পাক্কা এক ঘন্টা ধরে আরশি বিরিয়ানির বক্স হাতে নিয়ে পার্কের বেঞ্চিতে বসে আছে।অনেক কষ্টে সে ইউটিউব দেখে হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানিটা রান্না করা শিখেছে শুধু সাদিব কে খাওয়াবে বলে।একঘন্টা ধরে অপেক্ষা করে বসে আছে কিন্ত সাদিবের আসার কোন খবর নেই। এরমধ্যে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে কিন্ত সাদিব ফোন রিসিভ করেনি। আরশি আবারো ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে সাদিব কে কল দিল।এবার সাদিব ফোন রিসিভ করেছে।
– হ্যালো, কই তুমি? সাদিব ধমকে উঠে বলল,
– একটু দেরি কি হয়েছে,এতেই এত বার বার ফোন করার কি আছে?জানো না আমি বাইক চালাচ্ছি।এক্সিডেন্ট হয়ে যেতে পারে ফোনে কথা বললে।কোন কমনসেন্স নাই তোমার”। সাদিব ফোন কেটে দিল।
আরশি মন খারাপ করে বসে রইলো। সাদিবকে সে প্রচন্ডরকম ভালোবাসে।কিন্ত সাদিব একটু রগচটা স্বভাবের। কোন কিছু মন মত না হলেই ভীষণ রেগে যায়।আরশি সব সময় চেষ্টা করে এমন কিছু না করতে,যাতে সাদিব রেগে যায়।সম্পর্কটা সে যত্ন করে আগলে রেখেছে।বলা যায় সে ই এখন পর্যন্ত সম্পর্কটা টিকিয়ে রেখেছে।নিজের ইগোকে সে কখনোই সম্পর্কের মাঝে আসতে দেয় না।নিজের সবটা দিয়ে সে সাদিবকে ভালোবেসে গেছে। কিন্ত এবার সাদিব তার কাছে বেশী কিছু চেয়ে বসেছে।সে কোন ভাবেই রাজী হতে পারছে না।আর সে জন্যই সাদিব তার সাথে এক ধরনের কঠিন আচরণ করে যাচ্ছে। আরো আধা ঘন্টা পার করে সাদিব আরশির সামনে এসে দাঁড়ালো। পাশে বসে বলল,
– এত বার বার ফোন দিচ্ছিলে কেন?
– আমি সেই দেড়ঘন্টা ধরে বসে আছি।তাই ফোন দিয়েছি তুমি কখন পৌছবে সেটা জানতে”। সাদিব কোন জবাব না দিয়ে সিগারেট ধরালো।তার ভাব ভঙ্গিতে স্পষ্ট উপেক্ষা। আরশি সাদিবের দিকে তাকিয়ে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। শেষে নিরবতা ভেঙে আরশি বলল,
– তোমার জন্য বিরিয়ানি রান্না করে এনেছি।তুমি একদিন বলেছিলে হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি তোমার ফেভারিট। আমি রান্নাটা শিখেছি”। সাদিব সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে কন্ঠে বিরক্তি ফুটিয়ে বলল,
– উহু,এখন আর হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি ভালো লাগে না “।
আরশির মনটা খারাপ হয়ে গেল।এভাবে মুখের উপর “ভালো লাগে না” না বললেও হতো।সে কত কষ্ট করে সাদিবের জন্য রান্নাটা করেছিল।বাসা থেকে বেরুনোর আগে মায়ের জেরার মুখে পড়তে হলো। শেষে মা কে মিথ্যে বলে এসেছে যে,তার এক বান্ধবীকে খাওয়াবে বলে নিয়ে যাচ্ছে। আরশি বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
– তুমি আর আমাকে আগের মত ভালোবাসো না, তাই না?? সাদিব স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলো,
– তুমি ও তো ভালোবাসো না। আরশি ধাক্কা খেল সাদিবের এমন কথায়। বলল,
– ভালো না বাসলে তোমার চাকরির জন্য অপেক্ষা করে বার বার নিজের বিয়ে ভাঙ্গতাম না”।
– হয়েছে,আর বলতে হবে না।ভালোবাসলে রুমডেটের জন্য ঠিকই রাজি হতে।ভালোবাস না আর বিশ্বাস করো না বলেই রাজি হচ্ছ না”। সাদিব বেশ কড়া গলায় বলল।
– বিশ্বাস এক জিনিস আর নোংরামি আরেক জিনিস।আমার কাছে বিয়ের আগে এসব করা নোংরামি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না।সরি সাদিব,নোংরামি করে আমি আমার ভালোবাসার প্রমাণ দিতে পারবো না”। সাদিব এবার সরু চোখে আরশির দিকে তাকালো,
– তার মানে তুমি বলতে চাইছ তুমি কখনোই রাজি হবে না”? আরশি মুখ শক্ত করে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
– না, কখনোই না,মরে গেলেও না।
– তাহলে আমার পক্ষে রিলেশন রাখা সম্ভব না।
সাদিবের চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে রাগে। আরশি অন্যদিকে মুখ করে রাখলো।তার চোখের পানি সে সাদিব কে দেখাবে না। কোন ভাবেই না। অন্যদিকে তাকিয়েই বলল,
– তুমি যদি সম্পর্ক ভেঙেও দাও,তবুও আমি তোমার প্রস্তাবে রাজি হবো না”। সাদিব উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
– ওকে ডান,আজকেই তাহলে আমাদের ব্রেকাপ হয়ে যাচ্ছে।আর কখনোই আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো না”। বলে সাদিব চলে গেল।
আরশির ইচ্ছা হলো সাদিবের হাত ধরে আটকায়।কিন্ত সে কিছুই করলো না।তার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে।ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে কাঠ হয়ে বসে রইলো। এবং কিছুক্ষন পর ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। তার হুমায়ুন আহমেদের গল্পের একটা লাইন মনে পড়ছে।”আমরা সব সময় ভুল মানুষকে ভালোবাসি”। তার গভীর ভালোবাসা সাদিবের চোখে পড়েনি।আর সেজন্য সে প্রমাণ চাইছে।এটাকে কি ভালোবাসার প্রমাণ বলে? আরশি দুই হাতে মুখ ঢেকে অকুল হয়ে কাঁদছে।হটাৎ তাকে উদ্দেশ্য করে একটা রিনরিনে কন্ঠ বলে উঠলো,
– আফা একটা ফুল নিবেন”?
আরশি মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল একটা আট দশ বছরের বাচ্চা মেয়ে হাতে কয়েকটা ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সাথে একটা চার পাঁচ বছরের বাচ্চা।ছেলে নাকি মেয়ে বুঝা গেল না,পরনে শুধু একটা হাফপ্যান্ট, জুলজুল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আট দশ বছরের মেয়েটি আরশির কাছ থেকে কোন জবাব না পেয়ে বলল,
– একটা ফুল নেন না আফা।মাত্র দশ টেকা।সকাল থেইকা একটা ফুল ও বেচতে পারি নাই।নিজের খিদা তাও সহ্য করতে পারি।ছোট ভাইডা সেই কখন থেইকা খাওন চাইতাছে।বাচ্চা মানুষ, খিদা সইতে পারে না তো।একটা ফুল বেঁচতে পারলেও ওরে একটা পরোটা কিনা খাওয়াইতে পারি”।
আরশি বেশ অবাক হয়ে মেয়েটির কথাগুলো শুনল।এই বয়সেই তার ছোট ভাইয়ের প্রতি কত দায়িত্ববোধ।আরশির নিজের প্রতি ধিক্কার আসছে।সে কিনা কয়দিনের পরিচয়ের একটা ছেলের জন্য হাত পুড়িয়ে বিরিয়ানি রান্না করে এনেছে,যেখানে তার ছোট ভাইটা সামান্য নুডুলস খেতে চাইলেও সে রান্নাঘরের ধারেকাছে যায় না। আরশি মেয়েটিকে এবং সেই ছোট বাচ্চাটিকে নিজের পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কি নাম তোমার? মেয়েটি কাচুমাচু হয়ে বসে জবাব দিল,
– আমার নাম পরী। এরপর ভাইয়ে দেখিয়ে বলল,
– আর ওর নাম তুলা। আরশি জিজ্ঞেস করলো,
– তুমি ফুল বিক্রি করছ কেন? তোমার বাবা মা কোথায়?
– তুলা যখন মায়ের পেটে ছিল,তখন আব্বা কই জানি চইলা গেছে। কই আছে কেউ জানে না।মায়ের শরীর খুব খারাপ। কোন কাম করতে পারে না।তাই আমি ফুল বেইচা যা পাই তাই দিয়াই সংসার চালাই”। পরী মেয়েটির কথা শুনে আরশির এত মায়া হলো বলার মত না।এই মেয়েটির বয়সে সে স্কুলে যেত,খেলতো,মা জোর করে খাইয়ে দিতো।আর এই বাচ্চা মেয়েটা এই বয়সেই নিজের এবং নিজের পরিবারের সামান্য একটু খাবারের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। আরশি ব্যাগ থেকে বিরিয়ানির বাক্সটা বের করে পরীর হাতে দিয়ে বলল,
– নাও,এটা খাও তোমরা। পরী অবাক দৃষ্টিতে আরশির দিকে তাকিয়ে রইল।বিরিয়ানি নিবে কিনা বুঝতে পারছে না। আরশি আবার বলল,
– কি হলো, নাও।
পরী বাক্সটা নিলো।কৃতজ্ঞতায় তার চোখ দুটি ছলছল করছে। বিরিয়ানি দেখে তুলা কিযে খুশী হলো। দুই হাতে তালি দিয়ে লাফাতে লাগলো খুশীতে। বাচ্চাটার আনন্দ দেখে আরশির মনটা ভালো হয়ে গেল।ছোট বাচ্চারা যখন হাসে,তার থেকে সুন্দর দৃশ্য বোধহয় পৃথিবীতে আর কিছু নেই।
তুলার আর তর সইছিল না দেখে পরী তখনই তার ভাইকে পরম মমতায় বিরিয়ানি খাইয়ে দিলো।বাচ্চাটার তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া দেখে আরশির মনটা ভরে গেল।তার বিরিয়ানি রান্না বৃথা যায় নি। হঠাৎ করেই তার মনে হলো, এই পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে যারা এক ফোঁটা ভালোবাসার জন্য কাঙাল হয়ে থাকে।অথচ আমরা এমন সব মানুষের জন্য এক সাগর ভালোবাসা নিয়ে বসে থাকি,যারা ভালোবাসার কদরটুকু করতে জানে না।ভালোবাসার প্রমান চাওয়া মানুষগুলো ভালোবাসতে জানে না।ভালোবাসা পাবার যোগ্যতাও রাখে না। আরশি দেখল পরী মেয়েটি বক্সের এক সাইডে খানিকটা বিরিয়ানি বাঁচিয়ে রাখলো। আরশি জানতে চাইলে বলল,
– মায়ের শরীর খারাপ হেইর লাইগা মুখে রুচি নাই।কিছু খাইতে পারে না।এই বিরিয়ানিটুকু পাইলে একটু খাইতো”।
বলে লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসলো।
আরশি অবাক হয়ে গেল এই বাচ্চা মেয়েটির এরকম বড় মানুষের মত দায়িত্ববোধ দেখে।এই বাচ্চা মেয়েটি তাকে অল্প সময়ের মধ্যে অনেক কিছু শিখিয়ে দিল। আরশি ঠিক করলো, সে এই সংগ্রামী শিশু এবং নিরাশ্রয় মানুষ গুলোর জন্য কিছু করবে।।তার সাধ্যে যতটুকু পারে,সে করবে। এক জীবন একজন মানুষের বিরহে দুঃখ পেয়ে কাটিয়ে দেয়ার জন্য অনেক ছোট। এক জীবনে মানুষের করার মত অনেক কিছুই আছে।
রিকশা করে বাসায় যাওয়ার পথে আরশি অনুভব করলো তার কেমন যেন তৃপ্তি অনুভব হচ্ছে।মনে মধ্যে এক প্রাকার প্রশান্তি ছেয়ে গেছে। অথচ তার এখন সাদিবের কথা ভেবে দুঃখ পাওয়ার কথা ছিল।কিন্ত তার দুঃখ পেতে লজ্জা লাগছে।বাচ্চা মেয়েটির জীবনের দুঃখ কষ্টের তুলনায় তার দুঃখটাকে একেবারেই সামান্য মনে হচ্ছে। আরশি বাসায় ফিরে দেখলো তার ছোট ভাই অয়ন কি নিয়ে যেন মা কে প্রচন্ডভাবে অনুরোধ করে যাচ্ছে।
– প্লিয মা,বানিয়ে দাও প্লিয। জাহেদা কোন ভাবেই ছেলেকে বুঝাতে পারছে না,
– আরে আমি বললাম তো আমি থাই স্যূপ বানাতে পারি না।কিভাবে তোকে বানিয়ে দিবো বল?
– ইউটিউবে ভিডিও আছে স্যূপ বানানোর। রেসিপি দেখে দেখে বানিয়ে দাও মা।
– আমি ইউটিউবের ভিডিও দেখে বুঝি না ভালো মত।এক কাজ করি,তোকে একটা ইন্সট্যান্ট ম্যাগি স্যুপ বানিয়ে দেই, ঠিক আছে?
– না ওই জঘন্য স্যূপ আমি খেতে পারবো না।থাই স্যুপ ই বানিয়ে দাও মা প্লিয। অয়ন ঘ্যানঘ্যান করতেই থাকল। এমন সময় আরশি ঘরে ঢুকলো। পরী মেয়েটির কাছ থেকে কেনা ফুল গুলো ফুলদানিতে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করল,
– কি ব্যাপার, কি নিয়ে এত হইচই হচ্ছে? জাহেদা মেয়েকে দেখে একটু স্বস্থি পেয়ে বলল,
– দেখ না,ফেসবুকে থাই স্যুপের ছবি দেখে নবাবজাদার এখন সেটা খেতে ইচ্ছে করছে।কতবার বলছি আমি পারি না বানাতে তাও শুনছে না।ঘ্যানঘ্যান করেই যাচ্ছে। অয়ন মুখ গোমড়া করে বলল,
– এটা আর এমন কি কঠিন কাজ।কত ভারী ভারী রান্না করে ফেলতে পারো আর সামান্য স্যুপ খেতে চাইছি সেটা বানিয়ে দিতে পারবে না। জাহেদা মুখ ঝামটা দিয়ে বলল,
– এত সহজ লাগে তো যা নিজে বানিয়ে খা।আমাকে জালাস নে আর। আরশি তখন অয়নকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– চল আমি বানিয়ে দিচ্ছি। অয়ন বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– তুমি পারো বানাতে ? আরশি সোফায় হেলান দিয়ে বসে বলল,
– ইউটিউব থেকে দেখে নিবো। অয়ন একটু টিটকারির সুরে বলল,
– হয়েছে,যে কিনা দুই মিনিটের একটা নুডুলস বানিয়ে দেয় না কোনদিন,সে আজকে থাই স্যুপ বানিয়ে খাওয়াবে।হাহ,হয়েছে আপু, তুমি যে আমাকে বড়সড় একটা ডস খাওয়ানোর ধান্দা করছ সেটা আমি ভালো মতই বুঝতে পারছি।
– বেশী ভ্যাদর ভ্যাদর করবি তো বললাম,একেবারেই বানিয়ে দিবো না।তারপর নিজে বানিয়ে খাস। বলে আরশি ইউটিউবে থাই স্যুপের রেসিপি দেখতে লাগল। সেই মুহূর্তে অয়ন টের পেল আপু সত্যি সত্যি তাকে স্যুপ বানিয়ে খাওয়াবে।সে দ্বীগুন উৎসাহে বোনের পাশে বসে রেসিপি দেখতে লাগল। দুই ভাই বোন মিলে স্যুপ বানানোর আগ মুহূর্তে টের পেল বাসায় সব উপকরণ ই আছে শুধু লেমন গ্রাস নেই।আর লেমন গ্রাস ছাড়া থাই স্যুপের ফ্লেভার আসবে না। আরশি বলল,
– থাক,লেমনগ্রাস লাগবে না।বাসায় যা আছে তাই দিয়েই বানাবো। অয়ন মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালো,
– উহু,অবশ্যই লাগবে।একটা রান্না একটা সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট থেকে কোন অংশেই কম না।
সায়েন্স এক্সপেরিমেন্টে যেমন সব উপকরণ থাকা চাই,রান্নার ক্ষেত্রেও তাই।সব উপকরণ ই লাগবে।আপু তুমি চিকেন স্টকের জন্য বসাও, আমি পনেরো মিনিটের মধ্যে তোমার সামনে লেমনগ্রাস সহজ র করবো। সত্যি সত্যি অয়ন কিছুক্ষণের মধ্যে লেমনগ্রাস নিয়ে চলে এলো। এরপর দুই ভাই বোন মিলে মহা ধুমধামের সাথে স্যুপ বানালো এবং বেশ হইচই করে সন্ধ্যার নাস্তা সাজালো।স্যুপ এবং সাথে মালাই চা। বাবা মা খেয়ে দারুণ প্রশংসা করলো। অয়ন বলল,
– আপু আমাদের রান্নাটা বিপুল পরিমাণ টেস্ট হয়েছে। আরশি বিরক্তি নিয়ে বলল,
– কথায় কঠিন কঠিন শব্দ ব্যাবহার করবি না।বিপুল পরিমান টেস্ট আবার কি কথা।
অয়ন কিছু বলল না।দাঁত বের করে হাসলো। তার আজকে এত আনন্দ হচ্ছে কেন কে জানে। সবার সাথে এই আনন্দঘন মুহুর্তে আরশির একবারের জন্যও সাদিবের কথা ভেবে মন খারাপ হলো না।পরিবারের সাথে কাটানো সামান্য মুহুর্ত ও কি অসামান্য আনন্দ এনে দিতে পারে আরশি খুব ভালো ভাবে ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারলো।
কিন্ত রাতে ঘুমাতে যাবার আগে আরশি টের পেল,তার কাছে সব কিছু কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগছে।একটা সম্পর্ক যদি হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যায়,সেই মানুষটি যতই খারাপ হোক না কেন এক সাথে কাটানো স্মৃতিগুলো তখন প্রচুর পীড়া দেয়।অজান্তেই আরশির চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। আরশি দেখল তার মোবাইল ফোনটা বাজছে।স্ক্রিনে রাখির নাম দেখা যাচ্ছে।ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলতেই রাখি বলল,
– আমি তো ভেবেছিলাম কল ওয়েটিং পাবো। আরশি গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলল,
– আর ওয়েটিং পাবি না।
– কেন কেন?ঝগড়া হয়েছে নাকি তোদের?
– উহু, একেবারে ব্রেকাপ হয়ে গেছে।
– সত্যি! রাখি খুশী চেপে রাখতে পারল না। উচ্ছাসিত কন্ঠে “সত্যি” বলার পর সে টের পেল তার খুশী হওয়াটা একেবারেই উচিত হয় নি।তাই সে গলায় একটা দুখি দুখি ভাব ফুঁটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বলল,
– সত্যি বলছিস? কিন্তু কেন যেন তার গলায় দুখি দুখি ভাবটা ঠিক ফুটলো না।
– হ্যাঁ সত্যিই। কিন্ত তুই এত খুশী হচ্ছিস কেন?
– আরে ওই ছেলেকে প্রথম থেকেই আমার ভালো লাগে নি।শুধু তোর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতাম না।আর বেশী সুন্দর ছেলেরা কোন কাজের হয় না।এদের ক্যারেক্টার ঢিলা হয় বুঝলি?
– হু,যেন পৃথিবীর সব সুন্দর ছেলেরা এসে তোকে বলে গেছে তাদের ক্যারেক্টার সম্পর্কে। বাজে বকিস না তো।
– যাই হোক,এখন কি তোর মন খারাপ? আরশি কোন জবাব দিল না। রাখি জিজ্ঞেস করলো,
– কাল ভার্সিটিতে আসবি তো?
– হ্যাঁ আসবো।
– ওকে,তাহলে কাল আমরা তোর ব্রেকাপ সেলিব্রেট করবো।
– ফাইজলামি করবি না খবরদার।
– আচ্ছা আচ্ছা,এখন মাথা গরম তোর।শান্তি মত ঘুমা,কাল দেখা হচ্ছে।বাই। রাখি ফোন রেখে দিল।
পরদিন ভার্সিটিতে গিয়ে আরশি দেখল রাখি আর তিতির তার জন্য অপেক্ষা করছে।তারা তিনজন সেই কলেজ জীবন থেকে বেস্ট ফ্রেন্ড। তাদের মধ্যে রাখি হচ্ছে সবচেয়ে ছটফটে, যে কোন না কোন বিষয় নিয়ে সারাক্ষণ বকবক করতেই থাকে।সে পৃথিবীর সব কিছু নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী, শুধু পড়াশোনার বিষয়ে নিয়ে আলোচনা করতে সে রাজী না।
আর তিতির হচ্ছে রাখির একেবারে উল্টো। ছোট খাটো দেখতে।পড়াশোনায় বাড়াবাড়ি রকমের সিরিয়াস। কথা বলে কম।দুয়েকটা বললেও,সেটা হয় কোন জ্ঞানগর্ভ কথা নাহয় পড়াশোনা নিয়ে কথা।চোখে হাই পাওয়ারের চশমা।তার হাবভাব দেখলে যে কেউ ধরে নিবে,এটা রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেডি ভার্সন। রাখি মাঝে নিশ্চিত হয়ে বলে,
– মানুষ সাধারণত বাসর রাতে বরের সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে রাত পার করে।কিন্ত তিতির বাসর রাতে তার বরের সাথে ফিজিক্সের কঠিন কোন টপিক নিয়ে আলোচনা করবে।এবং বেচারা বর পরদিনই তিতিরকে ফেলে বাড়ি থেকে পালাবে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে,তিতিরকে যদি খুব ইন্টারেস্টিং কোন গল্প শোনানো হয় , সেখানে সে কিছুক্ষণ পর পর হাই তুলতে থাকে।অথচ কোন কঠিন টপিকের উপর স্যার যখন লেকচার দেয়,তিতির চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে সেটা শুনে।তার চেহারা দেখে তখন মনে হয়,খুব ইন্টারেস্টিং কোন থ্রিলার মুভি দেখছে। আরশিকে দেখে রাখি যখন বলল,
– চল,আজকে তোর ব্রেকাপ উপলক্ষে আমরা ক্লাস বাংক দিবো। তখন তিতির একেবারে হায় হায় করে উঠলো,
– কোন ভাবেই না।আজকের ক্লাস মিস দিলে এই সেমিস্টারে আর পাশ করা লাগবে না।আমি কোন ভাবেই ক্লাশ মিস দিবো না।
– বেশী বুঝিস না।ক্লাশ রোজ রোজ ই হয়।ব্রেকাপ কি রোজ রোজ হয় নাকি।বন্ধবীর প্রতি কোন মায়াদয়া না থাকলে যা তুই,ক্লাসে বসে বোরিং লেকচার শোন গিয়ে। এ কথা বলার পর জবাব দেবার মত আর কোন কথা থাকে না।তিতির ভেবে পায় না,এরকম সেন্টিমেন্টাল ফ্রেন্ড তার কপালে কিভাবে জুটলো। বাধ্য হয়ে তিতিরকে তার সাধের ক্লাশ ত্যাগ করতে হলো।
ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে তারা অনেক্ষন ফুটপাত ধরে হাঁটলো।টং দোকানে দাঁড়িয়ে চা খেলো।রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ভেলপুরি খেলো। আরশির প্রথম দিকে মন খারাপ লাগলেও ততক্ষণে মন একেবারে ফুরফুরে হয়ে গেছে। রাখি আশেপাশে যেটা দেখছে সেটা নিয়েই সমানে বকবক করে যাচ্ছে। তিতির প্রথম দিকে প্রচন্ড বিরক্তবোধ করছিলো। পুরো ব্যাপারটাই তার কাছে একটা ছেলেমানুষী মনে হচ্ছিল।কিন্ত কিছুক্ষণ যেতেই তার কাছে ব্যাপারটা বেশ আনন্দের মনে হচ্ছে। মাঝে মাঝে রাখি এমন সব কথা বলছে যার কারনে আরশি বা তিতির কেউই হাসি চেপে রাখতে পারছে না। একসময় রাখি কথা বন্ধ করে আরশিকে বলল,
– দেখ দেখ,ওই ছেলেটা সাদিব না? আরশি তাকিয়ে দেখল সত্যি ই সাদিব ই।তাদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।সাদিবকে দেখে তার বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো। কিন্ত বাইরে সে একদম স্বাভাবিক হয়ে রইল।তার অনুভূতির কদর যার কাছে নেই,তার প্রতি আর কোন অনুভূতি সে দেখাবে না।তার প্রতি অনুভূতিহীন হয়ে যেতে হবে। সাদিব অনেক্ষন ধরেই আরশিকে পর্যবেক্ষণ করছে।আরশিকে এমন খিলখিলিয়ে হাসতে দেখে সে যারপরনাই অবাক হয়েছে।
সাদিব মোটামুটি ধরেই নিয়েছিল,সে আরশির সাথে ব্রেকাপ করার কথা বলাতে আরশি এক সপ্তাহ পর্যন্ত কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে থাকবে।এরপর আর সইতে না পেরে সাদিবের কাছে ফিরে আসতে চাইবে এবং সাদিবের প্রস্তাবে রাজী হয়ে যাবে।কিন্ত ব্রেকাপের পরদিনই আরশি বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে বের হয়েছে,ব্যাপারটা সে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারলো না।এবং সে আরও অবাক হয়ে গেল যখন দেখল,আরশি তার সামনে দিয়ে হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছে এবং একবারের জন্যও তার দিকে ফিরে তাকায় নি।যেন সাদিবকে সে চিনতোই না।একদিনেই প্রিয় মানুষটা যেন অচেনা অপরিচিত হয়ে গেছে। সাদিব ভেবে পায় না,যে মেয়েটা একদিন আগেও তার জন্য পাগলপ্রায় ছিল,একরাতের ব্যাবধানে সেই মেয়ে এতটা শক্ত কি করে হলো। সাদিব বুকের ভেতর এক রকম জলুনী অনুভব করতে লাগল।
আরশির উপেক্ষা সাদিবকে প্রবলভাবে আঘাত করেছে,ব্যাপারটা টের পেয়ে তার মনটা আনন্দে ভরে গেল।
ওই মানুষটিকে তার জীবনে কোন প্রয়োজন নেই।আল্লাহ তাকে এত সুন্দর একটা পরিবার দিয়েছেন,প্রানের বন্ধু দিয়েছেন যাদের সাথে সে অনায়াসে তার এক জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। আর ভালোবাসা? সেটা সে আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছে। আল্লাহ সঠিক সময় সঠিক মানুষটিকে তার জীবনে পাঠাবেন।
ভুল মানুষ থেকে পাওয়া নকল দুঃখগুলো পেয়ে আমরা ভুলে গেছি এসবের বাইরেও একটা দুঃখের জগৎ আছে।সেখানে আসল দুঃখ থাকে।আবেগী মানুষরা নকল দুঃখ এবং আসল দুঃখের পার্থক্য করতে পারে না।বিলাসী মানুষরা সর্বদাই নকল দুঃখ গুলোকে আসল দুঃখ ভেবে নিজেকে প্রচন্ড দুখি ভেবে বসে। অথচ অসল দুঃখ কি জিনিস অনেকে সেটা জানেই না। রাস্তার ফুটপাতে ঘুমিয়ে থাকা নিরাশ্রয় মানুষগুলো, বাবা মা হীন পথশিশু গুলো কিংবা ফুল বিক্রেতা সেই বাচ্চা মেয়েটি কিন্ত খুব ভালো মত জানে আসলে দুঃখ কাকে বলে।