অপরিচিতা

অপরিচিতা

একটি শ্যামাঙ্গী যুবতী মেঝেয় মাদুর পাতিয়া ঘুমাইতেছে। এলো চুলগুলি বালিশের উপর বিস্রস্ত; অধর পানের রসে রাঙা হইয়া আছে; গায়ের কাপড় কিছু শিথিল। হঠাৎ দেখিয়া আর চোখ ফিরাইতে পারিলাম না।

লুচ্চা মনে করিয়া ঘৃণা করিবেন না; এমন মাঝে মাঝে সকলেই হয়। আমি বিবাহিত লোক, দশ বৎসর ধরিয়া দাম্পত্য-জীবন অতিবাহিত করিতেছি। আজ হঠাৎ গ্রীষ্মের দ্বিপ্রহরে এই নিদ্রালসা যুবতীকে দেখিয়া আমার যে এমন আত্মবিস্মৃতি ঘটিবে তাহা আমি নিজেই কোনও দিন ভাবিতে পারি নাই।

ঘরে ঢুকিয়া মাদূরের উপর চোখ পড়িতেই চমকিয়া উঠিয়াছিলাম; কিছুক্ষণ দ্বারের কাছেই দাঁড়াইয়া রহিলাম। যুবতীর শিয়রে ভোলা জানালা দিয়া অপর্যাপ্ত আলো প্রবেশ করিয়াছিল; লোভী আলো যেন লুব্ধতা সংবরণ করিতে না পারিয়া বিস্তবসনার অঙ্গে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিল। দাম্পত্য সৌভাগ্যের কৃপায় আমার মনে একটা বিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে স্ত্রী জাতির দেহ-মন সম্বন্ধে সব কিছু অভিজ্ঞতা ও অনুসন্ধিৎসার অবসান হইয়াছে। কিন্তু হঠাৎ যেন অভিনব দৃষ্টি লাভ করিলাম; সচরাচর যে আটপৌরে দৃষ্টি দিয়া জগব্যাপার নিরীক্ষণ করিয়া থাকি তাহা পরকলার মতো খসিয়া গেল।

পা টিপিয়া টিপিয়া নিদ্রিতার পাশে গিয়া দাঁড়াইলাম। তাহার চক্ষের দীর্ঘ পল্লবগুলি অল্প অল্প স্পন্দিত হইতেছে; পানের রসে রাঙা ঠোঁট একটু নড়িতেছে; গাল দুটিতে ঈষৎ রক্তিমাভা। দেখিলাম, বাহিরে নিদ্রিতা হইলেও অন্তলোকে সে কোনও চটুল সকৌতুক খেলায় মাতিয়াছে।

রাঙা ঠোট ঈষৎ বিভক্ত হইয়া গেল; শুনিলাম অধস্ফুট কণ্ঠে সে বলিতেছে—

…রাজার দুলাল…যাবে আজি মোর…

কী সর্বনাশ! কবিতা!! রাজার দুলাল!! এ যে অতি বড় দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করিতে পারি নাই! নিদ্রিতার মুখের উপর দিয়া আরও কত বিচিত্র ভাব ক্রীড়া করিয়া গেল। আমি নিশ্বাস রোধ করিয়া দেখিলাম; বুক গুরু গুরু করিতে লাগিল।

আবার সে অস্ফুট স্বরে বলিল, না না রাজকুমার, এখন নয়…নিশীথে আইও ফুলবনে…

নাভি হইতে তালু পর্যন্ত শুকাইয়া কাঠ হইয়া গেল। সত্যই তো, এ নারী আমার সম্পূর্ণ অপরিচিতা; চোখে যেমন নূতন দেখার স্বাদ পাইতেছি, মনেও তাই। কি আশ্চর্য! দশ বৎসর বিবাহ করিয়াছি, একসঙ্গে উঠিতেছি বসিতেছি, একদিনের জন্য কখনও ছাড়াছাড়ি হই নাই—অথচ—

হঠাৎ দারুণ ভয় হইল। তবে কি এ সে নয়? এতদিন ধরিয়া যাহাকে চিনিবার ভান করিয়াছি সত্যই তাহাকে চিনি না?

নিদ্রিতার গায়ে প্রবল নাড়া দিয়া বলিলাম, ওগো, তিনটে বেজে গেল–ওঠ ওঠ!

গৃহিণী নিদ্রা ভাঙিয়া সটান উঠিয়া বসিলেন, বলিলেন, এসেছ? পাওনাদার মিনসে এসেছিল বলে গেছে–

এই তো আমার চির-পরিচিতা! প্রকাণ্ড হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম। বলিলাম, চুলোয় যাক পাওনাদার। এখন চট করে এক পেয়ালা চা তৈরি করে দাও তা দেখি। গলাটা ভারি শুকিয়ে গেছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত