নিঃসন্তান

নিঃসন্তান

এই মুহুর্তে আমি আর শ্রাবণী বসে আছি ডাক্তার আজিজুল হকের সামনে। ডাক্তার আজিজুল হক খুব মনোযোগ সহকারে রিপোর্ট গুলো দেখে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে বললো,

~আপনি নিজেও একজন ডাক্তার। আপনি সহজেই বুঝবেন। আমরা মানুষের হাতে আল্লাহতালা অনেক ক্ষমতা দিলেও কিছু ক্ষমতা উনি উনার নিজের কাছে রেখেছেন। সব ক্ষমতা যদি আল্লাহতালা মানুষের হাতে দিয়ে দিতেন তাহলে মানুষ আল্লাহকে ভুলে যেতো। আপনাদের দুইজনের রিপোর্ট খুব ভালো কিন্তু তবুও কেন সন্তান হচ্ছে না এটা উপর ওয়লা ভালো জানেন ক্লিনিক থেকে বের হতে হতে বিকাল হয়ে গেছে। শ্রাবণী অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবছে। আমি ওর হাতটা ধরে বললাম,

— কি ভাবছো? শ্রাবণী মাথা নিচু করে উত্তর দিলো,

– পিয়াস, ৬ বছর হয়ে গেছে। আর কত অপেক্ষা করবো বলতে পারো? আমি শ্রাবণীর হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম,

— তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছো। তোমায় তো বলেছি আমাদের অফিসের বস রায়হান সাহেবের বাচ্চা হয়েছিলো ১৫ বছর পর। আমাদের তো সবে ৬ বছর হলো… শ্রাবণী মনমরা হাসি দিয়ে বললো,

– কেন আমায় মিথ্যা শান্তনা দাও পিয়াস? আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি তোমাদের বস রায়হান সাহেবের বিয়ের ১ বছর পর যমজ সন্তান হয়েছে আমি শ্রাবণীকে কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। তাই কথাটা ঘুরিয়ে বললাম,

— তুমি বাসায় যাও। আমার একটু কাজ আছে। কাজটা শেষ করে বাসায় আসছি আসলে আমার কোন কাজ নেই। আমি মিথ্যা বলে শ্রাবণীকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি কেন জানি শ্রাবণীর গোমড়া মুখটা দেখতে পারি না কলেজে প্রথম যেদিন ক্লাস করতে যাই সেদিন খেয়াল করলাম আমার থেকে কিছুটা দূরে খুব সুন্দরী একটা মেয়ে আমায় দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। আমি পকেট থেকে ছোট একটা চিরুনী বের করে মাথার চুলগুলো ঠিক করে একটু নায়ক নায়ক ভাব নিয়ে সেই মুচকি হাসির রিপ্লাই দিচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম, লোকে ঠিকিই বলে কলেজে উঠার পর শুধু প্রেম আর প্রেম পড়ালেখা তেমন হয় না। কিছুক্ষণ পর সেই মেয়েটা আমার কাছে এসে বললো,

– তুমি কি খুব দামী আন্ডারপ্যান্ট পরো? আমি মেয়েটার কথা শুনে চমকে গিয়ে আমতা আমতা করে বললাম,

— মানে? মেয়েটি হাসতে হাসতে বললো,
– মানেটা হলো দামী আন্ডার প্যান্ট পরো দেখেই কি প্যান্টের চেইন খুলে সেটা সবাইকে দেখিয়ে বেড়াতে হবে না কি? আমি লক্ষ্য করে দেখলাম আসলেই আমার প্যান্টের চেইন খোলা। তারমানে মেয়েটি এতক্ষণ আমার প্যান্টের চেইন খোলা দেখেই হাসছিলো ।

এরপর থেকেই মেয়েটি আমায় দেখলে শুধু হাসতো আর আমি ওর থেকে সবসময় পালিয়ে বেড়াতাম। সেই মেয়েটিই হলো শ্রাবণী। যার মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগে থাকতো। আর সেই হাসি দেখে মনের অজান্তেই কবে প্রেমে পড়েগিয়েছিলাম তা নিজেই জানি না আমি পার্কে বসে অতীতের কথা ভাবছিলাম। হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচি শুনে বাস্তবে ফিরে এলাম। খেয়াল করে দেখি আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের সজীব সাহেবের ছেলে রিংকু একটা মেয়ের হাত ধরে টানাটানি করছে। আমি রিংকুকে গিয়ে বললাম,

— কি ব্যাপার রিংকু, তুমি মেয়েটার হাতধরে টানাটানি করছো কেন? তখন মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে আমায় বললো,
~দেখেন না, এই ছেলেটা আমায় সবসময় ডিস্টার্ব করে। আমি রিংকুকে বললাম,
— হাতটা ছেড়ে দাও। কিন্তু রিংকু আমার কথা শুনেও হাত ছাড়েনি। তাই আমি বাধ্য হয়ে ওর গালে একটা থাপ্পড় মেরে বললাম,

— চুপচাপ বাসায় যাও। তা না হলে তোমার বাবার কাছে বিচার দিবো রাত ৯টার দিকে কলিংবেলর আওয়াজ শুনে দরজা খুলে তাকিয়ে দেখি সজীব সাহেব আর উনার স্ত্রী। আমাকে দেখেই সজীব সাহেব চিৎকার করে বলতে লাগলো,

– আপনি না কি সবার সামনে আমার ছেলেকে থাপ্পড় মেরেছেন? আমি উনাকে বললাম,

— আপনি শান্ত হোন। আপনাকে আমি পুরোটা বলছি। আপনার ছেলে অন্যায় করেছিলো। তাই একটু শাসন করলাম। সজীব সাহেব আরো রেগে গিয়ে বললো,

– আমার ছেলেকে শাসন করার আপনি কে? পাশে দাঁড়িয়ে থাকা উনার স্ত্রী বললো,
— এত শাসন করার ইচ্ছে থাকলে নিজে সন্তান জন্মদিয়ে শাসন করবেন। অন্যের সন্তানকে শাসন করতে আসবেন না। আমি আর কিছু বললাম না। মাথা নিচু করে চুপচাপ উনাদের কথাগুলো শুনলাম। পিছনে ফিরে দেখি শ্রাবণী পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কি বলবো না বলবো বুঝতে পারছিলাম না। শ্রাবণী যেন এই কথাগুলোতে মন খারাপ না করে তাই তাড়াহুড়ো করে শ্রাবণীকে বললাম,

— আজ মাছের তরকারিটা খুব ভালো রান্না করেছো। শ্রাবণী শান্তভাবে উত্তর দিলো,

– পিয়াস, আজ কোন মাছের তরকারিই রান্না করি নি আমি সচরাচর মানুষের উপর রাগ দেখাই না। কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ফাইল যখন মামুন সাহেব হারিয়ে ফেললো তখন উনাকে একটু রাগে বকাঝকা করেছিলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পর মনে হলো উনার কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। যখন নিজ থেকে উনার কাছে ক্ষমা চাইতে গেলাম তখন শুনি উনি উনার কগিলকে বলছে,

~ক্ষমতা শুধু আমাদের উপর দেখাতে পারে। অথচ খাট কাঁপানোর ক্ষমতা নেই। যদি খাট কাঁপানোর ক্ষমতা থাকতো তাহলে এতদিন নিঃসন্তান থাকতো না কথাটা কলিজার ভিতর লাগলো তবুও চুপ হয়ে থাকলাম তার মাসখানেক পর জানতে পারলাম মামুন সাহেবের স্ত্রী অন্য একজনের সাথে পালিয়ে গেছে। আমি তখন মামুন সাহেবকে বললাম,

— আমি না হয় খাট কাঁপাতে পারি না তাই নিঃসন্তান কিন্তু আপনি তো খাট কাঁপাতে কাঁপাতে ভেঙে ফেলতেন তাহলে আপনার স্ত্রী কেন অন্যজনের সাথে পালিয়ে গেলো? এলাকার ভিতর দিয়ে যখন হেটে যায় তখন রাশেদ নামের একটা ছেলে আমায় ইঙ্গিত করে বললো,

~বউকে ১ ঘন্টার জন্য আমার কাছে পাঠিয়ে দেন। কালকেই সুখবর পাবেন.. সেই রাশেদকেই আমি বছরখানেক পর ডাক্তার আজিজুল হকের চেম্বারে দেখেছি। আমি তখন রাশেদকে বললাম,

— তুমি তো বিয়েই করো নি। তাহলে এই ডাক্তারের কাছে আসলে যে? রাশেদ মাথা নিচু করে বসে আছে। ডাক্তার আজিজুল হক তখন বললো,

~ ছেলেটা বিয়ে করতে ভয় পাচ্ছে কিছু শারিরীক সমস্যার জন্য। আমি রাশেদকে কিছু না বলে শুধু ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম শেষবার শ্রাবণীকে কবে হাসতে দেখেছি আমার মনে নেই। কার্ডিওলজির খুব বড় ডাক্তার হওয়া শর্তেও আমি শ্রাবণীকে দেখেছি মানুষের কথা বিশ্বাস করে বিভিন্ন পরীদের থেকে তেলপড়া পানিপড়া আনতে। গলাথেকে জুয়েলারি খুলে একগাদা তাবিজ পরতে। আমি যখন শ্রাবণীকে বলতাম,

— তুমি ডাক্তার হয়েও এইসব কুসংস্কার বিশ্বাস করো? শ্রাবণী কোন উত্তর দিতো না। শুধু চোখের জলটা আড়াল করতো ৭ বছর পর বেলকনিতে বসে পত্রিকা পড়ছিলাম। হঠাৎ নিচে তাকিয়ে দেখি রিংকু সজীব সাহেবকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে আর বলছে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে। সজীব সাহেব হাতধরে মিনতি করছে আর উনার স্ত্রী আঁচলে মুখ ঢেকে কান্না করছে। আমি তাড়াতাড়ি সজীব সাহেবের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

— কি হয়েছে? রিংকু আপনাদের সাথে এত বাজে ব্যবহার করছে কেন? সজীব সাহেব কান্নাভেজা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে শুরু একটা কথায় বললো,

— ভাই, সন্তান জন্মদেওয়ার চেয়ে সন্তান মানুষ করা অনেক কঠিন কাজ সজীব সাহেব চলে গেলো। ফেরাবার চেষ্টা করলাম কিন্তু উনি আমার কথা শুনে নি। রুমের ভিতর ঢুকে খেয়াল করলাম শ্রাবণী সব পানিপড়া তেলপড়া জানালা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে। আমি তখন শ্রাবণীকে বললাম,

— এইসব ফেলে দিচ্ছো কেন? শ্রাবণী শান্তভাবে উত্তর দিলো,
– ১৩ বছর যেহেতু সন্তান বাদে থাকতে পেরেছি বাকি জীবনটাও তোমার হাতে হাত রেখে পার করে দিতে পারবো তবুও আমার সন্তান তোমার গায়ে হাত তুলবে কিংবা একটু কটুকথা বলবে সেটা আমি সহ্য করতে পারবো না। আল্লাহ যা ভালো বুঝেন তাই করেন। আমাদের সন্তান হলে হয়তো রিংকুর মত হতো এজন্য আল্লাহ আমাদের কোন সন্তান দেয় নি আসলে আমাদের সমাজের মানুষ মানতেই চাই না মাঝে মাঝে স্বামী স্ত্রীর কোন সমস্যা না থাকা শর্তেও সন্তান হয় না।

আজ এতবছর পর আমি হুট করে শ্রাবণীকে হাসতে দেখলাম। সেই হাসি যে হাসিটা শ্রাবণী আমায় প্রথম দেখে হেসেছিলো। আমি তড়িঘড়ি করে প্যান্টের চেইনের দিকে নজর দিলাম। কিন্তু না এইবার আমি ভুল করি নি। আমার তড়িঘড়ি করে প্যান্টের চেইনের দিকে তাকানো দেখে শ্রাবণী আরো জোরে জোরে হাসতে লাগলো। আমি তখন শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে ভাবছি, এই হাসিটার জন্য হলেও আমি ৭ জন্ম নিঃসন্তান থাকতে পারবো..

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত