রাখাল নিতাইকে একটা চড় মারিল।
চড়ের কারণ অনুসন্ধান করিবার প্রয়োজন নাই; হয়তো কারণ একটা ছিল। কিন্তু চড়টাই আসল।
নিতাই রোগা-পটকা লোক, সে রাখালের চড় ফিরাইয়া দিতে পারিল না, ছুটিয়া গিয়া নিজের ঘরে ঢুকিয়া পড়িল। রাখাল দম্ভভরে বুক ঠুকিয়া আস্ফালন করিতে লাগিল।
কিছুক্ষণ পরে নিতাই প্রকাণ্ড এক লাঠি ঘুরাইতে ঘুরাইতে বাহির হইয়া আসিল এবং রাখালকে। আক্রমণ করিল। রিক্তহস্ত রাখাল লাঠির বেগ সহ্য করিতে লারিল না, দ্রুত পলায়ন করিয়া নিজের ঘরে ঢুকিল। নিতাই এবার বুক ফুলাইয়া আস্ফালন করিল।
তারপর রাখাল বাহির হইল ইয়া লম্বা এক তলোয়ার লইয়া। দেখিয়াই নিতাই রণে ভঙ্গ দিয়া নিজ কোটরে ঢুকিয়া দ্বার বন্ধ করিল।
এইভাবে চলিতে লাগিল। প্রথমে চড়ের প্রতিক্রিয়া চক্রবৃদ্ধির আকারে বাড়িয়া চলিল। রাখাল বন্দুক বাহির করে তো নিতাই কামান বাহির করে। তখন রাখাল বাধ্য হইয়া ট্যাঙ্ক আবিষ্কার করে। নিতাই অমনি বোমারু বিমান বাহির করিয়া তাহার জবাব দেয়। কিন্তু দুজনের মধ্যে বাহুবলের সাম্য কিছুতেই স্থির হয় না।
মাঝে মাঝে এক পক্কড় লড়াই হইয়া যায়—কখনও এপক্ষ হারে, কখনও ওপক্ষ। তারপর আবার গৃহে ফিরিয়া গিয়া নূতন অস্ত্র আবিষ্কারের মতলব আঁটে। এইভাবে দুজনে দুজনের অনিষ্ট চিন্তা করিতে করিতে অনেকদিন কাটিয়া যায়।
ইতিমধ্যে দুইটা দল সৃষ্টি হইয়াছে; একদল নিতাইয়ের পক্ষে, একদল রাখালের পক্ষে। পক্ষপাতহীন দু একজন লোক মাঝে মাঝে ক্ষীণ কণ্ঠে বলে—ঝগড়া মিটাইয়া ফেল, হিংসার দ্বারা হিংসার ক্ষয় হয় না, বৃদ্ধি হয়। কিন্তু কে তাহাদের কথা শোনে!
অবশেষে একদিন রাখাল আবিষ্কার করিল—আণবিক বোমা! সিংহনাদ করিয়া বলিল, নিতাইকে তো সাবাড় করিবই, দলকে দল একটি বোমায় পোড়াইয়া মারিব, বাতি দিতে কাহাকেও রাখিব না।
বোমার ক্রিয়া দেখিয়া সকলেই থরহরি। শত্রু মিত্র সকলেই শঙ্কায় কণ্টকিত হইয়া উঠিল—এবার তো আর কেহ বাঁচিবে না! যে সকল ধর্মপরায়ণ লোকের ধর্মজ্ঞান সুপ্ত ছিল, বিষবাষ্প হাউই বোমা। পর্যন্ত যাঁহাদের বিবেককে জাগাইতে পারে নাই—তাঁহারা সন্ত্রাসে চিৎকার করিয়া উঠিলেন–না না, এটা উচিত হবে না। আণবিক বোমা ছুঁড়িলে ধর্মযুদ্ধ হয় না।
আশ্চর্য! ষণ্ডা রাখাল যখন দুর্বল নিতাইকে চড় মারিয়াছিল তখন ধর্মযুদ্ধের কথা কেহ তোলে নাই; বরং বীরভোগ্যা বসুন্ধরা বলিয়া বাহুবলের বাহবা দিয়াছিল। এখন তাহারাই বাহুবলের চরম পরিণতি দেখিয়া সবচেয়ে উগ্র ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়িতে লাগিল। যুদ্ধের সম্পর্কে ধর্মের কথা কিছু নূতন নয়; কিন্তু যতদূর মনে পড়ে, ইন্দ্রজিৎ যখন মেঘে লুকাইয়া যুদ্ধ করিয়াছিল তখনও বাল্মীকি মুনি তাহার দোষ ধরিতে পারেন নাই। সরলমতি বৃদ্ধ মুনি বোধ হয় ভাবিয়াছিলেন যে, যুদ্ধটাই যখন ন্যায়সঙ্গত বলিয়া স্বীকার করিয়া লওয়া হইয়াছে তখন তাহার ভঙ্গিবিশেষে আপত্তি করা চলে না।
যাহোক, রাখালের তর্জন গর্জন শুনিয়া নিতাই ভয় পাইয়া গেল; গলায় কাপড় দিয়া সে রাখালের ক্ষমা ভিক্ষা করিল।
যুদ্ধ শেষ হইয়াছে। সকলেই আনন্দিত, রাখালের তো কথাই নাই। অপদস্থ এবং নিগৃহীত নিতাই ভাবিতেছে কতদিনে এমন অস্ত্র বাহির করিতে পারিবে যাহার দ্বারা সে এই পৃথিবীটাকে সমুদ্রের জলে চটকাইয়া তাল পাকাইয়া সূর্যের আগুনে পোড়াইয়া ঝামা করিতে পারিবে, এবং তারপর সেই ঝামা ভগবানের রগ লক্ষ্য করিয়া ছুঁড়িয়া মারিবে।
৮ ভাদ্র ১৩৫২