সৌন্দর্য

সৌন্দর্য

ওসি খালাম্মার কথা হঠাৎ কদিন ধরে খুব মনে পরছে। খালাম্মাকে ওসি খালাম্মা বলতাম কারণ উনার স্বামী ছিলেন শহরের ওসি। খালাম্মাকে দেখলেই আমার মনে হতো মোনালিসা বুঝি ছবি থেকে নেমে এসেছে। আসলে এই মোনালিসার সাথে মিলটা অনেক পরে পেয়েছি। কিন্তু ছোটবেলা থেকে উনার পানখাওয়া লাল ঠোঁটের প্রাণবস্ত হাসি। টান করে বাঁধা চুল, বড়সর কপাল, মায়াবী চোখ, শ্যামলা বরণ দোহারা গড়নের হাসিখুশি মানুষটিকে আমার ভারী ভালোলাগত। কাছে ডেকে অনেক আদরে কথা বলতেন।

এক সময় তারা শহর ছেড়ে চলে যান। অনেক পরে আবার যোগাযোগ হয়। এবং তখন খালাম্মা জানান তিনি আমাদের আত্মীয়। আমার সেজ খালার স্বামীর বাড়ির দিক থেকে সম্পর্ক। মা বাবার সাথে বেয়াই সম্পর্ক নতুন ভাবে স্থাপিত হয়। আগের চেনাজানার সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হয়। ইতমধ্যে আরো অনেক শহর ঘুরে জেলা শহরে খালু নিজেদের বাড়ি করেন। যাওয়া আসা ঘনঘন হয়। উনাদের মেয়ে জেসমিন আপা পেয়ারা পারতে গিয়ে গাছ থেকে পরে গিয়েছিলেন যখন ছোটটি ছিলেন আমাদের শহরে। উনার একটা হাত ভেঙ্গে যায়। সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা হয় হাতে। কিন্তু কোন করণে ক্ষতটি ঠিক হয় না। হাতে সমস্যা দেখা দেয় এবং এক সময় হাতটি কেটে ফেলতে হয় কনুইর উপর থেকে বাচ্চা মেয়েটিকে বাঁচাতে।

হাসি খুশি একটি পরিবারে একটা দুঃখ ঢুকে যায়। খালাম্মা বিশেষ ডিজাইনে একপাশে ঝালরের মতন হাতাওয়ালা ফ্রক বানিয়ে পরাতেন জেসমিন আপাকে। যাতে ঝালরের নিচে যে একটি হাত নাই তা বোঝা যায় না। আমার মনে আছে খুব ছোটবেলা যখন কোন বাড়িতে অনুষ্ঠানে যেতাম। খালাম্মা জেসমিন আপাকে নিয়ে আসতেন। অনেক মহিলা ঝালর তুলে জেসমিন আপার নাই হয়ে যাওয়া হাতের অংশটি দেখতেন এবং আহা উহু মার্কা শব্দ করতেন। হাত নেই সে টা জেনেও ওই জায়গাটা দেখ, তারা কি সুখ বা দুঃখ পেতেন। আমি এখনও বুঝতে পারি না।

তাদের এই দুঃখবোধ একটি বাচ্চা মেয়ে বা তার মাকে কতটা মানসিক আঘাত করত সে বিবেচনা সেই সময় মানুষের ছিল বলে আমার মনে হয় না। একটা মেয়ের হাত ভেঙ্গে গেছে সবাই জানে সে জায়গাটা দেখে আহা উহু এবং নানা রকম বক্তব্য দিয়ে তারা তো কোন উপকার করতে পারতেন না। কিন্তু সেটা মানুষের স্বভাব। মনে কষ্ট দেয়ার বিষয়টা মানুষের মনেও আসে না। জেসমিন আপাকে পরে আবার দেখেছি। তখন তিনি বি এ পাশ করেছেন। ঘরের এমন কোন কাজ নাই যা তিনি এক হাতে করতে পারেন না। একজন দুই হাতওয়ালা মানুষ যত কাজ করতে পারে তার চেয়ে বেশি কাজ এক হাতেই তিনি রীতিমতন সামলে নিচ্ছেন। জেসমিন আপা দারুণ দেখতে একজন স্বামীর সাথে সংসার করছেন। ছেলে মেয়ে নিয়ে ভালো আছেন। শুনেছি তিনি এখন আমেরিকায় আছেন।

কিছুদিন ধরে একটা ভিডিও খুব শেয়ার হচ্ছে। দুইফুট উচ্চতার একজন মানুষ বিয়ে করছে। তার বিয়েতে মহা ধুমধাম হচ্ছে। অনেক দেশের গন্যমান্য লোকজন এসেছেন তার বিয়েতে। শুধু ভিডিও শেয়ার নয় পত্রিকাওলারাও লুফে নিয়ে প্রতিবেদন ছাপছেন বিষয়টির উপর। কিন্তু এই দুইফুট উচ্চতার মানুষটি শারীরিক ভাবে বেড়ে উঠতে পারেননি কিন্তু তার মস্তিস্কে যে মেধা আছে যা ব্যবহার করে নিজেকে ভালো একটা অবস্থানে সে নিয়ে যেতে পেরেছে স্বনির্ভর একজন মানুষ হয়ে উঠেছে। যা অনেক সুস্থ সবল মানুষ করতে পারেন না। অনেকদিন পর মহিলাদের ঝালর সরিয়ে জেসমিন আপার কাটা হাত দেখার মানসিকতা চোখে দারুণ উৎকট ভাবে ভেসে উঠল।

আর মনে পরল। নিক নামে যে লোকটি হাত এবং দুটো পা ছাড়া জন্ম নিয়েছে। পায়ের জায়গায় ছোট দুটো লেজের মতন আছে তার । কিন্তু সে এই শারীরিক বৈশিষ্ট নিয়ে থেমে থাকেনি। এমন কোন কাজ নেই নিক যা করতে পারে না। সুখে সংসার করছে। বাচ্চা আছে। নিক নিজেকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেছে আজ সুস্থ সবল লোকজন ঘন্টার পর ঘন্টা নিরব হয়ে বসে, নিকের মটিভেশন বক্তব্যগুলো শোনে। হাত পা শারীরিক উচ্চতা নিয়ে অনেকে তেমন ভাবে ভাবতেও পারে না, নিক যা ভাবে এবং করতে পারে।

নিজেকে উৎকৃষ্ট ভেবে মানুষ অন্যের খুঁত ধরা দোষ ধরা নিয়ে ব্যাস্ত এ ভাবনা থেকে বিরত হয়ে সব মানুষকে তার নিজস্বধারায় বিবেচনা করলে বেশ হয়। ভাবনার উৎস সুন্দর থেকে। সে সুন্দরের বিভক্তি ঠিক কি ভাবে করতে হয় কোথায় এবং কেন, সে মাত্রা এখনও ঠিক হয়নি অনেকের মনে। গড়পরতা দেখায় ব্যাস্ত বেশির ভাগ মানুষ । সৌন্দর্য বাইরে থাকে না ভিতরে জ্বলজ্বল করে ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত