বিয়ের গল্প

বিয়ের গল্প

১ — কাজী অফিস:

সুন্দর কোনো এক দিনের সকাল ১১:১৬। কান্ধে ব্যাগ নিয়া চা খাওয়া শেষ কইরা একটু বড় ডিস্টেন্সের হাঁটা দেবো বলিয়া ঠিক করিতেছি, এমন সময় খালি পেটে থাকা মোবাইলটা কান্না জুড়ে দিলো। খাইছে, খুবই আকাঙ্ক্ষিত নাম্বার, কিন্তু রিসিভ করতে ভুই পাই। অবশ্য রিসিভ নাই কইরাও থাকন যায় না। সবুজ বাটন টিপি দিলাম।

: হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম।
: এই বিয়ে করবা আমাকে? (আমি )

হাত থেকে মোবাইল পইড়া তিন টুকরা; কোনো মতে তুইলা নিয়া ঝাইড়া ফোন ফ্যাক্সের দোকানের দিকে দৌড়, এরপর ত্রিশ সেকেন্ড পরে দিলাম কল

: হ্যালো, তুমি ঠিক আছো? তুমি এখন কই? (আমার প্রশ্ন)
: আমি এখন মোস্তফার গলির সামনে দাঁড়িয়ে, বিয়ে করতে চাইলে আধা ঘন্টা সময় দিলাম চলে এসো। ফোন কেটে গেলো; এক মুহুর্ত চিন্তা করলাম, মানিব্যাগে হাত দিলাম; নাহ, আজকে এনেছি , ভেতরে ডেবিট কার্ডটাও আছে, বাঁচা গেলো , অটোরিক্সার দিকে দৌড় দিলাম….

: হেই হেই খালি…. চলো ফার্মগেট।
: যাওন যাইবো না ঐদিকে এক ট্রিপ মারতেই দিন পার হইয়া যাইবো জামে।
: এক ট্রিপেই তোমার ট্যাকা উঠায় দিমুনি, চলো চলো। ভ্রুউম ভ্রুউউম; সিএনজি ছেড়ে দিলো; ঠিক ২৪ মিনিটের মাথায় মোস্তফা গলির সামনে; দেখলাম রণাঙ্গিনী দাঁড়িয়ে আছে, হাতে একটা ছোট পার্স

(প্রথমে ওঁর প্রশ্ন)

: পরিচিত কোনো কাজি অফিস চেনো?
: তোমার কী মনে হয়, আমি আগেও কাজি অফিসে বিয়ে করেছি?
: ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলবা না, বিয়ে করতে এসেছো বিয়ে করে চুপচাপ আমাকে নিয়ে যাবা। (মেজাজ পুরাই ফরটি নাইন )

: আচ্ছা ঠিক আছে। কাছে বিজ্ঞান কলেজের গলিতে গেলে একটা কাজি অফিস চিনি দোতালায়, ঐখানে যাবা?
: চলো
: আচ্ছা চলো, তবে সেজান পয়েন্ট হয়ে যাই
: কেনো ওদিকে ঘুরে কেনো?
: বিয়ে করতে হবে না, টাকা লাগবে না? বুথ থেকে টাকা তুলবো।
: তোমার ডিবিবিএল এর বুথ হলিক্রসের সামনেও পাবা, ঘুরে যাওয়ার দরকার নেই চলো। (চোখ পাকিয়ে ঝাড়ি)
(ওভার ব্রিজ দিয়ে হাঁটছি, কিছুক্ষণ উসখুস করে জিজ্ঞাসা করলাম)

: তোমার বিয়ে করার সিদ্ধান্তে আমি যারপরনাই আনন্দিত; আচ্ছা বাসায় কী কিছু হয়েছে?
: (ওঁ চুপ)
: এই মানে বলছিলাম কী, বিয়ে করে কী তোমার বাসায় তুমি চলে যাবে?
: (কড়া ভাষায়) তুমি কী বলতে চাও? মেয়েরা কী বিয়ে করে বাবার বাড়িতে থাকার জন্যে বা যাবার জন্যে?
: না না না; তা তো অবশ্যই না। তবে কী না আমার বাসায় তো তোমাকে নেওয়া যাবে না (একটু রিস্ক আছে ), তবে এটা নিয়ে আমি চিন্তিত না, কতো ঘর-বাসা আছে। হুঁহ!

আমরা চুপচাপ হাঁটছি। আমি পুরোপুরি চিন্তিত না এইটা ঠিক না, প্রথম চিন্তা বিয়ের আগমুহুর্তে মত আবার না পাল্টায়; দ্বিতীয় চিন্তা, হঠাৎ এমন বিয়ের জন্য ডাকার কারণ কী?, তৃতীয় চিন্তা মাসের এই মাঝে বাসা ভাড়া পাওয়া যাবে না, ভালো হুটেলে থাকলে ট্যাকা যাইবো বর্ষাকালের গাঙের পানির মতো। এই চিন্তা করতে করতেই বুথের সামনে এসে দুজনে বুথে ঢুকলাম

: এই বিয়ে করতে কতো টাকা লাগতে পারে, কতো তুলবো? (আমার প্রথম প্রশ্ন)
: তোমাকে বলি নি আমি আগে বিয়ে করিনি, আমি জানি না? (রাগ পড়ার লক্ষণ কণ্ঠস্বরে, চিন্তিত বিয়ে করাটাই বাতিল না করে দেয় )
: আচ্ছা আচ্ছা, আমি শুনেছিলাম হাজার চারেক নাকি লাগে, আমি হাজার পাঁচেক তুলছি।
: অ্যাই শোনো সাক্ষীর বন্দোবস্তো তো হয় নি, তোমার কেউ আছে? (আবার আমার প্রশ্ন)
: আমি কাউকে আনি নি, আনবো না, তুমি ব্যবস্থা করো। এবং দয়া করে তাড়াতাড়ি করো, আমি টেনশন নিতে পারছি না।

ঠিক পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর কাজির সামনে। আমি আর ওঁ, সাথে দুই সাক্ষী। এক বড় ভাইরে অফিস থেকে ডেকে আনলাম, আর ফ্রেন্ডরে জজ কোর্ট থেইকা, সে আবার কিছুদিন হয় জাজ হিসেবে ঢুকছে। আইসাই তাঁর কথা, তোর শালা কপাল ভালো, সদরঘাট থেইক্কা রওনা দিলাম, রাস্তার জ্যাম নাই গাড়িতে পঁয়ত্রিশ মিনিটেই পৌঁছাইয়া গেলাম। বড় ভাইয়ের কথা, তুমি মিয়া পুরাই আনপ্রেডিক্টেবল , দুপুরের খাওন খাইতে যামু, এদিকে বিয়ার সাক্ষী হয়া গেলাম। কিছু নি খাওয়াইবা? (অবশেষে বিয়ে হয়ে গেলো, আর উত্তেজনা নিতে পারছি না, গল্পের বাকিটা পরের পর্বে। সবাই ভালো থাকবেন, আসসালামু আলাইকুম।)

২ — বিবাহত্তোর প্ল্যানিং:

বিয়া কইরা বাহির হইলাম। আল্লাহর অশেষ রহমতে কিছু টাকা বেঁচে গেলো। বড় ভাই (এবি) আমারে ট্যাকা দিতে দিলেন না। নিচে আইসা দাঁড়াইলাম। ওঁর রাগ পুরোপুরি শেষ, তবে যে মন যে খুশি তাও না। বিশাল রহস্যের চাদরে ঢাকা, এমতাবস্থায় না ঘাটানোই উত্তম কাজ।

: এখন কী করবা ঠিক করলা? (বড় ভাই নীরবতা ভাঙেন)
: আপাতত কিছু না, তয় নিজের বাড়ি যামু না এইটা সিওর।
: তো কই যাইবা?
: চলেন আপনাদের বিবাহত্তোর খানাপিনা করাই। চন্দ্রিমা উদ্যানের সামনে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আছে। খাবার ভালো, তয় দাম বেশি হওয়ার কারণে অনেক আগে একবার পেট ভইরা খাইতে পারি নাই, আইজ ট্যাকা আছে চলেন খাই।

: আইচ্ছা চলো।
: আমার বাসায় যাওন লাগবে। আব্বা শমন জারি করেছেন। (পাশ থেইক্যা বন্ধুর চিক্কুর)
: তো বিয়াটা খাইয়া তারপর যা।
: অতো খায় না, হুটেলের লোকের রান্না খামু না। যার বিয়া, তার বউয়ের হাতের রান্না খামু।
: যা তাইলে।

বন্ধু চলে গেলো। বড় ভাই গাড়ি নিয়ে আসছেন, সেটাতে চড়েই রেস্টুরেন্টের দিকে রওনা হলাম। সামনে ড্রাইভারের পাশে এবি। পেছনে নিশ্চুপ বাচাল আমি আর নিচুমুখে ওঁ। আবহাওয়ার রিপোর্ট পেন্ডিং। রেস্টুরেন্টে এসে স্বভাবস্বরূপ কোণার টেবিল দখল করলাম। বড় ভাই কথা কওনের সুযোগ দিয়ে চলে গেলো। যাবার আগে বলে গেলো….

: তোমরা অর্ডার দাও, আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। (সুযোগ দেওনের কী যুক্তি! ) বড় ভাই চলে গেছেন। আমি আর ওঁ। মেনু নিয়ে ওয়েটারকেও খেদিয়ে দিয়েছি। নীরবতা প্রথমে আমিই ভাঙি।

: বুঝলে এবি আমার চোখে দেখা সবচেয়ে ভালো মানুষদের মাঝে একটা। চরম একটা মানুষ। দেখছো, কথা বলার সুযোগ দিয়ে কেমন চলে গেলো?

: দেখেছি।
: শোনো, তোমার কী মন খারাপ?
: না, চিন্তায় আছি।
: আমি বুঝতে পারছি। এখন কী করতে চাও?
: ঠিক জানি না, তবে বাসায় যেতে হবে বাবা-মাকে জানাতে হবে।
: তা ঠিক বটে! (আমি চিন্তিত মনে বললাম )
: বাসায় খারাপ কিছু না হয়ে যায়, এই মার খেতে তোমার আপত্তি নেই তো? (চিন্তা বেড়ে গেলো, বিয়ের দিনে মাইর! )
: না না তোমার জন্য মার খাওয়া এ আর এমন কী? তোমাকে না মারলেই হলো
: আমি আমাকে না, তোমাকে নিয়েই চিন্তিত।
: হুম! (বড় ভাইয়ের আগমন)
: তোমরা এখনো অর্ডার দাও নি? ভালো আমি দিচ্ছি।
(বড় ভাই অর্ডার দিলেন, এরপর মুখ খুব কঠিন করে আমাদের দিকে তাকালেন)

: শোনো অর্ডার আসতে সময় লাগবে। এর মধ্যে কিছু কথা বলে নিই। বিয়ে করেছো, এটা নিয়ে কোনো মন্তব্য করবো না। প্রথম রাত কোথায় কাটাবে কিছু ভেবেছো? বৌমা তুমি বলো।
: পারমিশন ছাড়া তোমার কোনো কথা বলা যাবে না। (আমার দিকে কড়া ভাষায় তাকিয়ে)
: না (নতুন বৌয়ের শর্টকাট উত্তর)
: ভালো। আমি ঠিক করেছি তোমরা আমার বাসায় কাটাও।

ও বিয়েতে আসার সময় তোমাদের ভাবীকে বলে এসেছি সিচুয়েশন। বর্তমানে সে তাঁর দুই বোনকে নিয়ে ফুলশয্যা সাজানোর প্ল্যান করছে। সো প্রথম রাত তোমরা আমার বাড়িতেই কাটাচ্ছো। এবার বলো নিজ নিজ গার্ডিয়ানদের জানানোর ব্যাপারে তোমরা কে কী ঠিক করেছো? (আমার দিকে তাকিয়ে) তুমি আগে বলো।

: আমার প্ল্যান বাসা থেকে এম্নিতেই বেরুতে হবে, আমি সেটা নিয়ে চিন্তিত তা। কথা হইলো মাসের শ্যাষে বাসা ভাড়া পাওয়া যাইবো না, তাই আমরা ভালো কোনো হুটেলে দিনগুলো পার করতে পারি। এক ঢিলে দুই পাখি মারার নিয়তে আমার প্রস্তাব হইলো, এই হুটেলে কাটানোর সময়টা আমরা ঢাকার বাইরে হানিমুন কইরা কাটাই? আর বাসায় বলে দিবো যে, জরুরী একটা ট্যুরে যাইতেছি। সেখান থেকে আবার একটু প্রমোদ ভ্রমণে যাবো, আসতে দিন দশেক দেরি হবে….

: বুদ্ধি খারাপ না, গল্প বানাতে তোমার কষ্ট হবে না। আচ্ছা বৌমা তোমার কী অবস্থা? (এবির প্রশ্ন)
: আমি আজই জানাবো বাসায় গিয়ে। ও আর আমি। (বোমা বর্ষণকারী উত্তর)
: (নির্বিকার এবি বলেন) তাই ভালো। এখান থেকেই যাবা বলে ঠিক করেছো?
: জ্বি।
: ভালো। শোনো, আমি আমার গাড়ি দিয়ে যাচ্ছি। ড্রাইভারকে বলা আছে। ঢাকার ভেতরে সব জায়গায় যেতে পারবে। তোমার কী মনে হয় তোমার বাসায় যেয়ে কথা বলে ফিরে আসতে কতো সময় লাগবে? এখান বলে রাখি, আমি আশা করছি না, তাঁরা ব্যাপারটাকে সহজভাবে নেবেন।

: দু ঘন্টা (বৌয়ের শর্টকাট উত্তর)
: আচ্ছা দু ঘন্টা পর আমি কল দেবো ওর নাম্বারে (আমার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন)। (খাবার চলে এসেছে। খাবার খাচ্ছি। আপাতত বিদায়, আর আজ এই পর্যন্ত। পরবর্তীতে পর্ব পর্যন্ত এখানেই মূলতবি।)

৩ — শ্বশুরবাড়ির ক্লাইমেক্স:

চুপচাপ খাওয়া শেষ করলাম। নিজের বিয়ের খাওয়া হিসেবে বিলটা আমিই মেটালাম। রেস্টুরেন্ট থেকে নেমে বড় ভাই চলে গেলেন। গাড়ি নিয়ে সোজা শ্বশুন বাড়ির দিকে যাচ্ছি। গাড়িতে প্রস্তুতিমূলক কথাবার্তা হচ্ছে।

: বাড়িতে কোনো হিন্টস দিয়ে এসেছিলে? (আমার প্রথম প্রশ্ন)
: না।
: তাঁরা চমকে যাবেন না?

ওঁ এ কথার কোনো জবাব দেবার প্রয়োজন মনে করলো না। যা হোক বাকি পথ কথা হলো না। শ্বশুড় বাড়ির সামনে নামলাম। দরজার কলিংবেল চাপার আগে তাঁর কড়া হুশিয়ারি…

: প্রথমেই সালাম করতে যাবা না; মার খেলেও কিছু বলবা না, আমি মার খেলেও চুপ। আমার পত্রপাঠ সম্মতি জ্ঞাপন। শ্বাশুড়ি আম্মা দরজা খুললেন। আমার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে শুশ্বর আব্বার রুমে প্রবেশ। পেছনে কী হয়েছে! কী হয়েছে! বলতে বলতে শাশুড়ি আম্মার অনুসরণ ও কক্ষে প্রবেশ। (শ্বশুর-শাশুড়ির সামনে ওঁর প্রথম বক্তব্য)

: মা-বাবা, এই যে ছেলেটা দেখছো, একে কিছুক্ষণ আগে আমি বিয়ে করেছি। তোমাদের মতামত নেই, আমি জানি।

কিন্তু আমার যাঁকে পছন্দ তাঁর সাথে যেহেতু আমার বিয়ে তোমরা দিচ্ছো না, তাই ব্যাপারটা প্রতিশোধ ও অভিমানমূলক বলতে পারো, তবে সুবিবেচনাপ্রসূত। আর এটুকু জেনে রেখো এই ছেলেকে বিয়ে করে আমি ভুল করিনি, কারণ সে যোগ্য এবং আমাকে সে অনেক ভালোবাসে। শ্বশুর আব্বার হস্ত থেকে পত্রিকা ভূপাতিত হইলো। শাশুড়ি আম্মা টলায়মান অবস্থায় পাশ্ববর্তী টুলে আসন গ্রহণ করিলেন। শ্বশুর আব্বা এগিয়ে আসলেন, ও পঞ্চাশোর্ধ বলিষ্ঠ ডান হাতের চার আঙুল ওঁর গালে লেপে দিলেন। শক্তির বিনাশ নাই। কিছুটা গালে তাপশক্তি আকারে গাল লাল করে দিলো, কিছুটা শব্দ আকারে ঘর কাঁপালো, বাকিটা চাপ শক্তি আকারে ওঁকে ফেলে দিচ্ছিলো প্রায়। আমি চুক্তি মোতাবেক কাপুরুষের ন্যায় ওঁকে রক্ষা করলাম না, শুধু পড়ন্ত ওঁকে ধরে ফেললাম। সুন্দরভাবে দাঁড় করিয়ে একটু পেছনে সরে আসলাম। ভাবখান এমন, নেন এবার মারেন।

: ওঁকে নিয়ে বেরিয়ে যাও। (আমার দিকে তাঁকিয়ে শ্বশুর আব্বার হুঙ্কার) গ্রিন সিগনাল পাওয়ামাত্র আমি সবাইকে সালাম দিয়ে ওঁকে টেনে নিয়ে হিড় হিড় করে বেরিয়ে গেলাম। গাড়িতে উঠে লক্ষ্য করলাম ওঁর লাল গালে এক ফোটা অশ্রু।

: কই যাইবেন স্যার (ড্রাইভারের প্রশ্ন)
: রমনা পার্ক
: আইচ্ছা ত্রিশ মিনিট পর রমনা পার্কের এক বেঞ্চে বসে আছি দুজন। প্রথমে আমি-ই নীরবতা ভাঙি।

: খুব কষ্ট হচ্ছে? গাল জ্বলছে খুব?
: গালটা একটু জ্বললেও মনটা হাল্কা লাগছে। (আজব উত্তর)
: মানে?
: মনে আশংকা ছিলো খারাপ কিছু না হয়, শেষ পর্যন্ত হলো না বেঁচে গেছি।
: বুঝলাম না।
: মা হার্ট অ্যাটাক করে নাই, বাঁচছি। বুঝলে কিছু?
: এখনো তো সময় যায় নি।
: তখন না হলে এখন আর হবে না, কারণ তখন ছিলো চরম মুহুর্ত।
: অ
: অ্যাই মার্কেটে চলো।
: কেনো কী কিনবা?
: তোমার কী মনে হয়, আমি এই পার্সে করে আমার সব জামা-কাপড় নিয়ে চলে এসেছি?
: অবশ্যই না, অবশ্যই না। আফটার ইউ, মাই লেডি।

কেনাকাটা করতেছি। বিয়ের শাড়ি, শেরওয়ানি কিনতেছে না। কিনতেছে নরমাল পোষাক। থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম।

: বিয়ের শাড়ি কিনবে না?
: বিয়ের যখন নরমাল শাড়ি পরে করেছি, বাসরও নরমাল শাড়িতেই করবো।
: এটা কী বলো, এইটা কোনো কথা হইলো? বিয়ে রাস্তায় করছি, এখন বাসরও রাস্তায় করবো? গয়নাগাটি কিনবে না?
: না, এখন টাকার দরকার হবে। তবে তুমি চাইলে একটা রিং দিতে পারো। এই সব।
: আচ্ছা চলো।
ওর পছন্দমতো একটা রিং কিনলাম, চুপি চুপি পরিয়েও দিলাম। এবার বাসায় যাওয়ার মুহুর্ত। আমি বলি….
: শোনো গাড়ি দূরে পার্ক করা থাক। আমি বাসা থেকে ঘুরে আসি। কিছু জিনিস নিয়ে আসি, আর ট্যুরের গল্প সাবমিট করে আসি।

: কতোক্ষণ লাগবে?
: বড় জোর আধাঘন্টা। তুমি আবার কোথাও যেও না।
: কী আবোল-তাবোল বকছো? আমি কোথায় যাবো?
: তা তো জানি না, তবে পাওয়ার পরই আসে হারানোর ভয়।
: দর্শন না কপচিয়ে যাও। আমি ওয়েট করতেছি।
: আচ্ছা।

বাসায় আসলাম। মা দুপুরের ভাত বেড়ে রেখেছে। আমি ট্যুরের কথা বলার পর আকাশ থেকে পড়েন। জিনিসপাতি গোছাতে গোছাতে কথা হচ্ছে।

: বলা নেই কওয়া নেই কীসের আড্ডা দিতে ট্যুরে যাবা? কই যাবা? (তার প্রথম প্রশ্ন)
: এই দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গ। এক্সজাক্ট জেলা ঠিক না হইলেও টাইম ঠিক হয়েছে। ১০/১৫ দিন।
: এতো দিন?
: তুমি কী বলো? এইটা কোনো দিন হইলো তুমি জানো পায়ে হেঁটে মানুষ কয় বচ্ছর ধইরা ঘুরে?
: তোর যাওয়ার দরকার নাই।
: না না যেতেই হবে, কোনো উপায় নাই। কথা দিয়া ফেলছি। ভদ্রলোকের এক কথা। আসি আল্লাহ হাফেজ।
: ভাত খাইয়া তোর বাপের লগে দেখা কইরা যা।
: টাইম নাই, বইসা আছে। (এইটা সত্যি কথা )
ব্যাগ-প্যাক ঝুলিয়ে বেশ খানিকটা এসে আশেপাশে তাকিয়ে গাড়িতে উঠলাম। এবার সোজা এবির বাসায় যাবো।

: চলো
: শোনো, তোমার এবি ফোন দিয়েছিলো। বাসায় যেতে বলেছে তাড়াতাড়ি।
: কোনো সমস্যা?
: না, তোমাকে বলেছে, বউ নিয়ে প্রথম দিনই এতো ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘুরে বেড়াচ্ছো কেনো?
: এইতো এখনই যাচ্ছি।

এবির বাসায় ঢুকে দেখি সে বিশাল বড় ব্যাপার-স্যাপার। তাঁর দুই শ্যালিকাকে নিয়ে এবি ভাবী ঘর সাজাচ্ছেন। ঘরে ঢুকতেই খুব আনুষ্ঠানিকভাবে গদগদভাবে ওঁকে অন্য ঘরে নিয়ে গেলেন। বলে গেলেন একেবারে দেখা হবে বাসরে। আমার জন্যেও সারপ্রাইজ ছিলো। মোর বন্ধু এ বাসায় বসে আছে। সে আমাকে আরেকটা রুমে নিয়ে গেলো। এবির দায়িত্ব পড়েছে রান্নাঘরে, বেচারা। আয়োজকদের বড় জ্বালা।

: হুনো বন্ধু, তোমারে বিয়ার পোষাক পরাইয়া দিমু। খালি আন্ডারওয়্যার পইরা খাড়াইয়া থাকো। (বন্ধুর উক্তি)
: ফাইজলামি করো? তুই এইখানে আইলি ক্যামতে?
: আরে বাসায় যাওনের সময় মন খারাপ লাগতেছিলো।

খাওন হইলো না, আবার ছাইড়া আইলাম তোরে। এদিকে বাসায় বাপে বলে আমার কাজ নাকি অন্যেরে দিয়া করাইয়া ফেলছে, তাই আমার আর কাজ নাই। তোর কথা মড়ে পড়লো। সারা জীবন ব্ল্যাক পরিয়া গেলো, কিন্তু বিয়ার দিন যদি পোলাডা ব্ল্যাক শেরওয়ানি না পায়। এই দেখো বন্ধু, তোমার জন্য কালো শেরওয়ানী আনিয়াছি। একেবারে প্লেইন ব্ল্যাক। তয় পাগড়ী ব্ল্যাক পাই নাই তাই আনি নাই।

: আমি তো এ পরতে পারি না। যা পরে বিয়ে করিনি তা পরে ক্যামনে বাসর করি। তথ্যসূত্র: ওঁ। (দার্শনিক ধাঁচের উত্তর)
: এইডা কোনো ব্যাপার না, তাঁকেও বিয়ের ফরমাল ড্রেস পরানো হচ্ছে।
(এবির আগমন ও প্রথম বক্তব্য)

: শোনো ঐদিকে ঝামেলা কেমন?
: আজকে হামলা করবে না এইটা মোটামুটি সিওর। আর আমার বাসা জানে আমি এখন দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গের ট্রেনে।
: ভালো। তবে মোবাইল বন্ধ রাখবা না কারোর। তাহলে টেনশন বাড়বে।
: তা ঠিক বটে।
: তুমি বাসা থেকে কী কী আনছো?
: এই ব্যাগপ্যাক। এতে প্রায় সবই আছে। এবি, কালকেই চলে যাবো।
: কোথায়? হানিমুনে?
: জ্বে, তারপর আপনি এই ফাঁকে একটা বাসা আর সম্ভব হলে একটা চাকরি দেখে ফেলবেন।
: ভালো কথা মনে করেছো, তুমি এখন বৌকে খাওয়াবা কী?
: ব্যাংকে যা আছে ছয়মাস চলে যাবে। নেটের ফ্রিল্যান্স কাজটা আপাতত বাড়িয়ে দিতে হবে। আগে যা আসতো, এখন একটু বেশি আসবে।

: ওসব দিয়ে হবে না। চাকরি দেখো।
: আমিও তাই বলি। আপনি দেখেন। আমি তো হানিমুনে চাকরি খুঁজে বেড়াতে পারি না।
: তা বটে, তা বটে।
: হানিমুন থেকেই নিজের বাসায় উঠে যাবা? এ তো ভালো টাকার ব্যাপার।
: কী করবো, বউয়ের মান-সম্মানের ব্যাপার আছে না। এবি আপনে লাখ খানেক টাকা ধার দিয়েন।
: ফাইজলামি করো?
: না, ফাইজলামি না। তয় এগুলো ওঁরে নিয়া ঠিক করবো পরে। তবে আপনি রেডি থাইকেন। লাখ খানেকের ব্যাপারটা সত্যি হইবার পারে।

: হ, আমার বউরে নিয়া রাস্তায় বসি, আর তুমি আমার বাসায় উইঠা আসো। যত্তোসব, যাও মিয়া শেরওয়ানি পরো।
: জ্বে।
: তগো কথায় বাম হাত-পা কোনোডাই ঢুকাইতে পারলাম না, খালি হুইন্যাই গেলাম, আফসোস। (বন্ধুর শোকাক্তি)।
: ব্যাপারটা না। তোর শেরওয়ানি দে, পইরা নেই। (একটু চিন্তিত) আইজকা তুই এখানেই থাকবি?
: তাই মনে হইতেছে। তোরে কালকে উঠাইয়া দিয়া তারপর যামু।

: ভালো। (এবি ভাবীর আগমন, ও প্রশ্নবাণ)
: এই যে তুমি। বিয়ে করেছো, বউয়ের জন্য কেনাকাটা তো কিছুই প্রায় করোনি।
: উই করতে দেয় নাই ভাবী। আমার দোষ নাই। হেয় কয় বিয়ের মতো সবই হবে সিম্পল। উদাহরণ: ম্যাগি নুডলস।
: এই সব ফাজলামো করতে হয় না। বিয়ে কী বারবার করে কেউ?
: হুম! (মনে মনে কইলাম, অনেকেই করে )
: থাক হুম করতে হবে না। আমি সব গুছিয়ে এনে রেখেছিলাম। তোমার ভাইয়ের কলের পর শপিং করেছি। তুমি এখন তৈরি হয়ে নাও।
: ইয়া আলী! (এবিরে পুরা পথে বসায় ছাড়ছে মনে হইতাছে)।
: আলীর কথা আসলো কেনো আবার?
: তোমার আন্তরিকতায়।
: থাক, ঢং করা লাগবে না।

(বাসর ঘরে ঢোকার সময় হয়েছে অবশেষে। যেহেতু নিয়মতান্ত্রিক বিয়ে না, তাই বাসর তুলনামূলক আগেই শুরু হচ্ছে)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত