–তারমানে তুমি আমাকে ভালোবাসতে? ইরা বিস্ফোরিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি সামান্য হেসে বললাম
: সন্দেহ কি! আমি এখনো তোমাকেই ভালোবাসি।যাবে আমার সঙ্গে?
–তুমি একটা বিবাহিত মেয়েকে পালিয়ে যাওয়ার কথা বলছ? ইরার বিস্ময় এখন অবিশ্বাসে পরিনত হয়েছে। আমি ওর মুখের প্রতিটা অভিঃব্যক্তি পড়তে পারছি। মেয়েটা মারাত্মক দ্বন্দ্বে পড়ে গেছে। ওর দ্বিধা বিভক্ত মনকে আরও ক্ষানিকটা বিভ্রান্ত করে দেওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলাম,
–ভালোবাসো তোমার স্বামীকে?
ইরা সহসা কোন জবাব দিতে পারল না। অথচ আজ থেকে দুই বছর আগে এই মেয়েটিই বিয়ের মঞ্চে বরের সাথে ছবিতে হাসিমুখে পোজ দিয়েছিল। সেই ছবিটি এখনো ফেসবুকে ওর কাভার ফটো। আমি প্রতিদিন ছবিটা দেখি। যতই দেখি ততই প্রতিশোধের ইচ্ছাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে।
–কি জবাব দিতে পারছ নাতো? জানি পারবে না। কারন তুমি ওকে নয় আমাকে ভালোবাসো।
: কিন্তু অভ্র, ভার্সিটিতে আমরা কেবলই বন্ধু ছিলাম।
–আমরা কেবলই বন্ধু ছিলাম না। আমরা ছিলাম খুব ভালো বন্ধু। আর বন্ধুত্বই ভালোবাসা।
: না, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি এতদিন পড়ে এসব কথা কেন বলছ?
–কারন তুমি আমাকে কখনও বলার সুযোগই দাওনি।
ইরা অপলক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন ভরসা খুঁজছে। যাচাই করতে চাইছে আমার কথা। ওকে আশ্বস্ত করার জন্যই বললাম,
–আর তাছাড়া আমি ভেবেছি তুমি অয়নের সাথে ভালো আছো। তাই চুপ ছিলাম।কিন্তু ও তোমায় কষ্টে রাখবে এটা আমি মানতে পারব না, ইরা। ইরা নিজেই যেন নিজেকে বলল।
: অভ্র, আমি অয়নকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি। উফফ! কলিজাটা ছাৎ করে উঠল। এই মেয়ের মুখে ভালোবাসা শব্দটা মানায় না।
–তুমি ভালোবেসেছ। কিন্তু ও তোমায় ভালোবাসে না। তাহলে আজ তোমাকে একলা ফেলে দেশ বিদেশে টাকার জন্য ছুটত না অয়ন। তোমাকে এতটা উপেক্ষা করতে পারত না।
: সে তো আমাদেরই ভবিষ্যতের জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে।
–আর তুমি যে একাকী কষ্ট পাচ্ছ তার কি হবে। সময়ের চেয়ে টাকার মূল্য বেশি নাকি? ইরার মুখে ক্লেশের চিহ্ন স্পষ্ট। ও ধীরে ধীরে বলতে লাগল।
: হ্যাঁ, আজ হয়ত অয়ন আমাকে ইগনোর করে, সন্দেহ করে। কিন্তু একদিন তো ও আমাকে ভালোবাসতো।
–ও ভালোবাসতো আর আমি এখনো ভালোবাসি। ইরা, আমি জানি তুমি ভালো নেই। চলো আমার সাথে, প্লিজ।
আমাকে নিরাশ করো না। খুব ভালোবাসি তোমাকে। নিরা নতমুখে নিশ্চুপ হয়ে আছে। সে এখন গভীর ভাবনায় মত্ত। আমি তার ভাবনায় ছেদ ঘটালাম না। তার ডেস্কে আমার ফোন নাম্বার লেখা কাগজটা ফেলে আসলাম।
–যদি তোমার মন চায় তো যোগাযোগ কোরো। আসি।
সে আমাকে আটকাল না। আটকালেও আমি থামতাম না। আমি থেমে যাওয়ার জন্য পথে নামিনি। ইরা। আমার ভার্সিটি লাইফের বান্ধবী। বান্ধবী নয় ঠিক। বন্ধুর প্রেমিকা। আমার সব থেকে ভালো বন্ধু আসিফের ভালোবাসা ছিল ও। অাসিফ আর ইরা সেই স্কুল লাইফ থেকে এক সাথে ছিল। ভালোবাসত একে অপরকে। ইরার ফ্যামিলি কন্ডিশন ভালো ছিল না।কিন্তু ইরার পড়ার খুব ইচ্ছা ছিল। তাই ইরার পড়ালেখাসহ যাবতীয় খরচ অাসিফই যোগাত। নিজের টিফিনের টাকা থেকে শুরু করে প্রাইভেট টিউটরদের ফিস সবটাই এই ইরার পেছনে খরচ করত ও। হ্যাঁ, নিজে পড়ালেখা খুব কমই করত অাসিফ।
কারন ওর বাবা প্রাইভেট পড়ার জন্য যে টাকা ওকে দিতেন তাতে ইরার পড়া চলত। কলেজ শেষে মেধাবী ছাত্রী ইরা যখন ভার্সিটিতে চান্স পেলো অাসিফের তখন গ্রামের কলেজে ডিগ্রী পাস কোর্সে পড়া ছাড়া উপায় ছিল না। সেখানে থেকেই টিউশন করিয়ে আর ছোটখাট কাজ করে ইরার ভার্সিটির খরচ যোগাচ্ছিল। কিন্তু ইরা ভার্সিটির ঝলমলে ক্যাম্পাসে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। আসিফের মত চাষার ছেলের প্রতি সে আর ভালোবাসা অনুভব করে না। দেখতেও অবশ্য সুন্দরী ছিল সে। অল্পদিনেই ধনীর দুলাল অয়ন ইরার প্রেমে পড়ে যায়। ইরারও আপত্তি ছিল না। পুরোটা নাটক আমি চোখের সামনে মঞ্চস্থ হতে দেখেছি। কারন আমিও কাকতালীয়ভাবে ওই ভার্সিটিতেই পড়তাম।
ইরা আর আসিফের গল্পটা প্রথম থেকেই জানতাম। কিন্তু ইরা জানত না আমি আসিফের বন্ধু। কারন শৈশবটা আমার আসিফের সাথে কাটলেও বাবার চাকরির সূত্রে ঢাকায় চলে আসি। তবু আসিফের সাথে সর্বদা যোগাযোগ হত। ইরার পরে আমিই যে তার প্রান ছিলাম। ঢাকায় আসার পর ইরা যখন আসিফের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিল তখন আমিই আসিফকে ইরার খবর জানাতাম। এ জন্যই ইরার সাথে বন্ধুত্ব করেছিলাম। কিন্তু ঐ মুখোশধারী মেয়ে আমার বন্ধুর সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমার বন্ধুকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়ে ও অয়নের গলায় মালা পড়িয়েছে। ও অস্বীকার করেছে আসিফের অবদান, আসিফের ত্যাগ। আমার ভগ্ন হৃদয় বন্ধুটি সেই ব্যথা সহ্য করতে পারেনি।
আত্মহত্যা করেছিল ও।ইরা ওর মৃত্যুর খবর শুনে ঘৃনায় ঠোঁট ওল্টেছিল। সেই দিনই মেয়েটার সুন্দর মুখের আড়ালে থাকা লোভী আর নিচ মন মানসিকতা আমার সামনে স্পষ্ট হয়ে গেছিল। আমি সেইদিনই প্রতিজ্ঞা করেছি, আমার বন্ধুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নেব। গত দুই বছর থেকে আমি ওকে ফলো করছি। এই দুই বছরে ও অয়নের সংসারে খুব যে মহা আনন্দে ছিল তা কিন্তু নয়। তবে ওদের দ্বন্দ্বটা কখনো সম্মূখে আসেনি। কিন্তু বেশকিছুদিন ধরে অয়নের সাথে ওর সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে প্রকাশ্যে। আর গল্পের এ পর্যায়েই ইরার জীবনে আমার নাটকীয় প্রবেশ। ইরার ধারনা দুই বছর পর পুরনো ভার্সিটি ফ্রেন্ডের সাথে হঠাৎ দেখা হয়েছে ওর। যাকে বাসায় ডেকে এক কাপ কফি না খাওয়ালেই নয়। এভাবেই ওর সাথে আবারও ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলি। ইরা আমাকে ওর দু:খের কথা বলত। আমি শুনতাম।
অয়ন ওর সাথে কতটা খারাপ ব্যবহার করে জেনে দু:খিত হতাম। প্রায় প্রতিদিনই ওর বাসায় কফির নিমন্ত্রন থাকত। অয়নের অনুপস্থিতিতে ইরার অবসর আমার সাথেই কাটত। যখন বুঝলাম ইরাও আমার প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে তখনই আমি সুযোগটা নিলাম। আজ কফি খেতে খেতে আমি ওকে এমন এক ভালোবাসার গল্প শুনিয়েছি যা ওকে সারা দিন রাত জুড়ে ভাবাবে। ওর ধারনা হয়ে গেছে আমি ওকে ভালোবাসি আর ওর জন্যই এখনো বিয়ে করিনি। অয়নের প্রতিও ওর ভালোবাসা টলে গেছে। টলবে না কেন? আসলে এই মেয়েগুলো ভালো বাসতেই জানে না। নইলে আসিফ নিজের ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলী দিয়ে ওকে ভালোবাসল, আর ও কিনা তাকেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল। আমার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে দিল ফোনের রিংটোন। অপরিচিত নাম্বার। রিসিভ করতেই ইরার গলা শুনতে পেলাম।
: অভ্র, আমি ইরা।
–হ্যাঁ, বলো শুনছি।
: অয়ন বাসায় ফিরে আমাকে প্রচন্ড মেরেছ। আমার নাকি আসিফ নামের কোনো একটা ছেলের সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। আমি নাকি ওই ছেলেটার সাথে প্রতারনা করেছি।
–তুমি প্রতারনা করতেই পার না।আর আসিফ কে? কখনো নাম শুনিনি তো।
: আমিও চিনি না। তবে অয়ন বলছে আমি নাকি লোভী। আমি নাকি ওর সাথেও প্রতারনা করব।
–অয়ন তোমাকে এত বড় কথা বলতে পারল!
: ও আমাকে ডিভোর্স দিতে চায়।
ইরা কাঁদছে। হ্যাঁ, ইরার কাছে যাওয়ার আগে অয়নকে একটা মেইল করেছিলাম আমি। সেখানে অাসিফ-ইরার বেশকিছু ছবি আর ভয়েস রেকর্ড ছিল। তাছাড়াও ইরার বাসর রাত থেকেই অয়ন মাঝে মধ্যে বেশ কিছু বেনামি চিঠি পেতো। ইরা আর অয়নের সম্পর্কে তিক্ততা আসার এটাও অন্যতম কারন।
–ইরা তুমি কেঁদো না প্লিজ। এক কাজ করো তুমিই ওকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। আমার কাছে চলে আসো।
: আমি আসব। তোমার ঠিকানা বলো।
–আগে তুমি ডিভোর্স পেপার সাইন কর। আমিই তোমাকে নিয়ে আসব। একদম দেরি করো না। আমি আছি তো।
বলেই ফোনটা কেটে দিলাম। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই একবার আড়মোড়া ভাঙলাম। একটা ট্যাক্সি ডেকে নিলাম। দ্রুত বাসায় ফিরে ব্যাগ গোছাতে হবে। রাত দশটায় আমার ফ্লাইট। তনিমাকে অনেক অপেক্ষা করিয়েছি। আর না। বেচারি আমাকে ভালোবেসে কানাডায় বাসর সাজিয়ে বসে আছে। আর আমি এখানে ইঁদুর-বিড়াল খেলায় ব্যস্ত ছিলাম। এখন ইরা অয়নকে ডিভোর্স দিক বা অয়ন ইরাকে। কিচ্ছু যায় আসে না আমার। ইরা আমার বন্ধুর জীবন ভেঙেছে, আমি ওর সংসার ভেঙেছি। মনে হয় না, আর ও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে। যদি দাঁড়িয়েও যায়, অন্য কোন অভ্র আসবে ওকে ধ্ব:স করতে। ইরাদের ধ্বঃস করলে অভ্ররা কখনো পাপী হবে না। আমার কাজ শেষ। এখন তনিমার কাছে নিজেকে হস্তান্তর করে আমি অবসরে যাব। The game is over..