মেয়েটার সাথে আমার পরিচয় ফেসবুকে। দুই একদিন ফোনে কথাটথা হইছে। তেমন কিছুনা, এই কি করো বা কেমন আছো টাইপ। একদিন কথায় কথায় জানালাম আমি বৃষ্টিতে ভিজবো। ফোন রেখে দিয়ে বাইরে বের হলাম। বৃষ্টির পানিতে গোসল করে এসে দেখি ফোনে মেয়েটার একটা মেসেজ। ‘এই ছেলে শুনো, ঠিকমতো মাথা মুছে নিও। নইলে কিন্তু জ্বর আসতে পারে।’
মেসেজটা পড়ে হুট করেই আমার চোখ দিয়ে পানি চলে আসলো। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো, ভালোবাসার অনুভূতি। বাইরের অপরিচিত একটা মেয়ে আমাকে কেয়ার করছে, আমার কথা ভাবছে। আহা! আচ্ছা মেয়েটা কি আমার প্রেমে পড়ে গেছে? হয়তো তাই। আমি মেয়েটার প্রোফাইলে গিয়ে প্রোপিক দেয়া একটা মাত্র ছবি বহুক্ষণ ধরে দেখলাম। কি মায়াময় চোখ, যেন সেখানে যত মায়া আছে সবকিছুতে একমাত্র আমার অধিকার। মেয়েটা রাতে কল করলো। বললো, ‘খেয়েছো?’ আমি বললাম, ‘হ্যা, তুমি?’
– হুম আমিও। কি দিয়ে খেলে?
– গরুর মাংস আর ভাত।
– তুমি কি প্রায়ই গরুর মাংস খাও নাকি? দেখ, বেশি মাংস খাওয়া ঠিক না।
শরীরের জন্য ক্ষতিকর। রাতে নর্মাল কিছু খাওয়ার চেষ্টা করবা। সবজি, ডাল, একগ্লাস দুধ। আমি এখন তোমার সাথে থাকলে এইভাবে ডেইলি গরুর মাংস খেতে দিতাম না। কোনোভাবেই না।’
আমার চোখে আবার পানি এসে পড়লো। ভালোবাসার অশ্রুজল। তার আরো দুইদিন পর আমার জ্বর হলো। তেমন কিছু না, ভাইরাস জ্বর। কিন্তু এতেই মেয়েটা যেন নাওয়াখাওয়া ছেড়ে দিলো। প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন দিয়ে আমার খোঁজখবর নেয়। একটু পরপর বলে, ‘তুমি এরকম কেন সোহাইল? শরীরের একটু যত্ন নিবা না। আমার কত খারাপ লাগছে তুমি জানো?’ আমি ফোনটা শক্ত করে গালের সাথে চেপে ধরি। ফিসফিস করে বলি, ‘আমি ভালো হয়ে যাবো। আর কক্ষনো অনিয়ম করবো না। কক্ষনো না।’ মেয়েটা চোখ মোছে, প্রমিজ?
– পাক্কা প্রমিজ।
মানুষের জীবনের সবচাইতে সুন্দর সময় হলো প্রেমে পড়ার আগমুহূর্ত। দুইজন মানুষই জানে তারা একজন আরেকজনকে ভালোবাসে। কিন্তু কেউ মুখ ফুটে বলতে পারেনা। তাদের ভালোবাসা বোঝা যায় একেকটা খুব সাধারণ কথাতে। যেমন, মেয়েটা আমাকে যখন বলে, ‘দেখ তুমি ভাত না খেলে আমিও খাবো না’ তখন এই কথাতে তীব্র ভালোবাসা থাকে। আবার আমি যখন বলি, ‘তুমি না খেয়ে থাকলে আমার বয়েই গেছে।’ বলতে বলতে টেবিলে গিয়ে বসি। তখনও ভালোবাসা থাকে। এই সময়টার তুলনা হয়না। একবার প্রেম হয়ে যাওয়ার পর হাজারবার ভালোবাসি আর আই লাভ ইউ বলাতেও তখন এই সময়ের মত ভালোবাসা থাকে না।
মেয়েটার নাম সাদিয়া। আমি আমার ডায়েরীর মাঝখানে বড় বড় করে লিখে রেখেছি সোহাইল প্লাস সাদিয়া। আমাদের যখন প্রেম হয়ে যাবে তখন এটা ওকে দেখাবো। আচ্ছা ভালোবাসার কথা প্রথম কে বলবে? আমি না ও?
এইসব ক্ষেত্রে অবশ্য ছেলেদেরই বলতে হয়। মেয়েরা স্বভাবগত দিক দিয়েই খুব লাজুক হয়। কিন্তু এই যে কেয়ার করা, এটার শুরু তো সাদিয়াই করেছিলো। আমি এক্সিডেন্ট করে পা কেটে ফেলার পর ফোনের ওপাশে আকাশ বাতাস কাপিয়ে কান্না করে ঐ তো প্রথম ভালোবাসাটা বুঝিয়েছিলো। তাইলে প্রপোজ করতে কি দোষ? আমি অপেক্ষা করি। আমার খুব ইচ্ছা হয় ভালোবাসার প্রথম কথাটা মুখে সাদিয়াই জানাক।
আমার ইচ্ছা পূরণ হয়। সাদিয়া আমাকে লাজুক গলায় বলে, ‘শুনো তোমার সাথে কিছু কথা আছে। তোমাকে কিন্তু রাখতেই হবে। কিছু মনে করতে পারবা না প্লিজ।’ আমি যথাসম্ভব শান্ত গলায় বলি, ‘বলো সাদিয়া। আমি রাখবো।’ মনে মনে অবশ্য চিৎকার দিয়ে বলি, ‘তুমি যদি আমাকে মরে যেতেও বলো, তবুও আমি কিচ্ছু মনে করবো না। কিচ্ছু না। আমি হাসিমুখে মরে যাবো।’
সাদিয়া আমার মনের কথা শুনতে পায় না। অন্য কারো মনের কথা শোনার ক্ষমতা ঈশ্বর মানুষকে দেননি।
সাদিয়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘প্রথম যেদিন ফেসবুকে তোমার ছবি দেখি সেদিনই আমার বুকের ভেতরটা ভেঙেচুরে যায়। আমি একটু পর পর সারাদিন তোমার ছবি দেখি আর বালিশে মুখ চেপে কান্নাকাটি করি। তার কারণ তুমি দেখতে একদম রোহানের মতন। অবিকল। যেন রোহান হুট করেই বড় হয়ে গেছে। ও হ্যা, তুমি হয়তো রোহানকে চিনো না। রোহান আমার একমাত্র ছেলে ছিলো।
ছিলো বলছি কারন মাত্র ছয় বছর বয়সে ও নিউমোনিয়াতে মারা যায়। তাই তোমাকে দেখে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। নিজের ছেলের জায়গাটা কাউকে কখনো দিয়ে দেয়া সম্ভব না, কিন্তু কথা বলতে বলতে কখন যে আমি তোমাকে রোহান ভাবতে শুরু করেছি আমি নিজেও জানিনা। তোমার অসুখ হলে মনে হয় আমার রোহানের অসুখ হয়েছে। তুমি না খেয়ে থাকলে মনে হয় আমার রোহান যেন না খেয়ে আছে। আল্লাহ এই ফেসবুকের মাধ্যমে আমার রোহানকে সোহাইল নামে আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তোমাকে যদি বলি আমাকে মা বলে ডাকতে, তুমি কি আমার কথাটা রাখবে? একবার আমাকে আম্মু বলে ডাক দেবে, শুধু একটিবার?
সাদিয়া নামের মেয়েটা অথবা ভদ্রমহিলা, যাই হোক না কেন তার কষ্টে আমার হৃদয় দ্রবিভূত হয়। আমি আস্তে আস্তে বলি, ‘আম্মু তোমার কন্ঠ এরকম কেন? শুনলে একদম বোঝা যায় না যে তোমার একটা বাচ্চা ছিলো। মনে হয় অবিবাহিত কোনো তরুণী। এইটা ঠিক না আম্মু। একদম ঠিক না। বয়সের সাথে সাথে মানুষের কন্ঠও ম্যাচিউর হওয়া জরুরী। খুবই জরুরী। নাহলে বড় ঝামেলা হয়!’