তাই নে রে মন তাই নে

তাই নে রে মন তাই নে

কলিকাতার সমৃদ্ধ এবং আধুনিক অঞ্চলে একটি বাড়ির ড্রয়িংরুম। আসবাবপত্র মহার্ঘ রুচির পরিচায়ক। ঘরের কোণে টেলিফোন যন্ত্র।

১৯৪৬ সালের একটি অপরাহ্ন।

ঘরের মাঝখানে দুটি গদিমোড়া চেয়ার ও একটি সোফা। চেয়ারে বসিয়া আছে একটি যুবক, সোফায় একটি যুবতী। যুবকের বয়স সাতাশ-আটাশ, মাঝারি দৈর্ঘ্যের মজবুত চেহারা, কাটালো মুখ; সে অলসভাবে একটি সচিত্র পত্রিকা পাঠ করিতেছে। যুবতী সোফার কোণে ঠেস দিয়া সাদা বেবি-উল দিয়া একটি ছোট্ট জামা বুনিতেছে। যুবতীটি সুন্দরী, বয়স উনিশ কুড়ি; মুখে সদ্যফোটা ফুলের মতো একটি সতেজ সরসতা, ঠোঁট দুটি চটুল।

দুজনে থাকিয়া থাকিয়া একে অন্যের মুখের পানে চোখে তুলিতেছে, একটু হাসিয়া আবার নিজের কাজে মন দিতেছে, কথাবাতা নাই। পরস্পরের সান্নিধ্যই যেন তাহাদের তৃপ্ত করিয়া রাখিয়াছে। কয়েক মিনিট এইভাবে কাটিবার:পর যুবক হাতের পত্রিকাখানা নামাইয়া রাখিল।

যুবক : আমি এবার বাড়ি যাই।

যুবতী : (বুনিতে বুনিতে চোখে তুলিয়া) আর একটু থাকো না।

যুবক : আর বেশী থাকলে লোকে ভাববে তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারি না।

যুবতী: ভাবলেই বা।

যুবক : (উঠিবার উপক্রম করিয়া) তা ছাড়া এমনও ভাবতে পারে যে আমি সর্বদাই তোমাকে আগলে থাকি। সেটা তোমার পক্ষে খুব প্রশংসার কথা নয়।

যুবতী ঘাড় বাঁকাইয়া কিছুক্ষণ যুবককে নিরীক্ষণ করিল।

যুবতী : আসল কথাটা কি? টেনিস খেলার জন্যে মন ছটফট করছে?

যুবক : (আবার বসিয়া পড়িল) না না না তা নয়। তবে

যুবতী : তবে চুপ করে বোসো।–চা খাবে?

যুবক : এই তো খেলুম। এত ঘনঘন চা খেলে চায়ের দাম বেড়ে যাবে।

যুবতী : না, সত্যি, আর একটু থাকো। আমি বাড়িতে একলা। জামাইবাবু দিদিকে নিয়ে সেই দুপুরবেলা মেটার্নিটি হোমে গেছেন, হয়তো এখনই খবর আসবে।

যুবক : (ক্ষণেক চিন্তা করিয়া) তা এক কাজ করনা। তুমিই হয় ফোন করে খবরটা নাওনা। যুবতী বোনা রাখিয়া উঠিল।

যুবতী : এই কথাটা এতক্ষণ মনে হয়নি। এই জন্যেই তোমাকে সব সময় দরকার হয়।

যুবতী গিয়া টেলিফোন তুলিয়া লইল।

যুবতী : (নম্বর দিয়া) হ্যালো—জননী ভবন?…দেখুন, মিসেস সুবিমল রায় ওখানে গেছেন প্রসব হবার জন্যে…মিস্টার রায়ও ওখানেই আছেন…একবার ডেকে দেবেন তাঁকে? আমি তাঁর বাড়ি থেকে বলছি…জামাইবাবু! দিদির খবর কি?…ও…ও…আপনি ভয় পাননি তো?… আচ্ছা—হবার সঙ্গে সঙ্গে খবর দেবেন কিন্তু

যুবক উঠিয়া যুবতীর কাছে গিয়া দাঁড়াইয়াছিল। যুবতী ফোন রাখিয়া শঙ্কা শীর্ণ দৃষ্টিতে তাহার পানে চাহিল।

যুবক : কী?

যুবতী : এখনও ঘণ্টাখানেক।–বাবা, যত জ্বালা এই পোড়া মেয়েমানুষের।

যুবক : পোড়া পুরুষমানুষের জ্বালা আরও বেশী।

যুবতী : ওমা তাই নাকি! তোমাদেরও জ্বালা আছে?

যুবক : জ্বালা নেই? এক তো নিজেদের জ্বালা, তার ওপর তোমাদের জ্বালা। মেয়েমানুষকে ভালবাসলে জ্বালার শেষ নেই। সারা জীবন জ্বলেপুড়েই মলুম আমরা।

যুবতী : থাক, আর বাহাদুরীতে কাজ নেই। বসে থাক গিয়ে, যতক্ষণ না একটা খবর পাচ্ছি, ততক্ষণ যেতে পাবে না।

যুবক : বেশ। কিন্তু এখনি হয়তো পাড়াপড়শীরা খবর নিতে আসবে। আমাকে দেখলেই ঠাট্টা-ইয়ার্কি শুরু করে দেবে। (দরজায় ঘন্টি বাজিল) ঐ! আমি পাশের ঘরে পালাচ্ছি।

যুবতী : আচ্ছা—

যুবক সচিত্র পত্রিকা তুলিয়া লইয়া দ্রুত পাশের ঘরে অন্তর্হিত হইল। যুবতী গিয়া দ্বার খুলিল। তারপর সবিস্ময়ে পশ্চাৎপদ হইল।

যুবতী : কে!

আগাগোড়া মিলিটারি বেশ পরিহিত একটি পুরুষ প্রবেশ করিল। কাঁধে ক্রস-বেল্ট, কোমরে চামড়ার খাপে পিস্তল। চেহারা লম্বা অথচ গোলগাল, বড় বড় চোখ, গোঁফ কামানো। বয়স আন্দাজ পঁচিশ-ছাব্বিশ। সে প্রবেশ করিয়া নিজেই দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। তারপর একদৃষ্টে যুবতীর পানে চাহিতে চাহিতে ঘরের মাঝখানে আসিয়া দাঁড়াইল।

মিলিটারি : এতদিনে পেয়েছি!

যুবতী : (উৎকণ্ঠিতা) কাকে চান? কে আপনি?

মিলিটারি : কে আমি চিনতে পারলে না? তা চিনবে কি করে? এখন যে তুমি—(ব্যঙ্গভরে টুপি খুলিয়া) আমার নাম ক্যাপ্টেন অংশুমালী ধর। এবার চিনতে পারছ?

যুবতী : আপনাকে কখনও দেখিনি, নামও শুনিনি।

অংশুমালী যুবতীর কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, যুবতী দুই পা পিছাইয়া গেল।

অংশুমালী : (আবেগভরে) কমলা! তুমি আমাকে ভুলে গেছ! না, এ হতে পারে না, তুমি মিছে। কথা বলছ। পাঁচ বছরে তুমি আমাকে ভুলে যেতে পার না। মনে আছে, তুমি বলেছিলে জন্ম-জন্মান্তরেও তুমি আমাকে ভুলতে পারবে না?

কমলা স্থিরদৃষ্টিতে অংশুমালীর পানে চাহিয়া রহিল। উৎকণ্ঠা আর নাই, মুখের ভাব তার স্বাভাবিক হইয়াছে।

কমলা : কিছু মনে করবেন না। কোথায় আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল বলুন তো?

অংশুমালী : তাও বলে দিতে হবে? তুমি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ। সিমলায় দেখা হয়েছিল। এবার মনে পড়েছে? (কমলা অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়িল) এখনও মনে পড়ছে না? আমার চেহারা কি এতই বদলে গেছে। তুমি কিন্তু ঠিক তেমনি আছ, এই পাঁচ বছরে একটুও বদলাওনি।

কমলা : তা হবে। আপনি এখানে আমার সন্ধান পেলেন কি করে?

অংশুমালী : সন্ধান কি সহজে পেয়েছি? আজ ছমাস হল ফ্রন্ট থেকে ফিরেছি, সেই থেকে ক্রমাগত তোমার খোঁজ করে চলেছি। তুমি যে ঠিকানা দিয়েছিলে সেখানে গিয়ে দেখি তুমি নেই—পাগলের মতো চারিদিকে কত খুঁজে বেড়াতে লাগলুম। তারপর হঠাৎ খবর পেলুম তোমার বিয়ে হয়ে গেছে, তুমি এখানে আছ—

কমলা : বিয়ে হয়ে গেছে জেনেও এলেন?

অংশুমালী : হ্যাঁ, হাজার বার বিয়ে হলেও তুমি আমার—চিরদিনের জন্যে আমার। কমলা, গত পাঁচ বছর ধরে আমি পৃথিবীময় যুদ্ধ করে বেড়িয়েছি। কখনও প্রশান্ত মহাসাগরে, কখনও আফ্রিকার মরুভূমিতে। কিন্তু যেখানেই থাকি, তোমাকে এক মুহূর্তের জন্যে ভুলতে পারিনি। কানের কাছে যখন কামান গর্জন করেছে, মাথার ওপর বিমান বোমারুর বজ্রনাদ শুনেছি, তখনও তোমার ওই মুখখানি আমার চোখের সামনে ভেসেছে—এ ভালবাসার চেয়ে কি বিয়ে বড়?

কমলা : বসুন বসুন, আপনি বড় উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন।—চা খাবেন?

অংশুমালী : চা খেতে আসিনি। আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।

কমলা : সে কি! কোথায় নিয়ে যাবেন?

অংশুমালী : আর্মি নেভি হোটেলে, যেখানে আমি থাকি। তুমি আমার সঙ্গে থাকবে।

কমলা : কিন্তু সেটা কি ভাল দেখাবে?

অংশুমালী : বিয়ে-ফিয়ে আমি মানি না—ওসব কুসংস্কার। ভালবাসাই হচ্ছে আসল জিনিস।

কমলা : কিন্তু

অংশুমালী : কিন্তু নয়। কোনও কথা শুনব না, আমার সঙ্গে আসতে হবে। আজ এস্পার কি ওস্পার। এস। (কমলা সোফায় বসিয়া পড়িল) আসবে না? তবে এই দেখ পিস্তল।

অংশুমালী কোমর হইতে পিস্তল বাহির করিয়া কমলার দিকে নির্দেশ করিল।

কমলা : আমাকে খুন করবেন? তবে যে বললেন ভালবাসেন!

অংশুমালী : ভালবাসি বলেই খুন করব। খুন করে ফাঁসি যাব। ওঠ—চল আমার সঙ্গে। আসবে না? দেখ, তিন গুনতে যত সময় লাগে, ততক্ষণ সময় দিচ্ছি, তারপরই গুড়ুম। ওয়ান-টু-থ্রি! শুনলে না কথা? আচ্ছা আবার বলছি—ওয়ান-টু-

কমলা : (দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া) তাহলে সত্যি কথা বলতে হল। আপনি ভারি চমৎকার লোক, তাই বলতে কষ্ট হচ্ছে।

অংশুমালী : সত্যি কথা? কী সত্যি কথা?

কমলা : আমি কমলা নই, কমলার ছোট বোন—অমলা!

অংশুমালী : (পিস্তল নামাইয়া) কমলা নও। হতেই পারে না, তুমি অবিকল কমলা। দুজন মানুষের কখনও একরকম চেহারা হয়!

অমলা : আমাদের বোনে-বোনে প্রায় এরকম চেহারা। পাঁচ বছর আগে দিদি আমার মতোই দেখতে ছিল।

অংশুমালী পিস্তল খাপে রাখিয়া হতাশভাবে চেয়ারে বসিয়া পড়িল।

অংশুমালী : কিন্তু, কিন্তু কমলা তাহলে কোথায়?

অমলা : দিদিকে মেটার্নিটি হোমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার ছেলেপিলে হবে।

অংশুমালী : (মাথায় হাত দিয়া) কমলা—ছেলেপিলে—যাকে আমি পাঁচ বছর ধরে এত ভালবেসেছি—যে আমাকে এত ভালবেসেছে

অমলা : ঐখানে আপনার একটু ভুল হয়েছে।

অংশুমালী : ভুল! কি ভুল?

অমলা : দিদি ভারি ফাজিল, ভারি দুষ্টু। আপনার মতো—ইয়ে—ভালমানুষ পেলে তাকে বাঁদর-নাচানো দিদির চিরদিনের অভ্যেস

অংশুমালী : (তড়িদ্বেগে উঠিয়া) কী–বাঁদর-নাচানো! আমাকে বাঁদর-নাচানো! অসহ্য! আমি চললুম।

অংশুমালী দ্বারের দিকে চলিল।

অমলা : চা খেয়ে যাবেন না?

অংশুমালী : (সগর্জনে) না!

দ্বার পর্যন্ত গিয়া অংশুমালী দাঁড়াইল, ঘাড় ফিরাইয়া অমলার পানে চাহিল।

অংশুমালী : তোমার কি নাম বললে?

অমলা : অমলা!

অংশুমালী : হুঁ—(দুপা ফিরিয়া আসিয়া) তোমার বিয়ে হয়েছে?

অমলা : না, এখনও হয়নি।

অংশুমালী : হুঁ (এদিক-ওদিক চাহিয়া হঠাৎ) আমাকে বিয়ে করবে?

অমলা : (উঠিয়া) সে কি! আপনি দিদিকে এত ভালবাসেন, কামান গর্জনের মধ্যেও তাকে ভোলেননি। আর আমাকে দেখেই ভুলে গেলেন?

অংশুমালী : না না—মানে তুমিও তার মতো দেখতে কিনা—অর্থাৎ আমাকে বিয়ে করবে?

অমলা : আপনি তো বিয়ে-ফিয়ে মানেন না। ওসব কুসংস্কার—

অংশুমালী : হ্যাঁ–না—আসল কথা– করবে বিয়ে?

অমলা : দেখুন, ক্যাপ্টেন ধর, আপনি সব দিক দিয়েই সুপাত্র, কিন্তু আমার উপায় নেই।

অংশুমালী : (আরও কাছে আসিয়া) কেন? কেন উপায় নেই?

অমলা : আবার পিস্তল বার করবেন না কি?

অংশুমালী : না না–মানে—কেন?

অমলা : বাধা আছে।

অংশুমালী : বাধা? কৈ বাধা? কোথায় বাধা?

যে যুবক পাশের ঘরে গিয়াছিল সে ফিরিয়া আসিল। অংশুমালীর সম্মুখে দাঁড়াইয়া নিদ্রালুভাবে আলস্য ভাঙ্গিল।

যুবক : এই যে বাধা।

অংশুমালী : আঁ—আপনি কে?

যুবক : আমিই বাধা। নাম জ্যোতিষ মিত্র।

অংশুমালী : মানে

জ্যোতিষ : মানে আমার সঙ্গে অমলার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আপনি একটু দেরিতে এসে পৌঁচেছেন।

অংশুমালী কিছুক্ষণ মচ্ছিভঙ্গভাবে দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর মর্মভেদী নিশ্বাস ফেলিয়া চেয়ারে বসিয়া পড়িল। অমলা ও জ্যোতিষ একবার কটাক্ষ বিনিময় করিল।

জ্যোতিষ : আপনি দেখছি ভারি মুষড়ে পড়েছেন। আসুন, একটা সিগারেট নিন।

অংশুমালী নির্জীবভাবে সিগারেট লইল। জ্যোতিষ লাইটার জ্বালিয়া তাহা ধরাইয়া দিল।

অংশুমালী : (সিগারেটে লম্বা টান দিয়া) আমার জীবনটাই মরুভূমি হয়ে গেল। এর চেয়ে যদি যুদ্ধে মারা যেতাম।

জ্যোতিষ : সে কি কথা! (পাশে বসিয়া) দেখুন, আপনি খুব বেঁচে গেছেন, এদের দু বোনের কাউকে যে বিয়ে করতে হল না, এটা আপনার পরম সৌভাগ্য। (নিশ্বাস ফেলিয়া) আমি ধরা পড়ে গেছি, পালাবার উপায় নেই।

অংশুমালী : কিন্তু আমার এখন কী উপায়?

অমলা : শুনেছি, এ অবস্থায় অনেকেই নাকি গেরুয়া আলখাল্লা পরে হিমালয়ের দিকে যাত্রা করেন। আপনিও যদি কিছুদিনের জন্যে

জ্যোতিষ : না না, অমলা, তুমি ওসব বুদ্ধি দিও না। এমনিতেই সাধু-সন্নিসী এত বেড়ে গেছে যে, কুম্ভমেলায় জায়গা হয় না। তার ওপর মিলিটারিরাও যদি সন্নিসী হয়ে যায়, তখন দেশ রক্ষে করবে কে? নাগা পল্টন?

অমলা : আচ্ছা, তাহলে সন্নিসী হয়ে কাজ নেই।

জ্যোতিষ : দেখুন, আপনি এক কাজ করুন। বছর পাঁচকে চোখ-কান বুজে কাটিয়ে দিন। অমলাদের একটি ছোট বোন আছে, তার নাম রমলা। পাঁচ বছর পরে সে বেশ বড়সড় হবে, তখন তাকে বিয়ে করবেন।

অমলা : রমলা পাঁচ বছর পরে আমাদের মতোই দেখতে হবে। আমাদের তিন বোনেরই চেহারার ছাঁচ একরকম।

জ্যোতিষ : স্বভাবও একরকম।

অংশুমালী : (ঈষৎ সজীব হইয়া) রমলার বয়স কত?

জ্যোতিষ : এখন তের-চৌদ্দ হবে।

অংশুমালী : (সনিশ্বাসে) পাঁচ বছর!

অমলা : ও কিছু নয়, পাঁচটা বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে। হয়তো ইতিমধ্যে আবার একটা যুদ্ধ বাধবে। আপনি যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে রমলাকে বিয়ে করবেন।

জ্যোতিষ : যুদ্ধ-টুদ্ধ এখন ভুলে যান। রমলাকে যদি বিয়ে করতে চান, এক দণ্ড তাকে চোখের আড়াল করবেন না। ওদের স্বভাব আপনি জানেন না, একবার চোখের আড়াল করলে আর রক্ষে। নেই, পটু করে আর একজনকে বিয়ে করে ফেলবে। দেখছেন না, আমি অষ্ট প্রহর অমলাকে চোখে চোখে রেখেছি। আমার পরামর্শ শুনুন, এখন থেকেই জোঁকের মতো রমলার পেছনে লেগে যান, যদ্দিন না বিয়ে হয় কড়া নজর রাখবেন। এ যদি না করেন আপনার বিয়ের কোনও আশা নেই।

অংশুমালী : হুঁ। রমলা কোথায়?

অমলা : সে স্কুলে পড়ে, স্কুল হোস্টেলে থাকে, ছুটিতে বাড়ি আসে।

অংশুমালী : ও—তা-বিষণ্ণভাবে উঠিয়া) আজ তাহলে উঠি।

অমলা : আবার কবে আসছেন?

অংশুমালী : আবার—মানে—দেখি—

টেলিফোন বাজিয়া উঠিল। অমলা তাড়াতাড়ি গিয়া টেলিফোন ধরিল।

অমলা : কে—জামাইবাবু!…আঁ! ছেলে! আট পাউণ্ড!—দিদি ভাল আছে?…বাঁচলুম। ফোন রাখিয়া) ছেলে দিদির ছেলে হয়েছে

জ্যোতিষ : থ্রি চিয়ার্স!

অংশুমালী : (ক্ষীণকণ্ঠে) থ্রি চিয়ার্স। এবার আমি যাই।

অমলা : চললেন? খোকার আটকৌড়ের দিন কিন্তু আপনাকে আসতে হবে।

অংশুমালী : আটকৌড়ে? সে কবে?

অমলা : আজ থেকে আট দিনের দিন। নিশ্চয় আসবেন। আপনাকে কুলো বাজাতে হবে।

অংশুমালী : কুলো—তা-রমলা সেদিন আসবে নাকি?

অমলা : আসবে। তাকে স্কুল থেকে আনিয়ে নেব। বেশী দূর নয়, কলকাতার মধ্যেই।

অংশুমালী : আচ্ছা—আসব। টা টা—

জ্যোতিষ ও অমলা : টা টা।

অংশুমালী প্রস্থান করিল। তাহাকে বিদায় দিয়া জ্যোতিষ ও অমলা পরস্পরের খুব কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। দুজনেরই মুখেই চাপা হাসি।

অমলা : কী মজা!

জ্যোতিষ : লোকটিকে তোমার বেশ পছন্দ হয়েছে দেখছি।

অমলা : বেশ মানুষ, তোমার মতো বিচ্ছু নয়। ও রকম মানুষ একটা বাড়িতে থাকা ভাল।

জ্যোতিষ : হ্যাঁ, যত ইচ্ছে নাচাতে পারবে। রমলারও মিলিটারির দিকে ঝোঁক, ভালই হল। খুব আহ্লাদ হচ্ছে তো?

অমলা : হচ্ছেই তো। এদিকে রমলার জন্যে একটি ক্যাপ্টেন, ওদিকে দিদির ছেলে—

জ্যোতিষ : তবে সন্দেশ খাওয়াও

অমলা : (হাসি মুকুলিত মুখে) সন্দেশ কোথায় পাব? বাড়িতে তো সন্দেশ নেই।

জ্যোতিষ : সন্দেশ যদি না পাই, সন্দেশের চেয়ে মিষ্টি জিনিস কেড়ে খাব। আজকের দিনে মিষ্টিমুখ না করে ছাড়ছি না।

জ্যোতিষ খপ করিয়া অমলার আঁচল ধরিল।

অমলা : অ্যা–না না—ছেড়ে দাও—ভাল হবে না বলছি। আচ্ছা আচ্ছা, সন্দেশ আছে—পাশের ঘরে এস দিচ্ছি।

জ্যোতিষ অমলার আঁচল ধরিয়া পাশের ঘরের দিকে চলিল।

২৭ বৈশাখ ১৩৬১

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত