ভবানীপুরের প্রসিদ্ধ মণিকারের একমাত্র মেয়ের সঙ্গে কলকাতার প্রসিদ্ধ কাঞ্চন ব্যবসায়ীর একমাত্র ছেলের বিয়ে। মণিকাঞ্চন সংযোগ।
জ্যোতিষী বলেন, রাজযোটক। এর ফলে যে সন্তান জন্মাবে সে হবে কুলপ্রদীপ।
কুলপ্রদীপ পৌত্রের আশায় কাঞ্চন ব্যবসায়ী হারাধনবাবু হর্ষান্বিত; তাঁর কুমিরের মতো মুখে হাসি এবং দাঁতের যেন অন্ত নেই।
মেয়েটির নাম ছবি। ভাল নামও আছে, কিন্তু সে-নামে দরকার নেই। ইয়মধিক মনোজ্ঞ। ছবি বেশী কথা কয় না, সব কথাতেই হাসে। এমন কি যখন চোখে জল তখনও হাসে। ষোলটি শরতের সোনালী কমল তার সর্বাঙ্গে। যেন একটি পাকা রসে-ফেটে-পড়া ডালিম।
ছেলের নাম ডোম্বল। পোশাকী নামও আছে—গজেন্দ্র। কোন নামটি বেশী উপযোগী বোঝা যায় না। তরমুজের মতো মুখের ওপর পাঁড় শসার মতো একটি নাক। গ্রীবা নেই। রঙীন পাঞ্জাবি পরা দেহটি ফানুসের মতো। মেদ-সুকোমল। ভয় হয় টুকি দিলেই ফেঁসে যাবে, আর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে একরাশ ধোঁয়া
ভোম্বল শীতকালেও গরম জামা পরে না—শুধু ঢিলে হাতার পাঞ্জাবি। বন্ধুরা বলে, ডোম্বল যোগী, তাই তার শীত করে না। শত্রুরা বলেভেম্বলেরও শত্রু আছে—হবে না কেন? ভগবান ওকে দেড় ইঞ্চি পুরু ওভারকোট পরিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন—ওর গরম জামার দরকার কি? শুনে ভোম্বল বোকার মতো হাসে, তার গলা থেকে নিতম্ব পর্যন্ত চর্বির ওভারকোট নেচে নেচে উঠতে থাকে।
বিয়ের রাত্রে শুভদৃষ্টির সময় চারিচক্ষের মিলন হল। ডোম্বল একগাল হাসে; মনে হয় যেন তরমুজে টাঁকি পড়ল। ভেতর থেকে লাল লাল শাঁস আর কালো কালো বিচি দেখা যায়।
ছবিও হেসে ফেলে, বরের চেহারা দেখে। তারপরই চোখ ছলছল করে ওঠে। কান্নাহাসি একসঙ্গে—রোদ আর বৃষ্টি।
যেন শ্যাল কুকুরের বিয়ে।
২.
এক বছর কেটে যায়। তারপর আরও ছমাস। ছবি শ্বশুর-ঘর করে। বদ্ধ করায় গন্ধক ধোঁয়া অ্যাসিড পটাশ মোনছাল। ঐশ্বর্য আছে, কিন্তু সুখ? যৌবনের সুখ? শতদলের মতো তার নবযৌবন মর্মের কোষ মেলে থাকে; পরাগ উড়ে যায়, রস ঝরে পড়ে। কিন্তু ভোমরা কৈ? তার বদলে কোলা ব্যাংড্যাডেবে চোখ, পেট মোটা কোলা ব্যাং। ছবি তবু হাসে—মেঘে ঘেরা তৃতীয়ার চন্দ্রকলার মতো, ফ্যাকাসে হাসি-তৃষ্ণাতুর।
কুলপ্রদীপের দেখা নেই; ডিস্টান্ট সিগনাল পর্যন্ত না।
হারাধনবাবু বিপত্নীক; বাড়ি দূরসম্পর্কীয়া কুটুম্বিনীতে ভরা। তারা হা হুতাশ করে—ছেলে হল, রাজ-ঐশ্বর্য ভোগ করবে কে?
হারাধনবাবুর মুখভরা দাঁত ধারালো এবং হিংস্র হয়ে ওঠে। ভোম্বল বোকটে হাসি হাসে, মেদ তরঙ্গিত দুলকি হাসি।
বৌ বাঁজা। নইলে কুলপ্রদীপ আসতে এত বিলম্ব হয় কেন?
ঘটা করে বধুর চিকিৎসা আরম্ভ হয়। প্রথমে কবিরাজী। কবিরাজ ওষুধের ব্যবস্থা করেন। এমন তেজালো ওষুধ যে ঘটিবাটিতে পড়লে ঘটিবাটির গর্ভসঞ্চার হয়। ছবি এই তেজালো ওষুধ খায়। বুক পেট মুখ জ্বলে যায়, তবু খেতে হয়। অন্নপ্রাশনের অন্ন উঠে আসে, তবু খেতে হয়। এই রকম ছমাস। ছবির চোখে জল মুখে হাসি। মনে জানে ওষুধ নিষ্প্রয়োজন, তবু ওষুধ খায়।
কিন্তু কুলপ্রদীপের দেখা নেই। ডিস্টান্ট সিগনাল পর্যন্ত না। কবিরাজী তেজালো ওষুধের নির্বীর্যতা প্রমাণ হয়ে যায়।
ডাক্তার আসেন—অ্যালোপাথ। ছবিকে পরীক্ষা করে বলেন–বন্ধ্যা নয়, তবে জরায়ুর দোষ। ও কিছু নয়। কুলপ্রদীপের আগমন আমি সুগম করে দিচ্ছি।
ইনজেকশন।
ছমাস ধরে ইনজেকশন চলতে থাকে। ছবির সারা গা ঝাঁজরা শতচ্ছিদ্র হয়ে যায়। বসতে পারে না—শুতে পারে না; সর্বাঙ্গে ব্যথা। আর মনে? সে কথা বলে আর লাভ কি? তবু সে হাসে। কিন্তু সে-হাসি নিংড়োলে ঝর ঝর করে রক্ত পড়ে। বুকের তাজা রক্ত।
এমনি করে বছর ঘুরে যায়।
চোখের কোলে কালি, ছবি ক্রমে শীর্ণ হতে থাকে। যেন গ্রীষ্মের ঝর্না, যেন তাপসী অপর্ণা। ক্রমে শয্যা আশ্রয় করে।
ছবির বাবা কৈলাসবাবু দেখতে আসেন। মেয়ে দেখে কেঁদে ফেলেন। মা-হারা মেয়ে, একটিমাত্র সন্তান। এই তার দশা!
ছবিকে তিনি বাড়ি নিয়ে যান। যাবার সময় হারাধনবাবু নোটিস দিয়ে দেন—আর এক বছর তিনি দেখবেন, তারপরই আবার ছেলের বিয়ে। কুলপ্রদীপ তাঁর চাই-ই।
তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে ভোম্বল ন্যাকা-ন্যাকা বোকা-বোকা হাসে। পাড়ায় এই নিয়ে আলোচনা হয়। বন্ধুরা বলে, ডোম্বল যোগী—জিতেন্দ্রিয়–। শত্রুরা যা বলে তা শোনা যায় না, কারণ শোনবার আগেই কানে আঙুল দিতে হয়।
৩.
ছবি বাপের বাড়ি এসে প্রাণখুলে হাসে। বাড়িতে বাপ ছাড়া আর কেউ নেই, কেবল ঝি চাকর। তবু এ বাড়িতে মন লাগে। এ বাড়িতে কুমির নেই, কোলা ব্যাং নেই; অনাগত কুলপ্রদীপের বিপুলায়তন কালো ছায়া নেই। ছবি আগেকার মতো বাড়িময় হেসে খেলে ছুটোছুটি করে বেড়াতে চায়। কিন্তু শরীর দুর্বল–পারে না।
কৈলাসের মনে হারাধনের বিদায়কালীন নোটিস জেগে ওঠে। তিনি ডাক্তার ডাকেন।
পাড়ায় একজন নবীন ডাক্তার এসেছেন। বিলিতি পাস—এম আর সি পি। বয়স বত্রিশ–ভিজিটও তাই। কৈলাস তাঁকেই ডাকেন। মেয়ের রোগের ইতিহাস বলেন। বলতে বলতে প্রায় কেঁদে ফেলেন।
ডাক্তার মন দিয়ে শোনেন, তারপর রোগিণীর ঘরে যান। সুন্দর চেহারা, bedside manners অতুলনীয়। ডাক্তার ছবিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করেন। কৈলাস ব্যাকুল নেত্রে চেয়ে থাকেন। ডাক্তার ছবিকে প্রশ্ন করেন। ছবি মুখ টিপে হাসে, তারপর চোখ বুজে উত্তর দেয়।
পরীক্ষা শেষ করে ডাক্তার উঠে দাঁড়ালেন। কৈলাসের মুখের দিকে চেয়ে বলতে চান—আপনার মেয়ের কোনও রোগ নেই, রোগ অন্যত্র। কিন্তু বলতে গিয়ে মুখে কথা বেধে যায়, করুণায় বুক ভরে ওঠে। একটু ভেবে বলেন—এক মাস সময় পেলে আমি চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু রোজ রোগিণীকে দেখা চাই।
ডাক্তার চেষ্টা করবেন এই আহ্লাদে কৈলাস কাঁদো কাঁদো হয়ে পড়েন।
পরদিন থেকে নিয়মিত ডাক্তারের যাতায়াত আরম্ভ হয়। ডাক্তারের আসার সময়ের ঠিক নেই। কোনও দিন সকালে, কোনও দিন বিকেলে, আবার কখনও বা দুপুরে। কৈলাস কখনও উপস্থিত থাকেন, কখনও থাকতে পারেন না। ডাক্তারের ওপর অগাধ বিশ্বাস—বিলিতি ডাক্তার!
ডাক্তারের নাম শৈলেন। অল্পদিনের মধ্যে খুব পসার করে ফেলেছে। নিশ্বাস ফেলবার সময় নেই। দুপুরবেলা যে ফুরসতটুকু পায় সেই সময়ে ছবিকে দেখতে আসে।
ছবির ঘরে গিয়ে শৈলেন জিগ্যেস করে—আজ কেমন আছো?
ছবি হাসে, ঘাড় বাঁকায়, মুখ টিপে বলে–ভাল আছি।
শৈলেন ছবির নাড়ি টিপতে বসে ধ্যানস্থ হয়ে পড়ে। পাঁচ মিনিট—দশ মিনিট—চোখ বুজে নাড়ি দেখে। ছবি ডাক্তারের মুখের দিকে আড়চোখে চেয়ে হাসে। তার বুকের মধ্যে একরাশ নিশ্বাস জমা হয়ে ওঠে, তারপর সশব্দে বেরিয়ে আসে।
শৈলেন চমকে উঠে বলে—ভয় নেই, শিগগির সেরে উঠবে।
ডাক্তারে রোগিণীতে চোখাচোখি হয়, তারপর দুজনেই চোখ ফিরিয়ে নেয়। দুজনেই জানে রোগ কী এবং কোথায়।
দু হপ্তা কেটে যায়।
ছবির গালে ডালিম ফুল আবার ফুটে ওঠে। পাতাঝরা লতার মতো শীর্ণ দেহ আবার নবপল্লবিত হয়। সারা দিন একলা বাড়িময় ঘুরে বেড়ায়। গুনগুন করে গান করে। সখি রে, কি পুছসি অনুভব মোয়।
ডাক্তার এলে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ডাক্তার জিগ্যেস করে—আজ কেমন আছো?
ছবি হাসে, ঘাড় বাঁকায়, বলে—সেরে গেছি। ও ওষুধ আর খাব না। বড্ড মিষ্টি, গলা কিটকিট করে—
ডাক্তার ছবির হাত ধরে জানলার কাছে নিয়ে যায়; চোখের পাতা টেনে শরীরে রক্তের পরিমাণ নর্ণয় করে। বলে—আচ্ছা, অন্য ওষুধ দেব। টক-টক, মিষ্টি মিষ্টি, খুব ভাল লাগবে।
তারপর একথা সেকথা হয়। ছবি হাসে, সহজ ভাবে গল্প করে। শৈলেনের বুকে ছবির হাসি ল্যানসেটের মতো বিঁধতে থাকে।
কৈলাসের সঙ্গে ডাক্তারের দেখা হলে কৈলাস জিগ্যেস করেন—এমন কেমন দেখছেন?
শৈলেন বলে—ভাল।
কৈলাস নিজের চোখেই তা দেখতে পান; গলদশ্রু হয়ে পড়েন। বলেন—সে রোগটা সারবে তো?
শৈলেন বলে–আশা করি।
আরও এক হপ্তা কাটে। ডাক্তার নিয়মিত আসে, একদিনও কামাই যায় না! ছবির রূপ হয়েছে। আগের মতো—একটি পাকা রসে-ফেটে-পড়া ডালিম।
শৈলেন প্রায়ই স্টেথস্কোপ আনতে ভুলে যায়। বাধ্য হয়ে, ছবিকে বিছানায় শুইয়ে তার বুকে মাথা রেখে, হৃদযন্ত্রের অবস্থা নিরূপণ করতে হয়। হৃদ্যন্ত্রের মধ্যে তোলপাড় শব্দ শুনে ডাক্তারের ললাট চিন্তাক্রান্ত হয়। জিগ্যেস করে–বুক ধড়ফড় করছে? ছবি উত্তর দেয় না, চোখ বুজে শুয়ে থাকে। একটু হাসে।
প্রায় রোজ এই রকম হয়।
কোনও কোনও দিন অজ্ঞাতে ছবির একখানা হাত ডাক্তারের মাথার ওপর পড়ে, চুলের ভেতর আঙুলগুলো অজ্ঞাতে খেলা করে, আবার অজ্ঞাতে সরে যায়। ডাক্তার রোগিণীর বুকের মধ্যে দুমদুম শব্দ শুনতে পায়—যেন দুন্দুভি বাজছে। দশ মিনিটের কমে বুকের ওপর থেকে মাথা তুলতে পারে না।
বেশী কথা হয় না। কথার দরকার হয় না, চারটে চোখ যেখানে এত বাচাল, সেখানে রসনা নীরব হয়েই থাকে।
ডাক্তার বলে—যখন একেবারে সেরে যাবে, আমি আর আসব না–তখন কি করবে?
ছবি হাসে, বলে–শ্বশুরবাড়ি যাব। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ে।
৪.
এক মাস ফুরিয়ে আসে—আর চার দিন বাকি।
ডোম্বল শ্বশুরবাড়ি আসে। ছবির চেহারা দেখে তার সারা গায়ে আহ্লাদের ভূমিকম্প জেগে ওঠে—আলিপুরের সাইসমোগ্রাফে সে কম্পন ধরা পড়ে।
ছবিও হেসে লুটিয়ে পড়ে। তার মনে উদয় হয় দুটো চিত্র—তার স্বামীর আর শৈলেন ডাক্তারের–পাশাপাশি।
ভোম্বল বলে বাবা বললেন তাই নিতে এসেছি। হে হে—
ছবি বলে—আজ নয়, পরশু এসে নিয়ে যেও।
ভোম্বল ফিরে যায়। যাবার সময় ছবির দিকে তাকিয়ে কোল টেনে হাসে-হে হে—
দুপুরবেলা ডাক্তার আসে।
ছবি বলে—পরশু শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি।
তার মুখে বাণবিদ্ধ হাসি-crucified.
ডাক্তারের আত্মসংযম হারিয়ে যায়। বলে—ছবি!
দুপুরবেলার অলস বাতাসে ঘরের দরজা আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যায়। দরজায় ইয়ে লক্ লাগানো, কড়াত করে শব্দ হয়–
দুপুরবেলার অলস বাতাস প্রকৃতির কোন্ ইঙ্গিত বহন করে বেড়ায়?
৫.
ছবি শ্বশুরবাড়ি যায়। টকটকে লাল রেশমী শাড়ি পরা—যেন বিয়ের কনে। অনাস্বাদিত মধু—অনাবিদ্ধ রত্ন।
গাড়ি বারান্দায় মোটর দাঁড়িয়ে তার মধ্যে ভোম্বল। গাড়ির একদিকের স্প্রিং একেবারে দমে গেছে।
কৈলাস আর ডাক্তার শৈলেন পাশাপাশি দরকার কাছে দাঁড়িয়ে। কৈলাসের চোখ ছলছল; শৈলেনের মুখ পাথরে কোঁদা–নিশ্চল।
ছবি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে মোটরে গিয়ে ওঠে। তারপর বাড়ির দিকে ফিরে তাকায়। হয়তো বাপের দিকেই তাকায়। তার মুখে বাণবিদ্ধ হাসি-crucified.
মোটর চলে যায়।
৬.
তিন মাস কাটে।
হারাধনবাবুর মুখ-গহ্বরের অন্ধকার বারম্বার দংষ্ট্ৰাময়ূখে খণ্ড বিখণ্ড হতে থাকে। ডোম্বল মেদতরঙ্গিত দুকি হাসি হাসে।
কুলপ্রদীপের ডিস্টান্ট সিগনাল পড়েছে। বন্ধুরা আর কিছু বলে না, কেবল ডোম্বলকে অনুরোধ করে—খাওয়াও! শত্রুরা যা বলে তা শোনা যায় না, কারণ শোনবার আগেই কানে আঙুল দিতে হয়।
৭ অগ্রহায়ণ ১৩৩৮