আমাদের পরিবার

আমাদের পরিবার

‘তোমার চোখ এতো খারাপ কেন?’ ‘চোখ আবার কি করল? কোন মেয়ে-মহিলার দিকে তো তাকাইনি। সোজা গিয়েছি সোজা ফিরে এসেছি কারো দিকে তাকাইনি। ও, একজনের দিকে তাকিয়েছি, ফিরোজা আন্টি। বাজার ভর্তি ব্যাগ হাতে দেখেও মহিলা সেই যে কথা বলতে শুরু করেছে, ‘বাবা কেমন আছো, আব্বা-আম্মার শরীর কেমন, তোমার বউ টার কি খবর’ কথা শেষ আর হয় না।’

‘আমি তোমার ফিরোজা আন্টির কথা বলিনাই। কি সব কিনে আনছ এইগুলা?’ ‘কেন কি হইছে?’ ‘সবই তো পচা। আলু পচা, বেগুন পচা, পোটল পচা, শাকগুলো পর্যন্ত পচা।’ শিউলির চেচামেচি শুনে আম্মা এসে রান্নাঘরে ঢুকে জিজ্ঞাস করল— ‘কি হইছে বৌমা?’ ‘মা দেখেন না, আপনার ছেলে কি সব বাজার করে নিয়া আসছে।’ আম্মা গভীরভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, ‘তোর বাবার কোন গুণ থাকুক আর নাই থাকুক, বাজার টা সে খুব ভাল করে, তোর সেটাও নাইরে! মানুষ একটু দেখে-শুনে বাজার করে না? এতো বড় হইছিস এখনও বাজার করতে শিখলিনা?’

মেজাজটা খুবই খারাপ হয়ে গেল, প্রথমত আবুল ভায়ের উপর। তাকে নিয়েই বাজারে গিয়েছিলাম। তিনি বেছে বেছে সব পচা সবজি পাল্লায় তুলেছে। নিশ্চয়ই তার কাছ থেকে ধার নেওয়া ১০০টাকা ফেরৎ দেইনি বলে শোধ তুললেন। দ্বিতীয়ত নিজের উপর, কেন আবুল ভাইকে বিশ্বাস করলাম? একবারও সবজির দিকে তাকালাম না? আবুল ভাইকে ছাড়ছি না।

কয়েকদিন থেকে ছোট মামার সাথে ঠিকমত কথা হচ্ছে না। সকালে যখন অফিসে যাই, তখন তিনি নাক ডেকে ঘুমান, রাতে যখন বাসায় ফিরি তখন তিনি বাসায় থাকেন না। খাবার টেবিলে একবার মাত্র সামনা-সামনি দেখা হয়, কথা-বার্তা তেমন কিছুই হয় না। ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে দ্রুত উঠতে হবে নইলে ট্রেন মিস যাবে এমন তাড়াহুড়ো করর খাওয়া শেষ করে আবারও বাইরে চলে যান। মামার গতিবিধি বোঝা দুর্বোধ্য ব্যাপার, কখন কি করে বসেন ঠিক নাই।

‘শিউলি ছোট মামা কোথায়?’ ‘ঘরে বোধহয়।’  ‘বাসায় কি করে সারাদিন? তাকে তো দেখাই যায় না। কোন সমস্যা হয়েছে নাকি?’ ‘তাতো জানি না, তবে কিছু নিয়ে বোধহয় ভীষণ চিন্তার মধ্যে আছেন।’ ‘কি করে বুঝলে?’ ‘সারাদিন বাইরে যান আর আসেন। বাসায় যতক্ষণ থাকে দরজা বন্ধ করে রাখেন। গতকাল কি হলো জানো?’ ‘কি হলো?’ ‘আমি চা নিয়ে গিয়ে মামার ঘরের দরজা ধাক্কালাম, বললাম— মামা, চা বানিয়ে আনছি। দরজাটা খুলুন। মামা কি বলল জানো?’ ‘কি বলল?’ শিউলি বাচ্চাদের মত হাসতে হাসতে বলল, ‘মামা বলল কি, আপা এখন চা খাবো না।’ ‘ও এই কথা?’ শিউলি অভিমান মিশ্রিত গলায় বলল, ‘মনে হচ্ছে ব্যাপারটা তোমার আগে থেকেই জানা ছিলো?’

শিউলির কন্ঠস্বর অতি মধুর। সে যখন কথা বলে মনে হয় আমার ঠিক সামনে কেউ একজন খালি গলায় রবীন্দ্র সংগীত গাইছে। রবীন্দ্র সংগীত কেবল তাঁর গলাতে মানায়। পৃথিবীর আর কেউ তার মতন মধুর সুরে রবীন্দ্র সংগীত গাইতে পারে না। তবে মাঝে মধ্যে রাগ সংগীতও শোনার প্রয়োজন আছে, নইলে উভয়ের পার্থক্য বোঝা যাবে না। শিউলিকে রাগানোর জন্য বললাম— ‘তোমার গলা শুনে তো মাঝে মধ্যে আমিই কনফিউজড হয়ে যাই- কে কথা বলছে? আম্মা নাকি তুমি।’ শিউলি দাঁত কিড়মিড় করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কি বললা?’ আমি সাথে সাথেই বললাম- ‘না মানে তোমার কন্ঠস্বর তো ৫৫+ বয়সের বৃদ্ধাদের মতন। সেটাই বললাম—আমিই যেহেতু প্রতিদিন তোমাদের দুজনের কন্ঠস্বর শুনেও দ্বিধা-দ্বন্দে পরে যাই, সেখানে মামা কতদিন পর পর আসেন, কনফিউজড হওয়ারই তো কথা।’ শিউলির দুই চোখে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে শুরু করল। রান্নাঘরে আর বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ হবে না। দ্রুত রান্নাঘর ত্যাগ করলাম।

মামা সাহেবের এরুপ আচরণের কারণ কি? পুরুষ মানুষ কখন হঠাৎ করে নিরব হয়ে যায়? মামা কি তবে প্রেমে পরেছে? যদি পরে থাকেন তবে কার প্রেমে পরেছে? ১৭-১৮ বছরের কোন মেয়ের প্রেমে? ৪১ বছরের একজন মধ্যবয়সী লোক ১৭-১৮ বছরের মেয়ের প্রেমে কেন পরবে? পরা উচিৎ নয়। কেন উচিৎ নয়। দুটো কারণ আছে। কারণ এক- যথা সময় বিয়ে করলে মামার এতোদিনে এর চেয়েও বয়স্ক একটা অথবা দুই-তিনটা ছেলে এবং মেয়ে থাকত। কারণ দুই- বয়সের এতো পার্থক্যে বিয়ে করলে জেনারেশান গ্যাপ জনিত কারণে দাম্পত্য জীবনে উভয়ের মধ্যে মানসিক সমস্যার উদ্রেক হয়। দাম্পত্য জীবনে সেই মানসিক সমস্যা চিরদিন ধরে চলতে থাকে। মামার সাথে কথা বলা প্রয়োজন।

মামার ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে বললাম, ‘মামা দরজা খোল।’ মামা শুনলেন না অথবা শুনে চুপ থাকলেন। আরও কয়েকবার দরজা ধাক্কানোর পর, মামা খুবই বিরক্ত গলায় বলল, ‘বিরক্ত করিস না নিবিড়, খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করছি, কনসেন্ট্রেশন প্রয়োজন। পরে আয়।’ মামা বোধহয় জানে না, দরজার লকের চাবি একটা না, কয়েকটা থাকে। আলমিরা থেকে চাবির গোছা নিয়ে দরজা খুলতেই মামা হতভম্ব হয়ে গেল। পুরো ঘর দুমড়ানো-মুচরানো কাগজে ভরে আছে। প্রথমেই মামা টেবিলের উপর থেকে প্যাড লুকালেন, এরপর দ্রুত মেঝের কাগজ তুলতে শুরু করলেন।

‘মামা, চিঠি লিখছিলে নাকি কবিতা?’
‘কবিতা লিখছিলাম, এই আর কি।’
‘তুমি কবিতাও লেখ? জানতাম নাতো, দেখি কি লিখেছ?’

মেঝে থেকে একটা কাগজ তুলে নিতেই মামা ছো মেরে নিয়ে গেল। এর মানে হচ্ছে কবিতা-টবিতা না অন্য কিছু লিখছিলেন তিনি। কি লিখতে পারেন তিনি? খুব সম্ভবত, প্রেম পত্র। মামার ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে দুনিয়া এস্পার-ওস্পার হয়ে গেলেও কিছুতেই পড়তে দিবে না। আমি দুটা কাগজ তুলে নিয়ে ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলাম। মামা আমার পেছনে ছুটতে শুরু করল। আমি মামার পন্থা অবলম্বন করলাম, ঘরে ঢুকে দরজা লক করে দিলাম। মামা সজোরে দরজায় ধাক্কা দিলেন, নীচু গলায় বললেন— ‘নিবিড় ভাল হবে না কিন্তু।’

প্রথম চিঠি—

০৫ই ফেব্রুয়ারী
প্রিয় সুন্দরীতমা,
পত্রের শুরুতেই একগুচ্ছ লাল গোলাপের শুভেচ্ছা গ্রহণ করিবেন। আশা করিতেছি আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে ভালো আছেন, কিন্তু আমি থাকিতে পারিতেছি না…

দ্বিতীয় চিঠি—

০৫ই ফেব্রুয়ারী প্রিয় নাম না জানা অপরিচিতা, পত্রের প্রথমেই আমার সালাম নিবেন, ‘আসসালামু আলাইকুম।’ আমাকে আপনার চিনিবার কথা নয়, কিন্তু আমি আপনাকে চিনি, দীর্ঘদিন হইতে চিনি। একজন মানুষকে আমি দীর্ঘদিন হইতে চিনি অথচ তাহার নামখানিও আমি জানিতে পারিলাম না। বড়ই ইচ্ছা হয় একবার জিজ্ঞাস করি, ভয়ও হয় যদি নাম না বলিয়া চটি জোড়া হাতে তুলিয়া লন চিঠিগুলো লিখে মামা ফেলে দিয়েছেন, এরমানে হচ্ছে তিনি যাই ই লিখছেন তা যথার্থ হচ্ছে বলে তার মনে হচ্ছে না। তবে মানুষটা কে? কে সেই সৌভাগ্যবান, যিনি আমার কুমার মামাকে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে?

দরজা খুলে মামার ঘরে গেলাম। মামা আমার দিকে তাকালেন কিন্তু কিছু বললেন না। এতোক্ষণে রাগ পরে যাবার কথা। ব্যাপারটা এমন—কিছুক্ষণ আগে দরজা না খোলার কারণে তিনি আমার উপর ভীষণভাবে রেগে যান, যখন তিনি বুঝতে পারলেন দরজা ধাক্কিয়ে আর লাভ নেই সব পড়ে ফেলেছি তখন তিনি নিজের ঘরে চলে এলেন। তাঁর মন তাকে বলল, পড়েই তো ফেলেছে ওসব নিয়ে আর চিন্তা করে লাভ কি?

‘মামা—মামীটা কে?’
‘মামী! মানে?’
‘যাকে চিঠি লিখছিলে।’
‘আরে ধুর! ওসব এমনেই লিখেছি।’
‘শিউলিকে পড়তে দেই চিঠিগুলা? দেখি তার প্রতিক্রিয়া কেমন হয়?’
‘দেখতো! শিউলিকে কেন দিবি?’
‘তুমি তো আমাকে কিছু বলবে না তাই।’
‘আচ্ছা বলব যাহ। তবে এখন না পরে। কাগজগুলো ফিরিয়ে দে।’
‘কেন ফেরৎ দেবো? তোমার জরিমানা হয়েছে পাঁচশ টাকা দাও।’
‘ঘুস নিচ্ছিস? তুই বড়ই খারাপ রে, মামার কাছে থেকেও ঘুস নিস।’
‘মামা ঘুস বোলো না, ঘুস নেওয়া হারাম। বল বকশিস।’

পকেট থেকে টাকা বের করে মামা বলল—এই নে তোর বকশিস। ৫০টাকা কম আছে। মামার চিঠি লেখা দেখে, মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। কাগজ নিয়ে লিখতে শুরু করলাম-

প্রিয় আবুল,
পত্রের প্রথমেই আমার বুকভরা ভালোভাসা গ্রহণ করবে। তোমাকে ভীষণ মনে পরছে। অনেকদিন পর আজ তোমার সাথে দেখা হলো। কিছুতেই তোমাকে যেতে দিতে ইচ্ছা হচ্ছিলো না, কিন্তু তোমার দজ্জাল স্ত্রী দেরি হলেই তোমাকে সন্দেহ করবে, নির্যাতন করবে, আমি তা চাই না। আবার কবে দেখা হবে আমাদের? আই লাভ ইউ।

—ইতি শাহনাজ।

সন্ধ্যাবেলা আবুল ভায়ের সাথে দেখা। কুরবানের দোকানে গিয়ে বসলাম। আবুল ভায়ের ১০০টাকা ফিরিয়ে দেওয়াতে তিনি ভীষণ খুশি, কারণ তিনি ভেবেছিলেন টাকাটা তার গচ্ছা গেছে। গল্পের ফাঁকে চিঠিটা খুবই সাবধানতার সাথে আবুল ভায়ের পকেটে ঢুকিয়ে দিলাম।

রাত সাড়ে দশটার দিকে আবুল ভায়ের কল— ‘ভাই তাড়াতাড়ি নিচে আসো।’
‘কেন ভাই কি হইছে?’
‘নীচে আসো তাড়াতাড়ি। ভীষণ ঝামেলার মধ্যে পরছি।’
‘ঝামেলাটা কি? সারাংশ বলেন।’
‘আরে ভাই, তোমার ভাবী বাসা থেকে বের করে দিছে আমাক। তাড়াতাড়ি আসো।’

যেই আশা নিয়ে আবুল ভায়ের পকেটে চিঠি ঢুকিয়েছিলাম, তা পূরণ হয়েছে। এতো আনন্দ লাগে কেন আমার? মোবাইল ফোন দূরে সড়িয়ে রেখে মনের আনন্দে হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খেলাম। আনন্দে আরও পাঁচমিনিট গড়াগড়ি খেতে ইচ্ছা করল কিন্তু আবুল ভাই লাইনে আছে। বিছানায় উঠে বসতে বসতে মোবাইল হাতে নিলাম।

‘হ্যালো আবুল ভাই! কোথায় আপনি?’
‘তোমাদের বাড়ির নীচে। তাড়াতাড়ি আসো।’
‘আচ্ছা, আপনি দাড়ান। আমি আসতেছি।’

লাইন কেটে দিয়ে আরও কিছুক্ষণ হাসলাম। হাসতে হাসতে চোখ থেকে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পরল। মুখে পানির ঝাপ্টা দিয়ে নীচে চলে গেলাম। আবুল ভাই মেইন গেটের সামনে পায়চারী করছিলেন। আমি ডাকলাম।

‘এতোক্ষণে এলে! সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি।’
‘একটু দেরি হয়ে গেল ভাই, দুঃখিত। বলেন কি হইছে?’
‘তোমার ভাবী আমাক বাসা থেকে বের করে দিছে।’
‘কেন কেন? কেন বের করে দিলো?’
‘আর বইলো না ভাই, কোন মেয়ের ভালোবাসার চিঠি, আমার পকেটে পাওয়া গেছে।’
‘কোন মেয়ে আপনাকে চিঠি লেখে? আগে বলেন নাই তো ভাই।’

‘আহ, মশকরা কোরোনা তো ভাই। চিঠি যে লিখেছে তার নাম শাহনাজ। এই নামের কাউকে আমি চিনিই না। সে আবার আমার নামও লিখেছে।’ ‘বলেন কি ভাই!’ ‘আমি চিন্তা করছি কি জানো?’ ‘কি ভাই?’ ‘চিঠি যে লিখেছে তার মোটিভ যাই হোক, চিঠিটা আমার পকেটে এলো কিভাবে?’ ‘খুবই চিন্তার বিষয় ভাই। কিভাবে এলো?’ ‘আমার তো এমন শত্রু কেউ নাই ভাই। এখন কি করি বল তো? আজকে সারারাত তো বোধহয় বাসায় ঢুকতে পারব না। থাকব কোথায়?’ ‘ভাই আপনি একটু দাঁড়ান, খুব পেচ্ছাপ চেপেছে।’ ‘তাড়াতাড়ি আইসো ভাই।’

সিঁড়ি দিয়ে উঠতেছি আর হাসতেছি—হাসতে হাসতে মনে হচ্ছে পেট ফেটে যাবে। এতো আনন্দ কেন প্রতিশোধ নেওয়ায়? মোবাইল ফোনের সুইচ অফ করে সোজা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলাম। আবুল ভাই নিশ্চয়ই আরও ঘন্টা দুয়েক দাঁড়িয়ে থাকবেন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত