একটি জীবনের গল্প

একটি জীবনের গল্প

পাশের রুম থেকে অস্পষ্ট কান্নার শব্দটা ভেসে আসছে, মা কাঁদছে,,খানিক বাদে ফুপিয়ে কেঁদে উঠছে আর চোখ মুচছে,, আমি বই সামনে নিয়ে পাশের রুমে খাটের কোণে বসে রয়েছি,,যদিও আমার মনোযোগ সবটুকু ই মায়ের কান্নার দিকে,, আমিতো আজ নির্বাক, আমার বলার মতোন আজ কিছু নেই,,তবুও ইচ্ছে করছে একবার মা কে গিয়ে বলি- “”মা তুমি আর কেঁদোনা,,

আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে”” অনেকক্ষণ নির্বাক থাকার পর ভীরু ভীরু পায়ে মায়ের সামনে এগিয়ে যেতে লাগলাম,,, আমি পাশের রুমে পা রাখার সাথে সাথেই মা খুব জলদি করে চোখের পানিটুকু মুছে ফেলার চেষ্টা করলো,, যদিও সবটুকু পারেনি। কাঁপা কাঁপা কন্ঠস্বরে বললো- “কিছু বলবি?” ভয়ে হৃদস্পন্দন বেড়ে যেতে লাগলো,তবুও মায়ের চোখে চোখ রেখে বলেই ফেললাম- “তুমি কি কাঁদছো?” মা হঠাৎ ই বলে উঠলো- “কই? না তো,কাঁদছিনা।” আমি আচ্ছা বলেই চলে আসলাম রুম থেকে।

আমি আদিবা সুলতানা। বাবা আমার জন্মের আগেই মারা গিয়েছিলো,চিকিৎসার অভাবে। বড় একটা ভাই আছে আমার,নাম রাসেল। বাবা মাকে বলেছিলো ভাইয়াকে যেনো ডাক্তার বানায়, ভাইয়া যেনো একদিন নাম করা ডাক্তার হয়, কিন্তু নিজেকে যেনো গরীব অসহায়দের জন্য কাজে লাগায় সেই জন্য। আমাদের নুন আনতে পানতা ফুরোয়,, তবে ভাইয়া অত্যাধিক ভালো ছাত্র,তাই ভালো ফলাফল করে বৃত্তির টাকায় আর স্কুল,কলেজের শিক্ষকদের সহযোগিতায় ভাইয়া আজ কলেজ শেষ করেছে।

কোনো শিক্ষকের কাছেও কখনো পড়তে পারেনি,তবুও সবসময় সকলের থেকে এগিয়ে থাকতো। ওর মেধা আর পরিশ্রমের ফলেই আজ ও এতোদূর আসতে পেরেছে। আমি এখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। আমি যে স্কুলে পড়ি মা সেখানে আয়ার কাজ করে, তাই আমার পড়ার খরচটাও লাগেনা বললেই চলে। আজকে ভাইয়ার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছে,, ভাইয়া গোল্ডেন এ + পেয়েছে। সকলে ভাইয়াকে নিয়ে আনন্দ করছে,আর আমার মা কেঁদেই চলেছেন। তবে মায়ের কান্নার কারণটা আমার বেশ ভালো করেই জানা রয়েছে।

রুমে এসেই আবার বই সামনে নিয়ে বসে পড়লাম। তবে পড়ার জন্য নয়,, ভাবার জন্য। ভাবনাগুলো অবশ্য পড়া সম্পর্কিত নয়। মাথায় বার বার একটা কথা ই শুধু ঘোরপাক খাচ্ছে। মিথ্যে বলা নাকি অন্যায়!!!! মিথ্যে কথা বললে নাকি পাপ হয়!!! এসব কথা অবশ্য ছোটোবেলা থেকে মা ই আমাকে শিখিয়েছে। আর তাই আজ আমার মাথাতেও একটা প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে। যদি মিথ্যে বললে পাপ হয়,তবে মা কেনো মিথ্যে বলে? মায়ের কি তবে পাপ হবেনা? মা মিথ্যে কথা বললে কি তা অন্যায় নয়? নাকি মায়েরা মিথ্যে কথা বলতে পারে? আর ভাবা যাচ্ছেনা,মনে হচ্ছে খানিকবাদে হয়তো মাথার রগগুলো সব ছিঁড়ে যাবে, মুহূর্তের মাঝেই হয়ে যাবো আমি একটা লাশ!!! হুমম লাশ!!!!!!

এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেলো। আমাদের ক্লাসের ইংরেজি শিক্ষক, একবার আমাদের একটা কথা বলেছিলো। তিনি আমাদেরকে একবার জিজ্ঞেস করলেন- মিথ্যে কত ধরনের হয়?? আমরা সবাই চুপ হয়ে রইলাম,,ভাবতে লাগলাম- মিথ্যের আবার কত ধরন হতে পারে? তিনি বললেন- মিথ্যে হচ্ছে দু’ধরনের। 1. White lie, 2. Black lie. আমরা কথাটা শুনে হেসে দিলাম। এটা আবার কেমন? তিনি বললেন- কিছু কিছু সময় মানুষ অনেক মিথ্যে কথা বলে থাকেন,কিন্তু সেসকল কথায় কারো ক্ষতি হয়না।

হতে পারে সেসকল মিথ্যেগুলো কাউকে ভালো রাখার জন্য বলা হয়ে থাকে।সেগুলো হলো White lie. আর কিছু মিথ্যে কথা রয়েছে যেগুলো বললে শুধু মানুষের অনেক ক্ষতি হয়ে থাকে। অনেক সমস্যায় পড়তে পারে। সেগুলো হলো- Black lie অবশেষে স্যারের কথাগুলো মনে পড়ে বুঝতে লাগলাম কথাগুলোর মাঝে আসলে কোনো ভুল ছিলোনা। হয়তো তখন হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম,,তবে আজ বুঝতে পারছি কথাগুলোর মর্ম কতটা। আর সে সাথে এটাও আবিষ্কার করলাম আমার মা ও White lie এর আওতায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে রয়েছে।

আমি জোর গলায় বলতে পারি আমার মা একজন মিথ্যেবাদী। সারাদিন কাজ শেষে যখন মা ঘরে ফিরে,, আদর করে আমাকে আর ভাইকে খাবার খাইয়ে দেয়,, আমরা জিজ্ঞেস করলে মা হাসিমুখে উত্তর দেয়, আমি খেয়েছি। মা আমাদের বস্তির পাশের একটা বড় বিল্ডিং এ সন্ধ্যায় কাজ করতে যেতো। মা বলতো মালিক নাকি অনেক ভালো লোক। মা বেশিরভাগ সময়ে সেখান থেকেই রাতের খাবার খেয়ে আসতো। আমি মাকে অনেকদিন বলেছিলাম আমাকেও সেখানে নিয়ে যেতে। কিন্তু মা আমার কোনো কথা শুনলোনা, কেনো যেনো আমাকে নিয়ে যেতো না কখনো। একদিন ভাবলাম, আমি নিজে নিজে ই যাবো সেখানে। একদিন রাতে মা কাজে যাওয়ার পর,আমি খানিকবাদে সেখানে গেলাম।

গেটের দারওয়ান টাকে দেখা যাচ্ছেনা, এই সুযোগে আমি বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়লাম। দরজার আড়াল থেকে চিৎকারের শব্দ আসতে লাগলো। মালিক মায়ের সাথে চেঁচামেচি করছে। মা বলছিলো– স্যার, আমার পোলাটার কলেজের বেতন লাগবো,,কয়টা টাকা দেন না স্যার। মালিক মা কে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো,আমার মা “ওরে বাবা,ওরে মা” বলে চিৎকার করে উঠলো। আমি দরজার বাইরে মাটিতে বসে পড়লাম। আমার শুধু সে সময়ে একটা কথা মনে হতে লাগলো– কেউ হয়তো আমার হৃৎপিন্ডটা টেনে বের করে নিচ্ছে। আমি দৌড়ে বাড়িতে চলে আসলাম, অঝোরে কাঁদতে লাগলাম। কাঁদতে লাগলাম আর মনে মনে বলতে লাগলাম–“”মালিক আসলেই অনেক ভালো। কিন্তু তুমি ভালোনা মা। তুমি সারাজীবন আমাদের ভালোর জন্য মিথ্যে কথা ই বলে গেলে!!!””

আমি রোজ নামাজ পড়তাম। আর নামাজ শেষ করে সবার আগে একটি প্রার্থনা করতাম-“” আল্লাহ, তুমি আমার মায়ের সব কষ্ট দূর করে দাও। আমার মায়ের কষ্টগুলো আমাকে দাও,কিন্তু মা কে ভালো রাখো”” এক এক সময় মনে হতো- যদি এ দুনিয়ার গাছপালা, পশুপাখিগুলো কথা বলতে পারতো,তাহলে হয়তো আমার মায়ের কষ্টে আকাশে-বাতাসে তাদের চিৎকার শোনা যেতো। আমার মা সারাদিন খেটে কাজ করে, মালিকদের হাতে আবার মার ও খেতে হয়। তবুও মাকে কখনো বলতে শুনিনী যে- “”আমার কষ্ট হচ্ছে।”” জানিনা আল্লাহ মাকে মাটি দিয়ে বানিয়েছে নাকি পাথর দিয়ে!!! মাটি দিয়ে বানানোর পরেও কেউ কিভাবে এতোটা সহনশীল ক্ষমতা রাখে মা কে না দেখলে হয়তো জানতেও পারতাম নাহ।

ভাইয়ার স্কুল,কলেজের খরচ যোগাতে মা তার কাপড় ও বিক্রি করে দিতো,, অনেক কষ্টে বই,বেতন এগুলোর ব্যবস্থা করতো মা। অনেক ধার-দেনা, মানুষের লাথি খেয়েও আমাদের খাবারের,পড়বার ব্যবস্থা করতে হয়েছে তাকে। অনেক কষ্ট বুকে নিয়ে বাবার কথা রাখতে মা ভাইয়াকে ডাক্তার বানাতে চেষ্টা করেছিলো। আজকে ভাইয়ার এইচএসসি রেজাল্ট দিয়েছিলো। ভাইয়া এবারও গোল্ডেন এ+ পেয়েছে। কিন্তু মায়ের শেষ সম্বলটুকুও সব বিক্রি করে দিতে হয়েছিলো। ভাইয়াকে মেডিকেলে ভর্তি করানোর মতো কোনো টাকা নেই মায়ের কাছে। তাহলে কি অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে আমাদের স্বপ্নগুলো? মা কি ব্যর্থ হয়ে যাবে বাবার স্বপ্ন পূরণে!!! ভাইয়া ঘরে আসলো। মা কে বললো- মা,সবাই বলতেছে মেডিকেলে অনেক খরচ, আমার মনে হয় আর ডাক্তার হওয়া হবেনা। মা ভইয়াকে বুকে টেনে নিয়ে কেঁদে উঠলেন। আমি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে নির্বাক তাকিয়ে রয়েছি।

ভাইয়া আমাকে দেখে কাছে যেতে বললো। আমি ভাইয়ার পাশে গিয়ে বসলাম। ভাইয়া আমাকে বললো- ডাক্তার হবি? আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। যে ভাইয়ার নিজেই ডাক্তার হবার স্বপ্নটা নষ্ট হয়ে গেলো, সে আমাকে কিভাবে বলছে ডাক্তার হওয়ার কথা!!! আমি মাথা নেড়ে বললাম – নাহ। ভাইয়া বললো কেনো? আমি বললাম- মা কে কষ্ট পেতে দেখতে পারবো না। মা আর ভাইয়া দুজনেই আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। এইবার ভাইয়া বলে উঠলো– তুই ডাক্তার হবি ই। মা বললো কি বলছিস এসব তুই ওকে? ভাইয়া বললো- হ্যাঁ,ও ডাক্তার হবে। আমি ওকে ডাক্তার বানাবো। তোমাকে কোনো কষ্ট করতে হবেনা মা। আমি করবো যা করার। আমি আর মা কিছু বুঝতে না পেরে শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম সেদিন ভাইয়ার দিকে।

ভাইয়া যেহেতু খুব ভালো ছাত্র ছিলো,তাই ও একটা স্কুলে চাকুরী নিলো। সেখানে খুব ভালোভাবে চাকুরী করতে লাগলো। বেলা ১২ টা পর্যন্ত স্কুলে চাকুরী করতো। আর ১২টার পর আমাদের বাজারের দিকে একটা কাপড়ের দোকানে চাকুরী করতো। দিন-রাত এক করে কাজ করতে লাগলো ভাইয়া। আমিও বেশ ভালোভাবে পড়ালেখা করতে লাগলাম। এখন আর মা কে কোথাও কাজ করতে হয়না। ভাইয়া পুরো পরিবারটাকে দেখাশোনা করছে। আমি নবম শ্রেণীতে উঠলাম। ভাইয়া এর মাঝে ২ বছরে ব্যবসায় টা ভালোভাবে শিখে নিয়েছে। একটা সমিতি থেকে কিছু লোন নিয়ে ভাইয়া নিজে একটা ব্যবসা করা শুরু করলো। আল্লাহর রহমতে বেশ ভালো চলতে লাগলো ব্যবসায় টা। আমাদের এখন আর অভাব বলে কিছু থাকলোনা। আমাদের পরিবারে স্বচ্ছতা ফিরে এলো।

এই স্বচ্ছতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অস্বচ্ছতাগুলো শুধু আমাদের তিনটি মানুষের ই জানা। এমন ও দিন ছিলো ভাইয়া রাতে না খেয়ে আমাকে বেশি খেতে দিতো, একদিন ভালোভাবে খেতে না পারলে ভাইয়া বলতো- “”বোন রে, রাত টা একটু কষ্ট কর, সকালে অনেক খাবার খাওয়াবো রে।”” আজও যখন ভালো খাবার দেখি,তখন সেদিনের সেই অসহায় দিনগুলোর কথা মনে পড়ে চোখের কোণে জল জমা হয়,, আর ভাবি– “”এমন দিন ছিলো যখন মা আর ভাইয়া পাগলের মতো একটু খাবারের জন্য খোঁজাখোঁজি করতো।”” ভাইয়া এখন আমাকে আর মা কে নতুন পোষাক কিনে দেয়। নিজের দামি পোষাকের দিকে তাকিয়ে শুধুই ভাবতে থাকি- “”এ তো সেই পোষাক, যেগুলো পড়ে বড়লোক মেয়েরা রাস্তা দিয়ে নবাবের মতো হেঁটে যেতো আর আমি চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতাম। আর ভাবতাম,আহ!! কি সুন্দর!!”” ভাইয়া যখন মা কে নতুন কাপড় দিতো,মা কাপড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতো আর অজান্তেই চোখের জল পড়তো। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম– “”মায়ের গায়ের এরকম হাজারো কাপড় বিক্রির টাকা দিয়ে আমাদের পড়ালেখা আর খাবারের ব্যবস্থা হতো””

৮ বছর পর ভাইয়া আজ বিরাট এক ব্যবসায়ী। নিজেদের একটি গার্মেন্টস রয়েছে। কাপড়ের অনেক শোরুম ও রয়েছে। আর রয়েছে একটি হাসপাতাল, যেখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হয়। আমিও এমবিবিএস শেষ করেছি। আজ দেশের নামকরা একজন ডাক্তার আমি। কিন্তু টাকার প্রতি কোনো মোহ নেই,, সবটুকু মোহ একজন ব্যক্তিকে ভালোভাবে সুস্থ করে তোলা। আজ আমাদের কোনো কিছুর কোনো অভাব নেই। শুধু অপূর্ণতা রয়ে গিয়েছে ভাইয়ার ডাক্তার হবার ইচ্ছাটা। আমাদের বাড়িতে অনেক কাজের মহিলা আছে, কিন্তু মা তাদের নিজের বোন এর মতোই দেখে, কাউকে কখনো আমাদের থেকে লাথি খেতে হয়না, কিংবা আমাদের হাত কখনো কারো গায়ে ওঠেনা। কারণ, আমরা এই সকল কষ্টের অনুভূতিগুলো বুঝি। আর আমরা চাইনা কখনো কেউ এই কষ্টগুলো অনুভব করুক।

রাতে বাড়িতে ফিরলাম। মাকে বললাম ক্ষুধা লাগছে জলদি খেতে দাও। মা বললো যা ফ্রেশ হয়ে আয়। বললাম আচ্ছা মা। নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি ভাইয়া আমার টেবিলের কাছে চেয়ারের ওপর থেকে আমার এপ্রোন টা বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। আমিও হঠাৎ করে নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আর ভাবলাম- “” সাদা এপ্রোনগুলো শুধু একটি কাপড় নয়। একটি সাদা এপ্রোন মানে একটি জীবনের স্বপ্ন, সাধনা, ত্যাগ- তিতিক্ষার ফল। একটি সাদা এপ্রোন একটি জীবনকে পরিবর্তন করে দেয়। সেটা কারও জন্য সুখের, কারও জন্য বা অনেকটা দুঃখের। একটি সাদা এপ্রোন একটি জীবনকে বহন করে চলে। এভাবেই সাদা এপ্রোনগুলোর আড়ালে রয়ে যায় এক একটি জীবনের গল্প “””

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত