“মেয়েরা হলো টিস্যু পেপারের মতো ” বুঝলি দোস্ত। কথাটা বলে হাসতে হাসতে মাথা ঘুরিয়ে রিহান দেখলো পিছনে ইরা দাড়িয়ে আছে। রক্তবর্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। “ছি রিহান, এতোটা নোংরা তোমার মানসিকতা।” “তুমি এখানে কেন এসেছো?” “এসেছিলাম একটা খুশির খবর জানাতে। কিন্তু এসে তোমার যে নতুন রুপ আর মানসিকতা দেখলাম তারপর আমার আর কিছু বলার নেই।” “কি খবর জানাবি তুই হুহ্? বিয়ে বিয়ে ছাড়া আর কিছু আছে তোর মাথায়। তুই কি করে ভাবলি তোর মতো মেয়েকে এই রিহান বিয়ে করবে?”
“বাহ রিহান তোমার এই নতুন রুপ দেখে সত্যিই আমি শিহরিত হচ্ছি! এই আমার সেই চেনা রিহান?” “একদম নেকা সাজবি না বলে দিলাম। তুই কি মনে করেছিস আরেকটা ছেলে যে মেয়েকে ছেড়ে চলে গেছে সেই মেয়েকে আমি মেনে নিব! তুই যতই সাধু সাজিস না কেন আমি জানি ওই ছেলেটা ঠিকই ওর কাজ হাসিল করে তোকে ফেলে গেছে। আর তুই আমার সাথে সাধুগিরি দেখিয়ে ভেবেছিস আমি তোর মত ইউসড মেয়েকে বিয়ে করবো?” “মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ রিহান। তুমি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছো।” “বাড়াবাড়ির দেখলি কি? দেখবি তো এখন আয় দেখি তুই কিরকম সতি মেয়ে।” – বলে রিহান ইরার হাত ধরে ফেললো। ইরা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে রিহানের দিকে। এতোটা নিচে নামতে পারে রিহান সে কল্পনাই করতে পারছে না।
রিহান তার বন্ধুদের সামনেই ইরার সাথে অসভ্য আচরণ শুরু করলো। রিহানের বন্ধুরা কোনো প্রতিবাদ না করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা নিচ্ছিলো। রিহান ইরার যতই কাছাকাছি আসছিল ততই ঘৃণায় ইরার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। নিজের মনকে শক্ত করে ইরা ঠাস করর একটা চড় বসিয়ে দিল রিহানের গালে। এতে রিহান আরও ক্ষেপে গেলো। হিংস্র জানোয়ারের মতো তাকিয়ে আছে সে ইরার দিকে। ভীষন ভয় পেয়ে গেলো ইরা। কি করবে এখন সে। ইরার হাতে একটা টিফিন বক্স ছিল। নিজে রান্না করে খাবার নিয়ে এসেছিলো রিহান এর জন্য। ইচ্ছে ছিল খুশির খবর টা বলে নিজের হাতে খায়িয়ে দিবে রিহানকে। কিন্তু এতো তারাতাড়ি সবকিছু পাল্টে যাবে বুঝে নি। ওই বক্স দিয়েই রিহানকে আঘাত করে সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে এলো ইরা।
রিহান এর সাথে ইরার সম্পর্ক প্রায় ২ বছর হতে চলেছে। অনেক কেয়ারিং ছেলে ছিল রিহান। সারাক্ষণ ইরাকে হাসি-খুশিতে মাতিয়ে রাখতো। রিহান যখন প্রথম ইরাকে প্রপোজ করে তখন ইরা আরেকটা সম্পর্কে জড়িত ছিল। ছেলেটা পরে আরেকটা মেয়ের জন্য ইরাকে ছেড়ে দেয়। তখন অনেক কষ্ট, হতাশার মধ্যে ছিল ইরা। ঠিক তখনই রিহান তার জীবনে আসে। ইরাকে সামলে তার অতীত থেকে বের করে আনে। কয়েকমাস সবকিছু অনেক ভালোই চলছিলো কিন্তু এর পর দেখা দিতে লাগলো সমস্যা। রিহানের আচরণে ফুটে উঠতে শুরু হলো পরিবর্তন। ইরার আগের সম্পর্ক নিয়ে রিহানের সন্দেহ কাজ করতো সবসময়। ইরা অনেক বুঝিয়েও ভুল ভাঙাতে পারে নি রিহানের। কিন্তু যাই হোক কিছুক্ষণ পর রিহান আবার সরি বলে সবকিছু ঠিক করে নিতো। তারপর ইরা তার বন্ধুদের মাধ্যমে জানতে পারে রিহান আরও অনেক মেয়ের সাথে কথা বলে।এ নিয়ে রিহানের সাথে অনেক জগড়া হয় ইরার।শেষ পর্যন্ত রিহান নিজের ভুল শিকার করে আর এমন করবে না বলে ইরাকে।
ইরাও ওকে ক্ষমা করে দেয়। তারপর কিছুদিন ওদের ভালোই কাটে।এক পর্যায়ে রিহান ইরার সাথে শারিরীক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য জোর করতে শুরু করলো। কিন্তু ইরা মানলো না। ইরা বিয়ের কথা বললো। ঘর থেকেও বিয়ের জন্য চাপ আসছিলো ইরার। অনেক ভালো জায়গায় ইরার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। ছেলে ভালো চাকরি করে।কিন্তু ইরা রাজি হলো না।ইরা ওর ঘরে রিহানের কথা বললো। সে ভাবলো বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে।একমাত্র মেয়ের ইচ্ছে ইরার বাবাও ফেলতে পারলেন না। রিহানকে বাসায় নিয়ে আসতে বললেন। এই খুশিতেই ইরা রিহানের জন্য রান্না করে খুশির খবরটা দিতে রিহানের আড্ডার জায়গায় এসেছিল। তারপর রিহানের যে রুপ দেখলো তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না সে।
বাসায় এসে দরজা বন্ধ করে কাঁদছে ইরা। ওর সাথে কেন এমন হচ্ছে। ও তো কারো ক্ষতি করে নি কখনও, কাউকে ঠকায়ও নি। তাও ওর সাথে খারাপ হচ্ছে কেন। ভালবাসা নামক শব্দটার উপর থেকেই বিশ্বাস উঠে গেল ইরার। বাবার পছন্দ করা ছেলেকেই বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলো। আজ ইরার বিয়ে। এতে ইরার কোনো উৎসাহ নেই। নেহাত বিয়ে করতে হবে নয়তো সমাজের ১০ জনের ১০ কথার সামনাসামনি হতে হবে তাকে আর তার পরিবারকে। তাই বিয়ের জন্য রাজি হয়েছিল সে।
বাসর ঘরে বসে আছে ইরা। বরের মুখ এখনো দেখেনি সে। দেখার ইচ্ছেও নেই। এটাই ভেবে যাচ্ছে যে ছেলেটা এসে স্বামীত্ব খাটানোর জন্য জোর করবে কিনা না। “কেমন আছেন ইরা?” ইরার পাশে বসতে বসতে ওর বর জিজ্ঞেস করলো। “ভালো ” বরের দিকে না তাকিয়েই বললো ইরা। “আপনার কি আমাকে মেনে নিতে সমস্যা হচ্ছে? ” ইরা কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলো।
ছেলেটা ইরার হাতে হাত রাখতেই ইরা হাত সরিয়ে নিল। ছেলেটি বুঝতে পারলো ইরা চাইছে না সে তাকে স্পর্শ করুক। আর ইরার ব্যাপারে অনেকটা শুনেছে সে মেয়েটাকে একটু সময় দেওয়া উচিত। এই ভেবে বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বললো – “আচ্ছা অনেক রাত হয়েছে শুয়ে পরুন। আমি বুঝতে পারছি আমি আপনার কাছে অপরিচিত তাই হয়তো আপনার ইজি হতে সময় লাগবে। এ ছাড়া অন্য কোনো কারণও থাকতে পারে এর পিছনে। আমি আপনাকে বলার জন্য জোর করবো না। আপনার যদি ইচ্ছে হয় বইলেন। শুভ রাত্রি। “- এই বলে ছেলেটি সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। ইরা ভারি অবাক হলো ছেলেটির ব্যবহার দেখে।
ইরার বরের নাম আকাশ। আজ ২/৩ দিন হয়ে গেলো ইরা আকাশের সাথে ঠিকমতো কথাই বলে নি। কিন্তু ছেলেটা কতো সুন্দর সামলে নিচ্ছে সবকিছু। বাইরে এমন ভাবে ইরার সাথে কথা বলছে যেমন কতো ভালো সম্পর্ক ওদের। ইরাকেও জোর করছে না কোনোকিছুর জন্য। তাও ইরার এসবে কোনো মাথাব্যথা নেই। সবকিছুই দেখানো মনে হচ্ছে ইরার। ২ দিন পর এরকম ব্যবহার আর থাকবে না।
৫ দিন পর আকাশ এসে ইরার পাশে বসলো। ইরা অসস্তি নিয়ে উঠে যেতে চাইলে সে ইরার হাত ধরে ফেললো।
” ইরা বসো আমি শুধু কিছু কথা বলতে চাই” “বলেন” “ইরা আমি তোমার সম্পর্কে সব জানি। কেন তুমি এরকম করছো তাও বুঝতে পারছি। আমি ভেবেছিলাম নিজে থেকে তুমি বলবে কিন্তু বললে না। তাই আমার মনে হলো আমার তোমার সাথে কথা বলা প্রয়োজন। দেখ ইরা ওই ছেলেটা কি যেন নাম রিহান। ওর মতো আমার ধারণা না। ইরা আমি এমন অনেক পরিবার দেখেছি যেখানে ভালো, রুচিশীল মেয়ে বেছে ছেলে বিয়ে করিয়েও সংসার টিকিয়ে রাখতে পারে নি। আবার এমনও দেখেছি একটা ডিভোর্সি মেয়ে অন্য সংসারে গিয়ে সকল অপমান সহ্য করেও একটা পরিবার টিকিয়ে রেখেছে সুন্দরভাবে।
মেয়েরা কখনোই টিস্যু পেপারের মতো হতে পারে না ইরা। নারী হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার এক অমূল্য সৃষ্টি। একজন নারী যা পারে তা কখনো পুরুষ করতে পারে না। তাদের শুধু আমরা বুঝতে পারি না, সঠিক মূল্য দেই না বলেই তারা নিজেদের সম্পুর্ন রুপে প্রকাশ করতে পারে না। আমরা বেশিরভাগ পুরুষরা নারীদের মন দিয়ে বিচার না করে চাহিদা দিয়ে বিচার করি বলেই আজ আমাদের সমাজের এতো অবনতি। আমি বিশ্বাস করি ইরা তোমার মন অনেক সুন্দর। তুমিই পারবে আমার জীবন আর সংসার ভালবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিতে। আমি এর অপেক্ষায় থাকবো।” কথাগুলো শুনে চোখে জল চলে এলো ইরার।
৫ বছর পর, আকাশ ইরার আজ ৫ম বিবাহ বার্ষিকী। ওদের মাঝে আছে এখন ইরার মতোই মিষ্টি ছোট্ট একটি মেয়ে। সুখে, ভালবাসায় ভরা তাদের সংসার। পৃথিবীতে কেউ এতোটা সুখি হতে পারে বলে আকাশের ধারণা নেই। সত্যিই আমরা সব ছেলেরা যদি এভাবে ইরাদের ভরসা হয়ে দাড়াতে পারতাম তাহলে হয়তো প্রতিটি সংসার এভাবে সুখে ভরে উঠতো। এসব ভাবতে ভাবতেই তাদের মেয়েকে এক হাতে কোলে নিয়ে আরেক হাতে ইরাকে জড়িয়ে ধরলো আকাশ।