একজন বইপোকার আত্মকাহিনী

একজন বইপোকার আত্মকাহিনী

“আমাকে একটু বোরহানী দিবেন”,মেয়েটা ইশারায় ডাকলো নাহিদকে । “এই নেন ম্যাডাম”, বলে এক গ্লাস বোরহানী দিয়ে মেয়েটার দিকে এক পলক তাকালো নাহিদ । “কোথায় যেন দেখেছি ? নাহ্ , মনে করতে পারছি না ।” আরেক জনের ডাকে চলে গেল ও বোরহানী দিতে । সী সেল রেস্টুরেন্ট ।

আজ বিয়ের পার্টি চলছে এখানে । এই রেস্টুরেন্টের সাথে এক সপ্তাহের জন্য পার্টটাইম চুক্তি করেছে নাহিদ। একসপ্তাহের মধ্যে এই রেস্টুরেন্টের সকল পার্টিতে খাবার সার্ভ করবে ও । আজই শেষ দিন । অনুষ্ঠান শেষে নিজের পারিশ্রমিক হিসাবে চারটা পাঁচশত টাকার নোট নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল ও । বইমেলার আজকেই শেষ দিন । অনেক ভিড় । নাহিদ অনেক কষ্টে ভিড় ঠেলে মেলার ভিতরে প্রবেশ করলো । নিজের পছন্দের বইগুলো বেছে বেছে কিনলো পারিশ্রমিকের টাকা দিয়ে । বইগুলো নিয়ে যখন বাড়ি ফিরছিলো তখন ও গত সপ্তাহের সব কষ্ট ভুলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল । পরদিন ।

ক্লাশ শেষে ভার্সিটির মাঠে বসে বই পড়ছিলো নাহিদ । “এই যে শুনছেন!”পরিচিত একটা কন্ঠ শুনে মুখ তুলে দেখলো রেস্টুরেন্টের সেই মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে । “আরে আপনি ! কাল না আপনাকে সী সেলে দেখলাম । এখানে কি করছেন ?” মেয়েটা জিজ্ঞাসা করলো । “আমি এই ভার্সিটিতে বিবিএ ডিপার্টমেন্টে পড়ি, চতুর্থ সেমিষ্টার,” সহজ সরল ভঙ্গিতে বলল নাহিদ । একটু অবাক হল মেয়েটা,”আমি না কিছুই বুঝতেছি না । একটু বুঝাবেন প্লিজ।” বইটা বন্ধ করে চশমাটা চোখ থেকে খুলে নাহিদ বলল,”আমি ঐ রেস্টুরেন্টে পার্টটাইম কাজ করেছিলাম ।” “কিন্তু আপনাকে দেখে তো এত গরীব মনে হয় না,”নাহিদের পা হতে মাথা পর্যন্ত লক্ষ্য করে মেয়েটি বলল ।

“জ্বী, ঠিকই ধরেছেন । আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে । আসলে আমার প্রচুর বই পড়ার শখ । বই কিনতে খুব ভালো লাগে । আর তাছাড়া আমার একটা লাইব্রেরী আছে । আমি আমার লাইব্রেরীকে আরও বড় করতে চাই, আরও অনেক বই সংগ্রহ করতে চাই । কিন্তু সেই জন্য আমার যত টাকা লাগে সেটা আমি নিজেই উপার্জন করতে চাই । আর জানেন নিশ্চয়ই পৃথিবীতে কোন কাজই ছোট নয়,”বলল নাহিদ । “সেটা জানি । কিন্তু তাই বলে সামান্য বইয়ের জন্য আপনি রেস্টুরেন্টে খাবার সার্ভ করবেন ?” নাহিদের পাশে বসল মেয়েটি ।

“বই কখনও সামান্য নয় ; যারা বইকে ভালোবাসে তাদের কাছে বই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু ; নিজের জীবনের চেয়েও দামী,”বইয়ের দিকে তাকালো নাহিদ । “আপনি তো অদ্ভূত মানুষ । আপনার নাম কি ?” জিজ্ঞেস করলো মেয়েটি । “আমি নাহিদ । আপনি ? সহজ ভঙ্গিতে উত্তর দিল ও ।” “আমি ইরা, বিবিএ তেই পড়ি । তবে আপনার জুনিয়র,”হেসে উত্তর দিল ইরা । “ঠিক আছে । এখন আমার ক্লাশ আছে, যাই,”বইগুলো হাতে নিয়ে চলে গেল নাহিদ । ওর গমন পথে দিকে তাকিয়ে রইলো ইরা । পরদিন ক্যাম্পাসে আবার ওদের দেখা । হাঁটছিল নাহিদ । ”

“এই যে বই পাগল ! একটু দাঁড়ান । কথা আছে,”ইরা ইশারায় থামতে বলল নাহিদকে । ওর ডাকে দাঁড়ালো নাহিদ ।

“আমি বই পড়তে চাই । আমাকে আপনার লাইব্রেরীতে নিয়ে যাবেন ?”ইরা বলল।

“হুম, অবশ্যই,চলেন,”হাসি মুখে বলল নাহিদ । লাইব্রেরী দেখে ইরা বলল –

“অসম্ভব সুন্দর সাজিয়েছেন তো আপনি আপনার লাইব্রেরীকে !”

“আচ্ছা আপনি নিজে লিখেন না ?” জিজ্ঞাসা করলো ইরা ।

“হ্যাঁ, লিখি ।” অকপট উত্তর নাহিদের ।

” ঠিক আছে আপনার লিখা ডায়েরী আর কিছু বই দেন, আমি পড়বো,”ইরা বলল।

এইভাবেই ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে । ইরা নাহিদের লেখা পড়ে অবাক হয়ে যায় । “এত সুন্দর মনের মাধুরী মিশিয়ে মানুষ লিখে কি করে !” ভাবে ও। কয়েক দিন একসাথে ঘুরার পর ধীরে ধীরে নাহিদের লেখার প্রতি, নাহিদের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে ইরা, ও ভালোবেসে ফেলে নাহিদকে । “কিন্তু নাহিদ তো অগোছালো, যদিও সহজ সরল ; আর সারাক্ষণ শুধু বই,বই করে । ও কি ভালোবাসবে আমাকে ? ভাবে ইরা ।”

অনেক ভেবে ও ঠিক করলো,”নাহ্ , কালই ও নাহিদকে বলবে ভালোবাসার কথা । পরদিন নাহিদ ভার্সিটির মাঠে বসেছিল । ইরা এসে বসলো ওর পাশে । “তুমি আসছো ? তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম । কি হয়েছে জানো?”,ইরার দিকে তাকিয়ে বলল নাহিদ । “কি হয়েছে ?” অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো ও । “আমার পাশের ফ্ল্যাটের একটা মেয়ে আমাকে প্রোপোজ করেছে,” হাসতে হাসতে বলল নাহিদ । “তুমি কি বললে ?” নিরস স্বরে জিজ্ঞাসা করলো ইরা । “কি আর বলবো ? আমি কখনোও কাউকে ভালোবাসবো না,”সরল ভঙ্গিতে বলল নাহিদ । “কেন ?,”জিজ্ঞাসা করলো ইরা ।

“কেন আবার ? ভালোবাসা মানেই মেয়েটার প্রতি কেয়ার নাও, তার কথায় উঠো বসো, তার পিছনে টাকা খরচ কর । আর কাউকে ভালোবাসলে হয়তো বইয়ের প্রতি আমার ভালোবাসাটাও কমে যাবে । নিজের মত করে আর লিখতে পারবো না । সবকিছু মেয়েকেন্দ্রিক হয়ে পড়বে । আমি বই ছাড়া আর কিছুই ভাবতে চাই না । কাউকে ভালোবাসতে চাই না । আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে কার ফোন বা মেসেজ পেতে চাই না ; আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে সুন্দর সকালের প্রকৃতি নিয়ে কবিতা লিখতে চাই,”স্বাভাবিক ভাবে বলল নাহিদ ।

তখনই বাসের হর্ণ বাজলো ভার্সিটি গেইটের সামনে । ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরীর একটা বাস এসেছে । তাড়াহুড়ো করে ইরার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল নাহিদ । ইরা ওর ব্যাগ থেকে নাহিদের জন্য আনা দুটো গোলাপ বের করে ছুড়ে ফেলে দিল । দূর থেকে দেখলো বাস থেকে নতুন বই পেয়ে হাসিমুখে বই পড়ছে নাহিদ । “থাক, ও সারাজীবন এই ভাবেই খুশি থাকুক , ভালো থাকুক বই নিয়ে,”মুচকি হেসে বাড়ির পানে পা বাড়ালো ইরা ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত