা আর্টিক্যাল পড়েছি, হুবহু এই কেস। দুই গ্রুপ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা হল। এক গ্রুপকে দিল ড্রাগস, অন্য গ্রুপকে প্লাসিবু

শাহনাজ চিৎকার করে বলল, চুপ করবে তুমি? তোমার বড় বড় কথা বন্ধ করবে?

ছোটবোনের মুখে এ রকম কথা শুনে ইমতিয়াজ এবারে খেপে গেল। চোখ ছোট ছোট করে হিন্দি সিনেমার ভিলেনের মতো মুখ করে বলল, আমার সাথে ঘিড়িংগবাজি? একেবারে কানে ধরে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যাব।

পারলে নিয়ে যাও না!

ভাবছিস পারব না? আমাকে চিনিস না তুই?

তোমাকে চিনি দেখেই বলছি। শাহনাজ হিংস্র মুখ করে বলল, তোমার হচ্ছে শুধু কথা। বড় বড় কথা। বড় বড় কথা যদি বাজারে বিক্রি করা যেত তা হলে এতদিনে তুমি আরেকটা বিল গেটস হয়ে যেতে।

ইমতিয়াজ শাহনাজের দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে কিছু একটা করে ফেলত কিন্তু ঠিক তখন বাসার কাজের মানুষটি চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকল বলে সে কিছু করল না। তার হাত থেকে কাপটা নিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে মুখে পরিতৃপ্তির একটা ভাব নিয়ে আসে। শাহনাজের পক্ষে ইমতিয়াজের এইসব ভান আর সহ্য করা সম্ভব হল না, সে পা দাপিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।

বাইরে এসে বারান্দায় বসে শাহনাজ নিজের চোখ মুছে নেয়, তার এত মন–খারাপ লাগছে যে সেটি আর বলার মতো নয়। পরীক্ষা শেষ হবার পর এখানে বেড়াতে এসে সে কত আনন্দ করবে বলে ঠিক করে রেখেছিল অথচ এখন আনন্দ দূরে থাকুক, পুরো সময়টা যেন একটা বিভীষিকার মতো হয়ে যাচ্ছে। ইমতিয়াজ মনে হয় তার জীবনটাকে একেবারে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে। মানুষেরা তাদের ছোটবোনকে কত ভালবাসে কিন্তু ইমতিয়াজকে দেখলে মনে হয়। শাহনাজ যেন ছোটবোন না, সে যেন রাজনৈতিক দলের বিপক্ষ পার্টির নেতা!

শাহনাজ একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। আজ সকালে কাছাকাছি একটা টিলাতে সোমাকে নিয়ে হেঁটে যাবার কথা ছিল। সোমা এখন নেই সে একাই হেঁটে আসবে। সোমা বলেছে পুরো এলাকাটা খুব নিরাপদ, একা একা ঘুরে বেড়াতে কোনো ভয় নেই। শাহনাজ গেট খুলে বের হবার সময় দারোয়ার্ম জানতে চাইল সে কোথায় যাচ্ছে, সঙ্গে কাউকে দেবে কি না। শাহনাজ বলল কোনো প্রয়োজন নেই, সে একাই হেঁটে আসবে।

সোমাদের বাসা থেকে খোয়া–বাঁধানো একটা রাস্তা ঘুরে ঘুরে নিচে নেমে গেছে। রাস্তার দুপাশে বড় বড় মেহগনি গাছ। গাছে নানারকম পাখি কিচিরমিচির করে ডাকছে। শাহনাজ রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে নিচে নেমে আসে। কাছাকাছি আরো কয়েকটা সুন্দর সুন্দর ছবির মতো বাসা। তার পাশ দিয়ে হেঁটে সে পিছনে টিলার দিকে হাঁটতে থাকে। চা বাগানের শ্রমিক পুরুষ আর মেয়েরা গল্প করতে করতে কাজে যাচ্ছে, শাহনাজ তাদের পিছু পিছু যেতে থাকে। খানিকদূর যাবার পর পায়েচলা পথ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। সবাই একদিকে চলে যায়, শাহনাজ অন্যদিকে হাঁটতে থাকে। তার মনটি খুব বিক্ষিপ্ত, কোনোকিছুতেই মন দিতে পারছে না। অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে একটা জংলা জায়গায় হাজির হল, শুকনো পাতা মাড়িয়ে সে একটা বড় গাছের দিকে হেঁটে যেতে থাকে, গাছের গুঁড়িতে বসে বসে সে খানিকক্ষণ নিজের আর সোমার ভাগ্য নিয়ে চিন্তা করবে।

গাছটার কাছাকাছি যেতেই হঠাৎ প্রচণ্ড কর্কশ শব্দে প্রায় সাইরেনের মতো তীক্ষ্ণ একটা শব্দ বেজে ওঠে। শাহনাজ চমকে উঠে একলাফে পিছনে সরে যায়, কিন্তু পো পো শব্দে সেই তীক্ষ্ণ শব্দের মতো সাইরেন বাজতেই থাকে। শব্দটা কোথা থেকে আসছে বোঝার জন্য শাহনাজ এদিক–সেদিক তাকাতে থাকে, ঠিক তখন বাচ্চার গলায় কেউ একজন চিৎকার করে ওঠে, খবরদার, কাছে আসবে না।

কথাটি কে বলছে দেখার জন্য শাহনাজ এদিক–সেদিক তাকাল কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। শাহনাজ তখন ভয়ে ভয়ে বলল, কে?

আমি।

গলার স্বরটি এল গাছের উপর থেকে এবং শাহনাজ তখন উপরের দিকে তাকাল। দেখল গাছের মাঝামাঝি জায়গায় তিনটি ডাল বের হয়ে এসেছে, সেখানে একটা ছোট ঘরের মতন। সেই ঘরের উপর থেকে দশ–বারো বছরের একটা বাচ্চার মাথা উঁকি দিচ্ছে। বাচ্চাটির বড় বড় চোখ, ভারী চশমা দিয়েও চোখ দুটোকে ছোট করা যায় নি, খরগোশের মতো বড় বড় কান। মাথায় এলোমেলো চুল। বাচ্চাটি সাবধানে আরো একটু বের হয়ে এল। শাহনাজ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি গাছের উপরে কী করছ?

সাইরেনের মতো কর্কশ পো পো শব্দের কারণে ছেলেটি শাহনাজের কথা শুনতে পেল না, সে ভুরু কুঁচকে বলল, কী বলছ?

শাহনাজ আরো গলা উঁচিয়ে বলল, তুমি গাছের উপরে কী করছ?

দাঁড়াও শুনতে পাচ্ছি না বলে বড় বড় কান এবং বড় বড় চোখের ছেলেটা তার হাতে ধরে রাখা জুতার বাক্সের মতো একটা বাক্সের গায়ে লাগানো একটা সুইচ অফ করে দিল, সাথে সাথে কর্কশ এবং তীক্ষ্ণ সাইরেনের মতো পোঁ পোঁ শব্দটি থেমে যায়। ছেলেটি এবারে একটু এগিয়ে এসে বলল, কী বলছ?

শাহনাজ খানিকক্ষণ এই বিচিত্র ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি বলছি তুমি এই গাছের উপর বসে কী করছ?

ছেলেটা ঘাড়টা বাঁকা করে বলল, সেটা বলা যাবে না।

কেন?

কারণ এইটা টপ সিক্রেট। এইটা আমার গোপন ল্যাবরেটরি– বলেই ছেলেটা জিভে কামড় দিল, তার এই তথ্যটাও নিশ্চয়ই বলে দেওয়ার কথা ছিল না।

শাহনাজ খিলখিল করে হেসে বলল, তুমি তা বলেই দিলে।

ছেলেটাকে একটু বিভ্রান্ত দেখা গেল, শঙ্কিতমুখে বলল, তুমি কাউকে বলে দেবে না তো?

শাহনাজ মাথা নাড়ল, বলল, না।

ঠিক তো?

ঠিক।

তা হলে তুমি উপরে আস।

শাহনাজ ভুরু কুঁচকে গাছের উপরে তাকাল, বলল, কেমন করে আসব?

ছেলেটা তার ছোট ঘরটার ভিতরে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং পরের মুহূর্তে একপাশ থেকে দড়ির একটা মই নামিয়ে দিল। ক্যাটক্যাটে গোলাপি হাওয়াই মিঠাই রঙের দুটি নাইলনের দড়ির সাথে বাঁশের কঞ্চি বেঁধে চমৎকার একটা মই তৈরি করা হয়েছে। ছেলেটা গাছের উপরে বসেই মইয়ের নিচের অংশটুকু গাছের নিচে লাগানো একটা আংটায় বাধিয়ে নিল, যেন উপরে ওঠার সময় সেটা দুলতে না থাকে।

শাহনাজ মইয়ে পা দেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করল, ছিড়ে যাবে না তো?

নাইলন এত সহজে ছেড়ে না। ছেলেটা বড় মানুষের মতো বলল, তোমার ওজন দুইটা দড়িতে ভাগ হয়ে যাবে, এক একটা দড়ি কমপক্ষে দুই শ কিলোগ্রাম নিতে পারবে। আমি টেস্ট করেছি।

শাহনাজ আর তর্ক করল না, দড়ির মইয়ে পা দিয়ে বেশ সহজেই উপরে উঠে আসে। ছেলেটা শেষ অংশে হাত ধরে তাকে সাহায্য করল। উপরে বেশ চমৎকার একটা ঘরের মতো, বাইরে থেকে কাঠকুটো এবং গাছের ডালপালা দিয়ে ঢেকে রেখেছে বলে হঠাৎ করে চোখে পড়ে না। ভিতরে অনেকখানি জায়গা এবং সেখানে রাজ্যের যন্ত্রপাতিতে বোঝাই। ছেলেটি বলে না দিলেও একবার দেখলে এটা যে একটা গোপন ল্যাবরেটরি সে বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ থাকবে না।

ছেলেটা তার জুতোর বাক্স তুলে একটা সুইচ টিপে বলল, আমার সিকিউরিটি আবার অন করে দিলাম।

কী হয় সিকিউরিটি অন করলে?

কেউ ল্যাবরেটরির কাছে এলেই আমি বুঝতে পারি।

কীভাবে তৈরি করেছ সিকিউরিটি?

ছেলেটার মুখে এইবারে স্পষ্ট একটা গর্বের ছাপ ফুটে উঠল, লেজার লাইট দিয়ে। ঐ দেখ রেইনট্রি গাছে লেজার ডায়োড লাগানো আলোটা আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে গাছকে ঘিরে রেখেছে। একটা ফটো–ডায়োড আছে, সার্কিট ব্রেক হলেই আমার সাইরেন চালু হয়ে যায়। এফ, এম, সার্কিট।

শাহনাজ একটু চমকৃত হয়ে ছেলেটার দিকে তাকাল, ইতস্তত করে বলল, কোথায় পেয়েছ এই সিকিউরিটি সার্কিট?

আমি তৈরি করেছি।

শাহনাজ চোখ কপালে তুলে বলল, তুমি তৈরি করেছ!

হ্যাঁ।

তুমি দেখি বড় সায়েন্টিস্ট।

ছেলেটি খুব আপত্তি করল না, মাথা নেড়ে স্বীকার করে নিল। শাহনাজ একটু অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোর নাম কী?

ক্যাপ্টেন ডাবলু।

ক্যাপ্টেন কী?

ক্যাপ্টেন ডাবলু। ইউ ভি ডাবলু। সেই ডাবলু।

ক্যাপ্টেন ডাবলুর সাথে পরিচয় হবার দশ মিনিটের মাঝে শাহনাজ বুঝতে পারল এই ছেলেটার মতো আজব ছেলে সে আগে কখনো দেখে নি এবং ভবিষ্যতেও দেখবে না। নিজের নাম বলার পর শাহনাজ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ক্যাপ্টেন ডাবলু কীরকম নাম?

ছেলেটা মনে হয় তার প্রশ্নটাই বুঝতে পারল না, বলল, যেরকম সবার নাম হয় সেরকম নাম।

নামটা কে রেখেছে?

আমিই রেখেছি। শাহনাজের মুখে অবাক হওয়ার চিহ্ন দেখে মনে হয় সে গরম হয়ে উঠল, বলল, কেন? মানুষ কি নিজের নাম নিজে রাখতে পারে না?

নিশ্চয়ই পারে, তবে সাধারণত রাখে না।

আমি রেখেছি। আমার ভালো নাম ওয়াহিদুল ইসলাম। ওয়াহিদু–ল–নামটা বেশি লম্বা। আমার পছন্দ হয় নাই। তাই শুধু সামনের অংশটা রেখেছি। ডাবলু দিয়ে শুরু তো, তাই শুধু ডাবলু। শর্টকাট।

পুরো ব্যাপারটা একেবারে পানির মতো বুঝে ফেলেছে এ রকম ভান করে শাহনাজ জোরে জোরে মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু নামের আগে ক্যাপ্টেন কেন?

ছেলেটা দাঁত বের করে হেসে বলল, এইটা নাম না, টাইটেল।

কে দিয়েছে?

কে আবার দেবে? আমিই দিয়েছি। শুনতে ভালো লাগে।

একেবারে অকাট্য যুক্তি, শাহনাজের আর কিছুই বলার থাকল না। ক্যাপ্টেন ডাবলু নামের ছেলেটা শাহনাজের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার নাম কী?

শাহনাজ।

শাহনাজ! ছেলেটা মুখ সুচালো করে দাঁতের ফাঁক দিয়ে বাতাস বের করে বলল, কী অদ্ভুত নাম!

শাহনাজ আপত্তি করে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। যে নিজের নাম শর্টকাট করে ক্যাপ্টেন ডাবলু করে ফেলেছে, তার সাথে নামের গঠন নিয়ে আলোচনা করা মনে হয় বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা উঁচিয়ে একবার বাইরে তাকিয়ে শাহনাজকে জিজ্ঞেস করল, শাহনাজ, তুমি কোথা থেকে এসেছ?

শাহনাজের এবারে একটু মেজাজ গরম হল, তার থেকে বয়সে কমপক্ষে দুই–তিন বছর ছোট হয়ে তাকে নাম ধরে ডাকছে মানে? সে কঠিন গলায় বলল, আমাকে নাম ধরে ডাকছ কেন? আমি তোমার বড় না?

ক্যাপ্টেন ডাবলু অবাক হয়ে বলল, তা হলে কী বলে ডাকব?

শাহনাজ আপু বলে ডাকবে।

ও। শাহনাজ আপু, তুমি কোথা থেকে এসেছ?

ঢাকা থেকে।

কোথায় এসেছ?

সোমা আপুদের বাসায়।

সোমা আপু? সেটা কে?

শাহনাজ একটু অবাক হল, তার ধারণা ছিল চা–বাগানে মানুষজন এত কম যে সবাই বুঝি সবাইকে খুব ভালো করে চেনে। ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকিয়ে বলল, চা–বাগানের ম্যানেজারের মেয়ে।

ও, বুঝেছি! কী–মজা–হবে আপু।

কী–মজা–হবে আপু?

হ্যাঁ, আমি ঐ আপুকে ডাকি কী–মজা–হবে আপু! যেটাই হয় সেটাতেই ঐ আপু বলে কী–মজা–হবে, সেজন্যে।

শাহনাজের মনে মনে স্বীকার করতেই হল সোমার জন্য এই নামটি একেবারে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। সোমার কথা মনে পড়তেই শাহনাজের মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। আহা। বেচারি! হাসপাতালে না জানি কীভাবে আছে। ক্যাপ্টেন ডাবলু বুঝতে না পারে সেভাবে খুব। সাবধানে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ক্যাপ্টেন ডাবলু আবার বাইরে তাকিয়ে বলল, কী মজা–হবে আপু অনেকদিন এখানে আসে না।

শাহনাজ একটু অবাক হয়ে বলল, আমি ভেবেছিলাম তোমার এটা টপ সিক্রেট।

হ্যাঁ। সেটা সত্যি, কিন্তু কী–মজা–হবে আপু মাঝে মাঝে দেখতে আসত।

ক্যাপ্টেন ডাবলুর কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ আবার তীক্ষ্ণস্বরে পো পো

করে সাইরেনের মতো শব্দ হতে শুরু করে। শাহনাজ চমকে উঠে বলল, ওটা কিসের শব্দ?

ক্যাপ্টেন ডাবলু লাফিয়ে উঠে বাইরে তাকিয়ে বলল, ঐ যে দুষ্টু ছেলেটা এসেছে। নাম হচ্ছে লাল্ট প্রত্যেকদিন একবার আমার লেজার লাইটের সার্কিট হাত দিয়ে ডিস্টার্ব করে।

শাহনাজ লান্টুর নামের দুষ্ট ছেলেটাকে দেখতে পেল। খালি পা এবং শার্টের বোতাম খোলা সাত–আট বছরের একটা ছেলে। হাত দিয়ে ডায়োড লেজারের আলোটা আটকে রেখে মহানন্দে হিহি করে হাসছে। ক্যাপ্টেন ডাবলু গাছের উপরে লাফাতে লাফাতে বলল, খবরদার লা–একেবারে খুন করে ফেলব কিন্তু, লাইট আটকে রাখলে একেবারে দশ হাজার ভোল্টের ইলেকট্রিক শক দিয়ে দেব কিন্তু।

দশ হাজার ভোল্টের ইলেকট্রিক শক দেওয়ার ভয় দেখাতে যেটুকু রাগারাগি করা দরকার, ক্যাপ্টেন ডাবলুর মাঝে মোটেও সেরকম রাগ দেখা গেল না এবং শার্টের বোতাম খুলে পেট বের করে রাখা লাল্টকেও সেই ব্যাপারটি নিয়ে খুব ভয় পেতে দেখা গেল না। বরং দুজনকেই খুব আনন্দ পেতে দেখা গেল এবং শাহনাজ হঠাৎ করে বুঝতে পারল এটি আসলে দুজনের এক ধরনের খেলা। সে মুচকি হেসে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে জিজ্ঞেস করল, কত জন তোমার এই টপ সিক্রেট ল্যাবরেটরির কথা জানে?

ক্যাপ্টেন ডাবলু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আসলে ঝুমুরটা হচ্ছে সত্যিকারের পাজি। সে সবাইকে বলে দিয়েছে।

ঝুমুরটা কে?।

স্বপনের বোন। এক নম্বর পাজি। ইনডাকশন কয়েল দিয়ে একবার ইলেকট্রিক শক দিতে হবে।

স্বপনটা কে?

ঝুমুরের ভাই–সেটাও মিচকে শয়তান

শাহনাজ বুঝতে পারল ক্যাপ্টেন ডাবলুর সাথে এই বিষয় নিয়ে বেশিক্ষণ কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। যাদেরকে সে পাজি এবং মিচকে শয়তান বলছে তাদের কথা বলার সাথে সাথে তার মুখে এক ধরনের আনন্দের হাসি ফুটে উঠছে, এবং যতদূর মনে হয় লাল্ট, ঝুমুর বা স্বপনের মতো বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়েই তার এক ধরনের মজার খেলা চলছে।

শাহনাজের ধারণা কিছুক্ষণের মাঝেই সত্যি প্রমাণিত হল। আরো কিছু বাচ্চাকাচ্চা এসে নিচে ছোটাছুটি করতে লাগল এবং গাছের উপরে বসে ক্যাপ্টেন ডাবলু লাফঝাঁপ দিতে লাগল। শাহনাজ খানিকক্ষণ এক ধরনের কৌতুক নিয়ে তাদের এই বিচিত্র খেলা লক্ষ করে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে বলল, তোমরা খেল, আমি এখন যাই।

খেলা! এইটা খেলা কে বলেছে?

তা হলে এইটা কী?

আমার টপ সিক্রেট ল্যাবরেটরি দখল করতে চাইছে দেখছ না?

ও। তুমি কী করবে?

মনে হয় ফাইট করতে হবে।

শাহনাজ দেখতে পেল ক্যাপ্টেন ডাবলু একটা লাঠির আগায় একটা সাদা রুমাল বেঁধে নাড়তে থাকে। সে কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল, এইটা কী?

ফাইটটা কীভাবে করতে হবে সেটার নিয়মকানুন ঠিক করতে হবে না?

শাহনাজ দেখতে পেল নিচের ছেলেপিলেরা সঙ্কেত পেয়ে গাছের নিচে এসে হাজির হয়েছে। ক্যাপ্টেন ডাবলু ভয়ঙ্করদর্শন কিছু অস্ত্র নিয়ে গাছ থেকে নেমে এল। শাহনাজও নিচে নেমে আসে। টপ সিক্রেট ল্যাবরেটরি দখল করা নিয়ে যুদ্ধের পরিকল্পনা এবং যে যুদ্ধ শুরু হবে তার মাঝে থাকার মনে হয় তার কোনো দরকার নেই। ক্যাপ্টেন ডাবলুকে সে বলল, আমি গেলাম, তোমরা যুদ্ধ কর।

ক্যাপ্টেন ডাবলু চোখ বড় বড় করে বলল, তুমি থাকবে না আমার সাথে? আমি একা কেমন করে যুদ্ধ করব?

আমি আসলে যুদ্ধ করতে পারি না।

কেন পার না? কী–মজা–হবে আপু তো পারত।

উপস্থিত বাচ্চাকাচ্চারা সবাই মাথা নাড়ল, শাহনাজ বুঝতে পারল সোমা নিশ্চয়ই এই বাচ্চাকাচ্চাদের সাথে এই ছেলেমানুষি খেলায় অনেক সময় দিয়েছে। সোমার কথা মনে পড়ে আবার তার মন খারাপ হয়ে গেল, সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তোমরা খেল, আমি একটু বাসায় যাই, দেখি সোমা আপুর কোনো খবর পাই কি না।

.

বাসায় এসে দেখল ইমতিয়াজ খুব তিরিক্ষে মেজাজে বসে আছে। খবরের কাগজ আসতে দেরি হচ্ছে বলে তার মেজাজ ভালো নেই। একদিন খবরের কাগজ একটু দেরি করে পড়লে কী হয় কে জানে। শাহনাজ বলল, তুমি যে বইটা এনেছ সেটা পড়লেই পার?

কোন্ বইটা?

ঐ যে ট্রেনে যেটা পড়ার চেষ্টা করছিলে! মধ্যযুগীয় কী কী সব জিনিসের নান্দনিক ব্যবহার!

ইমতিয়াজ চোখ পাকিয়ে শাহনাজের দিকে তাকাল। রেগে গেলে চোখ থেকে আগুন বের হওয়ার নিয়ম থাকলে শাহনাজ এতক্ষণে পুড়ে কয়লা হয়ে যেত। শাহনাজের ওপর রাগটা ইমতিয়াজ কাজের ছেলেটার ওপর ঝাড়ল, বলল, তোমাকে বলেছিলাম না ঝরনার পানি আনতে, এনেছ?

আপনি বলেছিলেন বিকালবেলা যেতে।

মুখে মুখে তর্ক করছ কেন? এখন গিয়ে নিয়ে আসছ না কেন?

কাজের ছেলেটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, রান্না করেই যাব।

হ্যাঁ। আর আমার জন্য আরো এক কাপ চা দেবে। কনডেন্স মিল্ক দিয়ে।

.

বিকালবেলা তিনটি ভিন্ন খবর পাওয়া গেল। প্রথম খবরটি হল, খবরের কাগজের সাহিত্য সাময়িকীর পাতায় ইমতিয়াজের যে পোস্ট মডার্ন কবিতাটা ছাপা হওয়ার কথা ছিল সেটা ছাপা হয় নি। পুরো ব্যাপারটা যে পত্রিকার লোকজনের এক ধরনের ঈর্ষা সেটা নিয়ে ইমতিয়াজ বেশি চেঁচামেচি করতে পারল না। কারণ এই বিষয়ে তার চেঁচামেচি শোনার কোনো মানুষ নেই। শাহনাজকে শুনিয়ে কোনো লাভ নেই, কারণ ইমতিয়াজ চেষ্টা করলে সে ঠোঁটের এক কোনা উপরে তুলে ইমতিয়াজ থেকে শেখা বিচিত্র হাসিটি হাসতে থাকে। এবং সেটি দেখে ইমতিয়াজ চিড়বিড় করে জ্বলতে থাকে।

দ্বিতীয় খবরটি সোমাকে নিয়ে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, ডাক্তারেরা। পরীক্ষা করছে। সমস্যাটা কী বোঝার চেষ্টা করছে। সোমার অবস্থা একটু ভালো, সেই ভয়ঙ্কর ব্যথাটি আর হয় নি।

তৃতীয় খবরটির মাথামুণ্ডু বিশেষ বোঝা গেল না। কাজের ছেলেটি বালতি নিয়ে ঝরনার পানি আনতে গিয়ে ফিরে এসেছে, ঝরনা যেখানে থাকার কথা সেখানে নেই। শুনে ইমতিয়াজ শুধু তেলে–বেগুনে নয় তেলে–মরিচে জ্বলতে থাকে। মুখ খিঁচিয়ে বলল, ঝরনা কি রসগোল্লার টুকরা যে কেউ তুলে নিয়ে গেছে?

কাজের ছেলেটা মাথা চুলকে বলল, সেটা তো জানি না, কিন্তু স্যার ঝরনাটা নাই।

সেখানে কী আছে?

আছে স্যার, সবকিছুই আছে, খালি ঝরনাটা নাই।

ইমতিয়াজ খুব রেগেমেগে বলল, আমার সাথে রং তামাশা কর? সবকিছু আছে আর ঝরনাটা নাই মানে? ঝরনার পানি শুকিয়ে গেছে?

জি না। পানি শুকায় নাই। পানি আছে।

পানি আছে তা হলে ঝরনা নাই মানে? ইমতিয়াজ খুব রেগে উঠে বলল, পানি কি তা হলে আসমানে উঠে যাচ্ছে?

কাজের ছেলেটা চিন্তিতভাবে বলল, মনে হয় সেরকমই।

নেহায়েত সোমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছে, তা না হলে ইমতিয়াজ নিশ্চয়ই কাজের ছেলেটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কিছু একটা কাণ্ড করে ফেলত।

.

সোমার খবর পেয়ে শাহনাজের মনটা একটু শান্ত হয়েছে। বিকেলবেলা সে তখন আবার হাঁটতে বের হল। চা–বাগানের শ্রমিকেরা কাজ শেষে ফিরে আসছে, ছোট ছোট বাচ্চারা মায়ের পিছু পিছু ছুটে যাচ্ছে। সবাই ধুলায় পা ডুবিয়ে হেঁটে যাচ্ছে–দেখে কী মজা লাগে! শাহনাজ একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলল, সে যদি এ রকম খালি পায়ে ধুলায় ছুটে যেত তা হলে সবাই নিশ্চয়ই হা হা করে বলবে, সর্বনাশ! সর্বনাশ! হকওয়ার্ম হবে। টিটেনাস হবে! হ্যাঁন হবে। ত্যান হবে!

চা–বাগানের পথ ধরে আরো কিছুদূর হেঁটে গিয়ে হঠাৎ ক্যাপ্টেন ডাবলুকে পেয়ে গেল, বিদঘুঁটে কী একটা জিনিস কানে লাগিয়ে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা শুনছে। শাহনাজ এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ক্যাপ্টেন ডাবলু! কী শুনছ এত মন দিয়ে?

ক্যাপ্টেন ডাবলু শাহনাজকে দেখে বেশ খুশি হয়ে উঠল। বলল, নতুন একটা ট্রান্সমিটার তৈরি করেছি তো, সেটার রেঞ্জ টেস্ট করছি। অনেকদূর থেকে শোনা যায়।

তাই নাকি?

হুম।

দেখি কী রকম শোনা যায়?

শাহনাজকে শুনতে দিতে ক্যাপ্টেন ডাবলুর কেমন যেন উৎসাহের অভাব মনে হল। একরকম জোর করেই শাহনাজকে বিদ্ঘুটে জিনিসটা নিয়ে কানে লাগাতে হল এবং কানে লাগাতেই সে একেবারে চমকে ওঠে, শুনতে পেল কেউ একজন প্রচণ্ড বকাবকি করছে, কান। ছিঁড়ে ফেলব পাজি ছেলে–এক্ষুনি এসে দরজা খুলে দে, না হলে দেখিস আমি তোর কী অবস্থা করি।

শাহনাজ অবাক হয়ে বলল, কে কথা বলছে?

আম্মা।

কাকে বকছেন?

আমাকে।

কেন?

আমার ট্রান্সমিটার টেস্ট করার জন্য একজন মানুষের দরকার ছিল, কাউকে পাই না। তাই–_

শাহনাজ চোখ কপালে তুলে বলল, তাই কী?

তাই আমাকে ঘরের বাইরে থেকে তালা মেরে দিয়েছি, জানালায় রেখেছি মাইক্রোফোন। আম্মা একটানা চিৎকার করছে তাই টেস্ট করতে খুব সুবিধে।

শাহনাজ কয়েক মুহূর্ত কথা বলতে পারে না। কোনোমতে সামলে নিয়ে বলল, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? যাও এক্ষুনি দরজা খুলে দিয়ে এস।

ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, তুমি পাগল হয়েছ শাহনাজ আপু? এখন বাসায় গেলে উপায় আছে? আম্মা আস্ত রাখবে ভেবেছ?

তা হলে?

ক্যাপ্টেন ডাবলু পকেট থেকে আরেকটা যন্ত্র বের করল, সেখানে কী একটা টিপে দিয়ে বলল, দরজা খুলে দিলাম। রিমোট কন্ট্রোল। সন্ধেবেলা রাগ কমে যাবার পর বাসায় যাব।

শাহনাজ খানিকক্ষণ ঐ বিচিত্র ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল। একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, এইসব তুমি নিজে তৈরি করেছ?

হুম।

তার মানে তুমি একজন জিনিয়াস? সব কিছু বোঝ?

বইয়ে লেখা থাকলে সেটা বুঝি।

পরীক্ষায় তুমি ফার্স্ট হও?

ক্যাপ্টেন ডাবলু একটু অবাক হয়ে শাহনাজের দিকে তাকাল, পরীক্ষায় কীভাবে ফাস্ট হব? পরীক্ষায় কি এইগুলো লিখতে দেয়? গতবার তো আমার পাস করা নিয়ে টানাটানি হয়েছিল। আব্ব গিয়ে হেডমাস্টারকে অনেক বুঝিয়ে কোনোভাবে প্রমোশন দিতে রাজি করিয়েছে। ক্যাপ্টেন ডাবলু একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তারপর যা বিপদ হয়েছে!

কী বিপদ?

আব্বা আমার পুরো ল্যাবরেটরি বইপত্র সব জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছিল। সেই জন্যই তো আসল এক্সপেরিমেন্টগুলো টপ সিক্রেট করে ফেলেছি!

শাহনাজ খানিকক্ষণ এই বিচিত্র ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি একটু পড়াশোনা করলেই তো সব পারবে। পারবে না?

নাহ।

কী বলছ পারবে না! নিশ্চয়ই পারবে।

না, আমি পড়তেই পারব না। যেটা পড়তে ভালো লাগে না সেটা পড়ার চেষ্টা করলে ব্রেনের নিউরনগুলোর সব সিনান্স উল্টাপাল্টা হয়ে যায়।

শাহনাজ কী বলবে বুঝতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, তোমার কী কী জিনিস পড়তে ভালো লাগে না?

বাংলা ইংরেজি ইতিহাস ভূগোল পৌরনীতি এইসব।

আর কী পড়তে ভালো লাগে?

ক্যালকুলাস, ফিজিক্স এইসব।

শাহনাজ চমকে উঠল, ১১/১২ বছরের ছেলে, ক্যালকুলাস করতে পারে! সে একটু অবাক হয়ে বলল, তুমি ক্যালকুলাস পার?

বেশি পারি না। একটা রকেট পাঠালে সেটা অরবিটে যেতে হলে কী করতে হবে সেইটা করার জন্য ক্যালকুলাস শিখেছিলাম। তারপরে দেখলাম–

কী দেখলে?

কম্পিউটারে প্রোগ্রাম করেই বের করে ফেলা যায়।

তুমি কম্পিউটারে প্রোগ্রামিং করতে পার?

কিছু পারি। ক্যাপ্টেন ডাবলু একটা নিশ্বাস ফেলল, বলল, কিন্তু আমার আম্মা বেশিক্ষণ আমাকে কম্পিউটার ব্যবহার করতে দেয় না।

তুমি কী কী প্রোগ্রামিং কর?

জাভা, সি প্লাস প্লাস এইসব সোজা সোজা প্রোগ্রাম। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সটা ভালো পারি না। দাবা খেলার একটা প্রোগ্রাম লিখেছি, একেবারে ভালো হয় নাই। বারো চৌদ্দ দানের মাঝে হারিয়ে দেওয়া যায়।

শাহনাজ আড়চোখে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে দেখল। তাদের বাসাতেও একটা কম্পিউটার আছে। খুব সাবধানে সেখানে কম্পিউটার–গেম খেলা হয়, তার বেশি কিছু নয়। আর এই বাচ্চা ছেলে সেখানে নাকি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে প্রোগ্রামিং করে! কী সাংঘাতিক ব্যাপার! শাহনাজ ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল, ফিজিক্সে তুমি কী কী পড়?

সবচেয়ে ভালো লাগে রিলেটিভিটি।

তুমি রিলেটিভিটি জান?

শুধু স্পেশাল রিলেটিভিটি। জেনারেলটা বুঝি না। খুব কঠিন।

আমার মনে হয় কোয়ান্টাম মেকানিক্সটা ঠিক না। কিছু ভুলত্রুটি আছে।

ভুলত্রুটি আছে?

হা। যেমন মনে কর আনসার্টেনিটি প্রিন্সিপাল বলে এনার্জি আর টাইম একসাথে মাপা যায় না। এখন যদি মনে কর।

শাহনাজ লজ্জায় লাল হয়ে বলল, ক্যাপ্টেন ডাবলু—-আমি আসলে আনসার্টেনিটি প্রিন্সিপাল জানি না।

ক্যাপ্টেন ডাবলু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এইটাই হচ্ছে সমস্যা। এইসব বিষয় নিয়ে কথা বলার কোনো লোক পাই না।

তোমার স্কুলের স্যারদের সাথে চেষ্টা করে দেখেছ?

ক্যাপ্টেন ডাবলু কেমন জানি আতঙ্কের দৃষ্টিতে শাহনাজের দিকে তাকাল, বলল, তুমি কি পাগল হয়েছ শাহনাজ আপু? একবার চেষ্টা করেছিলাম। স্যার মনে করেছে আমি তার সাথে মশকরা করছি, তারপর আমাকে ধরে সে কী পিটুনি!

শাহনাজ মাথা নাড়ল, তার হঠাৎ মোবারক আলী স্যারের কথা মনে পড়ে গেল। স্যার আশপাশে নেই জেনেও সে হঠাৎ কেমন জানি শিউরে ওঠে। ক্যাপ্টেন ডাবলু একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তবে লান্টুকে বললে সে খুব মন দিয়ে শোনে। কোনো আপত্তি করে না। বেশিক্ষণ বললে শুধু ঘুমিয়ে যায়, এইজন্যে একটানা বেশিক্ষণ বলা যায় না।

শাহনাজ কী বলবে বুঝতে পারল না। দশজন থেকে আলাদা হওয়ার মনে হয় খুব বড় সমস্যা। তার হঠাৎ এই ছোট বিজ্ঞানীটির জন্য একরকম মায়া হতে থাকে।

সকালবেলা শাহনাজের ঘুম ভাঙল এক ধরনের মনখারাপ ভাব নিয়ে। এখানে সে বেড়াতে এসেছিল আনন্দ করার জন্য এখন বোঝাই যাচ্ছে আনন্দ দূরে থাকুক, সময় কাটানো নিয়ে সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। মন ভালো থাকলে যেটাই করা যায় তাতেই আনন্দ হয়, আর মন খারাপ থাকলেই কিছুই করতে ভালো লাগে না। এখানে আসার সময় এতগুলো মজার মজার বই নিয়ে এসেছে, এখন কোনোটাই খুলে দেখতে ইচ্ছে করছে না। সোমাকে যদি হাসপাতালেই থাকতে হয় তা হলে শাহনাজদের তো আর একা একা বাসায় থাকার কোনো কারণ নেই। কীভাবে ফিরে যাবে ইমতিয়াজের সাথে কথা বলে সেটা ঠিক করতে হবে পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করে শাহনাজের আরো বেশি মনখারাপ হয়ে গেল।

ঘুম থেকে উঠে নাশতা করার সময় শাহনাজ আবিষ্কার করল ইমতিয়াজ কোথায় জানি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ নেই জেনেও শাহনাজ জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া, তুমি কোথায় যাচ্ছ?

উত্তর না দিয়ে মুখ ভেংচে টিটকারি করে কিছু একটা বলবে ভেবেছিল কিন্তু শাহনাজকে অবাক করে দিয়ে ইমতিয়াজ প্রশ্নের উত্তর দিল। বলল, ঝরনাটা নিজের চোখে দেখে আসতে চাই। জলজ্যান্ত একটা ঝরনা কীভাবে উধাও হতে পারে ইনভেস্টিগেট করা দরকার। মুখে খুব একটা গভীর ভাব করে বলল, মনে হয় কোনো জিওলজিক্যাল একটিভিটি হচ্ছে। দেখে আসি।

ইমতিয়াজের প্রস্তুতি দেখে অবশ্য মনে হল সে দুই মাইল দূরে একটা ঝরনা দেখতে যাচ্ছে না, মরুভূমি বন প্রান্তর সমুদ্র পার হয়ে আফ্রিকার জঙ্গলে অভিযান করতে যাচ্ছে। একটা ব্যাক প্যাকে তার জন্য দুইটা স্যান্ডুউইচ, দুইটা কোল্ড ড্রিংক এবং কিছু ফলমূল দিতে হল। ব্যান্ডেজ, এন্টিসেপটিক লোশন, মাথাব্যথার ট্যাবলেট, ছুরি, নাইলনের দড়ি কিছুই বাকি থাকল না। টি–শার্টের ওপর সোয়েটার, তার ওপর জ্যাকেট, মাথায় বেসবল ক্যাপ, পায়ে টেনিস শু–এক কথায় পুরোপুরি অভিযাত্রী। রওনা দেওয়ার সময় অবশ্য কাজের ছেলেটাকে সাথে সাথে যেতে হল কারণ ইমতিয়াজের নিজের দুই মাইল ব্যাক প্যাক টেনে নেওয়ার শক্তি নেই এবং এই নির্জন জংগুলে জায়গায় যদি বাঘ–ভালুক তাকে খেয়ে ফেলে। সেটা নিয়েও একটা ভয় রয়েছে।

ইমতিয়াজ চলে যাবার পর শাহনাজ সোমার খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করল। কোনো একটি বিচিত্র কারণে চা–বাগানে টেলিফোনের অবস্থা খুব ভালো না। সোমাদের বাসায় যেটা আছে সেটা দিয়েও খুব সহজে কোথাও ডায়াল করা যায় না। সোমা যে হাসপাতালে আছে সেটার টেলিফোন নম্বরটাও জানা নেই–ইচ্ছে থাকলেও পেঁজ নিতে পারবে না। চা–বাগানের একটা। বড় ফ্যাক্টরি আছে, সেখানে অনেকে আছেন, তাদের সাথে কথা বললে হয়তো কেউ খোঁজ দিতে পারবে। শাহনাজ দুপুরবেলা একবার ধোঁজ নেওয়ার জন্য বের হবে বলে ঠিক করল।

শাহনাজের হিসাব অনুযায়ী ইমতিয়াজ ফিরে আসতে আসতে একেবারে বিকেল হয়ে যাবার কথা–শহুরে আঁতেল ধরনের মানুষেরা আসলে দুর্বল প্রকৃতির হয়, সিগারেট খেয়ে ফুসফুঁসের বারোটা বাজিয়ে রাখে বলে হাঁটাহাঁটি করতে পারে না। পাহাড়ি জঙ্গলের পথে দুই মাইল হেঁটে যেতে এবং ফিরে আসতে ইমতিয়াজের একেবারে বারোটা বেজে যাবে– কাজেই সে যে বেলা ডুবে যাবার আগে ফিরে আসতে পারবে না, সে ব্যাপারে শাহনাজের কোনো সন্দেহই ছিল না। ফিরে এসেও সে যে এই দুই মাইল হেঁটে যাওয়া নিয়ে এমন বিশাল একটা গল্প ফেঁদে বসবে শাহনাজ সেটা নিয়েও একেবারে নিশ্চিত ছিল।

কিন্তু আসলে যেটা ঘটল সেটার জন্য শাহনাজ একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। ইমতিয়াজ। ফিরে এল দুপুরের আগেই এবং যখন সে ঘরে এসে ঢুকেছে তখন তাকে দেখলে যে–কেউ বলবে সে বুঝি পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে। উত্তেজনায় সে কথাই বলতে পারছিল না। কাজেই কাজের ছেলেটার কাছে জিজ্ঞেস করতে হল। কিন্তু সে মাথা চুলকে জানাল যে ইমতিয়াজ কী বিষয় নিয়ে এত উত্তেজিত হয়ে আছে সে বুঝতে পারছে না। তার ধারণা ইমতিয়াজ সেখানে কিছু একটা দেখে এসেছে। শাহনাজ খুব কৌতূহল নিয়ে ইমতিয়াজকে জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া তুমি কী দেখেছ?

ইমতিয়াজ উত্তর না দিয়ে বুকে থাবা দিয়ে বলল, আমি বিখ্যাত হয়ে গেছি। ওয়ার্ল্ড ফেমাস। কেউ আর আটকাতে পারবে না।

পোস্ট মডার্ন কবিতা লিখে ইমতিয়াজ একদিন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও লজ্জার মাঝে ফেলে দেবে এ রকম একটা কথা শাহনাজ অবশ্য আগেও শুনেছে কিন্তু এটি মনে হয় অন্য ব্যাপার। সে জানতে চাইল, কী জন্য তুমি বিখ্যাত হয়ে গেছ?

আমি এমন জিনিস আবিষ্কার করেছি যেটা সারা পৃথিবীর কেউ কোনোদিন দেখে নাই, কোনোদিন কল্পনাও করে নাই। শুধু স্বপ্ন দেখেছে! ইমতিয়াজ এই পর্যায়ে উঠে দাঁড়িয়ে একপাক ভরতনাট্যম কিংবা খেমটা নাচ দিয়ে চিৎকার করে বলল, এখন আমি বি.বি.সির সাথে ইন্টারভিউ দেব, সি. এন. এন.–এর সাথে ইন্টারভিউ দেব। টাইম, নিউজউইকের কভারে আমার ছবি ছাপা হবে, রিডার্স ডাইজেস্টে আমার ওপর লেখা বের হবে

ইমতিয়াজ কথা বন্ধ করে দুই হাত উপরে তুলে ইয়াহু বলে একটা চিৎকার দিল।

শাহনাজের হঠাৎ সন্দেহ হতে থাকে ইমতিয়াজকে পথেঘাটে কেউ কোনো ড্রাগ খাইয়ে দিয়েছে কি না। সে কাজের ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, ভাইয়াকে কেউ কিছু খাইয়ে দিয়েছে নাকি? ধুতুরার বীজ না হলে অন্য কিছু?

কাজের ছেলেটা ফ্যাকাসে মূর্খে বলল, সেটা তো জানি না, আমি নিচে ছিলাম। স্যার একা টিলার উপরে উঠলেন, তারপর থেকে এইরকম অবস্থা।

অন্য কোনো সময় হলে ওদের এই কথা শুনে ইমতিয়াজ রেগেমেগে চিৎকার করে একটা কাণ্ড করত, এখন বরং হা হা করে হেসে উঠল। বলল, ভাবছিস আমি নেশা করছি? শুনে রাখ এইটা এমন ব্যাপার, কেউ যদি শোনে তার নেশা জন্মের মতো ছুটে যাবে।

কেন? কী হয়েছে?

সেই পাহাড়ে আমি কী দেখেছি জানিস?

কী?

একটা জলজ্যান্ত স্পেসশিপ!

শাহনাজ ভুরু কুঁচকে বলল, কী বললে? স্পেসশিপ?

হ্যাঁ। এরিখ ফন দানিকেন যেটা বলেছিলেন সেটাই মনে হয় সত্যি। ইমতিয়াজের গলা হঠাৎ আবেগে কেঁপে ওঠে, এই পৃথিবীর মানুষেরা হয়তো এসেছে গ্রহান্তর থেকে এই চা–বাগানে পাহাড়ের নিচে লুকিয়ে আছে সেই মহাকাশযান–পৃথিবীর ইতিহাস হয়তো আবার নতুন করে লিখতে হবে, সেই ইতিহাসের মাঝে যে নাম অক্ষয় হয়ে থাকবে সেটা হচ্ছে– ইমতিয়াজ ধুমসো গরিলার মতো বুকে থাবা দিয়ে বলল, ইমতিয়াজ আহমেদ।

শাহনাজ এখনো পুরো ব্যাপারটি বুঝতে পারছে না। সত্যি সত্যি যদি ইমতিয়াজ একটা স্পেসশিপ খুঁজে পায় সেটা নিশ্চয়ই সাংঘাতিক একটা ব্যাপার, কিন্তু ইমতিয়াজের এই নর্তনকুর্দন দেখে কোনোকিছুই ঠিকভাবে বুঝতে পারছে না। পুরো ব্যাপারটাই নিশ্চয়ই এক ধরনের বিকট রসিকতা কিন্তু ইমতিয়াজকে দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই।

ইমতিয়াজ বুকে থাবা দিয়ে বলল, খালি কি বিখ্যাত হব? নো–ও–ও–ও–ও! নো নো–নো! খ্যাতির সাথে আসবে ডলার। সবুজ সবুজ ডলার। বস্তা বস্তা ডলার! এই বান্দা বড়লোক হয়ে যাবে। বিখ্যাত এবং বড়লোক। কোথায় সেটল করব জানিস? মায়ামিতে! গরমের সময় চলে যাব সিয়াটল!

শাহনাজ ইমতিয়াজের প্রলাপের মাঝে একটু অর্থ খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকে। যেরকম উত্তেজিত হয়েছে, মনে হয় আসলেই কিছু একটা দেখেছে। চা–বাগানের কাছে। পাহাড়ের নিচে স্পেসশিপ খুঁজে পাওয়া ব্যাপারটি প্রায় অসম্ভব, কিন্তু সত্যিই যদি হয়ে থাকে? শাহনাজ ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল, ভাইয়া, তুমি কেমন করে জান সেটা স্পেসশিপ?।

আমি জানি। তুই স্পেসশিপ দেখলে চিনতে পারবি না, কিন্তু আমি পারি। ইমতিয়াজ আবার বুকে থাবা দিল। যেভাবে খানিকক্ষণ পরপর বুকে থাবা দিচ্ছে, বুকের পাজরের এক আধটা হাড় না আবার ভেঙে যায়।

আমাকে নিয়ে যাবে সেখানে? আমিও দেখে আসি?

হঠাৎ করে ইমতিয়াজ চুপ করে গেল, তার চোখদুটো ছোট হয়ে যায়, আর সে এক ধরনের কুটিল চোখে শাহনাজের দিকে তাকাল। কিছুএকটা ষড়যন্ত্র ধরে ফেলেছে এ রকম ভাব করে বলল, ও! আমাকে তুই বেকুব পেয়েছিস? ভেবেছিস আমি কিছু বুঝি না?

শাহনাজ অবাক হয়ে বলল, তুমি কী বোঝ না?

তোরও শখ হয়েছে বিখ্যাত হবার টাইম নিউজউইকের কভার? ইমতিয়াজ বাংলা সিনেমার ভিলেনদের মতো পা দাপিয়ে চিৎকার করে বলল, নেভার। তারপর বুকে আঙুল দিয়ে বলল, আমি এটা আবিষ্কার করেছি, বিখ্যাত হব আমি। আমি। আমি আমি। আমি একা। বুঝেছিস?

শাহনাজের সন্দেহ হতে থাকে যে তার ভাইয়ের মাথাটা মনে হয় একটু খারাপই হয়ে গেছে। সে অবাক হয়ে ইমতিয়াজের দিকে তাকাল। ইমতিয়াজ আঙুল দিয়ে চুল ঠিক করে বলল, এখন আমি সেখানে ফিরে যাব ক্যামেরা নিয়ে। সেই ক্যামেরায় ছবি তুলে রাখব। এক–একটা ছবি বিক্রি হবে এক মিলিয়ন ডলারে। বুঝেছিস?

কিন্তু তুমি কি ক্যামেরা এনেছ?

কিন্তু তুই তো এনেছিস? ইমতিয়াজ চোখ লাল করে বলল, আনিস নি?

হ্যাঁ।

দে ক্যামেরা বের করে এক্ষুনি। না হলে খুন করে ফেলব।

শাহনাজ কোনো কথা বলল না। তাড়াতাড়ি সুটকেস খুলে আঘার ক্যামেরাটা বের করে দিল। ইমতিয়াজ সেটা ছোঁ মেরে নিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, পৃথিবীর ইতিহাস নতুন করে লিখবে এই ইমতিয়াজ আহমেদ!

ইমতিয়াজ ক্যামেরাটা নিয়েই ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল। শাহনাজ জিজ্ঞেস করল, ছবি তুলে তুমি কি এখানে আসবে? নাকি সোজাসুজি ঢাকা চলে যাবে?

সোজাসুজি ঢাকা যাব, কেন?

আমিও ঢাকা যাব।

ইমতিয়াজ চিড়বিড় করে তেলে–বেগুনে জ্বলে উঠে বলল, এখন আমার আর কোনো কাজ নেই তোকে ঘাড়ে করে ঢাকা নিয়ে যাই।

তা হলে আমি ঢাকা যাব কেমন করে?

সেটার আমি কী জানি? তোকে এখানে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল, পৌঁছে দিয়ে গেছি। ব্যস আমার কাজ শেষ।

শাহনাজ রাগের চোটে কী বলবে বুঝতে পারল না। অনেক কষ্ট করে বলল, ভাইয়া, এখানে আর কেউ নেই। চাচা–চাচি কবে আসবে আমি কিছু জানি না–

তোর সমস্যাটা কী? বাসায় কাজের মানুষ আছে, বুয়া আছে, তোকে দেখেশুনে রাখবে।

ঐ পাহাড়ে গিয়ে তোমার কোনো বিপদ–আপদ হয় কি না সেটা কীভাবে বুঝব?

হবে না।

যদি হয় তা হলে তো জানতেও পারব না।

ইমতিয়াজ মুখ ভেংচে বলল, আমার জন্য তোর যদি এত দরদ তা হলে ঢাকায় ফোন করে খোঁজ নিস।

এই চা–বাগানের ফোন কাজ করে না, কিছু না–

ইমতিয়াজ ধমক দিয়ে বলল, এখন আমি তোর জন্য এখানে মোবাইল ফোনের অফিস বসাব নাকি?

কাজেই ইমতিয়াজ দুপুরবেলা পাহাড়ের উদ্দেশে রওনা দিল। যাবার আগে শেষ কথাটি ছিল বিবিসি টেলিভিশনটা ধরে রাখতে। পরদিন সেখানে তাকে নাকি দেখা যাবে।

.

রাতটা শাহনাজ একটু দুশ্চিন্তা নিয়ে কাটাল। ইমতিয়াজ বিখ্যাত হয়ে কোটি কোটি ডলারের মালিক হয়ে গেলে তার কোনো আপত্তি নেই। এক বাসায় থাকতে হলে হয়তো জীবনটা বিষাক্ত করে দিত, কিন্তু নিজেই বলেছে আমেরিকা গিয়ে থাকবে, কাজেই একদিক দিয়ে ভালোই। কিন্তু একা একা কোনো পাহাড়ে গিয়ে, কি স্পেসশিপের ছবি তুলে ফিরে যেতে যদি কোনো বিপদে পড়ে, কেউ তো জানতেও পারবে না। শাহনাজ স্বীকার করছে। তার এই ভাইয়ের জন্য বুকের মাঝে ভালবাসার বান ছুটছে না, কিন্তু সবকিছু নিরাপদ আছে–মনের শান্তির জন্য এইটুকু তো জানা দরকার।

সকালে উঠে সে ঢাকায় তাদের বাসায় ফোন করার চেষ্টা করল, কিন্তু চা–বাগানের টেলিফোন কানেকশন কিছুতেই বাগান থেকে বের হতে পারল না। কী করবে সে ভেবে পাচ্ছিল না। বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে বসে চিন্তা করছে, তখন হঠাৎ সে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে দেখতে পেল, লম্বা লোহার মতো একটা জিনিসের আগায় চ্যাপ্টা থালার মতো একটা জিনিস লাগানো, একপাশে একটা ছোট বাক্সের মতো, সেখান থেকে কিছু তার হেডফোনে এসে লেগেছে, গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা শুনতে শুনতে হেঁটে যাচ্ছে। শাহনাজ উঠে দাঁড়িয়ে ডাকল, ক্যাপ্টেন ডাবলু।

প্রথম ডাকে শুনতে পেল না, দ্বিতীয় ডাকে ঘুরে শাহনাজের দিকে তাকাল। তাকে দেখে খুশি হয়ে সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বলল, শাহনাজ আপু! এই দেখ মেটাল ডিটেক্টর তৈরি করেছি।

মেটাল ডিটেক্টর? কী হয় এটা দিয়ে?

মাটির নিচে কোনো গুপ্তধন থাকলে খুঁজে বের করে ফেলব।

খুঁজে পেয়েছ কিছু?

এখনো পাই নাই, দুইটা পেরেক আর একটা কৌটার মুখ পেয়েছি।

কথা বলতে বলতে শাহনাজ বারান্দা থেকে নেমে রাস্তায় ক্যাপ্টেন ডাবলুর কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল এবং হঠাৎ করে তার একটা কথা মনে হল, ক্যাপ্টেন ডাবলুকে নিয়ে সে কি ঝরনার কাছে রহস্যময় স্পেসশিপটা দেখে আসতে পারে না?

ক্যাপ্টেন ডাবলু কান থেকে হেডফোন খুলে তার মেটাল ডিটেক্টরের সুইচ অফ করে জিজ্ঞেস করল, শাহনাজ আপু, তুমি আর কত দিন আমাদের চা–বাগানে থাকবে?

শাহনাজ ইতস্তত করে বলল, আমি আসলে জানি না। আমি তো সোমা আপুর কাছে বেড়াতে এসেছিলাম কিন্তু সেই সোমা আপুই হাসপাতালে। আমি এখানে থেকে কী করব?

ক্যাপ্টেন ডাবলু ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারল বলে মনে হল না, তবে সে বেশি মাথা ঘামাল না, মাথা নেড়ে বলল, যদি চলেই যাও তা হলে এখানে দেখার মতো যেসব জিনিস আছে সেগুলো দেখে যাও।

কী আছে দেখার মতো?

ফ্যাক্টরিটা দারুণ। গ্যাস দিয়ে যে হিটার তৈরি করেছে সেটা একেবারে জেট ইঞ্জিনের মতো। ইস্! আমার যদি একটা থাকত!

থাকলে কী করতে?

কত কী করা যেত। একটা হোভার ক্র্যাফটই কাতাম।

আর কী আছে দেখার মতো?

ক্যাপ্টেন ডাবলু একটু চিন্তা করে বলল, বাগানের একপাশে একটা ছোট নদীর মতো আছে, তার পাশে একটা পেট্রিফাইড উড আছে। বিশাল গাছ ফসিল হয়ে আছে। আমি একটুকরা ভেঙে এনেছি, কার্বন ডেটিং করতে পারলে কত পুরোনো বের করতে পারতাম।

শাহনাজ ক্যাপ্টেন ডাবলুর সব ঠিক বুঝতে পারল না, কিন্তু সেটা আর প্রকাশ করল; জিজ্ঞেস করল, এখানে আর কী কী দেখার আছে? একটা নাকি ঝরনা আছে?

হ্যাঁ একটা ঝরনা আছে। এক শ তেপ্পান্ন মিটার উপর থেকে পানি পড়ছে।

এক শ তেপ্পান্ন?

হ্যাঁ আমি মেপেছি।

শাহনাজ ক্যাপ্টেন ডাবলুকে একনজর দেখে বলল, তুমি জান সেই ঝরনাটা অদৃশ্য হয়ে গেছে?

ক্যাপ্টেন ডাবলু অবাক হয়ে শাহনাজের দিকে তাকাল, অদৃশ্য হয়ে গেছে!

হ্যাঁ। আমার ভাই দেখতে গিয়েছিল, যেখানে ঝরনাটা ছিল সেখানে ঝরনাটা নাই।

অসম্ভব। ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নাড়ল, এই ঝরনাটায় সারা বছর পানি থাকে।

বলা ঠিক হবে কি না শাহনাজ বুঝতে পারল না, কিন্তু না বলেও পারল না, গলা নামিয়ে বলল, ঐ ঝরনার কাছে নাকি একটা স্পেসশিপ পাওয়া গেছে।

স্পেসশিপ নিয়ে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে একটুও উত্তেজিত হতে দেখা গেল না। সে মনে মনে কী একটা হিসাব করে বলল, প্রতি সেকেন্ড প্রায় ষোল শ কিউবিক ফুট পানি আসে। এত পানি যদি ঝরনা দিয়ে না এসে অন্য কোথাও যায়, সেখানে পানি জমে যাবে! ঝরনা। বন্ধ হতে পারে না।

কিন্তু স্পেসশিপ

পৃথিবীতে কমিউনিকেশান্স এত ভালো হয়েছে যে কারো চোখকে ফাঁকি দিয়ে এখানে স্পেসশিপ আসতে পারবে না। যদি সত্যি সত্যি এখানে স্পেসশিপ এসে হাজির হয় তা হলে সারা পৃথিবী থেকে সায়েন্টিস্টরা হাজির হবে।

শাহনাজ আবার চেষ্টা করল, কিন্তু আমার ভাই বলেছে সে নিজের চোখে দেখেছে।

অন্য কিছু দেখেছেন মনে হয়। ক্যাপ্টেন ডাবলু তার মেটাল ডিটেক্টরটা কাঁধে নিয়ে বলল, যাই, দেখে আসি।

কী দেখে আসবে?

ঝরনাটা। পানি কোথায় গেছে?

আমিও যাব তোমার সাথে।

চল।

শাহনাজ একটু ইতস্তত করে বলল, তোমার আম্মা–আব্বা আবার কিছু বলবেন না তো?

ঝরনাতে গেলে কিছু বলবেন না, কিন্তু

কিন্তু কী?

না থাক! শুনলে তুমি আবার হাসাহাসি করবে। প্যারাসুটের দড়িটা যে পেঁচিয়ে যাবে সেটা কি আমি জানতাম?

ঝরনার সাথে প্যারাসুটের দড়ির কী সম্পর্ক, প্যারাসুটের দড়িটা কোথায় পেঁচিয়ে গেল, কেন সেটা হাসাহাসির ব্যাপার, আর সত্যি যদি হাসাহাসির ব্যাপার হয় তা হলে ক্যাপ্টেন ডাবলুর আব্বা–আম্মা কেন রাগারাগি করলেন শাহনাজ কিছুই বুঝতে পারল। কিন্তু শাহনাজ এই মুহূর্তে সেটা নিয়ে আর কথা বাড়াল না। বলল, চল তা হলে যাই।

ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, তুমি একটু দাড়াও, আমি বাসা থেকে আমার টেস্টিং প্যাক নিয়ে আসি।

টেষ্টিং প্যাক?

হ্যাঁ।

কী আছে তোমার টেষ্টিং প্যাকে?

টেষ্ট করতে যা যা লাগে। মাল্টিমিটার থেকে শুরু করে বাইনোকুলার। বাইরে গেলে আমি সাথে নিয়ে যাই।

ঠিক আছে তা হলে, তুমি নিয়ে আস। আমিও রেডি হয়ে নিই।

শাহনাজও তার ব্যাগটা নিয়ে নেয়। ক্যাপ্টেন ডাবলুর মতো পুরোপুরি টেস্টিং প্যাক তার নেই, কিন্তু খাবার জন্য দুই–একটা স্যান্ডউইচ, বিস্কুটের প্যাকেট, কয়েকটা কমলা, বোতল ভরা পানি, ছোট একটা তোয়ালে, মাথাব্যথার ওষুধ, এন্টিসেপটিক টেপ এবং ছোট একটা নোটবই আর পেন্সিল নিয়ে নিল।

কিছুক্ষণের মাঝেই ক্যাপ্টেন ডাবলু এসে হাজির হল। তার টেষ্টিং প্যাক দেখে শাহনাজের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়। বিশাল একটা ব্যাক প্যাক একেবারে নানা জিনিসপত্র দিয়ে ঠাসা! জিনিসপত্রের ভারে ক্যাপ্টেন ডাবলু একেবারে কুজো হয়ে গেছে, একটা মোটা লাঠি ধরে কোনোমতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শাহনাজ চোখ কপালে তুলে বলল, এতবড় বোঝা নিয়ে তুমি কেমন করে যাবে?

ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নেড়ে বলল, যেতে পারব। আস্তে আস্তে যেতে হবে। পাওয়ার আর এনার্জির ব্যাপার। অল্প করে পাওয়ার বেশি সময় ধরে খরচ করলেই হবে।

এক কাজ করা যাক, তোমার কিছু জিনিস আমার ব্যাগের ভিতর দিয়ে দাও।

না, না। আমার সব টেষ্টিং যন্ত্রপাতি এক জায়গায় থাকুক।

শাহনাজ শুনেছে বিজ্ঞানীরা নাকি নিজেদের যন্ত্রপাতি নিয়ে খুব খুঁতখুঁতে হয় তাই সে আর জোর করল না। বলল, ঠিক আছে। তুমি কিছুক্ষণ নাও, তারপর আমি নেব।

ক্যাপ্টেন ডাবলুর কথাটা একেবারে অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। সত্যিই তারা দেখতে দেখতেই পৌঁছাল। নির্জন পথটায় এত সুন্দর ছোট ছোট টিলা, গাছপালা, ফুল, লতাপাতা যে তার সৌন্দর্য দেখতে দেখতেই পৌঁছে গেল। ক্যাপ্টেন ডাবলুর টেস্ট প্যাকটা দুজনে মিলে টেনে নিতে গিয়ে অবশ্য একেবারে কালো ঘাম ছুটে গেল। ঝরনার কাছাকাছি। পৌঁছানোর অনেক আগেই ক্যাপ্টেন ডাবলুর মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। সে মাথা নেড়ে বলল, শাহনাজ আপু, তুমি ঠিকই বলেছ। ঝরনাটা নেই। ঝরনা থাকলে এখান থেকে শব্দ শোনা যেত।

তারা আরো কাছে এগিয়ে যায়, জায়গাটা ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে উঠেছে। আশপাশে অনেক ফার্ন এবং শ্যাওলা। ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, ঝরনার পানির জন্য এখানে স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকে তো, তাই এখানে এ রকম গাছ হয়েছিল। দেখেছ, শ্যাওলাগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে?

ক্যাপ্টেন ডাবলুর টেস্ট প্যাক টেনে টেনে শাহনাজ শেষ পর্যন্ত একটা ফাঁকা। জায়গায় এসে দাঁড়াল। ক্যাপ্টেন ডাবলু দাঁড়িয়ে সামনে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, শাহনাজ আপু, এই যে এখানে ঝরনাটা ছিল। ঐ উপর থেকে ঝরনার পানি এসে পড়ত। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, একটা জিনিস জান? সামনের পাহাড়টা অনেক উঁচু হয়ে গেছে!

শাহনাজ অবাক হয়ে বলল, পাহাড় উঁচু হয়ে গেছে?

হ্যাঁ। আগেরবার মেপেছিলাম, এটা ছিল এক শ তেপ্পান্ন মিটার উঁচু। এখন মেপে দেখি কত হয়?

ক্যাপ্টেন ডাবলু তার টেস্ট প্যাক খুলে সেখান থেকে জ্যামিতি বাক্সের চাঁদা লাগানো একটা জিনিস বের করল, একটা টেপ দিয়ে পাহাড়ের গোড়া থেকে কিছু মাপামাপি করল, তারপর তার উচ্চতা মাপার যন্ত্রটা চোখে লাগিয়ে একটা কিছু মেপে কাগজে হিসাব করতে শুরু করল। শাহনাজ বুঝতে পারল ত্রিকোণোমিতি ব্যবহার করে উচ্চতা মাপছে–সে নিজেও মনে মনে হিসাব করতে থাকে, কিন্তু তার আগেই ক্যাপ্টেন ডাবলু ঘোষণা করল, দুই শ এগার মিটার। তার অর্থ পাহাড়টা আটান্ন মিটার উঁচু হয়ে গেছে! ঝরনার পানি আসবে কেমন করে!

একটা পাহাড় উঁচু হয়ে যায় কেমন করে? শাহনাজ অবাক হয়ে বলল, পাহাড় তো আর গরু বাছুর না যে আগে বসে ছিল এখন উঠে দাঁড়িয়েছে।

ক্যাপ্টেন ডাবলু মুখ গম্ভীর করে বলল, ভূমিকম্প হলে হয়।

এখানে কি কোনো ভূমিকম্প হয়েছে?

হয় নাই। হলেও সেটা রিক্টর স্কেলে পাঁচের কম। আমার ভূমিকম্প মাপার যন্ত্র রিক্টর স্কেলে পাঁচের কম ভূমিকম্প মাপতে পারে না।

শাহনাজ আবার মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রিক্টর স্কেলটা কী সেটা সম্পর্কে তার ভাসা–ভাসা একটা ধারণা আছে অথচ এই ছেলে নাকি রিক্টর স্কেলে ভূমিকম্প মাপার যন্ত্র পর্যন্ত তৈরি করে ফেলেছে! পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে শাহনাজ বলল, ভাইয়া বলেছিল এখানে নাকি একটা স্পেসশিপ নেমেছে। কিছু তো দেখতে পাচ্ছি না।

না। ক্যাপ্টেন ডাবলু তার টেস্ট প্যাক থেকে বাইনোকুলার বের করে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা দেখতে দেখতে বলল, তবে পাহাড়ের মাঝে বড় বড় ফাটল দেখা যাচ্ছে। পাথর পর্যন্ত ফেটে গেছে। কিছু একটা হয়ে গেছে এখানে।

শাহনাজ ক্যাপ্টেন ডাবলুর কাছ থেকে বাইনোকুলারটা নিয়ে পাহাড়ের দিকে তাকাল। সত্যি সত্যি পাহাড়ের গায়ে বড় বড় ফাটল। ফাটলগুলো একেবারে নতুন তৈরি হয়েছে। পুরোনো হলে গাছগাছালি জন্মে এতদিনে ঢাকা পড়ে যেত। ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, উপরে গিয়ে দেখতে হবে।

শাহনাজের হঠাৎ কেমন জানি একটু ভয় ভয় করতে থাকে, কী আছে উপরে? পরমূহুর্তে তার ইমতিয়াজের কথা মনে পড়ল, ইমতিয়াজের মতো ভীতু মানুষ যদি একা এখানে আসতে পারে তা হলে মনে হয় ভয়ের কিছু নেই। সে বলল, চল যাই। তারপর ক্যাপ্টেন ডাবলুর ভয়াবহ টেষ্ট প্যাকটার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বলল, এটা কি সাথে নিতে হবে?

না। এটা রেখে যাই, শুধু ভিতর থেকে কিছু জিনিস বের করে নিই।

ক্যাপ্টেন ডাবল যেসব জিনিস বের করল—-দুটি ওয়াকিটকি, নাইলনের দড়ি, সুইস আর্মি চাকু, ম্যাগনিফাইং গ্লাস, বড় টর্চলাইট, ছোট শাবল–সব মিলিয়ে বোঝাটি অবশ্য খুব ছোট হল না। আগে একটা ব্যাগে ছিল বলে টেনে নেওয়া সোজা ছিল, এখন জিনিসগুলো শরীরের এখানে–সেখানে ঝুলিয়ে পকেটে, হাতে করে নিতে হল বলে একদিক দিয়ে বরং একটু ঝামেলাই হল। রওনা দেবার আগে শাহনাজ তার স্যান্ডউইচগুলো বের করল। দেখে ক্যাপ্টেন ডাবলুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আনন্দে চিৎকার করে বলল, তুমি খাবার এনেছ! আমি ভেবেছিলাম আজকে না–খেয়ে থাকতে হবে!

তোমার বুদ্ধিমতো খালি যন্ত্রপাতি আনলে না–খেয়েই থাকতে হত।

ক্যাপ্টেন ডাবলু স্যান্ডউইচে বড় একটা কামড় দিয়ে বলল, মানুষের শরীরে যদি কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন না হয়ে নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশন হত তা হলে কী মজা হত, তাই না?

কী মজা হত?

অল্প একটু খেলেই সারা জীবন আর খেতে হত না। সেখান থেকেই ই ইকুয়েলস টু এম সি স্কয়ার হিসেবে কত শক্তি পাওয়া যেত!

নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশনের ব্যাপারগুলো শাহনাজ একটু জানে, তাই সে বলল, তা হলে তোমার স্যান্ডউইচ খেতে হত না। খেতে হত ইউরেনিয়াম ট্যাবলেট।

সাংঘাতিক একটা রসিকতা করেছে এ রকম একটা ভাব করে ক্যাপ্টেন ডাবলু হঠাৎ হা হা করে হাসতে শুরু করল। বিজ্ঞানের মানুষজন কোটাকে হাসির জিনিস বলে মনে করে সেটা বোঝা মুশকিল।

খাওয়া শেষ করে পানির বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি খেয়ে তারা রওনা দিল। পাথরে পা রেখে তারা উপরে উঠতে থাকে। সমান জায়গায় হাঁটা সহজ, কিন্তু উপরে ওঠা এত সহজ নয়, কিছুক্ষণেই দুজনে বড় বড় শ্বাস নিতে থাকে।

সামনে একটা সমতল জায়গায় বড় বড় কয়েকটা গাছ। গাছগুলোকে পাশ কাটিয়ে তারা আবার উপরে উঠতে শুরু করে। সামনে খানিকটা খাড়া জায়গা, এটাকে ঘিরে তারা ডানদিকে সরে গেল। পাথরে পা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা পাহাড়ের একটা বিশাল ফাটলের সামনে এসে দাঁড়াল। ফাটলটা কোথা থেকে এসেছে দেখার জন্য দুজনে এটার পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। সামনে একটা বড় ঝোঁপ, সেটাকে পাশ কাটিয়ে সামনে যেতেই ক্যাপ্টেন ডাবলু আর শাহনাজ একসাথে চিৎকার করে উঠল। তারা বিস্ফারিত চোখে দেখতে পেল পাহাড়ের বিশাল ফাটল থেকে একটা মহাকাশযান বের হয়ে আছে। শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলু দুজনেরই প্রথম প্রতিক্রিয়া হল ছুটে কোথাও লুকিয়ে যাওয়া, কিন্তু দুজনেই একেবারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারা নড়তে পারছিল না, বিশাল মহাকাশযানটি থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়া একেবারে অসম্ভব একটি ব্যাপার। দুজনে নিশ্বাস বন্ধ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। এবং শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন ডাব নাকমুখ দিয়ে বিচিত্র একটা শব্দ করে বলল, ডেঞ্জাস্টিক!

শাহনাজ ফিসফিস করে বলল, কী বললে?

সাংঘাবুলাস। ফাটাফাটিস্টিক। একবারে টেরিফেরিস্টিক!

শাহনাজ বুঝতে পারল এগুলো ক্যাপ্টেন ডাবলুর মুগ্ধ এবং প্রশংসাসূচক কথাবার্তা, সে কথাবার্তা বলতে বলতে চোখেমুখে বিস্ময় ফুটিয়ে আরো কয়েক পা এগিয়ে গেছে। শাহনাজ ভয়–পাওয়া গলায় বলল, বেশি কাছে যেও না ক্যাপ্টেন ডাবলু।

কিছু হবে না। ক্যাপ্টেন ডাবলু কাঁপা গলায় বলল, যারা এই ছ্যাড়াভাড়াস্টিক টেরিফেরিস্টিক ডেঞ্জাবুলাস স্পেসশিপ বানাতে পারে, তারা ইচ্ছা করলে আমাদের যা–খুশি তাই করতে পারে! ভয় পেয়ে লাভ কী?

ক্যাপ্টেন ডাবলু কয়েক পা এগিয়ে যায় এবং উপায় না দেখে শাহনাজও আরো কয়েক পা এগিয়ে যায়। হঠাৎ তার পায়ে কিছু একটা লাগল। শাহনাজ নিচু হয়ে তাকাতেই দেখতে পেল একটা ক্যামেরা। শাহনাজ সাবধানে ক্যামেরাটা তুলে নেয়। চিনতে কোনো অসুবিধে হয় না এটা তার আব্বার ক্যামেরা, ইমতিয়াজ গতকাল এটা নিয়ে ছবি তুলতে এসেছিল। ছবি তুলে নিশ্চয়ই ফিরে যেতে পারে নি, ফিরে যেতে পারলে ক্যামেরাসহই ফিরে যেত। বিখ্যাত হওয়ার জন্য ইমতিয়াজের এই ক্যামেরা ছবিগুলো দরকার।

শাহনাজ এবং ক্যাপ্টেন ডাবলু মুখ হাঁ করে মহাকাশযানটির দিকে তাকিয়ে রইল। কোনোকিছু দেখতে যে এত সুন্দর হতে পারে সেটি না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না। গোলাপফুল কিংবা সিনেমার নায়িকারা যেরকম সুন্দর হয়, এটা সেরকম সুন্দর না; এর সৌন্দর্যটা অন্যরকম। বিশাল একটা জটিল জিনিসকে একেবারে নিখুঁত করে তৈরি করার যে। সৌন্দর্য, এর ভিতরে সেইরকম সৌন্দর্য। পৃথিবীর সব যন্ত্রপাতির ভিতরে এক ধরনের মিল রয়েছে। এই মহাকাশযানটির মাঝে সেই যন্ত্রপাতির কোনো মিল নেই। এটি দেখলে যতটুকু যন্ত্রপাতি বলে মনে হয় তার থেকে বেশি মনে হয় যেন এক ধরনের অত্যন্ত আধুনিক ভাস্কর্য–কিন্তু একনজর দেখলেই বোঝা যায় যে আসলে এটি ভাস্কর্য নয়, এটি একটি মহাকাশযান।

সূর্যের আলো মহাকাশযানের যে অংশটুকুতে পড়েছে সেই অংশটুকু চকচক করছে এবং সেখান থেকে আলোর বর্ণালি ছড়িয়ে পড়ছে। পাহাড়ের ভিতরের অংশটুকু বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু মহাকাশযানের সেই অংশটুকুও যে একই রকম চমকপ্রদ হবে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। শাহনাজ বুকের ভিতর থেকে একটা নিশ্বাস সাবধানে বের। করে দিয়ে বলল, এতবড় একটা স্পেসশিপ এই পাহাড়ের মাঝে এসে আছাড় খেয়ে পড়ল, কেউ টের পেল না?

না না না না না শাহনাজপু। ক্যাপ্টেন ডাবলু নিশ্চয়ই বাড়াবাড়ি উত্তেজিত, তা না হলে এক নিশ্বাসে এতগুলো না বলত না। শুধু তাই না, শাহনাজ আপু না বলে সেটাকে শর্টকাটে শাহনাজপু করে ফেলেছে। কিন্তু সেটা নিয়ে শাহনাজ এখন মাথা ঘামাল না। ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নেড়ে বলল, এই স্পেসশিপ বাইরে থেকে আছাড় খেয়ে পড়ে নাই। এতবড় একটা পাহাড় ফাটিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলে সারা এলাকার মানুষ টের পেতরিক্টর স্কেলে আট থেকে বেশি ভূমিকম্প হত!

তা হলে?

এটা আকাশ থেকে আসে নাই। আকাশ থেকে এসে পাহাড়ের ভিতরে ঢুকলে সামনের এই গাছগুলো আস্ত থাকতে পারত? পারত না। ভেঙেচুরে গুড়ো গুড়ো করে ফেলত।

শাহনাজ মাথা নাড়ল। ক্যাপ্টেন ডাবলু ঠিকই বলেছে, এটা আছাড় খেয়ে পড়লে সামনের এই বড় বড় গাছগুলো থাকত না। আশপাশে কোথাও কোনো ক্ষতি না করে এতবড় একটা স্পেসশিপ এই পাহাড়ের মাঝে ঢোকা অসম্ভব কিন্তু তারা নিজের চোখে দেখতে পারছে এটা ঢুকে গেছে! কীভাবে হল এটা?

ক্যাপ্টেন ডাবলু চকচকে চোখে বলল, বুঝতে পারছ না শাহনাজপু, এই মহাকাশযানটা বাইরে থেকে আসে নাই। এটা পাহাড়ের ভিতরেই ছিল, এখন পাহাড় ফেটে বের হয়ে আসছে!

ডিম ফেটে যেরকম বাচ্চা বের হয়ে আসে?

তুলনাটা শুনে ক্যাপ্টেন ডাবলু একটু হকচকিয়ে গেল। মাথা নেড়ে আমতা আমতা করে বলল, হ্যাঁ, অনেকটা ডিম থেকে বাচ্চা বের হওয়ার মতো।

তার মানে এটা জীবন্ত? ভাইয়াকে খেয়ে ফেলেছে?

ক্যাপ্টেন ডাবলু এবারে মাথা চুলকাতে শুরু করে। একটা স্পেসশিপ জীবন্ত, পাহাড়ের মতো দেখতে একটা ডিমের ভিতরে বড় হয়ে সেটা ডিম ফেটে বের হয়ে মানুষজনকে কপকপ করে খেয়ে ফেলছে, সেটা বিশ্বাস করা কঠিন। তারা দুজনেই স্পোশিপের দিকে তাকাল, বিচিত্র এই স্পেসশিপটিকে আর যাই হোক, জীবন্ত প্রাণী মনে হয় না। শাহনাজ বলল, এটা ভিতরে আস্তে আস্তে বড় বড় হয় নাই। এখানে হঠাৎ করে এসেছে। হঠাৎ করে এসেছে বলে ঝরনার পানি হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেছে।

ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নেড়ে বলল, ঠিকই বলেছ। এটা হঠাৎ করেই এসেছে। হঠাৎ করে এই পাহাড়ের নিচে হাজির হয়েছে, তাই কেউ এর কথা জানে না।

হঠাৎ করে আসা মানে কী? হঠাৎ করে তো কিছু আসে না। কোনো এক জায়গা থেকে আসতে হয়।

ক্যাপ্টেন ডাবলু আবার মাথা চুলকাতে শুরু করল। শাহনাজ লক্ষ করল তার সাথে পরিচয় হবার পর এই প্রথমবার অল্প সময়ের মাঝে তাকে কোনো একটা প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য মাথা চুলকাতে হচ্ছে। ক্যাপ্টেন ডাবলু অনেকটা জোরে জোরে চিন্তা করার। মতো করে বলল, এটা এখানে ছিল না, হঠাৎ করে এখানে এসে হাজির হয়েছে। তার মানে–

শাহনাজ তীক্ষ্ণ চোখে ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকিয়ে রইল, তার মানে?

তার মানে হচ্ছে এটা সম্ভব হতে পারে শুধুমাত্র যদি—

শুধুমাত্র যদি?

ক্যাপ্টেন ডাবলু চোখ পিটপিট করে বলল, ওয়ার্মহোল্!

ওয়ার্মহোল?

হ্যাঁ।

সেটা কী?

স্পেস টাইম ফুটো করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অন্য সময়ে চলে যাওয়া!

তার মানে এটা অন্য কোনো জায়গা, অন্য কোনো সময় থেকে হঠাৎ করে এখানে চলে এসেছে?

ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। এইজন্য পৃথিবীর কেউ টের পায় নাই। অন্য কোনো গ্যালাক্সি থেকে লক্ষকোটি মাইল দূর থেকে এখানে এসে হাজির হয়েছে।

শাহনাজ ভুরু কুঁচকে ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকিয়ে রইল, সত্যি কি এ রকম সম্ভব?

ক্যাপ্টেন ডাবলু ঠোঁট উল্টে বলল, এক জায়গায় পড়েছি যে এটা সম্ভব। সত্যি–মিথ্যা জানি না। তবে

তবে কী?

তবে সেটা যারা করতে পারে তারা নিশ্চয়ই অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী। এত বুদ্ধিমান যে তাদের বুদ্ধির তুলনায় আমরা একেবারে পোকামাকড়ের মতো।

পোকামাকড়ের মতো?

হ্যাঁ। ক্যাপ্টেন ডাবলু খানিকক্ষণ চোখ কুঁচকে মহাকাশযানটার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর আস্তে আস্তে বলল, শাহনাজপু।

কী হল?

এই স্পেসশিপে যারা এসেছে তারা নিশ্চয়ই আমাদের থেকে অনেক অনেক উন্নত। তার মানে আমরা যদি স্পেসশিপের ভিতর যাই তাহলে তারা আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না।

শাহনাজ এতটা নিশ্চিত বোধ করল না, জিজ্ঞেস করল, কেন সেটা বলছ? একটু আগে না বললে আমরা পোকামাকড়ের মতো। পোকামাকড় দেখলে আমরা মেরে ফেলি না?

কে বলেছে মেরে ফেলি?

মশা? মশা তোমার গালে বসলে ঠাস করে এক চড়ে মেরে চ্যাটকা করে ফেল না?

তার কারণ মশা কামড় দেয়। আমরা কি কাউকে কামড় দিই? তা ছাড়া একটা প্রজাপতি দেখলে তুমি কি সেটা মার?

শাহনাজ মাথা নাড়ল, তা অবশ্য মারি না। তার কারণ প্রজাপতি সুন্দর। কিন্তু এই প্রাণীদের কাছে আমরা কি সুন্দর?

ক্যাপ্টেন ডাবলু শাহনাজের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে তো সুন্দরই লাগে! শুধু যদি নাকটা_

ফাজলেমি করবে না। এটা ফাজলেমির সময় না।

সাথে সাথে ক্যাপ্টেন ডাবলু গম্ভীর মুখে বলল, তা ঠিক।

তা হলে এখন কী করা যায়?

আমার মনে হয় আমাদের স্পেসশিপের ভিতরে ঢোকা উচিত।

সত্যি?

হ্যাঁ। আমি একটা বইয়ে পড়েছি একটা প্রাণী যখন খুব উন্নত হয় তখন তারা কাউকে মেরে ফেলে না। প্রাণী যত উন্নত হয় তার তত বেশি ভালবাসা হয়।

শাহনাজ একটা নিশ্বাস ফেলল, কে জানে সেটা সত্যি কি না। ভিন্ন জগতের উন্নত প্রাণীর ভালবাসা কেমন হয় কে জানে! হয়তো ধরে নিয়ে খাঁচায় রেখে দেওয়া হবে তাদের ভালবাসা, কিন্তু এখন সেটা নিয়ে আলোচনা করার সময় খুব বেশি নেই। ইমতিয়াজকে দেখা যাচ্ছে না–মনে হচ্ছে তাকে নিশ্চয়ই স্পেসশিপের ভিতরেই নিয়ে গেছে, সেটাও তো একবার দেখা দরকার। শাহনাজ ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকিয়ে বলল, চল তা হলে যাই। আমাদের কি সত্যি ভিতরে ঢুকতে দেবে?

দেবে না কেন? নিশ্চয়ই দেবে।

ক্যাপ্টেন ডাবলু আর শাহনাজ তখন গুটিগুটি এগিয়ে যেতে শুরু করে। মহাকাশযানটির কাছে এসে সাবধানে সেটাকে স্পর্শ করতেই তাদের শরীরে এক ধরনের শিহরন খেলে গেল। স্পেসশিপটি বিচিত্র এক ধরনের পদার্থ দিয়ে তৈরি। ভালো করে তাকালে দেখা যায় এক ধরনের নকশা কাটা রয়েছে। চকচকে মসৃণ দেহ, কিন্তু ঠিক ধাতব নয়। দুজনে হাত বুলিয়ে আরো ভিতরের দিকে যেতে শুরু করে। স্পেসশিপটি অস্বাভাবিক শক্ত, বিশাল পাহাড় ভেদ করে বের হয়ে এসেছে কিন্তু কোথাও সেই ভয়ঙ্কর ঘর্ষণের চিহ্ন নেই। দেখে মনে হয় এটা শক্ত পাথর ভেদ করে বের হয় নি, নরম কাদার মতো কিছু একটা ভেদ করে বের হয়েছে। মহাকাশযানের সূক্ষ্ম অংশগুলো পর্যন্ত শক্ত পাথরকে একেবারে মাখনের মতো। কেটে ফেলেছে। মহাকাশযানটি কী দিয়ে তৈরি কে জানে যে এত সহজে এত শক্ত পাথরকে এভাবে কেটে ফেলে?

শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলুর ধারণা ছিল মহাকাশযানের ভিতরে ঢোকা নিয়ে একটা সমস্যা হবে, কোনো ফুটো খুঁজে বের করে সাবধানে তার ভিতর দিয়ে ঢুকতে হবে। কিন্তু দেখা গেল কাছাকাছি একটা বড় দরজা হাট করে খোলা আছে। দুজনে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ভিতরে উঁকি দেয়। ঠিক কী কারণ কে জানে, ভিতরে ভালো করে দেখা যায় না। এমন নয় যে ভিতরে অন্ধকার বা অন্যকিছু, বেশ আলোকোজ্জ্বল, কিন্তু তবুও কেন জানি কোনোকিছুই স্পষ্ট নয়। ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, শাহনাজপু চল ভিতরে ঢুকি।

অন্য কোনো সময় হলে শাহনাজ কী করত জানে না, কিন্তু এখন আর অন্যকিছু করার উপায় নেই। সে বলল, চল।

দুজন প্রায় একসাথে ভিতরে পা দেয়–সাথে সাথে দুজনেরই বিচিত্র একটা অনুভূতি হল, মনে হল তারা বুঝি তেলতেলে ভিজে শীতল আঠালো একটা অদৃশ্য পরদার মাঝে আটকে গেছে–ছোট ছোট পোকা মাকড়সার জালে যেভাবে আটকে যায় অনেকটা সেরকম। হাত–পা ছুঁড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করে কোনোমতে তারা সেই পরদা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল এবং তখন মনে হল অদৃশ্য কোনো একটা শক্তি তাদের যেন শুষে ভিতরে টেনে নিল। শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলু দুজনে প্রায় একসাথে ভিতরে লুটোপুটি খেয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে। কোনোমতে দুজন সোজা হয়ে দাঁড়ায় এবং ভিতরে তাকিয়ে একেবারে হতচকিত হয়ে যায়। তাদের মনে হয় তারা বুঝি আদিগন্তহীন বিশাল একটা স্পেসশিপের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে যে জিনিসটি কয়েক শ মিটার ভিতরে সেটা কীভাবে এ রকম বড় হয়, দুজনের কেউই বুঝতে পারল না। ক্যাপ্টেন ডাবলু হাত দিয়ে তার চশমা ঠিক করতে করতে বলল, ও মাই মাই মাই–মাইগো মাই!

কথাটা নিশ্চয় অবাক হবার কথা, কাজেই শাহনাজ সেটার অর্থ নিয়ে মাথা ঘামাল না, নিচু গলায় বলল, কী মনে হয়?

কেস ডিঞ্জুফিটাস।

তার মানে কী?

ক্যাপ্টেন ডাবলু উত্তর না দিয়ে মাথা চুলকাতে থাকে। সে বিজ্ঞানের অনেক কিছু জানে, কিন্তু এখন যেসব জিনিস দেখছে সেগুলো তার জানা বিষয়ের মাঝে পড়ে না। শাহনাজ বলল, আমার কী মনে হয় জান?

কী?

প্রথমেই এখান থেকে কীভাবে বের হব সেই জিনিসটা ঠিক করে নেওয়া দরকার। চোরেরা যখন চুরি করতে আসে তখন প্রথমেই পালানোর ব্যবস্থাটা ঠিক করে নেয়।

ক্যাপ্টেন ডাবলু চোখ বড় বড় করে বলল, আমরা কি চোর?

শাহনাজ অধৈর্য হয়ে বলল, চোর না হলেও চোরের টেকনিক ব্যবহার করলে কোনো দোষ হয় না।

তা ঠিক। কী করবে এখন?

প্রথমেই এখান থেকে বের হয়ে দেখি দরকার পড়লে বের হতে পারব কি না।

ঠিক আছে।

দুজনেরই বের হওয়ার দরকার নেই, একজন বের হওয়া যাক, আরেকজন ভিতরে থাকি।

ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নাড়ল। শাহনাজ যেহেতু বড়, তাই সে ভিতরে থাকবে বলে ঠিক করল। ক্যাপ্টেন ডাবলু উঠে দাঁড়িয়ে খোলা দরজায় সেই অদৃশ্য তেলতেলে আঠালো ভিজে শীতল পরদার মাঝে লাফিয়ে পড়ল। শাহনাজ দেখতে পেল ক্যাপ্টেন ডাবলু সেই পরদায় আটকা পড়েছে, হাত–পা ছুঁড়ে বের হবার চেষ্টা করছে এবং কিছু বোঝার আগে হঠাৎ পরদা থেকে ছুটে বাইরে চলে গেছে। শাহনাজ সাবধানে বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দেয়। মহাকাশযান থেকে ঢোকা এবং বের হওয়া ব্যাপারটি একটু অস্বস্তিকর হতে পারে, কিন্তু কঠিন নয়। সত্যি কথা বলতে কী, ব্যাপারটা ভালোভাবে প্র্যাকটিস করলে একটা মজার খেলাও হতে পারে! ক্যাপ্টেন ডাবলুকে বলে দেওয়া ছিল সে বাইরে গিয়ে আবার সাথে সাথে ভিতরে ফিরে আসবে, কিন্তু শাহনাজ অবাক হয়ে লক্ষ করল সে সাথে সাথে ভিতরে ফিরে এল না। বাইরে দাঁড়িয়ে অহেতুক সময় নষ্ট করতে লাগল। সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে। ভিতরে দাঁড়িয়ে বাইরে স্পষ্ট দেখা গেলেও কোনো একটা বিচিত্র কারণে কোনোকিছুই যেন ঠিক করে বোঝা যায় না। স্পেসশিপের দরজার মাঝে যে অদৃশ্য পরদা রয়েছে সেটা যেন দুটি ভিন্ন জগৎ হিসেবে দুটি অংশ আলাদা করে রেখেছে। শাহনাজ অধৈর্য হয়ে হাত নেড়ে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে ভিতরে আসতে ইঙ্গিত করল, কিন্তু ক্যাপ্টেন ডাবলু মনে হল সেটাকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ঠাট্টা–তামাশা করতে লাগল। এ রকম সময়েও যে কেউ ঠাট্টা–তামাশা করতে পারে, শাহনাজ নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করত না।

ক্যাপ্টেন ডাবলু ভিতরে আসছে না দেখে শেষ পর্যন্ত শাহনাজ ঠিক করল সেও বাইরে যাবে। স্পেসশিপের দরজায় লাফিয়ে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে সে হঠাৎ স্পেসশিপের ভিতরে ঘরঘর এক ধরনের শব্দ শুনতে পায়। শব্দটা কোথা থেকে আসছে বোঝার জন্য শাহনাজ এদিক–সেদিক তাকাল। স্পেসশিপের ভিতরে অসংখ্য যন্ত্রপাতি, নানা ধরনের জটিল জিনিসপত্র–সেগুলো দেখতে সম্পূর্ণ অন্যরকম, হঠাৎ করে দেখলে মনে হয় বুঝি কোনো অতিকায় পোকার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। তার ভিতর দূরে একটি জায়গা থেকে ঘরঘর শব্দ করে কিছু একটা আসছে। শাহনাজ কী করবে বুঝতে পারল না, লাফিয়ে বাইরে চলে যাবে। নাকি ভিতরেই কোথাও লুকিয়ে পড়বে ঠিক করতে করতে মূল্যবান খানিকটা সময় চলে গেল। ঘরঘর শব্দ করে যে জিনিসটা আসছে সেটা দেখতে দেখতে কাছে চলে আসছে। শাহনাজ কী করবে বুঝতে না পেরে লাফিয়ে এক কোনায় বিচিত্র আকারের একটা পিলারের পিছনে লুকিয়ে গেল।

ঘরঘর শব্দ করে যে জিনিসটি আসছে সেটা একেবারে কাছে চলে এসেছে। শাহনাজ কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রইল, এবং হঠাৎ করে সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। জিনিসটি একটা হাতি–কোনো বিচিত্র উপায়ে সেটাকে মূর্তির মতো স্থির করিয়ে স্বচ্ছ চতুষ্কোণ একটা বাক্সের মাঝে আটকে রাখা হয়েছে, বাক্সের নিচে ছোট ছোট রোলার, সেই রোলার ঘোরার কারণে ঘরঘর শব্দ হচ্ছে। বাক্সটি কীভাবে যাচ্ছে সেটা দেখার জন্য শাহনাজ মাথা বের করে বিস্ময়ে চিৎকার করে ওঠে। ছোট একটি রোবট হাত দিয়ে ঠেলে ঠেলে স্বচ্ছ বাক্সটি নিয়ে যাচ্ছে–শাহনাজের চিৎকার শুনেও রোবটটা তার দিকে ঘুরে তাকাল না। হাতির পরে অন্য একটি চতুষ্কোণ বাক্সে একটা মাঝারি মহিষ, তার পিছনে একটা হরিণ, হরিণের পর একটা মাঝারি রয়েল বেঙ্গল টাইগার। রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিশ্চয়ই এখান থেকে বের হতে পারবে না, তবু শাহনাজের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ছোট ছোট পেটমোটা বেঁটে ধরনের রোবটেরা একটার পর একটা স্বচ্ছ বাক্স ঠেলে ঠেলে নিতে থাকে এবং সেইসব বাক্সের মাঝে গরু, ছাগল, ভেড়া থেকে শুরু করে সাপ, ব্যাঙ, পাখি, গিরগিটি, টিকটিকি, কিছুই বাকি থাকে না। এমন এমন বিচিত্র প্রাণী মাঝে মাঝে নিয়ে যেতে থাকে যেগুলো সে শুধু বইপত্রে ছবি দেখেছে। অক্টোপাস দেখলে যে এ রকম গা ঘিনঘিন করতে পারে সেটা নিজের চোখে দেখলে বিশ্বাস করত না। প্রাণীগুলো নড়ছে না, মূর্তির মতো স্থির হয়ে আছে কিন্তু তবু। দেখে বোঝা যায় সেগুলো জীবন্ত। কোনোভাকে অচেতন করে রেখেছে। স্পেসশিপের বুদ্ধিমান প্রাণীরা নিশ্চয়ই পৃথিবী থেকে ধরনের জন্তু–জানোয়ার একটি করে নিয়ে। যাচ্ছে–কে জানে তাদের জগতের চিড়িয়াখানায় হয়তো সাজিয়ে রাখবে।

শাহনাজের চিৎকার শুনেও বেঁটে পেটমোটা রোবটগুলো তার প্রতি কোনো গুরুত্ব না। দেওয়ায় তার একটু সাহস বেড়ে গেল। সে বিচিত্র পিলারের আড়াল থেকে বের হয়ে পৃথিবীর যাবতীয় জীবজন্তুকে স্বচ্ছ বাক্সে ভরে টেনে টেনে নেওয়ার দৃশ্যটি বাইরে দাঁড়িয়েই দেখতে শুরু করল। একটা ক্যাঙ্গারুকে লাফ দেওয়ার মাঝখানে আটকে ফেলে নিয়ে যাচ্ছিল, শূন্যে ঝুলে থাকা ক্যাঙ্গারুর বাক্সটা নিয়ে যাবার সময় সে বাক্সটা একটু ছুঁয়েও দেখল, পেটমোটা রোবটটা তাকে কিছু বলল না। ক্যাপ্টেন ডাবলু কেন এখনো বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সেটা বোঝা মুশকিল, ভিতরে এলে সে এই বিচিত্র প্রাণীকে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা দেখতে পেত। বাইরে গিয়ে সে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে নিয়ে আসবে কি না সেটা নিয়ে সে যখন নিজের সাথে মনে মনে তর্ক করছে তখন হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে হঠাৎ করে তার সমস্ত শরীর জমে যায়। সে এত জোরে চিৎকার করে উঠল যে রোবটগুলো পর্যন্ত এবার মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল। শাহনাজ দেখতে পেল একটা রোবট স্বচ্ছ একটা বাক্স ঠেলে ঠেলে আনছে এবং ঠিক তার মাঝখানে ক্যামেরায় ছবি তোলার ভঙ্গি করে ইমতিয়াজ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে–এক চোখ বন্ধ অন্য চোখ খোলা, বাম হাতে ক্যামেরা ধরে রাখার ভঙ্গি, ডান হাত। দিয়ে শাটারে চাপ দিচ্ছে–শুধুমাত্র হাতে ক্যামেরাটা নেই। মহাজাগতিক প্রাণী পৃথিবীর নানা জীব–জানোয়ার একটি করে নিয়ে যাচ্ছে, এর মাঝে একটি মানুষও আছে। মানুষ হিসেবে যাকে বেছে নিয়েছে সেটি হচ্ছে ইমতিয়াজ! কী সর্বনাশ! শাহনাজের জীবনকে ইমতিয়াজ মোটামুটি বিষাক্ত করে রেখেছে সত্যি, তাই বলে এভাবে ধরে নিয়ে চলে যাবে সেটা তো কখনো শাহনাজ চিন্তাও করে নি।

কী করবে বুঝতে না পেরে সে হঠাৎ চিৎকার করে বেঁটে পেটমোটা রোবটটার দিকে ছুটে গেল। রোবটটাকে ধরে টানাটানি করে চিৎকার করে বলতে লাগল, ছেড়ে দাও! একে ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও বলছি–ভালো হবে না কিন্তু

রোবটটা নির্লিপ্তভাবে শাহনাজের দিকে তাকাল, মনে হল শাহনাজের কাজকর্ম দেখে সে খানিকটা অবাক এবং বিরক্ত হয়েছে। শাহনাজ রোবটটার ঘাড় ধরে তাকে থামানোর চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু কোনো লাভ হয় না। ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল এবং রোবটটার পিছু পিছু ছুটতে লাগল। শেষ পর্যন্ত রোবটটার মনে হয় খানিকটা ধৈর্যচ্যুতি হল, সেটা একটা হাত তুলে শাহনাজকে ধরে খানিকটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। মাথাটা বেকায়দা কোথায় ঠুকে গিয়ে মনে হল চোখের সামনে কিছু হলুদ ফুল ঘুরতে থাকে। চোখে সর্ষেফুল দেখা কথাটা যে বানানো কথা নয়, সত্যি সত্যি কিছু একটা দেখা যায়, এই প্রথমবার শাহনাজ টের পেয়েছে। সে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে উঠে বসে। এবং দেখতে পেল ক্যাপ্টেন ডাবলু অদৃশ্য পরদায় আটকা পড়ে হাত–পা ছুঁড়ে হচড়পাঁচড় করতে করতে কোনোমতে ভিতরে এসে ঢুকেছে। শাহনাজকে নিচে পড়ে থাকতে দেখে সে অবাক হয়ে বলল, কী হল শাহনাজপু, তুমি নিচে বসে আছ কেন?

ক্যাপ্টেন ডাবলুর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শাহনাজ রেগেমেগে বলল, তুমি এতক্ষণ বাইরে বসে কী করছিলে?

ক্যাপ্টেন ডাবলু অবাক হয়ে বলল, এতক্ষণ? বাইরে বসে? কী বলছ তুমি?

তোমাকে না বলেছিলাম বাইরে গিয়েই সাথে সাথে আবার চলে আসবে?

তাই তো করেছি! একলাফে বাইরে গিয়েছি, আরেক লাফে ভিতরে ঢুকেছি।

হতেই পারে না। আমি এতক্ষণ থেকে বসে বসে সব জন্তু–জানোয়ারকে নিতে দেখলাম। সবশেষে যখন ভাইয়াকে ধরে নিচ্ছে– হঠাৎ করে কী হল কে জানে শাহনাজ হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। বড়

ক্যাপ্টেন ডাবলু কিছুই বুঝতে পারল না। সে তাদের কথামতো একলাফে বাইরে গিয়েছে তারপর আরেক লাফে ভিতরে এসে ঢুকেছে। এর মাঝে এতকিছু ঘটে গেছে সেটা সে একবারও কল্পনা করে নি। শাহনাজকে কাঁদতে দেখে সে বিশেষ ঘাবড়ে গেল। কীভাবে তাকে শান্ত করবে বুঝতে না পেরে ছটফট করতে লাগল। ইতস্তত করে বলল, শাহনাজপু তুমি কেঁদো না, প্লিজ তুমি কেঁদো না–

বয়সে ছোট একটা ছেলের সামনে কেঁদে ফেলে শাহনাজ নিজের ওপর নিজেই রেগে উঠেছিল। সে এবারে রাগটা ক্যাপ্টেন ডাবলুর ওপর ঝাড়ল, গলা ঝাজিয়ে চিৎকার করে বলল, তোমার ভাইকে যদি আচার বানিয়ে নিয়ে যেত তা হলে দেখতাম তুমি কাঁদতে কি না–_

আচার?

শাহনাজ চোখ মুছে বলল, সেরকমই তো মনে হল। বড় বড় বোতলের মাঝে যেভাবে আচার বানিয়ে রাখে সেইভাবে সবাইকে ধরে ধরে নিয়ে গেল।

ক্যাপ্টেন ডাবলু চিন্তিতমুখে বলল, শাহনাজপু, এই স্পেসশিপটা যত উন্নত ভেবেছিলাম আসলে তার থেকেও বেশি উন্নত।

কেন?

দেখছ না বাইরে একরকম সময়, ভিতরে অন্যরকম। আমি এক সেকেন্ডের মাঝে বাইরে থেকে এসেছি আর এদিকে কত সময় পার হয়ে গেছে!

শাহনাজ শক্ত মুখে বলল, তাতে লাভ কী হচ্ছে?

তার মানে যারা এই স্পেসশিপটা এনেছে তারা আসলেই খুব উন্নত। তারা অনেক বুদ্ধিমান। তাদেরকে বোঝালেই তারা তোমার ভাইয়াকে ছেড়ে দেবে।

ছাড়বে না। শাহনাজের আবার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। যে ভাই তার জীবনকে একেবারে পুরোপুরি বিষাক্ত করে রেখেছে তাকে বাঁচানোর জন্য চোখে পানি এসে যাচ্ছে ব্যাপারটা এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না। কোনোমতে কান্না সামলিয়ে বলল, আমি রোবটগুলোকে কত বোঝালাম, ছেড়ে দিতে বললাম, তারা ছাড়ল না। বরং আমাকে যা একটা আছাড় দিল, এখনো মাথাটা টনটন করছে।

ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, ওগুলো তো রোবট ছিল। রোবটগুলো তো কিছু বোঝে না। আমাদের খুঁজে বের করতে হবে আসল প্রাণীগুলোকে যারা সত্যিকারের বুদ্ধিমান। তাদেরকে বুঝিয়ে বললেই দেখো তারা ছেড়ে দেবে।

তাদেরকে কেমন করে বোঝাব? তারা কি বাংলা জানে? আমাদের কথা কি বুঝবে?

উন্নত প্রাণী সবসময় নীচুশ্রেণীর প্রাণীকে বুঝতে পারে।

ক্যাপ্টেন ডাবলুর কথায় শেষ পর্যন্ত শাহনাজ খানিকটা আশা ফিরে পেল। বলল, চল তা হলে খুঁজে বের করি কোথায় আছে।

চল।

দুজনে তাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে মহাকাশযানের ভিতর হাঁটতে শুরু করে। স্পেসশিপের ভিতরে নানারকম গলিঘুপচি, নানারকম বিচিত্র যন্ত্রপাতি। তাদের ফাঁকে ফাঁকে শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলু হাঁটতে শুরু করে। ভিতরে নানারকম শব্দ। কোথাও কোথাও ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, কোথাও বেশ গরম। স্পেসশিপের ভিতরে কোথাও কোনোরকম আলো জ্বলছে না কিন্তু তবু ভিতরে এক ধরনের নরম স্নিগ্ধ আলো। শাহনাজ হাঁটতে হাঁটতে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে জিজ্ঞেস করল, এই প্রাণীগুলো দেখতে কী রকম হবে মনে হয়? মাকড়সার মতো হবে না তো? তা হলে আমি ঘেন্নায়ই বমি করে দেব।

মনে হয় না। বুদ্ধিমান প্রাণী হলে মনে হয় একটু মানুষের মতো হওয়ার কথা। বাইনোকুলার ভিশনের জন্য কমপক্ষে দুইটা চোখ দরকার, আমার মনে হয় বেশি হবে। চোখগুলো ব্রেনের কাছে থাকা দরকার, শরীরের উপরের অংশে হলে ভালো। কাজ করার জন্য আঙুল না হলে ঔড় দরকার। অক্টোপাসের মতো, যত বেশি হয় তত ভালো।

শাহনাজ ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কেমন করে জান?

একটা বইয়ে পড়েছি। ক্যাপ্টেন ডাবলু একটু অপেক্ষা করে বলল, তোমার কী রকম হবে বলে মনে হয়?

আমার মনে হয় সবুজ রঙের হবে।

সবুজ? সবুজ কেন হবে?

জানি না। চোখগুলো হবে বড় বড়। একটু টানা টানা। চোখের পাতা উপর থেকে নিচে পড়বে না, ডান থেকে বামে পড়বে। নাকের জায়গায় শুধু গর্ত থাকবে। মুখ থাকবে না।

মুখ থাকবে না? মুখ থাকবে না কেন?

আমার মনে হয় মুখ থাকলেই সেখানে দাঁত থাকবে আর দাঁত থাকলেই ভয় করবে। সেই জন্য মুখই থাকবে না।

ক্যাপ্টেন ডাবলু খিকখিক করে হেসে বলল, শাহনাজপু, তোমার কথাবার্তা একেবারে আনসায়েন্টিফিক।

হতে পারে। তুমি জিজ্ঞেস করেছ তাই বলছি।

ক্যাপ্টেন ডাবলু হাসি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, হাত–পা কি থাকবে? লেজ?

না লেজ থাকবে না। দুইটা হাত, দুইটা পা থাকবে। প্রত্যেকটা হাতে তিনটা করে আঙুল। পেটটা একটু মোটা হবে। মাথাটা শরীরের তুলনায় অনেক বড়। যখন হাঁটবে তখন মনে হবে এই বুঝি তাল হারিয়ে পড়ে গেল।

ক্যাপ্টেন ডাবলু আবার হেসে উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু সামনে তাকিয়ে হঠাৎ সে পাথরের মতো জমে গেল। তাদের কয়েক হাত সামনে দুটি মহাজাগতিক প্রাণী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ের রং সবুজ, শরীরের তুলনায় অনেক বড় মাথা, সেখানে বড় বড় দুটি চোখ স্থিরদৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। নাকের জায়গায় দুটি গর্ত, কোনো মুখ নেই। দুটি ছোট ছোট পা, তুলনামূলকভাবে লম্বা হাত। প্রতি হাতে তিনটা করে আঙুল। ঠিক যেরকম শাহনাজ বর্ণনা করেছিল। ক্যাপ্টেন ডাবলু বিস্ফারিত চোখে মহাজাগতিক প্রাণী দুটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর শাহনাজের দিকে তাকিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল, শা–শা–শাহনাজপু–তো–তো–তোমার কথাই ঠিক।

শাহনাজ নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছে যে তার কথাই সত্যি বের হয়েছে, মহাজাগতিক প্রাণী সে যেরকম হবে ভেবেছিল প্রাণীগুলো হুবহু সেরকম। ক্যাপ্টেন ডাবলু ফিসফিস করে বলল, কি—কি–ছু একটা বলল।

শাহনাজ কী বলবে বুঝতে পারল না। মহাজাগতিক প্রাণীকে কি সালাম দেওয়া যায়? তারা কি বাংলা বোঝে? নাকি ইংরেজিতে কথা বলতে হবে? কী করবে বুঝতে না পেরে শাহনাজ আমতা আমতা করে বলল, হ্যাপি মিলেনিয়াম।

প্রাণী দুটি কোনো শব্দ না করে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রাণীগুলো একটি চোখের পাতা ফেলল, দুজনে অবাক হয়ে দেখল চোখের পাতাটি উপরে নিচে নয়, ডান থেকে বামে–ঠিক যেরকম শাহনাজ বলেছে। শাহনাজ কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, সে মুখ হাঁ করে প্রাণী দুটির দিকে তাকিয়ে রইল।

দুটি মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে সামনাসামনি দেখা হলে যেরকম ভয় পাওয়ার কথা ছিল শাহনাজ মোটেও সেরকম ভয় পেল না। সে মহাজাগতিক প্রাণীর যেরকম বর্ণনা দিয়েছিল সেটি অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে, কাজেই প্রাণীগুলোকে ভয় পাওয়ার কোনো। কারণ নেই। কারণ সে জানে প্রাণীগুলো খুব নরম মেজাজের। ভয় না পেলেও শাহনাজ খুব অবাক হয়েছে, কাজেই একটু স্বাভাবিক হতে তার বেশ খানিকক্ষণ সময় লেগে গেল।

ক্যাপ্টেন ডাবলু শুধু অবাক হয় নি, সে ভয়ও পেয়েছে। ঠিক কী কারণে ভয় পেয়েছে সে জানে না, ভয়ের সাথে অবশ্য যুক্তিতর্ক বা কারণের কোনো সম্পর্ক নেই। সে শাহনাজের পিছনে নিজেকে আড়াল করে চোখ বড় বড় করে প্রাণী দুটির দিকে তাকিয়ে রইল। শাহনাজ খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, আপনারা আমাদের পৃথিবীতে এসেছেন সেজন্য পৃথিবীর পক্ষ থেকে আপনাদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

পৃথিবীতে আগমন–শুভেচ্ছা স্বাগতম বলে একটা স্লোগান দেবে কি না একবার চিন্তা করে দেখল, কিন্তু মহাজাগতিক প্রাণী সেটা ভালোভাবে নাও নিতে পারে। শাহনাজ কেশে গলাটা একটু পরিষ্কার করে বলল, আপনারা এসেছেন খবর পেলে আসলে অনেক বড় বড় মানুষ আপনাদের সাথে দেখা করতে আসত। ফুলটুল নিয়ে আসত। কিন্তু আমরা হঠাৎ করে এসেছি বলে খালি হাতে আসতে হল।

মহাজাগতিক প্রাণী দুটি স্থিরচোখে শাহনাজের দিকে তাকিয়ে রইল, তার কথা বুঝতে পেরেছে কি না বোঝা গেল না। শাহনাজের হঠাৎ একটু অস্বস্তি লাগতে থাকে। কিন্তু যেহেতু কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে তাই হঠাৎ করে থামার কোনো উপায় নেই; তাকে কথা বলতেই হয়, আপনাদের স্পেসশিপটা আসলে খুবই সুন্দর। যেরকম সাজানো–গোছানো সেরকম পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন। আপনাদের কাজকর্ম ভালোভাবে হচ্ছে নিশ্চয়ই। যদি আপনাদের কোনো ব্যাপারে কোনোরকম সাহায্যের দরকার হয় বলবেন। আপনারা কী কী নিতে চাচ্ছেন জানি না, সবকিছু পেয়েছেন কি না সেটাও বলতে পারছি না। এখানে ভালো দোকানপাট নাই, ঢাকার কাছাকাছি নামলে সেখানে অনেক ভালো ভালো দোকান পেতেন।

শাহনাজের কথার উত্তরে কোনো কথা না বলে প্রাণী দুটি তখনো স্থিরচোখে তাকিয়ে রইল। মানুষের একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার সাথে এদের একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার মাঝে একটা পার্থক্য আছে। মানুষের চোখের দিকে তাকালে তার ভিতরে রাগ দুঃখ অভিমান বা অন্য কী অনুভূতি হচ্ছে সেটা অনুমান করা যায় কিন্তু এদের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুই বোঝার। উপায় নেই। শাহনাজ তবুও হাল ছাড়ল না, আবার কথা বলতে শুরু করল, আপনারা পৃথিবী থেকে অনেক রকম জন্তু–জানোয়ার নিয়ে যাচ্ছেন দেখলাম, নিয়ে কী করবেন ঠিক জানি না। কিছু কিছু জন্তু–জানোয়ার কিন্তু একটু রাগী টাইপের, একটু সাবধান থাকবেন। যেসব জন্তু–জানোয়ার নিচ্ছেন তার মাঝে একটা নিয়ে আমার একটু কথা বলার ছিল, যদি অনুমতি দেন তা হলে বলি।

মহাজাগতিক প্রাণী অনুমতি দিল কি না বোঝা গেল না, কিন্তু শাহনাজ বলতে শুরু করল, যে প্রাণীটা নিয়ে কথা বলছি সেটা আসলে আমার ভাই, ইমতিয়াজ। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। নিজের ভাই কাজেই বলা ঠিক না, কিন্তু না বলেও পারছি না। আমার এই ভাই কিন্তু পুরোপুরি অপদার্থ। আমরা যেটাকে বলি ভুয়া। একেবারে ভুয়া।

আপনারা পৃথিবী থেকে অনেক আশা করে একজন মানুষ নিচ্ছেন সেটা ভালো দেখে নেওয়া উচিত। এ রকম ভুয়া একজন মানুষ নেওয়া কি ঠিক হবে? কাজেই আমার বিশেষ অনুরোধ, আপনি আমার ভাইকে ছেড়ে দেবেন। আমি আপনাকে লিখে দিতে পারি আমার ভাই ইমতিয়াজকে নিলে আপনাদের লাভ থেকে ক্ষতি হবে অনেক বেশি। মানুষ সম্পর্কে যেসব তথ্য পাবেন তার সবগুলো হবে ভুল। তারা কীভাবে চিন্তা করে, কীভাবে কাজ করে সেই সম্পর্কেও আপনাদের ধারণা হবে ভুল। তাকে বিশ্লেষণ করে আপনাদের ধারণা হতে পারে যে, মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে পোস্ট মডার্ন কবিতা নামের বিদ্ঘুটে জিনিস লিখে। লিখে পরিচিত–অপরিচিত সব মানুষকে বিরক্ত করা।

শাহনাজ বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, কাজেই, এই পৃথিবীর সম্মানিত অতিথিরা, আপনারা আমার ভাইকে ছেড়ে দেন। আমরা এই ভুয়া মানুষটিকে নিয়ে যাই।

শাহনাজ তার এই দীর্ঘ এবং মোটামুটি আবেগ দিয়ে ঠাসা বক্তৃতা শেষ করে খুব আশা নিয়ে মহাজাগতিক প্রাণী দুটির দিকে তাকাল, কিন্তু প্রাণী দুটি ডান থেকে বামে চোখের পাতা ফেলা ছাড়া আর কিছুই করল না। শাহনাজের সন্দেহ হতে থাকে যে হয়তো তারা তার কথা কিছুই বুঝতে পারে নি। সে একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কি আমার কথা বুঝতে পেরেছেন? বুঝে থাকলে কিছু একটা বলেন, নাহয় কিছু একটা করেন।

শাহনাজের কথা শেষ হওয়ামাত্রই একটি মহাজাগতিক প্রাণী তার একটা হাত তুলে ময়লা ঝেড়ে ফেলার মতো একটা ভঙ্গি করল এবং সাথে সাথে একটা অত্যন্ত বিচিত্র ব্যাপার ঘটতে শুরু করে। ঝড়ো হাওয়ার মতো একটা হাওয়া এসে হঠাৎ করে শাহনাজ এবং ক্যাপ্টেন ডাবলুর উপর দিয়ে বইতে শুরু করে। বাতাসের বেগ দেখতে দেখতে বেড়ে যায়, তারা দুজন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ করে বাতাস তাদের একেবারে। শূন্যে উড়িয়ে নেয়। দুজন আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে। ঝড়ো হাওয়া তাদের কোথাও আছড়ে ফেলবে মনে করে তারা হাত–পা ছড়িয়ে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করে, কিন্তু তারা কোথাও আছড়ে পড়ে না। শূন্যে ভাসতে ভাসতে তারা উপরে–নিচে লুটোপুটি খেতে থাকে এবং কোথায় ভেসে যাচ্ছে তার তাল ঠিক রাখতে পারে না। ধুলোবালি, লতাপাতা, পোকামাকড়সহ তারা ভেসে বেড়াতে এবং কিছু বোঝার আগে তারা নিজেদেরকে মহাকাশযানের বাইরে পাহাড়ের নিচে নিজেদের ব্যাক প্যাকের পাশে আবিষ্কার করল। এত উপর থেকে নিচে পড়ে তাদের শরীরের প্রত্যেকটা হাড় ভেঙে যাবার কথা কিন্তু তাদের কিছুই হয় নি, মনে হচ্ছে কেউ যেন। তাদের ধরে এখানে নামিয়ে দিয়েছে। শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলু ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াতেই তাদের আশপাশ থেকে কয়েকটা পাখি উড়ে গেল। শাহনাজ ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকাল, সে ধুলোয় ডুবে আছে এবং শাহনাজের মনে হল তার বুকপকেটে জীবন্ত কিছু একটা নড়াচড়া করছে। ভালো করে তাকাতেই সে অবাক হয় দেখল ক্যাপ্টেন ডাবলুর পকেট থেকে একটা নেংটি ইঁদুর লাফ দিয়ে বের হয়ে গেল। শাহনাজ আতঙ্কে একটা চিৎকার করে ওঠে। কারো পকেটে একটা জ্যান্ত নেংটি ইঁদুর ঋঞ্চতে পারে সেটি নিজের চোখে না দেখলে সে বিশ্বাস করত না। ক্যাপ্টেন ডাবলু ঘুরে শাহনাজের দিকে তাকাল, কী হয়েছে শাহনাজপু?

তোমার পকেটে একটা ইঁদুর

ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নাড়ল, না। আমার পকেটে নাই–তোমার মাথায়।

সত্যি সত্যি শাহনাজের মনে হল তার মাথায় কিছু একটা নড়াচড়া করছে, হাত দিতেই কিছু একটা কিলবিল করে উঠল। শাহনাজ গলা ফটিয়ে চিৎকার করে জিনিসটাকে ছুঁড়ে দেয় এবং আতঙ্কিত হয়ে আবিষ্কার করে সত্যিই একটা নেংটি ইঁদুর ছুটে পালিয়ে যায়। দুজনে নিজেদের শরীর ঝেড়ে পরিষ্কার করে আরো কিছু পোকামাকড় আবিষ্কার করে। দুজনের প্রায় হার্টফেল করার অবস্থা হল যখন তাদের পায়ের তলা থেকে হলুদ রঙের একটা গিরগিটি এবং দুইটা ব্যাং লাফিয়ে লাফিয়ে পালিয়ে গেল।

ব্যাপারটা কী হয়েছে? আমরা এখানে এলাম কীভাবে? আর এত পোকামাকড় ব্যাং কোথা থেকে এসেছে? এত ধুলাবালিই কেন এখানে?

ক্যাপ্টেন ডাবলু নিজের মাথা থেকে ধুলা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, আমার কী মনে হয় জান শাহনাজপু? স্পেসশিপের প্রাণীগুলো তাদের স্পেসশিপটা ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করেছে।

ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার?

হ্যাঁ। আমরা হচ্ছি ময়লা আবর্জনা। যত পোকামাকড় ইঁদুর গিরগিটি ব্যাং এর সাথে সাথে আমাদেরকেও ঝাড় দিয়ে বের করে দিয়েছে! যা যা ঢুকেছে সবগুলোকে বের করে দিয়েছে।

ইঁদুর গিরগিটি ব্যাং আর আমরা এক হলাম?

ক্যাপ্টেন ডাবলু একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার তো তাই মনে হচ্ছে। স্পেসশিপের প্রাণীর কাছে পোকামাকড়ের সাথে নাহয় নেংটি ইঁদুরের সাথে আমাদের কোনো পার্থক্য নাই।

সেটা কেমন করে সম্ভব?

তারা এত উন্নত আর বুদ্ধিমান যে তাদের কাছে মনে হয় সবই সমান। একটা ইঁদুরকে যত বোকা মনে হয় মানুষকেও সেরকম বোকা মনে হয়।

শাহনাজ মুখ শক্ত করে বলল, সেটি হতেই পারে না। মানুষকে কেন বোকা মনে হবে?

ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা চুলকে বলল, আমি কেমন করে বলব?

ওদের কাছে প্রমাণ করতে হবে আমরা অন্য পশুপাখি থেকে অনেক বুদ্ধিমান।

কীভাবে করবে?

ওদেরকে বলতে হবে, বোঝাতে হবে।

তারা যদি তোমার কথা বিশ্বাস না করে শাহনাজপু?

তা হলে প্রমাণ করতে হবে। মানুষ পৃথিবীতে কত কিছু আবিষ্কার করেছে কম্পিউটার থেকে শুরু করে রকেট, পেনিসিলিন থেকে শুরু করে হুপিং কফের টিকা; আর এরা ভাববে আমরা নেংটি ইঁদুরের সমান? এটা কি কখনো হতে পারে?

কিন্তু তাই তো হয়েছে। তারা নিশ্চয় এত উন্নত যে এইসব আবিষ্কার তাদের কাছে মনে হয় একেবারে ছেলেমানুষি! তারা কোনো পাত্তাই দেয় না।

কিন্তু আমরা তো বুদ্ধিমান! আমরা তো পশুপাখি থেকে ভিন্ন।

স্পেসশিপের প্রাণীরা সেটা বুঝতে পারছে না।

শাহনাজ পা দাপিয়ে বলল, আমাদের সেটা বোঝাতে হবে।

পা দাপানোর সাথে সাথে শাহনাজের শরীর থেকে ধুলা উড়ে গিয়ে একটা বিচিত্র দৃশ্যের সৃষ্টি হল। সেই দৃশ্য দেখে এত দুঃখের মাঝেও ক্যাপ্টেন ডাবলু হেসে ফেলল। শাহনাজ রেগে গিয়ে বলল, হাসছ কেন তুমি হ্যাঁ? এর মাঝে হাসির কী হল?

তুমি যখন পা দাপালে তখন ভাইব্রেশানে শরীর থেকে ধুলা বের হয়ে এল! ধুলার সাইজ তো ছোট, মাত্র

এখন সেটা নিয়ে হাসাহাসি করার সময় তোমাকে দেখতে যে একটা উজবুকের মতো লাগছে আমি কি সেটা নিয়ে হেসেছি?

ক্যাপ্টেন ডাবলু হাত দিয়ে শরীরের ধুলা ঝাড়তে ঝাড়তে স্বীকার করল যে তাকে নিয়ে শাহনাজ হাসাহাসি করে নি। শাহনাজ রাগ সামলে নিল, এখন মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজকর্ম করতে হবে। ক্যাপ্টেন ডাবলু বিজ্ঞানের অনেক কিছু জানে কিন্তু বিপদের সময় মাথা ঠাণ্ডা রেখে কীভাবে কাজ করতে হয় সেটা মনে হয় জানে না; কী করতে হবে সেটা মনে হয় তাকেই ঠিক করতে হবে। শাহনাজ কঠিনমুখে বলল, আমাদের আবার স্পেসশিপটার ভিতরে ঢুকতে হবে। ঢুকে প্রাণীগুলোকে বোঝাতে হবে যে আমরাও উন্নত প্রাণী।

কঠিনমুখে বা জোর দিয়ে কিছু বললে ক্যাপ্টেন ডাবলু সেটা সাথে সাথে স্বীকার করে নেয়, এবারেও মাথা নেড়ে তাড়াতাড়ি সেটা স্বীকার করে নিল। শাহনাজ ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমরা সেটা কীভাবে বোঝাব?

ক্যাপ্টেন ডাবলু খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, বিজ্ঞানের বড় বড় সূত্র নিয়ে স্লোগান দিই?

বড় বড় সূত্র নিয়ে স্লোগান? শাহনাজ একটু অবাক হয়ে ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকাল।

ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, যেমন মনে কর আমি বলব ই ইকুয়েলস টু তুমি বলবে এম সি স্কয়ার! এইটা বলতে বলতে যদি স্পেসশিপে ঘুরে বেড়াই?

একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে ই ইকুয়েলস টু এম সি স্কয়ার বলে স্লোগান দিতে দিতে স্পেসশিপে ঘুরে বেড়াচ্ছে দৃশ্যটি কল্পনা করে শাহনাজ কেমন জানি অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। ক্যাপ্টেন ডাবলু কিন্তু নিরুৎসাহিত হল না; বলল, তার সাথে সাথে আমরা যদি পাইয়ের মান প্রথম এক হাজার ঘর পর্যন্ত মুখস্থ বলতে পারি?

শাহনাজ অবাক হয়ে বলল, পাইয়ের মান এক হাজার ঘর পর্যন্ত তোমার মুখস্থ আছে?

ক্যাপ্টেন ডাবলু মুখ কাচুমাচু করে বলল, এক হাজার ঘর পর্যন্ত নেই, মাত্র বিশ ঘর পর্যন্ত মুখস্থ আছে। তোমার নেই?

শাহনাজ মাথা নাড়ল, না নেই। পাইয়ের মান এক হাজার ঘর পর্যন্ত মুখস্থ রাখা যে। একটা সাধারণ কর্তব্য মনে করে, তার সাথে কথাবর্তা চালানো খুব সহজ ব্যাপার নয়। শাহনাজ মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

কিংবা আমরা যদি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অনিশ্চয়তার সূত্রটা অভিনয় করে দেখাতে পারি তা হলে কেমন হয়? ক্যাপ্টেন ডাবলু চোখ বড় বড় করে বলল, আমি হব অবস্থানের অনিশ্চয়তা, তুমি হবে ভরবেগের অনিশ্চয়তা।

না। শাহনাজ মাথা নেড়ে বলল, আমার মনে হয় এসব দিয়ে কাজ হবে না। আমাদেরকে এমন একটা জিনিস খুঁজে বের করতে হবে যেটা পশু থেকে আমাদের আলাদা। করে রেখেছে।

বুদ্ধিজীবী, না হলে সন্ত্রাসী। শুধু মানুষের মাঝে আছে। পশুপাখির নেই।

শাহনাজ একটু বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়ে বলল, এখন এইসব ভাবের কথা বলে লাভ নেই, কাজের কথা বল।

শাহনাজের ধমক খেয়ে ক্যাপ্টেন ডাবলু একটু দমে গেল। মাথা চুলকে বলল, আমি তো আর কিছু ভেবে পাচ্ছি না। ও

শাহনাজ কী একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন শাহনাজের মাথায় চটাৎ করে একটু শব্দ হল, সেখানে কিছু একটা পড়েছে। তারা একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে, গাছের ডালে পাখি কিচিরমিচির করছে, কাজেই তার মাথায় কী জিনিস পড়তে পারে সেটা বুঝতে খুব অসুবিধে হবার কথা নয়। কিন্তু এ রকম সময়ে যে তার জীবনে এটা ঘটতে পারে সেটা শাহনাজ বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে মাথা নিচু করে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে দেখিয়ে বলল, দেখ দেখি মাথায় কী পড়ছে?

ক্যাপ্টেন ডাবলু শাহনাজের মাথার দিকে তাকিয়ে হি হি করে হাসতে শুরু করল, হাসির চোটে তার মুখ থেকে কথাই বের হতে চায় না। অনেক কষ্টে বলল, মাথায় পাখি বাথরুম করে দিয়েছে।

শাহনাজ রেগে বলল, বাথরুম করে দিয়েছে তো তুমি হাসছ কেন?

ক্যাপ্টেন ডাবলু কেন হাসছে সেটা যুক্তিতর্ক দিয়ে ব্যাখ্যা করার কোনো চেষ্টাই করল না, হি হি করে হাসতেই থাকল। শাহনাজ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকিয়ে রইল। একজন মানুষ অপদস্থ হলে অন্য একজন সেখান থেকে এভাবে আনন্দ পেতে পারে? শুধু তাই নয়, আনন্দটিতে যে কোনো ভেজাল নেই সেটি কি ক্যাপ্টেন ডাবলুর এই হাসি দেখে বোঝা যাচ্ছে না? হাসতে হাসতে মনে হয় সে বুঝি মাটিতে লুটোপুটি খেতে শুরু করবে। পৃথিবীতে। শুধুমাত্র মানুষই মনে হয় এ রকম হৃদয়হীন হতে পারে–এ রকম সম্পূর্ণ অকারণে হাসতে পারে!

ঠিক তক্ষুনি শাহনাজের মাথায় বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটা জিনিস খেলে যায়। হাসি! হাসি হচ্ছে একটি ব্যাপার যে ব্যাপারটি মানুষকে পশু থেকে আলাদা করে রেখেছে। কোনো পশু হাসতে পারে না, শুধু মানুষ হাসতে পারে। হাসি ব্যাপারটির সাথে বুদ্ধিমত্তার একটা সম্পর্ক রয়েছে। মানুষ যে অত্যন্ত উন্নত একটি প্রাণী তার প্রমাণ হচ্ছে এই হাসি। মানুষ কেন হাসে সেটি নিয়ে পৃথিবীতে শত শত গবেষণা হয়েছে, সেই গবেষণা এখনো শেষ হয় নি, কিন্তু একটি ব্যাপার নিশ্চিত হয়েছে মানুষের নির্ভেজাল হাসি হচ্ছে বুদ্ধিমান মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। কাজেই স্পেসশিপে গিয়ে মহাকাশের প্রাণীদের সামনে গিয়ে তারা যদি এভাবে হাসতে পারে। তা হলে মহাকাশের প্রাণীদের মানুষের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এতটুকু সন্দেহ থাকবে না।

শাহনাজ এবারে সম্পূর্ণ অন্যদৃষ্টিতে ক্যাপ্টেন ডাবলুর হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে, সেই দৃষ্টিতে নিশ্চয়ই গুরুতর কিছু ছিল, কারণ হঠাৎ করে ক্যাপ্টেন ডাবলু তার হাসি থামিয়ে শাহনাজের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে শাহনাজপু?

স্পেসশিপের প্রাণীদের কী দেখাতে হবে বুঝতে পেরেছি।

কী?

হাসি।

হাসি? ক্যাপ্টেন ডাবলু ভুরু কুঁচকে তাকাল, কার হাসি? কিসের হাসি?

কার আবার, আমাদের হাসি। মানুষের হাসি হচ্ছে তাদের বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। মানুষ ছাড়া আর কেউ হাসতে পারে না–

তা ঠিক। শিম্পাঞ্জি মাঝে মাঝে হাসির মতো মুখ তৈরি করে, কিন্তু মানুষ যেভাবে হাসে সেভাবে হাসতে পারে না।

শাহনাজ উজ্জ্বলমুখে বলল, স্পেসশিপের ভিতরে গিয়ে আমরা সেই প্রাণীদের খুঁজে বের করব, তারপর তাদের সামনে হা হা হি হি করে হাসব। পারবে না?

ক্যাপ্টেন ডাবলুর মুখে ভয়ের একটা ছায়া পড়ল। যখন কোনো প্রয়োজন নেই তখন হেসে ফেলা কঠিন কোনো ব্যাপার নয়, কিন্ত যখন হাসির ওপর জীবন–মরণ নির্ভর করছে তখন কি এত সহজে হাসতে পারবে? যদি তখন হাসি না আসে? শাহনাজ অবশ্য ডাবলুর ভয়কে গুরুত্ব দিল না, হাতে কিল দিয়ে বলল, ডাবলু, তুই পুরো ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দে, আমি এমন সব জিনিস জানি শুনলে তুই হেসে লুটোপুটি খেতে থাকবি।

শাহনাজ যে উত্তেজনার কারণে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে শুধু ডাবলু বলে তুই তুই করে বলতে শুরু করেছে সেটা দুজনের কেউই লক্ষ করল না। উত্তেজনায় ক্যাপ্টেন ডাবলুও শাহনাজের নামটা আরো সংক্ষিপ্ত করে ফেলল। বলল, ঠিক আছে শাহনাপু, যদি আমার হাসি না আসে তা হলে আমি ঠিক তোমার মাথায় কীভাবে পাখিটা পিচিক করে বাথরুম। করে দিল সেই কথাটা চিন্তা করব, দেখবে আমিও হেসে লুটোপুটি খেতে থাকব।

কথাটা যে সত্যি সেটা প্রমাণ করার জন্য ক্যাপ্টেন ডাবলু আবার হি হি করে হাসতে থাকল। শাহনাজ চোখ পাকিয়ে বলল, এখন হাসবি না খবরদার, মাথা ভেঙে ফেলব।

তার মাথার পাখির বাথরুম কীভাবে পরিষ্কার করবে সেটা নিয়ে সে একটু চিন্তা করে ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে বলল, ডাবলু, নে আমার মাথায় পানি ঢাল। নোংবাটা ধুয়ে ফেলতে হবে। সাবান থাকলে ভালো হত।

না ধুলে হয় না? তা হলে যখনই হাসার দরকার হবে তুমি আমাকে তোমার মাথাটাকে দেখাবে–এটা দেখলেই আমার মনে পড়বে, আর আমার হাসি পেয়ে যাবে!

ফাজলেমি করবি না। যা বলছি কর। ক্যাপ্টেন ডাবলু খানিকটা অনিচ্ছা নিয়ে শাহনাজের মাথায় বোতল থেকে পানি ঢালতে থাকে।

প্রথমবার স্পেসশিপে ঢোকার সময় যেরকম ভয়–ভয় করছিল এবার তাদের সেরকম ভয় লাগল না। প্রাণীগুলো আগে দেখেছে সেটি একটি কারণ, তাদেরকে বঁটা দিয়ে বের করার সময় তাদের একটুও ব্যথা না দিয়ে স্পেসশিপের ভিতর থেকে পাহাড়ের নিচে নামিয়ে দিয়েছে সেটি আরেকটি কারণ, তবে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে শাহনাজ যেরকম কল্পনা করেছিল তার সাথে হুবহু মিলে যাওয়ার ব্যাপারটি। শাহনাজের কল্পনা মহাজাগতিক প্রাণী খুব মধুর স্বভাবের, কাজেই এই প্রাণীগুলোও নিশ্চয়ই মধুর স্বভাবেরই হবে এ ব্যাপারে শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলুর মনে এখন আর কোনো সন্দেহ নেই।

স্পেসশিপের সেই অদৃশ্য পরদা ভেদ করে ভিতরে ঢুকেই এবারে শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলু হাসাহাসি করার চেষ্টা করতে শুরু করল। প্রাণীগুলো নিশ্চয়ই তাদের দেখছে, কাজেই তাদের খুঁজে বের করার কোনো দরকার নেই। শাহনাজ বলল, বুঝলি ডাবলু, আমাদের ক্লাসে। একটা মেয়ে পড়ে, তার নাম মীনা–সবাই তাকে ডাকে মিনমিনে মীনা। কেন বল দেখি?

কেন?

সবসময় মিনমিন করে কথা বলে তো, তাই। একদিন স্কুলে আমাদের নববর্ষের অনুষ্ঠান হচ্ছে, তাই সবাই গান শিখছি। একটা গান ছিল রবীন্দ্রনাথের। গানের কথাটা এইরকম : বল দাও মোরে বল দাও, সেই গানটা শুনে মিনমিনে মীনা কী বলে জানিস?

কী?

বলে, কবি রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই ফুটবল খেলার সময় এই গানটা লিখেছিলেন! রাইট আউটে খেলছিলেন, গোলপোস্টের কাছাকাছি গিয়ে সেন্টার ফরোয়ার্ডকে বলেছিলেন, বল দাও মোরে বল দাও আমি গোল দেই। শাহনাজ কথা শেষ করেই হি হি করে হাসতে লাগল।

ক্যাপ্টেন ডাবলুকে একটু বিভ্রান্ত দেখাল, ভুরু কুঁচকে বলল, ফুটবল কেন? ক্রিকেটও তো হতে পারত!

শাহনাজ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, তোর যেরকম বুদ্ধি, তাতে ক্রিকেটও হতে পারত?

কেন শুধু ফুটবল না হয়ে ক্রিকেটও হতে পারত সেটা নিয়ে ক্যাপ্টেন ডাবলু একটা তর্ক শুরু করে দিচ্ছিল, শাহনাজ তাকে ধমক দিয়ে থামাল। বলল, তুই থাম আরেকটা গল্প বলি, শোন। আমরা তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। ইতিহাস ক্লাসে স্যার শেরশাহের জীবনী পড়াচ্ছেন। স্যার বললেন, শেরশাহ প্রথমে ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করলেন। ঝিনু মস্তান তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন স্যার, তার আগে ঘোড়ারা ডাকতে পারত না?

শাহনাজের কথা শেষ হতেই দুজনেই হি হি করে হেসে উঠল। হাসি থামার পর শাহনাজ জিজ্ঞেস করল, তুই কোনো গল্প জানিস না?

ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নাড়ল, বলল, জানি।

বল, শুনি।

এ্যা, এই গল্পটা খুব হাসির। একদিন একটা মানুষ গেছে চিড়িয়াখানাতে, ক্যাপ্টেন ডাবলুকে একটু বিভ্রান্ত দেখায়, মাথা নেড়ে বলল, না, চিড়িয়াখানা না, মিউজিয়ামে। সেই মিউজিয়ামে গিয়ে–ইয়ে–মানুষটা– ক্যাপ্টেন ডাবলু আবার থেমে যায়। তারপর আমতা আমতা করে বলে, না, আসলে চিড়িয়াখানাতেই গেছে। সেখানে মানুষটা কী একটা জানি করেছে–বানরের সাথে। আমার ঠিক মনে নাই, বানরটা তখন কী জানি করেছে সেটা এত হাসির–হি হি হি– ক্যাপ্টেন ডাবলু হি হি করে হাসতেই থাকে।

এইটা তোর হাসির গল্প?

হ্যাঁ। আমার পুরো গল্পটা মনে নাই, কিন্তু খুব হাসির ঘটনা। হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাবে

শাহনাজ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে। এবারে আমি বলি শোন। এক ট্রাক ড্রাইভার অ্যাকসিডেন্ট করে হাসপাতালে আছে। তাকে জিজ্ঞেস করা হল কেমন করে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, সে বলল, আমি ট্রাক চালিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ দেখি রাস্তা দিয়ে সামনে থেকে একটা গাড়ি আসছে–আমি তখন তাকে সাইড দিলাম। আরো খানিকদূর গিয়েছি তখন দেখি একটা ব্রিজ আসছে, সেটাকেও সাইড দিলাম। তারপর আর কিছু মনে নাই।

গল্প শেষ হওয়ার আগেই শাহনাজ নিজেই হি হি করে হাসতে থাকে। ক্যাপ্টেন ডাবলুও গল্প শুনে হোক আর শাহনাজের হাসি দেখেই হোক, জোরে জোরে হাসতে শুরু করে।

দুজনে হাসতে হাসতে আরো কিছুদূর এগিয়ে যায়, মহাজাগতিক প্রাণীগুলোকে এখনো দেখা যাচ্ছে না। না–দেখা গেলে নাই, শাহনাজ ঠিক করেছে তারা দুজন হাসতে হাসতে স্পেসশিপে ঘুরে বেড়াবে। ক্যাপ্টেন ডাবলুর অনেক জ্ঞান থাকতে পারে কিন্তু হাসির গল্প বলায় একেবারে যাচ্ছেতাই, কাজেই মনে হচ্ছে শাহনকেই চেষ্টা করে যেতে হবে। সে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে জিজ্ঞেস করল, ডাবলু তুই নাপিতের গল্পটা জানিস?

নাপিতের গল্প? না।

একদিন একজন লোক নাপিতের কাছে চুল কাটাচ্ছে। সে দেখল তার পায়ের কাছে একটা কুকুর খুব শান্তভাবে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটা নাপিতকে জিজ্ঞেস করল, এইটা বুঝি খুব পোষা কুকুর, ভাই এ রকম শান্তভাবে বসে আছে? নাপিত বলল, আসলে আমি যখন কারো চুল কাটি তখন এইভাবে ধৈর্য ধরে শান্তভাবে বসে থাকে। চুল কাটতে কাটতে হঠাৎ যখন কানের লতিটাও কেটে ফেলি তখন সেগুলো খুব শখ করে খায়।

গল্প শুনে ক্যাপ্টেন ডাবলু এক মুহূর্তের জন্য চমকে উঠে শাহনাজের দিকে তাকাল, তারপর হি হি করে হাসতে রু করল।

শাহনাজ হাসি থামিয়ে বলল, বুঝলি ডাবলু আমাদের পাশের বাসায় বাচ্চা একটা ছেলে থাকে, নাম রুবেল, তাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছি–রুবেল, তুমি কী পড়? সে বলল, হাফপ্যান্ট পরি! আমি হাসি চেপে জিজ্ঞেস করলাম, না মানে কোথায় পড়? সে শার্ট তুলে দেখিয়ে বলল, এই যে নাভির ওপরে!

ক্যাপ্টেন ডাবলু হি হি করে হাসতে হাসতে হঠাৎ করে থেমে গেল। শাহনাজ জিজ্ঞেস করল, কী হল?

ক্যাপ্টেন ডাবলু চোখের কোনা দিয়ে সামনে দেখিয়ে বলল, ঐ দেখ!

শাহনাজ তাকিয়ে দেখে চারটা মহাজাগতিক প্রাণী চুপচাপ দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। শাহনাজ মুখ হাসি–হাসি রেখে চাপা গলায় বলল, ডাবলু মুখ হাসি হাসি রাখ। আর হাসতে চেষ্টা কর।

ক্যাপ্টেন ডাবলু হাসার চেষ্টা করে বিদ্ঘুটে একরকম শব্দ করল। শাহনাজ একটা নিশ্বাস ফেলে মহাজাগতিক প্রাণীগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, আগের বার তোমরা ছিলে দুই জন, এখন দেখছি চার জন! এইভাবে বাড়তে থাকলে কিছুক্ষণেই তো আর এখানে জায়গা হবে না।

মহাজাগতিক প্রাণীগুলো কোনো শব্দ করল না। শাহনাজ দুই পা এগিয়ে বলল, তোমাদের সাথে যখন দেখা হয়েই গেল, একটা গল্প শোনাই। দেখি শুনে তোমাদের কেমন লাগে! কী বলিস ডাবলু?

ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নেড়ে বলল, হ্যা আপু বল।

দুই জন মাতাল রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এক জনের হাতে একটা টর্চলাইট, সে লাইটটা জ্বালিয়ে আলো আকাশের দিকে ফেলে বলল, তুই এটা বেয়ে উপরে উঠতে পারবি? অন্য মাতালটা আলোটার দিকে একনজর তাকিয়ে বলল, তুই আমাকে বেকুব পেয়েছিস? আমি উঠতে শুরু করি আর তুই টর্চলাইট নিভিয়ে দিবি। পড়ে আমি কোমরটা ভাঙি আর কি!

ক্যাপ্টেন ডাবলু হি হি করে হেসে উঠতেই চারটা মহাজাগতিক প্রাণীই চমকে উঠে ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাল। শাহনাজ দেখতে পেল পিটপিট করে চার জনেই চোখের পাতা ফেলছে।

পছন্দ হয়েছে তোমাদের গল্পটা?

মহাজাগতিক প্রাণীগুলো এবারে ঘুরে শাহনাজের দিকে তাকাল, এই প্রথমবার প্রাণীগুলোর ভিতরে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, আগেরবার কোনোরকম প্রতিক্রিয়াই ছিল না! শাহনাজ একটু উৎসাহ পেয়ে বলল, তোমাদের তা হলে আরেকটা গল্প বলি একজন মহিলা গেছে ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারকে বলল, আমার স্বামীর ধারণা সে রেফ্রিজারেটর। কী করি ডাক্তার সাহেব? ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনার স্বামী যদি মনে করে সে রেফ্রিজারেটর সেটা তার সমস্যা আপনার তাতে কী? মহিলা বললেন, সে মুখ হাঁ করে ঘুমায় আর ভিতরে বাতি জ্বলতে থাকে, সেই আলোতে আমি ঘুমাতে পারি না।

গল্প শুনে প্রথমে ক্যাপ্টেন ডাবলু এবং তার সাথে সাথে শাহনাজও খিলখিল করে হেসে উঠল, হাসতে হাসতে বলল, গল্পটা মজার না?

মহাকাশের প্রাণীগুলো এবারে নিজেদের দিকে তাকাল এবং মনে হল নিজেরা নিজেরা কিছু একটা নিয়ে আলোচনা শুরু করল। শাহনাজ খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থেকে, গলা নামিয়ে ক্যাপ্টেন ডাবলুকে বলল, মনে হচ্ছে কাজ হচ্ছে। কী বলিস?

হ্যা শাহনাপু। থেমো না। আরেকটা বল।

শাহনাজ কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, তোমাদের আরেকটা গল্প বলি শোন। একদিন একটা পাগল একটা ডোবার কাছে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে, পাঁচ পাঁচ পাঁচ। একজন লোক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি পাঁচ পাঁচ বলে চিৎকার করছ কেন? পাগলটা বলল, তুমি কাছে আস তোমাকে দেখাই। লোকটা পাগলের কাছে যেতেই পাগলটা ধাক্কা দিয়ে তাকে ডোবার মাঝে ফেলে দিয়ে চিৎকার করতে থাকল, ছয় ছয় ছয়।

গল্প শেষ করার আগেই শাহনাজ নিজেই খিলখিল করে হাসতে থাকে, আর তার দেখাদেখি ক্যাপ্টেন ডাবলুও নিজের হাতে কিল দিয়ে হাসা শুরু করে। আর কী আশ্চর্য! হঠাৎ করে মনে হল মহাজাগতিক প্রাণী চারটিও খিকখিক করে হেসে উঠেছে। মহাজাগতিক প্রাণী চারটির একটি হঠাৎ করে শাহনাজের দিকে তাকিয়ে একেবারে পরিষ্কার বাংলায় বলল, বিচিত্র।

সাথে সাথে অন্য তিনটি মহাজাগতিক প্রাণীও মাথা নেড়ে বলল, বিচিত্র।

শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলু একসাথে চমকে ওঠে। কী আশ্চর্য! মহাজাগতিক প্রাণীগুলো কথা বলছে। শাহনাজ চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল, কী বিচিত্র?

হাসি। তোমাদের হাসি।

কেন? বিচিত্র কেন?

এটি একটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম, জটিল, দুর্লভ, বিমূর্ত এবং ব্যাখ্যার অতীত প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াটি আমরা অন্য কোনো প্রাণীর মাঝে দেখি নি।

তোমরা মানে আপনারা হাসেন না?

তোমরা আমাদের তুমি–তুমি করে বলতে পার।

তোমরা হাস না?

না, আমরা হাসি না।

কী আশ্চর্য! শাহনাজ অবাক হয়ে বলল, তোমরা কখনো কিছু নিয়ে হাস নাই? তোমাদের কোনো বন্ধু কোনোদিন তোমাদের সামনে কলার ছিলকায় আছাড় খেয়ে পড়ে নাই?

না। মহাজাগতিক প্রাণী গম্ভীর গলায় বলল, প্রকৃতপক্ষে আমরা তোমাদের মতো প্রাণী নই। আমাদের আলাদা অস্তিত্ব নেই।

কী বলছ, তোমাদের আলাদা অস্তিত্ব নেই? এই যে তোমরা আলাদা আলাদা চার জন?

এটি আমাদের একটি রূপ। তোমাদের সুবিধের জন্য। আসলে আমরা এক এবং অভিন্ন।

গুল মারছ। শাহনাজ মুখ শক্ত করে বলল, আমাদের ছোট পেয়ে তোমরা আমাদের গুল মারছ!

গুল? প্রাণীটি দ্রুত কয়েকবার চোখের পাতা ফেলে বলল, গুল কীভাবে মারে?

গুল মারা কী জান না? শাহনাজ হি হি করে হেসে বলল, গুল মারা হচ্ছে মিথ্যা কথা বলা। অর্থাৎ একটা জিনিস করে যদি অন্য জিনিস বল তা হলে সেটাকে বলে গুল মারা।

বিচিত্র। অত্যন্ত বিচিত্র।

কী জিনিস বিচিত্র?

গুল মারা। কেন একটি তথ্যকে অন্য একটি তথ্য দিয়ে পরিবর্তন করা হবে? কেন গুল মারা হবে?

শাহনাজ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, গুল মারতে হয়। বেঁচে থাকতে হলে অনেক সময় গুল মারতে হয়। তাই নারে ডাবলু?

ডাবলু এতক্ষণ শাহনাজ এবং মহাজাগতিক প্রাণীর মাঝে যে কথাবার্তা হচ্ছে সেটা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, নিজে থেকে কিছু বলার সাহস পাচ্ছিল না। শাহনাজের প্রশ্ন শুনে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। হ্যাঁ। মাঝে মাঝে গুল মারতে হয়। কয়দিন আগে বাসায় আমার ল্যাবরেটরিতে একটা বিশাল বিস্ফোরণ হল, সবকিছু ভেঙেচুরে একাকার। আম্মার কাছে তখন আমার গুল মারতে হল। না হলে অবস্থা একেবারে ডেঞ্জারাসিন হয়ে যেত।

মহাজাগতিক চারটি প্রাণীই পুতুলের মতো মাথা নাড়তে লাগল, তাদের মাঝে একটা ফোঁস করে একটা শব্দ করে বলল, বিচিত্র, অত্যন্ত বিচিত্র।

শাহনাজ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে প্রাণীগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, তার মানে তোমরা বলতে চাইছ তোমরা কখনো একজন আরেকজনের কাছে গুল মার নি?

আমি বলেছি আমাদের আলাদা অস্তিত্ব নেই। সব মিলিয়ে আমাদের একটি অস্তিত্ব। এক এবং অভিন্ন।

এই যে তোমরা চার জন আছ– শাহনাজের কথা শেষ হবার আগেই দেখা গেল চার জনের জায়গায় আটটি মহাজাগতিক প্রাণী বসে আছে!

কী আশ্চর্য! শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলু একসাথে চিৎকার করে উঠলকীভাবে করলে এটা?

শাহনাজ অবাক হয়ে বলল, একেবারে ম্যাজিকের মতো। টিভিতে দেখালে লোকজন অবাক হয়ে যাবে!

একটি প্রাণী বলল, আমি তোমাদেরকে বলেছি, আমরা এক এবং অভিন্ন। তোমাদের জন্য এই রূপটি নিয়েছি। আমরা ইচ্ছে করলে অনেকগুলো হতে পারি। আবার ইচ্ছে করলে একটি হয়ে যেতে পারি।

হও দেখি।

শাহনাজের কথা শেষ হবার আগেই আটটি প্রাণী অদৃশ্য হয়ে মাত্র একটি প্রাণী রয়ে গেল–একেবারে ম্যাজিকের মতো। শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলু আবার অবাক হয়ে চিৎকার করে উঠল।

মহাজাগতিক প্রাণীটি বলল, এখন বিশ্বাস করেছ?

শাহনাজ বলল, এখনো পুরোপুরি করি নাই।

কেন পুরোপুরি কর নি?

এইটা কীভাবে সম্ভব যে সবাই মিলে একটা প্রাণী? তা হলে কীভাবে সবাই মিলে গল্পগুজব করবে, হাসিঠাট্টা করবে? নিজের সাথে নিজে কি হাসিতামাশা করতে পারে?।

প্রাণীটি ফোঁস করে একটা শব্দ করে বলল, আমরা ভিন্ন ধরনের প্রাণী, তোমাদের মতো নই। সেই জন্য তোমাদের অনেক কিছু আমাদের কাছে অজানা।

শাহনাজ হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নড়ে বলল, কিন্তু তোমরা যদি হাসতেই না পার তা হলে বেঁচে থেকে কী লাভ?

প্রাণীটি মাথা নেড়ে বলল, আমরা ঠিক করেছি পৃথিবী থেকে আমরা হাসি নামক প্রক্রিয়াটি আমাদের সাথে নিয়ে যাব।

হাসি কি একটা জিনিস যে তোমরা সেটা পকেটে ভরে নিয়ে যাবে?

প্রাণীটা গম্ভীর গলায় বলল, যে জিনিস ধরা–ছোঁয়া যায় না–সেই জিনিসও নেওয়া যায়। আমরা নিতে পারি তবে সে ব্যাপারে তোমাদের একটু সাহায্যের প্রয়োজন হবে।

শাহনাজ একগাল হেসে বলল, সাহায্য করতে পারি, কিন্তু এক শর্তে।

কী শর্তে?

আমার ভাই ইমতিয়াজকে তোমরা ধরে এনেছ, তাকে ছেড়ে দিতে হবে।

প্রাণীটা এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, ঠিক আছে, ছেড়ে দেব।

শাহনাজ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, শাহনাপু, আমরা আরো একটা কাজ করতে পারি।

কী কাজ?

আমরা ওদেরকে কেমন করে গুল মারতে হয় সেটাও শিখিয়ে দিতে পারি! একসাথে দুটি জিনিস শিখে যাবে। হাসি এবং গুল মারা।

শাহনাজ ভুরু কুঁচকে ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকাল, বলল, কিন্তু সেটা কি ভালো হবে? হাসি তো ভালো জিনিস, কিন্তু গুল মারা তো ভালো না।

ক্যাপ্টেন ডাবলু একগাল হেসে বলল, শিখতে তো দোষ নাই। ব্যবহার না করলেই হল। তাই না?

মহাজাগতিক প্রাণী মাথা নাড়ল, বলল, ভালো খারাপ এই ব্যাপারগুলো তোমাদের। আমরা যেহেতু এক এবং অভিন্ন, আমাদের কাছে ভালো এবং খারাপ বলে কিছু নেই।

শাহনাজ মাথা নাড়ল, বলল, তোমাদের কথা শুনে আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। এক এবং অভিন্ন। ভালো–খারাপ নেই। আমি–তুমি নেই। আলাদা অস্তিত্ব নেই শুনে মনে হচ্ছে ভাইয়ার পোষ্ট মডার্ন কবিতার লাইন। এসব ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে বল, আমাদের কী করতে হবে।

মহাজাগতিক প্রাণী বলল, আমরা অত্যন্ত খাঁটি হাসির কিছু প্রক্রিয়ার সকল তথ্য সগ্রহ করতে চাই।

ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা চুলকে বলল, হাসাহাসির ঘটনাটা ভিডিও করবে?

না। হাসির প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত প্রত্যেকের মস্তিষ্কের নিউরন এবং তার সিনাপ্সের সংযোগটি কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে সেটি সংরক্ষণ করব।

ক্যাপ্টেন ডাবলুর মুখ হা হয়ে গেল, বলল, সেটি কী করে সম্ভব? মস্তিষ্কের ভিতরে তোমরা কীভাবে ঢুকবে?

আমরা পারি।

কীভাবে পার!

স্থান এবং সময়ের মাঝে একটা সম্পর্ক আছে। তোমাদের একজন বিজ্ঞানী সেটা প্রথম অনুভব করেছিলেন–।

বিজ্ঞানী আইনস্টাইন?

সবাইকে একটি নাম দেওয়ার এই প্রবণতায় আমরা এখনো অভ্যস্ত হই নি। সেই বিজ্ঞানীর বড় বড় চুল এবং বড় বড় গোঁফ ছিল।

ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নাড়ল, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন!

যাই হোক, আমরা সময়কে ব্যবহার করে স্থানকে সংকুচিত করতে পারি, আবার স্থানকে ব্যবহার করে সময়কে সংকুচিত করতে পারি।

শাহনাজ বিভ্রান্ত মুখে বলল, তার মানে কী?

ক্যাপ্টেন ডাবলু চোখ বড় বড় করে বলল, বুঝতে পারছ না শাহনাপু? স্থান মানে হচ্ছে স্পেস! এরা স্পেস ছোট করে ফেলতে পারে! মনে কর এরা তোমার ব্রেনের ভিতরে ঢুকতে চায় তখন তারা একটা বিশেষ রকম ভাসমান গাড়ি তৈরি করল। তারপর সেই গাড়িটা যে জায়গায় আছে সেই জায়গাটাই ছোট করে ফেলল, গাড়িটা তখন এত ছোট হল যে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখতে হবে–সেটা তখন তোমার ব্রেনে ঢুকে যাবে, তুমি টেরও পাবে না! ক্যাপ্টেন ডাবলু মহাজাগতিক প্রাণীর দিকে তাকিয়ে বলল, তাই না?

মহাজাগতিক প্রাণী একটু ইতস্তত করে বলল, মূল ব্যাপারটি খুব পরোক্ষভাবে অনেকটা এ রকম, তবে স্থান এবং সময়ের যোগাযোগ–সূত্রে প্রতিঘাত যোজনের সম্পর্কটি বিশেষণ করতে হয়। চতুর্মাত্রিক জগতে অনিয়মিত অবস্থান নিয়ন্ত্রণের একটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া আছে। শক্তি ক্ষয় এবং শক্তি সৃষ্টির একটি অপবলয় রয়েছে, সেটি নিয়ন্ত্রণের একটি পদ্ধতি রয়েছে–সব মিলিয়ে পুরো ব্যাপারটি অনুধাবন করার মতো যথেষ্ট নিউরন তোমাদের মস্তিষ্কে নেই। তোমরা প্রয়োজনীয় সিনান্স সংযোগ করতে পারবে না।

শাহনাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কী বলছে কিছুই তো বুঝতে পারলাম না।

ডাবলু বলল, সেটাই বলেছে–যে আমরা বুঝতে পারব না।

না বুঝলে নাই। মোরব্বা স্যারের কেমিস্ট্রিই বুঝতে পারি না, আর শক্তির অপবলয়! ভাগ্যিস ভাইয়া ধারেকাছে নাই, থাকলে এই কটমটে শব্দগুলো দিয়ে একটা পোস্ট মডার্ন কবিতা লিখে ফেলত।

কিন্তু কীভাবে করে জানা থাকলে খারাপ হত না

থাক বাবা, এত জেনে কাজ নেই। শাহনাজ মহাজাগতিক প্রাণীর দিকে তাকিয়ে বলল, এখন বল আমাদের কী করতে হবে?

অত্যন্ত খাঁটি একটি হাসির প্রয়োজনীয় পরিবেশের সকল তথ্য সংরক্ষণে সাহায্য করতে হবে।

ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, হাসি আবার খাঁটি আর ভেজাল হয় কেমন করে?

হবে না কেন? তুই যখন কিছু না–বুঝে হাসিস সেটা হচ্ছে ভেজাল হাসি। আমি যখন হাসি সেটা খাঁটি।

মহাজাগতিক প্রাণী বলল, খাঁটি একটা হাসির পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে কী করতে হবে?

শাহনাজের হঠাৎ সোমার কথা মনে পড়ল এবং সাথে সাথে তার মুখ ম্লান হয়ে আসে। পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর করে হাসতে পারে তার সোন্স আপু এবং এর হাসি থেকে খাঁটি হাসি পৃথিবীতে আর নেই। কিন্তু সেই সোমা আপু এখন হাসপাতালে আটকা পড়ে আছে, তাকে তো আর এখানে আনা যাবে না।

মহাজাগতিক প্রাণীটি বলল, সোমার হাসি সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে কোনো সমস্যা নেই।

শাহনাজ চমকে উঠে মহাজাগতিক প্রাণীটির দিকে তাকাল, তুমি কেমন করে সোমা আপুর কথা জান?

তোমরা ভুলে যাচ্ছ, আমরা অন্য ধরনের প্রাণী। তথ্য বিনিময় করার জন্য আমরা সরাসরি তোমার মস্তিষ্কের নিউরনের সিনান্স সংযোগ লক্ষ করতে পারি। তোমরা যেটা বল সেটা যেরকম আমরা বুঝতে পারি, ঠিক সেরকম যেটা চিন্তা কর সেইটাও আমরা বুঝতে পারি। আমরা ইচ্ছা করলে সরাসরি তোমাদের মস্তিষ্কেও কথা বলতে পারি কিন্তু তোমরা অভ্যস্ত নও বলে বলছি না।

ক্যাপ্টেন ডাবলু নাক দিয়ে বাতাস বের করে বলল, পিকুইলাইটিস।

কী বললি?

মহাজাগতিক প্রাণী বলল, সে বলছে ব্যাপারটি খুব বিচিত্র।

ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, এখন আমি বুঝতে পারছি তোমরা কেন সবুজ রঙের এবং তোমাদের চোখ কেন এত বড় বড় এবং টানা টানা, তোমাদের হাতে কেন তিনটা করে আঙুল–আর শাহনাপু তাদের না–দেখেই কেমন করে সেটা বলে দিল।

শাহনাজ জিজ্ঞেস করল, কেমন করে?

ক্যাপ্টেন ডাবলু শাহনাজের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি এ রকম কল্পনা করেছিলে, এরা তোমার চিন্তাটা দেখে ফেলে নিজেরা সেরকম আকার নিয়েছে। সে মহাজাগতিক প্রাণীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তাই না?

মহাজাগতিক প্রাণী বলল, তুমি যথার্থ অনুমান করেছ। আমরা এমন একটি আকৃতি নিতে চেয়েছিলাম যেটি দেখে তোমরা অস্বস্তি না পাও। সেটি আমরা তোমাদের একজনের মস্তিষ্ক থেকে গ্রহণ করেছি।

ক্যাপ্টেন ডাবলু ঠোঁট সুচালো করে বলল, পিকুইলাইটিস! ভেরি ভেরি পিকুইলাইটিস!

শাহনাজ মহাজাগতিক প্রাণীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি সোমা আপুর কথা কী জানি বলছিলে?

আমরা বলেছিলাম

আমরা কোথায়? তুমি তো এখন একা।

আমি এবং আমাদের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। আমরা এক ও অভিন্ন। আমাদের ভিন্ন সত্তা নেই–

শাহনাজ মাথা চেপে ধরে বলল, অনেক হয়েছে, আর ওসব নিয়ে বকবক কোরো না, আমার মাথা ধরে যাচ্ছে। হ্যাঁ, সোমা আপুকে নিয়ে তুমি কী যেন বলছিলে?

বলছিলাম যে সোমার হাসি সংক্রান্ত তথ্য সগ্রহ করতে কোনো সমস্যা নেই।

কীভাবে সগ্রহ করবে?

আমরা স্থান এবং সময়কে নিয়ন্ত্রণ করি। আমরা যে কোনো স্থানে যেতে পারি।

শাহনাজ আনন্দে চিৎকার করে বলল, তা হলে আমরা সোমা আপুর কাছে যেতে পারব?

সে যদি এই গ্যালাক্সিতে থাকে তা হলে পারব?

শাহনাজ হি হি করে হাসতে গিয়ে থেমে গেল।। তার আবার মনে পড়েছে সোমা আপুর শরীর ভালো নয়। মুখ কালো করে বলল কিন্তু সোমা আপু কি হাসবে? তার তো শরীর ভালো না!

মানুষের শরীরে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা আছে, তাই শরীর ভালো না–থাকা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। তার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে তোলা যেতে পারে।

শাহনাজ আবার চিৎকার করে উঠল, তার মানে তোমরা সোমা আপুকে ভালো করে তুলতে পারবে? তোমাদের কাছে ভালো ডাক্তার আছে?

ডাক্তার? মহাজাগতিক প্রাণী মাথা নেড়ে বলল, একেকজনকে একেক বিষয়ে অভিজ্ঞ করে তোলার এই প্রবণতার সাথে আমরা পরিচিত নই। আমরা এক ও অভিন্ন, আমাদের জীবন্ত সত্তা–

ব্যস ব্যস ব্যস শাহনাজ বাধা দিয়ে বলল, অনেক হয়েছে, আবার এক ও অভিন্ন। সত্তা নিয়ে বক্তৃতা শুরু করে দিও না। তুমি ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাবে, না ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে চিকিৎসা করাবে সেটা তোমার ব্যাপার। সোমা আপু ভালো হলেই হল।

তা হলে আমরা কি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি?

হ্যাঁ। চল যাই, দেরি করে লাভ নেই।

মহাজাগতিক প্রাণী বলল, তুমি পূর্বশর্ত হিসেবে যে মানুষটিকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছিলে তাকে কি এখন ছেড়ে দেব? তাকে কি আমরা সাথে নিয়ে নেব?

না, না, না– শাহনাজ মাথা নেড়ে বলল, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে? সাথে নিলে উপায় আছে? ঠিক তোমরা যাবার সময় তাকে ছেড়ে দিও। তার আগে না।

ঠিক আছে।

শাহনাজ হঠাৎ ঘুরে মহাজাগতিক প্রাণীর দিকে তাকাল, বলল, আচ্ছা তোমরা কি একটা জিনিস করতে পারবে?

শাহনাজ কথাটি বলার আগেই মহাজাগতিক প্রাণী মাথা নাড়ল, বলল, পারব।

শাহনাজ ভুরু কুঁচকে বলল, আমি কী বলতে যাচ্ছি তুমি বুঝেছ?

হ্যাঁ। তুমি বলতে চাইছ তোমার ভাইয়ের আকার পরিবর্তন করে দিতে।

শাহনাজ মাথা নেড়ে বলল, হ্যা ছোট সাইজ করে একটা হোমিওপ্যাথিকের শিশিতে ভরে দিবে! আমি আমার জ্যামিতি–বক্সে রেখে দিব। তার খুব বিখ্যাত হওয়ার শখ এক ধাক্কায় বিখ্যাত হয়ে যাবে!

শাহনাজ হি হি করে হাসতে শুরু করে। এটা মোটামুটি খাঁটি আনন্দের হাসি, মহাজাগতিক প্রাণী তথ্য সংরক্ষণ করছে কি না কে জানে!

শাহনাজ এবং ক্যাপ্টেন ডাবলুকে নিয়ে মহাজাগতিক প্রাণীটি যে ভাসমান যানটাতে উঠল সেরকম যান সায়েন্স ফিকশানের সিনেমাতেও দেখা যায় না। সেটি একটি মাইক্রোবাসের মতো বড় আর যন্ত্রপাতিতে বোঝাই। চকচকে ধাতব রঙের, দুই পাশে ছোট ছোট দুটি পাখা, মাথাটা সুচালো। পিছনে গেলে একটা ইঞ্জিক। ভিতরে পাশাপাশি তিনটা সিট। মাঝখানে মহাজাগতিক প্রাণী বসেছে, দুই পাশে শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলু। ভাসমান যানটা চলতে শুরু করার আগে শাহনাজ ভয়ে ভয়ে বলল, এটা বেশি ঝাঁকাবে না তো? আঁকুনি হলে আমার কিন্তু শরীর খারাপ হয়ে যায়।

মহাজাগতিক প্রাণী বলল, না ঝাঁকাবে না।

শাহনাজ জিজ্ঞেস করল, ইয়ে তামার নাম কী?

আমি আগেই বলেছি নাম–পরিচয় ইত্যাদি ব্যাপারগুলোতে আমরা বিশ্বাস করি না।

কিন্তু তোমাকে তো কিছু একটা বলে ডাকতে হবে। বল কী বলে ডাকব?

উচ্চ কম্পনের একটা শব্দ করে ডাকতে পার।

কুকুরকে যেভাবে শিস্ দিয়ে ডাকে সেরকম?

ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, সেটা ভালো হবে না। যে এত সুন্দর একটা ভাসমান যান চালাবে তার একটা ফ্যান্টাবুলাস নাম দরকার। যেমন মনে করা যাক– ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা চুলকে বলল, ডক্টর জিজি?

ডক্টর জিজি?

শাহনাজ আপত্তি করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু মহাজাগতিক প্রাণীটা মাথা নেড়ে বলল, ভালো নাম। আমি ডক্টর জিজি।

তোমার নামটা পছন্দ হয়েছে?

মহাজাগতিক প্রাণীটা মাথা নাড়ল, কাজেই কারোই আর কিছু বলার থাকল না। ডক্টর জিজি সামনে রাখা ত্রিমাত্রিক কিছু যন্ত্রপাতির মাঝে হাত দিয়ে কিছু একটা স্পর্শ করতেই ভাসমান যানটিতে একটা মৃদু কম্পন অনুভব করল এবং প্রায় সাথে সাথে সেটি উপরে উঠে গিয়ে প্রায় বিদ্যুদ্বেগে ছুটে যেতে রু করে। মাটির কাছাকাছি দিয়ে এটি গাছপালা ঘরবাড়ি মানুষজনের পাশ দিয়ে ছুটে যেতে থাকে। কিন্তু কী আশ্চর্য! কেউ ঘুরেও তাদের দিকে তাকাল না। ভাসমান যানের ভিতর দিয়ে তারা সবাইকে দেখতে পাচ্ছে কিন্তু তাদেরকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। কী বিচিত্র ব্যাপার!

শাহনাজ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ডক্টর জিজি, আমাদেরকে কেউ দেখতে পাচ্ছে কেন?

কাউকে দেখতে হলে তাকে একই সময় এবং একই স্থানে থাকতে হয়। আমরা সময়ের ক্ষেত্রে একটু এগিয়ে আছি, কাজেই আমরা তাদের দেখতে পাচ্ছি কিন্তু তারা আমাদের দেখতে পাচ্ছে না।

সময়ে তারা যখন এগিয়ে আসবে?

তখন আমরাও এগিয়ে যাব, তাই কেউ দেখতে পারবে না।

ক্যাপ্টেন ডাবল ব্যাপারটি এত সহজে মেনে নিতে রাজি হল না। ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে তর্ক করার প্রস্তুতি নিল, বলল, কিন্তু আমি পড়েছি কিছু দেখতে হলে লাইট কোণের মাঝে থাকতে হয়, কাজেই আমরা যদি তাদের দেখতে পাই তা হলে তারাও আমাদের দেখতে পাবে।

ডক্টর জিজি বলল, ব্যাপারটি বোঝার মতো যথেষ্ট নিউরন তোমাদের নেই। সহজ করে এভাবে বলি–আমাদের কাছে আলো আসছে বলে আমরা তাদের দেখছি, আমাদের এখান থেকে কোনো আলো তাদের কাছে যাচ্ছে না বলে তারা আমাদের দেখছে না।

ক্যাপ্টেন ডাবলু তর্ক করার জন্য আবার কী একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই তাদের ভাসমান যানটি হঠাৎ পুরোপুরি কাত হয়ে একটা বড় বিল্ডিঙের ভিতর ঢুকে গেল, বারান্দা দিয়ে ছুটে গিয়ে একটা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। ডক্টর জিজি বলল, সোমা এই ঘরে আছে।

শাহনাজ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কীভাবে জান?

তোমার মস্তিষ্কে যে তথ্য আছে সেটা ব্যবহার করে বের করেছি।

শাহনাজ কী একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল তার আগেই ভাসমান যানটি কাত হয়ে ঘরের মাঝে ঢুকে গেল। শাহনাজ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল একটা ছোট জায়গার ভিতরে কেমন করে একটা বড় জিনিস ঢুকে পড়ে, কিন্তু তার আগেই তার নজরে পড়ল বিছানায় শুয়ে সোমা ছটফট করছে। তার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম, ঠোঁট কালচে এবং মুখ রক্তশূন্য। সোমার কাছে তার আম্মা দাঁড়িয়ে আছেন, তার মুখ ভয়ার্ত। সোমার হাত ধরে কাতর গলায় বলছেন, কী হয়েছে সোমা? মা, কী হয়েছে?

ব্যথা করছে মা। বুকের মাঝে ব্যথা করছে।

সোমার আম্মা লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর চিৎকার লাগলেন, নার্স নার্স। নার্স কোথায়?

আম্মার কথা শুনে কেউ এল না, তখন আম্মা চিৎকার করতে করতে বের হয়ে গেলেন। শাহনাজ বলল, চল আমরা নামি।

ডক্টর জিজি বলল, না। এই গাড়ি থেকে বের হলে তোমাকে দেখতে পাবে। এখন বের হওয়া যাবে না।

শাহনাজ প্রায় কান্না–কান্না হয়ে বলল, কিন্তু সোমা আপার বুকের মাঝে কষ্ট!

ডক্টর জিজি বলল, আমরা সেটা এক্ষুনি দেখব।

ডক্টর জিজির কথা শেষ হবার আগেই সোমার আম্মা আবার ঘরে এসে ঢুকলেন, তার পিছু পিছু একজন পুরুষমানুষ এসে ঢুকল। মানুষটা খুব বিরক্তমুখে সোমার আম্মাকে ধমক দিয়ে বলল, কী হয়েছে? এত চিৎকার করছেন কেন?

আমার মেয়েটার বুকে খুব ব্যথা করছে!

ব্যথা তো করবেই। অসুখ হলে ব্যথা করবে না?

কিন্তু ওষুধ দিয়ে তো ব্যথা কমার কথা, কমছে না কেন?

মানুষটা ধমক দিয়ে বলল, আমি কি ওষুধ তৈরি করি? আমি কেমন করে বলব?

ডক্টর জিজি বলল, বিচিত্র, অত্যন্ত বিচিত্র।

শাহনাজ জিজ্ঞেস করল, কী বিচিত্র?

এই মানুষটি মুখে একটি কথা বলছে কিন্তু মস্তিষ্কে সম্পূর্ণ অন্য কথা।

মস্তিষ্কে কী কথা বলছে?

মস্তিষ্কে বলছে যে—ভাগ্যিস বেটি জানে না আমি ভুল ওষুধ দিয়ে ফেলেছি!

সর্বনাশ! তাই বলছে ওই বদমাইশ লোকটা? ওই পাজি লোকটা? শয়তান লোকটা?

হ্যাঁ।

এখন কী হবে ডক্টর জিজি? শাহনাজ প্রায় কেঁদে ফেলল, এখন সোমা আপুর কী হবে?

বিশেষ কিছু হবে না। ডক্টর জিজি বলল, সোমার শরীর সামলে নিয়েছে। ভুল ওষুধে বেশি ক্ষতি হয় নি। কিন্তু খুব বিচিত্র।

কী বিচিত্র?

ওই মানুষটার মস্তিষ্ক আবার একটা জিনিস বলছে, কিন্তু মুখে অন্য জিনিস বলছে।

কী বলছে মস্তিষ্কে? কী চিন্তা করছে? তুমি সব শুনতে পাচ্ছ?

ডক্টর জিজি শাহনাজের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি একটা কাজ করি তা হলে তোমরাও শুনতে পারবে।

কী করবে?

মানুষটার ভোকাল কর্ডের সাথে মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণটা জুড়ে দিই। তা হলে সে যা চিন্তা করবে সেটা জোরে জোরে বলবে।

তুমি করতে পারবে?

পারব।

তোমাকে কি লোকটার ভিতরে যেতে হবে? নাকি এখানে বসেই করবে?

আমি বলে এখানে কিছু নেই। আমি একটা রূপ, আমাদের প্রকৃত অস্তিত্ব এক ও অভিন্ন।

বুঝেছি বুঝেছি বুঝেছি। শাহনাজ মাথা চেপে ধরে বলল, এখন বক্তৃতা না দিয়ে তোমার কাজ শুরু কর।

ডক্টর জিজি তার যন্ত্রপাতির মাঝে হাত ঢুকিয়ে কিছু একটা স্পর্শ করল এবং হঠাৎ করে সোমার আম্মার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার মাথাটা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে নড়তে থাকে। সোমার আম্মা এক পা পেছনে সরে ভয় পেয়ে বললেন, কী হয়েছে? আপনার কী হয়েছে?

মানুষটার মাথাটা হঠাৎ যেভাবে নড়তে শুরু করেছিল ঠিক সেরকম হঠাৎ করে আবার থেমে গেল। বলল, না কিছু হয় নাই। খালি মনে হল মগজ থেকে কিছু একটা টেনে বের করে নিয়ে গেল!

সোমার আম্মা অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকালেন, জিজ্ঞেস করলেন, কী বললেন আপনি?

আমি কিছু বলি নাই। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, যেটা বলতে চাই নাই সেটাও বলে ফেলেছি! শালার মহাযন্ত্রণা দেখি।

সোমার আম্মা কোনো কথা না বলে অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মানুষটা থতমত খেয়ে বলল, আমি আপনার মেয়েকে ব্যথা কমানোর জন্য একটা ইনজেকশন দিয়ে দিই। এবারে চেষ্টা করব ঠিক ইনজেকশন দিতে আগেরবারের মতো ভুল যেন না হয়!

সোমার আম্মা চমকে উঠে বললেন, কী বললেন আপনি? কী বললেন? আপনি আগেরবার ভুল ইনজেকশন দিয়েছেন?

মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, না, না, না, আমি ভুল ইনজেকশন দিই নাই।

শাহনাজ অবাক হয়ে দেখল মানুষটা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আবার কথা বলতে শুরু করেছে, কী মুশকিল! আমি সব কথা দেখি বলে ফেলছি। তুল ইনজেকশন দিয়েছি দেখেই তো এই যন্ত্রণা। ওষুধগুলো চুরি করার জন্য আলাদা করে রেখেছিলাম, তখনই তো গোলমালটা হল।

সোমার আম্মা তীক্ষ্ণচোখে মানুষটার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি ওষুধ চুরি করেন?

মানুষটার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, সে কথা না–বলার জন্য নিজের মুখ চেপে ধরার চেষ্টা করে, কিন্তু তবু মুখ থেকে কথা বের হতে থাকে, আমি তো অনেকদিন থেকেই ওষুধ চুরি করছি। শুধু ওষুধ চুরি করলে কী হয়? রোগীদের বিপদের মাঝে ফেলে দিয়ে তাদের থেকে টাকাও আদায় করি। আর গ্রামের সাদাসিধে মানুষ হলে তো কথাই নাই, তাদের এমনভাবে ঠকাই যে বারটা বেজে যায়।

সোমার আম্মা অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলেন, মানুষটা কাঁদো–কাঁদো হয়ে বলল, আমার কী হয়েছে আমি বুঝতে পারছিজ, উল্টাপাল্টা কথা বলে ফেলছি।

উল্টাপাল্টা বলছেন নাকি সত্যিই বলছেন?

মানুষটা আবার প্রাণপণে মুখ বন্ধ করে রাখার চেষ্টা করে কিন্তু তবু তার মুখ থেকে কথা বের হতে থাকে, এ কী বিপদের মাঝে পড়েছি! সব কথা দেখি বলে দিয়ে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারতে শুরু করেছি। এখন তো মনে হচ্ছে অন্য কথাগুলোও বলে দেব! কয়দিন আগে একজন রোগী এসেছিল, যখন ব্যথায় ছটফট করছে তখন মানিব্যাগটা সরিয়ে দিলাম কেউ টের পেল না! সেদিন ফুড পয়জনিঙে যখন একটা নতুন বউ এল, তার গলার হারটা খুলে নিলাম। ইচ্ছে করে ওভারডোজ ঘুমের ওষুধ দিয়ে রেখেছিলাম। তারপর সেই বাচ্চার কেসটা ধরা যাক–

মানুষটা আর পারল না, দুই হাতে নিজের চুল টেনে ধরে চিৎকার করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সোমা ক্ষীণ গলায় বলল, কী হয়েছে আম্মু?

তোকে নাকি একটা ভুল ওষুধ দিয়েছিল তাই ব্যথা কমছে না।

মানুষটা কী ভালো দেখেছ আম্মু? ভুল হয়ে গেছে সেটা নিজেই স্বীকার করল!

ভালো না হাতি! কী কী করেছে শুনিস নি? আস্ত ডাকাত, পুলিশের হাতে দিতে হবে। দাঁড়া আগে ঠিক ওষুধ দেওয়ার ব্যবস্থা করি।

শাহনাজ অবাক বিস্ময়ে পুরো ব্যাপারটি দেখছিল। এবারে অকারণেই গলা নামিয়ে ডক্টর জিজিকে বলল, তুমি সোমা আপুকে ভালো করে দিতে পারবে?

ডক্টর জিজি কিছুক্ষণ তার যন্ত্রপাতির দিকে তাকিয়ে বলল, মনে হয় পারব।

শাহনাজ হাততালি দিয়ে বলল, সত্যি পারবে?

হ্যাঁ।

কী করতে হবে?

ডক্টর জিজি তার যন্ত্রপাতি স্পর্শ করে বলল, সোমার হৃৎপিণ্ডে একটা সমস্যা আছে। তোমরা যেটাকে হৃৎপিণ্ড বল সেখানে একটা ইনফেকশন হয়ে একটা অংশ অকেজো হয়ে যাচ্ছে। রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা হচ্ছে, এভাবে থাকলে বড় বিপদ হয়ে যাবে।

শাহনাজ ভয় পাওয়া গলায় বলল, সর্বনাশ! কীভাবে এটা ঠিক করবে?

এখান থেকে ঠিক করা যায়। আবার শরীরের ভিতরে ঢুকে হৃৎপিণ্ডে ঢুকেও ঠিক করা যায়।

শরীরের ভিতরে ঢুকে? শাহনাজ চোখ কপালে তুলে বলল, শরীরের ভিতরে ঢুকবে কেমন করে?

ক্যাপ্টেন ডাবলু উত্তেজিত গলায় বলল, শাহপু–মনে নাই তোমাকে বলেছিলাম ডক্টর জিজি স্পেসকে ছোট করে ফেলতে পারে? আমরা সবাই মিলে এখন ছোট হয়ে কী–মজা হবে আপুর শরীরে ঢুকে যাব, তাই না ডক্টর জিজি?

ক্যাপ্টেন ডাবলু অতিরিক্ত উত্তেজনার কারণে শাহনাজের নামটি আরো সংক্ষিপ্ত করে সেটাকে শাহপু করে ফেলেছে, কিন্তু সেটা এখন কেউই খেয়াল করল না। ছোট হয়ে সোমার শরীরের ভিতর ঢুকে যাওয়ার কথাটি সত্যি কি না জানার জন্য শাহনাজ ডক্টর জিজির দিকে তাকাল। ডক্টর জিজি মাথা নাড়ল, বলল, আসলে ব্যাপারটা আমরা যেভাবেই করি না কেন, এর মাঝে টপোলজিক্যাল কিছু স্থানান্তর হবে। কিন্তু তোমাদের মনে হবে তোমরা অনেক ছোট হয়ে সোমার শরীরে ঢুকে যাচ্ছ।

শাহনাজ বুকের ভিতর আটকে থাকা একটা নিশ্বাস বের করে দিল। তারা নিশ্চয়ই এর মাঝে খানিকটা ছোট হয়ে গেছে তা না হলে মাইক্রোবাসের মতো বড় একটা স্পেসশিপ এই ছোট ঘরটায় ঢুকে গেল কেমন করে?

ডক্টর জিজি তার যন্ত্রপাতিতে হাত দিতে দিতে বলল, তোমরা শক্ত করে সিট ধরে রাখ, অনেক বড় ত্বরণ হবে।

শাহনাজ শুকনো গলায় বলল, বেশি ঝাঁকুনি হবে না তো? বেশি ঝাঁকুনি হলে আমার আবার শরীর খারাপ হয়ে যায়, বমিটমি করে দিই।

ডক্টর জিজি বলল, কিছু ঝাঁকুনি হতে পারে।

সর্বনাশ! আর সোমা আপু? তার শরীরের ভিতরে ঢুকে যাব–সে ব্যথা পাবে না তো?

চামড়া ফুটো করে শরীরের ভিতরে ঢুকে যাবার সময় একটু ব্যথা পাবে, মশার কামড় বা ইনজেকশনের মতো। তারপর আর টের পাবে না।

ভাসমান যানটি ভোঁতা শব্দ করে ঘরের ভিতরে ঘুরতে শুরু করে। শাহনাজের কেমন জানি ভয়–ভয় করতে থাকে, সে শক্ত করে তার সিটটা ধরে রাখল। ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকিয়ে দেখল তার মুখ আনন্দে জ্বলজ্বল করছে, উত্তেজনায় সবগুলো দাঁত বের হয়ে আছে। শাহনাজের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, কী খেপচুরিয়াস ফ্যান্টাগ্নিমাস কুকাডুমাস ব্যাপার! কী বুকাংটুকাস, কী নিন্টিফিটাস!

ক্যাপ্টেন ডাবলুর অর্থহীন চিৎকার শুনতে শুনতে শাহনাজ দেখতে পেল সোমার সারা ঘরটা আস্তে আস্তে বড় হতে শুরু করেছে। শুধু ঘরটা নয়, সোমাও বড় হতে শুরু করেছে, মনে হচ্ছে সোমা বিশাল একটা ভাস্কর্যের মতো বড় হয়ে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মাঝেই মনে হল তারা বুঝি এক বিশাল আদি অন্তহীন প্রান্তরে, বহুদূরে বিশাল পাহাড়ের মতো সোমা শুয়ে আছে, তাকে আর এখন মানুষ বলে চেনা যায় না। ক্যাপ্টেন ডাবলু চিৎকার করে বলল, শাহপু, দেখেছ– মনে হচ্ছে আমরা ঠিক আছি আর সবকিছু বড় হয়ে গেছে? আসলে আমরা ছোট হয়ে গেছি। কী বুকাংটুকাস ব্যাপার!

ক্যাপ্টেন ডাবলুর কাছে এটা খুব মজার বুকাংটুকাস ব্যাপার মনে হলেও শাহনাজের ভয়–ভয় করতে থাকে। কোনো কারণে তারা যদি আর বড় না হতে পারে তা হলে কী হবে? কেউ তো কখনো তাদের খুঁজেও পাবে না।

ডক্টর জিজি বলল, আমরা এখন সোমার শরীরে অনুপ্রবেশ করতে যাচ্ছি। সবাই প্রস্তুত থাক।

ভাসমান যানটা হঠাৎ মাথা নিচু করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে, শাহনাজ নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে। ভাসমান যানটা দিক পরিবর্তন করে সামনের পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে পাহাড়ের ঘুঁটিনাটি তাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এটা নিঃসন্দেহে সোমার শরীরের কোনো অংশ, সেটি এখন এত বিশাল যে কোন অংশ আর বোঝা যাচ্ছে না। হয়তো হাত, কিংবা হাতের আঙুল, কিংবা নাক বা কপাল! ডক্টর জিজি ভাসমান যানটিকে নিয়ন্ত্রণ করে সামনের দিকে ছুটিয়ে নিতে থাকে। সোমার মনে হতে থাকে তারা। বুঝি এক্ষুনি কোনো এক বিশাল পাহাড়ে আঘাত খেয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে সে চোখ বন্ধ করল। সাথে সাথে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা অনুভব করল, সাথে সাথে। চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। ক্যাপ্টেন ডাবলু আনন্দে চিৎকার করে বলল, নিন্টিফিটাস! শরীরের ভিতরে ঢুকে গেছি!

শাহনাজ ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে বলল, এত অন্ধকার কেন?

শরীরের ভিতরে তো অন্ধকার হবেই। ক্যাপ্টেন ডাবলু ডক্টর জিজিকে বলল, একটু আলো জ্বেলে দাও না।

সাথে সাথে বাইরে উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠল, শাহনাজ অবাক হয়ে দেখল বিশাল একটা পাইপের মাঝে দিয়ে তারা ছুটে যাচ্ছে পাইপে হলুদ রঙের তরল, তার মাঝে নানা ধরনের জিনিস ভাসছে। ভাসমান যানটিকে হঠাৎ কে যেন প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দেয়, আর সেই ধাক্কায় তারা সামনে ছিটকে পড়ল। শাহনাজ কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কী হয়েছে?

আমরা একটা আর্টারিতে ঢুকেছি। হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনের সাথে সাথে রক্তের চাপের জন্য এ রকম একটা ধাক্কা খেয়েছি।

রক্ত? শাহনাজ অবাক হয়ে বলল, বাইরে এটা রক্ত?

হ্যাঁ।

কিন্তু রক্ত তো লাল হবার কথা, হলুদ কেন?

ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, বুঝতে পারছ না শাহপু, আমরা এত ছোট হয়ে গেছি যে সবকিছু আলাদা আলাদা দেখতে পাচ্ছি। হলুদ তরলটা হচ্ছে প্লাজমা। মাঝে মাঝে যে লাল রঙের জিনিস দেখতে পাচ্ছ বড় বড় থালার মতো গোল গোল, সেগুলো হচ্ছে লোহিত কণিকা। আর ঐ সাদা সাদাগুলো, ভিতরে নিউক্লিয়াস, সেগুলো নিশ্চয়ই শ্বেতকণিকা। তাই না ডক্টর জিজি?

ডক্টর জিজি ভাসমান যানটিকে রক্তের স্রোতের মাঝে দিয়ে চালিয়ে নিতে নিতে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।

শাহনাজ ভয়ে ভয়ে বলল, কিন্তু শ্বেতকণিকা তো সবসময় শরীরের মাঝে রোগজীবাণুকে আক্রমণ করে! আমাদেরকে আক্রমণ করে ফেলবে না তো?

শাহনাজের কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ করে অনেকগুলো শ্বেতকণিকা তাদের। ভাসমান যানটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, প্রচণ্ড আক্রমণে তাদের ভাসমান যানটি ওলটপালট খেতে থাকে। শাহনাজ ভয়ে–আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। ডক্টর জিজি বলল, সবাই সাবধান, বাড়তি ত্বরণ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।

হঠাৎ করে তারা একটা প্রচণ্ড গতিবেগ অনুভব করল, মনে হল কোনো কঠিন জিনিস ভেদ করে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। খানিকক্ষণ ওলটপালট খেয়ে একসময় তারা স্থির হল। শাহনাজের সমস্ত শরীর গুলিয়ে আসছে, মনে হচ্ছে এখনি বুঝি হড় হড় করে বমি করে দেবে। ফ্যাকাসে মুখে সে ডক্টর জিজির মুখের দিকে তাকাল, কী হচ্ছে এখানে?

পুরো ভাসমান যানের শরীরে বৈদ্যুতিক চার্জ দিয়ে দিয়েছি। শ্বেতকণিকা এখন আর আক্রমণ করবে না।

শাহনাজ তাকিয়ে দেখল সত্যিই তাই, ভয়ঙ্কর শ্বেতকণিকাগুলো এখন দূরে দূরে রয়েছে, কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না। শাহনাজ কী একটা বলতে চাইছিল তার আগেই আবার পুরো ভাসমান যানটি দুলে উঠে প্রচণ্ড ধাক্কায় সামনে এগিয়ে যায়। প্রস্তুত ছিল না বলে ক্যাপ্টেন ডাবলু তার সিট থেকে উল্টে পড়ল, মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে উঠে বসে বলল, কী–মজা–হবে আপুর হার্ট কী শক্ত দেখেছ? একেকবার যখন বিট করে, আমরা একেবারে ভেসে যাই।

শাহনাজ অনেক কষ্ট করে বমি আটকে রেখে বলল মানুষের হার্টবিট তো সেকেন্ডে একটা করে হয়। সোমা আপুর এত দেরি করে হচ্ছে কেন?

ডক্টর জিজি বলল, আমাদের নিজেদেরকে সংকুচিত করার জন্য সময় প্রসারিত হয়ে। গেছে। বাইরের সবকিছু এখন খুব ধীরগতি মনে হচ্ছে।

ব্যাপারটি ঠিক কীভাবে হচ্ছে শাহনাজের এখন সেটা বোঝার মতো অবস্থা নেই, সে দুর্বল গলায় বলল, আমরা যদি আর্টারিতে থাকি তা হলে তো হার্ট থেকে দূরে সরে যাব। আর ব্লাডপ্রেশারের এই ধাক্কাগুলো খেতে থাকব। আমাদের এখন কি একটা ধমনীর মাঝে যাওয়ার চেষ্টা করা উচিত না?

ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, এখানে বসে থাকলে নিজ থেকেই ক্যাপিলারি হয়ে চলে যাব। তাই না ডক্টর জিজি?

ডক্টর জিজি মাথা নাড়ল। শাহনাজ ভয়ে ভয়ে বলল, কিন্তু তা হলে তো অনেক সময় লাগবে। তা ছাড়া আর্টারিতে থাকলে তো একটু পরে পরে হার্টের সেই প্রচণ্ড ধাক্কা খেতে থাকব।

ডক্টর জিজি বলল, আমরা রক্তের স্রোতের ওপর ভরসা না করে নিজেরাই এগিয়ে যাব। তা হলে সময় লাগবে না।

ক্যাপ্টেন ডাবলু আগ্রহ নিয়ে বলল, আমরা শরীরের কোন্ জায়গার ক্যাপিলারিতে যাব?

আঙুলের।

ক্যাপ্টেন ডাবলু ঠোঁট উন্টে বলল, আঙুল তো মোটেই ইন্টারেস্টিং না। ব্রেনের ভিতরে যেতে পারি না? সব নিউরনগুলোকে দেখতে পেতাম।

শাহনাজ কঠিন গলায় বলল, ডাবলু, তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে বুঝি পর্যটনের বাসে করে রাঙ্গামাটি বেড়াতে এসেছিস! যে কাজের জন্য এসেছি সেটা শেষ করে ভালোয় ভালোয় ফিরে যা।

কিন্তু শাহপু! এ রকম সুযোগ জীবনে আর কয়বার আসে তুমি বল? আমরা একজনের শরীরের ভিতরে ঢুকে সবকিছু নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছি।

আমার এত সুযোগের দরকার নেই। শাহনাজ ডক্টর জিজির দিকে তাকিয়ে বলল, ডক্টর জিজি। তুমি ক্যাপ্টেন ডাবলুর কথা শুনো না। যেখানে যাওয়ার কথা সেখানে চল।

ডক্টর জিজি তার যন্ত্রপাতিতে হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই ভাসমান যানটা একবার কেঁপে উঠে তারপর হঠাৎ দ্রুতগতিতে ছুটতে শুরু করে। বাইরের স্নাজমা, লোহিত কণিকা, শ্বেতকণিকা, আর্টারির দেয়াল সবকিছু অস্পষ্ট হয়ে আসে। এভাবে তারা কতক্ষণ গিয়েছিল কে জানে, হঠাৎ করে ভাসমান যানটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ডক্টর জিজি বলল, এসে গেছি।

কোথায় এসে গেছি?

হৃৎপিণ্ডে।

শাহনাজের পেটের ভিতরে কেমন জানি পাক খেয়ে ওঠে, কী আশ্চর্য, তারা সোমার হৃৎপিণ্ডের মাঝে হাজির হয়েছে! গোল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তারা দেখতে পায়, চকচকে ভিজে এবং গোলাপি রঙের বিশাল একটা জিনিস থরথর করে কাঁপছে, পুরো জিনিসটা হঠাৎ সংকুচিত হতে শুরু করে, এক সময় প্রচণ্ড শব্দ করে আবার ফুলে ওঠে, তার ধাক্কায় পুরো ভাসমান যানটি শূন্যে কয়েকবার ওলটপালট খেয়ে আসে। শাহনাজ তার সিট থেকে ছিটকে পড়ে গেল, কোনোমতে সোজা হয়ে বসে বলল, কী হয়েছে?

ক্যাপ্টেন ডাবলু সিটের তলা থেকে বের হয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, হার্ট বিট করছে।

শাহনাজ নিশ্বাস ফেলে বলল, সোমা আপুর হার্ট ঠিক করতে গিয়ে আমাদেরই তো মনে হচ্ছে হার্টফেল হয়ে যাবে!

ডক্টর জিজি বলল, পুরো হার্টটা একবার দেখে আসি, তারপর কাজ শুরু করব।

শাহনাজ ভয়ে ভয়ে বলল, বেসি কাছে যেয়ো না ডক্টর জিজি। হার্টটা যখন বিট করে একেবারে বারটা বেজে যায় আমার্দের।

ডক্টর জিজি তার ভাসমান যান নিয়ে হার্টটা পর্যবেক্ষণ করে আসে। শাহনাজ কিংবা ক্যাপ্টেন ডাবলু ঠিক বুঝতে পারল না, কিন্তু ডক্টর জিজি নিজে নিজে কিছু হিসাব করে কাজ শুরু করে দিল। ইনফেকশনের অংশটুকুতে কিছু খুব ছোট ছোট ভাইরাস ছিল, সেগুলোর। পিছনে ডক্টর জিজি কী সব লেলিয়ে দিল। ভয়ঙ্কর দর্শন কিছু ব্যাকটেরিয়া ছিল, শ্বেতকণিকা তাদের সাথে যুদ্ধ করে খুব সুবিধে করতে পারছিল না, ডক্টর জিজি তার কিছু রোবটকে শ্বেতকণিকার পাশাপাশি যুদ্ধ করতে পাঠিয়ে দিল। হার্টের কোষগুলোর ক্ষতি হয়েছিল, সেগুলো সারিয়ে তোলার জন্য ডক্টর জিজি তার কাজ আরম্ভ করে দিল। হার্টের ভিতরে একটা অংশ পরীক্ষা করে দেখা গেল কিছু গুরুত্বপূর্ণ আর্টারি ইনফেকশনের কারণে বন্ধ হয়ে আছে, রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে হার্টের বেশকিছু কোষ নষ্ট হয়ে গেছে, অনেক কোষ নষ্ট হবার পথে। ডক্টর জিজি আর্টারির পথ খুলে রক্তপ্রবাহ নিশ্চিত করল। হঠাৎ করে যখন। রক্তপ্রবাহ শুরু হল, রক্তের ধাক্কায় ভাসমান যানটি ওলটপালট খেয়ে একটা ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি হয়ে গেল। শক্ত করে আঁকড়ে ধরে থেকেও সিটে বসে থাকা যায় না। নষ্ট হয়ে যাওয়া কোষগুলো সরিয়ে সেখানে অন্য জায়গা থেকে কোষ এনে লাগানো হল, বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ দিয়ে সেগুলো জুড়ে দেওয়া হল, মৃতপ্রায় কিছু কোষকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য তার ভিতরে বিশেষ পুষ্টিকর জিনিস ঢোকানো হল।

এর সবকিছুর মাঝে সোমার হৃৎপিণ্ড যখন প্রতিবার স্পন্দন করে, তার প্রচণ্ড ধাক্কায় ভাসমান যানের ভিতরে সবাই ওলটপালট খেতে থাকে! শেষ পর্যন্ত যখন ডক্টর জিজি বলল, আমার ধারণা সোমার শারীরিক সমস্যাটি আমরা সারিয়ে তুলেছি তখন শাহনাজ আনন্দে চিৎকার করে উঠল। ক্যাপ্টেন ডাবলু হাতে কিল দিয়ে বলল, ক্যান্টাবুলাস! ফিকটুবুলাস!! চল এখন কী–মজা–হবে আপুর শরীরে একটা ট্যুর দিয়ে আসি?

শরীরে ট্যুর দিয়ে আসি!

হ্যা কিডনির ভিতরে দেখে আসি সেটা কেমন করে কাজ করে।

কিডনির ভিতরে? ডাবলু, তোর মাথা খারাপ হয়েছে?

তা হলে চল পাকস্থলিতে ঢুকে যাই, সেখানে দেখবে হাইড্রোক্লোরিক এসিড টগবগ করছে, একটু ভুল হলেই সবকিছু গলে যাবে! কী বুকাংটুকাস, নিন্টিফুটাস!

ডক্টর জিজিকে নিয়ে তুই একা যখন আসবি তখন তোর যা ইচ্ছে তাই করিস। এখন এই মুহূর্তে এখান থেকে বের হতে হবে! কখন কোথা থেকে কোন্ শ্বেতকণিকা আক্রমণ করবে, কোন্ এন্টিবডি এসে ধরে ফেলবে, কোন্ কেমিক্যাল জ্বালিয়ে দেবে, কোন্ নার্ভ থেকে ইলেকট্রিসিটি এসে শক দিয়ে দেবে, ব্লাডপ্রেশার আছাড় মারবে, তার কি কোনো ঠিক আছে? মানুষের শরীরের ভিতরের মতো ডেঞ্জারাস কোন্ জায়গা আছে?

তা ঠিক। কিন্তু এ রকম একটা সুযোগ আর কখনো আসবে?

না আসলে নাই। ডক্টর জিজি চল যাই।

ডক্টর জিজি মাথা নেড়ে বলল, চল।

কাজেই ক্যাপ্টেন ডাবলুকে তার আশা অসম্পূর্ণ রেখেই বের হয়ে আসতে হল। হৃৎপিণ্ডের কাছাকাছি একটা বড় আর্টারি ধরে রওনা দিয়ে গলার কাছাকাছি ছোট একটা কেপিলারি ধরে তারা বের হয়ে এল। ভাসমান যানটি আবার উপরে কয়েকবার পাক খেয়ে তার আগের আকৃতি নিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াল।

সোমা তার বিছানায় বসে একটু অবাক হয়ে তার গলায় হাত বুলাচ্ছে। পাশেই সোমার আম্মা দাঁড়িয়ে আছেন, অবাক হয়ে সোমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী হয়েছে, সোমা?

গলার কাছে কী যেন কুট করে উঠল। মশার কামড়ের মতো।

আমি মশার ওষুধ দিতে বলছি, তুই উঠে বসেছিস কেন? শুয়ে থাক।

সোমা হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে তার আম্মার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, আম্মা আমার আর শুয়ে থাকতে হবে না। আমি ভালো হয়ে গেছি। একেবারে ভালো হয়ে গেছি।

আম্মা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, কী বলছিস তুই পাগলের মতো! ডাক্তার বলেছে হার্টে ইনফেকশন

ডাক্তারকে বলতে দাও মা। আমি জানি আমি ভালো হয়ে গেছি। আমার বুকে কোনো ব্যথা নেই, আমার মাথা ঘুরছে না, আমার দুর্বল লাগছে না, আমার এত খিদে পেয়েছে যে আমার মনে হচ্ছে আমি আস্ত একটা ঘোড়া খেয়ে ফেলতে পারব!

কী বলছিস মা তুই!

হ্যা মা। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না, তাই না?

কেমন করে করি? ডাক্তার আজ সকালে এত মনখারাপ করিয়ে দিয়েছে।

ডাক্তার বলেছে আমার হার্ট রক্ত পাম্প করতে পারছে না, তাই আমি খুব দুর্বল। তাই?

হ্যাঁ।

আমি তোমার কাছে প্রমাণ করব। আমি দুর্বল না। আমি কী করব জান?

কী করবি?

আমি তোমাকে কোলে নিয়ে নাচব। বলে সত্যি সত্যি সোমা তার আম্মাকে জড়িয়ে ধরে টেনে উপরে তুলে একপাক ঘুরে এল! তারপর আনন্দে চিৎকার করে বলল, আমি ভালো হয়ে গেছি। আমি ভালো হয়ে গেছি!

সোমার আম্মা খুশিতে কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না, সোমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, খোদা নিশ্চয়ই তোকে ভালো করে দিয়েছে। কিন্তু মা, যতক্ষণ পর্যন্ত ডাক্তার তোকে পরীক্ষা না করছে আমি শান্তি পাব না। তুই চুপ করে শুয়ে থাক। বিকেলবেলা ডাক্তার আসবে।

সোমা মাথা নেড়ে বলল, না আম্মা। আমি শুয়ে থাকতে পারব না। তুমি শুয়ে থাক, আমি হাসপাতালটা ঘুরে দেখি।

কী বলছিস তুই!

আমি ঠিকই বলছি। তোমার ওপর দিয়ে অনেক ধকল গিয়েছে। তুমি শুয়ে থাক। সোমা সত্যি সত্যি তার আম্মাকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।

সোমা তার কেবিন থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে ডক্টর জিজি ভাসমান যানটি তার পিছু পিছু বের করে নিয়ে এল। এতবড় একটি ভাসমান যান কীভাবে ছোট দরজা দিয়ে বের হয়ে আসে সেটা নিয়ে শাহনাজ আর অবাক হয় না, কিছুক্ষণ আগে তারা সোমার শরীরের ভিতর থেকে ঘুরে এসেছে। সোমা হেঁটে হেঁটে সাধারণ ওয়ার্ডে এসে উঁকি দিল, সেখানে নানারকম রোগী বিছানায় শুয়ে আছে। সোমা তাদের মাঝে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা বেডের সামনে দাঁড়িয়ে যায়। চার–পাঁচ বছরের একটা ছোট বাচ্চা বিছানায় শুয়ে আছে, তার কাছে একজন মহিলা, মহিলাটির মাথার চুল এলোমেলো, উদ্ভ্রান্তের মতো চেহারা। সোমা কাছে গিয়ে নরম গলায় বলল, আপনার কী হয়েছে মা?

মহিলাটি মাথায় হাত দিয়ে ম্লানমুখে হেসে বললেন, কিছু হয় নি মা। আমার বাচ্চাটির সেলুলাইটিস হয়েছিল।

এখন কেমন আছে?

ডাক্তার বলেছে বিপদ কেটে গেছে। আল্লাহ মেহেরবান।

মা, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি কয়েকদিন কিছু খান নি, ঘুমান নি, বিশ্রাম নেন নি।

ঠিকই বলেছ মা। মা ম্লানমুখে হাসলেন, ছেলেটাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম।

সোমা বলল, এখন তো আর দুশ্চিন্তা নেই। এখন আপনি বিশ্রাম নেন। ছেলেটা আমাকে ছাড়ছে না। হাসপাতালের পরিবেশে অভ্যস্ত নয় তো।

আমি আপনার ছেলের সাথে বসি, আপনি ঘুরে আসেন। বাইরে একটা সোফা আছে, বসে দুই মিনিট ঘুমিয়ে নেন।

আমার ছেলে মানবে না, মা।

মানবে। সোমা বিছানার দিকে এগিয়ে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি জান আমি ম্যাজিক দেখাতে পারি?

বাচ্চাটি চোখ বড় বড় করে কৌতূহলী চোখে তাকাল। সোমা বিছানার পাশে বসে তার ডান হাত খুলে সেখানে একটা লজেন্স রেখে বলল, আমার এই হাতে একটা লজেন্স। এই দেখ আমি হাত বন্ধ করলাম। সোমা হাত বন্ধ করে তার হাতের উপর দিয়ে অন্য হাত নেড়ে বলল, ছুঃ মন্তর ছু! আকালী মাকালী যাদুমন্তর ছোঃ! তারপর ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, এখন বল দেখি লজেন্সটা কোথায়?

ছেলেটা বড় বড় চোখে সোমার দিকে তাকিয়ে রইল, সোমা আরো বড় বড় চোখ করে বলল, লজেন্সটা চলে গেছে তোমার পকেটে!

ছেলেটা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে সোমার দিকে তাকিয়ে নিজের পকেটে হাত দিতে গেল, সোমা তার আগেই ছেলেটার হাত ধরে বলল, উহঁ, আগেই পকেটে হাত দেবে না। আমি তো আসল ম্যাজিকটা এখনো দেখাই নি!

ছেলেটা কৌতূহলী চোখে সোমার দিকে তাকাল, সোমা চোখ বড় বড় করে তার ডান হাতটা মুষ্টিবদ্ধ রেখে বাম হাত নাড়তে শুরু করে, ছুঃ মন্তর ছুঃ কালী মন্তর ছু! পকেটের লজেন্সটা আবার আমার হাতে চলে আয়!

সোমা এবারে ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে তার ডান হাত খুলে বলল, এই দেখ লজেন্সটা তোমার পকেট থেকে আবার আমার হাতে চলে এসেছে।

ছেলেটাকে এক মুহূর্তের জন্য বিভ্রান্ত দেখায় তারপর হঠাৎ করে কৌশলটা বুঝতে পারে, সাথে সাথে বিছানায় উঠে বসে বলল, ঈশ! কী দুষ্ট! আসলে–আসলে লজেন্সটা হাতেই আছে,–আমার পকেটে যায়ই নাই। আমি যেন বুঝতে পারি না–_

সোমা চোখেমুখে ধরা পড়ে যাবার একটা ভঙ্গি করে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে রইল, তার পর হঠাৎ খিলখিল করে হাসতে থাকল। সোমার হাসি দেখে বাচ্চাটাও হাসতে থাকে, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মাও হাসতে শুরু করেন। হঠাৎ করে পুরো পরিবেশটা আনন্দময় হয়ে ওঠে।

শাহনাজ ডক্টর জিজিকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ঐ দেখ, সোমা আপু হাসছে! তাড়াতাড়ি রেকর্ড কর।

ডক্টর জিজি বলল, আমি তথ্য সংরক্ষণ করতে শুরু করেছি। অত্যন্ত বিচিত্র।

শাহনাজ উবু হয়ে বসে সোমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, দেখতে দেখতে তার মুখেও হাসি ফুটে ওঠে।

ভাসমান যানটা শহরের উপর ঘুরছে। খুব উপর থেকে নয়, মাটির কাছাকাছি মানুষজন গাড়ি দালানকোঠা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। কেউ তাদের দেখতে পাচ্ছে না, ভারি মজার একটা ব্যাপার। সোমার হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে সবার মনে খুব আনন্দ। ডক্টর জিজি যে আসলে মহাজাগতিক একটা প্রাণী, তার গায়ের রং সবুজ, বিশাল বড় মাথা, বড় বড় চোখ, নাকে দুটি গর্ত এবং কোনো মুখ নেই তবুও কথা বলে যাচ্ছে, হাতে তিনটি করে আঙুল, কোনো কাপড় পরে নেই কিন্তু তবু ন্যাংটা মনে হচ্ছে না এবং এই পুরো ব্যাপারটি প্রায় অসম্ভব একটি ঘটনা; কিন্তু শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলুর কাছে কোনোকিছুই অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। প্রয়োজনে ডক্টর জিজির শরীরে তারা থাবা দিয়েও দেখছে, তুলতুলে নরম। ঠাণ্ডা একটি শরীর, হাত দিলে প্রথমে একটু চমকে উঠলেও একটু পরে বেশ অভ্যাস হয়ে যায়।

শাহনাজ ডক্টর জিজিকে বলল, ডক্টর জিজি, সোমা আপুকে ভালো করে দেওয়ার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

ডক্টর জিজি বলল, আমরা যখন নিচুশ্রেণীর সভ্যতায় যাই সেখানে কোনো বিষয়ে হাত দিই না। কিন্তু এই ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল–

শাহনাজ চোখ পাকিয়ে বলল, আমাদের সভ্যতা নিচুশ্রেণীর?।

হ্যাঁ। সভ্যতা নিচুশ্রেণীর না হলে কেউ তাদের পরিবেশের এত ক্ষতি করে? এত মানুষকে না–খাইয়ে রাখে? নিজেরা নিজেরা যুদ্ধ করে এত মানুষকে মেরে ফেলে?

শাহনাজ কী বলবে বুঝতে পারল না। ডক্টর জিজি তো সত্যি কথাই বলেছে, আসলেই তো মানুষ অপকর্ম কম করে নি। একটা নিশ্বাস ফেলে সে বিষয়বস্তু পাল্টে ফেলার চেষ্টা করল, ডক্টর জিজি, তুমি তো সোমা আপুর হাসি রেকর্ড করেছ। সেটা হচ্ছে এক ধরনের হাসি। সোমা আপু হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ, তার মাঝে কোনো খারাপ জিনিস নেই। পৃথিবীতে যে কোনো খারাপ জিনিস থাকতে পারে সেটা সোমা আপু জানেই না, দেখলেও বিশ্বাস করবে না। কাজেই তার হাসিটা হচ্ছে একেবারে খাঁটি আনন্দের হাসি। কিন্তু পৃথিবীতে আরো অন্যরকম হাসিও আছে।

সেটা কীরকম?

যেমন মনে কর আমার কথা। আমি তো সোমা আপুর মতো ভালো না। আমার ভিতরে রাগ আছে, হিংসা আছে, কাজেই আমার হাসি হবে অন্যরকম।

সেটা কীরকম?

যেমন মনে কর ঝিনু মস্তান কিংবা মোরব্বা স্যারের কথা। এই দুইজনকে আমি দুই চোখে দেখতে পারি না। যদি তাদেরকে কোনভাবে আমি একটু মজা টের পাওয়াতে পারি তা হলে আমার এত আনন্দ হবে যে আমি খিলখিল করে হাসতেই থাকব, সেটাও এক ধরনের হাসি!

অত্যন্ত বিচিত্র!

এর মাঝে তুমি কোন্ জিনিসটাকে বিচিত্র দেখছ?

একজনকে মজা দেখিয়ে অন্যজনের মজা পাওয়া।

এটা মোটেও বিচিত্র না। এটা সবচেয়ে স্বাভাবিক। এটা দুনিয়ার নিয়ম

শাহনাজের কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ করে ভাসমান যানটি দাঁড়িয়ে গেল। শাহনাজ চমকে উঠে বলল, কী হয়েছে?

মোবারক আলী স্যারের বাসায় এসেছি।

শাহনাজ অবাক হয়ে বলল, সে কী! কখন এলে? কীভাবে এলে? চিনলে কীভাবে?

আমি সব চিনি, আমি দেখতে চাই তুমি মজা দেখিয়ে কীভাবে মজা পাও।

কিন্তু আমি কীভাবে মজা দেখাব?

সেটা তুমি ঠিক কর।

শাহনাজ নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি বুঝতে পারছ না ডক্টর জিজি। মোর স্যার। আসলে মানুষ না, কোনো দৈত্য–দানব। শুধু ওপরের চামড়াটা মানুষের। আমি যদি তাকে মজা দেখাতে যাই তা হলে আমাকে ধরে কাঁচা খেয়ে ফেলবে।

ডক্টর জিজি মাথা নাড়ল, বলল, সে যেন তোমাকে খেতে না পারে আমি সেটা দেখব। আমি তোমাকে সবরকম সাহায্য করব।

শাহনাজ চোখ বড় বড় করে বলল, সবরকম?

হ্যাঁ। সবরকম।

আমি যদি বলি, স্যার আপনার নাকটা এক হাত লম্বা হয়ে যাক–তা হলে স্যারের নাকটা এক হাত লম্বা হয়ে যাবে?

যা। তা হলে আমি তার নাকের মাঝে গিয়ে কোষ বিভাজন অনেক দ্রুত করে দেব যেন তোমাদের মনে হয় নাকটা লম্বা হয়ে গিয়েছে।

শাহনাজ নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, আমি যদি বলি আপনি শূন্যে ঝুলে থাকবেন তা হলে স্যার শূন্যে ঝুলে থাকবে?

হ্যাঁ, আমাকে ছোট একটা স্কাউটশিপ পাঠিয়ে তাকে উপরে তুলে রাখতে হবে।

শাহনাজ হাততালি দিয়ে বলল, ইশ! কী মজা হবে! আমাকে এক্ষুনি নামিয়ে দাও ডক্টর জিজি! শাহনাজ ক্যাপ্টেন ডাবলুকে জিজ্ঞেস করল, ডাবলু, তুই যাবি?

না, শাপু। তুমি যাও আমি এখান থেকে দেখি ডক্টর জিজি কী করে!

শাহনাজ চোখ বড় বড় করে বলল, কী বললি? শাপু? আমার নামটা ছোট করতে করতে এখন শাপু করে ফেলেছিস!

ক্যাপ্টেন ডাবলু হি হি করে হেসে বলল, কেন শাপ, তোমার আপত্তি আছে?

না নেই। আমি দেখতে চাই ছোট হতে হতে শেষ পর্যন্ত কী হয়! শাহনাজ ডক্টর জিজির দিকে তাকিয়ে বলল, এখন আমাকে নামিয়ে দাও। যখন বলব তখন আবার আমাকে তুলে নিও, ঠিক আছে?

ঠিক আছে।

শাহনাজ ভাসমান যান থেকে নেমে এদিক–সেদিক তাকাল, কেউ তাকে দেখতে পায় নি। যদি দেখত তা হলে ভয়ে চিৎকার শুরু করৎ, একেবারে অদৃশ্য থেকে হঠাৎ একজন মানুষ হাজির হলে ভয়ে চিৎকারই করার কথা। শাহনাজ স্যারের বাসার দরজায় শব্দ করল, প্রায় সাথে সাথেই একজন দরজা খুলে দেয়। শাহনাজদের স্কুলের একটা মেয়ে, তাকে দেখে অবাক হয়ে বলল, শাহনাজ আপু, তুমি?

হ্যাঁ। মোরব্বা স্যার আছে?

মেয়েটি মুখে আঙুল দিয়ে বলল, শ–স–স–স, স্যার শুনতে পাবে।

শুনলে শুনবে। আমি আর ভয় পাই না। স্যার কোথায়?

ঐ ঘরে, ব্যাচে পড়াচ্ছে আমাদের।

চল যাই, স্যারের সাথে দেখা করতে হবে।

শাহনাজ পাশের ঘরে গিয়ে দেখতে পেল একটা বড় ঘরে অনেকগুলো মেয়ে গাদাগাদি করে বসে আছে, সামনে একটা চেয়ারে পা তুলে কুৎসিত ভঙ্গিতে বসে থেকে একটা খবরের কাগজ পড়তে পড়তে স্যার নাক খুঁটছে। শাহনাজকে দেখে স্যার ভুরু কুঁচকে বললেন, কে?

আমি স্যার।

মোবারক স্যার খেঁকিয়ে উঠলেন, আমিটা আবার কে?

আমার নাম শাহনাজ। আপনার ছাত্রী।

ও। স্যার নাক খুঁটতে খুঁটতে জিজ্ঞেস করলেন, কী চাস?

অনেক দিন থেকেই আপনাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম।

কী কথা?

আপনি যে ক্লাসে কিছু পড়ান না, সবাইকে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেন সেটা খুব অন্যায়।

শাহনাজের কথা শুনে মোবারক স্যারের চোয়াল স্কুলে পড়ল, খানিকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলেন না, মাছকে পানি থেকে ডাঙায় তুললে যেভাবে খাবি খেতে থাকে সেভাবে খাবি খেতে লাগলেন। তারপর নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস বের করে বললেন, কী বললি?

আমি বলেছি যে আপনি যে ক্লাসে কিছু পড়ান না, সবাইকে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেন সেটা খুব অন্যায়।

মোবারক স্যার যেখানে বসে ছিলেন সেখানেই বসে থেকে কীভাবে যেন লাফিয়ে উঠলেন, উত্তেজনায় তার লুঙ্গি খুলে গেল এবং কোনোভাবে সেই লুঙ্গি ধরে চিৎকার দিয়ে বললেন, তবে রে পাজি মেয়ে। বদমাইশির জায়গা পাস না

অন্য যে কোনো সময় হলে ভয়ে শাহনাজের জান উড়ে যেত, কিন্তু আজ অন্য ব্যাপার, সে ভয় পেল না। বরং মুখটা হাসি–হাসি করে বলল, আপনি আরো বড় বড় অন্যায় কাজ করেন স্যার! পরীক্ষার আগে ছাত্রীদের কাছে থেকে টাকা নিয়ে তাদের পরীক্ষার প্রশ্ন বলে দেন। সেটা আরো বড় অন্যায়।

তবে রে শয়তানী বলে মোবারক স্যার শাহনাজের দিকে একটা লাফ দিলেন। কিন্তু তখন খুব বিচিত্র একটা ব্যাপার হল, মনে হল মোবারক স্যার অদৃশ্য একটা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে উল্টে পড়ে গেলেন। কোনোমতে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে চারদিকে তাকালেন এবং ঠিক তখন একটা মেয়ে কোথায় জানি হাসি চাপার চেষ্টা করতে করতে শেষ পর্যন্ত না পেরে ফিচ করে একটু হেসে ফেলল। মোবারক স্যার চারদিকে মুখ ঘুরিয়ে একটা হুংকার দিয়ে বললেন, চোপ, সবাই চোপ!

শাহনাজ নরম গলায় বলল, শব্দটা হচ্ছে চুপ। বাংলায় চোপ বলে কোনো শব্দ নেই।

তবে রে বদমাইশি– বলে মোবারক স্যার শাহনাজের উদ্দেশে আরেকটা লাফ দিলেন, কিন্তু আবার অদৃশ্য দেয়ালে আঘাত খেয়ে নিচে আছাড় খেয়ে পড়লেন। বেশকিছু মেয়ে লাফিয়ে সরে গিয়ে ঠিকভাবে আছাড় খাবার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা করে দিল। শাহনাজ তখন দুই পা অগ্রসর হয়ে বলল, স্যার খামোকা আমাকে ধরার চেষ্টা করবেন না। পারবেন না। এর চাইতে অপরাধ স্বীকার করে ফেলেন।

মোবারক স্যারের কপাল ফুলে উঠেছে, সেখানে হাত বুলাতে বুলাতে হিংস্র চোখে বললেন, কী বললি তুই?

আমি বলছি যে আপনি যে প্রাইভেট পড়ানোর নাম করে ছাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদেরকে পরীক্ষার প্রশ্ন বলে দেন, কিছু শেখান না–সেটা স্বীকার করে নেন।

তুই কে? তোর কাছে কেন আমি স্বীকার করব?

শাহনাজ সব মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা সব সাক্ষী। আমি কিন্তু স্যারকে একটা সুযোগ দিয়েছি। দিই নি?

মেয়েরা আনন্দে সবগুলো দাঁত বের করে জোরে জোরে মাথা নাড়ল। শাহনাজ মোবারক স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার এখনো সময় আছে। আপনি যদি অপরাধ স্বীকার করেন, আপনাকে এবারের মতো মাফ করে দেওয়া হবে। আর যদি স্বীকার না করেন, মিথ্যা কথা বলেন, খুব বড় বিপদ হবে।

কতবড় সাহস তোর? আমাকে বিপদের ভয় দেখাস!

জি স্যার। মিথ্যা কথা বললেই আপনার নাকটা এক হাত লম্বা হয়ে যাবে।

মোবারক স্যার চিৎকার করে বললেন, আমি মিথ্যা কথা বলি না। স্যারের কথা শেষ হবার আগেই সড়াৎ করে একটা শব্দ হল আর সবাই অবাক হয়ে দেখল স্যারের নাকটা লম্বা হয়ে পেট পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে। গাদাগাদি করে বসে থাকা মেয়েগুলো ভয় পেয়ে চিৎকার করে সবাই পিছনে সরে এল। শাহনাজ হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে মাথা নেড়ে বলল, আমি বলছিলাম না? আপনি আমার কথা শুনলেন না!

মোবারক স্যার একেবারে হতভম্ব হয়ে নিজের নাকের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তাকে দেখে মনে হতে লাগল একটা সাপ বুঝি নাককে কামড়ে ধরেছে। ভয়ে ভয়ে তিনি লম্বা নাকটা ধরলেন, তারপর একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে সেটাকে খুলে ফেলার চেষ্টা করলেন এবং হঠাৎ করে আবিষ্কার করলেন, সত্যি সত্যি তার নাক লম্বা হয়ে গেছে।

গাদাগাদি করে বসে থাকা মেয়েগুলোর ভিতর থেকে একজন হঠাৎ আবার ফিচ করে হেসে ফেলল। হাসি ভয়ানক সংক্রামক একটি জিনিস, ফিচ শব্দটি শুনে আরো অনেকে ফিচ ফিচ করে হাসতে শুরু করল। প্রথমে আস্তে আস্তে তারপর বেশ জোরে। শাহনাজ অনেকক্ষণ চেষ্টা করে আর নিজেকে সামলাতে পারল না, খিলখিল করে হাসতে শুরু করল।

মোবারক স্যার নিজের লম্বা নাকটা ধরে হতভম্বের মতো বসে রইলেন, কয়েকবার কিছু একটা বলতে চেষ্টা করে থেমে গেলেন। শাহনাজ হাসি থামিয়ে বলল, স্যার, আপনি যেসব। অন্যায় করেছেন সেগুলো একটা একটা করে বলতে থাকেন, তা হলে আপনার নাক এক ইঞ্চি করে ছোট হয়ে যাবে।

সার কাঁদো–কাদো গলায় বললেন, সত্যি হবে?

হবে স্যার, চেষ্টা করে দেখেন। শাহনাজ একগাল হেসে বলল, আর যদি সেটা না করতে চান তা হলে ডাক্তারের কাছে যেতে পারেন, অপারেশন করে ছোট করে দেবে।

স্যার শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছে নাক মুছতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন এখন আর আগের মতো নাক মুছতে পারছেন না, এবারে শুঁড়ের মতো নাকের ডগা মুছতে হচ্ছে। শাহনাজ ঘরে গাদাগাদি করে বসে থাকা মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা স্যারকে সাহায্য কর। একটা বড় লিস্ট করে দাও, স্যার সেই লিস্ট দেখে একটা একটা করে বলবেন। ঠিক আছে?

মেয়েগুলো আনন্দে মুখ ঝলমল করে একসাথে চিৎকার করে বলল, ঠিক আছে, শাহনাজ আপু।

শাহনাজ মোবারক স্যারের ঘর থেকে বের হওয়া মাত্রই তাকে টুক করে টেনে ডক্টর জিজির ভাসমান যানে তুলে নিল। সেখানে উঠে শাহনাজ দেখতে পেল ক্যাপ্টেন ডাবলু পেটে হাত দিয়ে খিকখিক করে হাসছে এবং ডক্টর জিজি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকিয়ে আছে। শাহনাজ জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

ঐ দেখ।

শাহনাজ দেখতে পেল মোবারক স্যার জবুথবু হয়ে বসে আছেন। মেয়েরা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। একজনের হাতে একটা রুলার, সে নাকটাকে লম্বা করে টেনে ধরে মাপছে। অন্যেরা একটা লিস্ট তার সামনে ধরে রেখেছে, তিনি একটা একটা করে সেটা পড়ছেন। শাহনাজ দৃশ্যটা দেখে আবার হি হি করে হেসে উঠল। ডক্টর জিজি মাথা নেড়ে বলল, অত্যন্ত বিচিত্র!

সে যন্ত্রপাতিতে হাত দিতেই ভাসমান যানটি মৃদু একটা ভোঁতা শব্দ করে হঠাৎ করে ঘুরে গেল, মুহূর্তে চারদিক ঝাঁপসা হয়ে যায়। শাহনাজ বলল, এখন বাকি আছে শুধু ঝিনু মস্তান। তাকে একটা শিক্ষা দিতে পারলেই কেস কমপ্লিট।

ঝিনু মস্তান? ডক্টর জিজি শাহনাজের মুখের দিকে তাকাল।

হ্যাঁ। এমন টাইট দেব যে সে জন্মের মতো সিধে হয়ে যাবে!

তুমি কি নিশ্চিত যে তাকে তুমি টাইট দিতে চাও?

হ্যাঁ। যেদিন আমাদের পরীক্ষা শেষ হয়েছিল সেদিন কী করেছিল জান? ঘুসি মেরে আমার নাকটা চ্যাপ্টা করে দিয়েছিল। মহা গুণ্ডা।

ডক্টর জিজি বলল, তা হলে কি আমি তোমাকে তার কাছাকাছি কোথাও নামিয়ে দেব?

হ্যাঁ। আর মনে আছে তো আমি যেটাই বলব সেটাই করবে।

ঠিক আছে।

শাহনাজ ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকিয়ে বলল, ডাবলু, তুই নামবি এবার?

ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নাড়ল, বলল, না। এখান থেকে দেখায় মজা বেশি।

কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ করে ভাসমান যানটা একটা শব্দ করে থেমে গেল এবং শাহনাজ আবিষ্কার করল সে কাওরানবাজারের কাছাকাছি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে। ডক্টর। জিজি তাকে খুব কায়দা করে নামিয়েছে কেউ কিছু সন্দেহ করে নি। কিন্তু ঝিনু মস্তানের কাছে না নামিয়ে তাকে রাস্তায় নামিয়ে দিল কেন কে জানে। ডক্টর জিজি অবশ্য ভুল করার। পাত্র নয়, এই রাস্তার মাঝে নামিয়ে দেবার নিশ্চয়ই একটা কারণ আছে। শাহনাজ এদিক সেদিক তাকাল এবং হঠাৎ করে ভয়ানকভাবে চমকে উঠল। ফুটপাত থেকে একটু দূরে রাস্তায় একটা রিকশায় ঝিনু মস্তান বসে আছে, তাকে ঘিরে তিনজন সত্যিকারের মস্তান। একজনের হাতে একটা জংধরা রিভলবার, অন্যজনের হাতে একটা বড় চাকু, তিন নম্বর মস্তানের হাতে একটা লোহার রড। কাছেই একটা স্কুটার দাঁড়িয়ে আছে, মস্তানগুলো মনে হয় এই স্কুটার থেকেই নেমেছে। লোহার রড হাতে মস্তানটি তার রড দিয়ে রিকশার সিটে প্রচণ্ড জোরে একটা আঘাত করল, মনে হয় ভয় দেখানোর জন্য। রিভলবার হাতে মস্তানটি তার রিভলবারটি ঝিনু মস্তানের দিকে তাক করে খনখনে গলায় চিৎকার করে বলল, দে ছেমড়ি, গলার চেইনটা দে।

শাহনাজ ঝিনু মস্তানের দিকে তাকাল, ক্লাসে তাকে তারা ঠাট্টা করে মস্তান বলে ডাকত কিন্তু এখন সত্যিকারের মস্তানের সামনে তাকে কী অসহায় লাগছে! ঝিনু তার গলা থেকে চেনটা খোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু ভয়ে তার হাত কাঁপছে বলে খুলতে পারছে না। চাকু হাতে মস্তাটা ক্রমাগত নড়ছে আর চোখের কোনা দিয়ে এদিক–সেদিক তাকাচ্ছে, সে অধৈর্য হয়ে হঠাৎ লাফিয়ে ঝিনুর গলার চেনটা ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিল। চেনটা ছিঁড়ে তার হাতে এসে যায় কিন্তু তাল সামলাতে না পেরে ঝিনু রিকশা থেকে হুমড়ি খেয়ে নিচে এসে পড়ল।

শাহনাজ চারদিকে তাকাল, রিকশাটা ঘিরে দূরে দূরে মানুষজন দেখছে, কেউ ভয়ে কাছে আসছে না। ঝিনু রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে, মুখ বিকৃত করে যন্ত্রণাটা সহ্য করে ওঠার চেষ্টা করছে! মস্তানগুলো এদিক–সেদিক তাকাতে তাকাতে স্কুটারে ওঠার জন্য ছুটতে শুরু করেছে, তখন শাহনাজ ছুটে যেতে শুরু করে। চিৎকার করে বলল, ঐ ঐ মস্তানের বাচ্চা মস্তান, যাস কোথায় পালিয়ে? খবরদার যাবি না।

অন্য যে কেউ এ ধরনের কথা বললে মস্তানরা কী করত জানা নেই, কিন্তু শাহনাজের বয়সী একটা মেয়ের মুখে এ রকম একটা কথা শুনে মস্তানগুলো ঘুরে দাঁড়াল। রিভলবার

হাতে মস্তানটি তার রিভলবার তাক করে বলল, চুপ ছেমড়ি। একেবারে শেষ করে ফেলব।

শাহনাজ চুপ করল না, চিৎকার করতে করতে ঝিনুকে টেনে তুলে বলল, ওঠ ঝিনু, তাড়াতাড়ি ওঠ। এই মস্তানগুলোকে বানাতে হবে।

ঝিনু তখনো কিছু বুঝতে পারছে না, অবাক হয়ে শাহনাজের দিকে তাকিয়ে আছে। শাহনাজ তখন চিৎকার করতে করতে মস্তানগুলোর দিকে ছুটে যেতে থাকে, খবরদার নড়বি না মস্তানের বাচ্চা মস্তানেরা, শেষ করে ফেলব, খুন করে ফেলব।

মস্তানগুলো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না যে এইরকম পুঁচকে একটা মেয়ে তাদেরকে এতটুকু ভয় না পেয়ে এ রকমভাবে তাদের কাছে ছুটে আসছে! রিভলবার হাতে মস্তানটির আর সহ্য হল না, সে তার রিভলবারটি শাহনাজের দিকে তাক করে মুখ খিঁচিয়ে কুৎসিত একটা গালি দিয়ে গুলি করে বসল। গুলোটা অদৃশ্য একটা দেয়ালে আঘাত করে তাদের দিকে ফিরে গেল—-সেটা অবশ্য উত্তেজনার কারণে মস্তানেরা টের পেল না।

শাহনাজ মস্তানগুলোর কাছে এসে নিজের দুই হাতের তর্জনী বের করে ছোট বাচ্চারা যেভাবে রিভলবার তৈরি করে খেলে সেভাবে খেলার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বলল, এই যে ছারপোকার বাচ্চারা–ভেবেছিস শুধু তোর রিভলবার আছে, আমার নেই? এই দ্যাখ আমার দুই রিভলবার, গুলি করে বারটা বাজিয়ে দেব কিন্তু।

মস্তানগুলো অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে শাহনাজের দিকে তাকিয়ে রইল, এখন তাদের সন্দেহ হতে শুরু করেছে যে মেয়েটি সম্ভবত পাগল। তারা আর সময় নষ্ট করল না, স্কুটারের দিকে ছুটে যেতে শুরু করল। শাহনাজ তখন রিভলবারের ভঙ্গিতে ধরে রাখা তর্জনীটি স্কুটারের দিকে তাক করে বলল, গুলি করলাম কিন্তু, তারপর মুখ দিয়ে শব্দ করল, ডিচুম।

সাথে সাথে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে স্কুটারটা মাটি থেকে লাফিয়ে উপরে উঠে গেল। মস্তান তিনটি চমকে উঠে ঘুরে শাহনাজের দিকে তাকায়, এই প্রথমবার তাদের মুখে ভয়ের চিহ্ন ফুটে ওঠে।

শাহনাজ দুই হাতের দুই তর্জনী তাক করে বলল, কী আমার সোনার চানেরা, বিশ্বাস হল যে আমি গুলি করতে পারি? এই দেখ বলে শাহনাজ আবার কাউবয়ের ভঙ্গিতে দুই হাত দিয়ে ডিচুম করে গুলি করতে থাকে, আর কী আশ্চর্য প্রত্যেকবার গুলি করার সাথে স্কুটারটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে থাকে।

ঝিনু এতক্ষণ হতভম্ব হয়ে পুরো ব্যাপারটি দেখছিল, এবার সে পায়ে পায়ে শাহনাজের কাছে এগিয়ে এল। শাহনাজ বলল, হা করে দেখছিস কী? গুলি কর।

ঝিনু বলল, গুলি করব? কীভাবে?

শাহনাজ নিজের হাতকে রিভলবারের মতো করে বলল, এই যে এইভাবে।

তা হলেই গুলি হবে?

হ্যাঁ। এই দেখ– বলে সে আবার ডিচুম ডিচুম করে কয়েকটা গুলি করল। সত্যি সত্যি সাথে সাথে কয়েকটা বিস্ফোরণ হল। ঝিনু অনিশ্চিতের মতো নিজের হাতটাকে রিভলবারের মতো করে স্কুটারের দিকে তাক করে গুলি করার ভঙ্গি করল, সাথে সাথে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে স্কুটারটা লাফিয়ে ওঠে। ঝিনু অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে একবার নিজের হাতের দিকে, আরেকবার স্কুটারটার দিকে তাকাল সত্যি সত্যি নিজের আঙুল দিয়ে সে গুলি করে ফেলেছে সেটা এখনো সে বিশ্বাস করতে পারছে না।

বিস্ফোরণ এবং গুলির শব্দ শুনে তাদের ঘিরে মানুষের ভিড় জমে গেছে। মস্তানগুলো কী করবে বুঝতে পারছে না, পালিয়ে যাবার জন্য রিভলবার তাক করে একদিকে ছুটে যাবার চেষ্টা করল, কিন্তু অদৃশ্য একটা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ল। তাদেরকে অদৃশ্য একটা দেয়াল ঘিরে রেখেছে সেটা এখনো বুঝতে পারছে না।

শাহনাজ ঝিনুকে বলল, আয় এখন মস্তানগুলোকে বানাই।

ঝিনু তার হাতের অদৃশ্য রিভলবারের দিকে তাকিয়ে বলল, এইটা দিয়ে গুলি করলে মরে যাবে না?

হ্যাঁ। রবার বুলেট দিয়ে করতে হবে।

ঝিনু মুখ হাঁ করে বলল, রবার বুলেট?

হ্যাঁ, এই নে। শাহনাজ ঝিনুর হাতে কাল্পনিক রবার বুলেট ধরিয়ে দেয়। ঝিনু কী করবে বুঝতে পারছিল না। শাহনাজ গম্ভীর গলায় বলল, ভরে নে। তারপর নিজে তার রিভলবারে রবার বুলেট ভরে নেওয়ার ভঙ্গি করে সেটি মস্তানদের দিকে তাক করল, সাথে সাথে মস্তানদের কুৎসিত মুখ রক্তশূন্য হয়ে যায়। শাহনাজ সময় নিয়ে গুলি করল এবং অদৃশ্য গুলির আঘাতে একজন মস্তান নিচে ছিটকে পড়ল। তার মনে হল প্রচও ঘুসিতে কেউ তাকে ধরাশায়ী করে ফেলেছে। এতক্ষণে ঝিনুও তার অদৃশ্য রিভলবারে অদৃশ্য রবার বুলেট ভরে নিয়েছে, সে দ্বিতীয় মস্তানটির দিকে তাক করতেই মস্তানটি হঠাৎ দুই হাজাড় করে হাঁটু ভেঙে মাটিতে পড়ে যায়। ঝিনু মস্তানের তবু মায়া হল না, সে অদৃশ্য রিভলবারের ট্রিগার টেনে ধরতেই দ্বিতীয় মস্তানটিও ধরাশায়ী হয়ে গেল। স্কুটারের ড্রাইভার এবং রড হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মস্তানটি এখনো নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছিল, মজা–দেখা মানুষেরা এখন তাদের দিকে ছুটে আসতে রু করে। শাহনাজ নিচু গলায় বলল, এখন পালা, বাকিটা পাবলিক ফিনিশ করবে।

দাঁড়া, আমার চেনটা নিয়ে নিই শুয়ে কাতরাতে থাকা মস্তানটির কাছে গিয়ে ঝিনু তার মাথায় অদৃশ্য রিভলবার ধরে বলল, আমার চেন।

মস্তানটি কোনো কথা না বলে সাথে সাথে পকেট থেকে তার চেনটা বের করে দিল। ঝিনু চেনটা হাতে নিয়ে শাহনাজকে বলল, চল্। পালাই।

তারপর দুজন ঘুরে ফুটপাত ধরে ছুটতে থাকে। রাস্তার মোড়ে ঘুরে গিয়ে দুজন একটা ছোট গলিতে ঢুকে পড়ে। ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে দুজন একটা দেয়ালের পাশে দাঁড়াল। বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে প্রথমে আস্তে আস্তে, তারপর জোরে জোরে হাসতে শুরু করে। হাসতে হাসতে শাহনাজের চোখে পানি এসে গেল, সে চোখ মুছে ঝিনুকে বলল, এখন বাড়ি যা, ঝিনু মস্তান!

ঝিনু শাহনাজকে ধাক্কা দিয়ে বলল, আমাকে মস্তান বলছিস? তুই হচ্ছিস সবচেয়ে বড় মস্তান!

শাহনাজ কিছু বলল না, চোখ মটকে বলল, আমাকে যেতে হবে।

কোথায়?

শাহনাজ হাতের অদৃশ্য রিভলবার দুটি দেখিয়ে বলল, এই অস্ত্রগুলো ফেরত দিতে হবে না।

ঝিনু নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, আমারটা?

রেখে দে।

এখনো কাজ করবে?

শাহনাজ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, জানি না। গুলি থাকলে কাজ করবে।

ঝিনু তার হাতের অদৃশ্য রিভলবারে অদৃশ্য গুলি আছে কি না সেটা দেখার চেষ্টা করতে লাগল, শাহনাজ কোথায় কোনদিকে অদৃশ্য হয়ে গেছে সেটা বুঝতেও পারল না।

ডক্টর জিজি শাহনাজের হাতে একটা ছোট শিশি দিয়ে বলল, এই নাও। শিশিটা হাতে নিয়ে শাহনাজ বলল, এটা কী?

তোমার ভাই। শিশিতে ভরে দিয়েছি। তুমি যেরকম চেয়েছিলে।

শাহনাজ শিশির ভিতর উঁকি দিয়ে দেখল একটা নিখুঁত পুতুলের মতো ইমতিয়াজের ছোট দেহটি ক্যামেরায় ছবি তোলার ভঙ্গিতে স্থির হয়ে আছে। শাহনাজ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া জেগে উঠবে না?

হ্যাঁ, আমরা চলে যাবার সাথে সাথে জেগে উঠবে।

তখনো কি এ রকম ছোট থাকবে?

না, তখন এ রকম ছোট থাকবে না। স্বাভাবিক আকারের হয়ে যাবে।

তোমরা কখন যাবে?

পৃথিবীতে আমাদের কাজ শেষ হয়েছে, আমরা এখনই যাব।

শাহনাজের বুকে হঠাৎ কেমন জানি মোচড় দিয়ে ওঠে, সে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আবার কবে আসবে?

সময় এবং অবস্থান সম্পর্কে তোমাদের ধারণা এবং আমাদের ধারণা এক নয়। আমরা আবার যদি আসি সেই সময়টা এক মুহূর্ত পরে হতে পারে আবার এক যোজন হতে পারে। কারণ–

শাহনাজ তার মাথা চেপে ধরে বলল, থাক, থাক, অনেক হয়েছে। আবার ঐসব কঠিন কঠিন কথা বোলো না, মাথা গুলিয়ে যায়।

আমি বলতে চাই না, তুমি জিজ্ঞেস কর দেখে আমি বলি।

ক্যাপ্টেন ডাবলু বলল, আমরা তোমাদের কয়েকটা ছবি তুলতে পারি?

ডক্টর জিজি মাথা নাড়ল, বলল, তুলতে পার। কিন্তু তুলে কী লাভ? তোমরা যেটা দেখছ সেটা তোমাদের বোঝার সুবিধার জন্য একটা সহজ রূপ। এটা সত্যি নয়।

তবু এটাই তুলতে চাই।

বেশ। তুলো।

ক্যাপ্টেন ডাবলু তখন শাহনাজের আব্বার ক্যামেরাটা দিয়ে অনেকগুলো ছবি তুলল। ডক্টর জিজির ছবি, ডক্টর জিজি এবং শাহনাজের ছবি, ডক্টর জিজি এবং ক্যাপ্টেন ডাবলুর ছবি, শাহনাজ এবং ক্যাপ্টেন ডাবলুর সাথে ডক্টর জিজির ছবি, শিশির ভিতরে ইমতিয়াজকে হাতে নিয়ে শাহনাজের ছবি ইত্যাদি ইত্যাদি।

ছবি তোলা শেষ হবার পর বিদায় নেবার পালা। শাহনাজ একটু ধরা গলায় বলল, ডক্টর জিজি, তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে থাকলে কিছু মনে কোরো না।

আমাদের কাছে খারাপ–ভালো বলে কিছু নেই।

ও আচ্ছা! আমার মনেই থাকে না।

ক্যাপ্টেন ডাবল বলল, সাবধানে যেয়ো। গ্যালাক্সিতে কত রকম বিপদআপদ থাকতে পারে, ব্ল্যাকহোল, কোয়াজার নিউট্রন স্টার।

ডক্টর জিজি বলল, আমরা সাবধানেই যাব।

উপায় থাকলে বলতাম, বাড়ি পৌঁছে একটা ই–মেইল পাঠিয়ে দিও। কিন্তু কোনো উপায় নেই।

না, নেই।

ক্যাপ্টেন ডাবলু মাথা নেড়ে বলল, আরেকবার এলে দেখা না করে যেয়ো না কিন্তু।

যদি তোমরা থাক তোমাদের খুঁজে বের করব। কিন্তু

কিন্তু কী?

তোমাদের কিছু মনে থাকবে না।

মনে থাকবে না? না। কেন?

আমরা যখন নিচুশ্রেণীর কোনো সভ্যতার কাছে যাই তখন চেষ্টা করি সেখানে বিন্দুমাত্র কোনো পরিবর্তন না করতে। এখানে যেসব পরিবর্তন করা হয়েছে সেগুলো আবার আগের মতো করে যেতে হবে।

তার মানে?

হাসপাতালের মানুষটি যে জোরে জোরে চিন্তা করছে তাকে ঠিক করে দিতে হবে। মোবারক স্যারের নাক, তার ছাত্রীদের স্মৃতি, ঝিনু মস্তান আর সন্ত্রাসী, আশপাশের লোকজন, তোমার ভাই ইমতিয়াজ, সবার সকল স্মৃতি ভুলিয়ে দিতে হবে। কারো কিছু মনে থাকবে না।

শাহনাজের মুখে হঠাৎ আতঙ্কের ছায়া পড়ে, তা হলে কি সোমা আপুকে আবার অসুস্থ করে দেবে?

আমাদের নিয়ম অনুযায়ী তা–ই করার কথা ছিল, কিন্তু তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার কারণে তাকে আমরা আর অসুস্থ করব না। সে ভালো হয়ে আছে ভালোই থাকবে।

শাহনাজ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, আর আমরা, আমাদের স্মৃতি? আমরাও কি সব ভুলে যাব?

ডক্টর জিজি ফোঁস করে একটা শব্দ করে বলল, তোমরা কী চাও? মনে রাখতে চাও?

শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলু একসাথে বলে উঠল, হ্যাঁ, আমরা মনে রাখতে চাই!

বেশ। তা হলে তোমরা মনে রেখো। এই পৃথিবীতে আমরা মাত্র তিনটি জিনিস রেখে যাচ্ছি।

কী কী জিনিস?

সোমার সুস্থ শরীর। ক্যামেরায় ছবি। আর তোমাদের দুজনের স্মৃতি।

ক্যামেরার ছবিগুলো কি আমরা অন্যদের দেখাতে পারি?

ইচ্ছে হলে দেখিও।

তোমাদের কথা কি অন্যদের বলতে পারি?

ইচ্ছে হলে বোলো৷

তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ডক্টর জিজি। অনেক অনেক ধন্যবাদ।

ডক্টর জিজি কোনো কথা না বলে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। শাহনাজ এবং ক্যাপ্টেন ডাবলু দুজনেই জানে ডক্টর জিজির এটি একটি কাল্পনিক রূপ কিন্তু তবুও তার প্রতি গভীর মমতায় তাদের বুকের ভিতর কেমন জানি করে ওঠে। শাহনাজ কিছু একটা বলতে চাইছিল

কিন্তু তার আগেই হঠাৎ করে একটা ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করে। বাতাসের ঝাঁপটায় তারা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, মাথা নিচু করে বসে পড়ে। তারা বুঝতে পারে তীব্র বাতাসে তারা উড়ে যাচ্ছে, ভেসে যাচ্ছে। শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলু বাতাসে শরীর এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে–তারা জানে ডক্টর জিজি গভীর ভালবাসায় তাদেরকে পৃথিবীর মাটিতে নামিয়ে দেবে।

শাহনাজ যখন চোখ খুলে তাকাল তখন তাদের সামনে ইমতিয়াজ দাঁড়িয়ে আছে। সে অত্যন্ত সন্দেহের চোখে শাহনাজ আর ক্যাপ্টেন ডাবলুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোরা এখানে কখন এসেছিস?

শাহনাজ আমতা আমতা করে বলল, এই তো একটু আগে।

ইমতিয়াজ চিন্তিত মুখে বলল, কী একটা ছবি তুলতে এসেছিলাম, মনে করতে পারছি ন্য।

শাহনাজ বলল, মনে হয় এই ঝরনাটার।

ইমতিয়াজ ঘুরে তাকাল, পাহাড়ের উপর থেকে পানির ধারা গড়িয়ে পড়ার দৃশ্যটি দেখতে দেখতে বলল, ঝরনার আবার ছবি তোলার আছে? তারপর বিরক্ত মুখে বলল, দে দেখি ক্যামেরাটা, এসেছি যখন একটা ছবি তুলে নিই।

শাহনাজ ক্যামেরাটা এগিয়ে দেয়, হাতে নিয়ে ইমতিয়াজ বিরক্তমুখে বলল, এ কী, একটা ফিল্মও তো বাকি নেই দেখি! কিসের ছবি তুলে ফিল্মটা শেষ করেছিস?

শাহনাজ আমতা আমতা করে বলল এই তো এইসব জিনিসপত্র!

.

বাসায় এসে তারা আবিষ্কার করল সোমা ফিরে এসেছে। শাহনাজকে দেখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, জানিস শাহনাজ আমি ভালো হয়ে গেছি। একেবারে ভালো হয়ে গেছি। ডাক্তাররা খুঁজে কোনো সমস্যাই পায় নি!

ইমতিয়াজ মুখ বাঁকা করে বলল, আমি আগেই বলেছিলাম সাইকোসেমেটিক। মানসিক রোগ। এখন আমার কথা বিশ্বাস হল?

সোমার আম্মা বললেন, তুমিই ঠিক বলেছ বাবা, আমরা বুঝতে পারি নি!

সোমা খিলখিল করে হেসে বলল, কী মজা দেখেছ, সাইকোসেমেটিক অসুখ হলে কেমন লাগে সেটাও এখন আমি বুঝে গেলাম।

শাহনাজের ক্যামেরার ফিল্মটি ডেভেলপ করে নিয়ে আসার পর সেখানে মহাকাশযান এবং ডক্টর জিজির অনেক ছবি দেখা গেল। শাহনাজ প্রথমে ছবিগুলো দেখাল সোমাকে। সোমা ছবি দেখে হেসে কুটিকুটি হয়ে বলল, ওমা! এমন মজার ছবি কোথায় তৈরি করেছিস?

শাহনাজ বলল, আসলে তৈরি করি নি_

সোমা বাধা দিয়ে বলল, বুঝেছি, ক্যাপ্টেন ডাবলুর কাজ! এইটুকুন ছেলের কী বুদ্ধি কয়দিন আগে আমার একটা ছবির সাথে ডাইনোসরের ছবি জুড়ে দিল। দেখে মনে হয় সত্যি সত্যি ডাইনোসর। কম্পিউটার দিয়ে করে, তাই না?

না, সোমা আপু। এটা সত্যি–

সোমা খিলখিল করে হেসে বলল, তুই যে কী মজা করতে পারিস শাহনাজ, তোকে দেখে অবাক হয়ে যাই! আমারও এ রকম একটা ছবি আছে এলিয়েনের সাথে, কম্পিউটার দিয়ে করা। তোর ছবির এলিয়েনটা দেখ, কেমন জানি বোকা বোকা চেহারা। আমারটা ভয়ঙ্কর দেখতে, এই বড় বড় দাঁত, নাক দিয়ে আগুন বের হচ্ছে।

শাহনাজ কিছু বলল না, একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল।

.

সোমাদের চা–বাগানে প্রায় একমাস সময় কাটিয়ে শাহনাজ ঢাকায় ফিরে এসেছিল। তার কিছুদিন পর ক্যাপ্টেন ডাবলুর একটা চিঠি এসে হাজির, চিঠিটা শুরু হয়েছে এইভাবে :

প্রিয় পু
আশা করি তুমি ভালো আছ। আমি ভালো নাই। আমি যার কাছেই ডক্টর জিজির কথা বলি, কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে না। আমার আব্বু সেদিন আমার সায়েন্স ফিকশানের সব বই বাক্সে তালা মেরে বন্ধ করে রেখে দিয়েছেন। এইসব ছাইভস্ম পড়ে পড়ে আমার নাকি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। লান্টু পর্যন্ত আমার কথা বিশ্বাস করে না, আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। কী–মজা–হবে আপু আমার যেন মনখারাপ না হয় সেজন্যে ভান করে যে ডক্টর জিজির কথা বিশ্বাস করেছে কিন্তু আসলে করে নাই।
ডক্টর জিজির কথা বিশ্বাস করানোর জন্য কী করা যায় বুঝতে পারছি না। তাড়াতাড়ি চিঠি লিখে জানাও।

ইতি
ক্যাপ্টেন ডাবলু
পুন. তোমাকে শুধু পু ডেকেছি বলে কিছু মনে কর নাই তো?

শাহনাজ ক্যাপ্টেন ডাবলুকে চিঠির উত্তরে কী লিখবে এখনো ভেবে ঠিক করতে পারে নি।

পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে শাহনাজ হেঁটে হেঁটে স্কুলের এক কোনায় লাইব্রেরি বিল্ডিঙের সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে বসল। তার পরীক্ষা শেষ, এখন তার মনে খুব আনন্দ হওয়ার কথা। এতদিন যে হাজার হাজার ফরমুলা মুখস্থ করে রেখেছিল এখন সে ইচ্ছে করলে সেগুলো ভুলে যেতে পারে। বড় বড় রচনা, নোট করে রাখা ব্যাখ্যা, গাদা গাদা উপপাদ্য, প্রশ্নের উত্তরের শত শত পৃষ্ঠা মাথার মাঝে জমা করে রেখেছিল; যেগুলো সে পরীক্ষার হলে একটার পর একটা উগলে দিয়ে এসেছে–এখন সে তার সবগুলো মস্তিষ্ক থেকে উধাও করে দেবে, কোনোকিছুই আর মনে রাখতে হবে না–এই ব্যাপারটা চিন্তা করেই আনন্দে তার বুক ফেটে যাবার কথা। শাহনাজ অবশ্য অবাক হয়ে আবিষ্কার করল তার ভিতরে আনন্দ–দুঃখ কিছুই হচ্ছে না, ভিতরটা কীরকম যেন ম্যাদা মেরে আছে! পরীক্ষা শেষ হবার পর যেসব কাজ করবে বলে এতদিন থেকে ঠিক করে রেখেছিল, যে গল্পের বইগুলো পড়বে বলে। জমা করে রেখেছিল তার কোনোটার কথা মনে পড়েই কোনোরকম আনন্দ হচ্ছে না। এ রকম যে হতে পারে সেটা সে একবারও চিন্তা করে নি, কী মন–খারাপ–করা একটা ব্যাপার!

শাহনাজ একটা বিশাল লম্বা নিশ্বাস ফেলে সামনে তাকাল, তখন দেখতে পেল মীনা আর ঝিনু এদিকে আসছে। মীনা তাদের ক্লাসের শান্তশিষ্ট এবং হাবাগোবা টাইপের মেয়ে, তাই সবাই তাকে ডাকে মিনমিনে মীনা। ঝিনু একেবারে পুরোপরি মীনার উল্টো, সোজা। ভাষায় বলা যায় ডাকাত টাইপের মেয়ে। যদি কোনোভাবে সে কলেজ শেষ করে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত যেতে পারে তা হলে যে সেখানে সন্ত্রাসী আর চাদাবাজি শুরু করে দেবে সে ব্যাপারে কারো মনে কোনো সন্দেহ নেই। তাকে সবাই আড়ালে ঝিনু–মস্তান বলে ডাকে এবং ঝিনু মনে হয় ব্যাপারটা বেশ পছন্দই করে। মীনা এবং ঝিনুর একসাথে থাকার কথা নয় এবং দুজনে কাছে এলে বুঝতে পারল ঝিনু মীনাকে ধরে এনেছে। কাঁচপোকা যেভাবে তেলাপোকা ধরে আনে অনেকটা সেরকম ব্যাপার। শাহনাজ দেখল মীনার নাকের মাঝে বিন্দু বিন্দু ঘাম, মুখ রক্তহীন, আতঙ্কিত এবং ফ্যাকাসে।

মিনু হেঁটে হেঁটে একেবারে শাহনাজের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ওঠ।

শাহনাজ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কেন?

কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিটা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলব।

শাহনাজ চোখ কপালে তুলে বলল, কী করবি?

ঢেলা মেরে কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিটা গুঁড়ো গুঁড়া করে ফেলব, তারপর আগুন ধরিয়ে দেব।

শাহনাজ সরু চোখে ঝিনুর দিকে তাকিয়ে রইল। সত্যি কথা বলতে কী, তার কথা শুনে সে খুব বেশি অবাক হল না। যে স্যার তাদের কেমিস্ট্রি পড়ান তার নাম মোবারক আলী। মোবারক স্যার ক্লাসে কিছু পড়ান না, শুধু গালিগালাজ করেন, সবাইকে একরকম বাধ্য করেন তার কাছে প্রাইভেট পড়তে। কেমিষ্ট্রি ক্লাসে এবং এই ল্যাবরেটরিতে তাদের যত যন্ত্রণা সহ্য। করতে হয় তার লিস্টি লিখলে সেটা ডিকশনারির মতো মোটা একটা বই হয়ে যাবে। যদি স্কুলে। একটা গণভোট নেওয়া হয় তা হলে সব মেয়ে একবাক্যে সায় দেবে যে কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিটা ঢেলা মেরে গুঁড়ো গুড়ো করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হোক, যদি সম্ভব হয় তা হলে মোবারক আলী স্যারকে ল্যাবরেটরির ভিতরে রেখে। সব মেয়েরা তাকে আড়ালে মোরব্বা স্যার বলে ডাকে, তিনি দেখতে খানিকটা মোরবার মতো সেটি একটি কারণ এবং মেয়েরা মোরার মতো তাকে কেচে ফেলতে চায় সেটি দ্বিতীয় এবং প্রধান কারণ! এই স্যারকে কেউ দেখতে পারে না বলে কেমিস্ট্রি বিষয়টাকেও কেউ দেখতে পারে না। কে জানে কেমিস্ট্রি বিষয়টা হয়তো আসলে ভালোই। মোবারক স্যার আর কেমিস্ট্রি বিষয়টুকু কেউ দেখতে পারে না বলে পুরো ঝালটুকু কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরির উপরে মেটানো তো কাজের কথা নয়। রাগ তো থাকতেই পারে কিন্তু রাগ থাকলেই তো সেই রাগ আর এভাবে মেটানো যায় না।

ঝিনু এগিয়ে এসে শাহনাজের কাঁধ খামচে ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করে বলল, নে, ওঠ!

শাহনাজ নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, তোর মাথা খারাপ হয়েছে?

কী বললি? ঝিনু–গুণ্ডী ঠিক গুণ্ডার মতো চেহারা করে বলল, আমার মাথা খারাপ হয়েছে?

হ্যাঁ। তা না হলে কেউ এ রকম করে কথা বলে? জানিস, যদি ধরা পড়িস তা হলে দশ বছরের জন্য তোকে বহিষ্কার করে দেবে?

ধরা পড়ার কথাটি ঝিনুর মাথায় আসে নি, সে চোখ ছোট ছোট করে বলল, ধরা পড়ব কেন? তুই বলে দিবি নাকি??

শাহনাজ কী বলবে বুঝতে পারল না, ঝিনু আরো এক পা এগিয়ে এসে ঘুসি পাকিয়ে বলল, বলে দেখ, তোর অবস্থা কী করি! এক ঘুসিতে যদি তোর নাকটা আমি ভিতরে ঢুকিয়ে না দিই!

মিনমিনে মীনা আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঝিনু এক ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আর ধরা পড়লেই কী? আর আমাদের স্কুলে আসতে হবে না। শুধু কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরি কেন, পুরো স্কুলটাই জ্বালিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।

মিনমিনে মীনা শেষ পর্যন্ত সাহস করে বলল, পরীক্ষার রেজাল্ট আর টেষ্টিমনিয়াল নিতে আসতে হবে না?

শাহনাজ বলল, আর যদি ফেল করিস?

ঝিনু–গুণ্ডী এত যুক্তিতর্ক পছন্দ করছিল না, মীনাকে ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলল, আয় যাই। আগে কয়টা ঢেলা নিয়ে আয়।

শাহনাজ বিপদের ঝুঁকি নিয়ে বলল, যাস নে মীনা। কেউ দেখে ফেললে নালিশ করে দেবে, তখন একেবারে বারোটা বেজে যাবে। সোজা জেলখানায় চলে যাবি।

জেলখানার তয়েই কি না কে জানে, মীনা শেষ পর্যন্ত সাহস করে ঝিনুর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসে বলল, আমি যাব না।

ঝিনু চোখ লাল করে দাঁত কিড়মিড় করে নাক দিয়ে স্টিম ইঞ্জিনের মতো ফোঁসফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে হুঙ্কার দিয়ে বলল, কী বললি, যাবি না?

মীনা ভয়ের চোটে প্রায় কেঁদে ফেলে বলল, না।

ঝিনু মীনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল, শাহনাজ আর সহ্য করতে পারল না, গলা উচিয়ে বলল, ঝিনু তুই গুণ্ডামি করতে চাস একা একা কর গিয়ে, মীনাকে কেন টানছিস?

কী বললি? ঝিনু কেঁদো বাঘের মতো মুখ করে বলল, কী বললি তুই? আমি গুণ্ডা?

না। আমি তা বলি নাই। আমি বলেছি–

শাহনাজ কী বলেছে সেটা ব্যাখ্যা করার আগেই ঝিনু তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নাকের ওপর একটা ঘুসি মেরে বসল। শাহনাজ একেবারেই প্রস্তুত ছিল না, আচমকা ঘুসি খেয়ে সে চোখে অন্ধকার দেখল। দুই হাতে নাক চেপে ধরে সে পিছন দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ঝিনু এগিয়ে এসে চুল ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলল, আমার সাথে রংবাজি করিস? এমন পেজকি লাগিয়ে দেব যে পেটের ভাত চাউল হয়ে যাবে। তারপর একটা খারাপ গালি দিয়ে দুই নম্বর ঘূসিটা বসানোর চেষ্টা করল। শাহনাজ এইবার প্রস্তুত ছিল বলে সময়মতো সরে যাওয়াতে ঘুসিটা ঠিক জায়গায় লাগাতে পারল না। মিনমিনে মীনা অবশ্য ততক্ষণে তার খনখনে গলায় এত জোরে চেঁচাতে শুরু করেছে যে তাদের ঘিরে অন্য মেয়েদের ভিড় জমে গেল। সবাই মিলে ঝিনুকে টেনে সরিয়ে নিতে চেষ্টা করেও কোনো সুবিধে করতে পারল, ঝিনু হুঙ্কার দিয়ে বলল, আমার সঙ্গে মস্তানি? পরের বার একেবারে চাকু মেরে দেব!

ঠিক এ রকম সময় কেমিস্ট্রির স্যার মোবারক আলী লম্বা পা ফেলে হাজির হলেন এবং ভিড়টা হালকা হয়ে গেল। ঝিনু অদৃশ্য হল সবার আগে, শাহনাজ তার নাক চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইল এবং মোবারক আলী ওরফে মোরব্বা স্যার তাকেই প্রধান আসামি বিবেচনা করে বিচারকার্য শুরু করে দিলেন। স্যারের বিচার খুব সহজ, হুঙ্কার দিয়ে বললেন, তোর এতবড় সাহস? মেয়েলোক হয়ে স্কুলের ভিতর মারামারি করিস?

প্রথমত মেয়েদের মেয়েলোক বলা এক ধরনের অপমানসূচক কথা, দ্বিতীয়ত শাহনাজ মোটেও মারামারি করে নি, তৃতীয়ত মারামারি করা যদি খারাপ হয় তা হলে সেটা স্কুলের ভিতরে যতটুকু খারাপ, বাইরেও ঠিক ততটুকু খারাপ। এই মুহূর্তে অবশ্য সেটা নিয়ে আলাপ–আলোচনার কোনো সুযোগ নেই, কারণ মোবারক স্যার বিচার শেষ করে সরাসরি শাস্তি–পর্যায়ে চলে গেলেন। নাক ফুলিয়ে চোখ লাল করে দাঁত বের করে হিংস্র গলায় বলতে লাগলেন, তবে রে বদমাইশ মেয়ে, তোর মতো পাজি হতচ্ছাড়া বেজন্মা মেয়ের জন্য দেশের এই অবস্থা। মেয়েলোক হয়ে যদি স্কুলের কম্পাউন্ডে স্যারদের সামনে মারামারি করিস তা হলে বাইরে কী করবি? রাস্তাঘাটে ছিনতাই করবি? মদ গাঞ্জা ফেনসিডিল খেয়ে মানুষের মুখে এসিড মারবি? বাসের ভিতরে পেট্রোলবোমা মারবি? …ভাদর ভ্যাদর ভ্যাদর ভ্যাদর ভ্যাদর ভ্যাদর…

শাহনাজ নাক চেপে ধরে বড় বড় চোখ করে মোবারক ওরফে মোরব্বা স্যারের দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনতে লাগল। ভ্যাগ্যিস স্যারের গালিগালাজ একটু পরে আর শোনা যায় না, পুরোটাকে একটা টানা লম্বা ভ্যাদর–ভ্যাদর জাতীয় প্রলাপ বলে মনে হতে থাকে!

.

শাহনাজ যখন বাসায় ফিরে এল ততক্ষণে খবর ছড়িয়ে গেছে। আম্মা তার দিকে তাকিয়ে সরু চোখে বললেন, স্কুলে নাকি মারামারি করেছিস?

আমি করি নাই।

আম্মা শাহনাজের লাল হয়ে ফুলে ওঠা নাকটার দিকে তাকিয়ে বললেন, তা হলে?

শাহনাজ শীতল গলায় বলল, তা হলে কী?

তোর এইরম চেহারা কেন?

শাহনাজ নাকের ওপর হাত বুলিয়ে বলল, ঝিনু–গুণ্ডী আমাকে ঘুসি মেরেছে।

আম্মা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে শাহনাজের দিকে তাকিয়ে রইলেন। শাহনাজ যদি বলত ঝিনু তাকে খামচি মেরেছে কিংবা চুল টেনেছে, চিমটি দিয়েছে তা হলে আম্মা বিশ্বাস করতেন, একটা মেয়ে যে অন্য একটা মেয়েকে ঘুসি মারতে পারে সেটা আম্মারা এখনো বিশ্বাস করতে পারেন না। আজকালকার মেয়েরা যে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে পকেটমার পর্যন্ত সবকিছু হতে পারে সেটা দেখেও মনে হয় তাদের বিশ্বাস হয় না। আম্মা কাঁপা গলায় বললেন, ঘুসি মেরেছে?

হ্যাঁ।

এত মানুষ থাকতে তোকে কেন ঘুসি মারল?

কারণ আমি মিনমিনে মীনাকে যেতে দেই নাই।

কোথায় যেতে দিস নাই?

শাহনাজ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি এটা বুঝবে না আম্মা। যদি বোঝানোর চেষ্টা করি তুমি বিশ্বাস করবে না।

আম্মা নিশ্বাস আটকে রেখে বললেন, কেন বিশ্বাস করব না?

পুরো ব্যাপারটা বুঝতে হলে তোমার পুরো ইতিহাস জানতে হবে। শুরু করতে হবে। আজ থেকে তিন বছর আগের ঘটনা দিয়ে।

আম্মা এবারে রেগে উঠলেন, চিৎকার করে বললেন, স্কুলে মারামারি করে এসে আবার বড় বড় কথা? স্কুলে পাঠানোই ভুল হয়েছে। রান্না, সেলাই আর বাসন ধোয়ানো শিখিয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। শাশুড়ির খন্তার বাড়ি খেয়ে এতদিন সোজা হয়ে যেত।

শাহনাজ পাথরের মতো মুখ করে বলল, এসব দিন ফিনিস। শাশুড়ি খন্তা দিয়ে বাড়ি দিলে তার হাত মুচড়ে সকেট থেকে আলাদা করে নেব।

আম্মা হায় হায় করে মাথায় থাবা দিয়ে বললেন, ও মা গো! কী বেহায়া মেয়ে পেটে ধরেছি গো। কী বলে এই সব!

.

সন্ধেবেলা শাহনাজের বড়ভাই ইমতিয়াজ এসে পুরো ব্যাপারটা আবার গোড়া থেকে শুরু করল। ইমতিয়াজ ইউনিভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে, এবং তার ধারণা সে খুব উঁচু ধরনের মানুষ। ঘর থেকে বের হবার আগে আধাঘণ্টা সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলকে ঠিকভাবে উষ্কখুষ্ক করে নেয়। শাহনাজের সাথে এমনিতে সে বেশি কথা বলে না, যখন তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে হয় কিংবা টিটকারি করতে হয় শুধু তখন সে কথাবার্তা বলে। আজকে শাহনাজকে দেখে সে জোর করে মুখে এক ধরনের ফিচলে ধরনের হাসি ফুটিয়ে বলল, তোর নাকটা দেখেছিস? এমনিতেই নিয়েন্ডারথল মানুষের মতো ছিল, এখন মনে হচ্ছে উপর দিয়ে একটা দোতলা বাস চলে গিয়েছে। হা হা হা।

এই হচ্ছে ইমতিয়াজ। পৃথিবীতে নাক চ্যাপ্টা মানুষ অনেক আছে কিন্তু সে উদাহরণ দেবার সময় এমন একটা শব্দ উচ্চারণ করল যেটা উচ্চারণ করতেই দাঁত ভেঙে যায়। আর। শাহনাজের নাক মোটেও চ্যাপ্টা নয়। তা ছাড়া নাক চাপা হলেই মানুষ মোটেও অসুন্দর হয় না। তাদের ক্লাসে একজন চাকমা মেয়ে পড়ে, নাকটা একটু চাপা কিন্তু দেখতে এত সুন্দর। যে শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। শাহনাজ দাঁতে দাঁত চেপে ইমতিয়াজের টিটকারিটা সহ্য করে বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। চোখের দৃষ্টি দিয়ে কাউকে ভস্ম করা হলে এতক্ষণে ইমতিয়াজ ভুনা কাবাব হয়ে যেত।

ইমতিয়াজ চোখেমুখে একটা উদাস উদাস ভাব ফুটিয়ে মুখের এক কোনায় ঠোঁট দুটোকে একটু উপরে তুলে বিচিত্র একটা হাসি হেসে বলল, তুই নাকি আজকাল রাস্তাঘাটে মারপিট করিস?।

শাহনাজ কোনো কথা বলল না। ইমতিয়াজ গলার স্বরে খুব একটা আন্তরিক ভাব। ফুটিয়ে বলল, চাদাবাজিও শুরু করে দিয়েছিস নাকি?

শাহনাজ নিশ্বাস আটকে রাখল, তখনো কোনো কথা বলল না। ইমতিয়াজ তখন উপদেশ দেবার ভঙ্গি করে বলল, যখন তুই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবি তখন তোর কোনো চিন্তা থাকবে না! হলে ফ্রি খাবিদাবি। কন্ট্রাক্টরদের কাছ থেকে চাঁদা নিবি। বেআইনি অস্ত্র নিয়ে ছেলেপিলেদের ধামকি–ধুমকি দিবি। আর একবার যদি জেলের ভাত খেতে পারিস দেখবি ধাঁধা করে উঠে যাবি। মহিলা সন্ত্রাসী! শহরের যত গডফাদার তোকে ডাবল টাকা দিয়ে ভাড়া করে নিয়ে যাবে!

শাহনাজের ইচ্ছে করল ইমতিয়াজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আঁচড়ে কামড়ে একটা কাণ্ড করে দেয়, কিন্তু সে কিছুই করল না। আস্তে আস্তে বলল, সবাই তো আর আমার মতো হলে চলবে না, আমাদেরও তো ঠ্যাঙ্গানি দেওয়ার জন্য তোমার মতো লুতুপুতু এক–দুইটা মানুষ দরকার।

ইমতিয়াজ চোখ বাঁকিয়ে বলল, কী বললি? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা!

শাহনাজ না–শোনার ভান করে বলল, যত হম্বিতম্বি আমার ওপরে! বিলকিস আপু যখন শাহবাগের মোড়ে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখে–

ইমতিয়াজ আরেকটু হলে শাহনাজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত, কোনোমতে সে দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। শুনতে পেল বাইরে থেকে ইমতিয়াজ চিৎকার করে বলল, বেয়াদপ পাজি মেয়ে, কান টেনে ছিঁড়ে ফেলব।

শাহনাজ ঘরে বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইমতিয়াজ আর বিলকিস এক ক্লাসে পড়ে, দুজনে খুব ভাব, কিন্তু ইমতিয়াজ মনে হয় বিলকিসকে একটু ভয়ই পায়। ইমতিয়াজকে শায়েস্তা করার এই একটা উপায়, বিলকিসকে নিয়ে একটা খোটা দেওয়া। কিন্তু একবার খোটা দিলে তার ঝাল সহ্য করতে হয় অনেকদিন।

আব্বা এলেন সন্ধেবেলা এবং তখন শাহনাজের সারা দিনের রাগ শেষ পর্যন্ত ধুয়েমুছে গেল। আম্মা এবং ইমতিয়াজের মুখে ঘটনার বর্ণনা শুনিয়েও আবাকে ঘাবড়ে দেওয়া গেল না। অট্টহাসি দিয়ে বললেন, শাহনাজ মা, তুই নাকি গুণ্ডী হয়ে যাচ্ছিস?

শাহনাজ মুখ গম্ভীর রেখে বলল, আব্বা এইটা ঠাট্টার ব্যাপার না।

কোনটা ঠাট্টার ব্যাপার না?

এই যে আমার নাকে ঘুসি মেরেছে।

কে বলেছে এইটা ঠাট্টার ব্যাপার? আমি কি বলেছি?

তা হলে হাসছ কেন?

হাসছি? আমি? আমি মোটেই হাসছি না– এই বলে আবা আবার হা হা করে হাসতে লাগলেন।

শাহনাজ খুব রাগ হওয়ার চেষ্টা করেও মোটেও রাগতে পারল না। তবুও খুব চেষ্টা করে চোখেমুখে রাগের একটা চিহ্ন ফুটিয়ে বলল, আব্বা, কাউকে মারলে তার ব্যথা লাগে, তখন সেটা নিয়ে হাসতে হয় না।

আব্বা সাথে সাথে মুখ গম্ভীর করে শাহনাজের গালে হাত বুলিয়ে ছোট বাচ্চাদের যেভাবে আদর করে সেভাবে আদর করে দিলেন। শাহনাজ কোনোভাবে আবার হাত থেকে ছুটে বের হয়ে এল। ভাগ্যিস আশপাশে কেউ নেই। যদি তার বান্ধবীরা কেউ দেখে ফেলত তার মতো এতবড় একজন মেয়েকে তার বাবা মুখটা সুচালো করে কিচি কিচি কু কুচি কুচি কু বলে আদর করে দিচ্ছে তা হলে সে লজ্জায় আর মুখ দেখাতে পারত না। আব্বা বললেন, তোর ব্যথা লাগছে বলে আমি হাসছি না রে পাগলী, আমি হাসছি ঘটনাটা চিন্তা করে। একটা মেয়ে পাই পাই করে আরেকজনের উপরে ঘুসি চালাচ্ছে এটা একটা বিপ্লব না?

বিপ্লব?

হ্যাঁ। আমরা যখন ছোট তখন ছেলেরা মারপিট করলে সেটা দেখেই এক–দুইজন মেয়ের দাঁতকপাটি লেগে যেত।

আম্মা আবার কথাবার্তা শুনে খুব বিরক্ত হলেন। একটা মেয়ে এ রকম মারপিট করে এসেছে, কোথায় তাকে আচ্ছা করে বকে দেবে তা নয়, তাকে এভাবে প্রশ্রয় দিয়ে মাথাটা পুরোপুরি খেয়ে ফেলছেন। আম্মা রাগ হয়ে আব্বাকে বললেন, তোমার হয়েছেটা কী? মেয়েটাকে এভাবে লাই দিয়ে তো মাথায় তুলেছ। এই রাজকুমারী বড় হলে অবস্থাটা কী হবে চিন্তা করেছ?

আব্বা জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললেন, রাজকুমারী বড় হলে রাজরানী হবে, এর মাঝে আবার চিন্তা করার কী আছে?

আম্মা একেবারে হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করে মাথা নাড়তে নাড়তে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। আব্বা আবার শাহনাজকে কাছে টেনে এনে বললেন, আমার রাজকুমারী শাহনাজ, বাবা তোমার পরীক্ষা কেমন হয়েছে?

শাহনাজ মুখে রহস্যের ভাব করে বলল, শেষ হয়েছে।

ভালোভাবে শেষ হয়েছে নাকি খারাপভাবে?

তোমার কী মনে হয় আব্বু?

নিশ্চয়ই ভালোভাবে।

শাহনাজ মাথা নেড়ে বলল, আব্বু, আমার পরীক্ষা ভালো হয়েছে, এখন তুমি আমাকে কী দেবে?

আব্বা মুখ গম্ভীর করে বললেন, তোর এই মোটা নাকে চেপে ধরার জন্য একটা আইসব্যাগ।

যাও! শাহনাজ তার আব্বাকে একটা ছোট ধাক্কা দিল। আব্বা নিজেকে রক্ষা করার জন্য হাত তুলে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোর এই বিশাল নাকের জন্য একটা বিশাল নাকফুল।

এবারে শাহনাজ সত্যি সত্যি রাগ করল, বলল, যাও আব্বু। তোমার সবকিছু নিয়ে শুধু ঠাট্টা।

আব্বা এবারে মুখ গম্ভীর করে বললেন, ঠিক আছে মা, বল তুই কী চাস?

যা চাই তাই দিবে?

সেটা নির্ভর করে তুই কী চাস। এখন যদি বলিস লিওনার্দো দ্য কাপ্রিওকে এনে দাও, তা হলে তো পারব না!

না সেটা বলব না।

তা হলে বল্।

শাহনাজ চোখ ছোট ছোট করে খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, আমি সোমা আপুদের বাগানে বেড়াতে যেতে চাই।

আব্বা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হাত নেড়ে বললেন, তথাস্তু।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত