বেরঙিন রঙপেন্সিল

বেরঙিন রঙপেন্সিল

বিচারকমন্ডলীর চেয়ারে বসে থাকা সবাই কাঁদছে ! স্টেইজে দাঁড়ানো ব্যক্তিটাও কাঁদছে ! দর্শকসারির সবার চোখেই জল । শুধুমাত্র কর্ণারের সিটে বসা একজন ভদ্রমহিলা অঝোরে কেঁদে যাচ্ছেন । কেউ একজন পাশ থেকে জিজ্ঞেস করলো,

– আপনি কি খুবই মর্মাহত হয়েছেন ? করুণ কণ্ঠে ভদ্রমহিলা উত্তর দিলেন,
– আমি চিত্রার মা ।

অক্টোবর মাসের প্রথম শুক্রবার বিশ্ব হাসি দিবস উপলক্ষ্যে শহরে জেলাপর্যায়ে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল । স্ত্রীর জোড়াজুড়িতে চিন্ময় সেখানে অংগ্রহন করে । দুই রাউন্ডে প্রতিযোগিতা হবে । সবাই প্রথম রাউন্ডে যে যার মত এঁকে জমা দিলো । প্রথম রাউন্ডের ফলাফলে চিন্ময় প্রথম হয়েছিল । খুব আনন্দ হয়েছিল ওর । দুপুরে খাওয়া শেষে দ্বিতীয় রাউন্ড শুরু হয় । সবাই নিজেকে সেরা ভাবে উপস্থাপিত করার চেষ্টা করেছিল । চিন্ময়ও নিজের ইচ্ছেমত এঁকেছিল । প্রায় ১০-১২জন প্রতিযোগী তাদের আর্টপেপার জমা দিলো । কিছুক্ষণ পর ফলাফল ঘোষনার পর্ব । উপস্থাপক স্টেইজে উঠে প্রথম রাউন্ডে যে প্রথম হয়েছিল তার নাম আবার ঘোষনা দিলো । বিচারককে অনুরোধ করলো ফাইনাল বিজয়ীদের নাম ঘোষনা করার জন্য । এরপর অতিথিদের বক্তব্য শুরু হয় । শেষ যিনি প্রধান অতিথি তিনি তার বক্তব্যে সবাইকে প্রায় অবাক করে দিয়েছিল ।

– আমরা যারা বিচারক ছিলাম তারা প্রায় সবাই প্রথম রাউন্ডে চিন্ময় রায়ের অঙ্কিত চিত্র দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম । ভেবেছিলাম ছবি এঁকে যে মনের ভাব এতটা প্রকাশ করা যায় তা এই ছবিটা না দেখলে হয়তো কখনো বুঝতামই না । তারপর আমরা শেষ রাউন্ডে তার থেকে আরও ভাল কিছু আশা করেছিলাম । কিন্তু তিনি কি এঁকেছেন তা কেউই বুঝতে পারছে না । হয়তো তিনি বিজয়ীদের মধ্যে নাও থাকতে পারে, তবে আগের চিত্র দেখে এতই মুগ্ধ হয়েছি যে আমি অথবা আমরা এই ছবিটার রহস্য জানতে চাই । আমি চিন্ময় রায়কে অনুরোধ করছি যদি তিনি একটু স্টেইজে আসতেন চিন্ময় ছোট ছোট পায়ে স্টেইজের দিকে আসছে । স্টেইজে উঠার পর প্রধান বিচারক তার সাথে করমর্দন করলো । তারপর বললো,

– আপনি খুব সুন্দর ছবি আঁকেন । কিন্তু দ্বিতীয় ছবিটায় কি এঁকেছেন একটু যদি বলতেন ।

চিন্ময় মাইক্রোফোন টা হাতে নিয়ে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে আছে । তারপর ও সবাইকে ওর আর্টপেপারটা দেখালো। ওর পেপারে বড় করে একটা টেডি বিয়ার আঁকা । সেটার হাত ধরে আছে একটা ছোট্ট মেয়ে । মেয়েটার সামনে একটা সাদা কাগজ রাখা । কাগজের মধ্যে লাল রঙপেন্সিল দিয়ে কিছু আঁকাবাঁকা দাগ টানা । কাগজের পাশেই একটা রুবিক্স কিউব এলোমেলো ভাবে পরে আছে । এ সব কিছুর চারপাশে খাঁচার মত আঁকা রয়েছে । অর্থাৎ মেয়েটা খাঁচার মধ্যে বন্দি । আর চারপাশে গাছ-গাছালি, একটা খেলার মাঠ আর সেই মাঠে বাচ্চারা খেলছে । তারপর ও ছবিটার কথা বলতে লাগলো । দর্শক সারির সবাই খুব মনযোগী দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে ।

– এই ছবিটাতে যে ছোট্ট মেয়ে আছে, ও আমারই মেয়ে । ওর নাম চিত্রা । চিত্রা গত দু’বছর আগে আলোর ঝলক নিয়ে আমাদের ছোট্ট পরিবারে জন্মেছিল । আমি নিজের নাম আর কর্মের সাথে মিল রেখে আমার পুতুলের মত মেয়ের নাম দিয়েছিলাম চিত্রা । আমি একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছে । পাশাপাশি ছোটখাটো একজন চিত্রশিল্পী । কাজের ফাকে ফাকে প্রায়ই ছবি আঁকে । চিত্রার মা তুলীর সাথে প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে আমাদের পছন্দানুযায়ী পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয়েছিল । খুব সুন্দর করেই যাচ্ছিল আমাদের জীবনের সোনালী মূহুর্তগুলো । বিয়ের প্রায় দু’বছরের মধ্যেই পরিবারে নতুন সদস্য চলে এলো । ফুটফুটে কণ্যা সন্তান, দেখতে পুতুলের চেয়েও সুন্দর । একজন বাবা, একজন মা, তাদের সন্তান আর সবমিলিয়ে আমাদের সংসার একটা সুখের মহল হয়ে গিয়েছিল । সময়ের সাথে সাথে পুতুলের হাত-পা ছোড়াছুড়ি বাড়তে লাগলো । চিত্রার বয়স যখন এক বছর পেরোলো আমি ওর জন্য মার্কেট থেকে একটা টেডি কিনে এনেছিলাম । চিত্রা যখন বসতে শিখেছে, সারাক্ষণ পুতুলটাকে হাতে ধরে রাখে । ঘুমানোর সময় ওটাকে পাশে রেখেই ঘুমায় ।

চিত্রার মুখ থেকে ছোট ছোট বুলিও ফুটেছে । মাঝে মধ্যেই পা পা বলে ডাকে । একসাথে কয়েকবার ডাকলে সেটা পাপা হয়ে যায় । আমি ওর মুখে পাপা ডাক শুনে আনন্দে মেতে উঠি । চিত্রার আঁকাআঁকির জন্য আমি এক প্যাকেট রঙপেন্সিল নিয়ে এসেছিলাম । সাদা কাগজে চিত্রা শুধু লাল রঙপেন্সিল দিয়েই আঁকাআঁকি করতো । চিত্রার বয়স যখন দেড় বছর তখন ও আমার রুবিক্স কিউবটা হাতে নিয়ে সেটাকে ঘুরাতো । ওটার প্রতি ওর খুব আগ্রহ ছিল । সবমিলে আমাদের পরিবারে একমাত্র হাসির কারণ ছিল ও । গত দু’মাস হলো ও আর নেই । বিচারকমন্ডলী থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা দর্শক নির্বাক হয়ে চিন্ময়ের দিকে তাকিয়ে আছে । চিন্ময় মাইক্রোফোন মুখের কাছে রেখেও চুপ হয়ে আছে ।

ওর মা থ্যালাসেমিয়া রোগাক্রান্ত ছিল । যার ফলে ও জন্মের সাথে করেই এই রোগ নিয়ে এসেছিল । ওর যখন দেড় বছর হলো তখন থেকেই ওর সমস্যা দেখা দিয়েছিল । তারপর কিছুদিন পরেই আজ দুপুরে খেতে বসে একটা বাচ্চাকে দেখলাম ওর বাবার প্লেটের খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে । সেই বাচ্চাটাও ওর বাবাকে পাপা বলে ডাকে । খাবার পর দেখলাম সেই বাচ্চাটাও ওর বাবার পেন্সিল নিয়ে আঁকাআঁকি করছে । সব দেখে চিত্রার কথা খুব মনে পড়ে গেল । আমি যখন আঁকতে বসেছিলাম আমি চিত্রাকে ছাড়া আর কিছুই কল্পনা করতে পারিনি ।

আমার মনে হলো- সবাই তার নিজের স্বাধীনতা উপভোগ করছে, গাছ-গাছালি ঘেরা খোলা মাঠে যে যার মত বিনোদন করছে । শুধুমাত্র আমার মেয়েটাই বন্দি । আমার মেয়েটাই বঞ্চিত হলো ওর সেই অধিকার থেকে । শুরু হওয়ার আগেই সব শেষ হয়ে গেল । তাই ওর সব কাজকর্ম, ওর কিছু স্মৃতি আমি আমার পেপারে এঁকে দিয়ে এসেছি । আমি জানি হয়তো আমি বিজয়ীদের তালিকায় থাকতে পারবো না তবে আমি যে আমার মেয়ের, আমার চিত্রার প্রতিচ্ছবি এখানে এঁকে দিয়ে গেলাম এতে আমার বিজয়ীদের তালিকায় থাকার আনন্দের চেয়েও বেশি আনন্দ পেয়েছি । আর কি বা চাই ভাল থাকবেন ।

এই বলে মাইক্রোফোন টা উপস্থাপকের হাতে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক পাশে । বিচারকমন্ডলী, উপস্থাপক আর দর্শকবৃন্দ সবাই, সবাই স্তব্ধ । সবার চোখের কোণেই জল উপস্থিত । বিচারকমন্ডলীর চেয়ারে বসে থাকা সবাই কাঁদছে ! স্টেইজে দাঁড়ানো ব্যক্তিটাও কাঁদছে ! দর্শকসারির সবার চোখেই জল । শুধুমাত্র কর্ণারের সিটে বসা একজন ভদ্রমহিলা অঝোরে কেঁদে যাচ্ছেন । কেউ একজন পাশ থেকে জিজ্ঞেস করলো,

– আপনি কি খুবই মর্মাহত হয়েছেন ? করুণ কণ্ঠে ভদ্রমহিলা উত্তর দিলেন,
– আমি চিত্রার মা ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত