অন্ধকার কাটিয়ে আলোর দিশা

অন্ধকার কাটিয়ে আলোর দিশা

আচ্ছা বাবা, মা দেখতে খুব সুন্দর ছিল তাই না ” তিয়ার মুখে কথা শুনে খানিকটা চমকেই গেলাম। আমি টেবিলে বসে ল্যাপটপে অফিসের কিছু কাজ করতে ছিলাম। আর আমার মেয়ে তিয়া সোফায় বসে পড়ছিল। তখনই সে কথাটা বলে উঠে। তাই আমি ল্যাপটপ রেখে তিয়ার সামনে যেতেই দেখি তিয়া আমার বিয়ের এলবাম দেখছে। আমার দেখে প্রশ্নটা আবার জানতে চাইলো।

— বাবা বলো না, মা দেখতে খুব সুন্দর ছিল তাই না।
— সুন্দর ছিল তবে আমার তিয়া পরীর মত এতো বেশি সুন্দর ছিল না।
— পাক্কা তো।
— হুমম একদম পাক্কা।
— আচ্ছা বাবা, মা কি আমার মত রাগ করতো?
— হুমম রাগ করতো তবে খুব তারাতারি রাগটা ভেঙ্গেও যেতো।
— বাবা তুমি না সত্যি খুব ভাল আর আমার সুপারম্যান।
— কি কারনে?
— কারন, আমার বাবা সবার চেয়ে বেস্ট আর আমার সব কথাই শুনো। আর আমার সব প্রশ্নের উত্তরও দাও।
— হইছে আমার পরী মামনি এখন পাকনী বুড়ি না সেজেঁ চলো ঘুমাবে চলো।
— ঘুমাবো তবে আমার একটা শর্ত আছে।

— হুমম বলে ফেলো আমার পরী, কি তোমার শর্ত?
— আজকে আমার সুপারম্যান বাবা আমায় গল্প বলবে আর আমি গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়বো।।
— কিন্তু আমি তো গল্প বলতে পারি না।
— আমি কিছু জানি না। যদি তুমি গল্প না বলো তাহলে আজ সারা রাত না ঘুমিয়ে সোফায় বসে থাকবো।
— ওরে বাব্বা মামনি আমার রাগ করেছে?
— ওই আমায় মামনি বলবে না। আমি অনেক বড় হয়েছি।
— আরে তাই তো আমার মামনি তো বুড়ি হয়ে গেছে। এখন তো সে স্কুলে যায় আর ৩য় শ্রেনীতেও পড়ে।
— হুহহ।
— আচ্ছা আমার বুড়ি এবার বিছানায় চলো আর আমি তোমায় গল্পও শুনাবো।
— ইয়াহু উম্মা

আমাকে একটা পাপ্পী দিয়ে দৌড়ে খাটে চলে গেল। আমিও ল্যাপটপ টা অফ করে তিয়ার পাশে শুয়ে পড়লাম। তিয়া এখন আমার পাশে তাকিয়ে আমায় জড়িয়ে আছে।

— বাবা বলো না।

আজ থেকে প্রায় আট বছর আগের একটি ঘটনা। তখন রাজ নামের একটা ছেলে মাত্র লেখাপড়া শেষ করে চাকরীর জন্য চারপাশে ঘুরছে আর ভাগ্যক্রমে খুব তারাতারি রাজের চাকরী হয়ে যায়। চাকরীতে জয়েন করার দুই মাস পরই রাজের পরিবার থেকে রাজকে বিয়ে করার জন্য চাপ দেয় কিন্তু রাজ বিয়ে করতেই চায় না। একদিন দুপুরে রাজ অফিসের ক্যান্টিনে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছিল তখনই রাজের ফোনটা বেজেঁ উঠে আর তাকিয়ে দেখে তার মা ফোন দিয়েছে….

— হ্যালো মা বলো।
— তুই আজ ছুটি নিয়ে একটু বাসায় চলে আয় তো।
— কেন? কোন দরকার?
— হুমম দরকার। তুই আয় আমি বসে আছি তোর জন্য।
— আচ্ছা দেখি।

ফোনটা রেখে তারাতারি খেয়ে নিলাম। কারন, মা হয়ত কোন কাজের জন্যই এই দুপুরে ফোন দিয়েছে।আর তাছাড়া আজ অফিসে কাজের চাপ নেই বলে স্যারের থেকে ছুটি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। রাস্তা দিয়ে এক প্রকার বিরক্তি নিয়ে হেটেঁ চলেছি। কারন, রিকশার কোন চিহ্নের দেখা নেই। এই দুপুরে কি ওরাও রেস্ট নিচ্ছে নাকি। হাটতেঁ হাটতেঁ এলাকার সরকারী কলেজের সামনে চলে আসলাম কারন এখানে অন্তত রিকশা পাওয়া যাবে। হঠাৎ পাশের দোকান থেকে কেউ একজন আমার নাম ধরে ডাক দিলো। তাকাতেই দেখি আরে এতো তুহিন আর রাজীব বসে আছে একটা কম্পিউটারের দোকানে। আর ওরা আমার কলেজে পড়াকালীন ক্লাসমেট ছিল। কলেজ শেষে যখন পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পাই তখন আর ওদের সাথে তেমন কোন যোগাযোগ থাকে না।তাই আমিও দোকানের ভিতরে গেলাম আর ওদের আড্ডায় যোগ দিলাম।

— আরে তুহিন আর রাজীব তোরা কেমন আছিস? কত দিন পর তোদের সাথে দেখা। আর এখানে কি করছিস?
— আমরা ভালই। তুই তো পাবলিক ভার্সিটিতে টিকে এই কলেজের আশে পাশে আসাই ভুলে গেছিস। আর আমরা কোন পাবলকি ভার্সিটিতে চান্স পাই নি বলে এই ন্যাশনাল কলেজ থেকেই রসায়ন নিয়ে অনার্স করি। লেখাপড়া শেষ কোন চাকরী না পাওয়ায় আমি আর রাজীব পার্টনারশিপে এই কম্পিউটারের দোকান দেই। এখানে ফটোকপি করা হয় আর কলেজের সব কাজ করা হয়।( তুহিন বলল)

— বাহ্ ভালই তো। আমার থেকে তো তোদের ইনকাম বেশি।
— এইসব বাদ দে। নে সিগারেট খা।
— দোস্ত এই সব কি আমি আগে খাইছি যে এখন খাবো।
— বাহ্ রাজ তো এখনো ভাল ছেলে হয়েই আছিস।
— হুমম।
— আচ্ছা রাজ তুই একটু বস। আমি এই সামনে মোড় থেকে বিরিয়ানি নিয়ে আসছি আর রাজীব তুই পানি আনতে যা।(তুহিন আমায় আর রাজীবকে বলল)
— ওকে। কিন্তু তোরা তারাতারি চলে আসিস। আমার কিন্তু কোন দোকানে বসার আইডিয়া নেই।
— আরে চাপ নিস না। আমরা তারাতারি চলে আসবো। যদি কেউ ফটোকপি করতে আসে তাহলে বলবি লোক নেই আর যদি কেউ কলম বা খাতা কিনতে আসে তাহলে বিক্রি করিস।
— ওকে।

আমি বসে রইলাম আর রাজীব ও তুহিন বেড়িয়ে পড়লো। কেমন যেন বোরিং বোরিং লাগছে আর একটু ভয়ও লাগছে। আমি ভাল ভাবে দোকানটা দেখতে লাগলাম। মেঝেতে দুইটা বিয়ারের বোতল পড়ে আছে আর সিগারেটের শেষ অংশও পড়ে আছে। এই রাজীব আর তুহিন বদলাবে না। এইসব বাজে জিনিস খেয়ে নিজের শরীর টাকে কেন নষ্ট করছে? ওরা আসলেই আমার বেড়িয়ে যেতে হবে কারন মা আমার জন্য বসে আছে। মনে হয় না খুব জরুরি কিছু, যদি বেশি জরুরী হতো তাহলে আমায় শিউর ফোন দিতো। প্রায় ৫ মিনিট পর একটা ছেলে আসলো…

— ভাইয়া একটা কলম দিয়েন তো।
— কোনটা দিবো ভাই?
— ওই প্যাকেট থেকে দেন।
— এই নাও।
— আচ্ছা রাজীব বা তুহিন ভাই কই? আর আপনাকে তো আগে এখানে দেখি নি।
— আমি ওদের বন্ধু আর ওরা একটু বাইরে গেছে।
— ও আচ্ছা। তারপর ছেলেটা আমায় টাকা দিয়ে চলে গেল। ছেলেটা যেতে না যেতেই একটা মেয়ে এসে হাজির।

— এই যে এইগুলো একটু ফটোকপি করে দেন তো।
— সরি সম্ভব না।
— কেন?
— দোকানের লোক বাইরে গেছে।
— ও আচ্ছা ।

মেয়েটা প্রথমে চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাড়ালো কিন্তু আবার আমার দিকে তাকিয়ে ভাল করে আমায় দেখতে লাগলো। আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখলো আর তারপর মেঝেতে বিয়ারের বোতল দেখে আমার দিকে চোখ গুলো ছোট ছোট করে তাকালো।মনে হয় কোন প্রকার রাগ দেখালো আবার ঘুরে চলে গেল। কিছুই বুঝলাম না মেয়ের তাকানো টা। একটু পরেই রাজীব আর তুহিন চলে আসলো আর আমায় খাওয়ার জন্য জোর করলো কিন্তু আমি আবার আসবো বলে চলে গেলাম। তারপর, কলেজের সামনে থেকে একটা রিকশা নিয়ে সোজা বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। কিন্তু বাসায় আসতেই মায়ের মুখ ঝামটার সম্মুখীন হতে হলো। আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগলো…..

— এখন তো চাকরী করে তাই হাত পা বড় হয়ে গেছে আর আমি আজ আছি কাল নেই। এইসব ভাবার জন্যও একটা লোক নেই। সারাটা দিন বাসায় একা বসে বসে বোরিং হয়ে যাই। হুহ একটা মেয়ে থাকলে তো তার সাথে একটু কথা বলতে পারতাম।

— তো হইছে কি বলবে তো?
— কিছু হয় নি আর কি হবে? ২ বছর হইছে তোর বাবা মারা গেছে আর তারপর থেকেই আমি বাসায় একা কাটাঁই। একটা বউ হলে তো তার সাথে মিষ্টি কথা না হোক বরং ঝগড়া করে তো দিনটা কাটাঁতে পারবো।
— তো কি চাও আমি বিয়ে করি?
— হুমম।
— তাহলে যাও মেয়ে দেখা শুরু করো। ( অন্তত মেয়ে দেখতে দেখতে তো এক বছর পার হয়ে যাবে। এটা ভেবে মেয়ে দেখার কথা বললাম)
— সত্যি। যা বাবা তারাতারি রেডি হয়ে আয়। আমি মেয়ে দেখে রাখছি। আজ বিকালে পাকাঁ কথা বলতে যাবো।
— কী? ( এক প্রকার ঝাটক্কা খেলাম)

মা আমাকে রেডি হওয়ার কথা বলে নিজে রেডি হতে চলে গেল। আরে এটা কোন মুসিবতে ফেসেঁ গেলাম রে। এখন তো আমার বিয়ে আটকানো যাবে না। আমি আর মা মেয়ের বাসায় বসে আছি। কথায় বলে না, “যে ছেলে বলে পরে বিয়ে করবো পরে বিয়ে করবো আর তার বিয়েই আগে হয় “। এই অল্প বয়সে আমার বিয়ে করার কোন শখ নেই কিন্তু মায়ের কথায় আর পারলাম না । মেয়ের বাসার লোকেরা আমাদের ভালই আপায়ন করতে লাগলো। আর একটু পর পর আশে পাশের ঘর থেকে কিছু ছোট ছোট মেয়ে আমায় উকিঁ দিয়ে দেখতে লাগলো।

একটু পরেই মেয়ে আসলো হাতে শরবত নিয়ে। আমি প্রথমে মাথা নিচু করে রাখলেও যখন মেয়ে আমায় শরবত দিতে আসলো আর আমি মেয়ের দিকে তাকালাম তখন ৮৪০ বোল্টের একটা ঝাটক্কা খেলাম কারন এটা তো ওই মেয়ে যার সাথে আমার তুহিনের দোকানের সামনে দেখা হইছিল। আর তখন মেয়ে আমার দিকে ওইভাবে তাকানোর কারন হলো মেয়ে আমার ছবি আগে দেখছিল। কিন্তু আমি তো মেয়ের ছবি দেখি নি। এখন মেয়েটা আমার দিকে মুখে ভেংচি কেটেঁ সামনের চেয়ারে গিয়ে বসলো। এখন মেয়েটার দিকে তাকেই আমার খুব লজ্জা লাগছিল। আমার মা তো অলরেডি ওই মেয়ের মাকে বিয়ান ডাকা শুরু করে দিছে। আমিও শুধু চুপচাপ বসে আছি। হঠাৎ মা বলল…

— রাজ মেয়ে তো আমার পছন্দ হয়েছে। যদি তোর কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে মেয়ে করতে পারিস।
–( আমি চুপ করে আছি) তখন মেয়ের বাবা আমায় উদ্দেশ্য করে বলল…

— রাজ বাবা তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো? যেহেতু সবই ঠিক হয়ে গেছে আর শুধু বিয়ের দিনটা ঠিক করা বাকি। তুমি চাইলে মেয়ের সাথে একা কথা বলতে পারো। ওনার কথায়, আমারও ইচ্ছা করলো আমি মেয়ের সাথে কথা বলি তবু ভদ্রতার খাতিরে চুপ করে রইলাম।তখন আমার মা মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল…

— মা যাও তো ওরে তোমার সাথে নিয়ে যাও আর আমরা বিয়ের তারিখটা ঠিক করে নেই।
তারপর আমি মেয়ের সাথে ওর রুমে গেলাম। আর রুমটাও ভাল করে দেখতে লাগলাম। যদিও একটু একটু অগোছালো তবুও খারাপ না। তখন মেয়েটি বলল…

— আচ্ছা মিস্টার রাজ। আমি আপনার নাম জানি আর আপনার ছবিও দেখেছি। আপনি আমার নাম জানেন তো? আর আপনি যে আমার ছবি দেখেন নি এটাও ভাল করে জানি।

— না তো নাম জানি না। আপনার নামটা কি?
— হা হা আমি নিত্তিয়া। যাই হোক, আপনি সত্যি বিয়ার আর সিগারেট খান।
— না তো।
— মিথ্যা বলবেন না কারন আজ আমি দেখলাম আপনি যে দোকানে বসে ছিলেন ওইখানে বিয়ারের বোতল ছিল।
— এই গুলো যে বিয়ারের বোতল তুমি কেমন করে জানো।তুমিও খাও নাকি?
— না মানে ইয়ে মাঝে মাঝে..
— কি?
— তবে প্রমিস আর খাবো না।
— হুমম।

— আচ্ছা মিস্টার রাজ তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে।
— না তো কেন?
— না সবাই বলে যে যেমন তার সাথে নাকি তেমনই ছেলে বা মেয়ে জুটে।
— কথাটা ঠিক বুঝলাম না। আসলে আমার ৩টা বয়ফ্রেন্ড ছিল। তবে সত্যি বলতে সকালেই ব্রেকআপ করে দিছি।
— বাহ্ তুমি তো হেব্বি চিজ।
— হুমম জানি তো আর আপনিও খুব কিউট। এক্কেরে গুলটু।
— গুলটু কি?
— বুঝবে না। এটা ভালবেসে ডাকতে হয়।
— ওকে চলো সবার সামনে যাই।
— ওকে

এরপর সবার সাথে এসে বসলাম আর বিয়ের দিন ঠিক করে চলেও আসলাম। বাসায় এসে ভাবতে লাগলাম এই মেয়ে এমনি যে পরিমানে ফাস্ট। বিয়ের পর জানি আমার কি অবস্থা করে? তবে যেহেতু মেয়ে আমার মায়ের পছন্দ হয়ে গেছে তাই এখানে আর কথা বলে লাভ নেই। বিয়ের দিন চলে আসলো আর খুব শান্তিতে বিয়েটা শেষ হয়ে গেল। বিয়ের আগে আমি মেয়ের সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ রাখি নি কারন আমার এটা ইচ্ছা ছিল। এখন নিত্তিয়ার আমার সামনে খাটে বসে আছে। ওকে কি বলবো বুঝতে পারছি না?তখন নিত্তিয়াই বলল…

— আচ্ছা আপনি কি খুব চুপচাপ?
— কেন?
— না মানে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কথা বলেন না তো তাই।
— হুমম একটু এমনিই।
— যাই হোক,আপনি খুব কিউট।
— হুমম।
— আচ্ছা আজ আমায় কোন গিফট দিবেন না।
— কি চাও বলো?
— চাইলে সত্যি দিবেন তো।
— যদি তোমার চাওয়া আমার সামর্থ্যের মাঝে থাকে তাহলে অবশ্যই দিবো।
— আমি জানি আমি যা চাইবো এই গুলো আপনি দিতে পারবেন।
— ওকে শুনি কি চাও?

— বেশি কিছু না। শুধু যখন আমি রাগ করবো তখন সব সময় নিজেই আমার রাগ ভাঙ্গাবে। আমার সাথে ঝগড়া হলে সব সময় আপনিই সরি বলবেন। শেষটা হলো, আমি রান্না করার সময় আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরতে হবে।
— বাব্বা এক লাইনে তিনটে চাওয়া।
— হুমম দিবেন কি না বলেন?
— হুমম দিবো।

এভাবে ভালবাসার দিন গুলো খুব ভালই কাটঁতে লাগলো। কিন্তু বেশি সুখ যদি কপালে না থাকে তাহলে তো সেই সুখ টিকে না। আমারও কপালে সেই সুখ টিকলো না। নিত্তিয়া প্রায় দেড় বছর পর মা হতে চলল আর তখনই বিপদ বাধঁলো। নিত্তিয়ার রক্তের গ্রুপ ছিল এবি নেগেটিভ। যা আমি ডেলিভারির সময় যোগার করতে পারি নি আর যখন রক্তের যোগার হলো ততখনে নিত্তিয়া এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে দিয়ে ছিল। তবে ও চলে যাওয়ার আগে আমার বেচেঁ থাকার জন্য একটা মিষ্টি গিফট দিয়ে গিয়ে ছিল। যার নাম রাখেছিলাম তিয়া। আমার তিয়াকে আমি আর তিয়ার দিদিমা মিলে বড় করতে লাগলাম। কিন্তু যখন তিয়ার বয়স ৫ বছর তখন তিয়ার দিদিমাও মারা যায়। এখন রাজ আর তিয়া ছোট একটা পরিবার বানিয়ে রয়েছে।

আমার গল্পটা শুনতে শুনতে তিয়া ঘুমিয়েই গেছে। আসলে আমি তো গল্প বলতে পারি না তবে নিত্তিয়া খুব সুন্দর গল্প বলতো। আমি শুধু রাজ নিত্তিয়ার গল্পটাই জানি তাই আমার মেয়ে তিয়াকে বললাম। মেয়েটা খুব শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। আমি মোবাইলে এলার্ম দিয়ে তিয়াকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গতেই ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে তিয়াকে ঘুম থেকে তুলে আমি রান্না ঘরে চলে গেলাম।তারপর যাই পারি তাই রান্না করে আমার তিয়া মেডামকে স্কুলের জন্য রেডি করে দিতে লাগলাম। বাবা মেয়ে সকালের নাস্তা করে বেড়িয়ে পরলাম। তিয়াকে স্কুলে পৌছেঁ দিয়েই আমি অফিসের জন্য বেড়িয়ে পড়লাম।

দুপুরে তিয়ার স্কুলের সামনে দাড়িয়ে আছি। স্কুল একটু আগে ছুটি হইছে। আমি আজ লেট করেই তিয়াকে নিতে আসলাম। আসলে কাজের চাপে একটুও মনে ছিল না। তিয়া মনে হয় স্কুল মাঠে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। তাই ভেবে স্কুলের ভিতরে গেলাম। কিন্তু দেখলাম তিয়া একটা মেয়ের সাথে বসে হেসেঁ হেসেঁ গল্প করছে। আমাকে দেখেই ওনাকে বায় দিয়ে আমার কাছে চলে আসলো। আমি তিয়াকে বাসায় নিয়ে আসলাম। আর দেখি কাজের মহিলা এসে রান্না করে রেখেছে। আসলে কাজের মহিলা দুপুরে আসে আর রাত পর্যন্ত থাকে। নয়ত তিয়াকে রেখে যেতে ভয় পেতাম। আমি তিয়াকে বললাম…

— তিয়া স্কুলে তোমার সাথে ওই বড় মেয়েটি কে ছিল?
— ও ওনি তো আমাদের ইংরেজি শিক্ষিকা। ওনার নাম হলো নিতা। জানো ওনি না আমায় খুব আদর করে। আমাকে মাঝে মাঝে চকলেটও দেয়। কাল তোমাকে ওনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো নে।
— ওকে এবার তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। বাবা মেয়ে এক সাথে খেয়ে নেই। বাবার তো আবার অফিস যেতে হবে মামনি।
— ওকে চলো।

তারপর তিয়াকে খাইয়ে দিয়ে আমি অফিসের জন্য চলে আসলাম। আজও তিয়াকে স্কুল থেকে নিতে লেট করে আসলাম। গতকালের মতই দেখি তিয়া ওর নিতা মেডামের সাথে গল্প করতে ব্যস্ত। আমি তিয়ার পিছনে গিয়ে ডাক দিলাম..

— তিয়া মামনি।
— বাবা তুমি চলে আসছো। এই যে আমার নিতা মেডাম।
— হাই, কেমন আছেন?( আমি বললাম)
— ভাল। আপনি কেমন আছেন?
— জ্বি ভাল।
— আপনি তিয়ার বাবা। আসলে তিয়া তো বাবা বলতে প্রায় অজ্ঞান। আপনি খুব লাকি যে তিয়ার মত মেয়ে পেয়েছে। তিয়ার মাকে মনে হয় তিয়া একদম জ্বালায় না।

— হুমম একদমই জ্বালায় না কারন তিয়ার মা গত ৭ বছর আগেই মারা গেছে।
— ও সরি। আমি জানতাম না।
— আরে ঠিক আছে। যাই হোক, তিয়া কিন্তু খুব মিষ্টি মেয়ে।
— হুমম আচ্ছা আসি আর যদি একদিন সময় হয় তাহলে আমাদের বাসায় যাবেন।
— হুমম যাবো।

এভাবে দিন গুলো ভালই চলছিল। একবার তিয়ার মোটামোটি জ্বর আসে তাই আমি ওরে স্কুলে যেতে দেই নি আর আমিও অফিস যাই নি। দুপুরে তিয়া ঘুমাচ্ছিল আর আমি তিয়ার মাথার পাশে বসে ছিলাম। হঠাৎ কলিং বেলটা বেজেঁ উঠলো। কাজের মহিলা রান্না ঘরে তাই আমি দরজা খুলতে গেলাম। দরজা খুলে দেখি নিতা মেডাম আছে….

— আরে মেডাম আপনি। আসুন ভিতরে আসুন।
— আসলে তিয়া তো আজ স্কুলে যাই নি আর শুনলাম আপনি নাকি স্কুলে ফোন দিয়ে বলে দিছেন তিয়ার জ্বর আসছে তাই আসতে পারবে না।তাই অফিস থেকে আপনার বাসার ঠিকানা নিয়ে তিয়াকে দেখতে চলে আসলাম।
— ও আসুন। তিয়া এখন ঘুমাচ্ছে।

তিয়া ঘুমাচ্ছে বলে ওর মেডাম আর ওকে ডাক দেয় নি।তিয়ার মেডাম চলে যেতে চাইলে আমি ওনাকে দুপুরে খেয়ে যাওয়ার জন্য জোর করি তাই ওনি আর না করতে পারে নি।আস্তে আস্তে ওনার সাথে কথা গুলো বাড়তে লাগলো। তিয়ার মেডাম নিত্তিয়ার গল্পটা শুনতে চাওয়ার কারনে আমিও বললাম। তখন আমি ওনাকে বললাম..

— মেডাম নিত্তিয়ার গল্প তো আপনি শুনলেন। আপনার জীবনের কোন গল্প নেই।
— না আপনার মত স্পেশাল কিছু গল্প নেই তবে ২ বছর আগে পারিবারিক ভাবে আমার বিয়ে হয়। আমি কখনো মা হতে পারবো না এটা গোপন রেখে আমার বাবা আমায় বিয়ে দেয়। কিন্তু আমি ফুলশয্যার রাতে ছেলেকে সব বলে দেই। সেই রাতেই ছেলে আমাকে ওর রুম থেকে বার করে দেয় আর সকালেই আবার আমায় আমাদের বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।তারপর আমাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। এরপর নিজের যোগ্যতায় এই শিক্ষকতার কাজ বেছেঁ নেই। সন্তান জন্ম দিতে পারবো না বলে কি হয়েছে? এখন তো স্কুলের প্রতিটা ছাত্রছাত্রীর মা তো আমি।

— হুমম বুঝলাম কিন্তু আপনার স্বামী আপনার সাথে ঠিক ব্যবহার করে নি।
— বাদ দেন তো আমার কথা।

আমাদের কথার মাঝে তিয়া এসে হাজির। তিয়া ওর নিতা মেডাম কে দেখে তো খুশিতে লাফাতে শুরু করেছে। যেন ওর জ্বরই নেই শরীরে। এরপর নিতা মেডামই তিয়াকে ফ্রেশ করতে নিয়ে গেল। আমি, তিয়া আর নিতা মেডাম বসে খাচ্ছিলাম। আমি একাই খাচ্ছিলাম তবে তিয়াকে ওর মেডাম খাইয়ে দিচ্ছিল। খুব ভালই লাগছিল দেখতে। হঠাৎ তিয়া একটা কথা বলে উঠলো যেন আমি নিজেই লজ্জায় পরে গেলাম।

— বাবা নিতা মেডাম না খুব ভাল। আমি ওনাকে মা বলে ডাকবো।
— না মামনি ওনি রাগ করবো। তখন নিতা মেডামের কথায় আরেকটু চমকে উঠলাম….
— না তিয়া তুমি ডাকতে পারো মা বলে।

আমি এখানে আর কথা বলি নি। কারন তিয়াকে অনেক দিন পর এতো খুশি হতে দেখছি। তাছাড়া তিয়ারও একটা মা দরকার। আমি নিত্তিয়ার কথা ভেবে কখনো বিয়ে করার কথা ভাবি নি। যদি অন্য কোন মেয়ে এসে আমার তিয়াকে দেখতে না পারে। কিন্তু যদি কেউ তিয়াকে ভালবেসে আমার পরিবারে আসে তাহলে আর কোন অাপত্তি নেই।নিত্তিয়ার ভালবাসার জায়গা তো আর কেউ নিতে পারবে না। এরপর খাওয়া দাওয়া শেষ নিতা মেডামকে একটা রিকশা করে দিয়ে আসলাম।

ইদানিং তিয়ার বায়না যেন বেড়েই চলছে ওর নিতা মেডামকে নিয়ে। আজ সকালে তিয়া বলল “নিতা মেডাম কেন আমায় রেডি করতে আসে না।মেডামকে আমি আমার মায়ের মত দেখতে চাই।” খুব জোরও করছিল তাই ওরে একটা বকা দিয়ে ছিলাম। তারপর অফিসে যাওয়ার পথে ওরে স্কুলে নামিয়ে নিয়ে চলে আসি । দুপুরে তিয়াকে নিতে ওর স্কুলে আসলাম। আর দেখি তিয়া চুপ করে বসে আছে আর নিতা মেডাম ওর রাগ ভাঙ্গাচ্ছে। আমাকে দেখে নিতা মেডাম যেন রেগে উঠলো।

— একটা বাচ্চা শিশুকে কাদিঁয়ে লাভ টা কি হে?
— আসলে…
— আসলে আবার কি? এখন যদি বায়না না করে তাহলে কবে করবো?
— তিয়া আপনাকে ওর মায়ের মত দেখতে চাইছিল।
— ( নিতা মেডাম আমার কথায় একটু চমকে গেল?) কিছুক্ষন যেন নিরবতা চলতে লাগলো। তখন নিতা মেডাম বলে উঠলো…
— তিয়ার আবদার চাইলে আপনি সত্যি করতে পারেন।

বলেই মেডাম চলে গেল আর আমি হা করে দাড়িয়ে রইলাম। সারাটা রাত নিতা মেডামের কথাটা ভাবতে লাগলাম। ভুল করবো না ঠিক করবো। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পরলাম খেয়াল ছিল না।সকালে ঘুম থেকে উঠেই তিয়াকে বললাম…

— তিয়া মামনি আজ তোমার পছন্দ মত একটা জামা পরে নাও। আমরা ঘুরতে যাবো।
— কেন স্কুলে যাবো না?
— হুমম স্কুল হয়েই ঘুরতে যাবো।
— আচ্ছা।

তিয়া খুব খুশি হয়ে রেডি হতে লাগলো। আমি রেডি হয়ে নিলাম। তারপর খাওয়া দাওয়া করে স্কুলের জন্য বেড়িয়ে পড়লাম। স্কুলের এসে বললাম…

— তিয়া আমি একটা রিকশা নিচ্ছি। তুমি তোমার নিতা মেডামকে বলো আমি ডাকছি। তিয়াও চলে গেল ওর মেডামকে ডাকতে। কিছুক্ষনে মাঝে তিয়া ওর মেডাম নিয়ে এসে হাজির। আমার সামনে এসে ওর মেডাম চুপ করে আছে….

— তিয়া তোমার মেডামকে বলো রিকশায় জায়গা আছে চাইলে উঠতে পারে। আর কোন কথা না বলে তিয়ার মেডাম উঠে বসলো আর তিয়াকে কোলে নিয়ে বসলো। তখন নিতা মেডাম বলল..
— তিয়া তোমার বাবাকে বলো তো আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?
— তিয়া তোমার মেডামকে বলে দাও ওনাকে পার্মানেন্ট তিয়ার মা বানাতে আমরা রেজিস্ট্রি অফিসে যাচ্ছি।
— তিয়া তোমার বাবাকে বলো এখানে যাওয়ার আগে আমার পারমিশন নিয়ে ছিল কি না? আমি কিছুর বলার আগে নিতার একটা হাত শক্ত করে ধরে বললাম।
— তিয়া ওনাকে বলো যদি ইচ্ছা না থাকে তাহলে যেন নেমে যায়। নিতার আর কোন কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে হেসেঁ দিলো। আর আমিও নতুন দিনের স্বপ্ন দেখতে লাগলাম।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত