০১. অক্ষয়চন্দ্র মেমোরিয়াল হাসপাতাল
অক্ষয়চন্দ্র মেমোরিয়াল হাসপাতালের চোদ্দো নম্বর বেডে আমার মা শুয়ে আছেন। মাথায় পুরু ব্যান্ডেজ। কপাল ঢেকে আছে। চোখ দুটো আধবোজা। বিছানার পাশে একটা লম্বা স্ট্যান্ডে বোতল ঝুলছে। বোতল থেকে একটা স্বচ্ছ নল ওপর হাতের শিরায় গিয়ে ঢুকেছে। এই আমার মা। আমার মা, আমার ছোট বোন শিখার মা।
আমরা নয়নজুলির তিনতলা একটা ফ্ল্যাটবাড়ির ওপরের ফ্ল্যাটে থাকি। আমরা দুই ভাই বোন, মা আর বাবা। বাবার কথা আমার লিখতে ইচ্ছে করে না। আমার বাবা অতি খারাপ লোক। খারাপ ছেলের কথা অনেক শুনেছি, খারাপ বাবা এই প্রথম দেখলুম। মা যে এমন একটা মানুষকে কেন বিয়ে করেছিলেন কে জানে? অবশ্য বাবা-মার বিয়ের ওপর ছেলেদের কোনও হাত থাকে না। বিয়ের পরই তারা বাবা-মা হন।
আমার বয়েস সতেরো। আমার বোনের বয়েস তেরো।
মা তার বাঁ-হাতটা অল্প একটু তুললেন। বুঝলাম আমি যে এসেছি তিনি দেখতে পেয়েছেন। বিছানার পাশে একটা ছোট টুল। আমি সেই টুলে বসলাম। আমি মায়ের জন্যে কিছু আনতে পারিনি। কারণ আমার কাছে হাসপাতালে আসা আর যাওয়ার পথখরচ ছাড়া আর কিছু ছিল না। বাজারে এখন আপেলের দাম আট টাকা কেজি। একটা মুসম্বি প্রায় এক টাকা দাম। পঞ্চাশ পয়সার কম দামের যে সন্দেশ তা ছুন্নিগুলির মতো এবং অখাদ্য।
মা ফিসফিস করে জিগ্যেস করলেন, “তোরা কেমন আছিস?”
বললুম, ভালো। কিন্তু আমরা মোটেই ভালো নেই। এই পৃথিবীতে একা-একা থাকতে কার ভালো লাগে। অনেক বইয়ে পড়েছি, জীবন একটা সংগ্রাম। সেই সংগ্রাম যে এই সংগ্রাম, কে জানত।
মা আবার ফিসফিস করে জিগ্যেস করলেন, বাবা ফিরেছে?
বাবার কথা শুনে কেমন একটা ঘৃণা হল। এমন মানুষের ফেরা আর না ফেরা!
না ফেরেননি। তুমি কি মনে করো ফিরে আসবেন?
আমার প্রশ্নের কোনও জবাব নেই। মা চুপ করে গেলেন। বোতল থেকে কী একটা জল টিপটিপ করে নলে পড়ছে। নল থেকে মায়ের শরীরে।
শিখা কী করছে রে?
শিখাকে নীচের ফ্ল্যাটের মাসিমার কাছে রেখে এসেছি।
আজ তোরা কী খেলি?
চিনি আর পাউরুটি।
মা আবার আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। চোখের কোণে দু-ফেঁটা জল নামল।
দূর থেকে জুতোর শব্দ তুলে নার্স হেঁটে আসছেন। সাদা ধবধবে পোশাক। পৃথিবীটা এত ভালো তবু কত খারাপ!
তোমার মাকে আর বকিও না, এবার উঠে পড়ো। আবার কাল।
সিস্টার বোতলটা একবার কঁকিয়ে দিলেন। মায়ের মাথার ব্যান্ডেজটার দিকে এক নজরে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। এমন রোগী, এমন বিপদ এঁরা সারাদিনে কত দেখছেন। মনে সব সয়ে গেছে।
উঠতে যাচ্ছি, মা আবার বাঁ-হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। নীচু হয়ে মুখটা মায়ের মুখের সামনে নামিয়ে আনলাম। মা ফিসফিস করে বললেন, বিনু তুই আমার কানের দুল দুটো খুলে নিয়ে যা। বেচে কিংবা বাঁধা দিয়ে যেমন করে পারিস কিছু টাকা জোগাড় কর। তা না হলে কী করে চলবে রে।
না মা, ও আমি পারব না। বরং আমার হাতঘড়িটা–।
মায়ের মুখ বড় করুণ হয়ে উঠল। মাকে কী ভীষণ অসহায় দেখাচ্ছে। ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল– ঘড়িতে হবে না রে বিনু। কত আর পাবি। অনেক খরচ। তুই খুলে নে বাবা! পরে আবার সব হবে।
মানুষের দিন কি ভালো হয়। আমার এই সতেরো বছরের জীবনে কোনও ভালোই তো দেখিনি। মা-ও বেশ ভালোই জানেন, জীবনে ভালো দিন আর আসবে না। টাকা সত্যিই চাই। আজকের দিন চলে গেলে কাল কী হবে তা কেউ জানে না।
অনেক ভেবে নীচু হয়ে মায়ের কান থেকে একে একে দুল দুটো খুলে নিলুম। মায়ের নিশ্বাস পড়ছে ধীরে-ধীরে। উষ্ণ বাতাসের মতো গায়ে লাগছে। বেশ জ্বর হয়েছে। জীবন যেমন ক্ষয়ে যায় সোনার অলংকারও তেমনি শরীরের স্পর্শ লেগে-লেগে কেমন বিবর্ণ, কেমন ক্ষয়-ক্ষয়া হয়ে যায়। দুল দুটো হাতের তালুতে রাখতেই মনে হল, এ সুখের শরীর থেকে আসেনি, এসেছে দুঃখের ছোঁয়া লাগা, জর্জরিত কোনও শরীর থেকে বিষণ্ণ, ক্ষতবিক্ষত চেহারা নিয়ে। দুল দুটোর দিকে তাকাতেই আমি যেন আমার মায়ের জীবনের অতীত দেখতে পেয়ে গেলুম। যিনি হাসতে চেয়ে কেঁদে গেলেন, যিনি ভালোবাসতে গিয়ে পুড়ে গেলেন। আমার মায়ের কিছু হল না। এ যেন সেই গাড়ি, যার চালক জানে না যে পথে ছুটে চলেছে সেই পথের শেষে বিশাল একটা খাদ। সন্ধে নেমেছে শহরে। আজ বৃহস্পতিবার। রঙ্গমঞ্চে এতক্ষণ আমার বাবা রেশমের পোশাক পরে ফুটলাইটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। মুখে মিহি মদের গন্ধ। তিনি আমার বাবা নন। শাজাহান। একান্নতম রজনির সফল অভিনেতা। মঞ্চে এসে দাঁড়ালেই দর্শকের প্রশংসার হাততালি।
০২. বিরাজবাবু আমার বাবার বন্ধু
বিরাজবাবু আমার বাবার বন্ধু। আমরা বলি বিরাজকাকু। একসময় দুজনে একইসঙ্গে থিয়েটার করতেন। বাবাও তখন অ্যামেচার। বাবা অভিনয়কে পেশা করে নিলেন। বিরাজকাকু একটা চাকরি পেয়ে অভিনয়ের জগৎ থেকে ক্রমশ দূরে সরে গেলেন। বাবার সঙ্গে মায়ের প্রেম, বিয়ে সব কিছুর পেছনে বিরাজকাকুর হাত ছিল। বিয়ের পরেও বেশ কয়েক বছর বাবার সঙ্গে বিরাজকাকুর অন্তরঙ্গতা ছিল। তারপরই বাবা পেশাদারি অভিনয়ের জগতে যত খ্যাতি পেতে শুরু করলেন ততই তিনি সংসার থেকে, সমাজ থেকে, বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগলেন।
বিরাজকাকু বলেন, আমি লাইন দিয়ে বেবি ফুড কিনে এনে তোর দুধ খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। ঘাড়ে করে চাইল স্পেশালিস্টের কাছে নিয়ে গেছি। আমিই তোর রিয়েল ফাদার।
মানুষটি বড় ভালো। মাঝে-মাঝে মনে হয় মা কেন বিরাজকাকুকে বিয়ে করলেন না। মা তো দুজনেরই বন্ধু ছিলেন। আমি জানি আমার এই ভাবনাটা খুব দোষের। তবু মনে হয়। বিরাজকাকুকে ভীষণ ভালো লাগে। আসলে আমার মা খুব বোকা। আমাদের নীচের ফ্ল্যাটের শ্যামলীর মতো। সে চঞ্চলকে ভালোবাসে। অথচ চঞ্চল ছেলেটা খুব বাজে ধরনের। চঞ্চলের একমাত্র গুণ ভালো গান গায়। চঞ্চল নেশা করে, চঞ্চল সংসার দেখে না, চঞ্চল কাপ্তেন, চঞ্চলের সব কিছুই বাজে। আমার মা-ও ঠিক শ্যামলীর মতো। কত শ্যামলী যে আছে এই সংসারে।
রাতের দিকে বিরাজকাকু এলেন। আমরা না খেয়ে আছি ভেবে খাবার এনেছেন। শিখা ঘুমিয়ে পড়েছে। শিখার জন্যে আমার খুব দুঃখ হয়। আমি তো ছেলে। আমার আর কি। যেমন করেই হোক চালিয়ে নেব। শিখার কী হবে?
বিরাজকাকু খুব পান খান জর্দা দিয়ে। সুন্দর একটা গন্ধ বেরোয়।
খাওয়াদাওয়া কিছু করেছিস বিনু। করিসনি?
এইবার করব কাকু।
নে, ঠোঙায় খাবার আছে। কাল থেকে অন্তত একবেলা তোদের জন্যে ভাতের ব্যবস্থা করতে হবে। কোথায় করি। নিজেরই চালচুলোর ঠিক নেই। তবু করতে হবে। মেয়েটার ঘাড়টা বেঁকে আছে রে বিনু। সোজা করে দে।
শিখা এঁকেবেঁকে শুয়ে আছে। পড়ার বই চারপাশে ছড়িয়ে আছে। মেয়েটার গা দিয়ে একটা ছেলেমানুষ-ছেলেমানুষ গন্ধ বেরোচ্ছে। শিখাকে ঠিক করে শোয়াতে শোয়াতে মনে হল আমার বাবা কত নিষ্ঠুর।
বিরাজকাকু চেয়ারে বসতে-বসতে বললেন, ব্যাপারটা কী হয়েছিল বল তো?
খুব বাজে ব্যাপার কাকু।
বাজে তো বটেই। হঠাৎ এত ক্ষেপে গেল কেন?
আমি তো সবটা জানি না। অনেক রাতের ঘটনা। আমরা যখন জেগে উঠে ছুটে গেছি তখন আমার মা মাটিতে পড়ে আছেন। চারপাশ ভেসে যাচ্ছে রক্তে। সিঁড়ির কাছের অল্প আলোতে দু-হাতে মুখ ঢেকে বাবা দাঁড়িয়ে। মুখে তখনও মেকআপ। থিয়েটারের ডায়লগের মতো বলে চলেছেন, এ আমি কী করলুম, এ আমি কী করে ফেলেছি। তারপর হঠাৎ জাহানারার ডায়লগ বলতে শুরু করলেন, উঠুন, দলিত ভুজঙ্গের মতো ফণা বিস্তার করে উঠুন, হৃতশাবক ব্যাঘ্রীর মতো প্রমত্ত বিক্রমে গর্জে উঠুন; অত্যাচারে ক্ষিপ্ত জাতির মতো জেগে উঠুন। তারপর ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কিছুক্ষণ কেঁদে টলতে টলতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন।
বিরাজকাকু কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে বললেন, তোর বাবা কাঁদতে চায়। দুঃখ দিয়ে দুঃখ পেতে চায়। তোর মায়ের মতো মেয়ে হয় না রে।
তাই তো বাবা অত বাড়তে পেরেছে।
ভুল বললি বিনু। লোকটা মনে প্রাণে সাজাহান হয়ে গেছে। সাজাহানকে যে কাঁদতেই হবে।
তা বলে মাকে মেরে?
তোর মা ছাড়া পৃথিবীতে ওর আপনার লোক আর কে আছে বল?
আপনার কথা আমি কিছুই বুঝি না। বাবা যদি সাজাহানই হবেন আমার মা তো তাহলে মমতাজ। এই কি বাবার তাজমহল!
বিনু তোর বাবার ওপর রাগ করিস না রে। লোকটার মনটা বড় ভালো রে। কত বড় অভিনেতা। ইতিহাসে নাম থাকবে।
আমাদের মনের ইতিহাসে কি থাকবে কাকু? হাসপাতালে গিয়ে মাকে একবার দেখে এলেই বুঝবেন। মাকে কারা হাসপাতালে নিয়ে গেল? জানেন মায়ের হাতে আজ একটাও পয়সা নেই। এই দেখুন কানের দুল দুটো মা আজ বেচে দেওয়ার জন্যে আমার হাতে খুলিয়ে দিয়েছেন।
ও দুটো তোমাকে বেচতে হবে না বিনু, তুলে রেখে দাও। মা হাসপাতাল থেকে ফিরে এলে যে হাতে খুলেছ সেই হাতেই আবার পরিয়ে দিও। জেনে রাখো শিল্পীদের হাতে কখনও পয়সা থাকে না। আসে আর উড়ে যায়। তাদের সংসার এই ভাবেই চলে। পাঁচজনে চালিয়ে দেয়। শিল্পের জন্মভূমি হল অভাব, অশান্তি, হতাশা, বিচ্ছেদ। ওসব বোঝার বয়েস তোর হয়নি। নে উঠে পড়।
কোথায় উঠব কাকু?
যেতে হবে না?
কোথায়?
কোথায় আবার! আমার আস্তানায়। মনে নেই তোকে আমি কি বলেছিলুম একদিন। আমিই তোর রিয়েল ফাদার। তুই ভাবিস না ব্যাটা। আমি কি তোর বাপের চেয়ে কম বড় অভিনেতা ছিলুম! আমার ঔরংজীব দেখেছিস। দেখিসনি। তুই তখন এতটুকু। মায়ের কোলে ট্যাঁট্যাঁ। স্টেজ ছেড়ে চাকরি ধরেছি কেন জানিস, আমি এক নতুন ঔরংজীব। সাজাহানকে আগ্রা দুর্গ থেকে মুক্ত করে দিয়ে বলব, সাজাহান, ওই তোমার মসনদ, ওই তোমার মমতাজ, ওই তোমার জাহানারা। নে জাহানারাকে টেনে তোল, অনেক রাত হল। ভালো তালা আছে?
হ্যাঁ আছে।
নে হৌজখাসে তালা মেরে আমার সঙ্গে চল। মা ভালো হয়ে ফিরে এলে তারপর আসবি।
বিরাজকাকুর সঙ্গে ট্যাক্সি করে আমরা দুই ভাই-বোন মাঝরাতের কলকাতার মধ্যে দিয়ে চলেছি। শিখা আমার কাঁধে মাথা রেখেছে। মাঝে-মাঝে আলোর রেখা মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে। শিখা যেন কেমন হয়ে গেছে। মুখটা ঠিক আমার মায়ের মুখের মতোই। কিন্তু কি ভীষণ ক্লান্ত। ঘটনার রাত থেকে আজ পর্যন্ত শিখার মুখে এতটুকু হাসি নেই। চলে ফিরে বেড়িয়েছে। যেন কলের পুতুল। সত্যিই জাহানারা। সাজাহানের সঙ্গে একই দুর্গে বন্দি। মায়ের জন্যে আমার যেমন দুঃখ হয় শিখার জন্যেও তেমনি দুঃখ হয়। শিখা যেন এই বয়সেই মায়ের মতো বুড়িয়ে গেছে।
বিরাজকাকু একলা মানুষ। দেড় কামরার ফ্ল্যাট। পরিচ্ছন্ন করে সাজানো। ঘরের একদিকের দেওয়ালে বিশাল একটা সিন টাঙিয়ে রেখেছেন। সেই সখের থিয়েটারের স্মৃতি। থিয়েটার গেছে সিনটা আছে। রোজই ঝাড়ামোছা করেন। তা না হলে ঘরটা এমন থাকে কী করে। রং জ্বলজ্বল করছে। দৃশ্যটা বড় সুন্দর, বনে বসন্ত লেগেছে। গাছে-গাছে আগুন। দেখলেই গান গেয়ে উঠতে চায় মন, ওরে ভাই আগুন লেগেছে বনে-বনে।
বিরাজকাকুকে দেখাশোনা করার জন্যে একজন রাঁধুনি আছেন। সেই ভরসাতেই আমাদের তুলে এনেছেন। বয়েস বেশি নয়। বিরাজকাকুর সঙ্গে সম্পর্কটা যেন আপনার লোকের মতো। তাল ঠুকে বললেন, রাতকা খানা লে আও।
আমার বাবাকে আমি কখনও এমন হাসিখুশি দেখিনি। সকালে বিরক্ত বিষণ্ণ। রাতে মাতাল।
বুঝলি বিনু। বিরাজকাকুর হাতে সিগারেট, তোর বাবাকে বুঝতে শেখ।
তার মানে?
শিল্পী মাত্রেই বড় একা।
আমরা তাহলে কী জন্যে আছি কাকু।
তোরা থেকেও নেই। তোরা অন্য গ্রহের মানুষ। জানিস কি?
কি জানিস?
আগামী রবিবার সাজাহানের শেষ অভিনয়। বই উঠে যাচ্ছে। ঐতিহাসিক নাটক আর পাবলিক স্টেজে চলবে না। এখন এসেছে আধুনিক নাটক। জোতদার মারা রাজনৈতিক নাটক। প্যানপ্যানে সামাজিক নাটক। আর এসেছে ড্যান্স। অভিনেতাদের যুগ শেষ। স্টেজ, লাইট, নাচ, কায়দা। তোর বাবার হতাশাটা কোথায় বুঝেছিস? যে লোকটা রাতের-পর-রাত পাদপ্রদীপের সামনে দাঁড়িয়ে দর্শকদের চমকে দিয়েছে, চোখের জলে ভাসিয়ে দিয়েছে, সেই লোকটি আর কয়েকদিনের পরেই শূন্যতার জগতে ফিরে আসবে। রাত আসবে, চোখের সামনে দর্শক থাকবে না, হাততালি থাকবে না, এনকোর, এনকোর চিৎকার থাকবে না। পরচুল, মেকআপ, গ্রিনরুম, আলো ঝলসানো আয়না, রং-তুলি কিছুই থাকবে না। নিঝুমরাত, চারটে দেওয়াল, একটা খাট, কয়েকটা চেয়ার, একফালি রাস্তা, ঝাঁপসা আলো, ছায়া ছায়া মানুষ, রিকশার ঠুনঠুন, সাজাহান তখন সত্যি-সত্যিই আগ্রার দুর্গে বন্দি! কে তখন ঔরংজীব? এই সমাজ, তোদের এই আধুনিক রুচি। তাই তো লোকটা মাঝে-মাঝেই খেপে উঠছে পাগলের মতো।
বাবা তো আধুনিক নাটকেও অভিনয় করতে পারে কাকু?
দূর পাগল, ক্ল্যাসিকাল গাইয়ের মেজাজে কি আধুনিক আসে রে পাগল।
তাহলে কী হবে?
তোর বাবা অতীতের স্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া করবে আর তোরা মানুষ হয়ে উঠে সংসারের হাল ধরবি। তবে জানিস তো শিল্পীর ছেলেরা মানুষ হয় না।
কেন হয় না?
সংসার জ্বলতে থাকে, চরিত্ররা পুড়তে থাকে। শিল্পীর সংসার এক জতুগৃহ। তবু চেষ্টা করতে হবে। জয়ে, পরাজয়ে, জয়ে দুলতে-দুলতে ফঁক খুঁজতে হবে, পথ করে নিতে হবে। সাজাহান তো পড়েছিস। মনে পড়ে সেই অংশটা যেখানে মহামায়া যশোবন্তকে বলছে, চেয়ে দেখ ওই রৌদ্রদীপ্ত গিরিশ্রেণি দূরে ওই ধূসর বালুস্থূপ। চেয়ে দেখ ওই পর্বতস্রোতস্বতী যেন সৌন্দর্যে কাঁপছে। চেয়ে দেখ ওই নীল আকাশ যেন সে নীলিমা নিংড়ে বার কচ্ছে। তোকে চেয়ে-চেয়ে দেখতে হবে। দেখতে হবে ছায়ার দিকে নয়, রোদের দিকে। জীবন থেকে নিংড়ে বের করতে হবে আকাশের নীলিমা। নে ওঠ। খেয়ে আসি।
০৩. রাত তখন কটা হবে
রাত তখন কটা হবে, বলতে পারব না। মনে হয় মাঝ রাত। আমি মাকে স্বপ্ন দেখছিলাম। বিশাল চওড়া, একেবারে ফাঁকা একটা রাস্তায়, আমি আর আমার মা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি। ভীষণ হাওয়া দিচ্ছে। মায়ের বয়েস যেন অনেকটা কমে গেছে। যেমন ছিল মায়ের প্রথম বয়েসের ছবিতে। মাথায় অনেক চুল ছিল। হাওয়ায় চুল উড়ছে। নীল শাড়ির আঁচল উড়ছে। আমার হাতে একটা সুটকেস। সামনের আকাশে সারি-সারি পাহাড়। পাহাড়ের কোলে ঘন সবুজ বন। কী সুন্দর যে জায়গাটা। পাশে মা। মায়ের মুখে সেই হারিয়ে যাওয়া হাসি।
ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্ন হারিয়ে গেল। কে যেন ভারী গলায় ডাকছেন, বিরাজ, বিরাজ। বিরাজকাকুর একটাই ঘর। খাটে শুয়ে আছি আমি আর শিখা। সোফা কাম বেডে কাকু শুয়ে আছেন চিত হয়ে। ঘুমের ঘোরেই শুনছি, কাকু দরজা খুলছেন। ঘরের আলো জ্বেলেছেন। চোখে আলো লাগছে। দরজা খুলতেই, গলাটা খুব চেনা মনে হল। বিরাজ বিরাজ।
বাবা। বাবার গলা। এত রাতে বাবা এখানে? বাবার কি তাহলে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই! সারারাত কলকাতার নির্জন পথে-পথে ঘুরতে-ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে, কুকুরের তাড়া খেয়ে, পুলিশের খোঁচা খেয়ে আশ্রয় খুঁজতে এখানে এসেছেন। নাকি সাজাহান এসেছেন ঔরংজীবকে মাঝরাতে খুন করতে। ভয়ে কাঠ হয়ে শুনছি, বিরাজকাকুর গলা,–আয়, আয় ভেতরে।
ভেতরে আসতে গিয়ে বাবার পা টলে গেল। দরজাটা ধরে সামলে নিলেন। ভীষণ একটা শব্দ হল। দরজার সঙ্গে দেওয়ালের ধাক্কা। শিখা ঘুমের ঘোরে চমকে উঠল। বাবা ঘরে ঢুকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সাজাহান নাটকের পঞ্চম দৃশ্যের সেই সংলাপ বলে উঠলেন, পৃথিবীর কি অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে জাহানারা? জাহানারা তো এখন বাড়ি গিয়ে মেক-আপ তুলে ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়েছে। জাহানারার সংলাপ কে বলবে? ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে বাবা সেই বিখ্যাত অভিনয়টা আর একবার দেখালেন, সত্যই তো, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি নাকি? না-না-না। জানি পাগল হব না। ঈশ্বর! এই শীর্ণ দুর্বল, জরাজীর্ণ নেহাতই অসহায় সাজাহানকে দ্যাখো ঈশ্বর! তোমার দয়া হচ্ছে না? দয়া হচ্ছে না? আমি এমন কী পাপ করেছিলাম খোদা। মাথার দুপাশ থেকে হাত দুটো নামিয়ে হাঁটুর সামনে নামাজের ভঙ্গিতে উপুড় করে বাবা ধীরে ধীরে পেছোতে-পেছোতে সোফা কাম বেডে ধপাস করে শরীরটা ফেলে দিলেন। শরীরের ভারে স্প্রিং নেচে উঠল শব্দ করে।
আমার বাবার নামটা ভারী অদ্ভুত ঋভু। বিরাজকাকু খুব ধীরে-ধীরে বাবার নাম ধরে ডাকলেন, ঋভু।
বাবা ফ্যালফ্যাল করে বিরাজকাকুর মুখের দিকে শিশুর মতো তাকিয়ে রইলেন। ষাট পাওয়ারের আলোতে বাবার মুখটা যতখানি দেখতে পাচ্ছি তাতে মনে হচ্ছে, একটি আপনভোলা শিশু যেন, মাঝরাতে খাটের ধারে বসে আছে। ঘুম ভেঙে দেখছে মা কি করছে। বাবার একবার অসুখ করেছিল। যেদিন জ্বর ছেড়ে গেল সেদিন মা বাবাকে খাটের ধারে বসিয়ে গেঞ্জির ওপর তোয়ালে রেখে ঠান্ডা জলে মাথা ধুইয়ে দিলেন। উশকোখুশকো চুলে বাবা বসে আছেন। কিছু দূরেই মা থালায় ঝোল আর রুটি সাজাচ্ছেন। বাবা কেমন খিদে-খিদে মুখে তাকিয়ে আছেন। সেদিনের সেই মুখ আর আজকের এই মুখ। মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল।
বাবা খুব ধীরে ধীরে জিগ্যেস করলেন, কটা বাজল?
বিরাজকাকু বললেন, প্রায় তিনটে।
রাত শেষ হয়ে এল। এখুনি সকাল হবে। তাই না? সকাল হবে না? বাবা জানালার দিকে তাকালেন। যেন আলো খুঁজছেন। আকাশ এখনও অন্ধকার। শেষরাতের তারা সোনার টাকার মতো আকাশে ছড়িয়ে আছে। বাবা বললেন, ঘরের আলো নিভিয়ে দাও। দিনের আলোর পথ করে দাও। কে সেই মূর্খ লণ্ঠন জ্বেলে সূর্য খুঁজছে।
বিরাজকাকু আলোটা তাড়াতাড়ি নিভিয়ে দিলেন।
সেই অন্ধকার ঘরে বাবার সুন্দর গলায় গান শোনা গেল—
আমি সারা সকালটি বসে বসে এই
সাধের মালাটি গেঁথেছি।
আমি, পরাব বলিয়ে তোমারি গলায়
মালাটি আমার গেঁথেছি।
আমি সারা সকালটি করি নাই কিছু,
করি নাই কিছু বঁধু আর
শুধু বকুলের তলে বসিয়ে বিরলে
মালাটি আমার গেঁথেছি।
আগেও দেখেছি আজও দেখলাম শেষরাতে একটা পেঁচা ডাকবেই ডাকবে। ডেকে জানিয়ে দেবে দিন আসছে। রাত যেন টান-টান সভা সাজিয়ে বসে থাকে। জলসাঘরে জাজিমের মতো। ক্রমশ জমতে জমতে একসময় হালকা থেকে হালকা হয়ে মিছিলের মতো সরে যেতে-যেতে একেবারে মুছে যায়। পেঁচার ডাক শুনে বাবা চমকে উঠলেন। গান থেমে গেল। ঘরের চারপাশে তাকালেন। রাত ফিকে হতে চলেছে। বাবার নেশাও ফিকে হচ্ছে। আমাদের দেখতে পেয়েছেন।
বিরাজ তোমার ঘরে এরা কারা। তুমি কি বিয়ে করেছ?
বিরাজকাকু সামান্য হেসে বললেন, এরা তোমারই ছেলে মেয়ে ঋভু। দীপাকে তো তুমি মেরে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছ।
বাবার মুখটা কেমন যেন বেঁকে গেল। কি যেন মনে করার চেষ্টা করছেন। সেই রাত। সিঁড়ির ধাপে মা পড়ে আছেন। অসম্ভব রক্ত ঝরছে। চারদিক নিস্তব্ধ। শুধু ঘরের দেওয়ালে একটা ঘড়ি টিকটিক করছে। দূরে কল থেকে বালতিতে জল পড়ছে টিপটিপ করে।
বাবার মুখ দেখে মনে হল, সেই রাত তার চোখের সামনে ফিরে আসছে। মুখটা ভাঙতে ভাঙতে কান্নায় ভেঙে পড়ল। দু-হাতে মুখ ঢেকে বাবা আকুল হয়ে কাঁদছেন। এভাবে আমি কখনও কাউকে কাঁদতে দেখিনি। কিছু ভেঙে ফেলে এ যেন শিশুর অসহায় কান্না।
একটা কাক ডাকছে। দিনের প্রথম কাক। কী তীক্ষ্ণ, কর্কশ আওয়াজ।
০৪. বাবা অপরাধীর মতো মুখ করে
বাবা অপরাধীর মতো মুখ করে বসে আছেন। বিরাজকাকুর আজ আর অফিস বেরোনো হল না। গোটা আষ্টেক খালি চায়ের কাপ সারা ঘরের এখানে-ওখানে ছড়ানো। কোনওটায় চায়ের তলানির সঙ্গে সিগারেটের টুকরো আর ছাই। কোনওটায় পোড়া দেশলাই কাঠি। কোনওটায় অ্যাসপিরিনের ফেলে দেওয়া সাদা কাগজ। বাবা সকাল থেকে কাপের-পর-কাপ চা খাচ্ছেন। সিগারেটের-পর সিগারেট। ধোঁয়ায়-ধোঁয়ায় ঘর ছেয়ে গেছে। আমার আর শিখার সঙ্গে একটাও কথা বলেননি।
আমার বাবা হলেন রাতের মানুষ। দিনের আলোর কেমন যেন অসহায়। রাতের প্রাণী দিনের আলোর যেমন অস্বস্তি বোধ করে, বাবার চোখে মুখে ঠিক সেই রকম এক ধরনের অস্বস্তি। বিরাজকাকু একবার সেই রাতের প্রসঙ্গ তুলতে চেয়েছিলেন, বাবা চোখের সামনে হাত আড়াল করে বললেন, আমাকে ভুলতে দাও, ভুলতে দাও।
বাবা যেন চোখের সামনে আমার রক্তাক্ত মাকে দেখে শিউরে উঠলেন।
বেলা তিনটের সময় বাবা বললেন, বিরাজ একটা ট্যাক্সি ডাক।
কোথায় যাবে?
হাসপাতালে।
খুব ভালো কথা।
বিরাজকাকু ট্যাক্সি ডাকতে গেলেন। আমরা তখন রাস্তার দিকের বারান্দায়। বাবাকে চিরকালই কেমন যেন অচেনা মনে হয়। সকাল থেকে আজ যেন আরও বেশি অচেনা মনে হচ্ছে। আমার মায়ের চেয়ে কত বেশি স্বাস্থ্যবান, বলিষ্ঠ। কত বেশি যুবক! চোখ-মুখ যেন বড় বেশি কঠোর আর নিষ্ঠুর।
বাবা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। কেন দিলেন? বোধহয় একটু একা থাকতে চান নির্জনে। বাইরে থেকে আমি শুধু একবার গেলাসের আওয়াজ পেলুম ঠুন করে। কি জানি, কোনও ওষুধ খাচ্ছেন হয়তো।
শিখা ফিশফিশ করে বলল, বাবা আমাদের সঙ্গে কোনও কথা বলছে না কেন রে দাদা?
আমি কী করে বলব! আমি বাবার মনের খবর কতটুকু জানি। সে জানেন আমার মা।
বারান্দা থেকেই দেখলাম ট্যাক্সি আসছে।
বিরাজকাকু ওপরে এসে দরজায় টোকা মারলেন। ভেতর থেকে গম্ভীর গলায় বাবা বললেন দাঁড়া খুলছি।
বেশ কিছুক্ষণ পরে বাবা বেরিয়ে এলেন। পরনে ধুতি, পাঞ্জাবি। চোখে সোনালি চশমা। চোখ দুটো গোলাপি লাল। পায়ে চকচকে জুতো। বাবাকে দেখে আমার ভীষণ হাসি পেল মনে মনে। বাবা যেন বিয়ে করতে যাচ্ছেন।
বিরাজকাকু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কি তোরা রেডি তো!
বাবা যেন কেমন কুঁকড়ে গেলেন, ওরাও যাবে নাকি!
যাবে না? মাকে দেখতে যাবে না?
বাবা হঠাৎ একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন। তোমরা কি পুলিশে ডায়েরি করিয়েছ?
বিরাজকাকু অবাক হয়ে বললেন, সে কী! ডায়েরি করব কেন? তোদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার। এ তো হতেই পারে।
বাবা বললেন, না, মারাও তো যেতে পারে।
তুই একটা পাগল! মাথায় সামান্য লেগেছে। তাতে মারা যাবে কেন?
বাবা মুখ নীচু করে কি যেন ভাবলেন, তারপর বললেন, আমি কী করেছিলুম, কেন করেছিলুম, কিছুই আর মনে নেই। আমাকে তোমরা ভুলতে দাও, আমাকে তোমরা শাস্তি দাও।
বিরাজকাকু এবার ধমকে উঠলেন, তুই খুব বাড়াবাড়ি করে ফেলছিস ঋভু। এখন তুই আবার ওসব খেলি কেন?
বাবা চাবুক খাওয়া মানুষের মতো চমকে উঠলেন। মুখে রাগ। শক্ত রেখা।
কী বললি! খেয়েছি কেন? বিরাজ হু ইজ মাই ফ্রেন্ড? কে আছে আমার? রঙ্গমঞ্চ খালি হয়ে যাওয়ার পর আমার পাশে কে থাকে? শেষ দর্শক চলে যাওয়ার পর কে থাকে? আমার পাশে কে থাকে? আমি থাকি। আমি যখন নির্জন রাস্তায় পায়ে-পায়ে বাড়ির দিকে ফিরতে থাকি তখন কারা আসে আমার পেছনে-পেছনে? এক পাল নেড়ি কুকুর। তখন মুগ্ধ দর্শকের হাততালি, তাদের বাহবা নয়, কুকুরের ঘেউঘেউ আমার পেছনে ফেরে! কেন ঘেউঘেউ? আমি যে অপরিচিত। মধ্যরাতের মাতাল। দীপা কি সেই কুকুরের একটি?
একী, একী কথা তুমি বলছ ঋভু?
ঠিকই বলছি। দীপা সেদিন আমাকে মাতাল বলেছিল। লম্পট বলেছিল। আমি নাকি থিয়েটারের ওই মেয়েটার সঙ্গে, যে জাহানারা সাজে, তার সঙ্গে রাত কাটাই। ফুল, ফুল, মূর্খ। জাহানারা আমার মেয়ে। চরিত্রের সঙ্গে জীবন না মেলাতে পারলে অভিনয় হয় বিরাজ। হয় না। অভিনয়, অভিনয় নয়? জীবন, জীবন। কে বুঝবে, কাকে বোঝাব?
বাবার সারা শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে। বিরাজকাকু বাবার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ঋভু তোকে আমরা বুঝতে পারিনি রে। তুই যে কত বড় কালই তার বিচার করবে। চল, চল। গাড়িটা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে।
০৫. হাসপাতালে গিয়ে বুঝলাম
হাসপাতালে গিয়ে বুঝলাম বাবা এখনও কী ভীষণ জনপ্রিয়। সমস্ত কর্মচারী, ডাক্তার, নার্স সবাই ছুটে এসেছেন। এমনকী রুগিরাও বিছানায় উঠে বসেছেন। স্টেজে বাবার একটা আলাদা নাম আছে। সারা শহরে মাঝে-মাঝে যখন পোস্টার পড়ে তখন সেই নাম দেখা যায়। নামের আগে একটা উপাধি থাকে–নটনারায়ণ চন্দ্রকুমার।
ডাকসাইটে অভিনেতাদের চাল-চলনই আলাদা। কখন মনকে গুটিয়ে রাখতে হয়, কখন ছড়িয়ে দিতে হয়, সবই যেন হাতের মুঠোয়। বাবা সোজা এগিয়ে চললেন দু-সার বেড়ার ফাঁক দিয়ে আমার পেছনে-পেছনে। এখন যেন আমার বেশ গর্ব লাগছে। যার বাবার এত সম্মান তার গর্ব একটু হবে না? হাসপাতালের কেউই জানে না মার কীভাবে লেগেছে। শুধু জানে সাধারণ ঘরের এক মহিলা হাসপাতালে এসেছে। পয়সার তেমন জোর নেই তার, ফ্রি বেডে রয়েছে। পেয়িং বেড বা কেবিনে থাকতে পারেনি। এইটুকুই যা লজ্জার। এত বড় একজন অভিনেতার স্ত্রী, তার তো কেবিনেই থাকা উচিত।
আমি জানতাম না, বাবা শুধু স্টেজেরই বিখ্যাত অভিনেতা নন, জীবনেও কত বড় অভিনেতা। জীবন আর অভিনয় যেন এক করে ফেলেছেন। মায়ের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে চারপাশ একবার ভালো করে দেখে নিলেন। বাবার চারপাশে আমরা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছি। মায়ের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। বিছানার পাশ থেকে সেই স্ট্যান্ড বোতল সব চলে গেছে। ও সবের এখন আর প্রয়োজন নেই। মায়ের মাথার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন সেই ভীষণ খিটখিটে সিস্টার। নরম একটা হাত মায়ের কপালে। বাবাকে দেখে মায়ের কপালে আদর ঢেলে দিচ্ছেন। বাবার প্রতি অনুরাগ তাঁকে মিষ্টি করে তুলেছে। কিছু দূরেই হাসি-হাসি মুখে ডাক্তারবাবু। গলায় স্টেথিসকোপ। এই প্রথম হাসপাতালের ডাক্তারবাবুকে হাসতে দেখলাম।
বাবা বললেন, এ কী? এ তুমি কী করেছ বিরাজ। একটা কেবিনের ব্যবস্থা করতে পারোনি? এইভাবে ফেলে রেখেছ এখানে? ডক্টর কেবিন নেই?
আজ্ঞে হ্যাঁ আছে। আপনি চাইলে না থাকলেও আছে।
প্লিজ আপনি এখুনি আমার স্ত্রীকে একটা কেবিনে সরিয়ে দিন। শি ইজ মাই ইনসপিরেশন। আমার যা কিছু সব ওরই জন্যে।
বাবা কথা কটা বলেই মায়ের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে সামান্য হেলে গিয়ে মায়ের একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিলেন। দু-হাতের মুঠোয় মায়ের হাত। বাবা ঘাড় ঘুরিয়ে মিষ্টি হেসে ধীরে ধীরে জিগ্যেস করলেন, কেমন আছ তুমি?
সত্যি বলছি, আমি এইসব দেখছিলাম একটু দূর থেকে। দেখে মনে হচ্ছিল, আমি কোনও নাটকের হাসপাতাল দৃশ্যে নায়ক-নায়িকার অভিনয় দেখছি। জানি না, কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক! বিরাজকাকু বলেছিলেন, তোর বাবা জীবন আর অভিনয়কে এক করে ফেলেছে। তাই হয়তো হবে। ডাক্তার বললেন, সিস্টার তাহলে ইমিডিয়েটলি রুগিকে কেবিন নাম্বার সিক্সে ট্রানসফার করার ব্যবস্থা করুন। আমি স্যারকে বলে পারমিশান করিয়ে আনছি।
বাবা একহাতে মায়ের একটা হাত ধরেছেন। আর-একটা হাত মায়ের গালে। বিছানার পাশে কোনও রকমে পেছন ঠেকিয়ে বসেছেন। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে দুজনের মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। দুজনে-দুজনের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বেশ বুঝতে পারছি বাবার দুটো চোখ ছলছল করছে। ভেতরটা কাঁদছে। কী জানি? এও অভিনয় কি না! যে জীবনে জীবন আর অভিনয় এক হয়ে গেছে সে জীবন কেমন যেন বিশ্বাস করা শক্ত। আর অবাক হয়ে এও দেখলুম মায়ের চোখে-মুখে কোনও ঘৃণা নেই, অভিযোগ নেই, রাগ নেই, অভিমান নেই। মায়ের ভাসা ভাসা বড়-বড় চোখ বেয়ে জল নেমে এসেছে মুক্তোর দানার মতো। আমি ভালোবাসার মুখ চিনি। মা যখন ভালোবেসে আমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়েন সে মুখ তো তখন আমি দেখেছি। মা বাবার দিকে ঠিক সেই মুখে চেয়ে আছেন। আমি পড়েছি কখনও কখনও নীরবতা ভাষার চেয়ে বড়। আজ তা চোখে দেখলাম।
শিখা কখন সরতে সরতে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ভয়ে ভয়ে বাবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। মা যে কতখানি কার সে জানে না। মা হয়তো জানেন। ডান হাত বাড়িয়ে শিখার হাত ধরেছেন। বড় সুন্দর দৃশ্য। কোথায় লাগে নাটক! একদিকে বাবা, একদিকে মা আর একদিকে শিখা। এর নাম পরিবার। সুখী পরিবার কি না বলতে পারব না। বিরাজকাকু একদিন বলেছিলেন, সুখ মানুষের মনে রে বিনু। বাইরে তার সন্ধান পাওয়া যায় না।
বাবা ডাক্তারবাবুকে জিগ্যেস করলেন, কবে ছাড়বেন?
দু-এক দিনের মধ্যেই।
বাবার মুখটা খুশিখুশি হয়ে উঠল। এও কি অভিনয়। হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। সত্য আর মিথ্যার ব্যবধান কোনও-কোনও জীবনে বড় সংকীর্ণ। আমার কী করার আছে। আমি এক দর্শক।
০৬. আজ আমার মা বাড়ি ফিরে আসবেন
আজ আমার মা বাড়ি ফিরে আসবেন। বাবা বাইরে গেছেন কয়েক দিনের জন্যে। কল শো আছে উত্তরবঙ্গের কোনও এক শহরে। বিরাজকাকুই দায়িত্ব নিয়েছেন হাসপাতালের সব দেনাপাওনা শোধ করে মাকে নিয়ে আসার। অনেক টাকা লাগবে। জানি না কে সেই টাকা দিচ্ছেন। বাবা না বিরাজকাকু।
হাসপাতাল থেকে ফিরে দুজনে সেদিন অনেক আলোচনা হয়েছে। সে আলোচনা থেকে ভবিষ্যতের কোনও চেহারা দেখেছি বলে মনে হয় না। সবই অনিশ্চিত। বাবা নাকি স্টেজ ছেড়ে যাত্রায় যাবেন। যাত্রায় এখন টাকা উড়ছে। ঐতিহাসিক আর পৌরাণিক পালা কলকাতার বাইরে এখনও নাকি বেশ জমে ওঠে। তা হয়তো হবে। আমি ও সব জানি না। তবে আমার যা মনে হচ্ছে, তা হল, একটা বড়সড়ো বুদবুদ তৈরি হচ্ছে, যে কোনও মুহূর্তে ফাটল বলে। আমার কেবলই মনে হচ্ছে, একটা খারাপ কিছু ঘটবে। সাংঘাতিক একটা ঘটনার মুখোমুখি হতে চলেছি। আমরা সেই জাহাজের যাত্রী যার ক্যাপটেন কম্পাস পড়তে জানেন না। আমার বাবা যখনই কিছু বলেন সবই মনে হয় এক একটি নাটকের সংলাপ। বাবার সমস্ত পরিকল্পনাই রঙিন ফানুসের মতো আকাশে উঠেই হারিয়ে যায়।
আমি সেই কবিতায় পড়েছিলুম, সে কবিতা বোধহয় আমার বাবাকে দেখেই লেখা :
কুশের ফুৎকারজাত বুদ্বুদের স্ফটিকমণ্ডল
চ্ছুরিত বর্ণচ্ছটা অন্তর্হিত হলে মহাকাশে
সনির্বন্ধ শিশু যথা ডুবে যায় অশ্রুর অতলে
বিশ্বের বৈচিত্র্য খোঁজে আপনার ভাবালু বিলাসে।
আমি এখন কবিতায়, উপন্যাসে, নাটকে আমার বাবা আর মাকে খুঁজি। খুঁজি এর শেষ কোথায়? শেষ দৃশ্যের শেষ সংলাপ এক-এক লেখকের কলমে এক-একরকম।
মা এলেন তার ফেলে যাওয়া সংসারে। মাথার চুল রুক্ষ। চোখ দুটো অসম্ভব উজ্জ্বল। বয়েস হয়েছে তবু আমার মা কত সুন্দর! আমার মায়ের পাশে থিয়েটারের সেই জাহানারা মাসি কি দাঁড়াতে পারবেন! তবে কেন ওসব কথা মাঝে-মাঝেই এ-সংসারে ভেসে আসে! কারা রটায়! কাঁদের স্বার্থ আছে এর পেছনে।
বিরাজকাকু বললেন, নিজের সংসার বুঝে নাও। আমি আদুরিকে এনে কয়েকদিন এখানে রাখছি। দিনকতক তুমি কোনও কাজ করবে না। যা করার আদুরি করবে।
আমি পারব। আমি ঠিক হয়ে গেছি।
তুমি বেঠিক কবে ছিলে! তুমি সব পারবে তাও জানি? তবে সেই পারাটা এখনও অন্তত সপ্তাহখানেক বন্ধ রাখতে হবে!
মা বারান্দায় একটা গোল চেয়ারে বসে পড়লেন। সামনেই বড় রাস্তা। লোকজন, গাড়িঘোড়া, দোকানপাট। মা সেই দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। আমার হঠাৎ মনে হল, আমরা সবাই এক একটা সাজাহান। এই জীবন হল এক-একটি দুর্গ। ঔরংজীব সেই ভাগ্য! সাজাহানদের জীবনের দুর্গে বন্দি করে রেখে সরে পড়েছে। আমাদের ইচ্ছে হল জাহানারা। তাকে সঙ্গী করে সারাদিন যত বিলাপ আর কান্না।
আদুরি এসে গেছে। বিরাজকাকু কয়েকদিন এ-বাড়িতেই থাকবেন। মনে একটা সুখ-সুখ ভাব আনতে চাইছি। আসছে কই? সব ব্যাপারটাই এত অনিশ্চিত, সমুদ্রের বালিতে বালি দিয়েই ঘর তৈরির মতো। এই আছে এই নেই। কার টাকায় কার সংসার কে চালাচ্ছে।
রাতে বিছানার শুয়ে মা জিগ্যেস করলেন, তোর বাবা কবে ফিরবে রে?
মায়ের মন থেকে সে রাতের লজ্জা আর অপমানের ভাবটা এখনও কাটেনি। ছেলে-মেয়ের সামনে মা মাথা উঁচু করে থাকতে চান। সেই মাথা বাবা এমন করে নীচু করে দিয়ে গেছেন! কারুরই গৌরব বাড়েনি। বাইরের চোখে বাবা কত বড়! আমাদের চোখে আজ কত ছোট। মা আর আমরা কোথায় কীভাবে দাঁড়িয়ে আছি, তা আজ খুবই স্পষ্ট।
কাল সকালেই তো আসার কথা আছে মা! সাজাহানের শেষ অভিনয় সামনের রবিবারে। পোস্টার পড়েছে শহরের দেওয়ালে। চ্যারিটি শো।
বিরাজকাকু বারান্দায় বসে আছেন। সিগারেটের আগুন দেখা যাচ্ছে।
মা বললেন, শুয়ে পড়ো এইবার। সারাদিন অনেক খেটেছ।
বিরাজকাকু হঠাৎ গান গেয়ে উঠলেন, সব মিছা কথা ভাবিতে যে ব্যথা, বড় লাগে প্রভু পরাণে। কেন বঞ্চিত হব চরণে।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। স্বপ্ন দেখছি, বিশাল এক ফঁকা মাঠ। কেউ কোথাও নেই। একটা জল টলটলে দিঘি। চারপাশে লম্বা লম্বা ঘাস। দূর থেকে হেঁটে আসছি। একটা ঝাকড়া গাছ। গোটা কতক ডাল নুয়ে পড়েছে জলের দিকে। গাছের ডালে-ডালে জরি বসানো রেশমের পোশাক ঝুলছে। রাজার পোশাক। ঝলমল করছে রোদের আলোয়। গাছের তলায় পড়ে আছে একটা মুকুট। দু-পাটি জরির কাজ করা নাগরা জুতো। একটা কোমরবন্ধনী পড়ে আছে সাপের মতো এঁকেবেঁকে। আমি ভাবছি এসব কার পোশাক। দিঘির নিথর জলে একটা ঢেউ গোল থেকে গোলাকার হতে হতে তীরের দিকে চলে আসছে। কেউ যেন এইমাত্র ডুব দিয়েছেন। আমি অনেকক্ষণ জলের দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটা মানুষ কতক্ষণ ডুবে থাকতে পারে। ঢেউ মিলিয়ে এল। দু-একটা ফড়িং উড়ছে জলের ওপর নেচে-নেচে। কেউই উঠছে না দেখে ছাড়া পোশাকের দিকে তাকাতেই দুটো পরিচিত জিনিস চোখে পড়ল। এতক্ষণ দেখতে পাইনি। একটা লাল সিগারেটের প্যাকেট, একটা সাদা লাইটার। দুটোই খুব চেনা। বাবা এই সিগারেটই খান। লাইটারটা জাহানারা মাসি বাবাকে জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন। আমি চিৎকার করে ডাকলাম–বাবা! আমার ডাক চাপা পড়ে গেল। দূরে মাঠের কিনারা দিয়ে একটা রেল চলেছে গুমগুম শব্দ করে বাঁশি বাজাতে-বাজাতে। আর ঠিক তখনই কোথা থেকে একটা ঝড়ো বাতাস উঠল। গাছের ডাল থেকে পোশাকগুলো একে-একে উড়ে গিয়ে জলে পড়ে ভাসতে লাগল। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে আবার ডাকলাম বাবা!
ঘুমটা ছাঁত করে ভেঙে গেল। সকাল হয়ে গেছে। বেশ সকাল। এখনও কারোর ঘুম ভাঙেনি। মা শুয়ে, পাশে শিখা। মেঝেতে আদুরি। ওপাশের ঘরে বিরাজকাকু। আমি দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালুম। আকাশে সামান্য ভেঁড়া-ঘেঁড়া মেঘ। শরৎ এসে গেছে। মনে হল নীচের রাস্তায় অনেক লোক। আমাকে দেখতে পেয়ে কে একজন বলে উঠলেন–
ওই যে, ওই যে।
আমি অবাক হয়ে রাস্তার দিকে তাকালাম। বেশ কিছু মানুষ। কারুর বগলে ভাঁজ করা বাজারের ব্যাগ। কারুর হাতে খালি দুধের বোতল। আমাকে তাকাতে দেখে একজন প্রশ্ন করলেন কোনও খবর পেলে?
কী খবর?
কখন আসছেন?
কে আসছেন? আমি খুবই অবাক হয়ে গেছি।
কেন তোমরা শোনোনি! ভোরের খবরে রেডিয়োতে বলেছে তো।
কী বলেছে?
জনতা স্তব্ধ হয়ে গেছে। বিরাজকাকু আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, রেলিঙে কনুইয়ের ভর রেখে। বিরাজকাকু জিগ্যেস করলেন, কী খবর? আমরা তো শুনিনি।
সকলেই তখন সমস্বরে বলে উঠলেন, প্রখ্যাত নট চন্দ্রকুমার ও চন্দ্রকুমারী দার্জিলিঙের কাছে পথদুর্ঘটনায় নিহত। আমরা গভীর বেদনার সঙ্গে জানাচ্ছি…।
আর কোনও কথাই আমার কানে এল না। খুব একটা দুঃখ নয়, কেমন একটা বিস্ময়ে মন ছেলে গেল। কী আশ্চর্য স্বপ্ন। কত স্পষ্ট! দিঘির জলে ঢেউ মিলিয়ে আসছে। রাজার পোশাক গাছের ডাল থেকে বাতাসে উড়ে-উড়ে জলে পড়ছে। সাদা একটা সিগারেট লাইটার, লাল একটা সিগারেটের প্যাকেট। কানে ভেসে আসছে, মাঝরাতের স্তব্ধ প্রেক্ষাগৃহ থেকে বাবার কণ্ঠস্বরে সাজাহানের সেই বিখ্যাত সংলাপ–
চেয়ে দেখ এই সন্ধ্যাকালে ওই যমুনার দিকে, দেখ সে কী স্বচ্ছ! চেয়ে দেখ ওই আকাশের দিকে–দেখ সে কী গাঢ়! চেয়ে দেখ ওই কুঞ্জবনের দিকে–দেখ সে কী সুন্দর!
আর চেয়ে দেখ, ওই প্রস্তরীভূত প্রেমা, ওই অনন্ত আক্ষেপের আপ্লুত বিয়োগের অমর কাহিনি আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। এখন দিন, তবু মনে হচ্ছে গভীর রাত। আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছে না, বাবারই এক বন্ধু, এক গুণমুগ্ধের মতো বলতে ইচ্ছে করছে–
হিরণ নদীর বিজন উপকূলে
আচম্বিতে পথের অবসান,
পরপারে নাম না-জানা গ্রাম।