মধুর এক প্রেমকাহিনি

মধুর এক প্রেমকাহিনি

ইংরেজের কলকাতা তখন বেশ সরগরম। মনে হচ্ছে বাংলার একটা নতুন ইতিহাস তৈরি হতে চলেছে। অতীতের যাবতীয় শাসক ও শাসন ঘটিত অশান্তির অবসান ঘটেছে। বর্গিদের হাঙ্গামা বাগে এসেছে। ফাঁসুড়ে ও ঠেঙাড়েরা ইংরেজ দাপটে জব্দ। তিনটি বিভাজন–সুতানুটি, কলকাতা ও গোবিন্দপুর আর নেই। এখন শুধুই কলকাতা ইংরেজের রাজধানী। কলকাতার যুবকরা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন। তাঁদের মানসিকতায় দ্রুত পরিবর্তন আসছে। প্রাচীনপন্থীদের দ্বারা অনুসৃত হিন্দুধর্ম তাঁদের সহ্য হচ্ছে না। শুধু শিক্ষা নয়, ধর্ম নিয়েও একটা দাপাদাপি শুরু হয়েছে। আদি ভট্টপল্লির কট্টর ব্রাহ্মণরা বলতে শুরু করেছেন–ফিরিঙ্গিদের সংস্পর্শে এসে উচ্ছন্নে যাওয়া কটা ছোঁড়া আমাদের ধর্মের পিণ্ডি চটকে দেবে দেখছি। পাদরিও এসে গেছেন। গির্জায় চলছে যিশুর ভজনা। আর চেষ্টা চলছে হিন্দুদের কীভাবে খ্রিস্টান করা যায়।

বাঙালির প্রথম সারির কয়েকজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন গুণী মানুষ জাতির জাগরণে অগ্রণী হয়েছেন। রাজনৈতিক স্বাধীনতা হারালেও মনে প্রাণে দাস হতে বাঙালি যে রাজি নয় তা তাঁরা প্রতিপন্ন করবেন। বাহুবলে শাসন দখল করলেও আমাদের মনোবলের কাছে তোমরা পরাজিত হবে। তোমরা সভ্য হওয়ার বহু আগেই হিন্দুরা সর্ব অর্থে সুসভ্য হয়েছে। আমাদের ধর্ম, আমাদের সংস্কৃত ভাষা, আমাদের দর্শন তোমাদের এমন কিছু দিতে পারে যা তোমাদের কোনও কালে ছিল না। সভ্যতার সংজ্ঞা আমাদের কাছেই জানতে হবে। সুপ্রাচীন কাল থেকে আমাদের ওপর দিয়ে বিদেশি আক্রমণের যে ঝড় বয়ে গেছে তার ফলে আমরা কোণঠাসা। আত্মরক্ষার জন্য এমন কিছু সংস্কার তৈরি করতে হয়েছে যা হয়তো কুসংস্কার। নারী স্বাধীনতা আমরা হরণ করতে চাইনি, বিদেশি লালসার হাত থেকে সুরক্ষার জন্য তাঁদের অন্তঃপুরে থাকার নিরাপদ ব্যবস্থা করতে হয়েছে।

জাগরণের কালের যুবকদের এইটিই হল প্রধান আক্রমণের স্থল। এর জন্য অপরিণত বুদ্ধিই হয়তো দায়ী। এই শতাব্দীতে, এই কলকাতা এমন একজন তরুণ শিক্ষককে পেয়েছিলেন। যাঁর সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা তৈরি হয়েছিল। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ তাঁকে ভালো চোখে

দেখলেও তিনি এই ইতিহাসের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও জাতিতে ফিরিঙ্গি। তাঁর শরীরে বিদেশি রক্ত। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর ভারতে তাঁর মতো স্বদেশপ্রেমিক ভারতীয় আর কে ছিলেন! একমাত্র ডিরোজিও বলতে পারেন,

স্বদেশ আমার, কিবা জ্যোতির মণ্ডলী
ভূষিত ললাট তব; অস্ত গেছে চলি
সেদিন তোমার হায়, সেই দিন-যবে
দেবতা সমান পূজ্য ছিলে এই ভবে।
কোথায় সে ব্যপদ! মহিমা কোথায়!
গগনবিহারী পক্ষী ভূমিতে লুটায়।

এই ডিরোজিওকে ঘিরে গড়ে উঠল শক্তিশালী এক যুবাগোষ্ঠী–ইয়ং বেঙ্গল। এই দলে যাঁরা ছিলেন পরবর্তীকালে তাঁদের সকলের নামের আগেই একটি করে বিশেষণ যুক্ত হয়েছে। যেমন, সত্যের উপাসক জ্ঞানবীর আচার্য কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, ভারতের ডিমস্থিনিস রামগোপাল ঘোষ। বঙ্গদেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রবর্তনের পুরোহিত, অদ্বিতীয় রাজনীতিক রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধিশালী রাজা দিগম্বর মিত্র, অকৃত্রিম সাহিত্যসেবক অদ্ভুতকর্মা প্যারীচাঁদ মিত্র, পরহিব্রত সাধু শিবচন্দ্র দেব, মনীষী রসিক কৃষ্ণ মল্লিক, নিষ্কলঙ্ক চরিত্র রামতনু লাহিড়ী। উনবিংশ শতাব্দীতে পরপর এতগুলি আলোকস্তম্ভ। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে একই সঙ্গে আলোকপাত। তাঁদের মধ্যে থেকে আমাদের সামনে একজন এসে দাঁড়াবেন, তিনি ইতিহাসের নায়ক রাজা দক্ষিণারঞ্জন।

এইবার যেতে হবে দূর অতীতে। দুটি পরিবার একটি পরিবার ভট্টপল্লির মুখোপাধ্যায় বংশ, আর একটি কলকাতার গোপীমোহন ঠাকুরের বংশ। দুটি পরিবারের মধ্যে বৈবাহিক আদানপ্রদান হতে পারে না, কিন্তু হয়েছিল অতি নাটকীয় পরিস্থিতিতে। অনেকটা সেকালের উপন্যাসের মতো। পাত্রকে ধরে এনে প্রায় বন্দি করে কন্যা সম্প্রদান। মুখোপাধ্যায় বংশের পাত্র সম্রান্ত কুলীন আর ঠাকুর বংশ হল পিরালি। অর্থাৎ কোনও সময়ে, কোনও কারণে সামাজিকভাবে তাঁরা তাঁদের জাতি খুইয়েছিলেন। কোনও অপরাধ, সে অপরাধ স্লেচ্ছসংসর্গও হতে পারে। বল্লাল সেন যে কুল তালিকা ও মেল তৈরি করেছিলেন সেখানে পরবর্তীকালে দুটি বিভাজন ঘটেছিল। একটি হল, বিশুদ্ধ কুলীন, অন্যটি হল ভঙ্গ কুলীন। দ্বিতীয় বিভাজনটি একটু অদ্ভুত। এটি নেতিবাচক। কুল হারালেও কুলীন। সেই সময় বিশুদ্ধ কুল বজায় রাখা সম্ভব হত না। কারণ সমাজ জীবন তখন প্রসারিত হচ্ছে। বিদেশি সংমিশ্রণ ঘটছে, বিদেশি সংস্কৃতি ঢুকছে।

কলকাতায় স্বতন্ত্র একটি ইতিহাস তৈরি করে গেছেন ঠাকুর পরিবার। একদিকে পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর বংশ আর একদিকে জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবার। এই পরিবারকে জগৎ বিখ্যাত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। শুরুতে দুই ঠাকুর পরিবারই অর্থবিত্তে সমান ছিলেন। ঠাকুররা কলকাতায় এসেছিলেন যশোহর থেকে। তাঁদের আদি পুরুষ ভট্টনারায়ণ। আদিশূর কান্যকুজ থেকে যেসব ব্রাহ্মণদের এনেছিলেন তাঁদের মধ্যে ভট্টনারায়ণের পূর্বপুরুষরাও ছিলেন। ধাপে ধাপে নেমে এসেছেন। এই অবরোহণে এসে দাঁড়ালেন পঞ্চানন। তিনিই প্রথম ঠাকুর পদবি গ্রহণ করে কলকাতায় গোবিন্দপুরে এলেন। তাঁরই পুত্র জয়রাম। ইংরেজরা গোবিন্দপুর ফোর্ট তৈরি করবেন। জয়রামকে ইংরেজরা জায়গা দিলেন পাথুরিয়াঘাটাতে। ঠাকুর পরিবার তখনও দুই শাখাতে বিভক্ত হয়নি। জয়রামের চার পুত্র আনন্দীরাম, নীলমণি, দর্পনারায়ণ আর গোবিন্দরাম। একসময় নীলমণি পৃথক হয়ে সরে গেলেন জোড়াসাঁকোতে। অতিবিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সূত্রপাত এইখানেই। অধস্তন চতুর্থ পুরুষে এলেন রবীন্দ্রনাথ। দর্পনারায়ণ সেকালের এক অতি সমৃদ্ধশালী ব্যক্তি–চন্দননগরের ফরাসি সরকারের প্রতাপশালী দেওয়ান। তাঁরই সুযোগ্য পুত্র গোপীমোহন।

গোপীমোহন ঠাকুরের বিশাল বংশ। তাঁর ছয় পুত্র-সূর্যকুমার, চন্দ্রকুমার, নন্দকুমার, কালীকুমার, হরকুমার ও সুবিখ্যাত প্রসন্নকুমার ঠাকুর (সি.এস.আই)। দক্ষিণারঞ্জনের জন্য আমরা গোপীমোহন ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র সূর্যকুমারেই থাকব। তাঁর দুই কন্যা। ত্রিপুরাসুন্দরী ও শ্যামাসুন্দরী। গোপীমোহন ঠাকুরের ছয়পুত্রের কথা বলা হলেও তাঁর একটি কন্যা ছিল। নাম রেখেছিলেন ব্রহ্মময়ী। এখন গোপীমোহন সম্পর্কে আরও বলার আছে। তিনি শুধু ধনী ছিলেন না। অতি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। শুধু ধনী নন তাঁকে বলা হত ধনকুবের, আবার দানবীর। তিনি ছিলেন শক্তিসাধক। সেইখানেই এলেন এক কন্যা, নাম রাখলেন ব্রহ্মময়ী–মা এসেছেন, সেই চোখেই তিনি কন্যাকে দেখতেন। স্বভাবতই পিতার সমস্ত স্নেহ কন্যার ওপর আরোপিত হল। যখন পূজায় বসতেন তখন ধ্যানদৃষ্টিতে আজ্ঞাচক্রে যে মুখটি ফুটে উঠত, সেই মুখটি কন্যা ব্রহ্মময়ীর। তিনি বলতেন আমি বিশ্বজননীকে বলেছিলুম, তুমি কন্যারূপে আমার কাছে এসো। ব্রহ্মময়ীকেই তিনি অলংকারে ভূষিত করে মা কালীকেই প্রত্যক্ষ করতেন। প্রাসাদের সর্বত্র নূপুর পায়ে ঝমঝম করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গৃহে আনন্দের হিল্লোল তুলছেন। সকলেই তাঁকে চোখে চোখে রাখতেন। সকলেই জানতেন তিনি জ্যান্ত মা।

গোপীমোহন নিজে পণ্ডিত মানুষ। তিনটি ভাষায় সমান পারদর্শী সংস্কৃত, ফারসি ও উর্দু। ইংরেজিও জানতেন। ফরাসি ও পর্তুগিজ ভাষাও শিখেছিলেন। মহাসমারোহে তাঁর বাড়িতে যে দুর্গাপুজো হত, আকারে প্রকারে তার কোনও তুলনা ছিল না। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান স্বীকৃত। দেশীয় শিল্প ও সাহিত্যের উন্নতির দিকে তাঁর বিশেষ দৃষ্টি ছিল। তিনি নিজে সংগীত অনুরাগী ছিলেন। যেসব বিশিষ্ট শিল্পীর সেবা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন–কালি মির্জা (কালীদাস মুখোপাধ্যায়), ল-কে কানা (লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাস), অঞ্জু খাঁ, লালা কেবল কিষণ। তিনি নিজে সুন্দর গান লিখতেন। নিজের বংশ সম্পর্কে তাঁর অত্যন্ত অভিমান ছিল। কোনওরকম তুচ্ছতাচ্ছিল্য সহ্য করতে পারতেন না। সেই মজার কলকাতায় বড়লোকদের মধ্যে অদ্ভুত অদ্ভুত সব চরিত্র ছিল। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন রাজা। রাজকৃষ্ণ। শোভাবাজারের মহারাজা রাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের পুত্র। হিন্দু ধর্মে তাঁর কোনও আস্থা ছিল না। হিন্দু আচার-ব্যবহার প্রকাশ্যে পদদলিত করে এক মুসলমান রমণীর সঙ্গে থাকতেন। সহবাসই বলা চলে। মুসলমান বাবুর্চি তাঁর আহারাদি প্রস্তুত করতেন। মুসলমানরাই তাঁর সভাসদ ও সহচর ছিলেন। মুসলমান কবিদের দিয়ে মহরমের গান রচনা করাতেন। প্রচুর খরচ করে মহরমে মিছিল বের করতেন। আর সেই শোভাযাত্রার একেবারে সামনে তিনি স্থান গ্রহণ করে ধার্মিক মুসলমানদের মতো বুক চাপড়াতে চাপড়াতে পদব্রজে শহর ভ্রমণ করতেন। আসল কথা কোনও ধর্মেই তাঁর বিশ্বাস ছিল না। মুসলমানরা ভাবতেন রাজা রাজকৃষ্ণ আমাদেরই সমাজের একজন। কিন্তু হিন্দুরা এই উচ্চবংশীয় ধনী মানুষটিকে ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন না। সেই সময়কার হিন্দু দলপতিরা রাজা রাজকৃষ্ণকে হিন্দু। পৰ্বাদির উৎসবে সাদরে নিমন্ত্রণ করতেন। রাজকৃষ্ণ উপেক্ষা করতেন না। এইবার সেই কথাটি গোপীমোহনের বংশঅভিমান, তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে হিন্দু পর্বের একটি শোভাযাত্রা চলেছে জাঁকজমকে ভরা। রাজা রাজকৃষ্ণও রয়েছেন। গোপীমোহন বারান্দায় বসে দেখছিলেন। থাকতে না পেরে রাজকৃষ্ণকে জিগ্যেস করলেন, রাজা আপনি কোন। দলের। কখনও দেখি হিন্দুর মিছিলে, কখনও আবার মুসলমানের। রাজা রাজকৃষ্ণ একটি চিমটি কাটা উত্তর দিলেন যাতে লুকিয়ে আছে গ্লানিসূচক একটি ভাব। অর্থাৎ তুমি তো পিরালি। রাজা হাসতে হাসতে বলছেন, সত্যিই তাই, আমাকে দু-দলেই দেখতে পাবেন। কিন্তু আপনি কোন দলে। কোনও দলেই তো আপনাকে দেখতে পাই না। আহত গোপীমোহন তাঁর পৈতেটি তুলে রাজাকে দেখিয়ে সগৌরবে বললেন, আশ্চর্য নয় রাজা, কিছুমাত্র আশ্চর্য নয়, আমার স্থান যেখানে, অতটা উঁচুতে আপনি কখনওই উঠতে পারবেন না।

গোপীমোহন তাঁর বংশগৌরব সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতন ছিলেন। তিনি শুধু ধার্মিক ছিলেন না, সাধনভজন করতেন। সংগীতচর্চা করতেন। দান-ধ্যান ও সংগীতের পৃষ্ঠপোষণ করতেন। –এতগুলি গুণের ধারা একত্রিত হয়ে তাঁর বংশধরদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। এইটিই ঠাকুরদের বৈশিষ্ট্য। জোড়াসাঁকোয় যার বিকাশ হয়েছিল পুরোমাত্রায়।

গোপীমোহনের ঐতিহাসিক কীর্তি মূলাজোড়ে মা ব্রহ্মময়ী মন্দির। সেকালেই যত অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ড ঘটত। কোথায় কলকাতা আর কোথায় মূলাজোড়। আর মা কালী পেলেন। ব্রহ্মময়ী নাম। এর অন্তরালে অদ্ভুত এক ইতিহাস। গোপীমোহন তাঁর আদরের কন্যাটিকে সিংহাসনে বসিয়ে পূজা করতেন না। কন্যাটিকে রেখেছিলেন তাঁর ধ্যানে। এদিকে তাঁর খেলাধুলা ও লেখাপড়ার ব্যবস্থাও করেছিলেন। সেখানে কোনও ত্রুটি রাখেননি। পরিবারের সবাই অনুভব করেছিলেন ব্রহ্মময়ীর জন্মের পর থেকেই ঠাকুর পরিবারের যশ ও ঐশ্বর্য শতগুণ বেড়ে গেছে।

সেই সময় গৌরীদানের প্রথা ছিল। অল্পবয়সেই মেয়েদের পাত্রস্থ করা হত। স্ত্রী এবং স্বামীর বয়সের যথেষ্ট ফারাক থাকত। কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তির বিবাহের বয়স এবং পাত্রীর বয়সের একটি তালিকা পাওয়া গেছে। সকলেই সেইকালের বিখ্যাত ব্যক্তি। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর চোদ্দো বছর বয়সে বিবাহ করেছিলেন। স্ত্রীর বয়স ছিল ছয়। কেশবচন্দ্র সেন আঠারো। বছর বয়সে যাঁকে বিবাহ করলেন, তাঁর বয়স নয়। এগারো বছরের বঙ্কিমচন্দ্র বিবাহ করলেন পাঁচ বছরের এক বালিকাকে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স উনিশ, স্ত্রীর বয়স আট। ভূদেব মুখোপাধ্যায় মোলো বছর বয়সে এগারো বছরের এক বালিকাকে বিবাহ করলেন। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স সতেরো, পাত্রীর বয়স সাত। উনিশ বছরের নবীনচন্দ্র সেন দশ বছরের একটি কন্যাকে বিবাহ করলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর চোদ্দো, তাঁর স্ত্রীর বয়স আট। পনেরো বছরের অমৃতলাল বসু নয় বছরের এক বালিকাকে গ্রহণ করলেন।

ব্রহ্মময়ী আট বছরে পড়েছেন। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ গোপীমোহন শাস্ত্রবিধি লঙ্ঘন করতে পারবেন না। শাস্ত্রে বলছেন, অষ্টম বর্ষে ভবেৎ গৌরী। পাত্র নির্বাচন হয়ে গেল। বিবাহের দিনক্ষণ স্থির। গোপীমোহন শহরের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। তাঁর আদরের কন্যার বিবাহ সে এক রাজকীয় ব্যাপার। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, কাজের লোকে রাজবাড়ি উৎসব মুখর। আজ ব্রহ্মময়ীর বিবাহ। পুরনারীরা জল সইতে যাচ্ছেন গঙ্গায়। কন্যাটিকেও স্নান করাবেন। সেকালের নিয়মানুসারে ব্রহ্মময়ী চলেছেন সুসজ্জিত পালকিতে আহিরিটোলার ঘাটে। পালকি জলে নামানো হল। সেকালের প্রথা অনুসারে ব্রহ্মময়ী পালকিতে বসেই স্নান করবেন। সঙ্গে এসেছেন বিশাল এক নারী বাহিনী। শঙ্খধ্বনি, উলু, অন্যান্য বাদ্যবাজনায় ভরা গঙ্গার কূলে সে এক মহা উৎসব। কারও কোনওদিকে খেয়াল নেই। প্রচুর হুড়োহুড়ি, জল ছোঁড়াছুঁড়ি। গঙ্গা আলোড়িত। হঠাৎ দেখা গেল ব্রহ্মময়ী পালকিতে নেই। সকলের অজ্ঞাতসারে জলে তলিয়ে গেছেন। তখন জোয়ার এসেছে গঙ্গায়। স্রোত চলেছে উত্তরদিকে। কোথায় ব্রহ্মময়ী! নিমেষে আনন্দ উৎসব স্তব্ধ। মুহূর্তেই সেই দুঃসংবাদ পৌঁছে গেল ঠাকুরবাড়িতে। উৎসব মুখর বাড়িতে নেমে এল শ্মশানের নীরবতা। উদ্ধারকারীর দল গঙ্গা তোলপাড় করে ফেললেন। কোথাও পাওয়া গেল না ব্রহ্মময়ীকে। দিন শেষ, রাত নামল। এল আর একটি দিন। এমন সময় খবর এল বহুদূরে মূলাজোড়ের গঙ্গার বাঁকে ব্রহ্মময়ীর প্রাণহীন দেহ পাওয়া গেছে।

এই কন্যাটিই গোপীমোহনের প্রাণ ছিলেন। এক মুহূর্ত তাঁকে না দেখে থাকতে পারতেন না। কলকাতার সব মানুষই শোকস্তব্ধ। নিয়তির কী খেলা! গোপীমোহন সেই যে ঘরের দরজা বন্ধ করেছেন আর খোলানো যাচ্ছে না। আহার, নিদ্রা ত্যাগ। ভূমিতে শয্যা। সংকল্প করেছেন। জৈনরা যেমন করেন সেইভাবেই অন্নজল ত্যাগ করে প্রাণত্যাগ করবেন। একদিন গেল, দুদিন গেল, তিনদিনের দিন গভীর রাতে তাঁর অন্ধকার ঘরটি আলোয় বিচ্ছুরিত হল। ব্রহ্মময়ী দাঁড়িয়ে আছেন আলোর শরীর নিয়ে। অভিমান ভরে পিতাকে বলছেন, আমি তো তোমার কাছে থাকব বলেই এসেছিলাম, তুমিই আমাকে দূর করে দেওয়ার ব্যবস্থা করলে। তাই তো আমি পালিয়ে এসেছি। আমি কিন্তু তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না। আমি মূলাজোড়ের গঙ্গাতীরে পাষাণ মূর্তিতে অবস্থান করছি। তুমি আমাকে সেখানেই প্রতিষ্ঠা করো। আমি তোমার হয়েই থাকব।

গোপীমোহন অন্ধকারে আলোর দিশা পেলেন। তাঁকে স্বপ্ন দিয়েছেন। হঠাৎ বাঁচার উৎসাহ ফিরে এল। পরের দিনই তাঁর লোকজন নিয়ে সাত সকালেই বেরিয়ে পড়লেন মূলাজোড়ের উদ্দেশে। গঙ্গারতীরে জঙ্গলাকীর্ণ জনবসতিহীন নির্জন একটি স্থান। অনুসন্ধান করে সেইখানেই অতি অপূর্ব মূল্যবান কষ্টিপাথরে নির্মিত একটি বিগ্রহ পাওয়া গেল। বিস্ময়কর তাঁর রূপ।

মূলাজোড় স্থানটি অখ্যাত না বিখ্যাত! প্রাচীন ইতিহাস কী বলছে! বাংলার ইতিহাসে একটি অন্ধকার যুগ আছে। শুরু ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে। বকতিয়ার খিলজি নদিয়া দখল করলেন। সেই থেকে ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দুশো উননব্বই বছরকাল বাংলার ইতিহাসের এক অন্ধকারময় যুগ, গৌড়ের সিংহাসনে হুসেন শাহের রাজত্বকাল পর্যন্ত। এই ইতিহাসের অনেকটাই হারিয়ে গেছে। একটু একটু কোথাও পাওয়া যায়। কিন্তু কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তা বলা শক্ত। একটি সত্য পাওয়া যায় যা অস্বীকার করার উপায় নেই–সর্বস্তরে নিরবচ্ছিন্ন অকাল। লুণ্ঠন, পীড়ন, নরহত্যা, নারী নির্যাতন, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার, এসব প্রতিদিনের ঘটনা। রাজশক্তি তাকিয়েও দেখত না। কারণ তাদের নিজেদের অবস্থাও শোচনীয়। সেখানে সন্দেহ, অবিশ্বাস, ষড়যন্ত্র, বিদ্রোহ, গুপ্তহত্যা–সিংহাসনে নিশ্চিন্তে বসে থাকাটাই অসম্ভব। এই সময়কালের মধ্যে বাহান্ন জন রাজা গৌড়বঙ্গ শাসন করার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের মধ্যে ঊনত্রিশ জন সিংহাসনে বসেছেন আর নেমেছেন। কখনও। কয়েকদিন, কখনও বড়জোর চার বছর। আঠারো জন মরেছেন গুপ্ত ঘাতকের হাতে। পৃথিবীর ইতিহাসে যানজিরবিহীন। একথা মোগল সম্রাট বাবরের।

নবদ্বীপেই প্রথম আঘাত, আর এই নবদ্বীপেই প্রথম জাগরণ। ১৪৮৬ সালের ফাগুন পূর্ণিমা। আবির্ভূত হলেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য। আলো হাতে এসে দাঁড়ালেন এক অমেয় পুরুষ সিংহ। শক্তির একটা তরঙ্গ খেলে গেল। ১৫১০ সালে তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করে মানুষের কল্যাণে। নিজেকে উৎসর্গ করলেন। এরপর তাঁকে আর পাওয়া গেল না। শ্রীক্ষেত্রের সাধন জগতে নিজেকে বিলীন করে দিলেন। কিন্তু রয়ে গেল যে তরঙ্গ তিনি তুলেছিলেন সর্বক্ষেত্রে তার অভিঘাত। মহাপ্রভু গৌরবঙ্গ ত্যাগ করলেন, আর মাত্র সাত বছর পরেই শুরু হল আর এক সংকটের কাল। এবার বিদেশিদের হামলা। তারা সবাই বণিক, প্রথমে পর্তুগিজ। শুরু হল তাদের অবাধ বাণিজ্য। ১৫৭০ সালে সরস্বতী নদী বেগ হারাল। সপ্তগ্রামের ঐশ্বর্য ও বোলবোলা শেষ হল। এইবার হুগলি। পর্তুগিজরা এখানে জমিয়ে বসতে চাইল। স্বভাবে তারা হার্মাদ জলদস্যু। স্থায়ী কোনও পরিকল্পনা ছিল না। বাইরে তারা বণিক, অন্তরালে তারা দস্যু। এদের লুণ্ঠন ও উৎপীড়নে বাংলার ছোট ছোট গ্রামে দেখা দিল আতঙ্ক। জাহাজ বোঝাই নরনারী ও শিশু ইউরোপের বাজারে পাঠাতে লাগল ক্রীতদাস করে। নারীহরণ। এদের নিত্যকর্ম। প্রায় একশোটা বছর এইভাবেই কাটল। বাংলা হল শ্মশান। সেই সময় ভাগীরথীর দুই তীরে হুগলি থেকে দক্ষিণের শেষ মাথা পর্যন্ত বৃহৎ বন্দর ও বন্দরকেন্দ্রিক জনপদ ছাড়া গোটা অঞ্চলটাই ছিল জনশূন্য অরণ্য। ত্রাতা হিসাবে দেখা দিলেন মোগল। সম্রাট শাহজাহান। ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দ। তিনি পর্তুগিজদের নির্মূল করলেন। ১৬৫০ইংরেজ বণিকদের আবির্ভাব। আবার হুগলি, সেখানেই তাদের কুঠি স্থাপিত হল।

বড় ইতিহাসের আড়ালে ছোট ছোট ইতিহাসও থাকে। মূলাজোড়ের কথা বলতে গিয়ে এসব প্রসঙ্গ আসছে কেন? কারণ একটাই, কোনও ঘটনা বিচ্ছিন্নভাবে একক থাকতে পারে না। গোপীমোহন ব্রহ্মময়ীর নির্দেশে মূলাজোড়ে মন্দির স্থাপন করবেন। অনেকটা জায়গা চাই। নদীর বাঁকে বিগ্রহটি বসেছিলেন ইঙ্গিত বহন করে। এই সেই স্থান। স্থান কোথায়! এ তো জলা আর জঙ্গল। ত্রিসীমানায় কোনও মানুষ নেই। এর চেয়ে শ্মশান যে ছিল ভালো।

অতীত ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যায়, এই মূলাজোড় স্থানটি একসময় বিরাট কুখ্যাত জঙ্গলের একটি দিক। জঙ্গলটির নাম জয়চণ্ডীর জঙ্গল। তৎকালীন সীমানা ছিল এইরকম–উত্তরে প্রাচীন নদী বন্দর নবহট্ট, এখন যার নাম নৈহাটি। দক্ষিণে বর্তমানের বারাকপুর পর্যন্ত। এই জঙ্গলেরই বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে ছিল বর্তির বিল। দীর্ঘকাল ধরে এই জঙ্গলে আচার অনাচার উভয়ই চলছিল পুরোদমে। একদিকে কাঁপালিক আর অঘোরীদের হাড়হিম করা যত কাণ্ডকারখানা, আর অন্যদিকে কুখ্যাত সব ডাকাতের দল। এই উভয় সম্প্রদায়েরই লোক সমাজে বিচরণের কোনও সম্ভাবনা ছিল না। এই কাঁপালিকরা নরবলি দিতেন আর ডাকাতরা ডাকাতির আগে এই নরবলিতে উৎসাহ দিত। এই ধারা থেকেই মা কালীর আর একটি রূপ প্রকাশিত হল–ডাকাত কালী। এই অরণ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী জয়চণ্ডী। সেই কারণেই বলা হত জয়চণ্ডীর জঙ্গল। এই দেবী কাঁপালিক ও ডাকাতদের দ্বারা পূজিত হতেন। গঙ্গার তীরে অবস্থান, তীরে বাঁধা থাকত দ্রুতগামী ছিপ। ডাকাতদের বাহন। গঙ্গার বুকে ডাকাতি করে নোয়াই খাল অথবা মুক্তাপুরের খাল ধরে এই অরণ্যে এসে আত্মগোপন করে থাকত। প্রয়োজন হলে জলপথেই পালাত।

হুসেন শাহের রাজত্বকালে দেশে শাসন ব্যবস্থার উন্নতি হল। পলাশির যুদ্ধের পর শুরু হল প্রকৃত সুশাসন। কাঁপালিক, অঘোরী, ডাকাত সব উধাও। জয়চণ্ডীর জঙ্গল ক্রমশ ছোট হতে লাগল। চারপাশে শুরু হল সাধারণ মানুষের বসবাস। ডাকাত আর কাঁপালিকরা পালাবার সময় অষ্ঠধাতু নির্মিত মা জয়চণ্ডীর মূর্তিটি বিলের জলে বিসর্জন দিয়ে চলে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে সেই মূর্তি উদ্ধার করে মন্দিরে স্থাপিত হয়। বহু মানুষের বিশ্বাস এই দেবী জাগ্রত, মানুষের কল্যাণসাধন করেন। চতুর্দিক থেকে মানুষ আসেন উৎসবে শামিল হতে। জয়চণ্ডীর মন্দির নৈহাটির একটি প্রসিদ্ধ স্থান।

গঙ্গা নদীর বাঁকে যেখানে ব্রহ্মময়ীকে পাওয়া গেল, মন্দিরটি সেই জায়গায় হবে। হবে না হতেই হবে। জঙ্গলাকীর্ণ কিন্তু এর তো একজন অধিকারী থাকবেন! সেই সময়টা তো জমিদারদের কাল। জানা গেল এই অঞ্চলটি বিখ্যাত ভূস্বামী রামদেব নাগের বংশধরদের মৌজাভক্ত। বর্ধমান রাজার দেওয়ান রামদেব নাগ প্রজাপীড়নের জন্য বিখ্যাত। এই রামদেবের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েছিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র। তিনি বর্ধমান মহারাজকে তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন। লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায় কবিতাতে। শিরোনাম নাগাস্টক। এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। যথারীতি গোপীমোহন রামদেবের বংশধরদের কাছ থেকে কোনওরকম সাহায্য পেলেন না। জঙ্গলই হোক আর যাইহোক, জমি আপনাকে দেওয়া হবে না। আমাদের সম্পত্তি আমাদেরই থাকবে। বিষণ্ণ গোপীমোহন রাতে তাঁর কন্যাকে নিবেদন করলেন, মা, তুই বললি ওইখানে মন্দির করতে, ওরা যে জায়গা দিচ্ছে না। অবশেষে বহু অনুনয়, বিনয়ের পর জমি পেলেন। কী আনন্দ! চতুর্দিকে জঙ্গল। উলুখাগড়ার বন। আধুনিক দস্যু-তস্করও আছে। অজস্র সাপ। পাল পাল শেয়াল। জোয়ারের সময় চুঁইয়ে চুঁইয়ে গঙ্গার জল ঢুকে জলাভূমির মতো করে রেখেছে। ভাগীরথীতে প্রথমে দিলেন বাঁধ। দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে যেমন পোস্তা তৈরি হয়েছিল ঠিক সেইরকম। তারপর প্রচুর মাটি ফেলে ঢালাই করে তৈরি হল মন্দিরের ভিত। অর্থের অভাব নেই। দক্ষ শিল্পী, কয়েক হাজার শ্রমিক হাজির করলেন সেই জায়গায়। গড়ে উঠল অতি সুন্দর নবরত্ন মন্দির। ১৮০৯ সাল। একটি পবিত্র দিনে মন্দিরের সিংহাসনে মহাসমারোহে আরোহণ করলেন দেবীব্ৰহ্মময়ী। গোপীমোহনের আদরিণী কন্যা, মহাশক্তিরূপিণী দেবী কালিকার রূপ ধারণ করলেন। কতদিন হয়ে গেল, আজও তিনি শত শত ভক্তের পূজা। পাচ্ছেন।

এতবড় মন্দির পশ্চিমবঙ্গে খুব কমই আছে। সমতল ভিত্তির ওপর স্থাপিত এই নবরত্ন মন্দিরটি। এর দুদিকে, এপাশে-ওপাশে ছটি, ছটি করে দ্বাদশ শিবমন্দির। দক্ষিণে প্রশস্ত অঙ্গনে তিনটি দেউল। তিনজন শিব। হর, শঙ্কর ও শিব। প্রত্যেক বছর পৌষমাসে আজও বসে বিরাট মেলা। সহস্র ভক্ত নরনারী জোড়ামুলো দিয়ে মাকে পুজো করেন। এখানেই শেষ নয়। মন্দিরের পেছনে রাধাকৃষ্ণ মন্দির ও আর একটি শিবদেউল। কালীমন্দিরের সামনে নাটমন্দির। তারপর বলিদানের স্থান। আর তারই নীচে গঙ্গার প্রবাহ।

মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর সভাকবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরকে মূলাজোড়ে বসবাসের জন্য গঙ্গার তীরে একটি স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, কবি, আপনার প্রতিভার পক্ষে গঙ্গাতীরবর্তী এই স্থানটি উপযুক্ত হবে। অদ্ভুত যোগাযোগ। অন্তরালে কার শক্তি! দুই রাজার সংগমে আর এক কলকাতার রাজা। বর্ধমানের মহারাজার দেওয়ান রামদেব নাগ মূলাজোড়ে জমিদারি পেলেন কীভাবে! এদিকটা তো মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জমিদারি? বর্গিরা তখন বাংলার ত্রাস। যা খুশি তাই করছে। ভয়ংকর এক আতঙ্ক। বর্ধমান তাদের টার্গেট। ওই পথেই পিল পিল করে ঢুকছে। সেই সময় বর্ধমানের মহারাজাধিরাজ তিলকচাঁদ রায়। বর্ধমান আর নিরাপদ নয়। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর বন্ধুস্থানীয়। কাউগাছি জায়গাটি কৃষ্ণচন্দ্রের খাস জমিদারিভুক্ত। বর্ধমানরাজ সেইখানে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করলেন।

ইতিহাসের কত কী বলার থাকে। নায়ক তো একজনই–কাল। আবার কাল শব্দটির আর এক অর্থ–অতীত। অনেক সুতো গোটানো লাটাই হাতে অদৃশ্য মহানায়ক বসে আছেন। সুতো ছেড়েই যাচ্ছেন, ছেড়েই যাচ্ছেন। একশো, দুশো, পাঁচশো বছর কিছুই নয়। এই। সেদিন। অতীত কলকাতার রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হত বঙ্গে বর্গি। সে কোন কাল?কত কাল?

১৭৪২ থেকে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দ। প্রায় দশ বছর স্থায়ী বিকট এক উৎপাত। বর্ধমানের মহারাজা তিলোকচাঁদ তাঁর রাজ্য ছাড়তে বাধ্য হলেন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের খাস পতিত জমিরই বিরাট একটা অংশ কাউগাছি। বেশ নিরাপদ। পশ্চিমে ভাগীরথী, পূর্ব দিকে ঘন জঙ্গল ঘেরা বর্তির বিল। দক্ষিণে একটি খাল–নোয়াই খাল, উত্তরে মুক্তাপুরের খাল। দুটি খালই ভাগীরথীর সঙ্গে সংযুক্ত। মূলাজোড়ের অধিবাসী রামদেব নাগ, জায়গাটির সন্ধান দিলেন। গড়ে উঠল বর্ধমান রাজের বিকল্প রাজধানী। অবশ্যই বিশাল ব্যাপার। হাতি, ঘোড়া, লোক-লস্কর, পাইক-বরকন্দাজ। স্থানটির চেহারা ফিরে গেল।

বর্ধমান রাজপরিবার চিরকালই শিক্ষা ও সংস্কৃতির অনুরাগী পৃষ্ঠপোষক। কাউগাছিতে এসেই রাজমহিষী কৃষ্ণকুমারী জানতে পারলেন, পাশেই মূলাজোড় গ্রাম, সেখানে বাস করছেন বিখ্যাত কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র। কৃষ্ণকুমারী আলোকিত রমণী, গুণী, ধর্মপ্রাণ। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্ৰ কবিকে ১৬ বিঘা জমি দান করেছিলেন! কৃষ্ণকুমারীর মনে হল লোক-লস্কর, অশ্ব গবাদি নিয়ে এই রাজপরিবারটি যেন কবির ঘাড়ে এক মহা উৎপাতের মতো এসে পড়েছে। কবির শান্তি নষ্ট করছে। ভারতচন্দ্র শুধু কবি নন, সাধক। তাঁকে আরও পরিসর দিতে হবে। তিনি যুগোত্তীর্ণ মানুষ। মহারানি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে একটি চিঠিতে অনুরোধ জানালেন, আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী। কথা আছে। জরুরি কথা। ভদ্র কৃষ্ণচন্দ্র এলেন। কৃষ্ণকুমারী ভারতচন্দ্রের প্রসঙ্গ তুলে বললেন, মহারাজ! ১৬ বিঘা পরিসর তাঁর পক্ষে যথেষ্ট নয়। আমরা পাশে এসে পড়ায় উৎপাত বেড়েছে। মূলাজোড় গ্রামটি আমাকে পত্তনি দিন। কৃষ্ণচন্দ্র খানিক চিন্তার পর বললেন, বেশ, ওই ষোলো বিঘা বাদ দিয়ে। আরও আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হল, কৃষ্ণচন্দ্র আনারপুরের গুস্তেগ্রামে কবিকে ১২১ বিঘা নিষ্কর ভূমি দান করবেন। কৃষ্ণকুমারী তখন নিজের নামে নয় তাঁদের অমাত্য রামদেব নাগের বেনামে পত্তনি পাট্টা সম্পাদন। করলেন। এই কাহিনিতে রামদেবের প্রবেশ এইভাবে। রাজারাজড়ার ব্যাপার। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়; আবার রাজায় রাজায় অনেক ভালো কাজও হয়।

বর্ধমানের অস্থায়ী রাজধানী এক সময় আবার বর্ধমান ফিরে গেল। গোপীমোহন নির্মাণ করলেন কাঙ্ক্ষিত দেবালয়। মূলাজোড়ে শুরু হল আর এক ইতিহাস। ভট্টপল্লির পরেই মূলাজোড় হল সংস্কৃতচর্চার কেন্দ্র। গোপীমোহন স্থাপন করলেন সংস্কৃত কলেজ, গ্রন্থাগার, দাঁতব্য চিকিৎসালয়। সংস্কৃত কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ভট্টপল্লির প্রখ্যাত নৈয়ায়িক শিবরাম সার্বভৌম। তাঁকে ঘিরে গড়ে উঠল এক মহামণ্ডলী। ন্যায়শাস্ত্রের এই ধারা বিখ্যাত হল মূলাজোড় সম্প্রদায় নামে।

ভট্টপল্লির নাম কয়েকবার করা হল। কোনও অদৃশ্য শক্তি কী ভট্টপল্লির এক নিষ্ঠাবান পরিবারকে পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবারের দিকে ঠেলছে? হয়তো তাই! ভাটপাড়ার এক প্রাচীন মুখোপাধ্যায় বংশ। কৌলীন্যে তাঁরা ফুলের মুখুটি। ভরদ্বাজ গোত্র। শ্রীহর্ষের বংশ, ফুলেমেল। বহুঁকাল আগে ভাটপাড়ায় বসতি স্থাপন করেছিলেন গঙ্গাধর ঠাকুর। পরপর একাধিক পুরুষ–গঙ্গাধর, রামভদ্র, শুকদেব, হৃদয়রাম, ভবানীশঙ্কর, ভৈরবচন্দ্র। ভৈরবচন্দ্রে স্থির হব। তাঁর সন্তান পরমানন্দ। অন্য নাম জগন্মোহন। ভৈরবচন্দ্রইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। হিজলিকাঁথির লবণকুঠির সদর আমিন ছিলেন। এই জীবিকায় কোম্পানির আমলে বড়লোক হওয়ার অনেক সুযোগ ছিল। ভৈরবচন্দ্র তাই হলেন। অর্থের সঙ্গে সামাজিক প্রতিপত্তিও আসে। পার্সি ভাষায় তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। লোকে রসিকতা করে বলতেন, মৌলবি মুখুজ্যে। তিনি কিন্তু অত্যন্ত নিষ্ঠাবান হিন্দু ছিলেন। তাঁর জীবনকালে মুখুজ্যেবংশের কুলভঙ্গ হয়নি। যা হল সব তাঁর মৃত্যুর পরে।

ভৈরবচন্দ্রের পুত্র পরমানন্দ রূপবান এক যুবক। অন্যদিকে গোপীমোহন ঠাকুরের বড়ছেলে সূর্যকুমার। তাঁর দুই মেয়ে ত্রিপুরাসুন্দরী ও শ্যামাসুন্দরী। ঠাকুর পরিবারে নিয়ম ছিল সত্বংশে স্বাস্থ্যবান, রূপবান ছেলের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দেওয়া। পরমানন্দের এক কাকা কলকাতায় যেতেন তাঁর কাজকর্মের জন্য। সেখানেই তাঁর বেশিরভাগ সময় থাকা। ঠাকুর পরিবারে তাঁর যাতায়াত ছিল। সূর্যকুমার একদিন পরমানন্দের খুল্লতাতকে বললেন, বড়মেয়ের বিয়ে দেব। সংশের সুচরিত্র ও সুপুরুষ একটি পাত্রের সন্ধান দিতে পারলে তোমাকে আমি পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দেব। পরমানন্দের খুড়ো সঙ্গে সঙ্গে একটি পরিকল্পনা ঠিক করে ফেললেন। পাঁচ হাজার টাকা কী কম কথা! আর পাত্র তাঁর চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাঁর নাম পরমানন্দ। সমস্যা একটাই, তাঁর বিধবা জননী এই বিবাহ কিছুতেই সমর্থন করবেন না। কারণ কুলমর্যাদার হানি হবে। ঠিক আছে! কৌশল করতে। হবে। পরমানন্দের মাকে তিনি বললেন, কলকাতায় পার্বণ উপলক্ষে কালীঘাটে মহাসমারোহ হবে। পূজা-হোম-আমোদ-প্রমোদ। আমার খুব ইচ্ছে পরমানন্দকে একবার দেখিয়ে আনি। পরমানন্দের মা অতি সরল, তাঁর কোনও সন্দেহই হল না। তিনি বললেন, বেশ তো। খুড়োমশাই পরমানন্দকে নিয়ে সোজা চলে গেলেন সূর্যকুমারের বাড়িতে। বললেন, এই নিন পাত্র। পাঁচ হাজার টাকা পকেটে পুরে তিনি বিদায় নিলেন। সেকালের জমিদাররা যেভাবে জোর করে বিয়ে দিতেন সেই পদ্ধতিই শুরু হল। সেইদিনেই গায়ে হলুদ। বালক পরমানন্দ ভয়ে কাঁদতে শুরু করেছেন। সূর্যকুমার বহু মূল্য অলংকারাদি দিয়ে পরমানন্দকে ভুলিয়ে রাখলেন। সেই সন্ধ্যায় তড়িঘড়ি পরমানন্দের বিবাহ হল ত্রিপুরাসুন্দরীর সঙ্গে। যথাসময়ে পরমানন্দের আত্মীয়স্বজনরা সব জানতে পারলেন। ভাটপাড়া থেকে তাঁদের চলে আসতে হল কলকাতায়। ইতিমধ্যে ঠাকুর পরিবারের জাঁকজমক, ঐশ্বর্য, আদর-আপ্যায়নে তাঁরা মোহিত। পরমানন্দ হলেন কলকাতার ঠাকুর পরিবারের ঘরজামাই।

কলকাতায় তাঁর নাম হল জগন্মোহন। পরমানন্দ আর কেউ বললেন না। নাম পরিবর্তনের ব্যাপারটাও খুব মজার। সেকালে এই ঠাকুর পরিবারের নিয়ম ছিল বাড়ির জামাইয়ের নাম বাড়ির মেয়েদের পছন্দ না হলে তাঁরা তা পালটে দিতেন। পরমানন্দ নামটি মহিলাদের পছন্দ হয়নি। তাঁর স্ত্রী স্বামীর নাম বলতে গিয়ে ভীষণ অস্বস্তি বোধ করতেন। পরমানন্দের মধ্যে পরমান্ন শব্দটি খুঁজে পাওয়া যায়। স্বামীর নাম উচ্চারণ করা অত্যন্ত দোষের। অতএব পরমান্ন বলা যায় না, নাম পালটাও। অতি সুন্দর পুরুষ পরমানন্দ, নাম রাখা হল জগন্মোহন।

অনেক পরে এই পরিবারের একটি মামলায় আলিপুর কোর্টে সাক্ষ্য দিতে উঠেছিলেন মহারাজা স্যার যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর। তিনি গোপীমোহন ঠাকুরের পঞ্চম পুত্র হরকুমার ঠাকুরের সন্তান। সাক্ষ্যদানকালে তিনি বলেছিলেন, আমার জ্যাঠামশাইয়ের নাম সূর্যকুমার ঠাকুর। আমি শুনেছি যাঁর নাম পরমানন্দ তাঁরই পরিবর্তিত নাম জগন্মোহন। জগন্মোহনের পিতার নাম ভৈরবচন্দ্রমুখুজ্যে। জগন্মোহনের ভাই ছিল কি না জানি না! তিনি বিবাহের আগে উচ্চবর্ণের কুলীন ব্রাহ্মণ ছিলেন। আমাদের ফ্যামিলির নিয়ম ছিল যে, ভালো কুলীন দেখে বিবাহ দেওয়া। ভৈরবচন্দ্রের সঙ্গে আগে আমাদের কোনও কুটুম্বিতা ছিল না। এই বিবাহে প্রথম হল। আমাদের ঠাকুরদার ফ্যামিলিতে নিয়ম ছিল, ভালো কুলীনের ছেলে এনে। আমাদের ফ্যামিলিতে বিবাহ দেওয়া এবং ভালো করে প্রভিশন করে দেওয়া। জগন্মোহনের সময় এইরকমই হয়েছিল। আমার পিতামহ গোপীমোহন ঠাকুর জীবিত থাকার সময় এই বিবাহ হয়।

পরমানন্দের দুর্গাদাস নামে এক ভ্রাতা ছিলেন। খড়দহের বিখ্যাত গোস্বামী বংশেবিবাহ করে সেখানেই বাস করতেন। পরমানন্দ সংস্কৃত ও ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। দুটি ভাষার গ্রন্থই পাঠ করতেন। লেখাপড়াতেই সমস্ত জীবন অতিবাহিত করেন। অসাধারণ সুন্দর হাতের লেখা। পুঁথি লিখতেন।

সূর্যকুমারের কোনও পুত্রসন্তান হয়নি। দুটি কন্যা। পরমানন্দ প্রথমে ত্রিপুরাসুন্দরীকে বিবাহ করেছিলেন। সন্তান দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়। কালে এই দক্ষিণারঞ্জনই হয়ে উঠবেন ইতিহাস বিখ্যাত এক মানুষ। সূর্যকুমার অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন। একটি সওদাগরি ব্যাংকের প্রধান অংশীদার। পরিচালনার কাজে যথেষ্ট সাহায্য করতেন। পিতা গোপীমোহনের সমস্ত জমিদারির তত্বাবধান করতেন। এক ইউরোপীয়, নাম স্মিথ, একটি ডক ইয়ার্ড নির্মাণ করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। স্মিথ সাহেব একটি সমবায় স্থাপন করে গোপীমোহনের সাহায্য চান। তিনি প্রচুর অর্থ সেখানে বিনিয়োগ করেন। সূর্যকুমার এই সমবায়ের বেনিয়ান নিযুক্ত হন। পুরো পরিকল্পনাটাই ভেস্তে গেল। গোপীমোহনের সমস্ত টাকা জলে। সূর্যকুমার খুব অল্প বয়েসে মারা যান। মাত্র ত্রিশ বছর। ত্রিপুরাসুন্দরী পরমাসুন্দরী ছিলেন। তাঁর অনেক গুণ ছিল। দুর্ভাগ্য এই দক্ষিণারঞ্জনের জন্মের অল্পকাল পরেই তিনি মারা গেলেন। একেবারে শৈশবেই মাতৃহীন। পরমানন্দ সূর্যকুমারের দ্বিতীয় কন্যাশ্যামাসুন্দরীকে বিবাহ করলেন। শ্যামাসুন্দরীর স্নেহ ও যত্নে দক্ষিণারঞ্জনের কোনও সময়েই মনে হয়নি যে তাঁর মা নেই। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভেই চারটি সন্তান কালিকারঞ্জন, বিশ্বরঞ্জন, নিরঞ্জন, সর্বরঞ্জন।

এই কাহিনির নায়ক দক্ষিণারঞ্জন। কলকাতার বিখ্যাত রাজবাড়িতে যিনি বড় হচ্ছেন। পিতা জগন্মোহন জানতেন ইংরেজের ভারতে ইংরেজি না শিখলে ভবিষ্যতে কিছুই করা যাবে না। দক্ষিণারঞ্জন ভরতি হলেন হেয়ার সাহেবের স্কুলে। প্রাথমিক শিক্ষা এখানেই হল। এরপর হিন্দু কলেজ। ইংরেজরা এদেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন করেননি। করেছিলেন কয়েকজন দূরদর্শী হিন্দু। কলকাতার কয়েকজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির দান ও আন্তরিক চেষ্টায়, সর্বোপরি ডেভিড হেয়ার ও স্যার হাইড-এর সহযোগিতায় স্থাপিত হয়েছিল হিন্দু কলেজ। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে। এ দেশীয় যাঁরা এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন মহারাজা স্যার

যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, হরকুমার ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র। অন্যান্য যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন। বর্ধমানের রাজা তেজচন্দ্র বাহাদুর, গোপীমোহন ঠাকুর, কালীপ্রসন্ন সিংহের পিতামহ জয়কৃষ্ণ সিংহ, স্যার রাধাকান্ত দেব বাহাদুরের পিতা গোপীমোহন দেব, আর গঙ্গানারায়ণ দাস। রাজা তেজচন্দ্র বাহাদুর ও দক্ষিণারঞ্জনের খুল্লমাতামহ চন্দ্রকুমার ঠাকুর হিন্দু কলেজে প্রথম গভর্নর হিসেবে নির্বাচিত হন। কার্যনির্বাহক সমিতির সদস্য হলেন গোপীমোহন দেব, জয়কৃষ্ণ সিংহ ও গঙ্গানারায়ণ দাস। জাস্টিস অনুকূল মুখোঁপাধ্যায়ের পিতা বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় প্রথম। সম্পাদক। পরিদর্শক হিসাবে নিযুক্ত হলেন ডেভিড হেয়ার ও ডাক্তার হোরেস হেম্যান উইলসন।

দক্ষিণারঞ্জনের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, অসাধারণ মেধা আর অদ্ভুত অধ্যবসায়। শিক্ষকরা বিস্মিত হতেন। এই ছেলেটিকে হেয়ার সাহেব পুত্ৰাধিক স্নেহ করতেন। ডাক্তার উইলসনও তাঁর প্রশংসা করতেন। বিখ্যাত কৃষ্ণদাস পাল, বাগ্মী, স্বদেশহিতৈষী রামগোপাল ঘোষের জীবনচরিতে স্বীকার করেছেন নীচের ক্লাসে পড়ার সময় দক্ষিণারঞ্জন ও রামগোপাল ইংরেজিতে এতটাই পারদর্শী হয়েছিলেন যে প্রবন্ধ লিখতেন। আর ডাক্তার উইলসন সেইসব লেখা ওপরের ক্লাসের ছাত্রদের দেখিয়ে বলতেন, পড়ে দেখো, তোমাদের চেয়ে নীচের ক্লাসের দুই ছাত্র কী অসাধারণ লিখেছে। তোমরা এদের ধারে কাছে যেতে পারবে কি! দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে যাঁরা পড়তেন পরবর্তীকালে তাঁরাও বিখ্যাত হয়েছিলেন। যেমন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, রামগোপাল ঘোষের কথা তো বলাই হয়েছে। রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রামতনু। লাহিড়ি, রাধানাথ শিকদার। তাঁদের মধ্যে অনন্য ছিলেন দক্ষিণারঞ্জন। পরবর্তী জীবনে সেই পরিচয় পাওয়া যাবে।

দক্ষিণারঞ্জন হিন্দু কলেজে। আর সেখানে একজন অসাধারণ শিক্ষক–হেনরি লুই ভিভিয়ান। ডিরোজিও। তাঁর শিক্ষা প্রণালী ছিল অতি বিচিত্র। ছাত্রদের ওপর অসামান্য প্রভাব। বয়সে তিনি তরুণ, কিন্তু প্রতিভায় বিচ্ছুরিত। ডিরোজিও মনে করতেন, শুধু ভাষায় পারদর্শী হলে হবে না, বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে হবে। মেধার সঙ্গে হৃদয়ের যোগ ঘটাতে হবে। ছাত্রদের বলতেন, ভাবতে শেখো। এই দেশ প্রাচীন সংকীর্ণতা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। এই অন্ধকার থেকে বেরোতে হবে। ডিরোজিও মনস্তত্ব ও নীতিশাস্ত্রে উন্নত ছিলেন। ছাত্রদের এই দুটি বিষয়ে জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করতেন। ধৈর্য অসাধারণ। ছাত্রদের নিয়েই পড়ে থাকতেন।

সেই সব ইউরোপীয় দার্শনিকদের কথা বেশি করে বলতেন যাঁদের চিন্তায় মানুষই প্রাধান্য পেত। এইসব দার্শনিক হলেন লক, রিড, স্টুয়ার্ট ব্রাউন প্রমুখ। ছাত্রদের তিনি পর্যবেক্ষণ শক্তি বাড়াতে বলেছিলেন। উৎসাহ দিতেন ডিবেটে। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অন্যান্য বই পড়তে বলতেন। সুযোগ পেলেই নিজের বাড়িতে বা অন্য জায়গায় তর্কসভার আয়োজন করে ছাত্রদের নিয়ে বসতেন। ছাত্ররাই ছিলেন তাঁর ধ্যান ও জ্ঞান। নিজে ছিলেন কবি। দীর্ঘ একটি কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন–

অৰ্দ্ধস্ফুট পুষ্পদল সম, ধীরে ধীরে হয় বিকশিত
তোমাদের সুকুমার চিত, হেরি আমি উৎসুক নয়নে;
মানসিক শক্তিচয় যেন ছিল মন্ত্রমূর্হিত শয়নে,
সুবৰ্ণ–শলাকা–স্পর্শে এবে ক্রমে ক্রমে হয় উদ্বোধিতা।

ডিরোজিওর শিক্ষাপ্রণালী এতটাই অভিনব ছিল যে, গতানুগতিক শিক্ষকরা ধরতেই পারতেন না কী হচ্ছে। হিন্দু কলেজের শিক্ষকদের প্রতিমাসে প্রধান শিক্ষকের কাছে ছাত্রদের প্রগ্রেস রিপোর্ট জমা দিতে হত। ডিরোজিও এই ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন না। পুঁথিগত বিদ্যার চেয়ে ছাত্রদের আত্মবিকাশের দিকেই তাঁর নজর ছিল। সেই সময় প্রধান শিক্ষক ছিলেন ডি. আনসেলম। ডিরোজিওর রিপোর্ট তাঁর পছন্দ হত না। একবার তিনি এতটাই রেগে উঠলেন যে, ডিরোজিওকে প্রহার করার জন্য হাত ওঠালেন! ডিরোজিও পিছনে সরে গিয়ে সেই আঘাত থেকে নিজেকে বাঁচান। তাঁকে ঘিরে একটি ছাত্র গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। তাঁরা ধর্ম ও সমাজ সংস্কারে সচেষ্ট হলেন।

ডিরোজিও একটি ছাত্রসভা স্থাপন করেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন, অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন। দক্ষিণারঞ্জন এই সভার সভ্য ছিলেন। ডিরোজিওর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন আর-এক বিদেশি–হেয়ার সাহেব। এই হেয়ার সাহেব দক্ষিণারঞ্জনকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। সাহেবের সংবর্ধনার জন্য ডিরোজিওর ছাত্ররা উৎসাহী হলেন। শিক্ষা বিস্তারে তাঁর অনন্য প্রচেষ্টা সকলের মুখে মুখে। মাধবচন্দ্রমল্লিক তাঁর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে একটি পরামর্শ সভা আহ্বান করলেন। আলোচনার বিষয়–ডেভিড হেয়ারের সংবর্ধনা। দুটি সভা হল। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ ২৮ নভেম্বর প্রথম সভা। উপস্থিত ছিলেন কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৮৩১ সালের ৩০ জানুয়ারি দ্বিতীয় সভা। সভাপতি রসিককৃষ্ণ মল্লিক। দুটি সভাতেই বক্তৃতা করলেন কৃষ্ণমোহন, রসিককৃষ্ণ, দক্ষিণারঞ্জন, রাধানাথ শিকদার প্রমুখ কয়েকজন। সিদ্ধান্ত হল চাঁদা করে হেয়ার সাহেবের একটি তৈল চিত্র আঁকা ও সেই ছবি প্রতিষ্ঠিত হবে উপযুক্ত স্থানে।

১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ ১৭ ফেব্রুয়ারি। ডেভিড হেয়ারের জন্মদিন। হেয়ার স্কুলে তাঁর সংবর্ধনা। দক্ষিণারঞ্জনের নেতৃত্বে হেয়ারের অসংখ্য ছাত্র সেই সভায় মিলিত হলেন। সুন্দর একটি অভিনন্দন পত্র পাঠ করে তাঁর হাতে দেওয়া হল। দক্ষিণারঞ্জন অসাধারণ একটি বক্তৃতা দিলেন। এই বক্তৃতাতেই হেয়ার সম্পর্কে তাঁর বিখ্যাত উক্তি–আপনি আমাদিগকে জননীর ন্যায় স্তন্য দিয়াছেন।হেয়ার সাহেব মাথাটি ধীর ভাবে নাড়তে নাড়তে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন। দক্ষিণারঞ্জনের চেষ্টায় চিত্রকর চার্লস পোট ডেভিড হেয়ারের সুন্দর একটি তৈলচিত্র সযত্নে আঁকলেন। ছবিটি হেয়ার স্কুলে আছে। ওই ছবির পাশে একটি বালকের প্রতিকৃতি। বালকটি আর কেউ নন, তাঁর প্রিয়তম শিষ্য দক্ষিণারঞ্জন।

ডিরোজিও তখন হিন্দু সমাজের পক্ষে ভয়ংকর এক সমস্যা। তিনি যে সভা স্থাপন করেছিলেন সেই সভায় ধর্ম ও সমাজ সংস্কার নিয়ে অগ্নিগর্ভ সব আলোচনা হত। প্রথম সারির সদস্যরা, কৃষ্ণমোহন, রামগোপাল, দক্ষিণারঞ্জন আর রসিককৃষ্ণ। তাঁরাই প্রধানত আলোচনা করতেন। সমাজের কয়েকজন বিশিষ্ট ক্ষমতাবান ব্যক্তিও আসতেন–তদানীন্তন চিফ জাস্টিস স্যার এডওয়ার্ড রায়ান, লর্ড উইলিয়ামস বেন্টিঙ্কের প্রাইভেট সেক্রেটারি কর্নেল বেনসন, কর্নেল বিটসন, পরে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হয়েছিলেন, বিশপ কলেজের অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ডরু এইচ মিল। তাঁরা এসে তরুণদের উৎসাহ দিতেন। তরুণরা অতি উৎসাহের ফলে হিন্দুধর্মের প্রতি ভয়ংকর অবজ্ঞা ও অশালীন আচরণ করতে শুরু করলেন। পারলে শাস্ত্র ও শাস্ত্রবিধিকে প্রকাশ্যে লাথি মারবেন, এইরকম একটা উচ্ছঙ্খলতা।

পাদরিরা দেখলেন, এই হল খ্রিস্টধর্ম ঢোকাবার সুবর্ণ সুযোগ। উঠে পড়ে লেগে গেলেন ডাক্তার ডফ ও আর্চ ডিকন ডিয়্যালট্রি। তাঁরাও অতি উৎসাহে ধর্মপ্রচারকদের বলতেন, কলেজের পাশেই সকাল, সন্ধ্যা পথসভা করে হিন্দুধর্মকে গালাগাল দাও আর খ্রিস্টধর্মের জয়গান করো, একদিকে ডিরোজিওর ছেলেরা ও অন্যদিকে পাদরিরা। খেলা খুব জমে উঠল।

পাদরিদের হিন্দুধর্ম-বিদ্বেষ ডিরোজিওর শিষ্যদেরও গ্রাস করল। ঘৃণার ওপর ঘৃণা–যেন ডবল ডোজ। তাঁদের আচার-আচরণে ভয়ংকর রকমের একটা উগ্রতা দেখা দিল। যা অবশ্যই ছেলেমানুষির শামিল। যার একটি হল–নিষিদ্ধ মাংস চ্যালেঞ্জ করে খাওয়া। এইরকম একটা জটিল সময়ে দক্ষিণারঞ্জন হিন্দু কলেজের পাঠ সমাপ্ত করলেন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন। মায়ের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রায় দেড় লক্ষ টাকার সম্পত্তির অধিকারী হয়েছেন। অর্থের প্রতি অবশ্য তাঁর কোনও আসক্তি ছিল না। স্বদেশ কল্যাণে মুক্ত হস্তে দান করতেন। মাথায় ছিল একটি স্বদেশি সংবাদপত্রের প্রয়োজন। যার মাধ্যমে জাতির জাগরণ ঘটানো যেতে পারে। কুসংস্কার মুক্ত একটি ধর্মের পক্ষে প্রচার জোরদার করা যায়। তিনি নিজেই প্রকাশ করলেন একটি সাপ্তাহিক পত্র, নাম জ্ঞানান্বেষণ। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে এই পত্রিকার প্রথম প্রকাশ। প্রায় তেরো বছর ধরে শিক্ষিত হিন্দু ছাত্রদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরিত হয়েছিল। সম্পাদক ছিলেন দুজন। দক্ষিণারঞ্জন ও রসিককৃষ্ণ মল্লিক। তেরো বছরের সময়কালে পালা করে এক-একজন সম্পাদক হয়েছিলেন–যেমন প্যারীচাঁদ মিত্র, তারিণী বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, রামচন্দ্র মিত্র ও হরমোহন চট্টোপাধ্যায়। সুপণ্ডিত গোবিন্দচন্দ্র বসাক মাঝে মাঝে প্রবন্ধ লিখতেন। প্রকাশের এক বছর পরে পত্রিকাটি হল দ্বিভাষী–ইংরেজি ও বাংলা। এই কাগজে প্রায়ই হিন্দুধর্মকে নানাভাবে আক্রমণ করা হত। হিন্দুধর্মের কুসংস্কারই ছিল আঘাতের লক্ষ্য। দক্ষিণারঞ্জনের পিতা জগন্মোহন নিষ্ঠাবান গোঁড়া হিন্দু। তিনি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হলেন। পিতার সঙ্গে পুত্রের বাদানুবাদ। দক্ষিণারঞ্জন অভিমানে গৃহত্যাগ করলেন। কোথায় যাবেন! সার্কুলার রোডে গুরু ডিরোজিওর বাড়ির পাশে একটি বাড়ি ভাড়া করলেন। অর্থের তো অভাব নেই। দক্ষিণারঞ্জন পিতাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন, ভালোবাসতেন। বেশিদিন ছেড়ে থাকা সম্ভব হল না। পিতা-পুত্রের আবার মিলন ঘটল। এই সময় ডিরোজিও উইলসনকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিতে তাঁর প্রিয় ছাত্র দক্ষিণারঞ্জনের গৃহত্যাগের উল্লেখ আছে–দুই থেকে তিন মাস আগে দক্ষিণারঞ্জন আমাকে বলল, তার পিতার ব্যবহার ও আচরণ অসহ্য হয়ে উঠেছে। কিছুতেই সমর্থন করা যাচ্ছে না। অতএব বাড়ি ছাড়তেই হবে। আমি জানতুম কী ঘটেছে। এও জানতুম সে সত্য কথা বলছে। কিন্তু আমি বলেছিলুম, তোমার গৃহত্যাগ আমি সমর্থন করি না। পিতার ব্যবহার যাই হোক না, সন্তানের সহ্য করা উচিত। তোমার প্রতিবাদ ও আচরণ জগৎ সমর্থন করবে না। তিনি তো তোমাকে চলে যেতে। বলেননি। তুমি স্বেচ্ছায় তাঁকে পরিত্যাগ করবে কেন! মনে হয়েছিল দক্ষিণারঞ্জন আমার যুক্তি মানবে। দুঃখের বিষয় কিছু দিনের মধ্যেই সে ধৈর্য হারিয়ে যা ভেবেছিল তাই করল। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে সে গৃহত্যাগ করল। অবাক হয়ে দেখলুম, আমারই এলাকায় একটি বাড়ি ভাড়া করে উঠে এসেছে।

সময় শ্রেষ্ঠ নাট্যকার, সময়ই শ্রেষ্ঠ পরিচালক। এ মনে হয় অস্বীকার করা যায় না। মাধুর্যের নাম এমিলিয়া। ডিরোজিওর সুশিক্ষিতা, স্নেহময়ী বোন। ভাই আর বোনের ছোট্ট সংসার। এমিলিয়া যেন ডিরোজিওর মা। ভাইটিকে স্নেহ দিয়ে ঘিরে রেখেছেন। দক্ষিণারঞ্জনকেও ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন। একই পাড়ায় দক্ষিণারঞ্জন এসেছেন। যখন তখন ডিরোজিওর বাড়িতে তাঁর অবাধ যাতায়াত। এক ধরনের মানুষ থাকেন যাঁরা চিরকালই অন্যের ছিদ্র অনুসন্ধান করেন, কুৎসা রটান। সব যুগেই তাঁরা বহালতবিয়তে থাকেন। শহরে রাষ্ট্র হয়ে গেল দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে ডিরোজিও পরিবারের ঘনিষ্ঠতা দেখে মনে হচ্ছে, গোপীমোহন ঠাকুরের নাতি এইবার খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেন বলে। বড়লোক বাড়ির এইরকম একটি ছেলেকে পেলে পাদরিরা ধন্য হয়ে যাবেন। আর ওই এমিলিয়া, তাঁকেই বা বিশ্বাস কী! দুজনের এই ভালোবাসা প্রেমেরই নামান্তর। বিয়ে আসন্ন। এই কুৎসার কোনও ভিত্তি ছিল না। দক্ষিণারঞ্জন অনেক আগেই ডাক্তার ডফের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছিলেন। তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে কেউই অতটা কাছাকাছি যেতে পারেননি। ডফ সাহেব নিশ্চয়ই পারলে দক্ষিণারঞ্জনকে অনেক আগেই খ্রিস্টান করে দিতেন। আর এমিলিয়ার সঙ্গে বিবাহ? অনেক আগে ছাত্রাবস্থায় দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে হরচন্দ্র ঠাকুরের কন্যা জ্ঞানদাসুন্দরীর বিয়ে হয়ে গেছে। এমিলিয়া অত্যন্ত পবিত্র স্বভাবের মেয়ে ছিলেন। বিবাহিত দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে অবৈধ প্রেমের কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। স্বল্প পরমায়ুর ডিরোজিও আজীবন অবিবাহিত ছিলেন। বোন এমিলিয়া অনেক চেষ্টা করেছেন দাদাকে বিবাহে রাজি করাতে। একটি ইংরেজি কবিতায় ডিরোজিও এমিলিয়াকে লিখেছিলেন যে কথা তার কোনও তুলনা নেই। সেই কবিতায় এমিলিয়ার নির্মল চরিত্রের বর্ণনা আছে।

কলকাতার সমাজে এখন হিন্দু ধর্মের কয়েকজন গোঁড়া সমর্থক খুবই প্রবল। তাঁদের একজন হলেন কেশবচন্দ্র সেনের পিতামহ দেওয়ান রামকমল সেন। তিনিই উদ্যোগী হয়ে হিন্দু কলেজ থেকে ডিরোজিওকে সরাবার প্রস্তাব করেন। কলেজের হিন্দু অধ্যক্ষরা ডিরোজিওর নামে তিনটি অপবাদ এনেছিলেন। প্রথম হল–ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাস, দ্বিতীয়টি, পিতা মাতার প্রতি অবহেলা করতে ছাত্রদের শিক্ষা দেওয়া, তিন নম্বরটি খুবই সাংঘাতিক। ভ্রাতা। এবং ভগিনীর বিবাহ অনুমোদন করা। ডাক্তার উইলসন আগেভাগেই ডিরোজিওকে এই খবর দিলেন–তোমাকে ওরা অপসারিত করতে চাইছে। ডিরোজিওর আত্মসম্মান অত্যন্ত প্রবল। তিনি কারও পরোয়া করেন না। তাঁর জীবনে প্রতিফলিত করতে চাইছেন উচ্চ একটি আদর্শ। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ, ২০ এপ্রিল, একটি চিঠিতে ডিরোজিও নিজেই পদত্যাগ করলেন। তিনটি অপবাদ অস্বীকার করে উইলসনকেও একটি চিঠি লিখেছিলেন। ডিরোজিওর পদত্যাগে তাঁর ছাত্ররা বজ্রাহত। তাঁরা এই অনন্য শিক্ষকের, তাঁদের প্রাণের মানুষটির আরও কাছে সরে এলেন। এরপর তিনি যতদিন বেঁচেছিলেন, এই ছাত্রগোষ্ঠী নিয়মিত তাঁর কাছে যেতেন, তাঁর উপদেশ অনুসারেই জীবন গঠনের চেষ্টা করতেন। ১৮৩১ সাল, ডিরোজিওর জীবনের একটি ঘনায়মান কাল। ২৩ ডিসেম্বর মাত্র তেইশ বছর বয়সে ওলাওঠা রোগে পৃথিবী ছেড়ে তিনি চলে গেলেন। অসুস্থ অবস্থায় যাঁরা প্রাণ দিয়ে সেবা করেছিলেন তাঁদের একজন হলেন দক্ষিণারঞ্জন। ডিরোজিও শূন্য কলকাতা। দক্ষিণারঞ্জন এই সময়ে অতি উচ্চভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ধনী কিন্তু ভীষণ অমায়িক, পরোপকারী ও বন্ধুবৎসল। একটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক যেন। এই চরিত্রের পরিচয় ছড়িয়ে আছে তাঁর শৈশব জীবনের কয়েকটি ঘটনায়। একটি হল– দক্ষিণারঞ্জনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তারাচাঁদ চক্রবর্তী। তিনি একবার ব্যবসায় প্রচুর টাকা লোকসান করলেন। প্রচুর ঋণ। দক্ষিণারঞ্জন তখন কৈশোর অতিক্রম করতে চলেছেন। তাঁর কানে এল এই সংবাদ। সঙ্গে সঙ্গে নাম প্রকাশ না করে বন্ধুকে এক হাজার টাকা পাঠিয়ে দিলেন। বহুদিন পরে তারাচাঁদ যখন তাঁর উপকারীর নাম জানতে পারলেন তখন ঋণ স্বীকার করে ওই টাকাটি শোধ দেওয়ার ব্যবস্থা নিলেন। যুবক দক্ষিণারঞ্জন শুনলেন, হেয়ার সাহেব অর্থের প্রয়োজনে অত্যন্ত বিব্রত। সমাজসংস্কারে তিনি প্রায় নিঃস্ব। দক্ষিণারঞ্জন তাঁকে। অবিলম্বে ষাট হাজার টাকা ধার দিলেন। হেয়ার সাহেব যখন দেখলেন শোধ করার কোনও ক্ষমতাই তাঁর নেই অথচ এই প্রবল অস্বস্তি। দক্ষিণারঞ্জন তখন বললেন, ঠিক আছে, আপনি যা ভালো বোঝেন তাই করুন। হেয়ার সাহেব এক খণ্ড জমি দক্ষিণারঞ্জনকে লিখে দিলেন। যার মূল্য মাত্র আট হাজার টাকা। দক্ষিণারঞ্জন বললেন, সব শোধ। তৃতীয় ঘটনাটি আরও জটিল। এই ঘটনার নায়ক দক্ষিণারঞ্জনের বন্ধু কৃষ্ণমোহন। ডিরোজিওর শিক্ষায় তিনি কিছুটা বেসামাল। কৃষ্ণমোহনের বাড়ির উত্তর দিকের একটি বাড়িতে থাকতেন ভৈরবচন্দ্র ও শম্ভুচন্দ্র চক্রবর্তী। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। একদিন কৃষ্ণমোহন যখন বাড়িতে নেই সেই সময় তাঁর। কয়েকজন বন্ধু এসে হাজির। যথারীতি বৈঠকখানায় বসে তাঁরা সমাজসংস্কার বিষয়ে আলোচনা করতে করতে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। একজন চলে গেলেন মুসলমানের দোকানে। সেখান থেকে গোমাংসের তৈরি খাদ্য নিয়ে এলেন। কৃষ্ণমোহন তখন নেই। ঘরে বসে খাওয়া হল। এরপর উচ্ছিষ্ট অংশ প্রতিবেশী চক্রবর্তীদের বাড়ির দিকে ছুঁড়তে ছুঁড়তে চিৎকার করতে লাগলেন–ওই গো হাড়, ওই গো মাংস। শম্ভুবাবু তখন বাড়িতে ছিলেন। ভৈরববাবু ছিলেন না। শম্ভুবাবু প্রতিবাদ করলেন। কাজ হল না। তখন তিনি কয়েকজন প্রতিবেশীকে নিয়ে মার মার করে তেড়ে এলেন। যুবক দল ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে গেলেন। কৃষ্ণমোহনের দাদা ভুবনমোহন বাড়িতে আসা মাত্রই প্রতিবেশীদের নালিশ শুনলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি হুকুম দিলেন, কৃষ্ণমোহন এই বাড়িতে যেন আর না ঢোকে। প্রতিবেশীরা বলেছেন, কৃষ্ণমোহনকে না তাড়ালে তাঁরা বাড়ি ভেঙে দেবেন। ভাইকে তাড়াতে বাধ্য হলেন ভুবনমোহন। কৃষ্ণমোহন এসবের কিছুই জানেন না। বাড়ি ফেরা মাত্রই শুনলেন, এই বাড়িতে তাঁর কোনও স্থান নেই। কৃষ্ণমোহন যে ছিলেন না, তিনি কিছুই জানেন না–এসব কথা বলার প্রয়োজন বোধ করলেন না। তিনি নিঃশব্দে চিরবিদায় নিলেন।

পথে নামা মাত্রই উন্মত্ত হিন্দু প্রতিবেশীরা তাঁকে মারার জন্য এগিয়ে এলেন। কেউ কেউ বললেন, ব্যাটাকে শেষ করে দাও। কোনওক্রমে রেহাই পেলেও তিনি জানেন না কোথায় আশ্রয়। তাঁর কোনও হিন্দু আত্মীয়স্বজন দরজা খুলে দিলেন না। পাশে এসে দাঁড়ালেন দক্ষিণারঞ্জন। আশ্রয় দিলেন নিজের বাড়িতে। এই আগুনে ঘৃতাহুতি পড়ল। The persecuted নামে পাঁচ অঙ্কের একটি নাটক লিখে ছাপিয়ে চতুর্দিকে বিতরণ করলেন। কৃষ্ণমোহন। নাটকে আক্রমণের লক্ষ্য হিন্দুদের ধর্ম, আচার, আচরণ, ব্যবহার। ডাক্তার ডফ আসরে নামলেন। ইংরেজি প্রবাদ আছে Strike the iron while it is hot কৃষ্ণমোহনকে বোঝাতে লাগলেন তোমার হিন্দুধর্ম পৃথিবীর একটি নিকৃষ্ট ধর্ম, সে তো দেখতেই পেলে। দক্ষিণারঞ্জন না থাকলে কোন হিন্দু তোমাকে আশ্রয় দিতেন? পৃথিবীর সেরা ধর্ম খ্রিস্টধর্ম। শহরে ইতিমধ্যে রাষ্ট্র হয়ে গেছে কৃষ্ণমোহন ও তার প্রাণের বন্ধু দক্ষিণারঞ্জন আর কয়েকদিনের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করবে। কৃষ্ণমোহনের প্রচুর প্ররোচনা দক্ষিণারঞ্জনকে টলাতে পারল না। তিনি ডফের ফাঁদে পা দিলেন না। তাঁর নিজস্ব একটা অহংকার ছিল। তিনি হিন্দু–এই গর্ব তাঁকে পরিচালিত করত। তাঁর পিতার বংশ, তাঁর মাতামহের বংশ কত বড়।

কৃষ্ণমোহন দক্ষিণারঞ্জনের বাড়িতে আশ্রিত। বাজারে প্রবল গুজব। দক্ষিণারঞ্জনের নিষ্ঠাবান পিতা পূজা, আহ্নিক শেষ করে বাইরের বাটিতে আসছেন। এমন সময় কেউ একজন এসে বললেন, দক্ষিণারঞ্জনের হয়ে গেল। সবে ঠাকুরঘর থেকে পুজো শেষ করে বৈঠকখানায়। এসেছেন, এমন সময় এই সংবাদ। দেখলেন কৃষ্ণমোহন সামনে, দক্ষিণারঞ্জন সেইসময়। বাড়িতে ছিলেন না। পা থেকে খড়ম খুলে তিনি কৃষ্ণমোহনকে ছুঁড়ে মারলেন। শুধু তাই নয়, তিরস্কার করলেন, কিছু অশালীন কথাও বললেন। বাইরে দরজার দিকে আঙুল তুলে বললেন, এখনই বেরিয়ে যাও। অপমানিত কৃষ্ণমোহন সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় নামলেন। ইতিমধ্যে দক্ষিণারঞ্জন ফিরে এসেছেন। শুনলেন, বন্ধু কৃষ্ণমোহনকে যা তা বলে বাবা দূর করে দিয়েছেন, এমনকী খড়ম ছুঁড়ে মেরেছেন। মর্মাহত দক্ষিণারঞ্জন সঙ্গে সঙ্গে গৃহত্যাগ করলেন। তিনি অবশ্য পরে শান্ত হয়ে ফিরে এলেন। পিতার প্রতি তাঁর অগাধ ভক্তি ছিল। শান্ত জগন্মোহন, পড়ুয়া জগন্মোহন যদিও কিছু করতেন না কিন্তু এই রাজগৃহের নানা কোলাহলের মধ্যে তাঁকে থাকতে হত। তার ওপর সমাজের এই বিক্ষিপ্ত অবস্থা। তিনি নিজেই গৃহত্যাগ করে চলে গেলেন কাশীতে। আর ফেরেননি। সেইখানেই তাঁর জীবনাবসান হয়। কাশীতে থাকাকালে দক্ষিণারঞ্জন প্রায়ই বাবার কাছে যেতেন। কিছুদিন কাটিয়ে ফিরে আসতেন। কলকাতায়।

ইংরেজরা বেশ জাঁকিয়ে বসেছেন। ১৮৩৫ সাল। স্যার চার্লস মেটকাফ, পরে লর্ড হয়েছিলেন। তিনি ভারতীয়দের ফ্রিডম অফ প্রেস অনুমোদন করলেন। এটি একটি বিরাট প্রাপ্তি। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা। তিনি বললেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এলে, মানুষ সোচ্চারে তার মনের কথা বলবে। এতে তাঁর জন্মগত অধিকার। কোনও সরকার তা কেড়ে নিতে পারে না। জ্ঞানান্বেষণ-এর সম্পাদক দক্ষিণারঞ্জন মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতার কথা প্রায়ই ভাবতেন। কলকাতার বহু ইংরেজি ও দেশীয় ভাষার সংবাদপত্রের সম্পাদকগণ এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিরা টাউন হলে সমবেত হয়ে মেটকাফকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলেন। একটি অভিনন্দনপত্র প্রদান করলেন। সভায় দক্ষিণারঞ্জন একটি হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতা দিলেন। লন্ডনের Alexanders Magazine-এ একটি চিঠি প্রকাশিত হল। সেই চিঠিতে ছিল এই সভার কার্য বিবরণী। দক্ষিণারঞ্জনের বক্তৃতাটিও প্রকাশিত হয়েছিল। বক্তৃতার এক জায়গায় তিনি বলেছিলেন, Sir Charles Metcalfe certainly deserves all the thanks that we are able to bestow on him, and I concur with Mr. Turton, that the liberty we require is not limited but absolute liberty under responsibility. Let the offender be amenable to the Law, and if he deserve punishment, a court of justice is the tribunal to inflict it. I am sorry that we have some cause of complaints against Lord William Bentinck, for not having passed the proposal law. It was his duty according to his oath, if he thought the present law good, to enforce it, if not, to repeal it. The proposal law is well calculated to promote the benefit of the country; for no country so much needs a free press as that whose Government is despotic.

ডিরোজিও স্থাপন করেছিলেন, অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন। তাঁর মৃত্যুর পর সেটি অবলুপ্ত হল। এই ধরনের সংস্থার প্রয়োজনীয়তা সমাজের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খুবই আকাঙ্ক্ষিত। ডিরোজিওর বিশিষ্ট শিষ্যগণতারিণীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিড়ী, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ দে–এই পাঁচজন ১৮৩৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি একটি অনুষ্ঠানপত্র প্রকাশ করলেন। স্বাক্ষরকারীদের প্রস্তাব সবরকমের জ্ঞান লাভ করার জন্য দেশের বিভিন্ন অবস্থার তথ্য সংগ্রহের জন্য, প্রীতি বজায় রাখার জন্য স্থাপিত হল সোসাইটি ফর দি অ্যাকুইজিশন অফ জেনারেল নলেজ বা সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা। স্থাপিত হওয়ার প্রয়োজন আছে। সংস্কৃত কলেজের সম্পাদক রামকমল সেনের অনুমতি নিয়ে ১২ মার্চ কলেজের সভাকক্ষে সকলে সমবেত হলেন, ১৬ মে থেকে সভার কাজ শুরু হয়ে গেল। অধিবেশনের জন্য নির্দিষ্ট হল প্রতিমাসের দ্বিতীয় বুধবার। সভ্যরা তাঁদের ইচ্ছামতো চাঁদা। দিতে পারেন। কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। যাঁদের যাঁদের প্রবন্ধ পাঠ করতে বলা হবে তাঁরা যদি নির্দেশ পালন না করেন, সন্তোষজনক কারণ দেখাতে না পারেন তাহলে অর্থদণ্ড হবে। এই সভার পরিদর্শক হলেন ডেভিড হেয়ার। সম্পাদক হলেন দুই বিখ্যাত ব্যক্তি রামতনু। লাহিড়ী ও প্যারীচাঁদ মিত্র। দক্ষিণারঞ্জনের নাম কোনওভাবেই যুক্ত হল না। কারণ সেই। সময়ে তিনি কলকাতায় ছিলেন না। ফিরে আসার পর তিনি যোগদান করেন। পরে হয়ে। উঠলেন একজন প্রধান সভ্য। এইটাই স্বাভাবিক।

এই সময় দেশের রাজনীতিতে একটি চাঞ্চল্য আসছে। ভারতীয়রা ক্রমশই সচেতন হচ্ছেন। পরবর্তীকালে যা পরিণত হয় স্বাধীনতা আন্দোলনে। ১৮২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি ঘটনা ঘটল। প্রিন্স দ্বারকানাথ ইংল্যান্ড থেকে ফেরার সময় সঙ্গে নিয়ে এলেন বিখ্যাত বাগ্মী ও ভারত হিতৈষী, মহাত্মা জর্জ টমসনকে। জন্মেছিলেন দরিদ্র পরিবারে। নিজের অধ্যবসায় ও চেষ্টায় লেখাপড়া শিখলেন। ক্রমে হয়ে উঠলেন বিশ্বপ্রেমিক মহাপুরুষ। ইংল্যান্ড ও। আমেরিকার ক্রীতদাসপ্রথার বিরুদ্ধে শক্তিশালী আন্দোলন তিনি গড়ে তোলেন। দেশের দরিদ্র ও অত্যাচারিত জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শুরু করলেন। রাজা রামমোহন রায়ের বন্ধু রেভারেন্ড উইলিয়াম অ্যাডাম ইংল্যান্ডে স্থাপন করেছিলেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি। টমসন তার প্রধান সভ্য ছিলেন।

ভারতবর্ষে স্বদেশ ভাবনার সূত্রপাত হয়েছে। পাশ্চাত্য থেকে নানা ধরনের ভাব আসছে। সেদেশের মণীষীরা অন্য স্তরে চিন্তা শুরু করেছেন। যুদ্ধ-বিগ্রহ, রাজ্য দখল, কলোনি স্থাপন, হাজার হাজার মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খল পরিয়ে নিজেদের সুখবৃদ্ধি, মানুষের অন্তরে অধিষ্ঠিত দেবতাকে অস্বীকার করে পশুর মতো দেখা–এই একপেশে পৃথিবীর সমর্থন করছেন না। চিন্তাবিদরা। ভারতবর্ষে সেইসব ভাব ঢুকছে। বিভিন্ন দিকে একাধিক ভারতীয় ভারতমুক্তির কথা ভাবতে শুরু করেছেন। ভারত পরিক্রমা শেষ করে আর কয়েকদিন পরেই স্বামী বিবেকানন্দ যাবেন আমেরিকায়, ভারতের মহান আদর্শ, সভ্যতা ও আধ্যাত্মিকতার কথা মানুষকে জানাতে। তিনি পরদা ছিঁড়ে দেবেন। কয়েকবছর পরেই আসছেন সিস্টার নিবেদিতা, জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথ, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, ঋষি বঙ্কিম, শ্রীঅরবিন্দ, এই পটভূমিতে একে একে আত্মপ্রকাশ করবেন। সকলেরই উদ্দেশ্য ভারতের অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনা। রামমোহনের সুহৃদ দ্বারকানাথ কিছু কম যেতেন না। তিনিই নিয়ে এলেন চিন্তাবিদ টমসনকে। স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যাবে, বিদেশিদের ভূমিকা কিছু কম ছিল না। এই টমসন হলেন আদি ইন্ডোলজিস্ট। ভারতবর্ষ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা তাঁর উদ্দেশ্য হলেও এদেশের শিক্ষিত মানুষকে রাজনীতি সচেতন করার জন্য যথোচিত শিক্ষাও দিতে চান। ডিরোজিওর রেখে যাওয়া যুবক দলকে সব বিষয়েই অগ্রগণ্য মনে করা হত। তাঁরা অনেকটা এগিয়ে ভাবতে শিখেছেন। তাঁদের গুরুর শিক্ষা। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রভাবশালী সদস্য, ভারতবর্ষের প্রতি সহানুভূতিশীল টমসন। কলকাতায় এসেছেন। অকারণে আসেননি। শিক্ষিত তরুণ দলের সামনে একের পর এক অসাধারণ বক্তৃতার মাধ্যমে তাঁদের চনমনে করে তুলেছেন। শুধু ধর্ম, ধর্ম, ধর্ম ছাড়াও জাগরণের অন্য অনেক মার্গ আছে। সর্বাধিক প্রভাবিত হলেন, দক্ষিণারঞ্জন ও রামগোপাল ঘোষ। পরবর্তীকালে জনৈক গবেষক বলেছিলেন, ডিরোজিওর শিষ্যদের মধ্যে দক্ষিণারঞ্জনের মতো ব্রিলিয়ান্ট পলিটিশিয়ান আর কেউ ছিলেন না। এমনকী পলিটিক্যাল পাদরি কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা ভারতবর্ষের ডিমস্থিনিস রামগোপাল ঘোষও নন। ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়ার সম্পাদক মার্শম্যান তারাচাঁদ চক্রবর্তী প্রমুখ নব্য সংস্কারকদের। Chuckerburty faction নাম দিয়েছিলেন। জ্ঞানোপার্জিকা সভার অধিবেশনটি হিন্দু কলেজের একটি ঘরে হচ্ছিল। সেইসময় হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন ক্যাপ্টেন ডেভিড লেস্টার রিচার্ডসন। তিনি ছিলেন রক্ষণশীল টোরি দলভুক্ত। তিনি এই Chuckeburty faction-এর নব্য সংস্কার আন্দোলন ভালো চোখে দেখছিলেন না। এই সভার এক অধিবেশনে দক্ষিণারঞ্জন গবেষণামূলক একটি প্রবন্ধ পাঠ করলেন। বিষয়–Present condition of East India Companys Courts of judicature and police under the Bengal Presidency। এই বক্তৃতায় দক্ষিণারঞ্জন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসননীতির বেপরোয়া কিন্তু নিরপেক্ষ সমালোচনা করলেন। সভায় রিচার্ডসনও ছিলেন। বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর তিনি চিৎকার করে বললেন, I cannot convert the college into aden of treason। হিন্দু কলেজকে আমি কোনওভাবেই ষড়যন্ত্রকারীদের ডেরায় পরিণত করতে চাই না। সভার সদস্যরা রিচার্ডসনের এই কথায় অপমানিত বোধ করে মুহূর্তে সভা ত্যাগ করলেন। সভা করার জায়গার অভাব হল না। প্রথম শ্রীকৃষ্ণ সিংহের। বাগানবাড়িতে, তারপর বিখ্যাত ডাক্তার ডি গুপ্ত মহাশয়ের চেম্বারের দোতলায় ফৌজদারি বালাখানায়। দক্ষিণারঞ্জনের সেদিনের বক্তৃতা ইংরেজি সংবাদপত্রে ঝড় তুলেছিল। স্বাভাবিক! ইংরেজরা কেন সহ্য করবে। তাঁরা অত্যন্ত অভদ্র ভাষায় দক্ষিণারঞ্জনকে আক্রমণ করলেন। একজন সম্পাদক জেমস হিউম দক্ষিণারঞ্জনকে বললেন–Duck। কিন্তু বেঙ্গল হরকরা বক্তৃতাটি দুটি কিস্তিতে পুরোটাই ছাপল। সঙ্গে উচ্চ প্রশংসা, তারিখ, ১৮৪৩, ২ ও ৩ মার্চ।

হিন্দু কলেজ থেকে বিতাড়িত হলেও চক্রবর্তী মণ্ডলের উৎসাহে ভাটা পড়ল না বরং আরও উদগ্র হল। ফৌজদারি বালাখানায় টমসন একের পর এক জ্বালামুখী বক্তৃতার মাধ্যমে ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের জমি তৈরি করে দিচ্ছেন। ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়ার সম্পাদক মার্শম্যান লিখলেন, এখন দুদিকে কামানের গর্জন–পশ্চিম ভারতে বালাহিসারে আর কলকাতার ফৌজদারি বালাখানায়। সকলেই স্বীকার করবেন, আমাদের দেশের রাজনীতিক আন্দোলনের জন্মদাতা জর্জ টমসন। দিগম্বর মিত্রের ইংরাজি জীবনী লিখেছিলেন ভোলানাথ চন্দ্র। এক জায়গায় তিনি লিখছেন, ডেভিড হেয়ার যে ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন, জর্জ টমসন সেই জমিতে রাজনীতিক শিক্ষার বীজ বপন করলেন। যাঁরা স্বদেশি তাঁরা নাম রেখেছিলেন অবমোচনকারী টমসন। আমাদের দেশে তিনি রাজনীতির জন্মদাতা বলেই ধন্যবাদ ভাজন।

সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা রাজনীতির আখড়া ছিল না কিন্তু রাজনীতির একটি অস্ত্র মাত্র। আসল উদ্দেশ্য দেশের প্রকৃত উন্নতি। আর সেই কাজের জন্য রাজনীতিতে রূপান্তর আনা প্রয়োজন। অতএব আলাদা একটি রাজনীতিক সভার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ১৮৪৩ সালের ২০ এপ্রিল টমসনের সভাপতিত্বে বালাখানায় একটি সভা হল। সেই সভায় বলা হল, এইরকম একটি সভার প্রয়োজনের কথা। সদস্যরা সকলেই একমত হলেন। ওই দিনই জ্ঞানোপার্জিকা সভার অবসান ঘটল। প্রতিষ্ঠিত হল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি।। যার মূল লক্ষ্য হল রাজনীতি। দক্ষিণারঞ্জন কার্যনির্বাহক সমিতির একজন উৎসাহী সদস্য হয়ে উঠলেন। সভাপতি ছিলেন জর্জ টমসন। সম্পাদক প্যারীচাঁদ মিত্র, কোষাধ্যক্ষ রামগোপাল ঘোষ। সদস্যদের মধ্যে অনেক ইংরেজ ছিলেন, যেমন–জি এফ রেমফ্রি, জি টি এফ স্পিড, এম ক্রো, অন্যান্য সবাই বাঙালি। একটি মুখপত্রও প্রকাশিত হল–বেঙ্গল স্পেক্টেটর। ১৮৪২ সালের এপ্রিল মাস থেকে মাসিকপত্র রূপে প্রকাশিত হতে লাগল। প্রবর্তক। রামগোপাল ঘোষ, প্রধান সম্পাদক প্যারীচাঁদ মিত্র। পত্রিকাটি বাইলিঙ্গুয়াল। ইংরেজি ও বাংলা তিনমাস পরে হল পাক্ষিক। কয়েকমাস পরেই হল সাপ্তাহিক। দক্ষিণারঞ্জন সম্পাদকীয় স্তম্ভে অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। কিছুকাল প্রধান সম্পাদকও ছিলেন। এই কাগজটির প্রচার ও প্রতিপত্তি হয়ে উঠল অসামান্য। জর্জ টমসন এই পত্রিকাটি প্রকাশের জন্য প্রচুর টাকা দিয়েছিলেন। এত প্রচার সত্বেও হিসাব করতে বসে দেখা গেল এক বছরে প্রায় এক হাজার টাকা লোকসান হয়েছে। শেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হল ১৮৪৩ সালের নভেম্বর মাসে। তারপরে উঠে গেল।

কলকাতায় সেকালে ধনী বড়লোকের ছেলেরা প্রভূত বিষয় সম্পত্তির অধিকারী হয়ে দুহাতে টাকা ওড়াতে ওড়াতে একসময় পথে বসত। এদের বলা হত কলকাতার বাবু। কোঁচানো ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি, কানে আতর, দু-ঘোড়ায় টানা ফিটন গাড়ি। রাত কাটত বাইজি মহল্লায়। দক্ষিণারঞ্জন অল্পবয়সেই ঠাকুরবাড়ির প্রচুর সম্পত্তি, অর্থ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন শিক্ষিত। ডিরোজিওর ইয়ং বেঙ্গলের একজন। তাঁর চরিত্র সম্পূর্ণ অন্যখাতে প্রবাহিত। নিজের ভোগসুখ নয়, দেশের মানুষকে শিক্ষার পথে, জাগরণের পথে, স্বদেশ চেতনার পথে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ব্রতী হয়েছিলেন। মনে প্রাণে তিনি ছিলেন। স্বাধীন। কোনও মত ও পথের দাসত্ব করা তাঁর স্বভাবে ছিল না। একটি ঘটনা তাঁর এই স্বভাবের পরিচয় বহন করছে। এখন যেখানে রাইটার্স বিল্ডিং ঠিক সেই জায়গার গোপীমোহন ঠাকুরের বিশাল একটি বাড়ি ছিল। সেকালে যেসব সাহেব নবীন সিভিলিয়ান হয়ে এদেশে আসতেন তাঁরা এই বাড়িটি ভাড়া নিয়ে বসবাস করতেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপকরা তাঁদের দেশীয় ভাষা, ইতিহাস, সামাজিক প্রথা ইত্যাদি শেখাতে আসতেন। এই দেশের কাজের উপযোগী হলে তাঁদের পোস্টিংহত বিভিন্ন পদে। আশপাশে দেশীয় মানুষের ঘরবাড়িও ছিল। সে সময় সকলের বাড়িতে গরু থাকত। একদিন একটি গাভি কোনওভাবে এই সিভিলিয়ানদের বসতবাটিতে ঢুকে পড়েছিল। একটি কমবয়সি সাহেব ছোঁকরা বাগানের গেট বন্ধ করে তার পোষা কয়েকটি কুকুরকে লেলিয়ে দিল। কুকুরের দল সেই গাভিটিকে আক্রমণ করে ছোটাছুটি করাতে লাগল। তার আর্তচিৎকারে ভাবী সিভিলিয়ানের খুব আনন্দ। গাভিটি প্রাণভয়ে ছুটছে আর সাহেবের পোষা কুকুররা তাকে ক্ষতবিক্ষত করছে। এইভাবে আর কিছুক্ষণ চললে গোরুটি প্রাণ হারাত। হিন্দু প্রতিবেশীরা আর্তনাদ শুনে ছুটে এসেছেন, কিন্তু কীভাবে গোরুটির প্রাণ বাঁচাবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না। পরিস্থিতি যখন চরমে উঠেছে ঠিক সেইসময় দেখা গেল একটি পালকি আসছে। পালকিটি ওই বাড়িটির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় এই গোলযোগ দেখে থেমে পড়ল। পালকিতে বসেছিলেন স্বয়ং গোপীমোহন ঠাকুর। তিনি নেমে এসে সিংহদরজা ভেঙে বাড়িতে প্রবেশ করলেন। হাতের ছড়ি দিয়ে ওই সাহেব যুবকটিকে উত্তমমধ্যম প্রহার। একবারও ভাবলেন না সাদা চামড়ার গায়ে হাত তুললে কী হতে পারে! এই গোপীমোহনের স্পিরিট দক্ষিণারঞ্জনের শরীরে প্রবেশ করেছিল। বেশ কিছুদিন পরে এই সিভিলিয়ানটি সদর আদালতের বিচারপতি হলেন। দক্ষিণারঞ্জনও তখন সদর আদালতের একজন আইনজীবী। একদিন ওই বিচারপতির এজলাসে একটি মামলায় দক্ষিণারঞ্জন উপস্থিত। তিনি তাঁর মক্কেলের হয়ে সওয়াল করছেন, প্রয়োজনীয় বক্তৃতা দিচ্ছেন। বিচারপতি দক্ষিণারঞ্জনকে উদ্দেশ্য করে কয়েকটি রূঢ় মন্তব্য করলেন। সেদিনের কথা, সেই প্রহারের কথা তিনি ভোলেননি। দক্ষিণারঞ্জন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আপনি এজলাসে বসে আছেন, বিচারকের আসনে। আপনার এই মন্তব্যের উত্তর আমি এখানে দিতে পারব না। তবে একসময় আপনি আদালত ছেড়ে বাইরে আসবেন তখন। এর উপযুক্ত জবাব পাবেন। দক্ষিণারঞ্জন এই কথা বলে কোর্টরুমের বাইরে চলে গেলেন। বিচারক এজলাস শেষ হওয়ার পর রাস্তায় বেরতে ভয় পাচ্ছেন। দক্ষিণারঞ্জন যথোচিত জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। জজ সাহেব এও জানেন দক্ষিণারঞ্জন গোপীমোহন ঠাকুরের পৌত্র। তখন তিনি দ্বারকানাথ ঠাকুরকে ডেকে দক্ষিণারঞ্জনকে শান্ত করার অনুরোধ জানালেন। দ্বারকানাথ আদালতের বাইরে এসে ক্ষিপ্ত দক্ষিণারঞ্জনকে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করলেন। এই ছিল দক্ষিণারঞ্জনের স্পিরিট।

সেকালে দাস বাঙালির স্বভাবই ছিল সাহেব দেখলেই পায়ের কাছে হামাগুড়ি দেওয়া। পদলেহন করে নিজেদের অবস্থা ফেরানো। এই দাস মনোভাব থেকে মুক্তি পেতে একযুগ সময় লেগেছিল। দক্ষিণারঞ্জনের পর বাঙালি সমাজ যে সন্ন্যাসীর সিংহগর্জন শুনেছিলেন তাঁর নাম স্বামী বিবেকানন্দ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও গর্জনকারী এক বাঙালি।

বসন্তকুমারী : বর্ধমানের রাজপরিবারের অভ্যুত্থান অলৌকিক। অনেকটা ইংরেজিতে যেমন বলে–From rags to reiches ছিল চটে শুয়ে, বসল গিয়ে সিংহাসনে। একে মিরাকল বলা যাবে না, সৎ প্রচেষ্ঠা এবং ভাগ্যের সংযোগ। মহামতী আকবর দিল্লির সিংহাসনে। স্বামীজি যে মোগলকে সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করতেন তিনি আকবর। ইংরেজরা আকবরকেই। বলেছেন–দ্য গ্রেট মোগল। ১৫৭৪ সালের বাংলা। শূর বংশের পাঠানদের রাজত্বকাল শেষ হওয়ার পর কররানি বংশের সুলেমান কররানি বাংলার সুলতান হয়েছিলেন ১৫৬৫ সালে। এই সুলেমান আকবরের শাসন কর্তৃত্বকে অস্বীকার করেননি। ফলে কোনও সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। ১৫৭২ সালে তাঁর মৃত্যু হল। কনিষ্ঠপুত্র দাউদ খান সিংহাসনে বসলেন। সিংহাসনে বসেই মনে করলেন, আমি একটা কেউকেটা। দিল্লি অনেক দূরে। এই বাংলায় তারা দাঁত ফোঁটাতে আসবে না। সিংহাসনে বসেই তিনি এমন কয়েকটি কাজ করলেন যার ফল হল ভয়ংকর। প্রথম, নিজের নামে খুত বা পাঠ। দ্বিতীয়, নিজের নামে মুদ্রাও চালু করলেন। দিল্লির সিংহাসনে আকবর নড়ে বসলেন। তাঁর সুদক্ষ সেনাপতি মুনিম খাঁকে বাংলায় পাঠালেন। দাউদ খানকে ঢিট করতে। ১৫৭৬ সালের জুলাই মাস। রাজমহলের যুদ্ধক্ষেত্রে দাউদ খান মোগল সেনাদের মুখোমুখি হলেন। যথারীতি যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত। দাউদ খানের পরিবারবর্গ তখন বর্ধমান শহরে। তাঁরা বন্দি হলেন। রাজা টোডরমল বর্ধমান শহরেই ঘাঁটি গাড়লেন।

এরপরের দশ বছর দাউদের পুত্র কতলু খান বা কুট্টি খান আকবর বাদশার সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে চুক্তি অনুসারে কাজ করায় কোনও গোলযোগ নতুন করে তৈরি হয়নি। ওদিকে দিল্লির মসনদে পরিবর্তন দেখা দিল। আকবর প্রয়াত, সিংহাসনে জাহাঙ্গির। বাংলাদেশে আবার। বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিল। ১৬২৪ খ্রিস্টাব্দ। যুবরাজ খুররাম, পরে দিল্লির বাদশাহ হয়ে শাহজাহান নামে পরিচিত হল। তিনি গড়ের দুর্গ এবং বর্ধমান শহর দখল করলেন। সেই সময় পাঞ্জাবের অন্তর্গত লাহোর কোটালির কাপুর ক্ষত্রিয় আবু রায় ভাগ্যের সন্ধানে মাতৃভূমি ছেড়ে চলে আসেন বর্ধমানে। শুরু করেন চিরস্থায়ী বসবাস। বর্ধমান রাজের প্রতিষ্ঠা শুরু হল। বলা চলে। পরবর্তীকালে মহারাজাধিরাজ বিজয়চাঁদ মোগল বাদশাহ শাহজাহানের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা জানালেন এইভাবে, আমি তাঁর কাছে ঋণী। কারণ তাঁর ঔদার্যে আমি এই জমিদারির মালিক হয়েছি। অবশ্যই উপযুক্ত জমিদার। তা না হলে সারা ভারতে মহারাজাধিরাজ বর্ধমান সর্বশ্রেষ্ঠ জমিদার হিসাবে স্বীকৃতি পেতেন না। দিল্লির কোষাগারে সবচেয়ে বেশি খাজনা জমা পড়ত বর্ধমান রাজের।

সঙ্গম রায় : বর্ধমান অঞ্চলের ক্ষত্রিয়দের আদি পুরুষ আর বর্ধমান রাজবংশের প্রথম রাজা। লাহোরের কোটলে মহল্লার অধিবাসী। তিনি শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবকে দর্শন করার জন্য পুরীতে আসেন। সেখান থেকে ফেরার সময় বর্ধমান শহরের কাছে বোলেরা বৈকুণ্ঠপুর অঞ্চলটি ভালো লেগে যায়। সেখানেই বসবাস শুরু করলেন। তিনি ছিলেন শিবভক্ত। প্রথমেই একটি শিবমন্দির স্থাপন করলেন যা আজও আছে। শের আফগানের সঙ্গে জাহাঙ্গিরের ভাই। কুতুবউদ্দিনের যুদ্ধের সময় সঙ্গম রায় বাদশাহি সৈন্যদের রসদদার হলেন। তাঁর কাজে অত্যন্ত খুশি হয়ে বাদশাহ তাঁকে করে দিলেন চারহাজারি মনসবদার। হয়ে উঠলেন বর্ধমান অঞ্চলের একজন ধনী সওদাগর। বৈকুণ্ঠপুরে একটি নদী আছে বলুকা। নদীটি এখন শুকিয়ে গেছে। এই নদীর ধারেই সঙ্গম রায়ের বাসভবন ছিল।

বন্ধুবিহারী রায় : সঙ্গম রায়ের পরলোকগমনের পর পুত্র বন্ধুবিহারী বর্ধমানের ফৌজদারের অধীনে বর্ধমান চাকলার মুনসেফদারি পেলেন। এই রায় বংশ দিল্লির সম্রাটের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। বিপদে আপদে তাঁদের প্রচুর সাহায্য করতেন। এরই ফলে তাঁকে দেওয়া হয় রায়রায়ান উপাধি।

আবুরাম রায় : রায়রায়ান বন্ধুবিহারীর মৃত্যুর পর আবুরাম রায় বর্ধমান শহরের রেকাবিবাজার ও মোগল টুলির কোতোয়াল ও চৌধুরীপদ পেলেন জায়গির সহ। তিনি ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য বর্ধমানে চলে এলেন। দিল্লির সিংহাসনে তখন সম্রাট শাহজাহান। বর্ধমান রাজবংশের প্রকৃত আদি পুরুষ আবু রায়। বর্ধমান শহরের পশ্চিমদিকে কাঞ্চননগরে বারোদুয়ারি নামে একটি বসতবাটি নির্মাণ করালেন।

বাবুরাম রায় : আবুরাম রায়ের মৃত্যুর পর বাবুরাম রায় হলেন উত্তরাধিকারী। খুব অল্পদিনই জীবিত ছিলেন।

ঘনশ্যাম রায় : বাবুরামের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ঘনশ্যাম বর্ধমানের কোতোয়াল হলেন। এই প্রথম শুরু হল প্রজাদের সেবা। শহরবাসীর জলকষ্ট দূর করার জন্য একটি বিরাট জলাশয় খনন করালেন। যার নাম শ্যামসায়র। এই অঞ্চলটি এখন খুবই উন্নত। পশ্চিমদিকে আধুনিক যুগের সমস্ত সুবিধাযুক্ত মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল, বিজয়চাঁদ দাঁতব্য। চিকিৎসালয়, বর্ধমান রায় কলেজ। সায়রের চারপাশে অতি সুন্দর শান বাঁধানো ঘাট। পূর্বদক্ষিণ কোণে হরিসভা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, বর্ধমান শাখা। ঈশানেশ্বর শিবমন্দির। (জনশ্রুতি ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ এই মন্দিরে পূজা করেছিলেন), শ্রী রামকৃষ্ণ আশ্রম। সায়রের দক্ষিণে হরিসভা গার্লস স্কুল। এইসব জায়গা বর্ধমান রাজ পরিবারের দান।

কৃষ্ণরাম রায় : ঘনশ্যাম রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র কৃষ্ণরাম রায় ঔরঙ্গজেবের ফরমান অনুসারে ১৬৮৯ সালে বর্ধমানের জমিদারি ও চৌধুরিপদে উত্তরাধিকারী হলেন। তিনি একটি বিশাল দিঘি খনন করালেন। নাম হল কৃষ্ণসায়র। সেইসময় মুদ্রা হিসেবে প্রচলিত ছিল কড়ি। এই বিশাল দিঘিটি খনন করতে প্রচুর কড়ি লেগেছিল। এটি বর্তমানে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি।

১৬৯৬ সাল। বর্ধমান রাজপরিবারের পক্ষে খুবই খারাপ সময়। ওই সময় চিতুয়া ও বরদার জমিদার শোভা সিংহ আর আফগান সরদার রহিম খাঁ একত্রিত হয়ে ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। মোগলদের প্রিয় ও আশ্রিত কৃষ্ণরাম রায় প্রাণ হারালেন। বর্ধমানের বহু এলাকা বিদ্রোহীদের দখলে চলে গেল।

পূর্বপুরুষদের কুলদেবতা লক্ষ্মীনারায়ণকে বৈকুণ্ঠপুর থেকে এনে বর্ধমানে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন আবু রায়। কৃষ্ণরাম রায় সেই বিগ্রহকে সরিয়ে এনেছিলেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরে। বিদ্রোহীরা এই কুলদেবতাকেই শুধু নয়, শিবমঙ্গল কাব্যের কবি রামকৃষ্ণ রায়ের গৃহদেবতা রাধাবল্লভকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এই রাধাবল্লভকেও একসময় উদ্ধার করেছিলেন কৃষ্ণরাম। এই হামলায় দুটি বিগ্রহই বিধর্মীদের হাতে চলে গেল।

জগৎরাম রায় : ১৬৯৬ সালের জানুয়ারি। কৃষ্ণরাম ওইদিন নিহত হয়েছেন। রাজবাড়ি বিদ্রোহীদের কবলে। পুত্র জগৎরাম গা ঢাকা দিয়ে পালালেন ঢাকায়। শোভা সিংহ রাজপরিবারের মহিলাদের বন্দি করল। তার নজর পড়ল রূপসী রাজকুমারী সত্যবতীর ওপর। এক রাতে শোভা সিংহ রাজকুমারীর সম্ভ্রম নষ্ট করার চেষ্টা করল। বীরাঙ্গনা সত্যবতী তাঁর ঘাগরার মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন একটি ছুরি। সেই অস্ত্র বসিয়ে দিলেন লম্পট শোভা সিংহের বুকে। শোভা সিংহের জীবন এইভাবেই শেষ হল। রইল রহিম খাঁ। সে এইবার। বিদ্রোহ পরিচালনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিল। ওদিকে ওড়িশা, এদিকে হুগলি, মাঝখানে বর্ধমান। চতুর্দিকে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল। লুঠপাট, নারীদের সম্ভ্রম নষ্ট ইত্যাদি যত অনাচার আছে সবই এত উদগ্র হল যে জনজীবন বিপর্যস্ত। ঔরঙ্গজেব তাঁর পৌত্র আজিম-উশ-শানকে। বিদ্রোহ দমন করার জন্য বাংলার সুবেদার নিযুক্ত করে বর্ধমানে পাঠালেন। ওদিকে ঢাকার নবাবপুত্র জবরদস্ত খান এই বিদ্রোহ দমনে জগৎরামকে নানাভাবে সাহায্য করতে লাগলেন। উভয়ের সমবেত চেষ্টায় বিদ্রোহীরা জব্দ হল। জগঞ্জামের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে বাদশাহ তাঁকে ফরমান দিয়ে সম্মান জানালেন। বর্ধমানের উপকণ্ঠে আজিমের কাছে বিদ্রোহীরা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হল। জগৎরাম শুধু তাঁর জমিদারি ফিরে পেলেন না, তার আয়তনও বেড়ে গেল। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই, ১৭০২ সালে জগৎরাম আততায়ীর হাতে প্রাণ হারালেন। পুত্র কীর্তিচাঁদ উত্তরাধিকারী হলেন। এই রাজবংশে কীর্তিচাঁদ এক উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি। যদিও রাজা উপাধিতে তিনি ভূষিত হননি।

রাজকুমারী সত্যবতী তাঁর সতীত্ব রক্ষার জন্য সুকৌশলে শোভা সিংহকে হত্যা করেছিলেন। সেদিন সত্যবতী ছাড়া রাজপুরীর দশজন সধবা ও তিনজন বিধবা হীরে চিবিয়ে আত্মবিসর্জন দিয়েছিলেন। রাজবাড়ির ইতিহাসে এই দিনটি চিহ্নিত হয়েছে জহুরীতিথি হিসেবে। যাঁরা প্রাণ দিলেন তাঁদের বলা হয় জহুরি। কারণ অমূল্য রত্ন হীরা তাঁদের রক্ষা করেছিল। রাজ ইতিহাসে জহুরিদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তাঁরা হলেন –১) কুণ্ডুদেবী, ২) হোতা দেবী, ৩) চিমো দেবী, ৪) লক্ষ্মী দেবী, ৫) আনন্দ দেবী, ৬) কিশোরী দেবী, ৭) কুঞ্জ দেবী, ৮) জিতু দেবী, ৯) মূলক দেবী, ১০) দাসো দেবী, ১১) লাজো দেবী, ১২) পাতো দেবী, ১৩) কৃষ্ণা দেবী।

কীর্তিচাঁদ রায় : জগৎরামের দুই ছেলে–কীর্তিচাঁদ আর মিত্র রাম। পিতার মৃত্যুর পর কীর্তিচাঁদ ক্ষমতায় এলেন। নানা কারণে কীর্তিচাঁদ এক অসাধারণ ব্যক্তি। যেমন সুন্দর দেখতে সেইরকম আজানুলম্বিত বাহু। সবাই বলতেন, ইনি শাপভ্রষ্ট অর্জন। এই পরিবারে তিনিই ছিলেন অমিতশক্তিশালী এক যোদ্ধা। তাঁর লেফটেনান্ট কর্নেল ছিলেন–বৎস রাম খান্না। বর্ধমান রাজের সঙ্গে অন্যান্য জেলার যুদ্ধও হত। কীর্তিচাঁদ চন্দ্রকোণা (মেদিনীপুর) এবং বরদা (ঘাটাল) জয় করতে চলেছেন। তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে। পূর্বপুরুষ আবু রায় বর্ধমানের কাঞ্চননগরে রথতলার প্রতিষ্ঠাতা। সেই জায়গায় এক সাধু দিনরাত ধুনি জ্বালিয়ে বসে থাকতেন। তিনি কীর্তিচাঁদের যুদ্ধযাত্রা দেখে বলে উঠলেন, মহারাজের জয় হোক। কীর্তিচাঁদ থমকে দাঁড়ালেন। সাধুজিকে বললেন, আমি যতদিন না ফিরি ততদিন আপনি এখানেই থাকবেন। রাজকর্মচারীদের বলে পাঠালেন, মাথার ওপর সুন্দর একটি আচ্ছাদন তৈরি করে দাও আর রাজপ্রাসাদ থেকে প্রতিদিন যেন সেবা আসে।

যুদ্ধজয় করে কীর্তিচাঁদ ফিরে এলেন। সন্ন্যাসীকে পাঁচশো বিঘা নিষ্কর সম্পত্তি দান করলেন। তৈরি করে দিলেন বিশাল একটি মন্দির ও প্রাসাদ। পরবর্তীকালে এই সাধুই রাজগঞ্জের নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের আদি পুরুষ বলে সর্বত্র পরিচিতি পেলেন। কীর্তিচাঁদ অনেক ছোট ছোট রাজ্য জয় করে তাঁর নামের সার্থকতা প্রতিপন্ন করেন। চন্দ্রকোণা জয় করার পর রথযাত্রার দিন প্রকাশিত হয় কীর্তিচাঁদ রথ। প্রচুর ধূমধাম। সপ্তাহব্যাপী মেলা, কীর্তিচাঁদ রথে তাঁর বিজয় ঘোষণা। এই উৎসব স্থায়ী হল কাল থেকে কালান্তরে। তাঁর জয়গানে কবিরা মুখর হলেন, যদিও তিনি রাজা বা মহারাজা উপাধি পাননি, কিন্তু সেই সাধু তাঁকে মহারাজ বলেই সম্বোধন করেছিলেন। তাঁর সময়ে জমিদারির সীমা প্রসারিত হয়েছিল। বিষ্ণুপুরের রাজারা তাঁর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। চন্দ্রকোণার রাজা মোগল সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে শোভা সিংহের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। কীর্তিচাঁদ তাঁকেও শেষ করলেন।

চিত্রসেন রায় : কীর্তিচাঁদের পুত্র চিত্রসেন। তিনিই প্রথম রাজ উপাধি লাভ করেন। সাল ১৭৪১। তখন মোগল সম্রাট ছিলেন মহম্মদ শাহ। সম্রাটের অনুমতি নিয়ে আরও কয়েকটি পরগনা তিনি দখল করেছিলেন। চিত্রসেনের সময় মণ্ডলঘাট, আরসা, চন্দ্রকোণার পুরোটা বর্ধমানের অধিকারভুক্ত হয়। যুদ্ধ করে বীরভূম, পঞ্চকোট ও বিষ্ণুপুরের অনেকটা তিনি দখল করে নেন। রাজগড়ে নির্মাণ করলেন প্রথম দুর্গ। দ্বিতীয় দুর্গ হল বীরভূমের প্রান্তে অজয়নদের তীরে–সেন পাহাড়ি। এই সময় বাংলায় ঘনিয়ে এসেছিল প্রবল দুর্দিন। একটি হল বর্গির হাঙ্গামা অপরটি ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। মহারাষ্ট্রের একদল নিষ্ঠুর লুঠেরা বাংলাদেশটাকে প্রায় শ্মশান করে দিয়েছিল। সাল ১৭৪৯। গ্রাম এবং শহর লুঠ করে, খুন করে, যে কোনও বাড়িতে ঢুকে যথাসর্বস্ব হরণ করে, ধানের গোলায় আগুন লাগিয়ে–এই বর্গিরা রঘুজি ভোঁসলের নেতৃত্বে তাণ্ডব শুরু করে দিয়েছিল। ভাবতে অবাক লাগে তাদের সঙ্গে ছিল প্রায় চল্লিশ হাজার অশ্বারোহী ফৌজ। ওড়িশা দিয়ে ঢুকে ছড়িয়ে পড়ত পঞ্চকোট, বিষ্ণুপুর, বীরভূম, মেদিনীপুর ও বর্ধমানে। এই সমগ্র এলাকাটা ছিল বারবার আক্রমণের লক্ষ্যস্থল। বর্ধমান জেলার কাটোয়া পর্যন্ত একটা জায়গাও তাদের আক্রমণের বাইরে রইল না। জমির সমস্ত ফসলই শুধু নষ্ট করল না উর্বরতাও শেষ করে দিল। বর্ধমানের শস্য ভান্ডার শেষ। বাইরে থেকে আনার পথও বন্ধ। অনাহারে প্রাণ যায়। মানুষ গাছের পাতা ও শেকড় খেতে শুরু করল। তাও একদিন শেষ হয়ে গেল। বর্গির হামলার যদি একটি মানচিত্র আঁকা যায় তাহলে দেখা যাবে–ওদিকে রাজমহল, এদিকে মেদিনীপুর ও জলেশ্বর পর্যন্ত সুবিস্তৃত একটি অঞ্চল বর্গির আক্রমণে প্রায় ধ্বংস। তাঁদের নিষ্ঠুরতার কোনও তুলনা ছিল না। মানুষের নাক, কান কাটছে, এমনকী হাত দুটোও উড়িয়ে দিচ্ছে। সমস্ত মৃতদেহ ফেলা হচ্ছে নদীর জলে। এক-একটি হত্যাকাণ্ডের এক-এক পদ্ধতি। কারও গলায় ময়লা ভর্তি বস্তা বেঁধে, হাত-পা কেটে জলে ফেলে দিল। কারওকে জীবন্ত পুড়িয়ে ছাই করে দিল। গঙ্গারামের মহারাষ্ট্র পুরাণে প্রত্যক্ষ একটি বর্ণনা আছে।

তবে সব বরগি গ্রাম লুটতে লাগিল
যত গ্রামের লোক সব পলাইল।
ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পলায় পুঁথির ভার লইয়া
সোনার বাহনা পলায় সোনার ভার লইয়া।
গন্ধবণিক পলায় দোকান লইয়া যত
তামা পিতল লইয়া কাঁসারি পলায় কত।
শঙ্খ বণিক পলায় করাত লইয়া যত।
চতুর্দিকে লোক পলায় কি বলিব কত।

নবাব আলিবর্দির চেষ্টায় বর্গিরা কিছুটা পিছু হটলেও নবাবকে কাটোয়া দুর্গে আশ্রয় নিতে হল। ১৭৪২ সালে কাটোয়ায় দু-পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হল। ভাস্কর পণ্ডিত পরাজিত হয়ে পঞ্চকোটের দিকে পালিয়ে গেল। কিছু পরে শক্তিসঞ্চয় করে চন্দ্রকোণার ভেতর দিয়ে। মেদিনীপুরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অবশেষে আলিবর্দি তাদের সঙ্গে সন্ধি করলেন। সন্ধির চুক্তি অনুসারে কটকশহরটি ছেড়ে দিতে হল। আর বছরে বারো লাখ টাকা চৌথ হিসাবে। মারাঠাদের অর্থকোষে জমা দেওয়ার শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হলেন নবাব। সেইসময় ছেলেদের ঘুম পাড়াবার সময় মায়েরা ঘরে ঘরে সুর করে বলতেন–

ছেলে ঘুমাল পাড়া জুড়াল
বর্গি এল দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে।

এই ডামাডোলের সময়েই মহারাজ তিলকচাঁদ মূলাজোড়ের কাছে কাউগাছিতে রাজধানী সরিয়ে এনেছিলেন। সে কথা পূর্বেই বলা হয়েছে।

এইখানেই সেই ঘটনাটি মূল কাহিনির সঙ্গে জোড়া লাগল।

রাজা চিত্রসেনের কোনও সন্তানাদি ছিল না। তিনি পরলোকগমন করার পর বর্ধমান রাজপরিবার ভিন্ন শাখায় চলে গেল। তাঁর পিতৃব্যপুত্র তিলকচাঁদ ক্ষমতায় এলেন। তাঁর ভাগ্য অতি প্রসন্ন। মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ১৭৬৪ সালে তাঁকে রাজবাহাদুর করে চার হাজার পদাতিক ও দু-হাজার অশ্বারোহী রাখার অনুমতি দিলেন। চার বছর পরেই ১৭৬৮ সালে তিনি হলেন মহারাজাধিরাজ, হয়ে গেলেন পাঁচ হাজারি মনসবদার। তাঁর বাহিনীতে আরও তিন হাজার অশ্বারোহী যুক্ত হল। কামান ও বন্দুকের শক্তিও পেলেন। সেই সময় বাংলায় ইংরেজ শক্তি প্রবল হচ্ছে। তখন বড় পিচ্ছিল অবস্থা। ১৭৬০ সালে তিলকচাঁদ ও বীরভূমের রাজা আসাদউল্লাহ একত্রিত হয়ে ক্যাপ্টেন হোয়াইটকে পরাজিত করলেন। এই বছরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৭৫৬ সালে আলিবর্দি চলে গেলেন পরলোকে। আর তার এক বছরের মধ্যেই পলাশি। বাংলা পরাধীন হল। মিরজাফর নামেমাত্র নবাব। প্রকৃত প্রভু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। অতি সমৃদ্ধ বর্ধমান কোম্পানির দখলে চলে গেল। কিন্তু তাঁরা তিলকচাঁদকে বন্ধু হিসাবেই গ্রহণ করলেন। একসময় মীরজাফরকেও যেতে হল। ১৭৬০ সালে মীরকাশেমকে বসানো হল মসনদে। তিনি বর্ধমানের রাজস্ব ধার্য করলেন। ৩১,৭৫,৪০৬ সিক্কা। এই কর দেওয়ার সংগতি মহারাজ তিলকচাঁদের ছিল না। মারাঠারা সব শেষ করে দিয়ে গেছে। মহারাজা উঁকিলের মাধ্যমে রাজ্যের অবস্থা কোম্পানিকে জানালেন। বর্গির হাঙ্গামায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় আট লাখ টাকা। রাজস্ব কিছুই আদায় হয়নি। কোম্পানি একটি সমঝোতায় এলেন। রাজস্বের পরিমাণ দাঁড়াল এগারো লক্ষ টাকা। কিস্তিতে কিস্তিতে দিতে হবে। তিলকচাঁদের পক্ষে দায়পরিশোধ করা সম্ভবপর হয়নি। ঠিক সেই সময় বীরভূম আর মেদিনীপুরে কোম্পানি বিরুদ্ধে সেখানকার রাজারা বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। তখন ইংরেজ কোম্পানি কোনও উপায় না দেখে বর্ধমানের মহারাজাকে মিত্র হিসেবেই গণ্য করলেন। রাজস্ব আদায় করার জন্য ১৭৬১ সালে বর্ধমানে একজন রেসিডেন্ট নিযুক্ত করলেন। এতেও কোনও সুরাহা হল না। রাজস্ব বাবদ প্রায় ছাব্বিশ লক্ষ টাকা বকেয়াই রয়ে গেল। তখন বর্ধমান মহারাজার কিছু কিছু জমিদারি হাতছাড়া হয়ে গেল। এর ফলে হুগলি ও বর্ধমানে নতুন একদল জমিদারের আবির্ভাব হল।

মারাঠা আক্রমণে কাটোয়া সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। গ্রামাঞ্চলে কেউ ছিল না বললেই চলে। গ্রাম ছেড়ে মানুষ পালিয়েছিল বনে বাদাড়ে, জলায় (ইম্পিরিয়াল গেজেটিয়ারে সেই খবর আছে)। মহারাজা তিলকচাঁদের সময় যথেষ্ট উদ্বেগপূর্ণ। তাঁর দুই বিবাহ। প্রথম স্ত্রীর নাম বিষণকুমারী দেবী। তাঁরই পুত্র মহারাজ তেজচাঁদ বাহাদুর। দুই কন্যা–তোতাকুমারী ও চিত্রকুমারী। বর্ধমান শহরের বিখ্যাত রানিসায়র সরোবরটি বিষণকুমারী দেবীর কীর্তি। দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম রূপকুমারী দেবী। তিনি নিঃসন্তান। এ ব্যাপারে সামান্য মতভেদ আছে। কারও মতে রূপকুমারীই প্রথম স্ত্রী। মহারাজ তিলকচাঁদ রেকাবি বাজার এলাকায় বর্তমান রাজপ্রাসাদ তৈরির কাজ শুরু করান। তাঁরই সময়ে শ্রী শ্রী লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ ও ভুবনেশ্বর মহাদেবের মন্দির দুটিও নির্মিত হয়। রাজপ্রাসাদ অসম্পূর্ণ রেখেই তিনি দেহত্যাগ করেন ১৭৭১ সালে। এই সময়েই সেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। রাজকোষ শূন্য। রাজবাড়ির জিনিসপত্রও বিক্রি করতে হয়েছে। পারলৌকিক ক্রিয়ার অর্থ চাইতে হয়েছে ইংরেজ সরকারের কাছে। এরপরে। ক্ষমতায় এলেন তেজচাঁদ। বর্ধমানের এক বর্ণময় চরিত্র।

তেজচাঁদ যখন ক্ষমতায় বসলেন তখন তিনি নাবালক। তাঁর মা বিষণকুমারী দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমের ফরমান নিয়ে রাজকার্য চালাতে লাগলেন। তাঁর অপূর্ব দক্ষতায় রাজভান্ডার। আবার ভরে উঠল। তাঁর খরচের বহর দেখলেই বোঝা যেত সুদিন ফিরেছে। সেইকালে এক লক্ষ টাকারও বেশি খরচ করে নবাব হাটে একশোনটি শিবমন্দির তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার দিন সারা ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে এক লক্ষেরও বেশিব্রাহ্মণ পণ্ডিত এসেছিলেন। মহারাজা তেজচাঁদ নিজে ব্রাহ্মণদের পদপ্রক্ষালন ও পদরজ সংগ্রহ করেন। অবশ্যই ঐতিহাসিক কীর্তি। এই মন্দির সমন্বয় বর্ধমানের পশ্চিমদিকে জিটি রোড ও সিউড়ি রোডের সংযোগস্থলে অবস্থিত। আজও হাজার হাজার মানুষ শিবরাত্রির দিন সেখানে সমবেত হন। পরবর্তীকালে বিড়লা স্ট্রাস্ট এটির সংস্কার করেন। ১৭৭৯ সালে তেজচাঁদ সাবালক হলেন। ১৭৯৩ সালে ইংরেজ সরকার একটি আইন প্রণয়ন করলেন–Regulation one, মহারাজের সঙ্গে ইংরেজ সরকারের চুক্তি হল। রাজস্ব ধার্য হল, ৪০,১৫,১০৯ সিক্কা। আর পুলবন্দি বাবদ ১,৯৩,৭২১ সিক্কা। আবার সেই এক ব্যাপার, দুর্ভিক্ষের জন্য মহারাজার পক্ষে রাজস্বের পুরো টাকা মেটানো সম্ভব হল না। জমিদারির কিছু অংশ বিক্রি হয়ে গেল। কিনলেন সিঙ্গুরের দ্বারিকনাথ সিংহ, ভাসতারার ছকু সিংহ, জনাইয়ের বন্দ্যোপাধ্যায় বংশ। অবশেষে পত্তনি প্রথা চালু করে তেজচাঁদ জমিদারি রক্ষা করলেন।

অনেক ভালো কাজ তিনি করেছেন। ১৮১৭ সালে বর্ধমানে একটি অ্যাংলো ভার্নাকুলার স্কুল স্থাপন করেন। পরে মহতাব চাঁদ এটিকে হাইস্কুল এবং ১৮৮১ সালে এটিকেই উন্নিত করলেন আই.এ.কলেজে।

তেজচাঁদের অন্য জীবন। তিনি বিলাসী এবং ভোগী। একবার নয়, আটবার বিবাহ করেছিলেন। প্রখ্যাত লেখক সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখছেন–শিরোনাম, তেজচাঁদ বাহাদুর (বর্ধমানের বুড়া রাজা)–প্রতিদিন প্রাতে দেওয়ান, মোসাহেব ও অন্যান্য কর্মচারীরা। অন্দরমহলের দ্বারে আসিয়া তেজচাঁদ বাহাদুরের বহির্গমন প্রতীক্ষা করিতেন; তিনি যথাসময়ে এক স্বর্ণপিঞ্জর হস্তে বহির্গত হইতেন, পিঞ্জরে কতকগুলি লাল নামা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পক্ষী আবদ্ধ। থাকিত, তিনি তাহাদের ক্রীড়া ও কোন্দল দেখিতে দেখিতে আসিতেন। সমুখবর্তী হইবা মাত্র তাঁহাকে সকলে অভিবাদন করিত, মহারাজা হাসিমুখে তাহাদের আশীর্বাদ করিতেন। একদিন প্রাতে তিনি পিঞ্জর হস্তে অন্দরমহল হইতে বহির্গত হইতেছেন, এমন সময় একজন প্রধান কর্মচারী অগ্রসর হইয়া করজোড়ে নিবেদন করিল মহারাজ, হুগলিতে খাজনা দাখিল করিবার নিমিত্ত সে দিবস যে এক লক্ষ টাকা পাঠানো হইয়াছিল, তাহা তথাকার মোক্তার। আত্মসাৎ করিয়া পলাইয়াছে। তেজচাঁদ বিরক্ত হয়ে উত্তর করিলেন, চুপ! হামরা লাল ঘবরাওয়েগা! এক লক্ষ টাকা গেল শুনিয়া তাঁহার কষ্ট হইল না, কিন্তু কথার শব্দে লালপক্ষী। ভয় পাইবে, এই জন্য তাঁহার কষ্ট হইল। এই মনে করিয়া কর্মচারী বড় রাগ করিলেন, পাপিষ্ঠ মোক্তারকে সমুদয় টাকা উদগীরণ করাইব, নতুবা কর্মত্যাগ করিব এই সঙ্কল্প করিলেন। মোক্তারের অনুসন্ধান আরম্ভ হইল। কিছুকাল পরে সংবাদ আসিল যে, মোক্তার আপন বাটিতে বসিয়া পুষ্করিণী কাটাইতেছে, দেউল দিতেছে, আর যাহা মনে আসিতেছে তাহাই করিতেছে। তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিবার জন্য রাজ্যসরকার হইতে সিপাহি ও হাওয়ালদার বাহির হইল। কিন্তু রাজা তেজচাঁদ প্রথমে তাহা জানিতেন না; কিছুদিন পরে তাহা শুনিয়াছিলেন। মোক্তার ধৃত হইয়া রাজবাটীতে আনীত হইলে তেজচাঁদ বাহাদুর মোক্তারকে জিজ্ঞাসা করিলেন :

তুমি আমার এক লক্ষ টাকা চুরি করিয়াছ?

মোক্তার–না, মহারাজ, আমি চুরি করি নাই, আমি তাহা বাটীতে লইয়া গিয়াছি।

তেজচন্দ্র–কেন লইয়া গেলে?

মোক্তার–মহারাজের কার্যে ব্যয় করিব বলিয়া লইয়া গিয়াছি। আমাদের গ্রামে একটিও শিবমন্দির ছিল না, কুমারীরা শিবমন্দিরে দীপ দানের ফল পাইত না, যুবতীরা শিবপূজা করিতে পাইত না। এক্ষণে মহারাজের পুণ্যে তাহা পাইতেছে। আর, একটি অতিথিশালা করিয়াছি, ক্ষুধার্ত পথিকেরা এখন অন্ন পাইতেছে।

তেজচন্দ্র–তুমি কি সমুদয় টাকা ইহাতেই ব্যয় করিয়াছ?

মোক্তার–আজ্ঞা না মহারাজা আমাদের দেশে বড় জলকষ্ট ছিল, গোবৎসাদি দুই প্রহরের সময় একটু জল পাইত না, আমি মহারাজের টাকায় একটি বড় পুষ্করিণী কাটাইয়াছি। মহারাজের পুণ্যে তাহার জল কীরূপ আশ্চর্য পরিষ্কার ও সুস্বাদু হইয়াছে, তাহা সিপাহিদের জিজ্ঞাসা করুন।

তেজচন্দ্র–পুষ্করিণীটি প্রতিষ্ঠা করিয়াছ?

মোক্তার–আজ্ঞা না! টাকায় কুলায় নাই।

তেজচন্দ্র–এখন কত টাকা হইলে প্রতিষ্ঠা হয়?

মোক্তার–ন্যূনকল্পে আর দুই হাজার চাই।

তেজচন্দ্র–কিন্তু দেখো! খবরদার!–দুই হাজার টাকার এক পয়সা বেশি না লাগে, তাহা হইলে আর আমি দিব না।

তাহার পর পূর্বকথিত কর্মচারীকে ডাকিয়া মহারাজ বলিলেন, আমি তো মোক্তারের কোনও দোষ দেখিতে পাইলাম না। মোক্তার যাহা করিয়াছে, তাহাতে আমার টাকা সার্থক হইয়াছে। ইহা অপেক্ষা আমি আর কি ভালো ব্যয় করিতাম। কর্মচারী নিরুত্তর হইল।

তেজচাঁদ বাহাদুরের বিবাহ কাণ্ডে আসার আগে তাঁর চরিত্রের কয়েকটি বিশেষ দিকে আলোকপাত করা যেতে পারে। বৃদ্ধ বয়সে তাঁকে দেখে সঞ্জীবচন্দ্র যেসব মন্তব্য করেছেন। তার আড়ালে আর একটি মহৎ জীবন খুঁজে পাওয়া যায়। যৌবনে তিনি একজন উচ্চাঙ্গের সাধক ছিলেন। সম্ভবত তন্ত্র। পরমশ্যামা সাধক কমলাকান্তের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। বর্ধমানের বোরহাট অঞ্চলে কমলাকান্ত তাঁর আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। বহুপ্রচলিত একটি লোককাহিনি আছে কমলাকান্ত মহারাজাধিরাজ তেজচাঁদকে অমাবস্যার রাতে পূর্ণিমার চাঁদ দেখিয়েছিলেন, আর সুরাকে রূপান্তরিত করেছিলেন দুগ্ধে। তেজচাঁদ বাহাদুরের আমলেই বর্ধমান শহরে রাধাবল্লভ জিউ ও অন্নপূর্ণাদেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। কলকাতার পেনোপোস্তা, ওল্ডচিনাবাজার, টেরেটো বাজার শ্রীশ্রী রাধাবল্লভজিউর সেবায় দান করেন। বর্ধমান রাজপ্রাসাদটিও তিনি সম্পূর্ণ করান। শ্রীশ্রীরাধাবল্লভ ঠাকুরের আবির্ভাব চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য মস্ত বড় একটি কাজ করেছিলেন। বাঁকা নদীর দক্ষিণ দিকে সাধারণের যাতায়াতের সুবিধার জন্য যে ভাঙা পুলটি ছিল সেটিকে সম্পূর্ণ সংস্কার করে একটি পাকা পুল নির্মাণ করান। এই পুলটি এখন আলমগঞ্জের পুল নামে পরিচিত। একটি শ্বেতপাথরের ফলকে উৎকীর্ণ আছে, ঈশ্বর রাধাবল্লভ ঠাকুরের আবির্ভাব জন্য সুখেতে প্রকাশ ইত্যাদি। তাঁর এইসব কাজে যিনি সর্বদা পাশে থেকেছেন তিনি হলেন মহিষী কমলকুমারী। তেজচাঁদের ষষ্ঠপত্নী এই কমলকুমারী।

প্রথম পত্নী জয়কুমারী দেবী। জাজপুরের মেয়ে। পিতার নাম অজ্ঞাত। দ্বিতীয় মহারানি প্রেমকুমারী। তাঁর আর একটি নাম পেয়ারকুমারী। উখরার উড়রমল শেঠের কন্যা। তৃতীয়, মহারানি সেতাবকুমারী। পিত্রালয় ফতেপুরে। লালা বাহাদুর সিংহের ভগিনী কন্যা, চতুর্থ মহারানি তেজকুমারী দেবী, পঞ্চম, মহারানি নানকীকুমারী দেবী, পিতার নাম পাঞ্জাব রায় ট্যান্ডন। তাঁরই গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন প্রতাপচাঁদ। যাঁকে নিয়ে তোলপাড় ইতিহাস। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অনুসন্ধানমূলক গ্রন্থ জাল প্রতাপচাঁদ। ষষ্ঠ পত্নী, মহারানি কমলকুমারী দেবী। তাঁর বিবাহ বিশেষ উল্লেখের অপেক্ষা রাখে। মহারাজা তেজচাঁদ তখন মধ্যবয়সি। সঞ্জীবচন্দ্রের বিশেষণে বর্ধমানের বুড়ো রাজা। তিনি জাল প্রতাপচাঁদ-এ লিখছেন, মহারাজ একদিন একটি দরিদ্র বালিকাকে পথে খেলিতে দেখিলেন, বালিকা পরমা সুন্দরী। মহারাজ তৎক্ষণাৎ তাহার পিতার সন্ধানে লোক পাঠাইলেন। তোক আসিয়া বলিল। পিতার নাম কাশীনাথ, জগন্নাথ দর্শনে যাইবে বলিয়া সপরিবারে লাহোর হইতে এখানে আসিয়াছে। জাতিতে ক্ষত্রিয়। মহারাজের আর বিলম্ব সইল না, দরিদ্রকে অর্থলোভ দেখাইয়া কন্যাটিকে বিবাহ করিলেন। তিনিই মহারানী কমলকুমারী। রাজবাড়ির তথ্য একটু অন্যরকম–সঞ্জীবচন্দ্রের বর্ণনায় আছে দরিদ্রের কন্যা রাস্তার খেলা করছিলেন, আসল ঘটনা খেমচাঁদ কাপুর তাঁর ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে পুরীতে জগন্নাথ দেবকে দর্শন করতে যাচ্ছিলেন। কেশবগঞ্জের চটিতে তাঁরা যখন বিশ্রাম করছিলেন সেই সময়ে তেজচাঁদ বাহাদুর কোথাও যাচ্ছিলেন। হঠাৎ মেয়েটির ওপর তাঁর দৃষ্টি পড়ল। তিনি এতটাই উতলা হলেন যে, তাঁর বাবাকে প্রচুর অর্থে সন্তুষ্ট করে মেয়েটিকে বিবাহ করলেন। পুরো পরিবারটি বর্ধমানে আশ্রয় পেল। এই কমলকুমারীর ভাই পরাণচাঁদ, তিনি এইবার বেশ জাঁকিয়ে বসলেন। হয়ে গেলেন দেওয়ান। সঞ্জীবচন্দ্রের লেখায়, প্রায়ই উল্লেখ পাওয়া যাবে কুচুটে, ষড়যন্ত্রকারী পরাণবাবুর। তেজচন্দ্রকে অতিষ্ঠ করে তোলার মতো একটি চরিত্র। তাঁরই উৎপাতে মহারাজার একমাত্র পুত্র প্রতাপচাঁদ কোথায় হারিয়ে গেলেন। কাটোয়ার গঙ্গার তীরে তাঁর অন্তর্জলি হল। তাঁকে দাহ করাও হল। কিন্তু সতেরো বছর পরে তিনি আবার ফিরে এলেন। শুরু হল মামলা। সঞ্জীবচন্দ্রের বইয়ের উপাদান–জাল প্রতাপচাঁদ।

পরাণচাঁদ কাপুর এইবার বর্ধমানের রাজগৃহে তাঁর জাল বিস্তার করলেন। তেজচাঁদের তখনও নিবৃত্তি আসেনি। কমলকুমারীকে বিয়ের পরেই ঘনশ্যাম চাঢ্যের কন্যা উজ্জ্বলকুমারীকে বিবাহ করলেন। পত্নীর সংখ্যা দাঁড়াল সাত। এরপর দেওয়ান পরাণচাঁদ ফেললেন পাশার শেষ দান। তাঁর বালিকা কন্যাটিকে নিবেদন করলেন তেজচাঁদের পত্নীকুলে। তিনি হলেন অষ্টম ও শেষ মহারানি। নাম বসন্তকুমারী। তিনি তখন চলিত বাংলায় বলতে গেলে কচি খুকি, পিতা পরাণচাঁদের দুষ্ট অভিসন্ধি পূরণের জন্য তিনি বলিপ্রদত্ত হলেন। কী কাণ্ড! পরাণচাঁদ তেজচাঁদের শ্যালক এবং শ্বশুর ও দেওয়ান।

জেনানা মহলে বসন্তকুমারীর কী অবস্থা তা পরে জানা যাবে। তিনি যথাসময়ে প্রকাশিত হবেন তাঁর ফণা বিস্তার করে। এত বিয়ে কিন্তু ছেলে একটি। সবেধন নীলমণি প্রতাপচাঁদ। পঞ্চম পত্নী নানকিকুমারী তাঁর মা। ষষ্ঠ রানি কমলকুমারী তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র চুনীলালকে দত্তক নিয়েছিলেন। এই চুনীলাল পরাণচাঁদের পুত্র। সে তার মায়ের অষ্টম গর্ভের সন্তান। দেওয়ান পরাণচাঁদের ধারণা অষ্টম গর্ভের সন্তানদের ভাগ্য রাজভাগ্য। প্রতাপচাঁদকে হটাতে পারলেই চুনীলালের বিরাট ভবিষ্যৎ। অন্যমতে চুনীলাল নয় ছেলেটির নাম কুঞ্জবিহারী। তেজচাঁদ অনেক ভালো ভালো কাজ করেছিলেন। কিন্তু পিতা হিসেবে প্রতাপচাঁদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তেমন ভালো ছিল না। কুমার প্রতাপচাঁদ একজন উদ্ধৃঙ্খল যুবক হয়ে দাঁড়ালেন। সাঁতারে পটু, সুদক্ষ ঘোড়সওয়ার, ক্ষুরধার বুদ্ধি, অল্প বয়সেই তাঁর মাতৃবিয়োগ হয়। পিতামহী মহারানি বিষণকুমারীই তাঁকে মানুষ করেন। তাঁর অতিশয় আদরে প্রতাপচাঁদ এক বেপরোয়া যুবক। কোনও ভয়ডর নেই। তেজচাঁদ বাহাদুর তাঁকে এড়িয়ে চলতেন। সুরা এবং সাকি–দুটিই তাঁর অতি প্রিয়। পরে সাধক কমলাকান্তের সংস্পর্শে এসে একেবারে অন্যরকম। হয়ে গেলেন। কুস্তিগীর, লম্বা চওড়া শরীর, তিরন্দাজিতে ওস্তাদ, লেখাপড়াও করতেন। ১৮১৯ সালের বিখ্যাত অষ্টম বঙ্গ আইনের খসড়া তাঁরই তৈরি। প্রতাপচাঁদেরও দুই বিয়ে। প্রথম স্ত্রীর নাম আনন্দী দেবী, দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম পেয়ারিদেয়ী দেবী।

প্রতাপচাঁদ পরাণবাবুকে একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। তেজচাঁদের বসন্তকুমারীর। সঙ্গে বিয়ে কেউই ভালো চোখে দেখেননি, সাধারণ মানুষ বলতে লাগলেন, পরাণমামা দড়ি পাকাচ্ছেন। প্রতাপচাঁদ উঠতে বসতে খালি শুনছেন, সিংহাসনে প্রতাপচাঁদ কী করে বসেন। একবার দেখি। বসবে অষ্টম গর্ভের ওই সন্তানটি। তিনিও বলতে শুরু করলেন, তোমরা লিখে রাখো–আমার গদিতে বসবে পরাণের ছেলে। এরফলে পরাণবাবুরই সুবিধে হল।

তাঁর ষড়যন্ত্রের শেকড় আরও গভীরে চলে গেল। বসন্তকুমারীর সঙ্গে তেজচাঁদের বিয়ের আগে থেকেই দুজনের সম্পর্ক তিক্ত হতে শুরু করেছিল। বসন্তকুমারীকে ভেট দেওয়ার পর থেকে সাপে নেউলে সম্পর্ক হয়ে দাঁড়াল।

প্রতাপচাঁদ নিজের ভাবমূর্তি বদলাবার জন্য রাজকার্যে মন দিয়েছিলেন। সেই সময়ে। জমিদারি রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত যদি না প্রতাপচাঁদ তাঁর আট আইনটি সরকারকে দিয়ে বলবৎ করাতেন। বর্ধমান রাজাদের বিরাট জমিদারি। যথাসময়ে খাজনা জমা দেওয়া এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। অতি কুখ্যাত সূর্যাস্ত আইনে জমিদারদের জমিদারি কখন যায়, কখন থাকে তার নিশ্চয়তা ছিল না। অধিকাংশ জমিদারের পরমায়ু চার বছরের বেশি হত না। প্রতাপচাঁদের মাথা থেকেই বেরোল, সরকারি খাজনা আদায় না করে জমিদারি ভাগ ভাগ করে এক-একজন জমিদারকে পত্তনি দেবেন। সূর্যাস্ত আইনের মতোই চুক্তি। ঠিক সময়ে খাজনা দিতে না পারলে সেই পত্তনি অন্য জমিদারকে নিলাম করা হবে। আর সেই টাকা থেকে মিটবে সরকারের খাজনা। এরফলে বর্ধমান রাজের জমিদারি শুধু পাকা হল না আয়ত্ত বেড়ে গেল অনেক গুণ।

একদিকে এই কৃতিত্ব অন্যদিকে প্রতাপচাঁদের উচ্ছঙ্খল স্বভাব। তেজচাঁদের কানে পরাণবাবুর ফুসমন্তর। অন্তিম সময়ে দেখা গেল পিতা-পুত্রের বাক্যালাপ পর্যন্ত বন্ধ। আট আইনের প্রণেতা প্রতাপচাঁদকে সবাই দেখলেন। এইবার প্রতাপচাঁদের আর একটি রূপ– ইংরেজ সিভিল সার্ভেন্ট দেখলেই বেধড়ক পেটান। তিনি একজন ঐতিহাসিকের লেখায় পড়েছিলেন, পলাশির যুদ্ধে মিরজাফর হঠাৎ যুদ্ধ থামিয়ে না দিলে ইংরেজদের বাহাদুরি বেরিয়ে যেত। সেই রাগে বলশালী প্রতাপচাঁদ ইংরেজ রাজকর্মচারী দেখলেই পেটাতেন। একবার পথে তাঁর সঙ্গে একজন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের দেখা হয়েছিল। তিনি রাস্তার মাঝখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রতাপচাঁদের গাড়ি দেখে তিনি রাস্তা ছাড়েননি। প্রতাপচাঁদ সঙ্গে সঙ্গে সাহেবকে রাস্তায় নামিয়ে আগাপাশতলা বেত দিয়ে পিটিয়েছিলেন। এই অপরাধের জন্য প্রতাপচাঁদের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বের হয়েছিল।

ইংরেজ রাজকর্মচারীদের পেটালেও সাহেবদের সঙ্গে তাঁর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। একসঙ্গে বসে মদ্যপান করতেন। মেদেয়িরা মদটি তাঁর ভীষণ প্রিয়। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও চোস্ত ইংরেজি বলতেন। এক ইংরেজ ডাক্তার স্কটের সঙ্গে তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল। রাজার ছেলে হলেও অত্যন্ত মিশুকে ছিলেন। দেশি-বিদেশি সকলের সঙ্গেই গড়ে উঠত আত্মীয়তা। তাঁর কতকগুলি আড্ডার স্থল ছিল। যেমন সালকিয়া, তেলেনিপাড়ার রামধনবাবুর বাড়ি। এই জায়গাটি ছিল ভদ্রেশ্বরে। রামধনের বৈঠকখানায় মজলিশ বসত। চুঁচড়োর রাজবাড়িতেও যেতেন। দিনেমারের গভর্নর বারবেক সাহেবের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। এইখানেই আর-একজন ছিলেন হাজি আবু তালিব। সিঙ্গুরের নবাববাবুর সঙ্গে তাঁর ভীষণ খাতির। মুসলমান হলেও নবাববাবু প্রতি বছর দোলের দিন বর্ধমানের ফাগ খেলতে আসতেন। একবার এত ফাগ নিয়ে গিয়েছিলেন, পনেরো দিনেও শেষ করা যায়নি। শেষে বস্তা বস্তা ফাগ বাঁকা নদীর জলে ফেলে দিলেন। নদীর জল টকটকে লাল। স্থানীয় মানুষ কয়েকদিন সেই জল ব্যবহার করতে পারেননি। নবাবের এই নবাবির পরিণাম–তাঁর স্ত্রী বৃন্দাবনে ভিক্ষে করে শেষ জীবন কাটিয়েছিলেন।

প্রতাপচাঁদ যখন বিষয়কর্মে মন দিলেন তখন পরাণবাবু কায়দা করে তাঁকে সেই কাজ থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতেন। প্রতাপচাঁদ বুঝেছিলেন, এই পরাণমামা কী চাইছেন! তিনি কৌশলে তাঁর পিতার কাছ থেকে সমস্ত বিষয়ের দানপত্র লিখিয়ে নিয়েছিলেন। পরাণবাবু খুব চেষ্টা করেছিলেন সেটিকে খারিজ করাতে। কিন্তু তিনি কিছুই করতে পারলেন না। আর তখনই তাঁর পরমাসুন্দরী কন্যা বসন্তকুমারীকে রাজার ভোগে পাঠিয়ে দিলেন।

হঠাৎ প্রতাপচাঁদের ভীষণ পরিবর্তন এল। ইতিমধ্যে তিনি সাধক কমলাকান্তের সঙ্গলাভ করেছেন। মানসিক পরিবর্তন আসা স্বাভাবিক। ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে গুটিয়ে আনছেন। হঠাৎ একদিন তিনি রাজবাড়ি থেকে অদৃশ্য হলেন। তেজচাঁদ এইবার বুঝতে পারলেন, একমাত্র এই পুত্রটির প্রতি তাঁর কী মমতা! কোথায় প্রতাপচাঁদ। একদিন এক মুসলমান আমলা এসে জানালেন, প্রতাপচাঁদের খবর তিনি জানেন। তিনি রাজমহলে আছেন। সঙ্গে সঙ্গে রাজকর্মচারীদের পাঠানো হল। তাঁরা প্রতাপচাঁদকে ধরে আনলেন। রাজবাড়িতে এলেও তাঁর বিমর্ষতা গেল না। তেজচাঁদ রোজ পুত্রকে কাছে বসিয়ে আদর করতেন, বোঝাতেন। প্রতাপ নিরুত্তর।

একদিন সকালে উঠে প্রতাপ খানসামাদের বললেন, আজ আমি নতুন মহলে চান করব। তিনি শখ করে একটি হামাম তৈরি করিয়েছিলেন। সেটি একবারও দেখতে যাননি। সেদিন কী খেয়াল হল! খানসামারা সেখানকার বিভিন্ন প্রণালীতে জল ভরে দিলেন। সবকটা ফোয়ারা খুলে দিলেন। জলের শব্দ বাইরে থেকে শোনা যেতে লাগল। প্রতাপচাঁদ তাঁর সাধের স্নানঘরে প্রবেশ করলেন। প্রায় এক প্রহর হয়ে গেল, তখনও তিনি বেরোলেন না। যখন বাইরে এলেন তখন চোখ দুটো টকটকে লাল, সারা শরীর কাঁপছে।

বিকেলেই রাজবাড়ির বাইরে খবর ছড়িয়ে পড়ল–প্রতাপচাঁদ ভীষণ অসুস্থ। ডাক্তার-বদ্যির আসা যাওয়া। একজন মুসলমান চিকিৎসক প্রতাপের খুব প্রিয় ছিলেন। তিনি তাঁরই কথা শুনতে লাগলেন। অসুখ দিন দিন বেড়েই চলল। শেষে বর্ধমানের সিভিল সার্জেন ডাক্তার কুলটার এলেন। খবর বেরোলসায়েব ডাক্তার কোনও ব্যবস্থা না করেই চলে গেছেন। ঘটনাটা ঠিক নয়, ডাক্তার কুলটার প্রতাপের কপালে দশ-বারোটা জোঁক বসাতে চেয়েছিলেন। বৃদ্ধ রাজা ও প্রতাপচাঁদ–দুজনেই আপত্তি জানানোয় ডাক্তার রাগ করে চলে গেছেন। সেকালের ডাক্তারদের প্রায় সংস্কারে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল–সব ব্যাপারেই জোঁক প্রয়োগ। ইংল্যান্ডে ডাক্তারদের একটা নামই হয়ে গিয়েছিল লিক অর্থাৎ জোঁক।

সেইদিনই বিকেলের দিকে প্রতাপচাঁদ বললেন, আমার গঙ্গাযাত্রার ব্যবস্থা করো। এত তাড়াতাড়ি তিনি চলে যাবেন এমন কারওরই মনে হল না। অবস্থা অতটা খারাপ নয়। কবিরাজ রাজবল্লভ এলেন। নাড়ি দেখে গঙ্গাযাত্রায় সায় দিলেন। প্রতাপকে নিয়ে যাওয়া হল কালনায়। সঙ্গে বৃদ্ধ মহারাজও রয়েছেন। আত্মীয় স্বজনদের কেউই গেলেন না; স্ত্রী লোকরা তো নয়ই। কালনায় পৌঁছে তাঁরা কয়েকদিন রাজবাড়িতে রইলেন। এইবার শেষ প্রহর। উপস্থিত। একদিন রাত দেড়টার সময় তাঁকে পালকি করে গঙ্গার তীরে নিয়ে যাওয়া হল। ঘাটটি ঘেরা হল কানাত দিয়ে। প্রতাপের দেহ অন্তৰ্জলিতে। গঙ্গার ঘাটে ছোটখাটো একটা ভিড়। সকলেই কানাতের বাইরে। ঘোর অন্ধকার। আট-দশটা মশাল জ্বলছে। একটা বড় জায়গার অন্ধকার এই আলোতে তেমন কাটছে না। জলের ধারে একটি তাঁবু। সেখানে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বসেছেন। পৌষ মাস, প্রচণ্ড ঠান্ডা। রাত দুটো প্রতাপ চলে গেলেন। রাত তিনটেয় চিতা জ্বলে উঠল। রাজা তেজচাঁদ বর্ধমান যাত্রা করলেন।

ভিন্ন ইতিহাসে বলা হচ্ছে, প্রতাপচাঁদ যখন মরণাপন্ন তখন তেজচাঁদের শ্যালক ও শ্বশুর পরাণচাঁদ মহারাজের ষষ্ঠ মহিষী অর্থাৎ তাঁর ভগ্নী কমলকুমারীর সাহায্যে জীবন্মত প্রতাপচাঁদকে সকার করার উদ্দেশে কালনার গঙ্গার তীরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু চিতায় তুলে দাহ করার আগেই প্রবল ঝড়বৃষ্টি শুরু হল। পৌষের রাত। শ্মশান যাত্রীরা শবদেহ ফেলে রেখে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে স্থান ত্যাগ করলেন। দুর্যোগ থেমে যাওয়ার। পর এসে দেখলেন লাশ নেই। প্রতাপচাঁদের দুই স্ত্রীকে বিধবার বেশ ধারণ করানো হল। এইবার পরাণচাঁদের দ্বিতীয় চাল। তিনি তাঁর ভগ্নী মহারানি কমলকুমারীকে দিয়ে তেজচাঁদ বাহাদুরকে দত্তক পুত্র গ্রহণের জন্য চাপ দিতে লাগলেন। মহারাজা কিছুতেই দত্তক গ্রহণ করবেন না। তাঁর স্থির বিশ্বাস–প্রতাপ ফিরবেই। পরাণচাঁদ ও কমলকুমারী বোঝালেন, আপনার বয়েস হয়েছে। হঠাৎ মারা গেলে উত্তরাধিকারীর অভাবে পুরো রাজতৃটাই সরকারের খাস হয়ে যাবে। তিনি চুনীলাল মতান্তরে কুঞ্জবিহারীকে দত্তক নিতে বাধ্য হলেন। রাজার মৃত্যুর পর মাহতাবচাঁদ বাহাদুর নামে বর্ধমানের সিংহাসনে অভিষিক্ত হলেন। রাজা হিসেবে তিনি অপূর্ব দক্ষতার পরিচয় রেখে গেছেন। প্রতাপের মৃত্যুর ঠিক চোদ্দো বছর পরে হঠাৎ এক সাধুর আবির্ভাব। বর্ধমান ইতিমধ্যে অনেক বদলে গেছে। ইংরেজরা ভালো ভালো রাস্তা তৈরি করেছেন। ধারে ধারে বিলিতি ফুলের বাগান। কৃষ্ণসায়রের পাড় ঝকঝকে তকতকে। জঙ্গল কেটে সাফ। জায়গায় জায়গায় সুন্দর সুন্দর উদ্যান। সেইসব উদ্যানের নামও খুব আকর্ষণীয়। রাজবাড়ির বাইরেটা অপরিষ্কার হলেও ভেতরে অনেক নতুন মহল তৈরি হয়েছে। চিড়িয়াখানাটা নেই। সন্ন্যাসী সোজা রাজবাড়িতে প্রবেশ করলেন। চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখলেন। কর্মচারীরা সব দেখেও কিছু বলছেন না। সন্ন্যাসীও নির্বাক। তিনি চলে এলেন বারমহলে। বহুঁকাল মেরামত হয়নি। দু-একটি দরজা ভাঙা। জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়েছে। তিনি ঠিক করলেন–এইখানেই থাকবেন। এইবার কয়েকজন রাজকর্মচারী এসে তাঁকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন।

নির্বিকার সন্ন্যাসী গোলাপ বাগে গিয়ে হাজির হলেন। ভেতরে ঢুকলেন না, গেটের একপাশে বসে রইলেন। অদূরেই গোপীনাথ ময়রার দোকান। তাঁর দিকে চোখ পড়তেই ময়রা বলে উঠলেন, একি আমাদের ছোট মহারাজ না! সন্ন্যাসী তাকালেন। গোপীনাথ ছুটে এসে গলায় কাপড় দিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে জোড়হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন। সন্ন্যাসী তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন। দেখতে দেখতে ভিড় জমে গেল। শহরের সর্বত্র দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। সংবাদ–ছোট মহারাজ ফিরে এসেছেন। চতুর্দিক থেকে পিলপিল করে লোক আসতে লাগল। ছোট মহারাজের রানিদের কানে খবরটা যেতেই তাঁরা পুরোনো এক দাসীকে পাঠালেন। দাসী ফিরে এসে চোখের জল মুছতে মুছতে বললে, আর সে বর্ণনাই, সে মূর্তি নাই, কিন্তু গাল ভরা সেই হাসিটি রয়েছে। ছিলেন মহারাজাধিরাজ আজ সন্ন্যাসী। একেই বলে মা, যে রাজ্যে রাজা ছিলেন, সেই রাজ্যে মেগে খেলেন। রাজবাড়ির পুরনো আমলারা দেখতে এলেন। তাঁদের একজন–মুহুরী, কুঞ্জবিহারী ঘোষ। রাজবাড়িতে ফিরে এসে পরাণবাবুর মেজছেলে তারাচাঁদকে বললেন, বাবু, আর দেখতে হবে না। আমাদের ছোট মহারাজ সত্যি, সত্যি ফিরে এসেছেন। তারাচাঁদ এই খবরটি বাবাকে জানালেন। পরাণবাবু সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন লেঠেলকে পাঠালেন। তাদের হম্বিতম্বিতে সন্ন্যাসী সেই জায়গা ছেড়ে চলে গেলেন কাঞ্চননগরে। পরাণবাবু ছাড়ার পাত্র নন, আবার লেঠেল পাঠালেন। তারা সন্ন্যাসীকে দামোদর পার করিয়ে দিয়ে এল। কুঞ্জবিহারীর চাকরি গেল।

সেই ভবিষ্যদ্বাণী ফলে গেল অক্ষরে অক্ষরে। পরাণবাবুর ছোটছেলে তেজচাঁদ বাহাদুরের। মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসলেন। প্রতাপচাঁদ রাজার লেঠেলদের তাড়া খেয়ে অবশেষে এলেন বর্ধমান রেল স্টেশনের উত্তরে একটি পরিত্যক্ত স্থানে। ধুনি জ্বালিয়ে কিছুদিন থাকার পর তাঁর একটি ডেরা তৈরি হয়ে গেল। তখন পরাণচাঁদ জেলাশাসককে হাত করে সন্ন্যাসীকে আবার তাড়ালেন। তুলে দিয়ে এলেন কালনার রাস্তায়। রটিয়ে দিলেন, এ মিথ্যেবাদী, একটা পয়লা নম্বরের জোচ্চোর। সাধু আর ফিরলেন না। এইবার সাধু যে জায়গায় ধুনি জ্বালিয়ে বসলেন পরবর্তীকালে সেই অঞ্চলটির নাম হল বাজে প্রতাপপুর। প্রতাপচাঁদের বন্ধু-বান্ধবের অভাব ছিল না। বিষ্ণুপুরের রাজা ক্ষেত্রমোহন সিংহ তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। প্রতাপচাঁদের দাবি প্রমাণ করার জন্য তিনি হুগলি কোর্টে একটি মামলা দায়ের করলেন। মামলা চলল বেশ। কয়েকবছর। বহু সাক্ষী পক্ষে-বিপক্ষে সাক্ষ্য দিলেন। মামলা দাঁড়াল না। প্রতাপচাঁদ রাজপদের অধিকার চিরতরে হারালেন।

সন্ন্যাসী প্রতাপচাঁদ মানুষের খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর সৌম্য চেহারা। সুমিষ্ট ব্যবহার, বহুরমণী তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। প্রতাপচাঁদকে কয়েক বছরের জন্য জেলেও যেতে হয়েছিল। তিনি শান্ত গলায় বিচারপতিকে একটি সুন্দর প্রশ্ন করেছিলেন–আমি এখনও বুঝতে পারলুম না, কী অপরাধে আপনি আমাকে দণ্ড দিলেন। বিচারপতি বলেছিলেন, তোমার আসল নাম আলোকশা। মহারাজাধিরাজ প্রতাপচাঁদ বলে লোক জুটিয়েছ। রাজ্যের। শান্তি নষ্ট করেছ। আমি তোমাকে কয়েক বছরের জন্য জেলে পাঠালুম। ১৮৩৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের যে দিনে তিনি কারামুক্ত হলেন সেদিন হুগলিতে এক মহাসমারোহ, কলকাতা থেকে বহু সম্রান্ত ব্যক্তি তাঁকে নিতে এসেছিলেন। পরের দিনটিতে ছিল অর্ধোদয় যোগ। সেই উপলক্ষে বর্ধমান আর বাঁকুড়ার বহু পুণ্যার্থী হুগলি ও ত্রিবেণীতে সমবেত হয়েছিলেন। তাঁরাও সংবর্ধনায় যোগ দেন। পঞ্চকোটের রাজা ও বিষ্ণুপুরের রাজা–দুজনেই এসেছিলেন। তাঁরা জেলখানার গেটে হাজির হলেন। অঞ্চলের ধনীরা দেশি বাদ্য, ইংরেজি বাদ্য, হাতি, ঘোড়া, রেসালা নিয়ে জেলখানার সামনে হাজির। প্রতাপচাঁদ বেরনো মাত্রই হাতির ওপর স্থাপিত নহবত বেজে উঠল। চতুর্দিকে কাড়ানাকাড়ার শব্দ, হরিধ্বনি, তিন-চার দল ইংরেজি বাদ্য বেজে উঠল। সবাই মিলে প্রতাপচাঁদকে পালকির সুখাসনে বসালেন। পালকিবাহকদের কাঁধে চারজন বালক, চামর ব্যজন করছে। শতশত পতাকা আগে আগে। নগর প্রদক্ষিণ শেষ করে সাধু জাহাজে উঠলেন। চলে এলেন কলকাতায়। তাঁর থাকার। জায়গা নির্ধারিত হয়েছিল। রাধাকৃষ্ণ বসাকের বাড়িতে।

প্রথমে কলকাতার চাঁপাতলা। সেখান থেকে প্রতাপচাঁদ এলেন কলুটোলার গোবিন্দ প্রামাণিকের বাড়িতে। এই ব্যক্তির আশ্রয়ে দু-তিনমাস থেকে তাঁকে নিঃস্ব করে দিলেন। গোবিন্দবাবু এই জাল রাজার ওপর জুয়ার দান ধরেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল তিনি আসল প্রতাপচাঁদ। যথাসময়ে রাজ্য ফিরে পাবেন এবং তাঁরও বরাত খুলে যাবে। প্রতাপচাঁদ এরপর গেলেন শ্যামপুকুরে। কিছুদিনের মধ্যেই ইংরেজ সরকার লাহোরের লড়াইতে জড়িয়ে পড়ল। সরকারের নজর পড়ল প্রতাপচাঁদের ওপর। তিনি কোম্পানির রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে গেলেন চন্দননগরে ফরাসিদের আশ্রয়ে। কয়েকবছর থাকার পর এলেন শ্রীরামপুরে। এইখানে তিনি হলেন ঠাকুর। সেইরকম তাঁর সাজপোশাক চালচলন। প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় বেশ্যারা এসে পঞ্চপ্রদীপ আর ঘণ্টা বাজিয়ে তাঁকে আরতি করত। তিনি জ্যান্ত ঠাকুর হয়ে সিংহাসনে বসে থাকতেন। অনেকেই ভাবলেন রাজ্যহারা রাজার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

কিন্তু তাঁর কথাবার্তা ও চালচলনে পাগলামির কোনও চিহ্ন ছিল না। বরং অসাধারণ বুদ্ধিমান ও সর্বশাস্ত্রজ্ঞ এক ব্যক্তি। বিলেতের রাজনীতিতে তাঁর অসাধারণ জ্ঞান। সমস্ত দেশের ইতিহাস তাঁর নখাগ্রে। সবচেয়ে ভালো বুঝতেন রুশ পলিটিক্স। বেদান্ত শাস্ত্রেও মহাপণ্ডিত।

এইটা তাঁর একটা দিক। আর অন্যদিকে বিচিত্র তাঁর পাগলামি। কখনও তিনি নিজেকে শালগ্রাম শিলা মনে করতেন। সর্বদা বসে থাকতেন ঝারায়। লোকের সচন্দন পুস্পাঞ্জলি নিতেন। পূজা গ্রহণ করতেন, বৈকালিও খেতেন। অনুগামীদের মধ্যে স্ত্রীলোকের সংখ্যা বেশি হলেও পুরুষের সংখ্যাও কম ছিল না। বাবাজিরা এসে তাঁর দরজায় পড়ে থাকতেন। স্ত্রীলোকদের ধারণা হয়েছিল এই মানুষটি সাক্ষাৎ দেবতা। তিনি যে মন্ত্র দিতেন তা বিষ্ণু। মন্ত্রও নয়, শক্তি মন্ত্রও নয়। তাঁর দীক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি ও অর্চনা করার পদ্ধতি একদম ভিন্ন। এই নতুন ধর্মটি পরবর্তীকালে হয়ে দাঁড়াল তঙ্কালের বিখ্যাত ঘোষপাড়ার দল অর্থাৎ কর্তাভজা সম্প্রদায়। এখন এই লেখক যেখানে বসবাস করেন তাঁর দূরেই ময়রাডাঙার একটি বাড়িতে ১৮৫২ অথবা ৫৩ সালে এই সাধুর জীবনাবসান হয়। সেই সময় তিনি সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ। সঞ্জীবচন্দ্র লিখছেন, তাঁহার যাত্রার সময় চক্ষের জল মুছিবার কেহ ছিল না।

এইবার কাহিনি মুখ ফেরাবে কলকাতার দিকে। বর্ধমানে মঞ্চ প্রস্তুত। আবির্ভূত হবেন দক্ষিণারঞ্জন। তিনি এখনও রাজা হননি। কলকাতার উচ্চ আদালতে আইন ব্যবসা শুরু করেছেন। আগেই বলা হয়েছে ছাত্র অবস্থায় তাঁর বিবাহ হয়েছিল হরচন্দ্র ঠাকুরের সুন্দরী কন্যা জ্ঞানদাসুন্দরীর সঙ্গে। তাঁর একটি মাত্র কন্যাসন্তান মুক্তকেশী। এই মেয়েটি হওয়ার পরই জ্ঞানদাসুন্দরীর মাথা খারাপ হয়ে গেল। দক্ষিণারঞ্জনের দাম্পত্য জীবন খুবই দুঃখের। ওদিকে বর্ধমানে আর একটি মেয়ের জীবনও তথৈবচ। তাঁর নাম মহারানি বসন্তকুমারী। পিতা পরাণবাবুর লোভের বলি। বৃদ্ধ রাজার কাছে মেয়েটিকে সমর্পণ করে ছেলের ভবিষ্যৎ তৈরি করলেন। যুবতী বসন্তকুমারীর কী হল তা দেখার দরকার নেই। বৃদ্ধ রাজা প্রয়াত, বসন্তকুমারীর জীবনে কিছুই জুটল না। বর্ধমানে বসন্তপঞ্চমীতে সেইসময় বিরাট উৎসব হত। এখনও হয়। বহু বড় বড় মানুষ নিমন্ত্রিত হতেন। একটি উৎসবে দক্ষিণারঞ্জনও নিমন্ত্রিত হলেন। তিনি সাদরে সেই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে কিছুদিনের জন্য বর্ধমানে গেলেন। মহাতাব চাঁদ তখনও সাবালক হননি। রাজকার্য চালাচ্ছেন কমলকুমারী আর তাঁর কুখ্যাত ভ্রাতা পরাণবাবু। বলা যায় পরাণবাবুই রাজা। দক্ষিণারঞ্জনের জীবনীকার মন্মথনাথ ঘোষ লিখছেন, মহারানি বসন্তকুমারী বিষয়ী পিতার স্বার্থসিদ্ধির জন্য নামে দুইদিনের জন্য মহারানি হইলেন বটে কিন্তু তাঁহার ন্যায় দুঃখিনী আর কে ছিল। আইনজ্ঞ দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই প্রেম। বসন্তকুমারী অতি সুন্দরী। দক্ষিণারঞ্জনও কিছু কম যান না। জীবনীকার লিখছেন, তেজচন্দ্র বসন্তকুমারীর নামে কিছু সম্পত্তি রাখিয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু সেই বিষয়ের উপস্বত্বও তিনি ভোগ করিতে পাইতেন না। দক্ষিণারঞ্জনকে সদর আদালতের উঁকিল জানিয়া মহারানি বসন্তকুমারী তাঁহার সহিত গোপনে বিষয় উদ্ধারের পরামর্শ করিলেন। স্থির হইল, মহারানি বসন্তকুমারী কলিকাতায় আগমন করিয়া বিষয়ের জন্য সদর আদালতে আবেদন করিবেন। মহারানি কমলকুমারী তখন বর্ধমানের সর্বময়ী কত্রী। তিনি বসন্তকুমারীর সঙ্কল্পের কথা জানিতে পারিলে অনর্থ ঘটিবে এইজন্য মহারানী বসন্তকুমারী গোপনে দুইজন বিশ্বস্তা দাসী ও একজন পুরুষ আত্মীয় সমভিব্যাহারে বর্ধমান পরিত্যাগ করিলেন।

দক্ষিণারঞ্জনের শত্রুর অভাব ছিল না। এবং তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রু ছিলেন টমাস এডওয়ার্ডস। তিনি ডিরোজিওর জীবনী লিখেছিলেন। বসন্তকুমারী ও দক্ষিণারঞ্জনের মধ্যে গভীর একটি প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল এই উৎসবের রাতেই। দুজনের মধ্যে বিষয়সম্পত্তি সম্পর্কে আলোচনাও হয়েছিল। সেই রাতের পর ঘন ঘন দেখা সাক্ষাৎ হওয়াও স্বাভাবিক। আর লোকমুখে সেটি পল্লবিত হয়েছিল। রাজবাড়ির মুচমুচে কুৎসা হিসেবে, ছোটরানির প্রেম। দক্ষিণারঞ্জন ধোয়া তুলসীপাতা ছিলেন না। আবার একজন জঘন্য চরিত্রহীন মানুষও নন। তাঁর শরীরেও বনেদি রাজরক্ত। এই টমাস সাহেব দক্ষিণারঞ্জনের। এই পর্বটিকে যেভাবে চিত্রিত করেছেন তার মধ্যে সত্যের চেয়ে মিথ্যাই বেশি। তিনি একটি সুযোগ নিয়ে সম্পূর্ণ বাজারে কাহিনি পরিবেশন করে গেছেন। সেই কাহিনিটির অনুবাদ এইরকম: মহারানি বসন্তকুমারী অতি অল্প বয়সে বিধবা ও লিতচরিত্র হন,তাঁহার দেওয়ান দক্ষিণারঞ্জনের সহিত অবৈধ প্রেমে আবদ্ধ হন এবং একদিন সুযোগ পাইয়া তাঁহার সহিত রাজবাড়ি ত্যাগ করেন। কিন্তু পথিমধ্যে রাজানুচরগণ কর্তৃক ধৃত হইয়া পুনরায় রাজপ্রাসাদে আনীত হন। কিছুকাল পরে মহারানি তাঁহার বিষয়সংক্রান্ত কোনও মোকদ্দমার জন্য কলিকাতায় আগমন করেন এবং দক্ষিণারঞ্জনের সহিত মহারানি বসন্তকুমারীর তথাকথিত বিবাহ হয়। মহারানি বসন্তকুমারী তাঁহার মৃত্যুকাল পর্যন্ত দক্ষিণারঞ্জনের সহিত সহধর্মিণীর ন্যায় বাস করিয়াছিলেন। দক্ষিণারঞ্জনের অসৎ চরিত্রের জন্য তাঁহার সতীর্থগণ তাঁহার সংস্রব পরিত্যাগ করিয়াছিলেন।

ইম্পিরিয়্যাল লাইব্রেরির ভূতপূর্ব সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইলিয়ট ওয়াল্টার ম্যাজও এডওয়ার্ডসের বই অবলম্বন করে লিখলেন, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় যখন দেওয়ান ছিলেন সেইসময় যুবতী বিধবা রানির অনুগ্রহভাজন হন এবং অবশেষে তাঁহাকে লইয়া পলায়ন করেন। রাজবাটি হইতে প্রেরিত কয়েকজন অশ্বারোহী পলাতক দম্পতির পশ্চাদ্ধাবন করে এবং পথিমধ্যে দক্ষিণারঞ্জনকে গ্রেপ্তার করিয়া গুরু প্রহারে জর্জরিত করিতে আরম্ভ করে, তাহারা বোধহয় তাঁহাকে হত্যা করিত কিন্তু ঘটনাক্রমে এইসময় তিনজন ইউরোপীয় ধর্মপ্রচারক ডাকগাড়িতে কলিকাতা হইতে অন্যত্র যাইতে ছিলেন, ইঁহারা ভয় প্রদর্শন করাতে অশ্বারোহীরা দক্ষিণারঞ্জনকে ছাড়িয়ে দেয় এবং রানিকে লইয়া রাজবাড়িতে প্রত্যাবৃত্ত হয়। কিন্তু অনতিকাল পরে কোনও মোকদ্দমার জন্য রানি কলিকাতায় আগমন করেন এবং দক্ষিণারঞ্জনের সহিত মিলিত হন। যেরূপ প্যারিনগরে নেপোলিয়ান পোপ সপ্তম পায়াসকে তাঁহার অভিষেকক্রিয়া করিতে বাধ্য করিয়াছিলেন সেইরূপ হিন্দু আচারানুসারে বিধবা রানির বিবাহ অসম্ভব হইলেও দক্ষিণারঞ্জন তাঁহার এক বেতনভোগী ব্রাহ্মণের দ্বারা রানির সহিত বিবাহিত হইয়াছিলেন।

দক্ষিণারঞ্জনের জীবনীকার মন্মথনাথ ঘোষ এই দুটি বিবরণই অস্বীকার করেছেন। প্রকৃত ঘটনাকে বিকৃত করা হয়েছে। এডওয়ার্ডস লোকটি বিশেষ সুবিধের ছিলেন না। তিনি যত বড় ঐতিহাসিক তার চেয়ে বেশি মিথ্যাবাদী। যে-কোনও প্রতিষ্ঠিত মানুষ সম্পর্কে কুৎসা রটনা করে বাজার গরম করতে ভালোবাসতেন। দক্ষিণারঞ্জন যখন লখনউতে ছিলেন তখন এই এডওয়ার্ডস তাঁর এবং অন্য আর একজন কমিশনারের নামে যাচ্ছেতাই অপপ্রচার করেছিলেন। দক্ষিণারঞ্জন তখন এডওয়ার্ডসকে তিরস্কার করে উপযুক্ত শাস্তি পাইয়ে লখনউ ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন। সেই রাগ তিনি এই সুযোগে উগরে দিলেন। দ্বিতীয় কথা, কোন ভিত্তিতে তিনি দক্ষিণারঞ্জন সম্পর্কে যা তা লিখলেন তার কোনও উল্লেখ করতে পারেননি। একটি কথাতেই সেরে দিয়েছেন–জনশ্রুতি। বাঙালির স্বভাবই হল পরনিন্দা। যে-কোনও সামান্য ঘটনাকে পল্লবিত করে এমন পর্যায়ে পৌঁছে দেয় যখন তা আর প্রকৃত ইতিহাস না। হয়ে সুস্বাদু উপন্যাস হয়ে দাঁড়ায়। এডওয়ার্ডসের বর্ণনা পড়লেই বোঝা যায়, পুরোটাই তাঁর ইচ্ছাকল্পিত। দক্ষিণারঞ্জন যে কত বড় মানুষ, কত ভালো ভালো কাজ করেছেন তার কোনও উল্লেখ নেই। রানি বসন্তকুমারীর সঙ্গে তাঁর ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু দক্ষিণারঞ্জন একজন লম্পট এমন কথা তো ইতিহাস স্বীকার করবে না। একের পর এক মিথ্যা কথা বলেছেন। প্রথম, দক্ষিণারঞ্জন কখনও বর্ধমান রাজের দেওয়ান ছিলেন না। এডওয়ার্ডসের বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে। তিনি লিখছেন, মহারানি বসন্তকুমারীর মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি ও দক্ষিণারঞ্জন স্বামী-স্ত্রীর ন্যায় বাস করিতেন। ঐতিহাসিক এডওয়ার্ডস খবরই রাখতেন না, কে আগে মারা গেছেন। দক্ষিণারঞ্জনের মৃত্যুর পর রানি বসন্তকুমারী ১৫/১৬ বছর জীবিত ছিলেন। সেই সময় দক্ষিণারঞ্জনের সতীর্থদের সঙ্গে তাঁর অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক ছিল। দক্ষিণারঞ্জনের একজন বাল্যবন্ধুই তাঁর সংস্রব ত্যাগ করেছিলেন। তিনি কে তা সহজেই অনুমান করা যায়। সেই আচার্য কৃষ্ণমোহন। বন্দ্যোপাধ্যায়। দক্ষিণারঞ্জন অল্পবয়সেই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রচুর সম্পত্তি লাভ করেছিলেন। বিদ্যায় ও বুদ্ধিতে তাঁর বিখ্যাত সতীর্থদের চেয়ে কোনও অংশে কম ছিলেন না। ডেভিড হেয়ার, ডিরোজিও ও ডক্টর ডফ তাঁকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। কৃষ্ণমোহনের এইটাই হয়েছিল গাত্রদাহ। এডওয়ার্ডস তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায় যে স্বীকারোক্তি করেছেন সেইটিই তাঁর বিরুদ্ধে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। তিনি লিখছেন, I have to acknowledge with many thanks, the very kind manner in which I have been aided in this bit of work by the revd Krishna Mohun Banerjea, L.L. D. & C. & C.93 স্বীকারোক্তিটি দেখে দক্ষিণারঞ্জনের প্রকৃত বন্ধুরা বুঝতেই পেরেছিলেন কৃষ্ণমোহন পণ্ডিত ও জ্ঞানী ব্যক্তি হলেও অত্যন্ত অকৃতজ্ঞ। দক্ষিণারঞ্জন ছিলেন তাঁর বিপদের বন্ধু ও আশ্রয়দাতা। সে কথা তিনি মনে রাখেননি। এর পরেও এডওয়ার্ডসের আর একটি উক্তি। তিনি লিখেছেন, দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে পরিচয়ের আগেই রানির চরিত্র লন হয়েছিল। অসাধারণ সিদ্ধান্ত। রাজ অন্তঃপুরের অসূর্যম্পশ্যা। তিনি ঐতিহাসিক এডওয়ার্ডদের কৃপায় চরিত্রহীনা হলেন। ইচ্ছে। করলে মহারানি মানহানির মামলাও করতে পারতেন। কিন্তু উপায় ছিল না।

জীবনীকার মন্মথবাবু সমস্ত অনুসন্ধান করে প্রকৃত যা ঘটেছিল তার একটি বিবরণ রেখে। গেছেন। দক্ষিণারঞ্জন কখনও বর্ধমান রাজের দেওয়ান ছিলেন না। বসন্ত পঞ্চমীতে বর্ধমানে তখন মহাউৎসব হইত এবং এখনও হইয়া থাকে। এইরূপ এক উৎসবে নিমন্ত্রিত হইয়া দক্ষিণারঞ্জন বর্ধমানে গমন করেন এবং কিছুকাল তথায় অবস্থিতি করেন। এরপরে যা লিখছেন তা সঞ্জীবচন্দ্রের লেখারই উদ্ধৃতি। পুনরুল্লেখের প্রয়োজন নেই। পরবর্তী অংশটি উল্লেখ করতেই হয় প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য। এখানেও বিশেষ কয়েকটি দিক পরপর তুলে। ধরলেই হবে। যেমন–১) তেজচন্দ্রবসন্তকুমারীর নামে কিছু সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই বিষয়ের উপস্বত্ব তিনি ভোগ করতে পাননি। ২) মহারানি কমলকুমারী তখন রাজপরিবারের সর্বময়ী কত্রী। ৩) তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কুচক্রী ভ্রাতা। ৪) দক্ষিণারঞ্জন। সদর আদালতের উঁকিল। তিনি রাজ অতিথি। ৫) মহারানি বসন্তকুমারী গোপনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। উদ্দেশ্য বিষয়ের অধিকার অর্জনের উপায় বের করা। ৬) স্থির হল মহারানি বসন্তকুমারী কলকাতায় যাবেন, বিষয়ের জন্য সদর আদালতে আবেদন করবেন। ৭) বসন্তকুমারী জানতেন, কমলকুমারীর অনুমতি নিয়ে বর্ধমান ত্যাগ করা সম্ভব নয়। ৮) দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে পরামর্শ করে স্থির হল বসন্তকুমারী গোপনে দুজন বিশ্বস্ত দাসী ও একজন পুরুষ আত্মীয়কে নিয়ে বর্ধমান ত্যাগ করবেন। দক্ষিণারঞ্জনও মহারানির অনুগমন করবেন।

মহারানি বসন্তকুমারী দক্ষিণারঞ্জনের মধ্যে এক বিশ্বস্ত বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছিলেন। রাজপরিবারে যাঁদের তিনি দেখেছিলেন তাঁরা কেউই যথেষ্ট শিক্ষিত ও উদার মানুষ ছিলেন না। বিষয়ই ছিল তাঁদের বিষয়। জমিদারি, খাজনা, লাঠালাঠি, মামলা-মোকদ্দমা এবং ভোগ। ইন্দ্রিয় বুদ্ধি প্রবল। সমাজ সংস্কার, দিঘি খনন, ফুলবাগান তৈরি, মন্দির প্রতিষ্ঠা–এইসব হল সামাজিক প্রতিপত্তি লাভের উপায়। ইংরেজ তত তাদের শাসন ক্ষমতায় স্থান দেবে না। তাই এইভাবে নিজেদের জন্য সম্মানের ব্যবস্থা করা। রাজপরিবারে পুরুষের চেয়ে নানা বয়সের মহিলার সংখ্যাই বেশি। বসন্তকুমারীর পিতা একেবারেই সুবিধের মানুষ ছিলেন না। জাল প্রতাপচাঁদ মামলার সূত্র ধরে তাঁর বদনাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। বসন্তকুমারী এক ক্যাপটিভ লেডি। অতি অসহায়। বালিকা থেকে যখন যুবতী হলেন তখন স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মধ্যে ভালোবাসা এল। দীর্ঘদেহী সুস্থ, সুন্দর এক রমণী। তিনি ভালোবাসতে চান এমন কোনও মানুষকে যাঁর মধ্যে প্রেম আছে, দায়িত্ববোধ আছে। শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান, উচ্চবংশীয়। কারণ তাঁর মধ্যে আভিজাত্য ছিল। দক্ষিণারঞ্জন ঈশ্বরপ্রেরিত, ডিরোজিওর প্রিয় ছাত্র। ধর্মবিশ্বাসী, উদার। সমাজসংস্কারক, শিক্ষার প্রসার বিশেষত স্ত্রী শিক্ষা ও স্বাধীনতার যাজ্ঞিক। বসন্তকুমারী যেন একটি দুর্গের আশ্রয় পেলেন। এখন প্রয়োজন রাজকারাগার থেকে মুক্তি। তিনি হয়তো পলাতকা, কিন্তু এমন নয় যে দক্ষিণারঞ্জন মধ্যযুগীয় কোনও ডন। জুয়ানের মতো তাঁকে অপহরণ করতে চেয়েছিলেন। বসন্তকুমারী একবারও বলেননি, আমি তোমাকে ভালোবাসছি বলেই রাতের অন্ধকারে পালাতে চাইছি। তাঁর প্রথম উদ্দেশ্য ছিল। চক্রান্তকারীদের হাত থেকে নিজের যোগ্য প্রাপ্যটুকু বুঝে নেওয়া। প্রথমবারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। দক্ষিণারঞ্জন কলকাতায় ফিরে গেলেন, এই আশ্বাস দিয়ে মামলা করব এবং তোমার প্রাপ্য আদায় করে দেব। এই তুমি কোনও সাধারণ মক্কেল নয়। সুন্দরী, স্বাধীনচেতা এক রমণী। বসন্তকুমারী যেমন এক নায়ককে দেখলেন, নায়কও দেখলেন এক সুযোগ্য নায়িকাকে। কর্মতৎপর এক মানুষ। সারা ভারত তাঁর কর্মক্ষেত্র। সুবক্তা, সুলেখক, সর্বোপরি সমাজদরদি এক মানুষ।

দক্ষিণারঞ্জন কলকাতায় ফিরেই একটি মামলা দায়ের করলেন মহারানির হয়ে। সদর আদালত থেকে একটি আদেশনামা বের করলেন। যাতে বসন্তকুমারী বিনা বাধায় কলকাতায় এসে তাঁর মামলা পরিচালনা করতে পারেন। এই আদেশবলে বসন্তকুমারী রাজপরিবারের সমস্তরকমের অসভ্যতা পাশ কাটিয়ে কোনওরকম বাধা ছাড়াই কলকাতায় এলেন। দক্ষিণারঞ্জন তাঁর উঁকিল। বসন্তকুমারী তাঁর ক্লায়েন্ট। দক্ষিণারঞ্জনের সহানুভূতি ও সমবেদনা, মহারানির গভীর বিশ্বাস ও কৃতজ্ঞতা। দুটি নদীর দুটি ধারা মিলিত হয়ে তৈরি হল একটি সংগম। কোনওরকম দেরি না করে তাঁরা এই আলগা সম্পর্ককে একটি স্থায়ী মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহী হলেন। সিদ্ধান্তটি সেকালের প্রেক্ষিতে ভয়ঙ্কর রকমের সাহসী এক ব্রাহ্মণ পুরোহিতকে আহ্বান করে হিন্দুমতে দুজনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন। দক্ষিণারঞ্জন আইন জানতেন, নিজের সমাজকে চিনতেন। এই অনুষ্ঠান যে যথেষ্ঠ আইনসিদ্ধ নয় তাও তিনি জানতেন। কারণ হিন্দু সমাজে অসবর্ণ বিধবাবিবাহ অসিদ্ধ। দক্ষিণারঞ্জন কলকাতার তদানীন্তন পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ বার্চকে সাক্ষী রেখে সিভিল ম্যারেজ করলেন। অর্থাৎ রেজিস্ট্রি হল। এই বিবাহ সম্পর্কে স্বয়ং রাজনারায়ণ বসু লিখছেন, দক্ষিণারঞ্জন বলিতেন যে, তিনি যেমন ধর্মসংস্কারক তেমনি সমাজসংস্কারক। রানি বসন্তকুমারীকে বর্ধমান হইতে কলিকাতায় আনিয়া কলিকাতার পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট বার্চ সাহেবের সম্মুখে Civil Marriage নামক বিবাহ করেন। ভাস্কর সম্পাদক গুড়গুড়ে পণ্ডিত তাহার সাক্ষী থাকেন। গুড়গুড়ে পরিতের প্রকৃত নাম গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য। লক্ষ্ণৌ অবস্থিতিকালে তিনি (দক্ষিণাবাবু) একদিন আমাকে বলিলেন যে তিনি বিধবাবিবাহ, অসবর্ণ বিবাহ ও সিভিল বিবাহ এককালে করিয়াছেন। তাঁহার ন্যায় সমাজসংস্কারক আর কে আছে? দক্ষিণারঞ্জন ব্রাহ্মণের সহিত ক্ষত্রিয় কন্যার বিবাহ ও বিধবাবিবাহ সম্পূর্ণরূপে হিন্দুশাস্ত্রানুমোদিত জ্ঞান করিতেন। আমি যখন লক্ষৌ-এ ছিলাম তাঁহার পূর্বে তাঁহার পুত্রবিয়োগ হইয়াছিল, কেবল পৌত্র বিদ্যমান ছিল। তিনি উইল না করিলেও এই পৌত্রের বিষয় পাওয়ার প্রতি তাঁহার কিছুমাত্র সন্দেহ ছিল না।

গুড়গুড়ে পণ্ডিত, ডাঃ ডি গুপ্ত এবং দক্ষিণারঞ্জনের আরও কয়েকজন বন্ধুর স্বাক্ষরযুক্ত বিবাহ সম্বন্ধীয় দলিলটি মহারানি বসন্তকুমারী তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত সযত্নে রক্ষা করেছিলেন। মহারানি ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের কোনও একসময়ে পরলোকগমন করেন। দক্ষিণারঞ্জনের জীবনীকার লিখছেন, রাজনারায়ণ বসুর মতো মানুষ যখন এই কথা লিখছেন তখন ওই কটা সাহেবের কুৎসাপূর্ণ বর্ণনার যে-কোনও ভিত্তি নেই, শুধুমাত্র চরিত্র হননের উদ্দেশ্যেই করা তা সাব্যস্ত হল। দুজনেই বড় সুখে দিন কাটিয়েছিলেন একথা ভাবতেও ভালো লাগে। এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলা দরকার, বিবাহের পর আদালতে রানির মোকদ্দমাটিও আপসে নিষ্পত্তি হল। কলকাতার কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তি যেমন মতিলাল শীল, রমাপ্রসাদ রায় এবং আরও কয়েকজন মধ্যস্থতা করে দুটি ব্যবস্থা আদায় করে দিলেন–দক্ষিণারঞ্জনের বিবাহিত স্ত্রী মহারানি বসন্তকুমারী তাঁর সঙ্গে বাস করবেন। আর মহারানি তাঁর বিষয়ের উপস্বত্ব স্বরূপ বর্ধমান রাজকোষ থেকে আজীবন পাঁচশত টাকা মাসিক বৃত্তি পাবেন। বসন্তকুমারী মৃত্যুকাল পর্যন্ত এই মাসোহারা পেয়েছিলেন।

বিবাহ হয়ে গেল দক্ষিণারঞ্জনের দ্বিতীয় বিবাহ, বসন্তকুমারীরও দ্বিতীয় বিবাহ, ৪৬ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে দুজনে সংসার শুরু করলেন। একেই বোধহয় বলে শুভ বিবাহ।

দক্ষিণারঞ্জন সরকারের অধীনে কলকাতার কালেক্টর হলেন। এই পদে সেকালে কোনও দেশীয় মানুষকে নিযুক্ত করা হত না। প্রবীণারা বলবেন, দেখেছ! বিয়ের পরেই ভাগ্য খুলে গেল! আবার যে-সে বিবাহ নয়, এক রাজার সঙ্গে এক রানির। রোমান্টিক, বিপদে ভরা। দক্ষিণারঞ্জনের প্রাণ যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। বৃদ্ধ রাজা তেজচাঁদ পরলোকে। অনেক বিধবা স্ত্রী রেখে গেছেন। বসন্তকুমারী তাঁদের একজন, সর্বকনিষ্ঠা। তাঁর পিতা পরাণচাঁদ সেই সময় জাল প্রতাপচাঁদকে নিয়ে জেরবার। বসন্তকুমারীর গতিবিধি নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নেই। লাভবান হলেন দক্ষিণারঞ্জন। জীবনসঙ্গিনীর প্রয়োজন ছিল। তিনি আবার ক্ষত্রিয় রাজকুমারী। অনেকটা রূপকথার গল্প।

কলকাতায় তখন স্ত্রী শিক্ষা নিয়ে বাঙালি সমাজপিতা ও ইউরোপিয় সংস্কারকরা খুব উদ্যোগী হয়েছেন। ইউরোপিয় রেনেসাঁর প্রভাব। পাশ্চাত্যের দার্শনিক ও চিন্তাবিদরা শুধু ভারতবর্ষ নয়, পৃথিবীর সমস্ত মানুষের, স্ত্রী, পুরুষ, নির্বিশেষে জাগরণ চান। মুক্তি চান। শিক্ষার বিস্তার চান। মধ্যযুগ থেকে নতুন যুগে বের করে আনতে চান–A new world। বড় চমৎকার একটা পৃথিবীর স্বপ্ন। এদেশের ইংরেজ শাসকরা নারীমুক্তি, স্ত্রী শিক্ষার কথা তখনও ভাবেননি। প্রথম ভাবনা এসেছিল পাদরিদের মনে। ১৮২১ সালে স্কুল সোসাইটির কয়েকজন সভ্য এই ব্যাপারে অগ্রণী হলেন। ইংল্যান্ড থেকে এক শিক্ষিতা মহিলাকে এদেশে আনলেন, তাঁর নাম কুমারী কুক। স্কুল সোসাইটি যেসব বিদ্যালয় স্থাপন করেছিল, সেগুলি পরিদর্শনে গিয়ে দেখলেন একটি বিদ্যালয়ে একজন ছাত্রের সঙ্গে তাঁর ছোট বোনও এসেছে। সে স্কুলে প্রবেশের অনুমতি চাইছে কাতর কণ্ঠে। কিন্তু গুরুমশাই কিছুতেই তাকে স্কুলে ঢুকতে দিলেন না। মিস কুক সেই দিনই সিদ্ধান্ত নিলেন, যেভাবেই হোক বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। সেই কাল, অজানা এক বালিকা, আর একা বিদেশিনি, এই তিনের সমন্বয়ে সময়। কীরকম ঘুরে গেল। একটা অন্ধযুগের অবসান ঘটতে চলেছে। রেনেসাঁর সূত্রপাত। শ্রীমতী কুকের চেষ্টায় এক বছরের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে আটটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হল। কুমারী কুক রেভারেন্ড আইজ্যাক উইলসনকে বিবাহ করলেন। কিন্তু জীবনের ব্রত পরিত্যাগ। করলেন না। বিভিন্ন স্থানে একাধিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করা সম্ভব নয়। স্থির করলেন যেভাবেই হোক উত্তর কলকাতার কেন্দ্র স্থলে বড় আকারের একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন। করতে হবে। চাই একটি গৃহ। ১৮২৪ সালে শ্রীমতী কুক কয়েকজন সম্রান্ত ইংরেজ মহিলাকে নিয়ে একটি মহিলা সমিতি স্থাপন করলেন–Bengal Ladies Society। সমিতির অধিনেত্রী হলেন লেডি অ্যামহার্স্ট। ১৮২৬ সালের ৮ মে সিমুলিয়ায় মহা সমারোহে স্কুলের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হল। ঠিক দু-বছর পরে ১৮২৮ সালের পয়লা এপ্রিল থেকে মিসেস উইলসনের স্কুল শুরু হয়ে গেল। হিন্দুদের মধ্যেও উৎসাহ জাগল, যেন ঘুম ভাঙল।

রাজা বৈদ্যনাথ রায়বাহাদুর শ্রীমতী কুকের স্কুল বাড়ি নির্মাণের জন্য কুড়ি হাজার টাকা দান করেছিলেন। ওদিকে রাজা স্যার রাধাকান্তদেব বাহাদুর একটি প্রস্তাব প্রকাশ করেছিলেন–স্ত্রী শিক্ষা বিধায়ক প্রস্তাব। এবার তিনি নিজেই নিজের বাড়িতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করলেন। এই আন্দোলনে এইবার যিনি এলেন–তিনি বিখ্যাত ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন। আমাদের ইতিহাসে এই বিদেশি, মহাত্মা উপাধিতে ভূষিত। তিনি এসেই লক্ষ্য করলেন, সম্রান্ত পরিবারের মেয়েরা স্ত্রী শিক্ষার ব্যাপারে উৎসাহী হলেও সরকারের কোনও আগ্রহ নেই। বেথুন সাহেব নিজের অর্থে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করলেন। সম্রান্ত হিন্দুদের আহ্বান জানালেন এই ব্রতে ব্রতী হওয়ার জন্য। প্রথমেই এগিয়ে এলেন দক্ষিণারঞ্জন। প্রতিদিন স্কুল চালানোর জন্য বেথুন সাহেবের অনেক খরচ। রাজা রাধাকান্তদেব, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, জাস্টিস শম্ভুনাথ পণ্ডিত, রাজা কালীকৃষ্ণ। দেবও বেথুন সাহেবকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলেন। সম্রান্ত পরিবার থেকে ছাত্রীরাও এলেন বেথুন সাহেবের স্কুলে পড়ার জন্য। এখন চাই একটি নিজস্ব বিদ্যালয় গুহ। এই স্কুলে বেথুন সাহেব প্রতিমাসে প্রায় আটশো টাকা খরচ করতেন। তিনি বিদেশি, অনেক কষ্টে অর্থ। উপার্জন করেন। এরপরে খরচ যখন আরও বাড়বে তখন কী হবে! দক্ষিণারঞ্জন নিশ্চেষ্টভাবে বসে থাকতে পারলেন না। তাঁর জাতিরও তো একটা সম্মান আছে। স্যার বেথুনের সঙ্গে। সাক্ষাৎ করে বিদ্যালয় গৃহ নির্মাণের জন্য বারো হাজার টাকা মূল্যের বিরাট একটি জায়গা দান করলেন। বেথুন তখনও দক্ষিণারঞ্জনকে চেনেন না। অপরিচিত ব্যক্তির অযাচিত দানে। তিনি বিস্মিত। এই জমির ওপর ১৮৫০ সালের ৬ নভেম্বর বাংলার তদানীন্তন ডেপুটি গভর্নর স্যার জন লিটলার বেথুন বালিকা বিদ্যালয়ের ভিত্তি স্থাপন করলেন। সেদিনের বক্তৃতার একটি জায়গায় তিনি বললেন, Dakhina Runjun Mookerjee was an utter stranger to me. I had never before heard his name, when he introduced himself to me, a year and a half ago, for the purpose of letting me know that he heard of my intention of founding a Female School for the benefit of his Country, that he could not bear the thought that if should be said here after of his countrymen that they all stood idly looking on without offering any help in furtherance of the good work and in short, without further perface that he was the propritor of a picee of ground in Calcutta, Valued as I have since learned, at about twelve thousand Rupees, which he placed freely and unconditionally at my disposal for the use of the school. It was noble gift, and nobly given… It is due to Dakhina Runjun Mookerjee, that his name should be held in perpetual remembrance in connexion with the foundation of this school.

বেথুন স্কুল, বেথুন কলেজ কত বড় ইতিহাস এই কলকাতার বুকে! ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দিনে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পর বিশিষ্ট কয়েকজন সাহেব–স্যার জন লিটলার, ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন, লর্ড বিশপ, স্যার এফ ক্যারি, মিস্টার লাউইস, স্যার আর্থার বুলার, স্যার জেমস কলভিল, ফ্রেডারিক হ্যাঁলিডে, স্যার জন রাসেল, স্যার জন পিটার, ডাক্তার মৌয়েট, রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, দক্ষিণারঞ্জনের সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে সান্ধ্য ভোজনে মিলিত হয়েছিলেন। কজনই বা মনে রেখেছে এই ইতিহাস! মহান বেথুন সাহেব মৃত্যুকালে এই বিদ্যালয়ের জন্য নগদ তিরিশ হাজার টাকা ও তাঁর অন্যান্য অস্থাবর সম্পত্তি দান করে যান। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানান। তাঁর মৃত্যর পর লেডি ডালহৌসি বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য মাসে ছশো টাকা অর্থ সাহায্য করতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর লর্ড ডালহৌসি এই সাহায্য বজায় রেখেছিলেন। তারপরেই কোম্পানি বিদ্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

দক্ষিণারঞ্জনের তৃতীয় জীবন শুরু হয়েছে। প্রথম জীবনে অ্যাংরি ইয়ংম্যান, দ্বিতীয় জীবনে কর্মব্যস্ত আইনজীবী ও রানি বসন্তকুমারীর সঙ্গে চিরকালের গাঁটছড়া বাঁধা। তৃতীয় জীবনে চরম পরিণতি। কলকাতার কালেকটারি ছাড়তে হল। এই সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সুস্থ হয়ে ত্রিপুরায় গেলেন রাজসচিব হয়ে। এসব ১৮৫১ সালের কথা। ত্রিপুরাও ভালো লাগল না। কয়েকমাস পরে এলেন মুর্শিদাবাদে। তখন নবাব নাজিম ফরেদুনজা। দক্ষিণারঞ্জন দেওয়ান হলেন। এই সময়ে তিনি রাজ উপাধিতে ভূষিত হলেন। শুধু রাজা নয়। আর একটি নবাবি উপাধি পেলেন, মাদার-উল-মাহাম, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী। মুর্শিদাবাদের এই উচ্চ পদে তিনি যথেষ্ট সুখ্যাতি পেলেন। এই পদে থাকাকালীন গভর্নর জেনারেলের এজেন্ট মিস্টার হেনরি টরেন্সের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হল। সাহেব তাঁকে ভীষণ ভালোবেসে ফেললেন। টরেন্স সেকালের একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। সুদক্ষ রাজকর্মচারী, আবার একজন প্রকৃত পণ্ডিত ও সাহিত্যসেবী। সেই কারণেই ডিরোজিয়ান দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে তাঁর এত ভাব-ভালোবাসা। টরেন্স তিনটি সংবাদপত্রের সম্পাদক-Calcutta Star, Eastern Star, Meerut Observer | অনুবাদক ও মৌলিক গ্রন্থপ্রণেতা। সাহিত্যের এইসব বিভাগ তাঁর প্রতিভা স্বীকৃত। সাত বছর এশিয়াটি সোসাইটির সভাপতি ও তিন বছর সহকারী। সভাপতি ছিলেন। এমন একজন বিদগ্ধ মানুষ দক্ষিণারঞ্জনের প্রতি আকৃষ্ট হতে বাধ্য। সেই সময় শাসন ক্ষেত্রে গুণী, আলোকিত মানুষ কোথায়!

নবাব ফরেদুনও দক্ষিণারঞ্জনকে খুব ভালো চোখে দেখতেন। তিনি সেই সময় বয়সে তরুণ। দক্ষিণারঞ্জন অত্যন্ত সৎ, রাজকার্যে অত্যন্ত পারদর্শী। তরুণ ফরেদুনের ইয়ার বন্ধুরা সুবিধের ছিলেন না। নবাবকে গোল্লায় পাঠাবার সব রাস্তাই এদের জানা। যেমন সিরাজের পতনের কারণ তাঁর অসভ্য সঙ্গীরা। টরেন্সের কালে ইংরেজ সরকার হঠাৎ নবাব সরকার থেকে যে বৃত্তি পেতেন, তা কমিয়ে দিলেন। আর নিজামত তহবিলেও ভাগ বসালেন। এই ইস্যুতে নবাবের সঙ্গে টরেন্সের লড়াই শুরু হল। মিটমাটের জন্য দেওয়ান দক্ষিণারঞ্জন প্রচুর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। হেনরি টরেন্স গভর্নর জেনারেলের সঙ্গে দেখা করার জন্যে কলকাতায় এসে উদরাময়ে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। সাল, ১৮২৫, ১৬ আগস্ট। সন্দেহজনক মৃত্যু। দক্ষিণারঞ্জন তাঁর এক প্রিয় বন্ধুকে হারালেন। বিরাট আঘাত।

টরেন্সের বিতর্কিত মৃত্যুর পর নবাব ফরেদুন তাঁর কুমন্ত্রীদের পরামর্শে লর্ড ডালহাউসির সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়লেন। ঘটনাটি এইরকমনবাবের কিছু জহরত চুরি হল। রাজকর্মচারীরা কয়েক জনকে ধরে এনে পিটিয়ে মেরে ফেলল। নবাবের প্রধান খোজা আমান আলিখাঁ ও আরও কয়েকজনকে ধরে এনে সুপ্রিম কোর্টে তোলা হল। প্রমাণের অভাবে তাঁরা ছাড়া পেলেও নবাবের কাছে সরকারি নির্দেশ এল, এদের যেন পুনর্বহাল করা না হয়। ফরেদুন এই আদেশ উপেক্ষা করলেন। সরকার সঙ্গে সঙ্গে নবাবের অনেক ক্ষমতা কেড়ে নিলেন। সম্মানসূচক ১৯ বার তোপধ্বনি কমে হল ১৩ বার। এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে মুর্শিদাবাদের নিজামত দক্ষিণারঞ্জনের পক্ষে আর নিরাপদ রইল না। ফিরে এলেন কলকাতায়।

মানুষের জীবন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। ওঠা-পড়া। সামান্য সময়ের জন্য থমকে যাওয়া। এই সময় কয়েকটি বড় বড় মৃত্যু। প্রথমে বঙ্গবন্ধু বেথুন সাহেবের মৃত্যু। একদিকের আকাশ নক্ষত্রশূন্য। এরপরেই চিরবিদায় নিলেন প্রিয় বাল্যবন্ধু জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক সুধী, বাগ্মী, সুলেখক রসিককৃষ্ণ মল্লিক। দক্ষিণারঞ্জন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বন্ধুর শয্যাপার্শ্বে ছিলেন। খুব সেবা করেছিলেন। রসিককৃষ্ণ ছিলেন তাঁর হৃদয়ের হৃদয়। তাঁকে অদেয় কিছু ছিল না। একবার দক্ষিণারঞ্জনের বাড়িতে আহারাদির পর একটি বহু মূল্য সুন্দর সোনার তাম্বুল দান থেকে তাঁকে পান দেওয়া হচ্ছিল। রসিককৃষ্ণ মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখতে দেখতে বললেন–ওঃ কী সুন্দর! দক্ষিণারঞ্জন সঙ্গে সঙ্গে সেই বহু মূল্য বস্তুটি বন্ধুকে উপহার দিলেন। এইরকম বড় মনের মানুষ ছিলেন রাজা দক্ষিণারঞ্জন। ক্রমশই বড় একা হয়ে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে শরীর বিদ্রোহ করছে। অজ্ঞাত এক অসুখ–প্রবল শিরঃপীড়া।

কলকাতায় তাঁর অনেক কাজ। দ্বারকানাথ ও প্রসন্নকুমার ঠাকুরের উৎসাহে স্থাপিত হয়েছিল জমিদার সভা। পরে এটি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সোসাইটির সঙ্গে মিলিত হয়ে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন নামে শুধু পরিচিত হল না, হয়ে উঠল একটি মাইল ফলক। ১৮৫৯, ১৮৬০, এই দু-বছর দক্ষিণারঞ্জন এই অ্যাসোসিয়েশনের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন।

ডিরোজিওর ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র দক্ষিণারঞ্জনেরই প্রখর রাজনীতি জ্ঞান ছিল। রীতিমতো পড়াশোনা করতেন এই বিষয়ে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াতেন দেশের অবস্থা বোঝার জন্যে। উত্তর-পশ্চিম ভারতে ভ্রমণের সময় দেশ উত্তাল হল সিপাহি বিদ্রোহের কারণে। বিদেশি ইংরেজরা ভারতবর্ষের অন্তর-চিত্রের কিছুই জানতেন না। ধর্ম, সংস্কৃতি, বিশ্বাস, লোকাঁচার, ভাষা। এত বড় একটা দেশ। কত রকমের ভাষা, প্রথা! দক্ষিণারঞ্জন জানতেন। শাসক গোষ্ঠীর কোথায় ভুল হচ্ছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবার ক্ষমতাও তাঁর ছিল। লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় এই বিদ্রোহের কারণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে পর পর কয়েকটি সুনিশ্চিত প্রবন্ধ লিখে শাসক মহলে আলোড়ন তুলে দিলেন। ক্যানিং-এর মতো বিচক্ষণ রাজনীতিকও বিস্মিত হলেন।

সিপাহি বিদ্রোহ অবদমিত হল। ইংরেজের পীড়ন, উৎপীড়ন, ইতিহাস হয়ে রইল। শাসন ক্ষমতা কোম্পানির হাত থেকে কুইনের হাতে সমর্পিত হল। মহারানি ভিক্টোরিয়ার এম্পায়ার। রাজ্যের নগরে নগরে ঘোষণা। দেশের সর্বত্র মহাসমারোহে উৎসব। নট-নাট্যকার গিরিশচন্দ্র মস্ত এক কবিতা লিখলেন। সেই কবিতায় এইসব লাইন, ভিকটোরিয়া তুমি মা আমার/ ইংল্যান্ডের রাজরানি, ছিল মা ইংরাজি বাণী/ছিল মা গো ইংরাজ আকার/কিন্তু এ ভারতে জানি, ভারতের মহারানি/ভারতসন্তান সাঙ্গপাঙ্গ মা তোমার/ভিকটোরিয়া কোথা মা আমার/ বাঙালি সন্তান দীন, তুমি দীন পুত্রাধীন কালার আশ্রয় তব হৃদয় আগার/ভক্তি, পুষ্প করি দান, নহে মা এ বাক্য ভান/স্বর্গ হতে উপহার করো মা গ্রহণ/ আমি মহা ভাগ্যবান করি তোরে শ্রদ্ধা দান/হীন বাঙালির শ্রদ্ধা নাহি মা বারণ/ভিকটোরিয়া মা আবার হবে কি কখন!

ঢাকার ব্রাহ্মসমাজে বিরাট অনুষ্ঠান। বিশিষ্ট সব মানুষ সমবেত হয়েছেন। মহারানির জন্যে পরমেশ্বরের কাছে শুভাশীর্বাদ প্রার্থনা করা হবে। দক্ষিণারঞ্জন সেই সময় ঢাকাতে। তিনি আমন্ত্রিত হলেন। মনোজ্ঞ এবং দীর্ঘ ভাষণে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের সুফল ব্যাখ্যা করলেন। পরমেশ্বরের কাছে ভারতবর্ষ ও ভারতশ্বেরীর মঙ্গল কামনা করলেন। ঢাকা ব্রাহ্মসমাজের এই দিনের কার্যবিবরণী ও দক্ষিণারঞ্জনের বক্তৃতা একটি পুস্তিকার আকারে প্রকাশিত হল।

দক্ষিণারঞ্জনের রাজভক্তি শাসক গোষ্ঠীর উচ্চ মহলে প্রশংসিত। লর্ড ক্যানিং দক্ষিণারঞ্জনের নামের সঙ্গে পরিচিত। তাঁর একান্ত পরামর্শদাতা ডাফ সাহেবের মুখে দক্ষিণারঞ্জনের প্রশংসা শুনেছেন। দক্ষিণারঞ্জনের প্রবন্ধাদি ডাফ সাহেবের মাধ্যমেই তাঁর হাতে এসেছে। ডাফ শুধু ধর্মপ্রচারকই ছিলেন না, সূক্ষ্ম রাজনীতিও করতেন। সিপাহি যুদ্ধের ওপর একটি বইও লিখেছিলেন। ক্যানিং বিচক্ষণ শাসক। যুদ্ধের পর যুদ্ধে সমস্যার প্রকৃত সমাধান হয় না। একজন ঠান্ডা মাথার বিচক্ষণ মানুষ চাই। বিদেশি নয়, শিক্ষিত, ভারতবোদ্ধা ভারতীয়। তাঁর কাজ হবে উত্তর-পশ্চিম ভারতের অর্ধ শিক্ষিত, অশিক্ষিত অভিজাতদের পোষ মানানো। ব্রিটিশ শাসনের সুফল বোঝাননা। বিনীত নাগরিকে পরিবর্তন করা। এই কাজ যিনি করবেন, তাঁর দুটো দিক থাকবে, এদিকের মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করবে। তাঁর কথায় আস্থা স্থাপনে দ্বিধা করবে না, আবার ইংরেজদেরও বিশ্বাসভাজন। দু-দেশের জ্ঞান থাকার প্রয়োজন। তিনি হবেন সম্রান্ত, আলোকিত, শ্রদ্ধেয় আবার সুকৌশলী। কে তিনি?ইন্দো-ব্রিটিশ, যোগসূত্রের নির্ভরযোগ্য সেতু!

ডাফ বললেন, দক্ষিণারঞ্জন। রাজভক্ত বনেদি পরিবারের শিক্ষিত সন্তান। তাঁর লেখা পড়েছেন, তাঁর লেখা, তাঁর বিচক্ষণ অ্যানালিসিস আপনাকে পড়িয়েছি, আপনার মন্তব্য তাঁকে শুনিয়েছি। আধার ইন্ডিয়ান, আধেয় ইংল্যান্ড। আপাতত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত বাঙালির এই অবস্থা পরের কথা পরে। দেখুন, বিখ্যাত, নট-নাট্যকার বাংলার গ্যারিক কি লিখছেন,

ভিকটোরিয়া কোথা মা আমার!
বাঙালি সন্তান দীন তুমি দীন পুত্রাধীন
কালার আশ্রয় তবু হৃদয়াগার।

এবার কেন্দ্র লখনউ। জীবনের পথে চলতে চলতে এইবার শীর্ষ। লর্ড ক্যানিংয়ের আহ্বান, চলে আসুন, অপেক্ষা করে আছে বিরাট কর্মক্ষেত্র। অযোধ্যায় শান্তি প্রতিষ্ঠা। বিদ্রোহীরা পরাজিত হলেও, বিদ্রোহ পরাস্ত হয়নি। অযোধ্যার দুর্দান্ত তালুকদারদিগকে বশীভূত করিয়া রাজভক্ত প্রজায় পরিণত করিবার দুঃসাধ্য কার্য আপনাকেই করিতে হইবে। আপনি আমাদের পরম আস্থাভাজন এক রাজভক্ত।

২৫ অক্টোবর, ১৮৫৯-দক্ষিণারঞ্জনের জীবনের রেড লেটার ডে। লর্ড ক্যানিং লখনউ দরবারে ঘোষণা করলেন, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, আপনাকে অযোধ্যায় অবৈতনিক অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের পদে অধিষ্ঠিত করা হল। এই সঙ্গে আপনাকে রায়বেরেলির অন্তর্গত শঙ্করপুর তালুকটিও প্রদান করা হল। আপাতত, আপনার কর্মক্ষেত্র অযোধ্যা প্রদেশ।

শঙ্করপুরের তালুকটি ছিল রাজা বেণীমাধো বক্সের। তিনি সিপাহি আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। সরকার তাঁর সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। এই তালুকটির সেই সময় বাৎসরিক আয় ছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা। তালুকটি যথেষ্ট বড়। জায়গায়, জায়গায় ভীষণ অরণ্য। হিংস্র পশু শুধু নয়, হিংস্র মানুষের বাস। দক্ষিণারঞ্জনের অক্লান্ত চেষ্টা ও ব্যবস্থাপনায় অঞ্চলটি উন্নত হল। জীবনের শেষ আকাশে সূর্যোদয় ঘটালেন ডফ সাহেব। এই সাহেবকে কী ভাবে তাঁর হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা জানাবেন! তাঁর তালুকের একটি গ্রামের নাম রাখলেন, ডফপুর। তাঁর নামে ভারতের একটি গ্রাম চিহ্নিত হতে চলেছে শুনে সাহেব দক্ষিণারঞ্জনকে একটি আবেগভরা চিঠি লিখেছিলেন, তারই একটি অংশ:

I say them that seldom have I ever received a letter which has afforded me more real joy. I could almost weep for joy. you are now at least in your right place-your proper sphere-a sphere in which, if spared. You have before you a long, honorable and distinguished career, alike of usefulness to your self and benefit poor bleeding country.

এই চিঠিতে ডফ সাহেব দক্ষিণারঞ্জন সম্পর্কে তাঁর ধারণা প্রকাশ করেছেন, যা দক্ষিণারঞ্জনের চরিত্রের প্রকৃত গ্রহণযোগ্য আলেখ্য। দেশের মানুষ, কিংবা বিদেশিরা তাঁকে চিনেছিল কি? এতটা সাফল্য ঈর্ষার কারণ তো হবেই। সেই এডওয়ার্ড সাহেব দক্ষিণারঞ্জনকে তখনও অব্যাহত দেননি। কুৎসার পর কুৎসা রটনা করেই চলেছেন। ডফ সাহেব লিখছেন, ৩০ বছর আগে প্রথম দেখাতেই আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলুম you are so frank, so open, so manly, so straight forward, so energetic, so overflowing also with generous and benevolent impulses. That I felt irresistibly drawn to you. And never never for a moment was my own confience in you shaken.

কেন রাজবধূ বসন্তকুমারী রাজগৃহ পরিত্যাগ করে তাঁর সঙ্গে বর্ধমানের পথে নেমেছিলেন? ডফ সাহেবের এই উক্তি থেকেই বোঝা যায়! প্রকৃত একজন পুরুষ। অপ্রতিরোধ্য তাঁর আকর্ষণ। সহজ, সরল, উদার, উপকারী, দয়ালু। তিরিশ বছরেও আলেকজান্ডার ডফের তাঁর প্রতি আকর্ষণ এতটুকু কমেনি। দুর্জয় সাহসী এই মানুষটি যখন অযোধ্যায় এলেন, তখন বিদ্রোহের আগুন নিবে গেলেও ধোঁয়া উঠছে। ইংরেজদের শাসনের মুঠো দৃঢ় হচ্ছে। ভারতবর্ষকে বিদেশিরা এইবার বজ্রমুষ্টিতে ধরবেন। এই সব সায়েবদের সঙ্গে সমানে টক্কর দিয়ে চলবেন। প্রয়োজনে সমালোচনা করবেন, প্রতিবাদ করবেন। তাঁর চাপে উচ্চ পদস্থ ইংরেজ অফিসার বদলি হবেন। তৎকালের অযোধ্যাবাসী তাঁদের এমন একজন সুহৃদকে পেলেন, যিনি ইংরেজ শাসনের চড়া আলোয় ভালোবাসার ছত্রচ্ছায়া। দীর্ঘকাল ধরে এই অঞ্চলের তালুকদাররা নিজেদের ভোগ-সুখের কথাই ভেবেছেন। এতদিনে এমন একজন এলেন যিনি জনহিতের কথা ভাবেন। যাঁর লক্ষ্য সমাজের সর্বস্তরের সর্ব বিষয়ে উন্নতি। বিদ্রোহদীর্ণ একটি প্রদেশকে গড়ে তোলা। প্রকারান্তরে বিদেশি শাসকদের জনমুখী করে তোলা।

সংস্কারমূলক প্রথম কাজটি হল–শিশুহত্যা নিবারণ। অযোধ্যা প্রদেশে বসবাসকারী রাজপুতরা শিশুকন্যাদের বধ করতেন। দক্ষিণারঞ্জনের চেষ্টায় এই নৃশংস প্রথা বন্ধ হল। এরপর ভূমি সংক্রান্ত প্রচলিত আইনের সংস্কার। দুটি পত্রিকা প্রকাশ করলেন, সমাচার হিন্দুস্থানি ও ভারত পত্রিকা। তাঁরই প্রচেষ্টায় আমিনাবাদ প্রাসাদে স্থাপিত হল ক্যানিং স্কুল। পরে এটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে উন্নীত হল কলেজে। কয়েক বছর পরে আইন বিভাগও চালু হল। স্থাপিত হল অভিজাত ওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন ও নৈশ বিদ্যালয়। নিজের তালুকে চালু করলেন একটি দাঁতব্য চিকিৎসালয়। খরচ চালাবার জন্যে ৪৮০ একর জমি দান করলেন।

শুধু অযোধ্যা প্রদেশে নয় সারা ভারতে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। অতঃপর এল সেই দিন– ১৮৭১ সালের ৫ মে, তিনি রাজ উপাধিতে ভূষিত হলেন। সনদ–ভারত সরকারের মোহর, ফরেন ডিপার্টমেন্ট–

To

Rajhah Dakshina Ranjan Mookherjee, Talooqdar of Oudh in consideration of your meritorius endeavours to promote the good of the province of Oudh, I hereby confer upon you the title of Raja as a personal distinction. (Sd) Mayo.

Dated, Simla, the 5th May, 1871

ডাক্তার ডফ এডিনবরা থেকে লিখলেন। তিনি অসুস্থ। পূর্বের কর্মশক্তি নেই, কিন্তু ভারত সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ এতটুকু কমেনি। তিনি খুশি, ভীষণ খুশি। তিনি জানতেন স্বীকৃতি আসবেই; একটু দেরিতে এল–Better late then never.

আর মাত্র তিন বছর। বেশ যখন জমে উঠছে যশ, খ্যাতি, প্রতিপত্তি, বাদ-বিবাদ-বিসম্বাদ। বড় গাছে বাতাস বেশি ধরে। সে বাতাস প্রতিহত করার ক্ষমতা রাজার ছিল। ভেবেছিলেন, সাগর পারে, ইংল্যান্ডে যাবেন। শেষ পর্যন্ত যাওয়া হল না অজ্ঞাত কারণে। ইন্দোরের রাজা হোলকার তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করতে চাইলেন, দক্ষিণারঞ্জন প্রত্যাখ্যান করলেন বিনীতভাবে, অজ্ঞাতকারণে। ইংরেজ সরকার এবং অযযাধ্যাবাসী দেশীয়রা–উভয়েই দক্ষিণারঞ্জনের প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি বিদ্রোহের পর যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল তা দূর করে মৈত্রীর বাতাবরণ সৃষ্টি করেছিলেন, যা একা ইংরেজদের পক্ষে করা কখনওই সম্ভব হত না। স্যার রোপার লেথব্রিজ লিখলেন :

He did much to remove the racial antipathies between the English and the Indians.

কৃতজ্ঞ অযোধ্যাবাসীরা মহারাজ দিগ্বিজয় সিং-এর প্রতিনিধিত্বে একটি সভা আহ্বান করে দক্ষিণারঞ্জনকে স্বর্ণপদক প্রদান করলেন। একদিকে ইংরেজি অন্য দিকে পারস্য ভাষায় Grah 007: Oudhs love and gratitude through its British Indian Association to Baboo Dakshina Ranjan Mukherjee Bahadur.

দিনের আলো কি কমছে? আসল মানুষটি কোথায়। রাজনারায়ণ বুঝতে পারছেন না, তিনি। ব্রাহ্ম, না টিকিধারী ব্রাহ্মণ। মহর্ষির বেদ, না, রামমোহনের উপনিষদ! ব্রিটিশ বন্ধু, না ভারত বন্ধু। নিঃসন্দেহে এক কৃতী স্টেটসম্যান। তাঁর পারিবারিক জীবন? প্রথম স্ত্রী জ্ঞানদাসুন্দরী তাঁকে একটি গুণী, অসীম পিতৃভক্ত কন্যা দিয়েছে মুক্তকেশী। মুক্তকেশী প্রতিটি দিন শুরু করেন পিতাকে একটি চিঠি লিখে। মুক্তকেশী শিল্পী! দক্ষিণারঞ্জন খুব ভালোবাসেন। বিবাহ। দিয়েছেন, স্বনামধন্য মহাত্মা হরিমোহন ঠাকুরের প্রপৌত্র ললিতমোহন ঠাকুরে পুত্র। রঘুনন্দনের সঙ্গে। মুক্তকেশীর তিন কন্যা, এক পুত্র রণেন্দ্রমোহন। দক্ষিণারঞ্জনের প্রাণপ্রতিম রণজিৎ। বহু গুণের অধিকারী-সুপুরুষ।

দক্ষিণারঞ্জনের প্রেমিকা বসন্তকুমারী, যাঁর জীবন এক দীর্ঘশ্বাস। দক্ষিণারঞ্জন যাঁকে বর্ধমানের ধুলো থেকে বহু ঝুঁকি সত্বেও তুলে নিয়েছিলেন বুকে। রাজকন্যা নন এক রাজবধূ। তিনি উপহার দিয়েছিলেন একমাত্র বংশধর মনোহররঞ্জন। কান্যকুজ দেশীয় হিন্দুস্থানি ব্রাহ্মণ কাশীরাম শুকুলের কন্যা রামকুমারী দেবীর সঙ্গে মনোহরের বিবাহ দিলেন। মনোহরের দুটি কন্যা ও একটি পুত্র হল। পুত্র ভুবনরঞ্জনের বিবাহ হল এক ব্রাহ্মণ কন্যার সঙ্গে। অনেক আলোর ঝাড়বাতি।

কিন্তু নায়ক এইবার যাবেন বুঝি চির বিশ্রামে। তা অনেক হল! কী বলো বসন্তকুমারী! চিরকাল কি কেউ বসন্তে থাকে? শীত আসবেই শীতল মৃত্যু নিয়ে। অযোধ্যা কী শ্রীরামচন্দ্রকে ধরে রাখতে পেরেছে যে আমাকে পারবে! বসন্ত! নবাব ওয়াজিদ আলি সাহেবের কথা মনে পড়ে! সেই হতভাগ্য রাজা! কৈসার বাগ! কৈসার বাগ! প্রমোদ উদ্যান, প্রমোদ ভবন। মঞ্জিলা! ফোয়ারা, গীত, গজল এক কোটি টাকা খরচ করেছিলেন নবাব! প্রাচীর ঘেরা সেই বাগান! এক-একটি সৌধে এক-একজন বেগম। প্রতিটি সৌধে আলাদা বাগান। আনন্দের ফোয়ারা! বসন্ত সব শ্মশান। দেশীয় রাজাদের দিন শেষ। ইংরেজের ঘোড়া ছুটছে। কামানের গর্জন! হাত ছাড়ো! আমি যাই। তুমি আরও কিছু দিন থাকো। আমি তোমাকে ভালোবাসি বসন্ত! সেই ভালোবাসারই টানে আবার কোনওদিন ফিরে আসব। আবার, আবার সেই এক খেলা। শত্রু, মিত্র সবাই রইল, পরিবার, পরিজন তাদের দেখো!

আমার কথাটি ফুরলো,
নটে গাছটি মুড়লো।।

তুমি চিরকালই একা। মনোহররঞ্জনও অকালে চলে গেল। কে যায়, কে থাকে?

ক্যালেন্ডার লিখে রাখে–১৮৭৮ সাল, ১৫ জুলাই, ৬৪ বছর বয়সে লখনউ নগরীতে রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোঁপাধ্যায়ের জীবনাবসান।

ঋণ স্বীকার
মন্মথনাথ ঘোষ।।
সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।।
আবদুল গণি খান।।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত