ঘড়ি

ঘড়ি

আর্য সিকিউরিটি সংঘ নামক লিমিটেড কোম্পানীর অফিস ভবনের ত্রিতলে একটি সুপরিসর কক্ষ। কক্ষটি বোর্ড অফ ডিরেক্টর্স-এর মন্ত্রণাগৃহ বা মীটিং রুম। ঘরের মধ্যস্থলে একটি ডিম্বাকৃতি টেবিল ঘিরিয়া কোম্পানীর পাঁচজন ডিরেক্টর বসিয়া আছেন; তিনকড়িবাবু সভাপতি—তাঁহার তিন থাক চিবুক, বড় বড় গোঁফ এবং উন্নত স্তন। ইনি কোম্পানীর হতাকতা; বাকি চারজন ডিরেক্টর অর্থাৎ রসময় বসাক, প্রাণহরি চৌধুরী, ঝাপড়মল কাপড়িয়া (মারোয়াড়ী) ও চতুর্ভুজ মেহতা। (গুজরাতি)। ইহারা তিনকড়িবাবুর ব্যক্তিত্ব ও দূরদর্শী বাণিজ্য-প্রতিভার নিকট পরাভব স্বীকার করিয়া শেষ পর্যন্ত তাঁহারই কথায় সায় দিয়া থাকেন। আরও এক বিষয়ে সকলের মধ্যে ঐক্য দেখা যায়—সকলেই স্কুল কলেবর এবং অল্পবিস্তর পীন পয়োধরাঢ্য।

রাত্রিকাল; দেয়ালের ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজিয়াছে। ঘড়ির ঊর্ধ্বে দেয়ালের গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা A.S.S. Ltd. ঘড়ির নীচে একটি অগ্নি-প্রুফ সিঁদেল-পুফ লোহার সিন্দুক। ঘরের বিভিন্ন দেয়ালে চারিটি দরজা; তন্মধ্যে বাঁ-ধারের দরজাটি সদর দরজা, উহা বর্তমানে ভেজানো রহিয়াছে; বাকি দরজা তিনটি দিয়া পাশের ঘরগুলির কিয়দংশ দেখা যাইতেছে।

ঝাপড়মল কাপড়িয়া প্রথম কথা কহিলেন। ইনি একজন ভোজন রসিক; প্রচুর অর্থ থাকা সত্ত্বেও অকালে জীবন সম্ভোগ-ক্রিয়ায় অসমর্থ হইয়া পড়ায় ইনি এখন একান্তভাবে ভোজন ও ভুক্তবস্তুর পরিপাকে মনঃসংযোগ করিয়াছেন।

ঝাপড়মল : তিনকৌড়িবাবু, আপনে আজ রাত্তির বেলা মীটিং কল করিলেন, হামার আবার নয়টার পর ঘুমালে হোজম হয় না।

তিনকড়ি : রাত্তিরে মীটিং ক করবার বিশেষ কারণ কাছে, ঝাপড়মজি, ব্যাপারটা গোপনীয়।

ঝাপড়মল : তো কী গুফত গু আছে জলদি জলদি শুরু করিয়ে দেন রাত তো বহুত হৈল!

তিনকড়ি : এই যে শুরু করি। কিন্তু তার আগে

তিনকড়িবাবু টেবিলের পাশে বৈদ্যুতিক কল-বেল টিপিলেন। ঘরের বাইরে কিড়িং কিড়িং শব্দ হইল। কয়েক মুহূর্ত পরে ভেজানো দরজায় টোকা মারিয়া একটি অল্পবয়স্ক শীর্ণকায় কেরানী প্রবেশ। করিল। তাহাকে দেখিয়া ক্ষুধার্ত মনে হয়; হয়তো সেই সকালবেলা আহার করিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইয়াছিল, তারপর আর পেটে কিছু পড়ে নাই। তাহার নাম চরণদাস বিশ্বাস; সে তিনকড়িবাবুর সবচেয়ে অনুগত কেরানী, তাই তাহার অফিসে আসাযাওয়ার সময়ের কিছু ঠিক নাই। মাহিনা পঁয়ত্রিশ টাকা। আশায় ভর করিয়া চরণদাস অনন্যমনে প্রভুর সেবা করিয়া চলিয়াছে। প্রভুও ইঙ্গিতে ভরসা দিয়াছেন, এইভাবে কাজ করিয়া চলিলে কোনও এক অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতে চাকরি পাকা হইতে পারে। চরণদাস তাহাতেই কৃতার্থ—

চরণদাস : আজ্ঞে?

তিনকড়ি : বিশ্বাস, অফিসে কেউ আছে?

চরণদাস : আজ্ঞে অ্যাকাউন্টেন্টবাবু এতক্ষণ ছিলেন; তাঁর হিসেব মিলছিল না। তিনি এই গেলেন।

তিনকড়ি : এখন তাহলে অফিসে আর কেউ নেই?

চরণদাস : আজ্ঞে না, সবাই চলে গেছে। আমাকে থাকতে বলেছিলেন—তাই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন লোক এসে আমার নাম করবে; ফরসা রং, মাথায় কোঁকড়া চুল, বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ। সে এলেই বেল্ টিপে আমাদের খবর দেবে—তারপর তাকে সঙ্গে করে ওপরে নিয়ে আসবে।

চরণদাস : যে আজ্ঞে।

চরণদাস সন্তর্পণে দরজা ভেজাইয়া দিয়া প্রস্থান করিল। প্রাণহরি চৌধুরী একটু অধীর হইয়া উঠিতেছিলেন। বেশী রাত্রি পর্যন্ত বাড়ির বাহিরে থাকিতে তিনি ভালবাসেন না। তাঁহার একটি বাই আছে; গৃহিণীর বয়স চল্লিশ পার হইয়া গেলেও তাঁহার সম্বন্ধে প্রাণহরিবাবুর মন এখনও অসন্দিগ্ধ হয়। নাই। রাত্রে বাড়ি ফিরিতে একটু দেরি হইলেই নানাপ্রকার সন্দেহ তাঁহার মনে জটলা পাকাইতে থাকে।

প্রাণহরি : এত লুকোচুরি কিসের—কে লোকটা? হঠাৎ

ঝাপড়মল : ওহি তো হামিভি ভাবছে—হ্যাঠাৎ! তিনকৌড়িবাবু, আপ্ হ্যাঠাৎ কোন্ আদমিকো বোলায়াক্যা মতলবসে-কুছু পাতা তো বালান! হ্যাঠাৎ

চতুর্ভুজ মেহতা এবার কথা কহিলেন। ইহার ধ্যানজ্ঞান সমস্ত জুড়িয়া বসিয়া আছে রেসের ঘোড়া; তাই তাঁহার প্রত্যেক কথার মধ্যে ঐ চতুষ্পদ জন্তুটির ক্ষুরধ্বনি পাওয়া যায়।

চতুর্ভুজ : এ মানস্ কোন ছে, তিনু শেঠ? ডার্ক হর্স মালুম হোয়।

তিনকড়ি : সেই কথা বলবার জন্যেই তো আজ আপনাদের ডেকেছি—ডার্ক হর্স না হলে এত সাবধান হবারই বা কি দরকার ছিল?

রসময় : হ্যাঁ হ্যাঁ, কি বলবেন চট করে আরম্ভ করে দিন; আমার আবার সাড়ে নয়টার মধ্যে

তিনি তীক্ষ্ণ উৎকন্ঠায় ঘড়ির পানে তাকাইলেন। রসময় বসাক মহাশয় রাত্রিকালে গৃহে শয়ন করেন না, যেখানে শয়ন করেন, সেখানে পৌঁছিতে দেরি হইলে বেদখল হইবার সম্ভাবনা।

তিনকড়ি : হ্যাঁ, এই যে আরম্ভ করি। ব্যাপারটা বড় জটিল, গোড়া থেকে বেশ গুছিয়ে বলা দরকার

তিনকড়িবাবু তাঁহার বিপুল দেহভার চেয়ার হইতে উত্তোলিত করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তিনি একটু নাটুকে ভঙ্গিতে বক্তৃতা দিতে ভালবাসেন, এ বিষয়ে স্বর্গীয় নট অমর দত্ত তাঁহার আদর্শ। যৌবনকালে তিনি সখের অভিনেতা হিসাবে বেশ নাম করিয়াছিলেন। এখন ভীম সাজিতে লজ্জা করে, কিন্তু বোর্ড অফ ডিরেক্টস-এর মিটিং থাকিলেই তিনি সহজ ভাষায় বক্তব্য প্রকাশ না করিয়া এই ছুতায় একটু নাটকীয় অভিনয় করিয়া লয়েন।

তিনকড়ি : বন্ধুগণ, দেখিতে দেখিতে সুখ-স্বপ্নের মতো পাঁচটা বছর কাটিয়া গেল। আমাদের। সাধের আর্য সিকিউরিটি সংঘ—আমাদের শত্রুপক্ষ Ass অর্থাৎ গাধা লিমিটেড বলিয়া বিদ্রূপ করিয়া থাকেন—সেই গাধা লিমিটেড আজ শত্রুর সমস্ত অবজ্ঞা নিষ্কলুষিত করিয়া, শত্রুর ভবিষ্যদ্বাণী ভূমিষ্ঠপাত করিয়া বন বন শব্দে এরোপ্লেনের মতো আকাশে উড়িতেছে—

রসময় : কি মুশকিল—আসল কথাটা শুরু করুন না; এদিকে যে ঘড়িতে

তিনকড়ি : যে ক্ষুদ্র চারা গাছ আমরা বুকের রক্ত দিয়া রোপন করিয়াছিলাম তাহা আজ আকাশ চুম্বনকারী শাল্মলীতরুর ন্যায় ফলে ফুলে সুশোভিত হইয়া উঠিয়াছে। কী করিয়া ইহা সম্ভব হইল? কোন অমানুষিক উপায়ে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বীদের পদদলিত করিয়া ব্যবসায় বৃক্ষের মগডালে উঠিতে সমর্থ হইলাম?

ঝাপড়মল : সে তো হাম সোবাই জানে—

চতুর্ভুজ : হ্যাঁ, মুর্দা ঘোড়াকে চাবুক মারিলে কতো দৌড়িবে, তিন ভাই? ইবার নয়ী কহানি শুরু করেন।

তিনকড়ি : আপনাদের স্মরণ থাকিতে পারে, আরম্ভের দিকে আমাদের ব্যবসা ভাল চলিতেছিল না। এই সময় এই বৈজ্ঞানিক ছোকরাকে আমি আপনাদের কাছে লইয়া আসি। এই যুবক এক ডাক্তারি মলম আবিষ্কার করিয়াছিল—যুবতীগণের যৌবন রক্ষার এক অদ্ভুত মুষ্টিযোগ! কিন্তু আপনারা এই যুবকের দুর্ভিক্ষপীড়িত শীর্ণ চেহারা দেখিয়া তাহার কথায় বিশ্বাস করেন নাই। আমি জোর করিয়া তাহার মলম আমাদের সকলের উপর পরীক্ষা করাইয়াছিলাম। ফলে—

প্রাণহরি : ফলের কথা আর বলে কাজ নেই।

তিনকড়ি : কেন কাজ নেই–নিশ্চয় আছে। (সাধু ভাষায়) ঔষধের অত্যাশ্চর্য ফল যখন আমাদের সকলের অঙ্গে পরিস্ফুট হইয়া উঠিল, যখন মলমের মহিমা সম্বন্ধে আর কোনও সন্দেহ রহিল না, তখন আমরা মাত্র দুই শত টাকা মূল্যে ঐ দরিদ্র যুবকের নিকট হইতে তাহার স্বত্ব কিনিয়া লইলাম। সেই দিন হইতে আমাদের ভাগ্য ফিরিয়া গেল; আমাদের শত্রুপক্ষ সাফল্যের সহিত পশ্চাদপসরণ করিল। আমরা মলমের নাম রাখিলাম—কুচকাওয়াজ। সেই কুচকাওয়াজ—আমাদের সাধের কুচকাওয়াজ আজ বাঙলার ঘরে ঘরে বিরাজ করিতেছে। হাজার হাজার টাকা মুনাফা আমরা কুচকাওয়াজের প্রসাদে অর্জন করিয়াছি। এই যে ইন্দ্রপুরীতুল্য অফিস বাড়ি—যাহার ত্রিতলে বসিয়া আমরা মহানন্দে সভা করিতেছি—এই যে আমাদের দিগ্বিদিক্‌—অর্থাৎ দিগন্তব্যাপী নাম যশ প্রতিষ্ঠা—এ সকলের মূলে কেবল কুচকাওয়াজ!

রসময় : (অর্ধর্ষগত) খেলে কচু, কাজের কথা বলবে না, কেবল কুচকাওয়াজ করে চলেছে। ওদিকে রাত পুইয়ে গেল—

প্রাণহরি : তিনকড়িবাবু, এবার একটু তাড়াতাড়ি আসল কথাটা আরম্ভ করে দিন; যার আসবার কথা সে হয়তো এতক্ষণ এসে পড়ল—

তিনকড়ি : সংক্ষেপেই তো বলছি। আপনারা একটুতেই হাঁপিয়ে ওঠেন; আপনাদের মতো ব্যস্ত-সমস্ত স্বভাব নিয়ে ব্যবসা করতে যাওয়া বাতুলতা শাস্ত্রে বলেছে—

প্রাণহরি : জানি জানি, আপনি আবার অন্য কথা আরম্ভ করবেন না; যা বলছিলেন তাই বলুন কুচকাওয়াজ শেষ করুন।

ঝাপড়মল : একটা কথা পুছ করি, তিনকৌড়িবাবু। ঐ ছোকরাঠো কিধার গিয়া? উসকো দেকে ঔর একটা মলম যদি তৈয়ার করিয়ে নিতে পারেন তো লাখ লাখ রূপা উপায় হোয়—

তিনকড়ি : তার খোঁজ করিয়েছিলাম; জানা গেল, ছোকরা যক্ষ্মা রোগে মারা গেছে। (সাধু ভাষায়) কিন্তু মরুক সে, তাহাতে কিছু আসে যায় না। একজন মরিলে আর একজন আসিবে—ইহাই জগতের নিয়ম। সেই কথাই বলিবার জন্য আজ এই এই মীটিং আহ্বান করিয়াছি।

চতুর্ভুজ : আহহা—ডবল টোট! তিনু ভাই ডবল টোট মারিবার মতলব করিয়েছেন!

তিনকড়ি : হ্যাঁ। আর একটি বৈজ্ঞানিক ছোকরাকে পাকড়াও করিয়াছি। যুবক রুশ দেশে গিয়াছিল; সেখানে কোনও বৈজ্ঞানিক গবেষণা-মন্দির হইতে এক অদ্ভূত আবিষ্কার চুরি করিয়া পলাইয়া আসিয়াছে।

রসময় : (সপ্রশংস কণ্ঠে) খলিফা ছেলে তো!–রাশিয়ানদের ঘাড় ভেঙেছে!

প্রাণহরি : কিন্তু চোরাই মাল

তিনকড়ি : কে জানিবে চোরাই মাল—আমরা উহার পেটেন্ট লইয়া রীতিমত আইনসঙ্গতভাবে ব্যবসা করিব। কাহার সাধ্য আমাদের ধরে!

প্রাণহরি : ধরা না পড়লেই ভাল। আবিষ্কারটা কী?

তিনকড়ি : অদ্ভূত আবিষ্কার—বিজ্ঞানের চরমোৎকর্ষ! আজকাল এই যন্ত্রের যুগে কত রোমহর্ষণ কাণ্ডই না হইতেছে! আমরা আকাশে উড়িতেছি, সমুদ্রে ড়ুবসাঁতার কাটতেছি, শূন্যে ফসল ফলাইতেছি—কিছুতেই আশ্চর্য হইতেছি না। কিন্তু এই নবীন আবিষ্কারক যে অত্যাশ্চর্য যন্ত্র আমাদের কাছে আনিতেছে, তাহার কথা শুনিলে আপনারা একেবারে চমৎকৃত হইয়া যাইবেন। ইহা একটি ঘড়ি!

সকলেই উৎসুক হইয়া একটা অভাবনীয় কিছুর প্রতীক্ষা করিতেছিলেন, ঘড়ি শুনিয়া নিরাশভাবে একবাক্যে প্রতিধ্বনি করিলেন–ঘড়ি!

তিনকড়ি : হ্যাঁ, ঘড়ি। আপনারা অ্যালার্ম ঘড়ির কথা জানেন; দম দিয়া রাত্রে শয়ন করিলে সকালবেলা ঠিক সময়ে ঘুম ভাঙাইয়া দেয়! এ ঘড়ি আরও বিস্ময়কর; দম দিয়া শয্যার পাশে রাখিয়া শয়ন করুন, পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুম পাড়াইয়া দিবে।

সকলে কিছুক্ষণ নির্বাক; তারপর ঝাপড়মল প্রথম কণ্ঠস্বর ফিরিয়া পাইলেন।

ঝাপড়মল : আপনে বোলেন কি, তিনকৌড়িবাবু! ঘড়ি হামাকে শুতিয়ে দিবে—এঁ?

রসময় : ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি!

চতুর্ভুজ : তাজ্জব হে! ঘড়িমে ভি ডোপ আছে কী?

তিনকড়ি : তা না হলে আর বলছি কি! এই অদ্ভুত আবিষ্কার ছোকরা চুরি করে এনেছে সাধু ভাষায়) ভাবিয়া দেখুন এই আবিষ্কারের বিপুল সম্ভাবনা! আজকাল অনিদ্রা রোগ সভ্য মানুষের প্রধান রোগ হইয়া দাঁড়াইয়াছে; চিন্তা-জর্জরিত কর্মক্লান্ত মানব শয্যায় শয়ন করিয়া নিদ্রার আরাধনা করিতেছে, কিন্তু নিদ্রাদেবী দেখা দিতেছেন না। ডাক্তারী ঔষধে কোনই ফল হয় না; উপরন্তু স্নায়ুর জটিলতা বাড়িয়া যায়। এরূপ অবস্থায় এই ঘড়ি মৃতসঞ্জীবনী সুধার কাজ করিবে; শয্যায় শয়ন করিয়া ঘড়ি চালাইয়া দিন—ঘড়ি হইতে মৃদু মৃদু স্বর্গীয় সংগীত উত্থিত হইবে ব্যস্, শুনিতে শুনিতে পাঁচ মিনিটের মধ্যে আপনি গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত হইবেন। আপনাদের আর অধিক কি বলিব আপনারা জ্ঞানী, গুণী, মনস্বী। এই ঘড়ি বাজারে বাহির হইলে ইহার জন্য কিরূপ কাড়াকাড়ি পড়িয়া যাইবে, তাহা সহজেই অনুমান করিতে পারেন।

প্রাণহরি : সে সব তো পরের কথা। আপনি ঘড়ি পরখ করে দেখেছেন?

তিনকড়ি : পরীক্ষা করিবার জন্যই তো আজ নিশীথকালে এই সভা আহ্বান করিয়াছি। আপনারা সকলে পরীক্ষা করিয়া দেখুন; যুবক ঘড়ি লইয়া এখনি আসিবে; এইখানেই তাহার পরীক্ষা হইবে।

চতুর্ভুজ : ই তো সারু বাত আছে। ঘোড়া পন্ ঘড়ি দোন্ বরাবর, কে দৌড়ে দেখনেসে পতা লগে।

প্রাণহরি : কত দাম চায় কিছু বলেছে?

তিনকড়ি : দামের বেলাতেই মোচড় দিচ্ছে, বলে দশ হাজারের কম নেবে না। আর আজ রাত্রেই লেখাপড়া সব শেষ করে ফেলতে চায়। বলে, আপনারা যদি না নেন, অন্য লোক আছে।

রসময় : হুঁ, গরম বেশী দেখছি, রাশিয়া ঘুরে এসেছে কিনা। একবার ওদিকে পা বাড়ালেই বেটাদের মাথা ঘুরে যায়। কুচকাওয়াজের বেলায় কিন্তু

ঝাপড়মল : হ্যাঁ, দেখেন না, কুচকাওয়াজ কোত্তো সস্তা মিলা থা—উ তো বিলকুল ফোকমে মিলা থা!

তিনকড়ি : তা বটে, কিন্তু সব জিনিস তো ফোকটে পাওয়া যায় না, ঝাপড়জি। আর এ ঘড়ি যদি সত্যি হয়, পশ্চাশ লক্ষ টাকা তো বাঁধা। সে হিসেবে দশ হাজার টাকা জলের দর। তবে যদি আপনারা অমত করেন

চতুর্ভুজ : নেহি নেহি, তিনুভাই, বাত ই আছে কি অড়স যতো ভালা মিলে ওতোই মজা, পন যদি মিলে তো কী উপায়!

তিনকড়ি : তাহলে আপনাদের সকলের মত আছে?

সকলে ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি দিলেন। তিনকড়ি : আমি জানতাম আপনাদের অমত হবে না। তাই আগে থাকতেই দলিল তৈরি করিয়ে দশ হাজার টাকা এনে সিন্দুকে রেখেছি, সে আবার চেক নেবে না। আজ রাত্রেই এ ব্যাপারের নিষ্পত্তি করে ফেলা ভাল; নইলে হয়তো হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।

এই সময় দ্বারের নিকট বৈদ্যুতিক ঘন্টি বাজিয়া উঠিল। তিনকড়িবাবু উপবেশন করিলেন। আর সকলে উৎসুকভাবে খাড়া হইয়া বসিলেন।

তিনকড়ি : এসে পড়েছে। আপনারা বেশী আগ্রহ দেখাবেন না; বলা কওয়া আমিই করব। ঝাপড়মল : জয় গড়েশ!

দ্বার ঠেলিয়া চরণদাস প্রবেশ করিল; সঙ্গে একটি যুবক। যুবকের ধুতি মালকোঁচা মারা, খদ্দরের পাঞ্জাবির উপর জহরলালী কুর্তা, হাতে একটি ছোট হ্যান্ডব্যাগ। যুবকের চেহারায় এমন কোনও বিশেষত্ব নাই; বাঙলাদেশে এরূপ একটি টাইপ মাঝে মাঝে দেখা যায়। রং ফরসা, মাথার চুল কাফ্রির মতো কোঁকড়ানো, তাই সহসা তাহাকে বিরলকেশ বলিয়া মনে হয়; মুখের হাড় শক্ত, যেন পেটাই করা।

তিনকড়ি : আসুন মনুজবাবু। চরণদাস, তুমি নীচে গিয়ে বসো। আর কাউকে ওপরে আসতে দেবে না।

চরণদাস : যে আজ্ঞে—এঁ—বেশী রাত হবে কি? বাড়িতে মার অসুখ, ওষুধ নিয়ে যেতে হবে।

তিনকড়ি : (ধমক দিয়া) যা বলছি কর।

চরণদাস : আজ্ঞে—

দীননেত্রে একবার ঘড়ির দিকে তাকাইয়া সে দ্রুত প্রস্থান করিল। তিনকড়িবাবু তখন আগন্তুককে সকলের কাছে পরিচিত করিলেন—

তিনকড়ি : ইনিই হচ্ছেন শ্রীযুক্ত মনুজ কর রাশিয়া ফেরত বৈজ্ঞানিক; আর এঁরা হচ্ছেন আর্য সিকিউরিটি সংঘের ডিরেক্টর—শ্রীপ্রাণহরি চৌধুরী; শ্রীচতুর্ভুজ মেহতা, শ্রীরসময় বসাক, শীঝাপড়মল কাপড়িয়া।

মনুজ কর একবার নড় করিল; অন্য পক্ষ কেবল নিষ্প্রাণ মৎস্যচক্ষু মেলিয়া তাহার পানে চাহিয়া রহিলেন।

মনুজ : দরজা বন্ধ করে দিতে পারি?

অনুমতির অপেক্ষা না করিয়াই সে দরজায় ছিটকিনি লাগাইয়া দিল; তারপর নিকটে আসিয়া হ্যান্ডব্যাগটি টেবিলের উপর রাখিল।

মনুজ : আমার যন্ত্র আপনাদের দেখাবার আগে আমি টাকার কথা পাকা করে নিতে চাই। টাকা এনেছেন তো?

তিনকড়ি : হ্যাঁ হ্যাঁ, সেজন্যে আপনি ভাববেন না, টাকা মজুদ আছে—নগদ টাকা। (ইঙ্গিতে লোহার সিন্দুক দেখাইলেন) এখন আপনার যন্ত্র আমাদের পছন্দ হলেই

মনুজ : যন্ত্র পছন্দ না হয়ে উপায় নেই-হতেই হবে।

মনুজ কর ব্যাগ খুলিয়া একটি ঘড়ি বাহির করিল। নিতান্ত সাধারণ এলার্ম ঘড়ি : যেরূপ ঘড়ি পরীক্ষার সময় মাথার শিয়রে রাখিয়া ছাত্রেরা শয়ন করে। মনুজ ঘড়ির এলার্মে দম দিতে দিতে দাঁত বাহির করিয়া হাসিল।

মনুজ : আমি তিনকড়িবাবুকে বলেছিলাম আমার ঘড়ি আপনাদের ঘুম পাড়িয়ে দেবে। কথাটা হয়তো পুরোপুরি সত্যি নয়, তবে এ ঘড়ি আপনাদের মনে চমক লাগিয়ে দিতে পারবে, এ বিশ্বাস আমার আছে। আসলে এটি ঘড়ি নয়—বোমা; যাকে বলে টাইমবম্ব!

মনুজ ঘড়িটি টেবিলের মধ্যস্থলে রাখিল। সকলে হতভম্ব হইয়া ক্ষণকাল সেইদিকে তাকাইয়া রহিলেন; তারপর ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

তিনকড়ি : অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ—

রসময় : আরে খেলে কচু!

ঝাপড়মল : লা হোল্ বিলাকুবৎ!

মনুজ : (শান্তকণ্ঠে) ঘড়িতে দম দিয়ে দিয়েছি, ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে বোমা ফাটবে।

আর কেহ দাঁড়াইলেন না, খোলা দরজাগুলি দিয়া মুহূর্তে অদৃশ্য হইয়া গেলেন। কেবল তিনকড়িবাবু সদর দরজার দিকে দৌড়িয়াছিলেন, মনুজ তাঁহাকে ধরিয়া ফেলিল।

মনুজ : এদিকে নয় ওদিকে; নীচে গিয়ে পুলিস ডাকবেন সেটি হচ্ছে না। আর সিন্দুকের চাবিটা দিয়ে যান।

তিনকড়ি : বেল্লিক, বদমায়েস্, বোম্বেটে।

কদর্য গালাগালি দিতে দিতে তিনকড়িবাবু পকেট হইতে চাবি বাহির করিয়া দিলেন এবং অন্যান্য ডিরেক্টরদের মতো পাশের একটা ঘরে লুকাইলেন।

চাবি পাইয়া মনুজ আর দেরি করিল না, ক্ষিপ্রহস্তে কাজ আরম্ভ করিয়া দিল। সিন্দুক খুলিয়া দেখিল, সম্মুখেই কয়েক তাড়া নোট রহিয়াছে। সে প্রত্যেকটি তাড়া মোটামুটি গণিয়া লইয়া নিজের ব্যাগে ভরিতে লাগিল। ভরা শেষ হইলে ব্যাগ বন্ধ করিয়া সে একবার চারিদিকে চাহিল; তাহার মুখে একটা কঠিন হাসি ফুটিয়া উঠিল। পকেট হইতে একটি চিঠি বাহির করিয়া সে টেবিলে ঘড়ির নীচে চাপা দিয়া রাখিল, তারপর ব্যাগ হাতে লইয়া বহিদ্বারের পানে চলিল। দ্বারের ছিটকিনি খুলিয়া, ভিতরের দিকে ফিরিয়া সে উচ্চকণ্ঠে বলিল,—

মনুজ : আপনারা এবার ফিরে আসতে পারেন, আমার কাজ হয়ে গেছে। ঘড়িটা একেবারে অহিংস, নিরামিষ ঘড়ি; ফাটবে না।

মনুজ উচ্চকণ্ঠে একবার হাসিয়া বাহির হইয়া গেল।

কিয়ৎকাল ঘর শূন্য। তারপর দরজাগুলির নিকট সন্ত্রস্ত মুণ্ড দেখা যাইতে লাগিল। ক্রমে সকলে সন্তর্পণে ঘরে পদার্পণ করিলেন। সন্দেহ, আশ্বাস, ক্রোধ, কি-জানি-কি ঘটিবে এমনি একটা স্নায়বিক শঙ্কা মিলিয়া তাহাদের বিচিত্র মনোভাব এবং আনুষঙ্গিক অঙ্গভঙ্গি বর্ণনা করা অসম্ভব।

তিনকড়ি : গেছে শালা, পাজি; নচ্ছার হারামজাদা!

ঝাপড়মল : চোট্টা ডাকু আওয়ারা!

রসময় : গুণ্ডা বর্গী বোমারু!

প্রাণহরি : সিন্দুক তো ফাঁক করে দিয়ে গেছে দেখছি।

আর একপ্রস্থ অকথ্য গালাগালি বর্ষণ হইল। সকলেই বিভিন্ন দিক হইতে টেবিলের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন।

রসময় : যাবার সময় কী বলে গেল ব্যাটা, ঘড়িটা নিরামিষ?

প্রাণহরি : ভুলকুনি দিয়ে টাকাগুলো নিয়ে গেল, বেইমান ব্যাটাচ্ছেলে?

তিনকড়ি : পুলিসে দেব, জেলে পাঠাব স্কাউন্ড্রেলকে! বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা, পীরের কাছে মামদোবাজী।

চতুর্ভুজ : থাম্বা থাম্বা তিনু শেঠ। চিল্লানেসে কী হোবে? পঞ্ছী তো উড়িয়ে গেল।

প্রাণহরি : হ্যাঁ, এখন কিল খেয়ে কিল চুরি ছাড়া উপায় নেই; এ কেলেঙ্কারি জানাজানি হয়ে গেলে বাজারে আর মুখ দেখানো যাবে না। পুলিস হয়তো শেষ পর্যন্ত চোরাই মাল কিতে গেছলাম বলে আমাদেরই ধরে টানাটানি করবে।

রসময় : ঘড়ির তলায় একটা কাগজ রয়েছে না?

প্রাণহরি : তাই তো মনে হচ্ছে। তিনকড়িবাবু, দেখুন না, হয়তো কিছু লিখে গেছে।

তিনকড়ি : আমি দেখব! বেশ লোক তো আপনি! আর ঘড়ি যদি ফাটে?

রসময় : না না ফাটবে না নিরামিষ ঘড়ি। ফাটবার হলে এতক্ষণ ফাটত না?

তিনকড়ি : বলা যায় না, শয়তান ব্যাটা হয়তো মতলব করেই ঘড়ির তলায় চিঠি রেখে গেছে। ঘড়িতে হাত দিলেই

প্রাণহরি : কিন্তু এ আপনার কর্তব্য; আপনি আমাদের চেয়ারম্যান। আপনি যদি না করেন তখন বাধ্য হয়ে পুলিস ডাকতে হবে—

রসময় : ঠিক কথা। সিন্নি দেখে এগিয়েছিলেন, এখন কোঁকা দেখে পেছুলে চলবে কেন?

ঝাপড়মল : ডর খাচ্ছেন কেনো, তিনকৌড়িবাবু।—হামরা ভি তো আছি। এগিয়ে যান—এগিয়ে যান—

হঠাৎ চড়বড়শব্দে ঘড়ির এলার্ম বাজিয়া উঠিল। সকলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দরজার দিকে ছুটিলেন। কিন্তু ঘড়ি ফাটিল না; কয়েক সেকেন্ড পরে এলার্ম থামিয়া গেল। সকলে আবার ফিরিলেন।

প্রাণহরি : দেখলেন তো, নেহাৎ মামুলি এলার্ম ঘড়ি; ব্যাটা দম দিয়ে রেখে গেছল। নিন, এগোন—কোনও ভয় নেই।

তিনকড়িবাবু সৃক্কণী লেহন করিলেন।

তিনকড়ি :–আচ্ছা—আমি দেখি—

অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে কয়েকবার হাত বাড়াইয়া এবং হাত টানিয়া লইয়া শেষে তিনকড়িবাবু চিঠিখানি ঘড়ির তলা হইতে উদ্ধার করিলেন। বাকি সকলে অলক্ষিতে পিছু হটিয়া প্রায় দেয়াল ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন; এখন আবার আসিয়া তিকড়িবাবুকে ঘিরিয়া ধরিলেন—

চতুর্ভুজ : কাগজ মে সুঁ আছে, তিনু ভাই, পোঢ়েন না।

তিনকড়িবাবু চিঠির ভাঁজ খুলিয়া কিছুক্ষণ তাহার দিকে তাকাইয়া রহিলেন, তারপর বিরাগপূর্ণ কণ্ঠে পড়িতে আরম্ভ করিলেন—

তিনকড়ি : সবিনয় নিবেদন—হুঁ!–

প্রথমেই আমার প্রকৃত পরিচয় আপনাদের জানাতে চাই। যে হতভাগ্য যুবকের নিকট হইতে দুই শত টাকা মূল্যে আপনারা কুচকাওয়াজের স্বত্ব কিনিয়া লইয়াছিলেন, আমি তাঁহারই ছোট ভাই। আমার দাদার প্রতিভার ফলে আজ আপনারা বড়মানুষ; আর তিনি অন্নাভাবে যক্ষ্মা রোগাক্রান্ত হইয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছেন।

আপনাদের এই রক্তমাখা টাকা আপনারা কিভাবে সদ্ব্যয় করেন তাহাও আমি জানি। তিনকড়িবাবু থিয়েটার দলের অভিনেতা অভিনেত্রীদের পিছনে অজস্র টাকা খরচ করেন—তার উপর রায় বাহাদুর হইবার চেষ্টায়

ঝাপড়মল : আরে ঠিক পাকড়া হ্যায়!

তিনকড়ি : (ক্রুদ্ধভাবে) হ্যাঁ, খরচ করি। আমার টাকা আমি খরচ করি, কার বাবার কী!

প্রাণহরি : হ্যাঁ হ্যাঁ—তারপর পড়ুন—

তিনকড়ি : প্রাণহরিবাবু নিজের স্ত্রীকে এখনও সন্দেহ করেন, তাই তাঁহাকে খুশি রাখিবার জন্য। মাসে এক হাজার টাকার গহনা ও বস্ত্রাদি কিনিয়া দেন।

সকলের হাস্য।

তিনকড়ি : শুনুন আরও আছে। চতুর্ভুজ মেহতা রেসের ঘোড়ার পিছনে বৎসরে বিশ-পঁচিশ। হাজার টাকা ব্যয় করেন। ঝাপড়মল কাপড়িয়া অকালে শক্তিহীন হইয়া এখন হজমি গুলি ও হকিমি দাওয়াইয়ের জন্য মাসিক দুই হাজার টাকা খরচ করিয়া থাকেন। রসময় বসাক হুইদী উপপত্নীকে বারো শত টাকা বেতন দেন—

রসময় : মিথ্যে কথা—মিথ্যে কথা

ঝাপড়মল : বিকুল ঝুট—

তিনকড়ি : যে টাকা আমি আজ লইয়াছি, আপনাদের পক্ষে তাহা কিছুই নয়। কিন্তু শুনিয়া সুখী হইবেন, এই টাকা সকার্যে খরচ হইবে। আমি সত্যই একজন বৈজ্ঞানিক; এমন কোনও বিষয় লইয়া গবেষণা করিতেছি যাহাতে টাকার প্রয়োজন। আপনাদের নিকট বা আপনাদের মতো অন্য। কোনও ধনিকের নিকট হাত পাতিলে আপনার টাকা দিতেন না। তাই এই উপায় অবলম্বন করিতে হইয়াছে।

এ টাকা আর ফেরত পাইবেন না; পরিবর্তে এই ঘড়িটি আপনাদের দান করিলাম। ওটি স্মরণ। চিহ্নস্বরূপ রক্ষা করিবেন, হয়তো মাঝে মাঝে সত্ত্বার্যে টাকা খরচ করিবার ইচ্ছা জন্মিতে পারে। ইতি

চিঠি পড়া শেষ হইলে তিনকড়িবাবু দাঁত কড়মড় করিতে করিতে কাগজখানা দুহাতে ছিঁড়িয়া ফেলিলেন।

তিনকড়ি : শালা! হারামজাদা! আমাদের ঘড়ি দান করেছেন!

ক্রোধান্ধ তিনকড়িবাবু ঘড়িটা তুলিয়া লইয়া মেঝেয় আছাড় মারিবার উপক্রম করিলেন। সকলে সত্রাসে হাঁ হাঁ করিয়া তাঁহাকে ধরিয়া ফেলিলেন।

রসময় : করেন কি? মাথা খারাপ হয়েছে না কি?

তিনকড়ি : (থতমত) কেন—কি হয়েছে?

রসময় : বলা তো যায় না, যদি ওর মধ্যে বোমা-টোমা কিছু থাকেই,—আছাড় মেরে শেষে পেল্লয় ঘটাবেন

তিনকড়ি সভয়ে ঘড়িটি টেবিলের উপর রাখিয়া দিলেন।

প্রাণহরি : এখন কথা হচ্ছে এ ঘড়ি নিয়ে কি করা যায়! হতে পারে নিতান্ত সহজ ঘড়ি, আবার নাও হতে পারে। এখানে রেখে গেলেও বিপদ; রাত্রে যদি ফাটে লঙ্কাকাণ্ড হবে—অফিস বাড়ি কিছুই থাকবে না—

রসময় : জানালা গলিয়ে রাস্তায় ফেলে দিলে হয় না?

প্রাণহরি : হুঁ, রাস্তায় ফাটুক আর আমরা বাড়িসুদ্ধ হুড়মুড় করে রসাতলে যাই! আচ্ছা এক ফ্যাচাং লাগিয়ে রেখে গেলে, হতভাগা শয়তান; টাকাকে টাকা গেল তার ওপর আবার—

সকলেই বিষমভাবে চুপ করিয়া রহিলেন। শেষে তিনকড়িবাবু মুখ হাসি হাসি করিয়া বলিলেন—

তিনকড়ি : দেখুন, আপনারা মিছে ভয় পাচ্ছেন। ঘড়িটা যে একেবারে গান্ধীমাকা তাতে সহে নেই। তা আমি বলি কী, আপনারা কেউ ওটা বাড়ি নিয়ে যান না—

রসময় : (রুক্ষস্বরে) আপনি নিয়ে যান না! আপনি তো নাটের গুরু, নিতে হলে আপনারই নেওয়া উচিত।

তিনকড়ি : না না, আপনাদের বঞ্চিত করে আমার নেওয়া উচিত নয়। প্রাণহরিবাবু আপনি? প্রাণহরি : বাজে কথা রেখে দিন। আমি বাড়ি চললাম। তিনকড়ি : ঝাপড়মলজী? চতুর্ভুজভাই? দেখিয়ে, ফোকটমে মিলতা হ্যায়।

উভয়ে দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়িলেন।

ঝাপড়মল : হামলোক ভি ঘর চলা। বহুত রাত হুয়া, রাম রাম। এই সময় বহিদ্বারে টোকা পড়িল। চরণদাস দরজা ঈষৎ খুলিয়া মুণ্ড বাড়াইল।

তিনকড়ি : কে—চরণদাস! কি চাও?

চরণদাস সঙ্কুচিতভাবে প্রবেশ করিল।

চরণদাস : আজ্ঞে কিছু নয়। সে-ভদ্রলোক অনেকক্ষণ হল চলে গেছেন, তাই ভাবলাম মিটিং শেষ হতে কত দেরি আছে।

তিনকড়িবাবু একবার ঘড়ির দিকে একবার চরণদাসের দিকে তাকাইলেন; মুহূর্তমধ্যে সমস্যার সমাধান হইয়া গেল। তিনি গম্ভীরকণ্ঠে কহিলেন—

তিনকড়ি : মিটিং শেষ হয়েছে। চরণদাস, এদিকে এস।

সঙ্কুচিত উৎকণ্ঠায় চরণদাস নিকটে আসিল।

তিনকড়ি; আজ মিটিংয়ে আমরা তোমার কর্মনিষ্ঠা এবং প্রভুভক্তি সম্বন্ধে রেজল্যুশন পাস করেছি। বোর্ড অফ ডিরেক্টর্স খুশি হয়ে তোমাকে এই ঘড়ি উপহার দিয়েছেন।

চরণদাস এই অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যে একেবারে দিশেহারা হইয়া গেল। গদগদ কৃতজ্ঞতায় সে অনেক কিছুই বলিতে চাহিল কিন্তু বেশী কিছু মুখ দিয়া বাহির হইল না।

চরণদাস : আজ্ঞে আপনাদের অনেক দয়া। আপনারা আমার

তিনকড়ি : (প্রসন্নকণ্ঠে) হয়েছে হয়েছে। এখন ঘড়ি নিয়ে বাড়ি যাও। এই যে ঘড়িনাও, তুলে নাও।

চরণদাস ঘড়ি তুলিয়া লইয়া বুকে চাপিয়া ধরিল।

চরণদাস : আমি—আমি আর কি বলব—আপনারা আমার অন্নদাতা–মা বাপ।

তিনকড়ি : হ্যাঁ হ্যাঁ, এবার বাড়ি যাও। কার অসুখ বলছিলে—যাও আর দেরি করো না।

চরণদাস আভূমি নত হইয়া কপালে দুহাত ঠেকাইয়া সকলকে প্রণাম করিল, তারপর কৃতজ্ঞতা বিগলিত মুখে ঘড়িটি বুকে ধরিয়া প্রস্থান করিল।

সকলে পরস্পর মুখের পানে চাহিলেন; সকলের মুখেই হাসি ফুটিয়া উঠিল।

১৪ বৈশাখ ১৩৫১

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত