দিনদুপুরে (গল্পগ্রন্থ)

দিনদুপুরে (গল্পগ্রন্থ)

ঘোতন কোথায়?

সকালে খুব দেরি করে উঠলাম। উঠেই গায়ের চাদরটা এক লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে তারই উপর দাঁড়ালাম। চটি খুঁজে পেলাম না। খালি পায়ে স্নানের ঘরে গেলাম। দাঁত মাজলাম না, তাতে যে সময়টুকু বাঁচল সে সময়টা কলের মুখ টিপে ধরে পিচকিরির মতন দেয়ালে-টেয়ালে জল ছিটোলাম। খানিকটা আবার বাবার তোয়ালের উপরও পড়ল দেখলাম। তারপর চোখে-মুখে জল দিয়ে, মুখ-হাত মুছে সেটাকে তালগোল পাকিয়ে ঘরের কোনায় ছুঁড়ে মারলাম। তারপর একমুখ জল ভরে নিয়ে, শোবার ঘরে গিয়ে জানলা দিয়ে নীচে রাস্তায় একজন বুড়ো লোকের গায়ে পু চূ করে ফেলেই তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে চুলটাকে খুব যত্ন করে আঁচড়াতে লাগলাম।

ততক্ষণে নীচের তলায় মহা শোরগোল লেগে গেছে। পিসিমা দুধের বাটি নিয়ে বলছেন:ঘোতন কোথায়?মা আমার চটি-জোড়া নিয়ে বলছেন:ঘোতন কোথায়?আর সব থেকে বিরক্ত লাগল শুনে যে মাস্টারমশাইও সেইসঙ্গে ম্যাও ধরেছেন: প্রশান্তকুমার কি আজ পড়বে না?ভীষণ রাগ হল। জীবনে কি আমার কোনো শান্তি নেই? এই সক্কাল বেলা থেকে সবাই মিলে পেছু নিয়েছে!

পিসিমাকে সিঁড়ির উপর থেকে ডেকে বললাম– দুধ খাব না। সিঁড়ির নীচে মাকে এসে বললাম–চটি পরা ছেড়ে দিয়েছি। বসবার ঘরে গিয়ে গলা নীচু করে মাস্টারমশাইকে বললাম– মা বলে দিয়েছেন, আজ আমার পেট ব্যথা হয়েছে, আজ আমি পড়ব না। তারপর একেবারে তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে, সারাটা সকাল রোয়াকে রোদ্দুরে বসে বসে পা দোলালাম, আর রাস্তা দিয়ে যত ছ্যাকড়া গাড়ি গেল তার গাড়োয়ানদের ভ্যাংচালাম।

দশটা বাজতেই উঠে গিয়ে বই-টই কতক কতক গুছিয়ে, আর কতক কতক খুঁজেই পাওয়া গেল না বলে ফেলে রেখে, ঝুপ ঝুপ করে একটু স্নান করে নিয়ে, খুব যত্ন করে চুলটা ফের আঁচড়ে নিয়ে খাবার ঘরে গেলাম।

মা জলের গেলাস দিতে দিতে বললেন: হারে মাস্টারমশাই কখন গেলেন। শুনতে পেলাম না তো?

আমি সত্যি করেই বললাম: সে ক-খ-ন চলে গেছেন কেবা তার খবর রাখে!

ভাত কতক খেলাম, কতক চার পাশে ছড়ালাম, কতক পুসিকে দিলাম, আর কতক পাতে পড়ে রইল। মাছটা খেলাম, ডাল খেলাম, আর ঝিঙে, বেগুন ইত্যাদি রাবিশগুলো সব ফেলে দিলাম। মা রান্নাঘর থেকে দেখতেও পেলেন না। ট্রামভাড়াটা পকেটে নিয়ে মাকে বললাম: মা যাচ্ছি। এই পর্যন্ত প্রায় রোজই যেমন হয় তেমনই হল। অবিশ্যি মাস্টারমশাইর ব্যাপারটা রোজ হয় না, তাই যদি হত তাহলে বাবা-টাবাকে বলে মাস্টারমশাই এক মহাকাণ্ড বাধাতেন সন্দেহ নেই।

কিন্তু এরপর থেকে সেদিন সব যেন কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। মনে আছে ট্রামে উঠে ডান দিকের একটা কোনা দেখে আরাম করে বসলাম। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি আর খালি মনে হচ্ছে কে যেন আমাকে দেখছে। একবার ট্রামসুদ্ধ সবাইকে দেখে নিলাম, বুঝতে পারলাম না। কে। তারপর আবার যেই বাইরে চোখ ফিরিয়েছি আবার মনে হল কে আমাকে এমন করে দেখছে। যে আমার খুলি ভেদ করে ব্রেন পর্যন্ত দেখে ফেলছে। তাইতে আমার ভারি ভাবনা হল। এমনিতেই নানান আপদ, তার উপর আবার ব্রেনের ভিতরকার কথাগুলো জেনে ফেললে তো আর রক্ষে নেই।

কিছুতেই আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। আবার মাথা ঘুরিয়ে ট্রামের প্রত্যেকটি লোককে ভালো করে দেখলাম।

এবার লক্ষ করলাম ঠিক আমার সামনে কালো পোশাক পরা একটি অদ্ভুত লোক। তার মুখটা তিনকোনা মতন, মাথায় গাধার টুপির মতন কালো টুপি, গায়ের কালো পোশাকে লাল নীল হলদে সবুজ চড়াবড়া তারা-চাঁদ আঁকা, পায়ে শুড়ওয়ালা কালো জুতো, দুই হাঁটুর মাঝে হাতে ঝুলছে একটা সন্দেহজনক কালো থলে।

এরকম লোক সচরাচর দেখা। যায় না। অবাক হয়ে একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই ভীষণ চমকে উঠলাম। দেখলাম মাথায় টুপি নয়, চুলটাই কীরকম উঁচু হয়ে বাগিয়ে আছে। গায়ে সাধারণ ধুতির উপর কালো আলোয়ান, তাতে ট্রামের ছাতের কাছের রঙিন কাঁচের মধ্যে দিয়ে রং বেরং। হয়ে আলো পড়ছে। আর পায়ে নাকতোলা বিদ্যাসাগরি চটি। খালি হাতের থলেটা সেইরকমই আছে।

কীরকম একটু ভয় ভয় করতে লাগল।

লোকটা খুশি হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর স্পষ্ট গলায় বলল: অতই যদি খারাপ লাগে ইস্কুলে যাও কেন? বড়োরা যখন এতই অবুঝ তাদের কথা মেনে নাও কেন?

আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম: তবে কী করব?

লোকটি বলল: কী করবে? তাকিয়ে দেখো নীল আকাশে ছোটো ছোটো সাদা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। গাছেরা সব ভিজে পাতায় সোনালি রঙের রোদ মেখে বসে আছে। গড়ের মাঠের ধার ঘেঁষে পুকুরটাকে দেখো, ঘোর সবুজ জলে টলমল করছে। আর, টের পাচ্ছ দখিন হাওয়া দিচ্ছে?

তারপর লোকটা তার বড়ো বড়ো ফুটোওয়ালা নাকটা তুলে বাতাসে কী যেন শুকে বলল: , পেঙ্গুইনের গন্ধ পাচ্ছি। গড়ের মাঠের ওপারে, গঙ্গার ওপারে, বঙ্গোপসাগরের ওপারে, ভারত-মহাসাগরের ওপারে, কোনো একটা বরফজমা দ্বীপের উপর সারি সারি পেঙ্গুইন চলাফেরা করছে, তাদের মুখেচোখে রোদ এসে পড়েছে, ঠোঁট দিয়ে ডানা পরিষ্কার করছে, দু-একটা সাদা নরম পালক উড়ে গিয়ে এখানে ওখানে পড়ছে– দেখতে পাচ্ছ না? কী আর বলব, তখন আমি যেন স্পষ্ট ওইসব দেখতে পেলাম, আর আমার সমস্ত মনটা আনচান করে উঠল। মনে হল এমন দিনে কি কেউ ইস্কুলে যায়? এমন পৃথিবীতে কোনো দিনও কেউ ইস্কুলে যায়?

আমি হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে আর একটু আস্তে আস্তে বলল: জানো ভোররাতে বড়ো বড়ো চিংড়ি মাছ ধরতে হয়, তার এক-একটার ওজন এক সেরের বেশি। দু-দিন ধরে সমুদ্রের নীচে দড়ি-বাঁধা সব হাঁড়ার মতন ডুবিয়ে রাখতে হয়। আর ভোরবেলা গিয়ে ওই দড়ি ধরে টেনে হাঁড়াসুদ্ধ চিংড়ি তুলতে হয়। তারপর বাড়ি ফেরবার সময় আস্তে আস্তে সকাল হয়। তুমি তো জান যে পুব দিকে সূর্য ওঠে, কিন্তু একথা জান কি যে পশ্চিম দিকের আকাশটা আগে লাল হয়, তারপর পুব দিকে সূর্য ওঠে। তারও পর পশ্চিম দিকের লাল রং মিলিয়ে যায়, আর সমস্ত আকাশটা ফিকে পোড়া ছাইয়ের মতন হয়ে যায়। তারাগুলোকে নিবে যেতে কখনো দেখেছ কি?

আমার মনে হল আমার নিশ্চয় এখানে কিছু বলা উচিত কিন্তু আমার জিভ দেখলাম শুকিয়ে কাঠের মতন হয়ে গেছে। কিছু আর বলা হল না। খালি মনটা হু হু করতে লাগল। সে লোকটা আমার দিকে আরও ঝুঁকে পড়ে বলল: কীজন্য কলকাতায় পড়ে থাক আর ইস্কুলে যাও? জান রবিঠাকুর ইস্কুল পালিয়ে পালিয়ে অত বড়ো কবি হয়েছিলেন! আর জান, সাঁওতাল পরগনায় যখন মহুয়া গাছের ফল পাকে, তার গন্ধে জঙ্গলসুদ্ধ সব জিনিসে নেশা লেগে যায়। আর বনের ভাল্লুকগুলো মহুয়া খেয়ে খেয়ে নেশায় বেহুঁশ হয়ে গাছতলায় পড়ে থাকে। পরদিন সকালে কাঠুরেরা তাদের ওইরকমভাবে দেখতে পায়। তুমি জানতে যে মহুয়া ফল খেলে নেশায় ধরে? আমার তখন মনে হল দিনের-পর-দিন ইস্কুলে গিয়ে আমি বৃথাই জীবন নষ্ট করছি। ওই লোকটা নিশ্চয় কখনো ইস্কুলেই যায়নি।

হঠাৎ দেখি সে উঠে দাঁড়িয়েছে, আমার দিকে ফিরে অম্লানবদনে বলল, এসো৷ এমন করে বলল যেন বহুক্ষণ থেকে ওইরকমই কথা ছিল। ও-ও নামবে আর সেই সঙ্গে আমিও নামব।

আমি নামলাম। যদিও আমি জানতাম অচেনা লোক ডাকলে সঙ্গে যেতে নেই। যদিও দিনের-পর-দিন পিসিমা বলেছেন– দুষ্টু লোকেরা বলে: মন্ডা খাবি? সার্কাস দেখবি? এই সব বলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ছেলেদের ধরে নিয়ে গিয়ে হয় আসামের চা বাগানে চালান দেয়, নয় ঘোর জঙ্গলে মা কালীর কাছে ঘ্যাচ করে বলি দেয়।

তবুও আমি নামলাম। কারণ রোজ রোজ ওই ঘুম থেকে ওঠা, দাঁত মাজা, পড়া তৈরি করা, স্নান করে ভাত খাওয়া, ইস্কুলে যাওয়া, ইস্কুল থেকে সারাটা দিনমান নষ্ট করে বিকেলে আবার বাড়ি ফেরা, সেই খাওয়া, সেই শোয়া– ওইরকম দিনের-পর-দিন, মাসের-পর-মাস, বছরের-পর বছর– যতদিন না অনিশ্চিত ভবিষ্যতে, কবে আমি বড়ো হয়ে ভালো চাকরি করে এইসব জিনিসের ভালো ফল দেখাব-ও আর আমার সহ্য হচ্ছিল না।

বইগুলো ট্রামের কোনায় আমার জায়গায় পড়ে রইল। আমি সেই লোকটার সঙ্গে গেলাম।

তখন মোড়ের ঘড়িতে সাড়ে দশটা বেজেছে।

সে আমাকে একটা চায়ের দোকানের ভিতর দিয়ে পিছন দিকের ছোটো একটা ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে আমাকে একটা টিনের চেয়ারে বসিয়ে কোথায় জানি চলে গেল। একটু পরেই সে আবার ফিরে এল, সঙ্গে একটা একচোখা লোক, অন্য চোখটার গায়ে একটা সবুজ তাপ্পি মারা। একটা পা আছে, আরেকটা পা কাঠের তৈরি।

এই লোকটা আমার দিকে একচোখ দিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল: কী হে ছোঁকরা, পড়াশুনোর উপর নাকি এমনই ঘেন্না ধরে গেছে যে একেবারে সেসব ত্যাগ করে এসেছ? তার গলাটা এমন কর্কশ আর চেহারাটাও এমন বিশ্রী যে আমি সত্যি ভারি ভড়কে গেলাম।

কালো কাপড় পরা লোকটার দিকে তাকাতেই সে গ্রামোফোনের চাকতির মতো বলে যেতে লাগল– পড়াশুনো করে কী হবে? জান, আফ্রিকার জঙ্গলের মধ্যে যেসব বিরাট বিরাট নদী আছে তার ধারে ধারে কুমিরেরা আর হিপ্পোপটেমাসরা শুয়ে শুয়ে দিন কাটায় আর লম্বা লাল ঠ্যাঙে ভর দিয়ে গোলাপি রঙের ফ্ল্যামিংগো পাখিরা রোদ পোয়ায়? আর ওইসব জঙ্গলের মধ্যে এমন বিশাল বিশাল অর্কিড জাতের ফুল ফোটে যে তার মধ্যে একটা মানুষ দিব্যি আরামে শুয়ে থাকতে পারে?

বুঝতে পারছিলাম এ লোকটা জাদু জানে। কারণ তক্ষুনি আমার ভয়টয় কোথায় উড়ে গেল– অন্য লোকটাকে জোর গলায় বললাম: হাঁ, সেসব চিরদিনের মতো ত্যাগ করে এসেছি। লোকটা হাসল, বলল: চিরদিন বড়ো দীর্ঘকাল হে ছোঁকরা চিরদিনের কথা কে বলতে পারে? কিন্তু তোমার সাহস আছে, উৎসাহ আছে, তুমি অনেক কিছু করতে পারবে। স্বাস্থ্যটাও তো ভালো দেখছি। আশা করি বাড়ির জন্য মনের টান ইত্যাদি কোনো দুর্বলতা নেই?

হঠাৎ মনে হল মা এতক্ষণে স্নানের জোগাড় করছেন, বাবা আপিস গেছেন, এবং দু-জনেই মনে ভাবছেন আমি বুঝি ইস্কুলে গেছি। গলার কাছটা সবে একটু ব্যথা করতে শুরু করেছিল এমন সময় কালো কাপড় পরা লোকটা বলল: ইস্কুলের বাইরে, বাড়ির বাইরে, কলকাতা থেকে বহুদূরে নরওয়ের উত্তরে চাঁদনি রাতে হারপুন দিয়ে তিমি শিকার হয়। তিমির গায়ে হারপুন বিঁধলে তিমি এমনি ল্যাজ আছড়ায় যে সমুদ্র তোলপাড় হয়ে যায়। কত নৌকো ডুবে যায়। আবার তিমি মরে গিয়ে যখন উলটে গিয়ে ভেসে ওঠে দেখবে তার বুকের রঙটা পিঠের চেয়ে ফিকে। আর, জান, ইংল্যান্ডে শীত কালে সোয়ালো পাখিরা থাকে না। তারা দলে দলে উড়ে স্পেনে চলে যায়, আর যেই শীত কমে আসে আবার তারা দলে দলে সমুদ্রের উপর দিয়ে অবিশ্রান্ত গতিতে উড়ে ফিরে আসে। এসে দেখে তাদের আগেই শীতের বাতাসকে তুচ্ছ করে ড্যাফোডিল ফুলরা ফুটে গেছে।

আমার মন পাখির মতন উড়ে যেতে চাচ্ছিল।

একচোখা বলল: কিন্তু শুধু তিমি মারলে হবে না। তার বহু অসুবিধাও আছে, বহু দূরও। এই কাছাকাছি মানুষ-টানুষ মারতে পারবে? পরে যাবে আফ্রিকা, নরওয়ে, আলাস্কা– আপাতত অন্ধকার রাত্রে গলির মুখে দাঁড়িয়ে বাঁকা ছুরি হাতে নিয়ে ঘচ করে সেটাকে লোকের বুকে আমূল বসিয়ে দিতে পারবে? যেমন রক্তের নদী ছুটবে তুমিও হো হো করে রাত কাপিয়ে কাষ্ঠ হাসি হেসে। উঠবে? মাথায় বাঁধা থাকবে লাল রুমাল?

আমি উঠে দাঁড়ালাম। সেই কালো কাপড় পরা লোকটা বলল: উত্তর মেরুতে সিল মাছেরা বরফের মধ্যে বাসা করে—

আমি বললাম: কুড়ি বছর পরে উত্তর মেরুর কথা শুনব, এখন আমি ইস্কুলেই বরং যাই, মাথায় আমি লাল রুমাল কিছুতেই বাঁধতে পারব না।

লোকটা বলল: কে জানে ভুল করছ কি না?

আমি ততক্ষণ চায়ের দোকানের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এসে ট্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়েছি। প্রথম যে ট্রাম এল তাতেই উঠে পড়লাম। উঠেই ভীষণ চমকে গেলাম। দেখলাম ট্রামের কোনায় ডানদিকের সিটে আমার বইগুলো পড়ে রয়েছে। কেমন করে হল বুঝতে না পেরে ফুটপাথে চায়ের দোকানের সামনে কালো কাপড় পরা লোকটার দিকে তাকালাম।

আবার মনে হল তার মাথায় গাধার টুপির মতো টুপি, গায়ের কালো পোশাকে রং-বেরঙের চড়াবড়া আঁকা, আর পায়ে শুড়োলা কালো জাদুকরের জুতো।

সে আমাকে হাত তুলে ইশারা করে চায়ের দোকানে ঢুকে পড়ল। আর আমি মোড়ের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তখনও সাড়ে দশটাই বেজে রয়েছে।

টাকা চুরির খেলা

প্রথম যখন গণশার সঙ্গে আলাপ হল সে তখন সদ্য সদ্য নর্থবেঙ্গল এক্সপ্রেস থেকে নেমেছে। চেহারাটা বেশ একটু ক্যাবলা প্যাটার্নের, হলদে বুট পরেছে–তার ফিতেয় আবার দু-জায়গায় গিট দেওয়া; খাকি হাফ প্যান্ট, আর গলাবন্ধ কালো কোট– তার একটাও বোম নেই, গোটা তিনেক বড়ো বড়ো মরচে-ধরা সেফটিপিন আঁটা। তার উপর মাথায় দিয়েছে সামনে বারান্ডওয়ালা হলদে কালো ডোরাকাটা টুপি। দেখে হেসে আর বাঁচিনে।

ছোটোকাকা সঙ্গে ছিল, গণশার দাদাকে ডেকে বলল, ওহে হরিচরণ, এটি আমার ভাইপো। তোমার ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে মিলবে ভালো। তাই শুনে গণশা রেগে কাই, অত ছোটো ভাই ছোটো ভাই করবেন না মশাই। আর ওই কুচো চিংড়িটার সঙ্গে মিলব ভালো, শুনলেও হাসি পায়।

ছোটোকাকার মুখের রংটা কীরকম পাটকিলে মতন হয়ে গেল। সেঁক গিলে বললেন বটে! সে বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ! অথচ শেষ অবধি ওই গণশাকেই আমি বিষম ভক্তি করলুম।

সে এক মস্ত উপাখ্যান।

ছুটির দিন দুপুর বেলায় নিরিবিলি ছাদের ঘরের মেঝেতে বেশ আরাম করে উপুড় হয়ে শুয়ে, পা দুটোকে উঁচুবাগে তুলে একটা চেয়ারের পায়াতে লটকে, দিব্যি করে নিজের মনে দাদার টিকিটের অ্যালবামে নতুন নতুন পাঁচ পয়সার টিকিট সারি সারি মারছি, কারু কোনো অসুবিধা করছি না, কিছু না, এমন সময়ে ওরে গবা, গবা রে! বলে বাপরে সে কী চিল্লানো! আর এরা আমায় কিনা বলে যে গোলমাল করি! সেই বিকট গোলযোগ শুনে তাড়াতাড়ি টিকিট অ্যালবামটা লুকিয়ে ফেলে নীচে যেতে যাব, ভুলেই গেছি যে পা দুটো চেয়ারে লটকানো, তাড়াতাড়ি না টেনে নামাতে গিয়ে চেয়ার উলটে গেল, তার উপর দিদিটা হাঁদার মতন দুটো কাঁচের ফুলদানি রেখেছিল, সে তো গেল ভেঙে; সবচেয়ে খারাপ হল, আমার আধ-খাওয়া পেয়ারাটা ছিটকে গিয়ে ঘরের কোণে পিসিমার গঙ্গাজলের হাঁড়ির মধ্যে পড়ে গেল।

এই সমস্ত ঘটনাতে আমার যে একেবারে কোনো দোষ ছিল না একথা যে শুনবে সেই বলবে। অথচ এই একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে দাদা, দিদি, পিসিমা এমন হইচই লাগাল, যেন তাদের ঘরে চোর সিঁদ কেটেছে! বাবা পর্যন্ত আমার দিকটা বুঝলেন না, বললেন–দোষ করে আবার কথা!

এরপর যখন ছোটোকাকা গোলমাল শুনে দাড়ি কামাতে কামাতে এসে একটু কাষ্ঠহাসি হেসে বলল– অনেক দিন থেকেই বলছি ও ঝুরিভাজা ছেলেকে বিদেয় কর। তা তো কেউ শুনলে না। এখন জেলখানাতেও ওকে নিতে রাজি হবেনা। সময় থাকতে নারানবাবুর ইস্কুলে দিয়ে দাও, নইলে নাকের জলে চোখের জলে এক হবে। মনে মনে বুঝলাম, ছোটোকাকার নতুন সাদা জুতোয় সেই যে কলম ঝাড়বার সময়ে সামান্য তিন-চার ফোঁটা কালি পড়েছিল, ছোটোকাকা এখনো সেকথা ভোলেনি।দিকগে বোর্ডিঙে, এদের চেয়ে খারাপ বোর্ডিঙে কেন নরকেও কেউ হতে পারে না। তাই রেগে, চেঁচিয়ে, হাত-পা ছুঁড়ে বলতে লাগলাম–তাই দাওনা, তাই দাওনা, তাই দাওনা। এদিকে নিজে যখন বায়োস্কোপ দেখে দেরি করে ফিরে বাবার কাছে তাড়া খাও, তখন

বাবা বললেন– চোপ!

এরই ফলে ছুটির পর যখন ইস্কুল খুলল, আমি গেলুম নারানবাবুদের বোর্ডিঙে। বেশ জায়গা, বাড়ি থেকে ঢের ভালো। প্রথমটা সকাল বেলা হালুয়া খেতে বিশ্রী লাগত। তারপর দেখলাম ওতে খুব ভালো ঘুড়ি জুড়বার আঠা হয়। এ ছাড়া বোর্ডিঙের আর সব ভালো। গণশাও দেখলাম ঘুরে বেড়াচ্ছে, তবে সে আমাদের ঘরে থাকে না।

প্রথম দিন শুতে গিয়ে দেখি আমাদের ঘরে ছ-জন ছেলে, পাঁচজন ছোটো আর একজন বড়ো। আমাদের ঘরের বড়ো ছেলেটি ঠিক বড়ো নয়, বরং মাঝারি সাইজের বললে চলে। কিন্তু তার তেজ কী! তার নাম পানুদা, তার কাজ নাকি আমাদের সামলানো, আর তাই করে করে নাকি তার ঠান্ডা মেজাজ খ্যাকখ্যাক করার ফলে দিন দিন বিগড়ে যাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানলুম পানুদা সেকেন্ড ক্লাসে পড়ে। নিয়ম করে ক্লাসের লাস্ট বয়ের ঠিক উপরে হয়। কিন্তু তার মন খুব ভালো, লাস্ট বয়কে খুব সাহায্য করে। আমাদের ঘরের নীলু বলল, সেই সাহায্যের ফলেই নাকি লাস্ট বয় বেচারা চিরটা কাল লাস্টই হচ্ছে!

যাই হোক, আমি এ-সমস্ত কথা বিশ্বাস করিনি, কারণ আমাদের ঘরে দেখতাম তার খুব বুদ্ধি খোলে। নিজে লুকিয়ে ডিটেকটিভ বই পড়তে আর আমরা কোনো অন্যায় করলে ধরে ফেলতে তার মতন ওস্তাদ আর দুটি হয় না। এই পানুদাই যেদিন বিপদে পড়ল, আমরা তো সবাই থ! সে এক অদ্ভুত আশ্চর্য ব্যাপার!

পানুদা আর তার গুটি পাঁচেক ক্লাসের বন্ধু প্রায়ই ভোজ মারে। সবাই মিলে টাকা জমিয়ে পানুদার কাছে দেয় আর এক শনিবার বাদে এক শনিবার চপ, কাটলেট, ডিমের ডেভিল– আরও কত কী-র ব্যবস্থা হয়! আমায় একবার একটা ঠোঙা ফেলতে দিয়েছিল, আমি সেটা একটু শুকে আর একবার চেটে সারারাত কী পেলুম না, কী পেলুম না করে আর ঘুমুতে পারিনি।

পানুদার কাছে তো পিঁপড়েটি আদায় করা দায়, তাই আমরা ছোটো ছেলেরা নিজেরা একবার পয়সা জমাতে চেষ্টা করেছিলাম। সে আর এক কেলেঙ্কারি! জগা আজ চার আনা দিল, আবার কাল বলে, দে বলছি আমার চার আনা, আমি পেনসিল কিনব। যত বলি পেনসিল কিনবি কীরে, ও দিয়ে যে আমরা চপ কাটলেট খাব রে! জগা বলে, ইয়ার্কি করবার আর জায়গা পাসনি! দে বলছি, নইলে এইসা এক রদ্দা কষিয়ে দেব! পারলে বোধ হয় চার আনার জায়গায় ছ-আনা নেয়। এমনি করে আমাদের সাড়ে তিন আনার বেশি জমলই না। তাও জমত না, নেহাত মন্টুর জ্বর-টর হয়ে বাড়ি চলে গেল, আর পয়সাগুলো চেয়ে নিতে ভুলে গেল।

যাই হোক, পানুদারা এদিকে সাড়ে তিন টাকা জমিয়েছিল। রাত্রে শুনলাম পাশের খাট থেকে পানুদা বলছে– আট আনার বরফি, আট আনার চিংড়ি মাছের কাটলেট, চার আনার ছাঁচি পান শুনে শুনে আমার গা জ্বলতে লাগল। জিভের জল গিলে গিলে পেটটা ঢাক হয়ে উঠল।

পরদিনই কিন্তু পানুদা বিষম বিপদে পড়ল। লাইব্রেরিতে পানুদা আর সমীরদা আর কে যেন একটা ছেলে পেল্লায় আড্ডা দিচ্ছে, পানুদা চাল মেরে কী-একটা কুস্তির প্যাঁচ দেখাতে গেছে আর স্লিপ করে কাঁচের আলমারির দরজা-টরজা ভেঙে চুরমার! পানুদা উঠে দাঁড়িয়ে কী-একটা বলতে যাচ্ছে, এমন সময়ে হেডমাস্টারমশাই এসে এমনি বকুনি লাগালেন যে পানুদা চমকে গিয়ে নিজের আলজিভ-টিভ গিলে বিষম-টিষম খেয়ে যায় আর কী! হেডমাস্টারমশাই এমনি রেগে গিয়েছিলেন যে এসব কিছু না দেখে বললেন– বাঁদুরে ব্যাবসা ছেড়ে এখন মানুষের মতন ব্যবহার শেখো। তোমাকে বেশি জরিমানা কোত্থেকে আর করি, কিন্তু তোমার বাক্সে যা টাকাকড়ি আছে সমস্ত দিয়ে যতগুলি কাঁচ হয় কিনে দেবে, তা দিয়েও যে অর্ধেকের বেশি হবে তা তো মনে হয় না।

সেদিন পানুদার মেজাজ দেখে কে! রাত্রে আমরা ঘরে বসে শুনলাম সিঁড়ি দিয়ে পানুদার চটির শব্দ–অন্যান্য দিনের মতন চটচট চটাং চটচট চটাং না হয়ে একেবারে চটাং চটাং চটাং! বুঝলাম পানুদা রেগেছে।

যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে দেখলাম আসলে আরও ঢের বেশি রেগেছে। ঘরে ঢুকেই পানুদা আমার আর কেষ্টর মাথা একসঙ্গে ঠুকে দিয়ে বললে অত হাসি হাসি মুখ কেন রে বেয়াড়া ছোঁড়ারা? আমরা তক্ষুনি গম্ভীর হয়ে গেলাম। তারপর পানুদা জগার দিকে চেয়ে বলল, ফের ফোঁস ফোঁস করছিস রাস্কেল? বলে তার কানে দিল এক প্যাঁচ। হিরু বলল, ওর সর্দি হয়েছে কিনা–পানুদা তার গালে এক চড় কষিয়ে দিয়ে বলল-চুপ কর বেয়াদপ, তোর কে মতামত চেয়েছে?তারপর সময় কাটাবার জন্য শিবুর কানের কাছে খোঁচাখোঁচা চুলগুলো নখ দিয়ে কুটকুট করে টানতে টানতে দাঁতে দাঁত ঘষে বললে– আজ তোদের কাছ থেকে যদি টু শব্দটি শুনি, সব ক-টাকে কচুকাটা করে ফেলব বলে রাখলাম।

ঘরের মধ্যে একদম চুপ। পানুদা খাটে বসে পা দোলাতে লাগল আর বোধ হয় হেডমাস্টারমশাইয়ের কথা ভাবতে লাগল। এমন সময়ে সেই গণশাটা এসে হাজির। এসেই পানুদার পিঠ থাবড়ে একগাল হেসে বললে– কী রে পেনো, ফিস্টিটা ভেস্তে গেছে বলে বুঝি মুখোনা হাঁড়ি আর কচি ছেলের উপর উৎপাত? রোজ বলি:ওরে পেনো, একা একা অত খাসনি!

পানুদা গুম হয়ে রইল।

গণশা বলল– তাই বলে কি টাকাগুলো সত্যি দিবি না কি?

পানুদা বলল, দেব না তো কি তুমি আমার হয়ে দিয়ে দেবে?

গণশা হেসে বললে, আরে রামঃ! এমন এক উপায় বাতলাতে এলুম, তোকেও দিতে হবে না, আমাকেও দিতে হবে না। আজ রাত্রে দরজা খুলে শুবি, দেখবি একটা ডাকাত এসে সব টাকা নিয়ে যাবে। পরে হয়তো ফিরে পাবি, কিন্তু ডাকাতটাকে খাওয়াতে হবে বলে রাখলুম।

পানুদা হাঁ করে খানিক তাকিয়ে বলল–সে দেখা যাবে এখন। এ সময়ে তুমি এঘরে যে বড়ো এসেছ, জানো না রুল থ্রি?

গণশা বললে– সাধে শাস্ত্রে বলে কদাচ কাহারও উপকার করিয়ো না।

মুখে পানুদা যতই তেজ দেখাক না কেন, শোবার সময়ে দেখলুম দরজাটা ঠিক খুলে শুল। অন্য দিন তো পারলে জানলাও বন্ধ করে, আমাকে দিয়ে খাটের নীচে খোঁজায়, রাত্রে উঠবার দরকার হলে জগাকে আগে একবার পাঠায়, আর সেদিন দেখি বেজায় সাহস! বালিশে মুখ গুঁজে একটু হেসে নিলাম।

উৎসাহের চোটে আমার অনেকক্ষণ ঘুম হয়নি, অনেক রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভাঙলে দেখি কে যেন টর্চের আলো ফেলেছে। পানুদা ভোঁসভাঁস করে ঘুমোচ্ছে আর বাকিরা কেউ যদি জেগেও থাকে। ভয়ের চোটে চোখ বুজে পড়ে আছে। আমি দেখলুম কে একটা লোক পা টিপে টিপে এসে পানুদার বালিশের তলা থেকে চাবি বের করল, পানুদার বাক্স খুলল, কী যেন নিল, আবার বাক্স বন্ধ করে চাবি বালিশের নীচে রেখে আস্তে আস্তে চলে গেল। পরদিন সকালে ইস্কুলময় হইচই, পানুদার টাকা চুরি গেছে। হেডমাস্টারমশাই সবাইকে ডেকে যাচ্ছে-তাই করে বলেন, সকলের বাক্স খোঁজা হল। কোথাও কিছু নেই। গণশার বাক্সে তো এত কম জিনিস, এবং তাও এত নোংরা যে তাই নিয়ে গণশা। বেজায় বকুনি খেল।

সেদিন রাত্রে পানুদার হাসি হাসি মুখ।

আজ কাউকে কিছু তো বললই না, এমনকী যে-পানুদা শার্টের বোতাম ছিঁড়ে গেলে আমাদের শার্ট থেকে বোতাম ফেটে নিজের শার্টে লাগিয়ে নিত সে নিজের থেকেই জগাকে দুটো আস্ত খড়ি দিয়ে ফেলল!

এমন সময়ে গণশা আবার ঘরে ঢুকল।

কী রে পেনো! শেষটা সত্যি ডাকাত পোলো তোদের ঘরে?

পানুদা খুব হেসে বলল– দিস ভাই, তোরও নেমন্তন্ন রইল। গণশা যেন আকাশ থেকে পড়ল– কী দেব রে পেনো! বলছিস কী?

কেন, টাকা!

কীসের টাকা? টাকা আবার কোথায় পাব রে? দানছত্তর খুলেছি না কি? আর তা যদি খুলিও, তোকে টাকা দেব কেন রে এত যোগ্য লোক থাকতে?

পানুদা ভয়ংকর চটে বললে– দেখ গণশা, ইয়ার্কি ভালো লাগে না। দে বলছি!

গণশা বললে– ইয়ার্কি কি আমারই ভালো লাগে নাকি রে?

তারপর গুনগুন করে গাইতে লাগল–

নিশুত রাতে চোরের সাথে টাকা চুরির খেলা,
ওই চোর বেটা নিলে সেটা পেনো বুঝল ঠেলা!

সেই অবধি গণশাকে আমি ভক্তি করি।

সর্বনেশে মাদুলি

পুজোর ছুটির পর যখন স্কুল খুলল, অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম গুপে ডান হাতে মাদুলি বেঁধে এসেছে। কনুইয়ের একটু উপরে ময়লা লাল সুতো দিয়ে বাঁধা চকচকে এক মাদুলি। আমি ভাবলাম সোনার বুঝি, কিন্তু গুপে পরে বলল নাকি পেতলের। ঘাম লেগে লেগে সোনার মতো হয়ে গেছে।

টিফিনের সময় জিজ্ঞেস করলাম, কেন রে? তাতে সে এক আশ্চর্য কথা বলল।

তার দাদামশায়ের নাকি যখন অল্প বয়েস, একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখেন বালিশের তলায় চকচকে এক কুচকুচে কাগের পালক। প্রথমটা খুব খুশি হলেন। ভাবলেন দিব্যি এক খাগের কলম বানিয়ে বন্ধুদের লম্বা লম্বা চিঠি লেখা যাবে। পরে শিউরে উঠলেন। কী সর্বনাশ! কাগ যে ছুঁতে নেই, ইয়ে-টিয়ে খায়, তার পালক বালিশের তলায় এল কোত্থেকে? আর কেউ দেখবার আগেই সেটাকে জানলার শিকের ফঁক দিয়ে উঠোনে ফেলে দিলেন।

কিন্তু কী আশ্চর্য, তার পরদিনও ঘুম থেকে উঠে দেখেন বালিশের নীচে আবার আরেকটা কাগের পালক! এবার আর কোনো সন্দেহই নেই, দস্তুরমতো কাগ কাগ গন্ধ পর্যন্ত পেলেন। দাদামশাই সেইদিনই মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিলেন, চুল ন্যাড়া করলেন, পাশের বাড়ির লোকদের তাদের গাছ-ছাঁটা কঁচিটা ছ-মাস বাদে ফিরিয়ে দিয়ে এলেন, গঙ্গাস্নান করলেন।

স্নান করে উঠে, ঘাটের উপর দেখেন দিব্যি ফোঁটা কাটা, তিলক আঁকা, জটাওয়ালা, গেরুয়াপরা এক সন্ন্যাসী বাবা হাসি হাসি মুখ করে তারই দিকে তাকিয়ে আছেন। দাদামশাই তাকে ঢিপ করে প্রণাম করলেন। অমনি সন্ন্যাসী তার ডান হাতের কনুইয়ের উপর ওই লাল সুতো দিয়ে মাদুলিটা বেঁধে দিয়ে, দাদামশাইয়ের ঘাড়ে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, কু ডর নেই বেটা। শাপখোঁপ সব কেটিয়ে যাবেন।

দাদামশায়ের ঘাড়ে খুব সুড়সুড়ি লাগা সত্ত্বেও তিনি শুধু একটু কিলবিল করে বললেন, ঠিক বলছ তো ঠাকুর?

গলার আওয়াজ শুনে চমকে উঠে সন্ন্যাসী ঠাকুর ঝুলির মধ্যে থেকে সুতো বাঁধা এক চশমা বের করে নাকে পরেই আঁৎকে উঠে বললেন, তাঁ! এ কী আছে রে? আরে আমি তো তোমাকে চিনতে পারেনি, উ মাদুলি পলটু জমাদার কো আস্তে বনায়া, দে দে রে বেটা, উ তোমারা নেহি।

কিন্তু কে শোনে? দৈবাৎ অমন মাদুলি মানুষের জীবনে এক-আধবার ঘটে যায়। তাকে কি অমনি অমনি দিয়ে দেওয়া যায়? দাদামশাই ছপাত করে মালকোঁচা মেরে দে দৌড়!

বাড়ি এসে অবাক হয়ে দেখলেন পাশের বাড়ির আম গাছের যে ডাল পাকা পাকা আমসুষ্ঠু তাঁদের উঠোনের উপর ঝুলছিল, অথচ পাছে নেপালবাবুপুঁতে ফেলেন সেই ভয়ে কিছু করা যাচ্ছিল না, সেসব আম আপনি-আপনি দাদামশায়ের উঠোনে পড়ে গেছে। দেখা গেল নতুন কুয়োতেও ভোর থেকে ঠান্ডা মিষ্টি জল আসছে। রাত্রে ফেলাদা পুকুরে যে ছিপ ফেলে রেখেছিল তাতে মস্ত এক কাতলা মাছ পড়েছে। বেলা না হতেই দাদামশায়ের শালা, গত বছর যে পাঁচ টাকা ধার নিয়েছিল, নিজে থেকে ফেরত দিয়ে গেল। উপরন্তু রবিবার দুপুরে নেমন্তন্ন করে গেল। বাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখলেন এমনকী দিদিমার পর্যন্ত হাসিমুখ।

মাদুলির গুণ দেখে দাদামশাই অবাক। মনে মনে সন্ন্যাসী বাবার ময়লা পায়ে শত শত প্রণাম করলেন।

সে থেকে বাড়ির লক্ষ্মীশ্রী ফিরে গেল। টাকা-পয়সা হল, গোরু-ভেড়া হল, ছেলেরা বড়ো বড়ো চাকরি পেল, মেয়েদের ভালো ভালো বিয়ে হল। এমনকী মামার বাড়ির গোরুর দুধের ক্ষীর, গাছের আম, আর পুকুরের মাছের কথা বলতে গিয়ে উত্তেজনার চোটে গুপে লোম-হর্ষণ সিরিজ-এর বিশ নম্বর বইয়ের পাঁচ ছ-টা পাতার কোনা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলল।

আরও বলল: এই সেই মাদুলি। একচল্লিশ বছর এক মাস দাদামশায়ের হাতে বাঁধা ছিল, একদিনের জন্যও ভোলা হয়নি, দাদামশায়ের হাতে সুতোবাঁধা মাদুলির সাদা দাগ পড়ে গেছে, গায়ে লেগে শেষটা এমন হয়েছিল যে মাঝে মাঝে নাকি মাদুলিটার উপরও চুলকতো!

সেই মাদুলি দাদামশাই এককথায় গুপের হাতে বেঁধে দিয়েছেন কারণ গুপে বায়না ধরেছিল যে মাদুলি না দিলে নাকি সে তেলও মাখবে না, চানও করবে না, ভাতও খাবে না। আর নেহাত যদি খায়ও তাহলে এত কম খাবে যে কিছুদিন বাদে পেট না ভরে ভরে হাত-পা ঝিমঝিম করবে, মুখ দিয়ে ফেনা উঠবে, চোখ উলটে যাবে–এই অবধি শুনেই দাদামশাই কানে হাত দিলেন ও তখনি পট করে মাদুলির সুতো ছিঁড়ে সেটাকে গুপের হাতে বেঁধে দিলেন।

গুপে দেখলে মাদুলির গুণ একটুও কমেনি। আধ ঘণ্টার ভিতর ছোটোমামার ফাউন্টেন পেনের নব খারাপ হয়ে গেল, ছোটোমামা সেটা গুপেকে দিয়ে দিল। পরে অবিশ্যি আবার চেয়েছিল, তাইতেই তো গুপে ছুটির দু-দিন বাকি থাকতেই মামাবাড়ি থেকে চলে এসেছিল।

বাড়ি এসেই শোনে মাস্টারমশাইয়ের মাম্পস হয়েছে, গাল ফুলে চালকুমড়ো, সেরে যদি-বা ওঠেনও তবু একটি মাসের ধাক্কা।

এরপর গুপে যা-তা বলতে আরম্ভ করল। নাকি মাদুলি হাতে পরা থাকলে গুপে যখন যা বলবে তাই ঘটতে বাধ্য। একথা শুনে আমরা সবাই ভীষণ আপত্তি করলাম, তা কি কখনো হয়?

নগা বললে, এক যিশু ছাড়া আর কেউ

গুপে ভীষণ রেগে সরু লম্বা ময়লা নখওয়ালা একটা আঙুল নগার দিকে বাগিয়ে বলল, আজ বলে দিলাম তুই ভূগোল ক্লাসে দাঁড় খাবি।

ওমা! সত্যি সত্যি ভূগোল ক্লাসে নগা দাঁড় তো খেলই, তার উপর কানমলাও খেল! এরপর আর কারুর কিছু বলবার জো নেই। গুপে এক বার মাদুলির দিকে তাকালেই হল, সে যখন যা বলে সবাই তা মেনে নেয়। যখন যা চায় সবাই তাই দিয়ে ফেলে।

তিন সপ্তাহক্লাসসুদ্ধ সবাই গুপের দৌরাত্ম্যে খাবি খেলাম। সে খুশি তাই করতে আরম্ভ করল। এমনকী কালীপদর চুল ছাঁটা পছন্দ হচ্ছিল না বলে সে বেচারাকে ন্যাড়া করিয়ে ছাড়ল।

সবাই দিন দিন রোগা হয়ে যেতে লাগলাম।নগার তো পেন্টেলুন এমন ঢিলে হয়ে গেল যে শেষে তার দাদা তাই নিয়ে টানাটানি। বলে কি না–দেখছিস না, ও আমার, তোর গায়ে বড়ো হচ্ছে। হয় আমার, নয় বাবার।

এদিকে যার যা ভালো জিনিস গুপে সব গাপ করতে লাগল। পেনসিল, রবার, পেনসিলকাটা, রঙিন খড়ির বোঝায় গুপের পকেট ঝুলে ঝুলে ছেড়ে আর কী! শেষে কি না সেসব রাখবার জন্য আমার নতুন টিফিনের বাক্সটা একদিন চেয়ে বসল। তখন আমি বেজায় চটে গেলাম। একটু তোতলামি এসে গেল। মাথাটাথা নেড়ে বললাম- দ্যা-দ্যাখ গুপে, দিন দিন তোর বাড় বাড়ছে। কাল তোর সব অঙ্ক কষে দিয়েছি। আমার টিফিনের অর্ধেকের বেশি খেয়ে ফেলেছিস। ইংরেজি ক্লাসে ছুরি ফটফট করেছিস আর তার জন্য বকুনি খেয়েছি আমি। বেশি বাড়াবাড়ি করিসনে বলে দিলাম!

এক নিশ্বাসে রাগের মাথায় এতগুলো কথা বলে দেখি গুপে আমাকে শাপ দেবার জন্য তৈরি হচ্ছে। তার চোখ দুটো ছোটো হয়ে হয়ে আলপিনের ডগার মতো হয়ে গেল, ঢোক গিলে, গলা হাঁকড়ে, আঙুল বাগিয়ে, খনখনে গলায় বলল– আজ তোর জীবনের শেষ দিন। দিনটা কাটলেও রাত কাটবে না। ক্লাসময় একটা থমথমে চুপচাপ। তার মধ্যে নরেনবাবু এসে গেলেন, আর কিছু হল না।

একটু পরেই আমার গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে আসতে লাগল, নিশ্বাসটা কীরকম জোরে জোরে পড়তে লাগল, চুলের গোড়াগুলো শিরশির করতে লাগল, পেটের ভিতর কেমন ফঁকা ফঁকা মনে হতে লাগল। বুঝলাম মাদুলির শাপ আমার লেগেছে। কিছু পড়া-টড়া শুনলাম না, হোমটাস্ক টুকলাম না, ড্রইং ক্লাসে বেয়াদপি করলাম। যার দিন কাটলেও রাত কাটবে না, তার আবার ভাবনা কী? টিফিন বাক্সটা ক্লাসের মধ্যেইনগার হাতে তুলে দিলাম, আমি মরি আর গুপে সেটা ভোগ করুক আর কী! ছুটির ঘণ্টা পড়লে পর মনে হল, আমি তো গেলাম, যাবার আগে ওই সর্বনেশে মাদুলিটাকে শেষ করে তবে যাব।

দেখি গুপেদের পুরোনো চাকর ভদু গুপের বই গুছিয়ে নিচ্ছে, আর গুপে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই দেখছে। হঠাৎ খুন চড়ে গেল, ছুটে গিয়ে এক সেকেন্ডে মাদুলিটা কেড়ে মাড়িয়ে ভেঙে একাকার! তার থেকে অন্তত ধোঁয়াও বেরুনো উচিত ছিল, কিন্তু কিছু হল না। গুপে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু ওদের চাকরটা হই হই করে ছুটে এসে হাত-পা ছুঁড়ে বললে- যা, কী করলে! আমার পেটব্যথার অব্যর্থ মাদুলি, আমি কালীঘাট থেকে দু-পয়সা দিয়ে কিনে এনেছি। আগেই জানি গুপি দাদাকে যা দেওয়া যাবে তাই আর কিছু থাকবে না!

আমরা সবাই হাঁ করে গুপের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার নিশ্চয় কিছু বলা উচিত ছিল, কিন্তু সে অম্লানবদনে পকেট থেকে দুটো পয়সা বের করে ভদুকে ছুঁড়ে দিয়ে একটু কাষ্ঠহাসি হেসে বাড়ি চলে গেল।

হুঁশিয়ার

যখন সামনের লোকটার লোমওয়ালা ঘেমো ঘাড়টার দিকে আর চেয়ে থাকা অসম্ভব মনে হল, চোখ দুটো ফিরিয়ে নিলাম। অমনি কার জানি একরাশি খোঁচা খোঁচা গোঁফ আমার ডান দিকের কানের ভিতর ঢুকে গেল। চমকে গিয়ে ফিরে দেখি ভীষণ রোগা, ভীষণ লম্বা, ভীষণ কালো একটা লোক গলাবন্ধ কালো কোট পরে ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে। তার পিছনে আরও অনেক লোক সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য কোন পা জোড়া তার বুঝে নিতে আমার একটু সময় লাগল। শেষটা টের পেলাম খুব সরু, খুব নোমওয়ালা, আর খুব কালো ঠ্যাং দুটো ওর। তায় আবার একজোড়া দাঁত-বেরকরা ছেঁড়া চটি পরা, তার ফুটো দিয়ে নোংরা বুড়ো আঙুল বেরিয়েছে।

এই লোকটা হাসি হাসি মুখ করে আস্তে আস্তে আমার কানের মধ্যে থেকে তার গোঁফটাকে সরিয়ে নিতে নিতে বলল, মনিব্যাগটা আরেকটু খামচে ধরুন, যা চোর-চামারের উপদ্রব! লোকটার কথাগুলো যেন কতদূর থেকে এল, কীরকম একটা হালকা ফিসফিস আওয়াজ। তার চোখ দুটোও যেন আর কিছুতেই গর্তের মধ্যে থাকছিল না, একেবারে বেরিয়ে এসে আমার মনিব্যাগের ভিতরের খোপের মধ্যে পড়ে যেতে চাচ্ছিল।

সবাই এক জনের পিছনে এক জন দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে শেয়ালদা স্টেশনের ইন্টার ক্লাস টিকিটঘরের দিকে এগোচ্ছিলাম। খুব সাবধানে, কারণ একটু এক পাশেসরলেই ধাক্কার চোটে লাইন থেকে বেরিয়ে পড়বার ভয়। এমনি করে যখন খাঁচার ভিতরে বেশ কালোকালো মেমসাহেবের কাছে পৌঁছোলাম, তখনও টের পাচ্ছিলাম, পিছনে সেই লোকটার ফোঁসফোঁস নিশ্বাস আর আস্তে আস্তে গোঁফ নাড়া।

লোকটা দেখলাম আমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। মেমসাহেবকে যখন টাকা দিলাম লোকটা ঝুঁকে ব্যাগের মধ্যে দেখতে দেখতে বলল–চেঞ্জ গুনে নেবেন, বেটিরা ভারি হঁচড়। মেম রেগে এ-গাল থেকে ও-গালে চুইংগামটা ঠুসে দিয়ে বলল– চোপরাও বাবু। তারপর লোকটা আমাকে সেইরকম যত্ন করে উপদেশ দিতে দিতে প্ল্যাটফর্মের দিকে নিয়ে চলল। একটা কলার খোসা আর কী যেন খানিকটা খুব কসরত করে এড়িয়ে বলল– সংসারে কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। সবাই সবারটা গিলবার ফিকিরে আছে। গেটের কাছে চেকারবাবু চিকিৎ চিকিৎকরে টিকিট হেঁটে দিলে পর আমার সঙ্গে সঙ্গে সেও প্ল্যাটফর্মে ঢুকল। বলল–এই যে গাড়ি–অবিশ্যি সেটা বলবার কিছু দরকার ছিল না।

আমার সঙ্গে একটা ইন্টার ক্লাস গাড়িতে ঢুকে আমার পাশে বসে বলল- জিনিসপত্র আগলে রাখুন, সুটকেসটা দূরে রাখবেন না, নিজের সিটের তলায় রাখাই ভালো। এটা জেনে রাখবেন শিয়ালদা স্টেশন চোর-বাটপাড়ের আড়ত। তারপর আমরা দুজনেই জুতো খুলে পা তুলে আরাম করে বসলে পর বলতে লাগল– সংসারে কাউকে বিশ্বাস করা যায় না। আমি নিজে যতগুলো চোর-জোচ্চর দেখেছি সবগুলোকে একটার পেছনে একটা দাঁড় করালে এখান থেকে বোলপুর স্টেশন অবধি লম্বা একটা লাইন হয়। একথা শুনে আমি অবাক হলাম।

তখন সে আরও বলতে লাগল, আর ছিচকে চুরির জন্য তারা যে অধ্যবসায়, ধৈর্য ও বুদ্ধি দেখিয়েছে, ভালো কাজে যদি লাগাত এতদিনে ভারতবর্ষ উদ্ধার হয়ে যেত।

তারপর তার কালো কোটের পকেট থেকে একটা চারকোনা পানের ডিবে বের করে বলল গিরিডির মতন সভ্য শহরে, যে জায়গা সজ্জনের বাস বলে বিখ্যাত এমন শহরে, সেবার পুজোর সময়ে সচ্চিদানন্দ জ্যাঠামশাইয়ের পাজামা সুটের ইজের গা থেকে খুলে চোরে নিয়ে চলে গেল, এর বেশি আর কী বলা যায়!

আমি নিবিষ্ট মনে শুনতে লাগলাম। আর সে গোটা দুই পান মুখে পুরে, একটু চুন দাঁতে লাগিয়ে বলে যেতে লাগল– গরমের জন্য বাইরে মাদুর পেতে, তায় চাদর বিছিয়ে, বালিশ মাথায়, চাদর গায়, পায়ের কাছে চটি, বালিশের নীচে হাতঘড়ি, মাথার কাছে জলের গেলাশ নিয়ে, ভগবানের নাম নিয়ে রোজকার মতন শুয়ে পড়েছেন। আর সকালে উঠে দেখেন কিনা চটি নেই, গেলাশ নেই, বালিশ নেই, হাতঘড়ি নেই, এমনকী পরনের ইজেরটা পর্যন্ত কখন যেন আস্তে আস্তে খুলে নিয়েছে!

তখন সে বলল–কাউকে মশাই বিশ্বাস করা যায়? অরুণবাবু ট্রেনে করে আসছেন। সেকেন কেলাস গাড়ি, সঙ্গে উঠলেন দিব্যি খাকি প্যান্ট শার্ট হ্যাঁট পরা বাঙালি সাহেব। ক্যায়সা ভাব জমে গেল দেখতে দেখতে। ইনি ওঁর বিস্কুট খেলেন, আবার উনি এঁর সিগারেট টানলেন। তারপর মুড়ি-সুড়ি দিয়ে দু-জনে ঘুম। সকালে উঠে অরুণবাবু দেখলেন বাঙালি সাহেবও নেই, তার জিনিসপত্রও নেই, আর অরুণবাবুর সুটকেশও নেই।

আমি একবার আমার সুটকেস ও পুঁটলিটা দেখে নিয়ে ঠ্যাং বদলে বসলাম। আর সে বাইরে এঁদো পুকুরে ধোপাদের কাপড় কাঁচা দেখতে দেখতে নীচু গলায় বলতে লাগল।

ছোটোবেলায় পাড়াগাঁয়ে পিসিমার কাছে থাকতাম। গ্রামের একধারে বাঁশঝাড়ের কাছে খড়ের চালের বাড়ি। যেই-না সন্ধ্যে হওয়া আর অমনি বাড়ির আর উঠোনের আনাচে-কানাচে ভয়ভীতিরা ভিড় করে আসত। বাঁশঝাড়ের শুকনো পাতা খসার শব্দ থেকে আরম্ভ করে আমাদের মেনি বেড়ালটারকাঁক করেইঁদুর ধরার আওয়াজটা পর্যন্ত সূর্য ডোবার পর কেমন যেন অন্যরকম লাগত। আরপিসিমা শোবার আগে প্রত্যেক ঘরের প্রত্যেকটা খিল ভালো করে দেখে নিতেন, বাক্স প্যাটরার উপর নানানভাবে ঘণ্টা বাসন সব এমন করে সাজিয়ে রাখতেন যাতে একটু সরালেই সব দুমদাম পড়ে আমাদের কেন, পাড়ার অন্য লোকদেরও ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। এইসব করতে করতে পিদ্দিমের তেলটুকু পুড়ে যেত আর আলো নিবে যেত। পিসিমাও অমনি খচমচ করে বিছানায় ঢুকতেন। মাঝে মাঝে ওঁর ঠান্ডা খড়খড়ে পা আমার পায়ে লেগে যেত, আমি শিউরে উঠতাম। শুয়েই আবার পিসিমার মনে হত–কী হবে, খাটের তলা দেখা হয়নি, যদি কোনো ধূর্ত চোর ছোরা-হাতে সেখানে ঘাপটি মেরে বসে থাকে! আমাকে বলতেন–এই, তোর একটা মার্বেল খাটের তলা দিয়ে গড়িয়ে দে না, ওদিক দিয়ে বেরোলে বুঝব খাটের তলায় কেউ নেই।ভয়ে আমার হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁদিয়ে যেত, পিসিমা যা বলতেন তাই করতাম। একবার খাটের পায়ায় মার্বেল আটকে গেল, আর সারারাত পিসিমা আর আমি জেগে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলাম। আর কখনো যদি পিসিমা আগে শুতেন আর আমাকে অন্ধকারে পরে শুতে হত, খাটের তিন হাত দূর থেকে এক লাফ মেরে খাটে উঠে পড়তাম, যাতে খাটের তলায় লুকিয়েবসা বদমায়েশটা তার ঠান্ডা হাত দিয়ে আমার ঠ্যাং ধরে টেনে নিতে না পারে। একদিন হিসেব ভুল হওয়াতে পিসিমার পেটের উপরল্যান্ড করেছিলাম, আর পিসিমা আমার কানটান মলে বার বার বলতে লাগলেন যে উনি পষ্ট টের পাচ্ছেন ওঁর নাড়িভুঁড়ি সব এলিয়ে গেছে!

এতটা বলে লোকটা এক বার আড়চোখে আমার দিকে চেয়ে বলল–ছোটোবেলা থেকে এমনি আমার ট্রেনিং যে কোনো শা–র চোরও আমার কাছ থেকে কানাকড়িও পায়নি! এই দেখুন নোটের তাড়া নিয়ে নির্বিঘ্নে যাচ্ছি!

এই অবধি বলেই হঠাৎ সে এদিক-ওদিক চেয়ে সটাং শুয়ে পড়ে নাক ডাকতে লাগল। গাড়িতে আর যে দু-চারজন ছিল তারাও সবাই একসঙ্গে নেমে গেল। আর আমিও আমার যে দু-একটা কাজ ছিল সেরে নিয়ে অন্য এক বেঞ্চিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম ও একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

যখন ঘুম ভাঙল তখন ভোর হয়ে এসেছে, চোখ ঘষে উঠে দেখি আমার সঙ্গীটি কখন জানি নেমে গেছে। তার কথা মনে উঠতেই আর তার চোরের ভয় মনে করতেই বেজায় হাসি পেল। ঠিক এই সময় চোখে পড়ল বেঞ্চির তলায় আমার সুটকেস, পুটলি ও চটি কিচ্ছু নেই। আছে কেবল তার সেই দাঁত বের করা ছেঁড়া চটি জোড়া!

ভীষণ রাগ হল। ভণ্ড, জোচ্চর, বকধার্মিক কোথাকার! রাগের চোটে হঠাৎ নিজের ট্র্যাকের উপর হাত পড়ে গেল। ট্র্যাক খুলে দেখলাম, কাল রাত্রে লোকটা ঘুমিয়ে পড়বার পর তার বুকপকেট থেকে যে নোটের তাড়াটা সরিয়েছিলাম আমার সুটকেস্ ইত্যাদি চুরি যেতে পারে কিন্তু সেটি ঠিকই আছে।

বেশ একটু খুশি মনে আবার শুয়ে এক ঘুম দিয়ে উঠলাম।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত