গোধূলি মায়া

গোধূলি মায়া

আমার স্ত্রীর কপালে আমার বাবা-মার আদর জোটেনি। এজন্য ওর আফসোসের শেষ নেই। কখনও কথা উঠলে অভিমানে কিশোরীদের মতো গাল ফুলিয়ে বলে, বাবা বলতো আমি নাকি শ্বশুর-শাশুড়ি পাওয়ার পর উনারে ভুইলে যাবো। এইজন্যি মনে হয় কারও মুখখানও দেখার কপাল আনলাম না! মায়ের গাল ফোলানো দেখে আমার পাঁচ বছরের মেয়ে চারু কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আলাভোলা ভাষায় বলে, ও বাবা! আমি কি মা না, বলো? বলো না? ও বাবা!

আমি মেয়ের গাল টিপে দেই। মেয়েকে দেখিয়ে স্ত্রীকে সহজ করার জন্য কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করি, শুনলে তো সুমু। মা তো মেয়ের রূপ নিয়ে এসেছেন আমাদের কোলে। তুমি গ্রিন সিগনাল দিলে এবার বাবাকেও আনার চেষ্টা করতে পারি। কী বলো? হাহা আমার দুষ্টুমিতে সুমতির মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যায়, সরো তো। সুযোগ পালি ঢং বাইড়ে যায় তাই না? হিহিহি এই দিক থেকে সুমতির সাথে আমার বেশ মিল। আমাদের দুজনের কারুর বাবা-মা বেঁচে নেই। সুমুর তাও কেবল বাবা বেঁচে ছিলেন। তিনিও দুবছর আগের এক আষাঢ়ে বিছানায় পড়লেন, পরের আষাঢ় আর পাননি। স্বর্গবাসী হয়েছেন।

দুই পুত্রের পর অল্প বয়সে মা হারা সুমুকে বাড়াবাড়ি আদর দিতেন ওর বাবা। মেয়েও ছিল আজন্ম বাপ ঘেঁষা। আদরের বাড়াবাড়ি মেয়ের পড়াশোনার গুরুত্বকেও ছাপিয়ে গেলো। ফলাফল, মেয়ে তিন-তিনবার এসএসসি ফেইল। শেষে শুক্লা তিথির এক শুভ লগ্ন দেখে নিজে পছন্দ করে গ্রামের আধা-সরকারী দাখিল মাদ্রাসায় সদ্য নিযুক্ত বিএসসি শিক্ষকের সাথে মেয়ের বিবাহ দিলেন। প্রায় অনাথ পাত্রটির প্রতি বরাবর-ই তাঁর বিশেষ মমতা ছিল। সেই শিক্ষক আমি। বীরেন মজুমদার (বিএসসি)।

শ্বশুর মশাই বেঁচে থাকতে নিয়ম করে পূজো-পার্বণে নানান জিনিষ পাঠাতেন। গতবার আর তা হয়নি। দুর্গা পূজোয় একরকম জোর করেই ওকে বাবার বাড়ী নিয়েছিলাম। ভাইদের নিয়মরক্ষার আতিথেয়তায় কেমন মন মরা হয়ে থেকে পরদিনই ফিরে আসে সুমু। ওকে বোঝাতে পারি না, বাবা-মা চিরকাল তো থাকে না।

দেখতে-দেখতে দোল যাত্রার অষ্টমীর দিন ঘনিয়ে আসে। শ্বশুর মশাইয়ের বাড়ীর কোল ঘেঁষে বুড়ি-বটতলায় সার বেঁধে পাঠা রাখা হয় বলী দেয়ার জন্য। একদিকে শীতলা দেবীর আরাধনা শুরু হয়, ওঁ নমামি শীতলাং দেবীং রাসভস্থাং দিগম্বরীম আর অপরদিকে বাবার ঘরের দাওয়ায় বসে সুমু আঁচলের কোণায় চোখ মোছে। দূরে দাঁড়িয়ে দেখি। কিছু বলি না। মন চাইছে কাঁদুক। এক সন্ধ্যায় কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ঢাকার পথে রওনা হলাম। বোর্ড থেকে সেকেন্ডারির কিছু খাতা আনতে বলা হয়েছে। এই কাজটা বেশ ভাল। কিছু বাড়তি পয়সা আসে সংসারে। আমার যাত্রাপথে সুমু চারুকে কোলে নিয়ে অজ-পাড়াগাঁর এবড়েথেবড়ে রাস্তার প্রায় অর্ধেকটা এলো পেছন-পেছন। প্রতিবারই এমন করে। পেছন থেকে একটু পরপর বলে, ও চারুর বাপ! মোবাইল খুলা রাখবা কিন্তু। জানালার সাইডি বসবা। ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি ওর উদ্বিগ্নতায় মুখ টিপে হাসি। একসময় দূরে গিয়ে হাত নাড়াই। ওদের মুখ ধীরেধীরে অস্পষ্ট হয়ে যায়। সকালে ঢাকায় পৌঁছেছি। সারাদিন বোর্ড অফিসে কাটানোর পর খাতার বাণ্ডিল নিয়ে লোকাল বাসে চেপে বসেছি। ইচ্ছে আজ রাতটা মিরপুরের এক বন্ধুর বাসায় কাটাবো। বিকেল হয়ে এসেছে। ফার্মগেট আসতেই পাশের খালি সিটে এক বৃদ্ধ এসে বসলেন। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ পরপর মুখ ভরে বাতাস নিয়ে আবার হু করে ছেড়ে দিচ্ছেন। বেশ ক্লান্ত। ভাল করে খেয়াল করতেই চিনে ফেললাম। মাষ্টার মশাই। আমাদের অতি পরিচিত সফিক স্যার। হেসে পরিচয় দিলাম। স্যার ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় নিলেন। হঠাৎ ফ্যালফ্যালে চোখে বিস্ময় নিয়ে প্রায় দাঁত-শূন্য মুখে হাসি ছড়িয়ে দিলেন, তুই সেই বীরু? জ্বি স্যার।

আমার সাথে থাকা খাতার বাণ্ডিলে চোখ বুলিয়ে বললেন, তুই টিচার হয়ে গেছিস বুঝি? বাহ বেশ করেছিস। স্যার তাঁর ভারী গ্লাসের চশমা খুলে নিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তাঁর হাত কাঁপছে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো স্বর্গ থেকে আমার বাবা ফিরে এসেছেন বুঝি। স্যার হেসে জানতে চাইলেন, অন্যদের খবর জানিস কিছু? ফেসবুকে মাঝেমধ্যে দেখি। পিয়াস এখন জার্মানিতে স্যার। রতনের এফসিপিএস শেষ হয়েছে মনে হয়। বড় ডাক্তার। বকুল মেজিস্ট্রেট। ছোট বেলায় কী মারটাই না খেতো আপনার হাতে! হাহাহা স্যার চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকলেন। ঠিক ধ্যানমগ্ন মুনিঋষির মতো মনে হচ্ছে। কুশল বিনিময় হলো। কথায় কথায় জানলাম, স্যার রাজাবাজারে এক ভাগ্নির বাসায় এসেছিলেন।

এই বয়সে একা কেন এসেছেন জানতে চাইলে বললেন, তোর কাকিমা তো নেই। ইবনাতকে তো চিনতিস। আমার ছেলে। ও তো আমেরিকায় এখন। বিরাট ডাক্তার। বউমাও ডাক্তার। ওরা ওয়াশিংটনে সেটেল হয়েছে। দাঁড়া আমার নাতীটাকে দেখাই। স্যার গাল ভরা হাসি নিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখালেন। স্ক্রিন-সেভারে ভীষণ সুন্দর একটি ছয়-সাত বছরের ছেলের ছবি। স্যার স্ক্রিনে আঙুল বুলিয়ে বললেন, ওর নাম আরাফাত। শুনেছি স্বভাব অনেকটা আমার মতো পেয়েছে। লাইক গ্রান্ডপা লাইক গ্রান্ডসান। হাহাহা যোগাযোগ হয় নিয়মিত? কী বলিস? একটা মাত্র ছেলে আমার, যোগাযোগ হবে না? রোজ নিয়ম করে ভিডিও-কল দিয়ে কথা হয়। নাতী একদিন দাদুর সাথে কথা না বললে সারা বাড়ী মাথায় তুলে কান্না শুরু করে। বাংলা কম বুঝে যদিও। তবুও তো রক্তের টান!

জিজ্ঞেস করলাম, একাই থাকেন ঢাকায়?একা ঠিক না। কেয়ারটেকার আছে। একটা মেয়ে আছে রান্না-বাড়া ধোয়া-মোছা করে যায়। দিব্যি আরামে কেটে যায় দিন। জায়গা তো কেনাই ছিল জানিস। ঐখানে ভীষণ সুন্দর বাড়ী উঠিয়েছি। দুই তলা। তবু এই বয়সে একা বের হওয়া। লোকাল বাসের ধকল। রিস্ক একটু বেশি স্যার। তোরা সবাই বুড়োর পেছনে লাগিস কেন বল দেখি? ইবনাত গতবার এসে গাড়ি কিনে রেখে গেছে। আমি তো কোথাও তেমন যাই না। ড্রাইভারকে বসিয়ে বেতন দেয়ার কী দরকার। ওটা এখন রেন্ট-এ-কারে দিয়ে দিয়েছি। আমার এভাবে চলতেই ভাল্লাগে। অবশ্য ছেলে-বউমা জানলে আর আস্ত রাখবে না। তাই না জানিয়ে হুটহাট বেরিয়ে পড়ি। হাহাহা
স্যারের মুখ থেকে হাসি সরছে না। বললাম, খুব ভাল লাগলো শুনে।

স্যার কিছুটা লজ্জা নিয়ে বললেন, কিন্তু তোকে যে নেবো সে অবস্থা নেই। আগারগাঁয়ে এক আত্মীয়ের মেয়ের বিয়ে। খুব জোর করলো। কিছুদিন থাকতেই হবে। আপনি ব্যস্ত হবেন না। একদিন এসে বেড়িয়ে যাবো। স্যারের লজ্জা কাটিয়ে দিয়ে মোবাইল থেকে সুমতি আর চারুর ছবি দেখালাম। স্যার আনন্দে কেঁদে ফেললেন।
তোর ভারী সুন্দর মেয়ে রে বীরু! বললাম, আসেন না একদিন গরীব ছাত্রের বাড়ীতে। বেড়ানোর সেই দিন কি আছে? বয়েস হয়েছে। তাছাড়া ছেলে-বউমা খুব টেনশান করে আমাকে নিয়ে। সেদিন ওষুধ না খেয়ে ঘুমিয়েছি জেনে কী বকাটাই না বকলো। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে এমন করি। ওদের মিষ্টি বকুনি এই বুড়ো বয়সের একমাত্র সম্বল। হাহাহা স্যারের প্রসন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগছে। মনে হলো কতদিনের পরমাত্মীয়ের দেখা পেয়েছি।

প্রায় দেড় যুগ পেরিয়ে গেছে। একসময় আমরাও পারিবারিক ভাবে ঢাকার মিরপুরে থাকতাম। বাবা সীজনাল পোশাকের ব্যাবসা করতেন। চট্টগ্রাম থেকে বেল্ট সহ শীতের আধ-পুরনো পোশাক এনে ঢাকায় বেচতেন। একবার পিক-আপ বোঝাই মাল আনতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পিক-আপের নিচেই তাঁর মৃত্যু হয়। মা ছাড়াও বড় এক ভাই আর বোন ছিল সংসারে। স্বামীর প্রতি অতি ভক্তি দেখিয়ে সেই একই বছরে মা নিজেও স্বামীর দেখানো পথ ধরলেন। এক সন্ধ্যায় বুক চেপে ধরে বললেন, ও বীরু আমার জানি কেমন ঠেকতিছে! গ্যাসের ব্যথা ভেবে সেকলো খাওয়ানোর দশ মিনিটের মাথায় মা মারা গেলেন। ভাগ্য ভাল, বড় বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল ততদিনে। ভগ্নিপতি সাভারের এক জুয়েলারি শপে গয়না বানানোর কাজ করে।

কিছুদিন যেতেই ভাইয়ের সাথে বাবার ব্যবসায় লেগে গেলাম। পড়াশোনা করবো এমন অবস্থা ছিল না। মাস খানেক স্কুলে আমাকে না পেয়ে একজন স্যার আমাকে খুঁজে বের করেন। পড়াশোনার দায়িত্ব নেন। তিনি এই শফিক স্যার।
এসএসসি’র পর ভাই আমাকে গ্রামের পড়ো-ভিটায় একা রেখে মুম্বাই গিয়ে এক খাবার হোটেলে চাকরী নিলেন। সেখানে আমার এক খুড়তুতো ভাইও আছেন শুনেছি। বছর খানেক গড়াতে ভাই কলকাতায় আমাদের এক দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়ের মেয়ে বিয়ে করলেন। এখন মাঝেমধ্যে বউ-বাচ্চা সমেত আসেন। দুদিন বেড়াবার পর আবার চলে যান।

আমি থেমে যাইনি। মফঃস্বলের কলেজে ভর্তি হয়েছি। মানুষের চিংড়ীর ঘেরে দিন চুক্তির কাজ করেছি। টিউশানি করেছি। কালে-কালে আমার একসময়ের পড়ো-ভিটায় এখন একতলা দালান। কিন্তু পেছনে পড়ে গেছে অগণিত স্মৃতিময় ঢাকার অগণিত বন্ধু, অগণিত শুভাকাঙ্ক্ষী, আমার তিক্ত-মধুর শৈশব, আর দীর্ঘ পাঁচ বছর সন্তানের মতো আগলে রাখা আমার ভীষণ প্রিয় শিক্ষক শফিক স্যার।

স্যার আগারগাঁ এসে উঠে দাঁড়ালেন। পা ভাল করে ফেলতে পারছেন না। শরীর কাঁপছে। হাত ধরে নামিয়ে দিলাম। স্যার বিদায় জানিয়ে চোখের পানি মুছতে-মুছতে নেমে পড়লেন। রাত হয়ে এসেছে। বাস ছেড়ে দিয়েছে। বাসের জানালা থেকে দেখলাম স্যার স্টপেজে দাঁড়িয়ে চশমাটা পাঞ্জাবীর খুটে মুছে নিয়ে পাশের ফুটপাতে টলটলে পায়ে গিয়ে বসলেন। পরদিন দুপুর। ছোট্ট একটা কামরায় বসে আছি। দু পাশে দুটো সিঙ্গেল খাট পেতে রাখা। একটিতে একজন সত্তর বছরের বৃদ্ধ মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছেন। বৃদ্ধ আমার পরিচিত। একসময় তাঁর সামান্য একটু জায়গা কেনা ছিল। স্বপ্ন ছিল সুন্দর একটি বাড়ী করবেন। সেখানে আর বাড়ী ওঠেনি। ছেলেকে মানুষ করার জন্য বিক্রি করে আমেরিকায় পড়তে পাঠিয়েছিলেন। কথা ছিল ছেলে বড় ডাক্তার হয়ে ফিরে আসলে এমন বাড়ীর অভাব হবে না।

ছেলে ফিরে এসেছে ঠিকই। তবে পুরোপুরি নয়। কদিন বাদে প্রবাসে স্থায়ী ভাবে খুঁটি গেড়েছে। সেখানেই বিয়ে করেছে, সন্তান হয়েছে। দেশে বৃদ্ধ বাবা থাকতেন ভাড়া বাসায়। আত্মীয়স্বজন দু-একজন যারা আছেন, তাঁরা দু-চারদিনের মেহমানদারী করলেও পুরো দায়িত্বের কথা ভুলেও মনে আনেননি কেউ। কিন্তু শেষ বয়সে একাকী প্রাণে আর কত সয়? যে মানুষটা একসময় সহস্র মানুষের মাথার উপরের আশ্রয় হয়েছিলেন, আজ তিনি নিজে সব হারিয়ে আশ্রয়হীন। বৃদ্ধের নাম শফিকুর রহমান। আমার মাষ্টার মশাই। স্যার মাথা উঁচিয়ে তাকালেন, আমার পিছু নিয়েছিলি গতরাতে? কী বলা উচিৎ কিছু খুঁজে পেলাম না। স্যার হাসলেন। বললেন, ছেলে গতবার এসে এখানে দিয়ে গেছে আমাকে। মাসে একবার ওদের সাথে কথা হয়। টাকা পাঠিয়ে কনফার্ম করে। আমি অপেক্ষায় থাকি আমার দাদুটাকে একনজর চোখের দেখা দেখবো। বেশিরভাগ সময় দেখতে পারি না। হয় স্কুলে থাকে, না হয় ঘুমিয়ে থাকে। আমার বুকটা হাহাকার করে। তুই ক্ষমা করিস রে বীরু। অনেক মিথ্যা বলে ফেলেছি।

স্যার অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন। চোখের পানি লুকোনোর সহজ অভিনয়। আমি কিছু বলার মতো খুঁজে পাই না। নিছক সান্ত্বনায় কি এ যন্ত্রণা যায়? আমার নীরবতায় স্যার মৃদু হাসলেন। বললেন, তুই এসেছিস এখন। প্রতিদান দিতে চাচ্ছিস রে বীরু? প্রতিদান চাইলেও সম্ভব না স্যার। আমি হিন্দু। কিন্তু আপনিই তো শিখিয়েছিলেন, বাবা-মায়ের আলাদা জাত হয় না। এগিয়ে গিয়ে পা জড়িয়ে ধরলাম। স্যার পা সরিয়ে নিলেন। তুই চলে যা। আর আসবি না এখানে। আমি এখানেই ভাল আছি। শেষ দুপুরের দিকে একা বের হয়ে আসলাম। স্যার আবার আগের মতো মাথা ঝুঁকিয়ে বসে রইলেন। আমার বিদায়ের সময় একবার ফিরেও দেখলেন না।

আগারগাঁ স্টপেজটা এখান থেকে বেশি দূরে না। পেছন ফিরে তাকালাম। লাল রঙের চারতলা একটা দালান। বিশাল সাইনবোর্ড দেয়া। প্রবীণ হিতৈষী সঙ্ঘ। এখানে বেশকিছু মানুষের বাস। অনেকের মতে ফুরিয়ে যাওয়া মানুষ। ঘাড়ের বোঝা! যাঁদের মমতায় একসময় উঠোন ভরে উঠতো কোলাহলে – আজ তাঁরাই মমতার আশায় কাঙাল হয়ে নীরব দৃষ্টিতে অতীত খুঁজে ফেরেন দূর দিগন্তে চোখ ফেলে। একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে মাথা ঘুরিয়ে নিলাম। ফুটপাত ঘেঁষে পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম। কতক্ষণ বসে আছি জানা নেই। কিছু দূরে একটা রিকশা দাঁড়ানো। রিকশার পাশে সফিক স্যার হাতে একটা ট্রলি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি কাঁদতে-কাঁদতে সুমুকে ফোন দিলাম, সুমু বাবাকে সাথে করে নিয়ে আসছি।

সুমু সব জানে। গতরাতে বলেছিলাম। চারু ছিল পাশেই। সুমুর কাছে শুনলাম, মেয়ে নাকি ইতিমধ্যে একটা কাগজে লিখে ফেলেছে, “তুমি যদি এ কথা পড়তে পারো তাহলে তুমি চোখে দেখো। বুড়ো হওনি মোটেও বুঝেছো দাদু?” কী অদ্ভুত! মেয়েটা মায়ের মতোই পাগলাটে হয়েছে। স্যারকে নিয়ে আসছি শুনে সুমু চমকে উঠে বলল, ঠাকুরঘর খালি কইরে সোনা-রূপোর পানি দিয়ে ভাসায়ে ধুইছি। জায়নামাজ কিনে আনিছি। মক্কা-শরিফির ছবি টাঙ্গাইছি দিয়ালে। ঘরে আমার জ্যান্ত ঠাকুর থাকলি মাটির দেবতা দিয়ে করবোটা কী? তুমি কান্দা থামাও। ভগবান যাত্রা শুভ করুক। রওনা দেও।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। রাতের বাসে সায়েদাবাদ থেকে বাগেরহাটে ফিরবো। মাঝে আছে পদ্মা ফেরির ধকল। মেলা পথ। রিকশা বাস স্টপেজের দিকে ধীরে-ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। স্যার হাত নাড়িয়ে স্কুল জীবনের গল্প শুরু করেছেন। আমি অবাক হয়ে শুনছি। স্যারকে বুঝতে না দিয়েই মাঝেমধ্যে তাঁর গা ঘেঁষে শরীর স্পর্শ করছি। নিজের মধ্যে একধরণের পবিত্র অনুভূতি হচ্ছে। আমি প্রায় নিশ্চিত আমার স্বর্গবাসী বাবার স্পর্শটাও ঠিক এমনই লাগতো!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত