দুই জীবন

দুই জীবন

আজ আমার বিয়ে।বাবা মায়ের পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে হচ্ছে। খুব ইচ্ছা ছিল প্রেম করে বিয়ে করবো কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। আমরা তিন ভাই বোন আমি বড়ো ছোট দুই ভাই । মা পইপই করে নিষেধ করেছে খবরদার সুমি প্রেমের ধারেকাছেও যাবি না তুই একমাত্র মেয়ে তোর বাবার খুব ইচ্ছা নিজে দেখেশুনে বিয়ে দেবে।আমি শান্ত নরম স্বভাবের বাধ্য মেয়ে, মায়ের কথা শুনে প্রেমের ধারেকাছে যায়নি। যার সাথে বিয়ে হচ্ছে তার নাম রাসেদ ব্যাবসা করে। বাবা মা নেই ছোট একটা বোন,স্বামীর সাথে দেশের বাইরে থাকে।

বাবা মা নেই শুনে আমার মায়ের চোখ আদ্র হয়ে উঠলো করুণ সুরে বললো আহারে এতিম ছেলে ভালবাসার কাঙাল,সুমি যদি একটু ভালোবাসে তাহলে ঐ ছেলে সুমিকে অনেক ভালবাসবে। নতুন বউ হয়ে শ্বশুরবাড়ি এসে মন খারাপ হয়ে গেল পুরনো আমলের ভাঙাচোরা দুটো ছোট্ট ঘর। বাবা শুধু ছেলেই দেখেছেন ঘরবাড়ি দেখেননি! চাচাত জা মর্জিনা ভাবি সারাক্ষণ আমার পাশে।গল্পে গল্পে জানালো রাসেদ তো আমাদের বাসায় তিনবেলা খায় তোমার ভাসুরের সাথে ব্যাবসা করে। এখন থেকে রান্না বান্না তুমি করবে রাসেদের যত্ন নেবে।

আমার স্বামীর মুখে সারাক্ষণ মর্জিনা ভাবির প্রশংসা আমার রান্না তার কাছে ভালো লাগে না শুধু বলে ভাবির মতো রান্না করতে পারো না? বাবা আমাকে নিতে এসে বাড়ি দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। রাশেদ কে বলল, বাবা রাশেদ তোমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমি কি তোমাকে বাড়ি করে দিতে পারি? আপত্তির কি আছে আব্বা? আপনার মেয়ের জন্য বাড়ি করে দেবেন এতে আমি আপত্তি করবো কেন? তবে আব্বা পাঁচজনে দেখবে সুন্দর বাড়ি করে দেবেন। রাশেদের কথা শুনে আমি হতভম্ব, এতো আস্ত লোভী মানুষ! বাড়ি শেষ হওয়ার আগেই আমি অন্তঃসত্ত্বা হলাম,রাশেদ খবরটা শুনে একটুও খুশি হয়নি রাগী গলায় বললো এতো তাড়াতাড়ি বাচ্চা নেওয়ার কি দরকার ছিল? যত্তসব।

নতুন বাড়িতে উঠার কিছুদিন পরে রাশেদ বললো,সুমি মর্জিনা ভাবিদের ঘর পুরনো হয়ে গেছে ভেঙে আবার তৈরি করবে যতদিন ঘরের কাজ শেষ না হয় ততদিন আমাদের বাড়িতে এসে থাকুক, তুমি কি বলো? আমি আর কি বলবো তুমি যেটা ভালো মনে করো। কয়েকদিনের মধ্যে মর্জিনা ভাবিরা আমাদের বাড়ি চলে এসেছে। ভাবির স্বামী কামাল ভাই খুব সহজ সরল কাজ পাগল মানুষ সকালে ব্যাবসার কাজে বেরিয়ে যায় ফেরে রাতে। রাশেদ সারাক্ষণ ভাবির সাথে গল্প গুজব হাসি তামাশা করে ভাবির দুটো ছেলে আছে তাদেরকে খুব কোলে নেয় আদর করে। আমার শরীর ভাল না আস্তে আস্তে পুরো সংসারের দায়িত্ব ভাবি নিলো। নিজের বাড়িতে নিজে মেহমান হয়ে গেলাম।

সন্তান হওয়ার জন্য বাপের বাড়ি এসেছি, রাশেদ একদম আসে না। নির্দিষ্ট দিনে ফুটফুটে একটা ছেলে হলো।ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো পৃথিবীতে আমার থেকে সুখি কেউ নেই। ছেলের নাম রাখলাম রনি। ছেলে হওয়ার পর রাশেদ একদিন মাত্র ছেলে দেখতে এসেছে। দুই মাস পর ছেলে নিয়ে নিজের বাড়ি ফিরলাম।পুরো সংসার ভাবির দখলে, আমাকে একের পর এক কাজের হুকুম করে, প্রতিটা কাজের ভুল ধরে জীবন দূর্বীসহ করে দিচ্ছে। ভাবির সম্পর্কে কোন কথা রাশেদ কে বলা যায় না রেগে যায়।

ভাবি বাপের বাড়ি বেড়াতে গেছে, আমি ছেলেকে ঘুম পাড়াচ্ছি পাশের বাড়ির এক ননদ রেশমা আসলো টুকটাক কথা বলতে বলতে বললো,ভাবি তুমি খাল কেটে কুমির আনলে কেন? মর্জিনা ভাবির সাথে রাশেদ ভাই এর অবৈধ সম্পর্ক আছে তোমার বিয়ের আগে থেকে এখন আবার বাড়িতে এনে তুলেছো, ওদের তো পোয়াবারো। তুমি এতো নরম কেন ভাবি? শক্ত হও ওদের বাড়ি থেকে চলে যেতে বলো। রেশমার কথা শুনে আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। ওদের এতো গল্প গুজোব হাসাহাসির রহস্য সব দিনের আলোর মতো পরিস্কার। রাতেই রাশেদ কে বললাম, ভাবি বাপের বাড়ি থেকে ফিরে আর এই বাড়িতে উঠবে না নিজের বাড়িতে থাকবে। রাশেদ রেগে গেল, কেন এই বাড়িতে কি সমস্যা? এই বাড়িতেই থাকবে।

আমি জানি তোমার সাথে ভাবির অবৈধ সম্পর্ক আছে,তোমার প্রেয়সী কে কিছুতেই আমি এই বাড়িতে রাখবো না।
রাশেদ ছুটে এসে আমার গালে জোরে চড় মারলো বেয়াদব মেয়েছেলে যেতে হলে তুই যাবি ভাবি কিছুতেই যাবে না।
লজ্জায় অপমানে এক কাপড়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসলাম। আসার সময় শুধু বলে আসলাম তোমার প্রয়সী কে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে যেদিন আমাকে আনতে যাবে সেদিন ফিরে আসবো।নিজের এতো বড়ো অপমানের কথা লজ্জায় বাবা মা কে বলতে পারিনি শুধু বলেছি রাশেদের সাথে ঝগড়া করে এসেছি কয়েকদিন থাকবো। কিছুদিন পর রাশেদ আমাকে নিতে আসছে না দেখে বাবা নিজে ঝগড়া মিটানোর জন্য রাশেদের কাছে গিয়েছিল উল্টো রাশেদ বাবার কাছে আমার নামে অনেক বদনাম করেছে আমার মন ছোট সন্দেহ বাতিক নিজেকে সংশোধন করে যেন রাশেদের সংসারে ফিরে যায় তার আগে না।

আজ দুই বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি রাশেদ আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে অন্তত ছেলের কারনে। রাসেদ একদিনের জন্যেও আসিনি কোন খোঁজ খবর নেয়নি।উল্টো তালাক নামা পাঠিয়ে দিলো। তালাক নামা দেখে মা আকুল হয়ে কাঁদছে। আব্বা চিৎকার করে উঠলো, মগের মুল্লুক পেয়েছে যা খুশি তাই করবে! ওর নামে আমি কেস করবো। না আব্বা কোন ঝামেলার দরকার নেই যার মনের ভিতর জায়গা হলো না তার সাথে ঝঞ্ঝাট করে কি লাভ আপোসেই তালাক হোক। রাশেদের সাথে তালাক হয়েছে আজ তিন মাস। বিকেলে মামার সাথে এক ভদ্রলোক এসেছেন সাথে রনির বয়সী একটা ছেলে।

মামা আব্বাকে বললেন,দুলাভাই ইনি নাজমুল হাসান আমাদের অফিসে অফিসার পদে চাকরি করেন। দুই মাস আগে স্ত্রী মারা গেছে আবার বিয়ে করবেন সুমির কথা বলেছি, উনি সুমির সাথে কথা বলতে চান। ড্রইং রুমে আমি আর নাজমুল সাহেব মুখোমুখি বসেছি। নাজমুল সাহেব বললেন আপনাকে আমার মা মরা ছেলে রাজুর মা হতে হবে, পারবেন? আস্তে করে বললাম পারবো।আমারও একটা ছেলে আছে আপনি কি সেটা জানেন?তাকে কি আমি আমার কাছে রাখতে পারবো? আমি জানি তো আপনার একটা ছেলে আছে, অবশ্যই আপনি আপনার ছেলেকে সাথে করে নিয়ে যাবেন এবং সেটা বিয়ের দিনই।

আমি দ্বিতীয় বার বউ হয়ে দুই পাশে দুই ছেলে রাজু আর রনির হাত ধরে স্বামীর বাড়ি আসলাম। সুন্দর দোতলা বাড়ি। বাসর রাতে নাজমুল আমার হাত ধরে বললো,সুমি আমাদের অনেক দায়িত্ব দুই ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে। আর সবচেয়ে যেটা বেশি খেয়াল রাখতে হবে সেটা হলো, রাজু আর রনি কখনও না ভাবে ওরা আপন ভাই না, ওরা এখনও ছোট ওদের দু’জনকেই যদি একই রকম ভালবাসা হয় তাহলে ওরা বুঝবে ওরা আপন ভাই ।ওদেরকে একই রকম ভালবাসতে হবে।

নাজমুল একই রকম জামা জুতো দু’ভাই এর জন্য কেনে, একই রকম খেলনা দুই টা কেনে।আমি অবাক হয়ে দেখি।নাজমুল আর দুই ছেলে নিয়ে খুব সুখে আছি। একজীবনে অনেক কষ্ট অপমান সহ্য করেছি, মঙ্গলময় আরেক জীবনে আমাকে অফুরন্ত সুখ দান করেছেন। নাজমুলের মতো স্বামী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। নাজমুল অফিস থেকে ফিরে কিছু কাগজ পত্র আমার হাতে দিয়ে বললো,সুমি হায়াত মউতের কথা তো বলা যায় না। আমি হঠাৎ মারা গেলে রনি আমার বিষয় সম্পত্তির কিছুই পাবে না সেই জন্য আমি আমার সমস্ত বিষয় সম্পত্তি ওদের দু’ভাই এর নামে লিখে দিয়েছি,এমন ভাবে উইল করেছি যে তোমার মৃত্যুর পর ওদের নামে হবে।

নাজমুলের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার চোখে পানি চলে আসছে। রনির নিজের বাবা কোনদিন রনিকে এতোটুকু আদর করে নি,কোনদিন একটু খোঁজ খবর নিলো না অথচ নাজমুল রক্তের কেউ না হয়েও রনিকে রাজুর সমান অংশীদার করেছে। রাসেদের মতো শয়তান তুল্য মানুষ যেমন এই সংসারে আছে তেমনি নাজমুলের মতো ফেরশতা তুল্য মানুষ এই সংসারে আছে বলেই পৃথিবীটা এখনও এতো সুন্দর।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত