তহুরা খালার গায়ে হলুদ হচ্ছে। আমি তার কাছে গেলাম, তিনি ফিসফিস করে বললেন, হানিফ আমাকে একটু বিষ এনে দিবি? আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম, চোখদুটো চিকচিক করছে, সারা রাত কেঁদেছে বুঝা যায়।আমি কোন কথা বললাম না,অশ্রু মুছে সেখান থেকে বেড়িয়ে এলাম।
তহুরা খালা আমার সমবয়সী। তাদের অবস্থা ভালো নয়,বেশ গরীব। সে আমার মায়ের দুর সম্পর্কে বোন। নানা বাড়িতে ফাইফরমাশ খাটে। তার বাবার পক্ষে চার ভাইবোনকে পালন করা কঠিন। কিছুদূর পড়াশোনা করার পর অর্থের অভাবে আর হয়ে উঠেনি।
আমি তখন হাইস্কুলে পড়ি।তখন থেকে তহুরা খালার সাথে আমার বেশ খাতির।এত সুন্দর এবং মিষ্টি একটা মেয়ে ছিল সে, এক দেখাতেই সবাই মুগ্ধ হয়ে যেত। অল্প বয়সে এতো সুন্দর মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি। গায়ের রং দুধে আলতা,চেহারা মায়া কাড়া, গরীবের ঘরে এমন মেয়ে অচিন্তনীয়! সে যেখানে যেতো, সে জায়গাটা যেনো আলোকিত হয়ে যেতো!
সে আমার খালা হলে ও তীব্র একটা টান অনুভব করতাম তার প্রতি। তার সাথে মেশার জন্যই কারনে অকারণে নানা বাড়ি চলে যেতাম। সেও আমাকে দেখে খুশি হতো। নানাী বলতেন, এতো লক্ষী একটা মেয়ে, নিশ্চিত এ মেয়ের ভালো একটা ঘরে বিয়ে হবে।
আমাদের বাড়িতে কোন কাজের দরকার হলেই তহুরা খালার ডাক পরতো,সে এসে সব কাজ সামলাতো।মা তাকে অনেক পছন্দ করতেন, তাই মাঝে মাঝেই আমাদের বাড়িতে তার ডাক পরতো। আমার মনে হতো আমার সাথে মেশার জন্য খালা ঘনঘন আমাদের বাড়িতে আসতো। তারা তিন বোন এক ভাই ছিল, ভাই ছোট। আমার এস এস সি পরীক্ষার সময় খালার বিয়ের তোড়জোড় শুরু হলো। আমার মনে হলো যেহেতু খালা এতো সুন্দর নিশ্চয় তার একটা সুন্দর ছেলের সাথে বিয়ে হবে।
ঘটক একটা সম্পর্ক এনেছে। ছেলের বয়স একটু বেশি তবে প্রচুর টাকা পয়সার মালিক। বিয়ের সমস্ত খরচ ছেলে বহন করবে। তার বাবা বিয়ের খরচ থেকে বাঁচার জন্য রাজি হয়ে গেল। বিয়ের কথা বার্তার দিন আমি গেলাম। ছেলে একেবারে কালো, বয়স বেশি,ভাংগা চোরা চেহারা,মাথায় বিশাল টাক। ছেলে দেখে আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। কেউ এ বিয়ের পক্ষে নয়,শুধু মেয়ের বাবা মেয়ে পার করার জন্য রাজি হয়ে গেল।
আমি তহুরা খালার কাছে গিয়ে বললাম, খালা তুমি এ বিয়েতে রাজি হইয়ো না।সে কোন কথা বললো না,শুধু চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরতে লাগলো। আমি বললাম, তুমি এ লোকের সাথে কখনো সুখী হবে না,এর সাথে তোমার যায় না। তুমি একে পছন্দ করবে? সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আপন মনে বললো, ঠিক মতো খাবার পাইনা, তার আবার পছন্দ!
আমি মাকে গিয়ে ধরলাম, মা এ বিয়ে ভেংগে দাও। মা অবাক হয়ে বললেন, আমি এ বিয়ে ভাংতে যাবো কেন?আমি বিয়ে ভাংগার কে? আমি বললাম, খালার সাথে এ লোকের যায় না, মা। মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, গরীবের পছন্দ অপছন্দ থাকে না। গরীবের ঘরে মেয়ে হয়ে জম্ম নেওয়াটাও এক ধরনের অভিশাপ!
তহুরা খালা অল্প কথার মানুষ। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল। তার জন্য আমার মনটা কেমন করে উঠতো! মাঝে মাঝে মন চাইতো,ঐ লোকটার মাথা ফাটিয়ে দিয়ে আসি,এতো বজ্জাত চেহারা নিয়ে কেমন করে খালার মতো একটা মেয়ে বিয়ে করতে আসে? শুধু টাকার জোরে!
বিয়ের দু’দিন আগেই আমরা নানা বাড়ি পৌছে গেলাম। সবার আগে তহুরা খালার সাথে দেখা করলাম, খালা চুপি চুপি আমাকে তার ঘরে নিয়ে গেলো, তারপর কান্নাভেজা কন্ঠে বললো, আমার একটা উপকার করবি তুই? আমি বললাম, কি করবো? তোর ছোট চাচাকে একটা চিঠি দিতে পারবি? বলেই বালিশের নীচ থেকে একটা খাম বের করে আমার হাতে দিল।আমি খাম হাতে নিয়ে কিছুক্ষন বসে রইলাম,তারপর আস্তে আস্তে বেড়িয়ে এলাম।
ছোট চাচা ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। সারাক্ষণ পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। অন্য দিকে মন দেওয়ার তার সময় নাই। তার জন্য অপেক্ষা করছে রাজত্ব সহ রাজকন্যা। তহুরা খালা তাহলে ছোট চাচাকে দেখার জন্য আমাদের বাসায় যেতো! এই গরীব মেয়েটি চাচার কাছে পাত্তা পাবে না,ভালো করেই জানি।আমি চিঠিটা লুকিয়ে ফেললাম।
গায়ে হলুদ হচ্ছে। খালা পাথরের মুর্তি হয়ে বসে আছে। আমি তার সামনে যেতে পারছি না,খালি মনে হচ্ছে যদি কিছু করতে পারতাম! একবার হলুদ দেওয়ার জন্য কাছে গেলাম, তারপর আস্তে করে বললাম,খালা আমি ছোট চাচাকে চিঠি দেইনি।
তিনি অশ্রুঝরা চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, ভালোই করেছিস। অনেকক্ষন কেউ কোন কথা বললাম না,এক সময় খালা ফিসফিস করে বললেন, আমাকে একটু বিষ এনে দিতে পারবি? আমি অশ্রু লুকিয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে এলাম। খালার বিয়ে হয়ে গেলো। যাওয়ার সময় সে এক ফোটা চোখের পানি ফেললো না। শান্ত মেয়েটা যেন জীবন্ত লাশ হয়ে গেল।
চার বছরে খালার দুটি বাচ্চা হলো। এ কয় বছরে সে একবারও বাপের বাড়ি আসেনি।পাঁচ বছরের মাথায় তার স্বামী মারা গেলো। অতিরিক্ত নেশা করতো সে,কিডনি লিভার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তার স্বামীর মৃত্যুর সময় লাশ মাটি দিতে গেলাম।খালার সেই জৌলুশ নেই। কাছে গিয়ে কথা বলতে চাইলাম। সে আমার সাথে কোন কথা বললো না,পাথরের মুর্তি হয়ে বসে রইলো। বাড়ি ফিরে এসে খালার চিঠি টার কথা মনে পরলো,কি লেখা ছিল সেই চিঠিতে? কখনো দেখা হয়নি। আলমারি খুলে চিঠি বের করলাম, এতদিন গুরুত্বহীন হয়ে এক কোনায় পরে ছিল।
আস্তে করে চিঠির ভাজ খুললাম। তাতে শুধু একটা শব্দ লেখা- আমাকে বাঁচান! আজ হাড়েহাড়ে উপলব্ধি করছি, মেয়েদের ভাগ্য শুধু রুপ গুনের উপরেই নির্ভর করে না,বাপের টাকার উপর ও নির্ভর করে!