—মোহন দরজাটা খোল,কে এসেছে দেখ তো। মোহন দরজা খুলে একটা লোককে দেখতে পায়।
—কে আপনি?
—আমি সুন্দরবন কুরিয়া সার্ভিস থেকে এসেছি।আপনাদের নামে একটা পার্সেল এসেছে।এইটা নিন আর পেপারটায় স্বাক্ষর করুন।
—বুবু একটা পার্সেল এসেছে তোর নামে।
—আমার নামে? কে পাঠাবে পার্সেল?
বেশ চিন্তা পড়ে যায় মোহন ও মিম।তারা লক্ষ করলো ইংরেজী বর্ণে কিছু লেখা আছে সাদা কাগজে।লেখাটা হলো…
“No one will open without mimu.Here are my some personal words and gifts for mimu.” লেখাটা মিম পড়ে বুঝতে বাকি রইলো না কে পাঠিয়েছে।পার্সেলটা বেশ বড় ছিলো।মিম ও মোহন দুজনে মিলে পার্সেলটা মিমের রুমে নিয়ে যায়।সব ব্যস্ততার অবসান ঘটিয়ে কাগজে মোড়ানো উপহারটা খুলতে ব্যস্ত হয়ে যায় মিম ও মোহন।মিম খুব বিস্ময়ের সাথে খুলতে লাগলো। কাগজে মোড়ানো উপহারটা খুলতে গিয়ে একটা সাদা চিরকুট চোখে পড়ে মিমের।চিরকুটটা হাতে নিয়ে পড়তে থাকে মিম।
শ্রদ্ধেয় মিমু, তোমাকে এই প্রথম চিরকুট পাঠালাম।আশা করি তুমি ভালোই আছো।তোমার সাথে শেষ কথা হয়েছিলো আজ থেকে প্রায় ৭ বছর আগে।এরপর আমি চলে এলাম বিদেশের মাটিতে।সম্পর্কের শুরু হয়েছিলো ঠিকি, তবে শেষটা হয়েছিলো কবে সেটা অজানা।হটাৎ করেই তুমি নিজেকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে নিলে।তারপর আমি নিজেকে গুছিয়ে নিতে চলে এলাম লন্ডনে। ৭ বছর ধরে এখানেই আছি।সম্পর্কের শুরু থেকে আজ অব্দি তোমাকে কোন উপহার দিতে পারি নি।আমাদের সম্পর্কটা এখন আর নেই।
তবে কথা দিয়েছিলাম তোমায় একদিন আমি উপহারগুলো দিবো।তাই আমার কথা রাখতে তোমার জন্য সামান্য কিছু উপহার পাঠালাম।তুমি উপহারগুলো সযত্নে গ্রহণ করিও।আর প্রতিটা উপহারের মধ্যে আলাদা আলাদা চিরকুট রয়েছে।যেখানে লিখা আছে আমার অব্যক্ত কথন। ইতি, তমাল চিঠিটা পড়া শেষ হতেই মিমের চোখটা কেমন জানি ঝাপসা হতে শুরু করে।মিম ভাবতে পারেনি সেদিনের চাওয়া উপহারগুলো এভাবে দিবে।মিম প্রতিটা উপহারের পাশে আলাদা আলাদা চিরকুট দেখতে পায়।মিম একেক করে উপহারগুলো খুলতে লাগলো ও চিরকুট পড়তে থাকে…
—এই যে লাল শাড়ীটা দেখছো, এটা তোমার জন্য।তুমিতো জানতেই লাল রং আমার পছন্দ।তোমাকে বলেছিলাম লাল একটা শড়ী তোমাকে দিবো।জানো খুব ইচ্ছা ছিলো তোমাকে নিজে শাড়ীটা পরিয়ে দিবো। কিন্তু দেখো ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস সেটা আর হলো না।তবে তুমি কিন্তু শাড়ীটা একবারের জন্য হলেও পইরো।আর শোনো শাড়ীটা পরে যখন বাহিরে বের হবে,তখন মাথায় আঁচলটা দিয়ে বের হবে।আর হ্যাঁ তোমার তো নীল রং পছন্দ তাই এই নীল শাড়িটাও তোমার জন্য।
—এই যে কাঁচের চুড়ি গুলো দেখছো এগুলোও তোমার জন্য।তুমি যখন শাড়ী পরবে তখন এই চুড়িগুলো পরবে।আর সাবধানে কাঁচের চুড়ি তো,ভেঙ্গে গিয়ে হাত কেটে না যায়।
—এই টিপগুলো দেখছো সবগুলোই তোমার জন্য।তুমি যখন শাড়ী পরবে তখন না হয় এখান থেকে একটা টিপ কপালে দিও।দেখতে বেশ লাগবে তোমায়।যদিও দেখতে পাবো না তবে কল্পনার রজ্যে তোমাকে একে নিয়েছি। আর হ্যাঁ কালো টিপ দিও কপালটায়,কালো টিপে বেশ মহনীয় লাগবে তোমায়।
—এই যে কানের দুল দেখছো এগুলোও তোমার জন্য।শাড়ীর সাথে দুলগুলো বেশ মিল রেখেই কিনেছি।তোমাকে বেশ মানাবে।দুলগুলোও পরবে কিন্তু..
—আর এই যে লিপস্টিক দেখছো সবগুলো তোমার জন্য পছন্দ করে কিনেছি।যদি ইচ্ছে হয় তোমার ঠোটে স্পর্শ দিও এদের।
—এই যে পায়েলটা দেখছো, এটা সেদিন অনলাইনে দেখলাম।খুব পছন্দ হলো আমার তাই তোমার জন্য নিয়ে নিলাম।তবে ইচ্ছা ছিলো নিজে পরিয়ে দিবো সেটাও হলো না।
—তোমার তো চকলেট খুব পছন্দ তাই এই চকলেট গুলো তোমার জন্য।এখানে ২২ রকমের চকলেট আছে।তুমি চকলেট গুলো খেও।
— আর এই যে টেডিবিয়ার এটা হলো মোহনের জন্য।ও বলেছিলো “বিয়ু” আমাকে একটা টেডি দিও তুমি।তখন তো দিতে পারি নি তাই আজ পাঠালাম। টেডিটা হাতে নিয়ে মিম বললো,
—মোহন এই টেডিটা তোর জন্য পাঠিয়েছে।
—দেখেছিস বুবু বিয়ুর কাছে আমি একটা টেডি চেয়েছিলাম সেটাও মনে রেখেছে। মোহন কথাটা শেষ কর লক্ষ করলো মিমের চোখে জল।মোহন কিছুটা এগিয়ে গিয়ে জিঙ্গেস করে,
—বুবু তুই কাঁদছিস কেন?
—কেন কাঁদছি সেটা আমি নিজেও জানি না।ছেলেটা যে আমায় এতটা ভালোবাসাতো সেটা তখন বুঝতে পারি নি জানিস মোহন আমি তমালের সাথে খুব অন্যায় করেছি।ওর কাছে কখনো ক্ষমা চাইতেও পারি নি।
—বুবু তমাল ভাইয়া তো তোর কাছে ফিরতে চেয়েছিলো তবে তুই কেন ফিরিয়ে দিয়েছিলি??
—জানি না রে।তখন আমি মোহোর মধ্যে ছিলাম।তমালের ভালোবাসা তখন বুঝতে পারি নি।
—তমাল ভাইয়া তোকে অনেক ভালোবাসতো বুবু।আর তুই একবার বলে দেখতি?? উনি তো চেয়েছিলো ফিরতে।তুই তখন অন্য রিলেশনে ছিলি।তুই ভেবেছিলি তমাল হয়তো তোর যোগ্য হয়ে উঠতে পারবে না।তুই আম্মুর কথায়,জড়িয়ে ছিলি অন্য একটা সম্পর্কে।তমাল ভাইয়া সবই জানতো।তারপরেও চেয়ে ছিলো তোর সাথে থাকতে কিন্তু তুই তখন বুঝিস নি। আর আজ তোর চোখে জল।এটা মানায় না বুবু! এটা মানায় না।
—মোহন কিছু ভুলের প্রায়শ্চিত্ত চোখের জলেই করতে হয়।সেদিনের ভুলের আমার জীবনে অন্ধকার বয়ে আনবে সেটা বুঝিনি।আমি আলো খুজতে গিয়ে অন্ধকারে আটকে আছি আজ।এই অন্ধকার জীবন থেকে আমার মুক্তি নেই।
হটাৎ করেই মিমের ফোনটা বেজে ওঠে।বিদেশী নাম্বার থেকে ফোন।সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ফোনটা রিসিভ করে।
মিম বললো,
—হ্যালো কে বলছেন? ওপাশ থেকে তমাল বললো,
—পরিচয় জানাটা কি খুব জরুরী??
—ওওওও! তুমি।
—যাক এবার তো অন্তত চিনতে পেরেছো।আমাকে চিনতে পারার জন্য ধন্যবাদ।
—তুমি এটুও বদলাও নি তমাল।খুঁচা মেরে কথা বলার স্বভাবটা এখনও আছে তোমার।
—হুমমম! হয়তো। যাই হোক, তোমার জন্য কিছু উপহার পাঠিয়ে ছিলাম পেয়েছো??
—হুমমম! পেয়েছি।
—যদি ইচ্ছা হয় শাড়ীটা পইরো।ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে হবে না।আচ্ছা ভালো থেকো।
—তমাল একটু শুনবে??
—হুমম বলো।অফিসে যেতে হবে সময় নেই।যা বলার একটু তাড়াতাড়ি বলো।
—আচ্ছা আমরা কি আগের মত সম্পর্কটা শুরু করতে পারি না?? মিমের এমন কথায় তমাল নিশ্চুপ হয়ে থাকে।তমাল কিছুটা সময় নিয়ে বললো,
—নাহহ! এখন আর সেটা সম্ভব নয়।তুমি যখন ফেলে চলে গেছিলে তখন আমার জীবনটা অগোছালো ছিলো।আর আমার জীবনটা এখন সুমাইয়ার সাথে জড়িত।আজ এত দূর এসেছি শুধু মাত্র ওর সাপোর্টের জন্য।আমার খারাপ সময়ে ও আমার পাশে ছিলো।আর তুমি ভালো করেই জানো আমি কোন মেয়ের সাথে প্রতারণা করতে পারবো না।সো এটা আর এখন সম্ভব না। হ্যাঁ একটা সময় সম্ভব ছিলো।
তখন তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি,তুমি কখন এসে বলবে তমাল আমাকে তোমার করে নাও।কিন্তু তুমি তখন আসো নি।আমার খারাপ সময়ে তোমাকে পাশে পাই নি।তবে কেন তোমাকে আমার ভালো সময়ের সঙ্গী করবো?? যে মেয়েটা আমার খারাপ সময়ে পাশে ছিলো তাকে আমি কথা দিয়েছি যে তাকে ছেড়ে যাবো না।সে ভুলিয়ে দিয়েছে তোমার স্মৃতি।যখন তোমার কথা মনে হতো তখন ও আমাকে নানান ভাবে বোঝাতো।তখন ও ছিলো আমার একটা শক্তি। আর হ্যাঁ আগামী মাসেই আমাদের বিয়ে।তোমাদের দাওয়াত রইলো।
কথা শেষ করেই তমাল ফোনটা রেখে দেয়।তমালের কন্ঠে তখন গভীর কষ্টের ছাপ।অজান্তেই তামালে চোখে জল এসে যায়। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে পকেট থেকে টিস্যু বের করে চোখটা মুছে নেয় তমাল। তমাল নিজেকে সান্তনা দেয়, আরে দূর এ কান্নায় আমাকে মানায় না।আমাকে বহুদূর যেতে হবে এখনও। আর ও দিকে যে পথ চেয়ে বসে আছে তমালের খারাপ সময়ের সঙ্গী। যার সাথে হতে চলছে বিবাহ সম্পর্ক। মেয়েটা তমালকে অনেক ভালোবাসে।তমালও প্রচন্ড ভালোবাসে সুমাইয়াকে।
তমাল শুধু তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে দিয়েছে মিমকে উপহারগুলো। তমালের মনে মিমের জন্য এখনও রয়েছে ভালোবাসা।তবে সে ভালোবাসাটা এখন চুপসে আছে।কেননা তমালের জীবনটা এখন জড়িয়ে আছে সুমাইয়ার জীবনের সাথে। সুমাইয়ার বুকে মাথা রেখে ভুলে থাকতে চায় অতীতের স্মৃতি।তমাল জানে অতীতকে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।তার অতীতই তাকে আজ এখানে এনে দিয়েছে।তারপরেও যতটা ভুলে থাকা যায়।কিছু ভালোবাসার পরিসমাপ্তি এমন হয় যে, সে ভালোবাসা তখন ডায়েরীর পাতাতে নতুন গল্পে আখ্যায়িত হয়।