আমি এখন পতিতাপল্লীতে। মাসীর ঘরে একটা সোফায় বসে আছি। আমার পাশে আরও দুজন মেয়ে বসে আছে। মাসী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন সবাইকে ডাকতে হবে? আমি বললাম হুমম। এখানেতো অনেকগুলো মেয়ে মাসী জানালো। থাকুক আমরা দশদিন আপনাদের সাথে কাজ করবো। আশাকরি সহযোগিতা করবেন? মাসী জানালো কোনো অসুবিধা হবেনা। তার আগে আমার পরিচয় জানিয়ে দেই, আমি তৃণা হাসান। একটা প্রজেক্টে কাজ করছি প্রজনন স্বাস্থ্যনিয়ে। তার ফলশ্রুতিতে পতিতাদের নিয়ে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। প্রথমে অনেককেই এ দায়িত্ব টা দিয়েছিলেন বস, কিন্তু পতিতাদের কাছে যেয়ে কাজ করতে কেউ রাজী হননি।নিরুপায় হয়ে বস আমাকে যখন দায়িত্বটা দিলেন। আমি এক কথাতেই রাজী হয়ে গেলাম। বস অবাক হয়ে বললেন, এতো আগ্রহ কেনো, ভয় পাচ্ছোনা এই কাজটা করতে?
আমি বললাম, ভয় পাবো কেনো?বস বললেন, পতিতা পল্লীতে যাচ্ছো, নিশ্চয়ই কেউ ভালো চোখে দেখবেনা? আমি কন্ঠে দৃঢ়তা এনে বললাম, আমি ওদেরকে কাছ থেকে জানতে চাই, ওদেরকে জানার খুব ইচ্ছে আমার, আর এই কাজে সহযোগিতা করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। বস বললেন, তা ধন্যবাদ কেনো? স্যার, এমন একটা সুযোগ আমাকে দেওয়ার জন্য। এবার হাসলেন বস, আমি চাই তুমি সফল হও তৃনা। তোমার আগ্রহ এবং আন্তরিকতা দেখে খুব খুশী হলাম।কাজে নেমে যাও, সব ধরনের সহযোগিতা পাবে।রানী এবং রুবিকে নিয়ে শুরু করলাম কাজ, সাথে মিঠু আর অয়ন। সবাই খুব চটপটে।
আমরা মেয়েরা ভিতরে এসেছি। অনেক মেয়ে সবার সাথে একে একে পরিচিত হচ্ছি। হঠাৎ করে একটি নাম শুনে চমকে গেলাম ইরাবতী! আমি ভালো করে চোখ তুলে দেখার আগেই মেয়েটি ঘোমটার আড়ালে নিজেকে লুকোলো। ভালো করে দেখা যাচ্ছেনা, তবে ঘোমটার আড়ালে ঠোঁটের বাম পাশে বেশ বড় একটা তিল দেখতে পেলাম। মেয়েটি দ্রুত চলে গেলো। বাকী মেয়েগুলোর সাথে পরিচয় হলাম। সন্ধ্যা নাগাদ আমাদের কাজ চললো।মাসীকে বলে এলাম পরদিন দুপুরে সবাই একসাথে খাবো।
রাতে বার বার কেনো জানি ইরা নামটা কানে বাজছিল। আর চোখে ভাসছিল ঠোঁটের কোনে সেই তিল। মনে মনে ভাবছি, আগামীকাল ভালো করে জানতে হবে এই ইরা মেয়েটি কে? কী তার পরিচয়? আমার উশখুশ দেখে পিয়াস বললো কি ব্যাপার তৃনা, এতো অন্য মনস্ক কেনো? ঘরে মন থাকেনা? মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো । পিয়াস আমার স্বামী, আমার চাকুরী করা একটুও পসন্দ করেনা। আমি কখনও সংসার বাদ দিয়ে অফিসে সময় দেইনা। তবুও পিয়াস কেনো এমন করে বুঝিনা? তুমিও তো অফিস থেকে অনেক দেরী করে আস আমিতো কৈফিয়ত চাইনা? তাহলে আমার বেলায় কেন এতো দোষ? শোন, এতো তর্ক করবেনা। পুরুষরা বাইরে কাজ করবে, রাত করে বাসায় ফিরবে এটা স্বাভাবিক, তাই বলে মেয়েদেরও এসব করতে হবে তা কেন? মেয়েদের এই ধরনের কাজে মানায়না বলেই পাশ ফিরে শুয়ে পরে পিয়াস। আমিও মন খারাপ করে ঘুমিয়ে গেলাম।
পরদিন ঘুম থেকে উঠে দ্রুত নাস্তা বানালাম, সাথে সাহায্য করলো হাসি। হাসি আমার সংসারের প্রায়ই সব কাজ করে। অনেক ভালো মেয়ে, ঘরের কাজে সাহায্য করার জন্য মা ওকে পাঠিয়েছে। আমাকে আপামনি বলে ডাকে। ও দেখতে সুন্দর না বলে মনে অনেক দুঃখ। আমি ওকে বলি দেখিস হাসি, তোর জন্য একদিন রাজপুত্র আসবে ঘোড়ায় চড়ে, তখন ও ফিক করে হেসে ফেলে। নাস্তা বানানো শেষ হলে আমি হাসিকে টেবিলে খাবার দিতে বলে, অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিলাম।
পিয়াসকে ডেকে টেবিলে বসালাম, নিজের হাতে ওকে খাবার তুলে দিচ্ছি পিয়াস চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছে , আমি বললাম রান্না ভালো হয়নি? হুমম, বলেই আবার খেতে শুরু করলো। এবার আমি কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম বউ কিছু রান্না করলে ভালো না হলেও প্রশংসা করতে হয় জানেন তো? এবার পিয়াস আমার দিকে তাকালো বললো আসলেই ভালো হয়েছে । তাহলে এবার একটু হেসে কথা বলো। সারাদিন দুজনে বাহিরে কাজে যাবো এমন গম্বীর থাকলে ভালো লাগবে ? কাজে মন বসবে? পিয়াস একটু হাসলো ঠিক আছে । নাস্তা শেষ করেই দ্রুত অফিসে চলে এলাম। বসের সাথে দেখা করে রুবি রানী অয়ন মিঠু সহ বেড়িয়ে এলাম। পতিতাপল্লীতে এসে মাসীর ঘরে বসলাম।
বুঝতে পারলাম ওদেরকে নিয়ে কাজ করা অতো সহজ নয়, কারন নিয়মিত ওদের যা কাজ, তা বাদ দিয়ে আমাদের সাথে বসা কিংবা সময় দেওয়া একটু কঠিন বৈ কি । তবে দিনের বেশীর ভাগ সময় ওরা ফ্রি থাকে , কারন, অন্ধকার জগতের সুখ নিতে আঁধারেই আসতে হয় মুখোশ পরে।তাই সেই ফ্রি সময়টুকু ভরসা। আজ সবাইকে একসাথে লাগবে কারন, কিছু স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে, তার পর সবাইকে বিভিন্ন সচেতন মূলক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। পরীক্ষার জন্য আলাদা টিম কাজ করবে, এখনি চলে আসবে ওরা। আমাদের টিম চলে আসছে। আমার চোখ ইরাকে খোঁজছে। যদি সেই হয় তাহলেতো আমাকে দেখলে আসবেনা। কি করবো তবে? রুবি বললো আপু কিছু কি ভাবছো? আমি ওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে বললাম আমার কিছুক্ষনের জন্য বেরোতে হবে তুমি ম্যানেজ করো। রুবি ঘাবড়ে গেলো, খুব জরুরী?
না গেলে হয়না? আপনি ছাড়া এগুলো ম্যানেজ করা অসম্ভব? আমি চলে আসবো, ভয় পেয়োনা ওকে আশ্বস্ত করে বেরিয়ে এলাম। আমি মনে মনে খুব উত্তেজিত ছিলাম , এটা যেন সেই না হয়। আমি দুপুরের আগেই চলে এলাম কারন লাঞ্চের সময় থাকতে হবে। যদিও রুবি রানী দুজনেই মুখ ভার করে বসে আছে । আমি কান ধরে সরি বলতেই, ওরা হেসে ফেললো। সবাই খাবার টেবিলে বসে গেছে আমি মাসীর কাছে বসেছি, তাকিয়ে দেখলাম একটি চেয়ার বাকী, চুপি চুপি মাসীকে বললাম একজন মনে হয় বাকী আছে। কে আসেনি দেখেনতো? মাসী বাজখাই গলায় বলে উঠলো এই টগর দেখতো কে আসেনি? যা এখনি ডাইক্যা আনবি। কিছুক্ষন পর টগর ফিরে এসে জানালো ইরাবতী আসেনাই, তার শরীরডা ভালো না।
মাসী রেগে গিয়ে বললো আমার কথা বলোস নাইকা তারে আমি আইতে কইছি ? কইছিতো, হের শরীরডা ভালা না, তাই আইতে পারবো না কইলো। মাসী রণরঙ্গিণী বেশে উঠে দাঁড়ালো হারমজাদী পাইছেডা কি .. এমনিতে রোজগার কম করে তার আবার ঢং কতো? আইজ তোর ঢং ছুডামো? আমি মাসীর হাত ধরে থামালাম, বললাম শরীর খারাপ হতেই পারে এতো রাগ করবেন না। আমি বরং ওর ঘরে খাবারটা দিয়ে আসি। আতকে উঠলো মাসী, আরে করেন কি আপনে বসেন আমি ওরে এক্ষনি ডাইক্যা আনি। বললাম ডাকতে হবেনা , আপনি সবাইকে নিয়ে খেতে বসে যান। আমাদের টিমের সব কজন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! আমি সব খাবার একটু একটু করে বেড়ে নিয়ে টগরকে বললাম চলুন। যাবার আগে আমাদের সবাইকে বললাম শুরু করার জন্য।
টগর আমাকে একটা রুমের সামনে নিয়ে গিয়ে বললো এই রুমে থাকে, ডাকবো? আমি আস্তে করে করে বললাম না, আপনি গিয়ে খেতে বসুন। টগর চলে যেতেই আমি ভেজানো দরজা খোলে রুমে ঢুকলাম। খোলা জানালায় বাইরে তাকিয়ে আছে ইরাবতী, পিঠে একরাশ ঘন চুল ছড়িয়ে আছে। আমি নিঃশব্দে খাবারগুলো টেবিলে রেখে ওর পিছনে দাঁড়ালাম, ডাকলাম ইরাবতী ? শুনতে পেলোনা, এবার ডাকলাম নুপুর! চমকে পেছন ফিরলো! দু চোখ বেয়ে অশ্রু সারা গাল ভিজিয়েছে । মিষ্টি ঠোটদুটো তির তির করে কাঁপছে , আমি হতবাক হয়ে গেলাম!! একি দেখছি! ! স্বপ্ন নাতো! ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে আছে আমার পানে। সেখানে প্রাণ নেই। রক্তশুন্য ফ্যাকাশে সেই মুখ, হঠাৎ ঢলে পরলো।
দৌড়ে ওর কাছে গিয়ে ধরে বিছানায় সোজা করে শুইয়ে দিলাম। মুর্ছা গেছে মনে হলো।পালস দেখলাম দ্রুত চলছে, শরীর ঘেমে যাচ্ছে। শরীরের কাপর চোপরগুলো ঢিলে করে দিলাম তারাতারী, পায়ের নীচের বালিশ দুটো দিয়ে পা উঁচু করে দিলাম। তারপর কাঁধে হালকা একটু ঝাঁকুনি দিয়ে ব্যাকুল হয়ে ডাকলাম নুপুর, নুপুর , নুপুর, দেড় মিনিটের মধ্যেই ও সাড়া দিলো আহঃ করে।
এবার আমার মাথার বোঝাটা নেমে গেল। আতংক কাটিয়ে মনের স্বস্থিতে উঠে পরলাম। একটু পানি নিয়ে মুখটা পরিস্কার করে রিকভারী পজিশনে শুইয়ে দিলাম।পালস্ এখন স্বাভাবিক। প্রচণ্ড মানসিক টেনশনে এমন হয়েছে বুঝলাম। চোখবুজে কাত হয়ে শুয়ে আছে ও , আর আমি ? পতিতাপল্লীর এক পতিতার ঘরে, তার ব্যক্তিগত বিছানায় বসে, বুকের ভিতরে ছাইচাপা আগুন নিয়ে, এক সাগর বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি, এক পতিতার মুখের দিকে!! কাকে দেখছি এভাবে? সেই চপলা কিশোরী নুপুর, না এক পতিতা ইরাবতী??? সেই মিষ্টি ঠোঁট সাথে ভুবন ভুলালো তিল, যা প্রথম দেখলেই নজরে পরতো সবার। তিল বলতোনা কেউ, বিউটি স্পট বলতো। আমিতো ওকে তিশা বলে ডাকতাম, রেগে যেতো ও এই নামে ডাকিস কেনো? আমি কি নায়িকা হবো? হেসে ফেলতাম আমি, হুমম তুই যা সুন্দর না, নায়িকাই হবি।
তখন ও নরম হয়ে বলতো, হবো নায়িকা, তবে নাটক সিনেমার না আমার স্বপ্নের রাজার। শুধু নির্জরের নায়িকা আর ওর ভালোবাসার স্বপ্নের বধু হবো। সেইসময় ওর চোখে মুখে উপচে পরতো এক আত্মপ্রত্যয়ি প্রেমিকার সুদৃঢ় প্রত্যয়। আচ্ছা, নুপুরের নির্জর এখন কোথায় আছে? আর নুপুর ই বা এখানে এলো কিভাবে? চোখবুজে নুপুর শুয়ে আছে। আর কষ্টি পাথরে খোদাই করা একবুক কষ্টের পর্বত নিয়ে আমি চলে গেলাম বার বছর আগের ঝলমল সেই গুলিতে এস, এস, সি পরীক্ষা শেষে আমি বেড়াতে গেছি খালার বাসায় চিটাগাং, আর নুপুর এসেছে চাচার বাসায়। একই বিল্ডিং এ পাশাপাশি ছিলাম আমরা। খালার সাথে নুপুরের চাচীর খুব ভালো সম্পর্ক। আমি খালাতো বোনের সাথে লুডু খেলছিলাম ঠিক তখনি নুপুর এলো, এসেই বলে তুমি বুঝি তৃনা? আমি নুপুর অনুদের বাসায় থাকি। আমি বললাম কেমন আছো? আর আমার নাম জানলে কি করে? নাম জানা কোন ব্যাপার নাকি? তবে তোমার কথা চাচী বলেছে।
তোর বয়সী একটা মেয়ে এসেছে, তোর সংগী হবে এখন থেকে বলেই থামলো নুপুর। আমি মাথা নেড়ে বললাম, হুমম আজ থেকে আমরা সখী হলাম।এতোদিনে আমারও বেড়ানোর সাথী হলো বলেই দুজনে হাত এক ঘিট দিলাম। দুজনের এমন হলো, এক সাথে খাওয়া ঘুমানো গল্পের বই পড়া। রাতে ঘুমানোর সময় নুপুর আমার চুলে বিলি কেটে দিতো আর গান গাইতো, আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশী কিনে এনেছি….প্রতিদিন ওর গান শুনে ঘুমাতাম। দুজনে ফয়েজ লেক বইমেলা সী বীচ কতো জায়গায় বেড়াতে গিয়েছি। রাত জেগে ও নির্জরকে চিঠি লিখতো, পরদিন সকাল বেলা দুজনে পোষ্ট করে আসতাম। কখন কিভাবে সময় কেটে গেলো বুঝিনি। রেজাল্ট বের হবার আগেই নিজেদের বাড়ীতে ফিরে যাই। নুপুরদের বাড়ী খুলনার বাগের হাটে আর আমি ঢাকায়,। আবার দেখা হবে আমাদের ইন্টার পরীক্ষার পর। সেই অপেক্ষায় ফিরে গেলাম যে যার গন্তব্যে।
দুজনে দুজায়গায় থাকলেও আমাদের নিয়মিত চিঠি আদান প্রদান হতো। ইরার চেহেরা তিশার মতো বলেই আমি ওকে তিশা নাম দিয়েছিলাম। ইরার চিঠিতে শুধু নির্জরের কথা লেখা থাকতো, আর নির্জরই ওকে ইরা নাম দিয়েছিলো। নুপুরের অনুরোধ ছিলো আমিও যেনো ওকে ইরা নামেই ডাকি। তারপর থেকে আমিও ওকে ইরা বলেই ডাকতাম। আবার আমাদের দেখা হলো ঠিক দু বছর পর, ইন্টার পরীক্ষা শেষ করে চিটাগাং এসে। আমাদের বন্ধুত্ব যেনো জনম জনমের, এতো কথা দিন রাত বলেও ফুরোয় না।
মামী এবং চাচী দুজনেই হাসেন কি এতোদিন কেমনে ছিলা মানিক জোড়েরা? ইরা কথা বলতো এতো মিষ্টি করে শুধুই শুনতে ইচ্ছে হতো। সারাদিন শেষে রাতের বেলা দরজা বন্ধ করে ও নির্জরকে চিঠি লিখতো, লেখা শেষ করে আমায় পড়তে বলতো। আমি পড়ে পড়ে টিপ্পনী কাটতাম, ও রেগে গিয়ে কান ধরে বলতো, আর যদি তোকে দেখাই? আমিও ভেংচি কেটে বলতাম, দেখার জন্য আমার বয়ে গেছে? কিন্তু পরদিন আর ওসব মনে থাকতোনা, আবারও লিখেই আমায় দেখাতো, আর আমিও প্রবল আগ্রহ নিয়ে প্রতিটা শব্দ অভিনয় করে করে পড়তাম। প্রতিটা রাতেই একটা গান শুনাতে আমি মেলা থেকে তাল পাতার এক বাঁশী কিনে এনেছি… গান শুনতে শুনতে কখন ঘুমের রাজ্যে চলে যেতাম টেরই পেতাম না।
এ গান শুনেই আমার ঘুম এসে যেতো, রুটিন ছিলো প্রতিদিনের। মাঝে মাঝে হঠাৎ করে বলতো আচ্ছা তৃনা, আমি যদি কোনদিন হারিয়ে যাই আমাকে ভুলে যাবিনাতো? আমি ওর মুখ চাপা দিয়ে বলতাম, তুই হারাবি কেনো? আমরা চিরদিন এমন মানিকজোড় হয়েই থাকবো। তোর নির্জরও তোকে কেড়ে নিতে পারবেনা আমার কাছ থেকে। কেমন করে দিনগুলো কেটে গেলো জানিনা। কদিন পরই রেজাল্ট বেরোবে, তাই বাড়ী ফেরার পালা।দুজনেই কেঁদে কেটে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছি।জানিনা আবার কবে দেখা হবে আমাদের? সিদ্ধান্ত নিলাম রেজাল্ট বের হলে দুজনে এক জায়গায় ভর্তি হবো। সেই রাত আর ঘুমাইনি, শুধুই কান্না করেছি দুজনে। বাড়ীতে আসার কদিন পর রেজাল্ট হলো। কিন্তু ইরার খবর পাচ্ছিলাম না। আমি খুব চিন্তায় ছিলাম ইরার খবর না পেয়ে। ওর কি খবর? পাশ করেছেতো?
তাহলে আমার সাথে যোগাযোগ করছেনা কেনো? চিঠি লিখেও জবাব পাচ্ছিনা, কি করবো? অনেক টেনশনের পর মামীর কাছ থেকে খবর পেলাম, ইরা এক সাবজেক্ট ফেল করেছে, এটা নিয়ে ওদের বাড়ীতে অশান্তি চলছে। আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো, সান্তনা জানিয়ে লিখলাম তবুও কোন উত্তর পেলামনা।ভাংগা মন নিয়ে ভর্তি হলাম মেডিকেলে। ইরাদের সেই আত্নীয় কোথায় বদলী হয়ে গেছে, মামাও চলে আসছে ঢাকা। ওর সাথে যোগাযোগের আর কোন পথ রইলো না বলে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। আমি হোষ্টেলে থাকি ছুটি ছাটায় বাড়ী আসি। আমি তখন দ্বিতীয়বর্ষে পড়ি, বাড়ীতে এসেছি মা আমার হাতে একটা চিঠি দিয়ে বললো ইরা লিখেছে তোর বান্ধবী। লিখেছে, তৃনা অনেক দেখেছি, অনেক দেখছি, আরও দেখবো তোর মতো কেউ নেই সখী আমার। তোর তুলনা তুই নিজেই , আমার তপ্তপ্রানে শীতল ছোঁয়া শুধুই তুই, ভুলে যাস এই অযোগ্য সখীরে মনে রাখিসনা কিছু। ক্ষমা করে দিস।
আর মাকে লিখেছে খালাম্মা, সালাম নিবেন। আপনার না দেখা অযোগ্য মেয়েটির এই চিঠিটা তৃনার হাতে পৌছে দিবেন ও যেখানেই থাকুক। ওকে বলবেন আমাকে যেনো আর চিঠি না পাঠায়।মা ইরাকে দেখেনি কোনদিন শুধুই আমার কাছে শুনেছে। আমার কাছে শুনেই মা ওর প্রতি দুর্বল। আমি চিঠি পাঠাতাম নির্জরের ঠিকানায়। তারপর ওকেন চিঠি লিখেও জানতে পারিনি ওর খবর। কতো দেখতে চেয়েছি ওকে, নির্জরের বউ সাজলে ওকে কেমন লাগবে কল্পনা করতাম । মনে মনে ভাবতাম যেনো ওর সাথে আমার দেখা হয় এজনমে… আবার হলো দেখা বারটি বছর পর অন্ধগলির নিকোষ কালো কুঠরিতে…. এভাবে কেনো হলো দেখা?? দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চোখের জল মুছে যখন বাস্তবে ফিরেছি… দেখলাম ইরা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ভেজা চোখে….আমার বুকের ভিতরে হাহাকার করে উঠলো।
কখন চোখ মেলেছে বুঝিনি, দেখতে পাইনি। ওর ভিতরে কি হচ্ছে তা জানিনা, কিন্তু আমার ভিতরে কালবৈশাখী ঝড় তান্ডব চালাচ্ছে, নিজেকে স্থির রাখতে পারছিনা। এতো বছর ধরে যাকে মন প্রাণ দিয়ে খোঁজছিলাম, সে আজ আমার সামনে আছে অথচ কোন অন্ধকারে নিমজ্জিত অচেনা ভূবনে…। নিজেকে সামলে নিয়ে জড়িয়ে ধরতেই, ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো আমাকে, না না আমায় স্পর্শ করবেন না। আমার ছোঁয়ায় আপনি কলংকিত হবেন না । আমি নর্দমার কিট নোংরা হয়ে গেছি, পঁচে গেছি, আমি বাজারের বেশ্যা, আপনি তারাতারী চলে যান অন্ধ গলি থেকে।আমাকে আমার মতো থাকতে দিন, চলে যান আপনি বলেই আর্তনাত করে উঠলো।
আমি ওকে ধরে বললাম ইরাবতী, তুমি যে পরিচয়ই হওনা কেনো, তবুও তুমি আমার সখী। চিৎকার করে উঠলো ইরা, এ নামে আমায় ডাকবেন না, আপনি ভদ্রসমাজের বাসিন্দা, আপনার মুখে এ নাম শোভা পাবেনা। এ নাম শুধু একজন দেহজীবিনীর তার খদ্দেরের জন্য শোভা পায়। ওর কথা শুনে আমার বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছিলো। দুচোখের জলে গাল ভেসে যাচ্ছে, নুপুর তুই এখানে কেনো? আজ তোর এই অবস্থা কে করলো? এবার নুপুর কিছুটা শান্ত হলো, যে নুপুরকে তুই খোজঁছিস সে বারটি বছর আগে মরে গেছে, আজ যাকে দেখছিস সে নুপুরের ফসিল। আর আমি এখন ইরাবতী। তোরা যাকে বেশ্যা বলে জানিস। একটু পরেই মুখে রং মেখে দাঁড়াব একাধিক পুরুষের জৈবিক চাহিদা মিটানোর জন্য।
আমি আজ কোন একজনের স্বপ্নের বধু নইরে. আমি এখন বারবধু! তুই চলে যা, আর কখনও আমার সামনে আসিস না। তুই সমাজে একটা সম্মান নিয়ে থাকিস কেউ যদি জানে একজন বেশ্যা তোর পরিচিত তাহলে সম্মান কমবে বৈকি? সবাই জানার আগেই তুই চলে যা। আমি চোখের জল মুছে বললাম না যাবোনা। আমি আমার সখীকে অস্বীকার করবো সমাজের ভয়ে? কিছুতেই না। আমি তোর সব কথা শুনবো, তারপর এখান থেকে তোকে নিয়ে যাবো। জানিস, আমি তোকে কতো জায়গায় খোঁজেছি, কতো কথা বলার ছিলো তোকে, বলতো? কেমন করে হারিয়ে গেলি আমার কাছ থেকে? আজ এতোদিন পরে তোকে পেলাম আমার কি যে…থামিয়ে দিলো ইরা আমাকে.. নিশ্চয়ই নুপুরকে খোঁজছিলি ইরাবতী নামের কোন পতিতাকে নয়? শোন তৃনা, আর সময় নষ্ট করিসনা চলে যা। তোর যে কাজ তা শেষ কর, কিন্তু কোন উছিলায় কখনই আমার সামনে আসবিনা।
যদি আসিস এই ইরাবতীর মরা মুখ দেখবি। আর একটা কথা, তোর সাথে আমার কবে কোনজনমে, পরিচয় ছিলো একথা কাউকে বলবি না। এবার বেড়িয়ে যা, আমাকে অনেকটা ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বেড় করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে ফেললো। আমার শরীরটা অসাড় হয়ে আসছিলো, টেবিলে ওর খাবার রাখা আছে, খাবে কিনা? আমি দরজায় টোকা দিয়ে বললাম, খাবার গুলো খেয়ে নাও নুপুর। খাবো খাবো, না হলে নাগরের মন ভরাবো কেমনে ভেতর থেকে বললো ইরা। ওর কথায় এতো ঝাঁঝ এতো কঠোরতা ছিলো, যা আমার শরীরে বিষাক্ত তীরের মতো বিধছিলো। একবুক যন্ত্রনা আর হতাশা নিয়ে ফিরে এলাম ওখান থেকে। আপাতত চলে এলাম, তবে আবারও দেখা হবে ইরাবতীর সাথে।