চুল

চুল

চুল খেয়েছেন কখনো?’ একটু চমকালাম। চব্বিশ- পঁচিশ বৎসরের ক্ষুদ্র জীবনে এমন অদ্ভুত প্রশ্নের সম্মুখীন আগে কখনো হইনি। প্রশ্ন যিনি করেছেন তিনি আমার পাশেই বসে আছেন। বয়স পঞ্চান্ন থেকে ষাট এর মধ্যে হবে, লম্বাটে চেহারা, চিকন স্বাস্থ্য, উচ্চতায় তালগাছ সমান। আমার একটা বন্ধু ছিলো স্কুলে, তালগাছ ডাকতাম সবাই ওকে। তালগাছের মতোই লম্বা বলে ‘তালগাছ!’ সুপারি গাছও অনেক লম্বা হয়, কিন্তু লম্বা কোনো মানুষকে সুপারিগাছের সাথে তুলনা করা হয়না। আজব! আমরা বসে আছি নামকরা একটা বড় ডাক্তারের সাক্ষাৎ এর অপেক্ষায়। এই ডাক্তারের সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্যে লম্বা সিরিয়াল লাগাতে হয়।

সিরিয়ালে আমার নম্বর হচ্ছে একশত পঁয়ত্রিশ। আমায় যে ভদ্রলোক অদ্ভুত প্রশ্নটি করেছেন তার নম্বর আমার ঠিক পরে। তিনি এখন দুই চোখ বন্ধ করে আমার দিকে মুখ করে রেখেছেন। আমি অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করেছি মানুষটির ডান চোখ থেকে অকারণেই জল বের হচ্ছে। ত্রিশ- পঁয়ত্রিশ সেকেন্ড পর পর টিস্যু দিয়ে ডান চোখের কোনা মুছছেন তিনি, আবার ভিজে যাচ্ছে, আবার মুছছেন। ভদ্রলোকের ডান চোখে সমস্যা; চোখ দেখাতেই আসছেন সম্ভবত। চোখে সমস্যা দেখা গেলে কালো চশমা ব্যবহার করেন সবাই। ইনি করছেন না। কালো চশমা ব্যবহার না করলেও অদ্ভুত সব প্রশ্ন করছেন। প্রশ্ন করেছেন আমি কখনো চুল খেয়েছি কিনা। ভ্রুঁ বাঁকা করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘চুল কি খাওয়ার কোনো জিনিস?’

ভদ্রলোক চোখ খুললেন, ডান চোখ ভেজা। টিস্যু দিয়ে চোখের কোনাটা মুছে নিয়ে বললেন, ‘না, ঠিক তা নয়। কোনোদিন ভুল করে খেয়ে ফেলেছিলেন কিনা? ধরুন, ভাত খাচ্ছেন, হঠাৎ পাতে একটা লম্বা চুল, আপনি অন্যমনস্ক হয়ে খেয়ে ফেললেন। গলার মাঝামাঝি পর্যন্ত গিলে নেয়ার পর টের পেলেন, মুখে চুল। কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে অনেক, চুলের অনেকটাই গিলে ফেলেছেন। অবস্থা খারাপ, অর্ধেক বাইরে অর্ধেক ভেতরে। না গিলতে পারছেন পুরোটা, না টেনে বের করতে পারছেন। হয়েছে কখনো এমন?’ ভদ্রলোক মজা করছেন না, মুখভঙ্গি সেটাই বলছে। ডাক্তার দেখাতে এসে ডাক্তারের অপেক্ষায় বাইরে বসে থেকে সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে কেউ কখনো মজা করে কিনা জানা নেই আমার। তাড়াতাড়ি আলাপ শেষ করতে চাইলাম, বললাম, ‘নাহ। হয়নি কখনো এমন। আমি অন্যমনস্ক হয়ে ভাত খাইনা। মনোযোগ দিয়েই খাই।’

ভদ্রলোক আমার দিক করে ফিরে বসলেন এবার। সম্ভবত লম্বা কোনো এক বিরক্তিকর গল্প বলার ইচ্ছে আছে তার। শুরুটা ইতিমধ্যে করে ফেলেছেন। বললেন, ‘আমার আব্বাও প্রচণ্ড মনোযোগ দিয়ে ভাত খেতেন। তারপরেও অদ্ভুত কোনো এক কারণে ভাতের প্লেটে সবসময় একটা না একটা চুল পেতেন। কোনো কোনো সময় মুখেও চলে যেতো; লম্বা চুল।’ আমি বিরক্তিবোধ করলাম; ভদ্রলোক গল্প ফাঁদছেন বসে বসে। পারিবারিক গল্প। আব্বা দিয়ে শুরু হয়েছে, তারপর আম্মা, ভাই, বোন, ছেলে, মেয়ে, আত্মীয় স্বজনের প্রতিটি গল্প আলাদা আলাদা করে শুনতে হবে।

এইরকম গল্পের অনেকগুলো পার্ট থাকে। আমি প্রচন্ড বিরক্তিবোধ করছি। হতাশার কথা হলো, এই টাইপের মানুষদের কারোর বিরক্তিবোধ ধরার ক্ষমতা প্রায় নেই বললেই চলে। ভদ্রলোক বলছেন, ‘প্রথম প্রথম আমলে নিইনি ব্যাপারটা। এটা আমলে নেয়ার কোনো ব্যাপারও না। সামান্য চুল নিয়ে লাফালাফি করবো, এমন মানুষ আমি না। তবে আব্বা ব্যাপারটা প্রচণ্ড গুরুত্ব সহকারে নিলেন। প্লেটে চুল পেলে সেটা হাতে নিয়ে তার চোখ শুকিয়ে যেতো। খাবারে চুল পড়লে ঘেন্না করতে দেখেছি মানুষকে, অনেকে খাবার রেখে উঠেও যায়… ভয় পেতে এই একটি মানুষকেই দেখলাম। আব্বা। চার পাঁচ দিন পর আব্বা চুল হাতে নিয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে একদিন আমায় বললেন, ‘বাবা, তোর বৌকে রান্না করতে নিষেধ করবি, আজকেই রান্নার জন্যে একটা কাজের লোক জোগাড় করবি। পুরুষ কাজের লোক, শুধু একটা ব্যাপার খেয়াল রাখবি, যাকেই জোগাড় করিস, মাথায় যেন চুল না থাকে। ন্যাড়া মাথা।’

বৌ মনে কষ্ট পেলো খুব, রাগ করে থাকলো দুই সপ্তাহ। আব্বা ভয়ানক সিরিয়াস। দুই সপ্তাহ আমায় রান্না করতে হলো, অফিস থেকে ফিরে। আব্বা বৌয়ের হাতের কিছুই খাবেন না, চাও না। দুই দিন ধরে চায়ের কাপেও চুল পাচ্ছেন। এবার একটা নয়, দু’টো করে চুল। আস্তে আস্তে চুলের পরিমাণ বাড়ছে। আব্বার ভয়ও বাড়ছে। মেজাজ খারাপ করছেন কথায় কথায়। অতএব, আমায় ন্যাড়া মাথার কাজের লোক জোগাড় করতেই হলো।’ টের পেলাম, আমি এখন ভদ্রলোকের দিকে আগ্রহী চোখে তাকাচ্ছি। গল্পের শুরুটা একটু অদ্ভুত, এটাই কি কারণ? হতে পারে। ভদ্রলোক আমার আগ্রহ দেখে একটু চুপসে গেলেন, এই ব্যাপারটাও অদ্ভুত। ব্যাপারটা স্বাভাবিক হলে ভদ্রলোক আমার আগ্রহ দেখে উৎসাহবোধ করতেন। তিনি উৎসাহ বোধ করলেন না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে টিস্যু দিয়ে ডান চোখের কোণা মুছে যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও আবার বলতে শুরু করলেন, ‘ন্যাড়া মাথার কাজের লোকের নাম রমিজ।

রমিজ উদ্দিন। দুই বাচ্চার বাবা। বাচ্চা একটা ক্লাস থ্রিতে পড়ে, আরেকটা এখনো ছোট। রমিজ উদ্দিন বাজারের কয়েকটা সস্তা ছোটখাটো হোটেলে বাবুর্চির কাজ করেছেন আগে, রান্নার হাত ভালোই। রমিজ উদ্দিনের প্রথম রান্নার দিন দুপুরে খেতে বসে আব্বা ভাত প্লেটে নিয়ে একটা দু’টো নয়, একদলা চুল পেলেন। মেয়েদের মাথার লম্বা চুল। দেখে মনে হলো, এইমাত্র কোনো মেয়ের মাথা থেকে ভয়ানক জোরে খামচি দিয়ে কিছু চুল ছিঁড়ে নিয়ে ভাতের সাথে মিশিয়ে দিয়েছে কেউ। আব্বা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন, তারপর জ্ঞান হারালেন। রমিজ উদ্দিন বিষ্মিত! চোখ বড় করে বললো, -বিশ্বাস করেন, আমি পুরা ভাতের পাতিল চেক করেছি। রমিজ উদ্দিনকে রান্নাবান্নার কাজ থেকে অব্যাহতি দেয়া হলো, আব্বা ভাত খাওয়া একেবারে বন্ধ করে দিলেন।’

ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করলেন। আমি ভদ্রলোকের চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। সিরিয়ালের একশত পঁচিশ নম্বর ডাক্তারের রুম থেকে বের হয়ে এলেন। আমার একশত পঁয়ত্রিশ; এখনো অনেক দেরি। বললাম, ‘তারপর?’ ‘আব্বা ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বিছানায় পড়ে রইলেন। স্যালাইন, তরল খাবার দেয়া হলো তাকে। তিনি চিৎকার করলেন, -সরা.. এইসব সরা আমার সামনে থেকে। এইগুলাতে চুল মিশানো আছে..! আব্বাকে ঘুমের ঔষুধ দেয়া হলো। ঘুমের ঔষুধ কাজ করলোনা, রাত দেড়টা দুইটায় তার ভয়ানক চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে যেতো। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে বলতেন, স্বপ্ন দেখেছেন।

স্বপ্নে তিনি ইয়া বড় এক প্লেটে অনেকগুলা ভাত নিয়ে খেতে বসেছেন। ভাতের সাথে চুল মিশানো আছে। দলা দলা চুল। তার প্রচণ্ড ক্ষিধে। ক্ষিধের চোটে তিনি ঐ চুল মেশানো ভাতই খেতে শুরু করেন। গলায় চুল আটকায়, কিছু চুল ভাতের সাথে গলা থেকে নেমে যায়। কিছু আটকে থাকে। মুখের বাইরে থাকা কিছু চুলের অর্ধেক গলার ভেতরে আটকে থাকে। আব্বার দমবন্ধ হয়ে আসে। তিনি গলায় আটকানো চুল মুখে হাত ঢুকিয়ে টেনে বের করার চেষ্টা করেন। চুল বের হতে চায়না, তবুও তিনি টেনে বের করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। অনেক চেষ্টার পর কিছু চুল বের হয়ে আসে। রক্তমাখা চুল। বের হওয়ার সময় গলার জায়গায় জায়গায় কেটে যায়। তিনি বমি করেন, বমির সাথে জমাট বাঁধা খন্ড খন্ড রক্তের দলা বের হয়। স্বপ্নের ভেতরেই গলায় ভয়ানক জ্বালাপোড়া শুরু হয় তার। সে কি কষ্ট!’

গল্পের এই পর্যায়ে ভদ্রলোক আমার দিকে একটা টিস্যু বাড়িয়ে দিয়েছেন। টের পেলাম, আমি ঘামছি। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। টিস্যু দিয়ে সেটা মুছে নিলাম। ভদ্রলোক বলছেন, ‘আব্বার অসুখটা মানসিক। বয়েস হয়েছে। যৌবনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলেন। সার্টিফিকেটও আছে মুক্তিযোদ্ধার। তবে বাবা কোনোদিন মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলেননি আমাদের কাছে। মানুষ যেটা লুকোয়, একটা সময় পর মানুষকে সেটা কামড়ায়। ক্ষত করে। আব্বারও তেমন হয়েছে ধারণা করলাম। আব্বা মারা যান ১৬ই ডিসেম্বর। সেদিন বিজয় দিবস। আব্বার গল্পের অর্ধেক এখানেই শেষ। বাকি অর্ধেক বাকি গল্পে বাকি গল্পটা মালশ্রীকে নিয়ে!’

আমি মুগ্ধ চোখে ভদ্রলোকের দিকে তাকাই। ভদ্রলোক একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমি নিজেও। ভদ্রলোক যদি গল্পটা শুরু করতেন, আমার আব্বা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন দিয়ে.. তবে আমি প্রথম থেকেই প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে শুনতাম গল্পটা। এখন কেন জানিনা লজ্জ্বিত বোধ করছি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘মালশ্রী কে?’ ভদ্রলোক আমার থেকে চোখ সরিয়ে একটু দুরে আশেপাশে বসে পত্রিকার পাতায় কিংবা মোবাইলের স্ক্রীনে মনোযোগ দেয়া মানুষগুলোর দিকে তাকালেন। শান্ত স্বরে বললেন, ‘আমার মেয়ে। একাদশ শ্রেণীর সবচেয়ে স্পষ্টবাদী, জিদ্দি, সাহসী আর প্রচণ্ড মেধাবী ছাত্রী। সে মারা গিয়েছে আব্বার মৃত্যুর একদিন আগে। ১৫ ই ডিসেম্বর! শুরু করি?’

আমি চুপ করে শুনছি। কেন জানিনা, প্রচণ্ড আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও গল্পের পরবর্তী অংশ শুনতে ইচ্ছে করছেনা আমার এখন। কষ্ট পাবো সম্ভবত। কষ্ট থেকে দুরে থাকার অভ্যেস। ভদ্রলোক শুরু করেছেন, ‘মালশ্রী আব্বার দেয়া নাম। মালশ্রীর আসল নাম, জান্নাতুল ফেরদাউস। এটাও আব্বার দেয়া নাম। মালশ্রী টুকটাক লিখালিখি শুরু করে নবম শ্রেণীতে থাকার সময়। আস্তে আস্তে পত্র পত্রিকায় লেখালিখি শুরু করে। পত্রিকায় তার কিছু লেখা পড়ার পর আব্বা মালশ্রী নামে ডাকতে শুরু করেন তাকে। কারণ জিজ্ঞেস করলে কখনো বলেননি। আমি পত্রিকায় মালশ্রীর লেখা পড়ে চমকালাম।

একদিন সন্ধ্যেয় সামনে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, -জান্নাত। তুমি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করোনা? মালশ্রী আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কপালে চুমু খায়, বলে, -বাবা, আমি ধর্ম নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করছি। তোমার শুনতে খারাপ লাগবে, তুমি শুধুমাত্র বংশগত মুসলিম। আমি তেমন মুসলিম হতে চাইনা। ইসলাম যদি সত্য ধর্ম হয়, তবে আমি বুঝেশুনেই মুসলিম হবো। তার আগে আমার জানতে হবে সব ধর্ম সম্পর্কে। আমি সেটাই করছি..! আমি হতাশ হলাম মেয়ের কথা শুনে, জিজ্ঞেস করলাম, -তুমি নাস্তিক..? মেয়ে আমার মুচকি হেসে উত্তর দিলো, -না বাবা, আমি নাস্তিক না। নাস্তিকেরা বিধাতা আছে বিশ্বাস করেনা। আমি করি। এবং করি বলেই সমস্যাটা জটিল। বিধাতাকে তোমরা চার পাঁচ ভাগে ভাগ করে নিয়েছো। আমি প্রত্যেকটা ভাগই পড়ছি, জানছি, বুঝার চেষ্টা করছি..! জেনেবুঝার পর যেটা সত্য বলে মনে হয়, সেটাই গ্রহন করবো।’

ভদ্রলোক কিছুক্ষণ দম নিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘মালশ্রীর লেখালিখিতে কি ইসলাম সম্পর্কে উস্কানীমূলক কিংবা বাজে মন্তব্য থাকতো?’ ‘নাহ। একদম নাহ। সে বিশ্বাস নিয়ে লিখতো। প্রত্যেকের বিশ্বাসের প্রতি সন্মান ছিলো তার, শ্রদ্ধা ছিলো, শুধু ঐ বিশ্বাসের প্রতি তার বিশ্বাস ছিলোনা। বিশ্বাস করার মতোই বিশ্বাস খুঁজেছে সে, বুঝতে চেয়েছে সবসময়। আমি এরপর আর কখনোই কিছু বলিনি মালশ্রীকে। কারণ আমি জানি, ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনা করার পর প্রচণ্ড মেধাবী, বুদ্ধিমতী এই মেয়ের কাছে স্পষ্ট হবে অনেক কিছুই।’

ভদ্রলোক চুপ করে রইলেন আবার অনেকক্ষণ। সম্ভবত গল্পের বাকি অংশ বলার জন্যে প্রস্তুত করছেন নিজেকে। গুছিয়ে নিচ্ছেন গল্প। দুই মিনিট চুপ করে থেকে ধরা গলায় বললেন, ‘মালশ্রী মারা যায় ১৫ ই ডিসেম্বর। চার/পাঁচটা ছেলে প্রায়ই তাকে ফলো করছে, আমায় জানিয়েছিলো সে। ফোনেও কিছু আজেবাজে কল আসছিলো, লেখালিখি বন্ধ করার জন্যে। কিছুদিন আমি মেয়েকে কলেজ দিয়ে আসলাম, আর নিয়ে আসলাম। এক সপ্তাহ এইভাবে চলার পর, ছেলেগুলোকে আর দেখা গেলোনা।

ফোন কলও বন্ধ হলো। এরপর মালশ্রী নিষেধ করলো কষ্ট করে তাকে আর নিয়ে আর দিয়ে আসতে। আমার অফিস উল্টোদিকে, তাই কলেজ দিয়ে আর নিয়ে আসতে সমস্যা। আব্বা তখন অসুস্থ, সব খাবারে চুল দেখছেন। খানাদানা ছেড়ে দিয়ে, বিছানায় পড়ে আছেন। ১৫ ই ডিসেম্বর কলেজে ক্লাস ছিলোনা, তবুও ১৬ই ডিসেম্বরের অনুষ্ঠান আয়োজন সংক্রান্ত কাজকর্মে কলেজ যেতে হলো ওকে। ফিরে আসেনি মালশ্রী। রাস্তার পাশের একটা জঙ্গলে অর্ধনগ্ন লাশ পাওয়া যায় ওর। লাশের পাশে টাইপ করা কাগজের টুকরোয় লিখা ছিলো, ‘এই দেশ নাস্তিকদের নয়!’ রেপ করা হয়েছে ওকে। উপর্যুপরি ধর্ষণের পর জ্ঞানহারানো মেয়েটির যোনীর ভেতরে ভেঙ্গে পড়া কয়েকটা গাছের ছোট ছোট ঢাল ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিলো।’

আমার পানির পিপাসা পেলো খুব, ভদ্রলোক ঘামছেন। ডান চোখ আগেও ভেজা ছিলো, এবার বাম চোখ থেকেও জল বের হচ্ছে। ভদ্রলোক কাঁদছেন। আমি চুপ করে ঢোক গিললাম, ভদ্রলোক বললেন, ‘আব্বা মালশ্রীর মৃত্যু সংবাদ শুনলেন রাতে। পরের দিন, ১৬ ই ডিসেম্বর সন্ধ্যেবেলায় আমায় রুমে ডাকলেন। আমি পাথরের মুর্তির মতো হয়ে গিয়েছি তখন। শক্ত, টনটনে। কোনো অনুভুতি নেই। আব্বার রুমে গিয়ে বিছানার পাশে দাঁড়াতেই বসতে বললেন তিনি। আমি পাশে বসি। আব্বা বলেন, -সম্ভবত আমি আজ মারা যাবো। তোর খুব ইচ্ছা ছিলো জানার, তোর মেয়েকে মালশ্রী নামে কেন ডাকতাম আমি? আমি চুপ করে বসে থাকি।

বাবা আমার চোখের দিকে জল ছলছল দৃষ্টি নিয়ে তাকায়, বলে, ‘১৯৭১, জুলাইয়ের মাঝামাঝি। আমি মাথায় টুপি লাগিয়ে, বাড়ির ছাদে পাকিস্তানের পতাকা লাগিয়ে গোপনীয় জায়গায় লুকিয়ে সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকা মুক্তিযোদ্ধা গুলোকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমরা অল্প কয়েকজন আছি, শান্তিকমিটির সক্রিয় সদস্য! পাকিস্তানি মিলিটারির ইনফর্মার। আমাদের বুঝার গণ্ডি ছিলো- পাকিস্তান পাকিস্তান ভাই ভাই, হুদাই ঝামেলা বাঁধাইছে কিছু বেশি বুঝি টাইপের লোকজন। দেশটাকে ইন্ডিয়ার হাতে তুলে দেবে, হিন্দুদের হাতে তুলে দেয়ার পায়তারা করেছে… এখন বোঝো ঠেলা! হিন্দু একটারও এই দেশে জায়গা নাই। আমরা মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি হিন্দু পরিবারও খুঁজি। পুরুষদের গুলি করা হবে, মেয়েদের ধর্ষণ। কাজ শেষ। জুলাই মাসের শেষের দিকে একটা মেয়ের খোঁজ পাই আমি। হিন্দু মেয়ে।

গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করছে। মেয়ে যে হিন্দু সেটা বুঝার উপায় নাই, চার কলেমা শিখা আছে মেয়ের। আরবী সুরা বলে হড়বড় করে, ইসলাম ধর্মের সব কিছুই জানে, বোরকা পরে। আর সাথে গোপনে ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচুর সাহায্য সহযোগিতাও করে ফেলেছে। আমি মিলিটারিকে জানাই ব্যাপারটা, তারপর সন্ধ্যেবেলায় কয়েকজন মিলিটারি সহ ওখানে পৌঁছোই। মেয়েটি আছে বন্ধুদের বাড়ি, এখানেই থাকে। মেয়েকে ওখান থেকে ধরে নিয়ে আসা হলো। একটা পুরনো স্কুল ঘরে হাত পেছনে বেঁধে প্রথমে চড় থাপ্পড় দিয়ে কথা বের করার চেষ্টা করলাম, মেয়ে ভীষণ শক্ত আর কি জিদ্দি। একটা কথাই বললো শুধু, ‘না!’ আসল অস্ত্র প্রয়োগ করলাম এবার, ধর্ষণ করলাম।

আঁচড় আঁচড়ে মুখে, স্তনে, উরুতে দাগ করে ফেললাম। মুখে থু থু ছিটানোয় রাগে উপুড় করে মাথার চুল ধরে হেঁচকা টান দিলাম, মাথা থেকে ছিঁড়ে হাতে কিছু চুল উঠে এলো। মেয়ের ভয়ংকর চিৎকারে স্কুলঘর কেঁপে উঠলো। মেয়েটির নাম ছিলো মালশ্রী। একটা স্পষ্টবাদী, জিদ্দি, সাহসী মেয়ে। মরে যাওয়ার আগে আমার মুখের দিকে ঘৃণাভরা চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো, -হত্যা করছিস কেন? উদ্দেশ্য কোনটা? হিন্দু বলে? নাকি মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের সহযোগীতা করেছি বলে…? আমি চুপ করে ছিলাম। উত্তর দিইনি। মালশ্রী আমার রাগান্বিত চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বললো, -এটা ধর্মযুদ্ধ নয়, অন্যায়- শোষণ- বঞ্চনার বিরুদ্ধে, প্রতিবাদের যুদ্ধ! আমাদের সবার যুদ্ধ। বিজয় ঠিক আসবে।

আমি হিন্দু; এই বিজয় আমার নয়, আমাদের হবে! যদি মেরেই ফেলতে হয়, তবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতার অপরাধে মেরে ফেল আমায়, ধর্ম আনিসনা মাঝখানে। ধর্ম দিয়ে আমিকে আমরা থেকে আলাদা করিস না। আমরা যে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখছি, ওখানে আমি আমরা আলাদা হবেনা। শুধু আমি মিলে স্বাধীন বাংলাদেশ নয়, আমি বাদেও স্বাধীন বাংলাদেশ নয়, আমরা মিলে স্বাধীন বাংলাদেশ! মালশ্রীর কথা ধরতে পেরেছো? তারা চেয়েছে যেটা, সেটা হয়নি। আমরা এখনো আমরা হতে পারিনি। স্বাধীনতার এত বৎসর পরেও এখনো আমরা থেকে আমি আলাদা করছি প্রতিনিয়ত। সবাই করছে। আমার দাদাভাইটাকেও আলাদা করেছে!’

আব্বা দম নেয়, কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিড়বিড় করে বলে, ‘স্বাধীনতা অর্ধেকই পেয়েছো তোমরা। আমার গলায় আটকানো চুলের মতো। না পুরোপুরি গিলতে পারছো, না টেনে বের করতে পারছো। আমি মুক্তিযোদ্ধা নই। যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে বেশভুষা ত্যাগ করে, পালিয়ে গিয়ে এসে অন্য অঞ্চলে কিছু মুক্তিযোদ্ধাকে নামমাত্র সাহায্য করে এই সার্টিফিকেট গলায় লটকিয়েছি। অস্ত্র হাতে দু’টা মিলিটারি মারার আগে শতশত মুক্তিযোদ্ধার গোপন আস্তানার খবর দিয়ে সর্বনাশ করেছি ওদের.. ওদের প্ল্যানের। একচল্লিশটা হিন্দু মেয়েকে ধর্ষণ করেছি। আমি স্বাধীনতা চাইনি প্রশ্নটা হচ্ছে, তুমি পেয়েছো সেটা?

১৬ই ডিসেম্বর মালশ্রী পেয়েছে..? ভদ্রলোক দম নেয়ার জন্যে থামলেন, আমি অস্বস্তিবোধ করছি। কেন বুঝতে পারছিনা। ভদ্রলোক বলছেন, ‘আব্বা মারা যান সন্ধ্যের একটু পর পরই। মারা যাওয়ার পর তার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটটা ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ফেলি আমি। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয় আব্বাকে। জানাজায় আমি ছিলামনা। অদ্ভুত এক অপরাধবোধে ভুগছিলাম, কেন সেটাও বুঝতে পারছিলামনা। মালশ্রীর লাশ নিয়ে তদন্ত চলছে, পুলিশ ব্যস্ত।

আমার ভীষণ ইচ্ছা করলো পুলিশকে গিয়ে বলতে, -থাক, তদন্তের প্রয়োজন নেই। লাশটাকে কবর দিতে দেন..! বলা হয়নি। মালশ্রীর আম্মু বিছানায় পড়ে আছে ১৫ই ডিসেম্বর থেকে, জ্ঞান হারাচ্ছেন কিছুক্ষণ পর পর। আমি শূণ্য চোখে তাকিয়ে দেখি সব। পাথর, টনটনে দৃষ্টি। কোনো অনুভুতি নেই। মালশ্রীকে কবর দিয়ে কবরের পাশে বসে থেকে প্রথমবার খেয়াল করলাম, আমার ডান চোখ দিয়ে অনবরত জল বের হচ্ছে, বের হয়ে মুখে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। অন্য চোখটা শুকনো, খটখটে! ঠিক আমার মেয়ে মালশ্রীর মতোই, মালশ্রী বড্ড শক্ত.. কখনো কাঁদেনা!’

ভদ্রলোক এখন সত্যিই অনেক শক্ত হয়ে আছেন। আমি চোখ মুছলাম, ভদ্রলোক বললেন, ‘গল্পটা কয়েক বৎসর ধরে চুলের মতো আটকে আছে গলায়। না পুরোপুরি গিলতে পারছি, না টেনে বের করতে পারছি। আপনাকে যে বলেছি, এই এখন একটু হালকা মনে হচ্ছে নিজেকে। আপনার নম্বর আসছে, উঠুন সিরিয়ালে এখন নম্বর আমারটি, একশত পঁয়ত্রিশ। আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠলাম। পেছনে ভদ্রলোক একচোখ শুকনো রেখে একচোখে অশ্রু নিয়ে বসে আছেন। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। শুকনো চোখটা মালশ্রীদের, ভেজাটা আমাদের। চোখ ফিরিয়ে নিলেই বা কি! শুকনো চোখটা হয়তো আজীবনই আক্ষেপ, কষ্ট আর হতাশায় ভেজাবে আমাদের!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত