ঘুরেফিরে

ঘুরেফিরে

আমার একটা গাধা ছিল। হলুদ রঙের কাঠের বানানো খেলনা গাধা। গাধাটার পিঠের নিচে একটা বাটন ছিল। সেটাতে প্রথমবার চাপ দিলে গাধাটা লেজ নাড়তো । পরের বার চাপ দিলে কোমর দুলাতো। সকাল সাতটা বাজে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমি সেই গাধাটার কথা ভাবছি। একটু পরে আমার ইন্টারভিউ। সাদা রঙের একটা ফুলহাতা শার্টের সাথে বাদামি রঙের পেন্ট পড়ে নিজেকে বিদঘুটে লাগছে। কালো পেন্টটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছিনা। চুলগুলো জেল দিয়ে অনেক কষ্ট করেও একপাশে আনতে পারিনি। আমার এক হাতে একটা লাল রঙের টাই। নিজেকে কেন জানি ওয়েটার ওয়েটার লাগছে। আমার চাকরি করার কোনো ইচ্ছা নেই। তরুর চাপে পড়ে ইন্টারভিউত দিতে যাচ্ছি। আমার এখন ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।

ইন্টারভিউ থেকে আমার ঘুমের চিন্তা বেশি হচ্ছে। রাতে ঘুমিয়েছি ঠিক দশটায়। ঘুমের মাঝখানে নিয়ম করে ভয় পেয়ে প্রতি দু ঘন্টা পর পর উঠে আমি এক কাপ পানি খেয়েছি। দুদিন ধরে আমার গ্লাসটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছিনা। বাসার অন্য গ্লাসে আমি পানি খাইনা,অন্য কাপে চা খাইনা। আমার সব জিনিস আলাদা করা। গ্লাস হারানোর দুঃখে আমি আমার কাপ দিয়ে পানি খাচ্ছি। তরুর ফোনে আমার ধ্যান ভাঙলো। সাতটা পঁয়ত্রিশ বাজে। আটটায় ইন্টারভিউ। এখনো ঘর থেকে বের হইনি শুনলে নির্ঘাত কপালে দুঃখ আছে। ফোন ধরে যতটুকু সম্ভব গম্ভীর গলায় “হ্যালো” বললাম। তরু তার থেকেও গম্ভীর গলায় বললো, “বের হয়েছ?” আমি ভাব নিয়ে বললাম, ” নাহ। বের হতে ইচ্ছা করছেনা । কেন জানি মনে হচ্ছে চাকরিটা হবেনা। তুমি বিয়েটা করে ফেলো তরু।”

তরু ঠান্ডা গলায় বললো,” আচ্ছা আমি বাবাকে বলছি তোমার পরিবারকে জানাতে।” আমি তড়িঘড়ি করে ,”বের হচ্ছি এখুনি” বলে ফোন কেটে দিলাম। অফিস অতো দূরে না। রাস্তায় জ্যাম ও ছিলনা। বের ও হয়েছি ঠিকঠাক মতো। তবু আটটার ইন্টারভিউ,আমি পৌঁছালাম ন’টা বাজে। আমার উদ্দেশ্য ছিল জ্যাম এর বাহানায় দেরি করে যাবো আর ইন্টারভিউ ক্যান্সেল হয়ে যাবে। রাস্তায় টেক্সি ভাড়া করার আগে বিশ মিনিট দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি আবার গাঁধাটার কথা ভেবেছি। গাধাটার গায়ে কি লাল রঙের নকশা ছিল নাকি কমলা সেটা মনে পড়ছিলনা। মাঝে একবার তরু ফোন দেয়ার পর বলেছি ,”গাড়ি পাচ্ছিনা।”

যতটুকু সম্ভব দেরি করে গিয়ে দেখি সিরিয়াল অনুসারে ডাকা হচ্ছে। আর দুজন বাকি। মনে মনে খুশি হয়ে গেলাম।
ভাবলাম ,হয়তো আমার নাম ডাকা শেষ। চেক করে দেখলাম আমার নামটা একেবারে সবার শেষে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়েটিং রুমের সোফায় বসে রইলাম। দুজনের পর আমার ডাক পড়লো। ভিতরে ঢুকলাম। সালাম দিলামনা। কিছু জিজ্ঞেস না করেই চেয়ারে বসে ইন্টারভিউ বোর্ডের মেম্বারদের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

তিনজন মেম্বার। একজন ধবধবে সাদা দাড়িওয়ালা লোক মাঝখানে বসা। তার মেরুদন্ড চেয়ারের সাথে বরাবর নব্বই ডিগ্রি কোনে দণ্ডায়মান হয়ে আছে। তার চুল পুরো কালো। সম্ভবত কলপ করেছে। তার বাম পাশের লোকটার চোখে গাঢ় করে সুরমা দেয়া। সাদা শার্টের সাথে কালো টাইটায় সোনালী রঙের ভারী কাজ করা পিন বসানো। ডানপাশের লোকটা পাঞ্জাবি পড়া।বাকি দুজনের চেহারা রুক্ষ আর গম্ভীর হলেও তার চেহারাটা কেমন যেন হাসি হাসি। বেশ সুদর্শন মানুষ।

ইন্টারভিউ রুম থেকে শুধুমাত্র নাম ,বয়স,বাসার ঠিকানা জিজ্ঞেস করে বের করে দেয়া হলো। এই সবগুলো প্রশ্নই মাঝখানের মানুষটা করলেন। সুরমা দেয়া ভদ্রলোক তার হাতের পেন্সিল দিয়ে একটা কাগজে কি জানি আঁকছিলেন। পাঞ্জাবি পড়া মানুষটা কেবল হাসি হাসি চোখে তাকিয়ে ছিলেন। দুই মিনিটের ইন্টারভিউ থেকে বের হওয়ার সময় তিনি কেবল একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন। প্রশ্নটা ছিল,” ক্লাস ওয়ানে আপনার রোল কত ছিল?” আমি দুই সেকেন্ডের মধ্যে জবাব দিলাম, “৪১।” তিনি হাসতে হাসতে বললেন,”ক্লাসে ঠিক ৪১ জনই ছিল তাইনা?” আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।

ইন্টারভিউ শেষে অফিস থেকে বের হয়ে একঘন্টা ধরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। রাস্তায় সত্যি সত্যিই কোনো গাড়ি নেই এখন। মাথার উপর কড়া রোদ। প্রচন্ড গরম। বাস স্টপের সামনের ফুটপাতটায় একজন চা ওয়ালা বসে আছেন।লোকটা বাবার বয়সি হবে।আমি গিয়ে একটা চা দিতে বললাম। এই কড়া রোদের মধ্যে চা চাওয়ায় চাওয়ালা কেমন যেন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইলো। বললো, “হাছাই খাইবেন নি?” আমি হাসি দিয়ে বললাম, “হ চাচা।চিনি বেশি দিয়েন”। লোকটা তার ছোট্ট কাপে ফ্লাক্স থেকে চা ঢালতে লাগলো। চা নিয়ে আমি চাচার পাশে বসে গেলাম। রাস্তায় জ্যাম লেগেছে। সারি বেঁধে প্রাইভেট কার দাঁড়ানো। আমি নিশ্চুপ হয়ে কাপে চুমুক দিচ্ছি।

চা ওয়ালা কোনো কথা বলছেন। চা শেষ করে ভাবছি চাচাকে জীবন নিয়ে উস্কানি দিব।এরপর গাড়ি না পাওয়া পর্যন্ত বকবক শুনবো। আর ঠিক তখনই জ্যাম একটু ছাড়তে ছাড়তে একটা গাড়ি সামনে এসে দাঁড়ালো। কালো রঙের পাজেরো। জানালা বন্ধই ছিল, সামনে এসে জানালার কাচ নীচে নামলো। দেখলাম ভিতরে ইন্টারভিউ বোর্ডের হলুদ পাঞ্জাবি পড়া মানুষটা। তাকে দেখেও না দেখার ভান করে আমি স্বজোরে রাস্তার পাশে থুতু ফেললাম। তাকিয়ে দেখলাম ভদ্রলোক তখনো হাসছেন। ইশারায় হাত নেড়ে ডাক দিলেন আমাকে। আমি কাপ রেখে উঠে দাঁড়ালাম। চায়ের দাম আগেই দিয়ে দিয়েছি। গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা নিচু করে একটা হাসি দিলাম। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন,”এখানে কি?” আমি বললাম ,”গাড়ি পাচ্ছিনা,তাই বসে বসে চা খাচ্ছি।” “আমার গাড়িতে উঠে পড়ুন নিলয় সাহেব।নামিয়ে দেই আপনাকে”,ভদ্রলোক হাসতে হাসতে বললেন। আমি নির্লজ্জের মত উঠে পড়লাম।

এসি গাড়ি। এসি গাড়িতে আমার বমি আসে। বমি করে দিলে ভালোই হবে। কোনোমতেই চাচ্ছিনা চাকরিটা হোক। গাড়িতে মৃদু রবীন্দ্রসংগীত বাজছে। ড্রাইভার এর সাজ বেশ পরিপাটি। কালো রঙের শার্ট পেন্ট। মাথার চুল সুন্দর করে আঁচড়ানো। সাজানো গোছানো বড়লোক। কোনো বেখাপ্পা ভাব নেই। “এই গরমে চা খাচ্ছিলেন কেন?”,ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন । ” চাওয়ালা একলা একলা বেচাকেনা ছাড়া বসে ছিল। মায়া লাগছিলো স্যার”,কথাটা বলার সাথে সাথে জিহবা কাটলাম মনে মনে। এত সুন্দর উত্তর দেয়া ঠিক হয়নি।ভদ্রলোক গলে গেলে আবার সমস্যা। তিনি একটা হাসি দিলেন। বললেন, “চাকরিটা পেলে কতটুকু খুশি হবে?” এই বার মোক্ষম সুযোগ পেলাম। সরাসরি বলে দিতে হবে।

-“একদম খুশি হবোনা স্যার।”, গম্ভীর হয়ে বললাম।

-কিন্তু কেন?

-ইচ্ছা নেই। প্রেমিকা জোর করে পাঠিয়েছে।চাকরি হলে বিয়ে হয়ে যাবে। বিয়ে করতে চাচ্ছিনা।

-তাহলে ভবিষ্যতে কি করবে তুমি?

– লেখক হবো স্যার।কবিতা লিখতে ভালো লাগে।

– কতটা কবিতা লিখেছো এ পর্যন্ত?

– হবে স্যার শ-দুয়েক।

– একটা শুনাও তো।

– দু লাইন শুনাই স্যার…

” কাক ডাকা ভোরে মোরগ ডাকে জোরে জোরে হঠাৎ বৃষ্টি পরে বুক ধড়ফড় করে !” এক নিঃশ্বাসে ছড়াটা পড়ে বেশ স্বস্তি পেলাম। নিজের উপর বেশ গর্ববোধ হচ্ছে। তাকিয়ে দেখলাম ভদ্রলোকের চেহারায় একটা তীক্ষ্ণ হাসি।কেমন যেন অন্য সময়ের হাসির সাথে মিলছেনা। “আরেকটা শুনাও তো দেখি”,ভদ্রলোক তীক্ষ্ণ ভারী গলায় বললেন। কেমন যেন ভয় লেগে উঠলো। মনে হচ্ছে আমার মনের সব ব্যাপার তিনি বুঝতে পারছেন।

আমি নিঃশ্বাস ফেলে আরেকটা ছড়া ধরলাম , ” অন্ধকারে লাগছে ভয় জয় বাংলা ,বাংলার জয় এতোটুক বলার পর এবার সত্যি সত্যি জিহ্বায় কামড় দিলাম। স্কুলের বেঞ্চ এ আগে ইচ্ছামতো উল্টাপাল্টা ছড়া লিখতাম। সেই পদ্ধতি খাটাতে গিয়ে পুরানো অভ্যাসে উল্টাপাল্টা লাইন চলে এসেছে। তাকিয়ে দেখি ভদ্রলোকের তীক্ষ্ণ হাসি আরো তীক্ষ্ণ হয়েছে। হয়তো আমার লেখক হবার অভিনয় ধরে ফেলেছেন। একটু ব্যঙ্গ করেই বললেন,-“বাহ বেশ ভালো কবিতা লেখো। আমাকে একটা অটোগ্রাফ দিয়ো ভবিষ্যতের কবি। তুমি করে বললাম,কিছু মনে করোনা।”

-” জি স্যার ,জি সার”।
– প্রেমিকা কি করে?
– অনার্স থার্ড ইয়ার,ইংরেজি ডিপার্টমেন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্যার !
– ভালো ভালো। বিয়ে করলে সমস্যা কি?
– স্যার অনেক দায়িত্ব।প্রেমিকাকে ভয় পাই ।
– ও আচ্ছা।

ভদ্রলোক এরপর পুরো রাস্তা চুপ চাপ মুচকি হেসে বসে রইলেন।আর আমি এসিতেও কুলকুল করে ঘামতে লাগলাম। কেন এত ভয় পাচ্ছি নিজেও জানিনা। বাসার সামনে গাড়ি থেকে নামার পর ভদ্রলোক জানালা দিয়ে মাথা বের করে বললেন,”ইয়ং মেন ! বই বের হলে পাঠিয়ে দিয়ো অফিসে। বেস্ট অফ লাক।” নিঃশ্বাস ফেলে বাসায় উঠে গেলাম। মনে মনে একটা শান্তিও পেলাম। এতকিছুর পর চাকরি নির্ঘাত হবেনা।

আমার একটাই সমস্যা। প্রত্যেকটা ইন্টারভিউতে উল্টাপাল্টা কিছু করতে হয়। নয়তো টিকে যাওয়ার সম্ভাবনা নব্বই ভাগ থাকে। শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশি হলে যা হয়। সিভি আমার বাবা তৈরি করে দিয়েছেন। সেটাই দেখাতে হয়।
ভার্সিটা থেকে বের হবার একমাসের মাথায় তরু আর বাবা মিলে আমাকে চাকরিতে ঢুকানোর সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র করে চলেছে। কিন্তু আমার চাকরি করার কোনো ইচ্ছা নেই আপাতত। দীর্ঘ বিশ বছর আমি খালি পড়াশুনাই করেছি।
একবছর তাই বেকার জীবনযাপন করতে চাই আমি। আমার এই সিদ্ধান্ত আমি ভার্সিটি থেকে বের হবার পরই সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি। জানানোটাই সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। এখন সবাই আমার কানের কাছে দিনরাত চাকরি চাকরি করে। এই চাকরিটা তরু খুঁজে এনেছে।বেচারি আমাকে নিয়ে ভীষণ ভয়ে আছে। তার ধারণা এখন চাকরিতে না ঢুকলে পরে আর চাকরি হবেনা,আমাদের বিয়েও হবেনা। আর তার দৃষ্টিতে আমি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অকর্মণ্য ব্যক্তি। আমি তার থেকে গুনেগুনে তিনবছরের বড় হওয়া সত্ত্বেও ন্যুনতম শ্রদ্ধাবোধ সে প্রদর্শন করেনা।

বরং তাকে আমি উল্টো ভয় পাই। সব মিলিয়ে আমি একটা গাঁজাখুরি অবস্থায় আছি। এই নিয়ে পনেরো নাম্বার ইন্টারভিউ দিয়ে আসলাম এবং এটাই সবচেয়ে বিদঘুটে ইন্টারভিউ। আশা করি এতেও কিছু হবেনা। আমি মনের সুখে জয়বাংলা চিৎকার করতে করতে বাসায় ঢুকলাম। ঢুকে দেখি বাবা আমার দিকে টেরা চোখে তাকিয়ে আছে। আমি সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ঘরে ঢুকে গেলাম। আজ রবিবার। সকাল ছয়টা। বাসার সবাই বেশ খুশি। দু সপ্তাহ আগে আমি ইন্টারভিউটা দিয়েছিলাম। তিনদিন আগে সেই চাকরির জয়েনিং লেটার পেয়েছি। এখন আমি শার্ট পেন্ট পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই গাধাটার কথা ভাবছি।

আয়নায় নিজেকে এখন গাধা গাধাই মনে হচ্ছে। বারবার খালি ভাবছি আমি অফিসে কিভাবে যাবো। সেদিন চাকরির লেটারটা সাথে আরেকটা লেটার পেয়েছিলাম। জনাব শাহাবুদ্দিন খানমের চিঠি। হলুদ পাঞ্জাবি ওয়ালা সেই ভদ্রলোক চিঠিতে লিখে রেখেছেন, “অনেকদিন অফিসের স্টাফদের বিয়ের দাওয়াত খাইনা। দাওয়াতটা সময়মত দিয়ে দিয়ো। জয় বাংলা,বাংলার জয়।” আমিও মনে মনে জয়বাংলা বলে ঘর থেকে বের হয়ে পড়লাম। কথায় আছে, “কপালের লিখন না যায় খণ্ডন”..

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত