হাঁটতে হাঁটতে পতিতা পল্লীর সামনে চলে এসেছি। নিয়মিত কাষ্টমারের তালিকায় আমার নাম সবার শীর্ষে। আজ আমার জন্মদিন। আজকের দিনে এখানে আসার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা ছিলো না। পকেট হাতড়ে সর্বসাকুল্যে ২২০ টাকা পেয়েছি। এই টাকা একঘন্টার জন্য যথেষ্ট। তাছাড়া নিয়মিত কাষ্টমার হিসাবে কিছু ছাড়তো পাবোই।
একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছি ভদ্রমহিলার দিকে। তার সাথে কথা বললে অকাট্য এক মায়ায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাই। যেই মায়াজাল ভেদ করার ক্ষমতা আমার নেই। হয়তো ঈশ্বর ছাড়া কারো নেই সেই ক্ষমতা। টেবিলের উপরে ঢেকে রাখা একবাটি পায়েশ আমার দিকে এগিয়ে ধরলেন। জন্মতিথীতে পায়েশ খেতে হয়। মায়ের হাতের পায়েশ খেলে সন্তানের বিপদ কেঁটে যায়। আমার মত এতিম ছেলেদের ভাগ্যে সাধারণত এই সুখ থাকে না। চামচ দিয়ে পায়েস খাওয়ার চেষ্টা করছি। দুই চোখ বেয়ে টুপটুপ করে পানি পরছে। ভদ্রমহিলা আমার হাত থেকে পায়েশের বাটি নিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছেন। কোন এক না পাওয়া সুখের, একরাশ পূর্ণতা ঘিরে আছে আমায়। মুখে কিছুই বলতে পারছি না।
পড়ালেখার প্রতি আগ্রহী ছিলাম আমি। বাবা মায়ের পরিচয় না থাকায় কোন স্কুলে ভর্তি হতে পারিনি। স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য বাবা-মায়ের পরিচয় জরুরি। বর্তমানে স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীর চেয়ে অভিভাবরের উপস্থিতি বেশি। আমারতো অভিভাবকই নেই। এজন্যই হয়তো স্কুলে যাওয়ার ভাগ্য হয়নি আমার।
ছোট থেকে রাস্তায় রাস্তায় বড় হয়েছি। সামান্য একমুঠো ভাতের জন্য মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছি। ভাতের বিকল্প হিসাবে তাদের হাতে মার খেয়েছি। ভাত পঁচিয়ে মানুষ ডাস্টবিনে ফেলবে। কিন্তু কোন পথশিশুর মুখে দিবে না। তারা মনে করেন “টোকাইদের মুখে ভাত দিলে তাদের জাত চলে যাবে।” ক্ষুধার্ত মানুষ অপরাধ বোধ হারিয়ে ফেলে। পেটের খুদা সহ্য করতে না পেরে খাবার চুরি করে খেয়েছি আবার কখনো কোন পথ না পেয়ে ডাষ্টবিনে সন্ধান করেছি বড়লোকের ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্ট।
কিছুটা বড় হওয়ার পর থেকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে কুলির কাজ করি। মাত্র ১২ বছর বয়সে অপরাধ জগতের সাথে জড়িয়ে যাই। তখন থেকে আর খাবারের কষ্ট পেতে হয়নি। কিন্তু আমার জীবনে নেমে আসে এক আমানিষার অন্ধকার। তখন থেকেই এই পতিতাপল্লীতে নিয়োমিত যাতায়াত করি। কালু বাহিনী সদস্য হওয়াতে এখানে সবাই যথেষ্ট সম্মান দিতো। মানুষ অর্থ লোভ উপেক্ষা করতে পারলেও। সম্মান পাওয়ার লোভ উপেক্ষা করতে পারে না। একজন চোরও সম্মান পাওয়ার স্বপ্ন দেখে। ধীরেধীরে নেশা আমাকে আকর্ষণ করলেও কখনো নারীর নেশা আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি। হঠাৎ একদিন এই ভদ্র মহিলাকে পতিতালয়ে দেখে থমকে গিয়েছিলাম। সেই থেকেই নিয়মিত আসা হয় এখানে।
ক্রসফায়ারে কালু ভাই মারা যায়। শহরে টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে পরে আমাদের। দলের সবাই শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। কেউ কারো সাথে যোগাযোগ রাখে না। আমি এই শহর ত্যাগ করতে পারিনি। অতীত বর্তমানকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আমার অতীতও আমার পিছু ছাড়ে না। পেটের টানে আবারো ফিরে যেতে হয় আগের পেশায়। টাকার বিনিময়ে কুলির কাজ করি। দিনশেষে তবু আমি একজন পরিশ্রমী, খেটে খাওয়া মানুষ। কোন সন্ত্রাসী নয়। অপরাধ করে বিবেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয় না।
বেঁচে থাকার জন্য স্বপ্ন দেখতে হয়। যার স্বপ্ন যত বড় হবে তাকে তত বেশি পরিশ্রমী হতে হয়। আমিও স্বপ্ন দেখি। পড়ালেখা করে বড় হবার স্বপ্ন। প্রতিটা মানুষের স্বপ্ন পূরণ হয় দ্বিতীয় একজনের হাত ধরে । আমার স্বপ্ন পূরণের অংশীদার নুড়ি। পথ-শিশুদের পড়া-লেখা করায় এমন একটি সংস্থার পরিচয় পাই ওর মাধ্যমে। নুড়ি আমাকে সেই স্কুলে ভর্তি করে। সারাদিন কাজ করে রাতে স্কুলে যেতাম।
এইচ.এস.সি সম্পন্ন করলে একটা এনজিওতে চাকরি হয় আমার। সেইসাথে নুড়িকে বিয়ে করে, ঘর বাঁধার স্বপ্নও পূরণ হয়। নিজের অপূর্ণ ইচ্ছা নুড়ির মাধ্যমে পূরণের স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। পড়ালেখা শেষ করে বিসিএস দেয় সে। ৩৫তম বিসিএস পরিক্ষার একজন সফল গর্বিত সদস্যা নুড়ি। বর্তমান ঢাকায় ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে কর্মরত।
আচমকা দরজা ধাঁক্কার শব্দে ঘোর কাঁটলো আমার। এতো জোড়ে শব্দ হচ্ছে যে, মনে হচ্ছে কোন এক প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে এই দরজার উপর। ভদ্রমহিলা অনেক রিকুয়েস্ট করেছেন, “পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার জন্য।” বিপদের মুখে তাকে একা রেখে পালিয়ে যেতে সায় দেয়নি আমার মন। দরজা ভেঙ্গে দুইজন পুলিশ ঘরে ঢুকে পরে। আমাকে মারতে মারতে নিয়ে দাঁড় করায় কাষ্টমারের সাড়িতে। আমাদের সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে আছে, সরদার, মালিকসহ সব পতিতারা।
দুই লাইনের মাঝে ফাঁকা যায়গার শেষ মাথায়। একটি চেয়ারে বসে আছেন ম্যাজিস্ট্রেট। সে আর কেউ নয় আমার নুড়ি। তার দিকে তাকিয়ে বাতাসের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো আমার ভিতরে। সম্পুর্ণ শরীর ঘামে ভিজে উঠলো। অতিরিক্ত টেনশনে মানুষের শরীর ঘামে। মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডে সম্পূর্ণ শরীর ভিজে উঠেছে। যেকেউ দেখলে ভাববে আমি মাত্র গোসল করেছি। একে একে সবার চলে গেলো লাইন ফাঁকা করে। আমার লাইনে আমি একা দাঁড়িয়ে। অন্যসবার মতো আমাকেও দাঁড়াতে হলো ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে। নুড়ি শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে, মৃদু স্বরে বললো
-“কি অভাব ছিলো তোমার??? কি এমন আছে ওই মহিলার মাঝে যা আমার নেই??? কি করিনি তোমার জন্য????”
ওর মুখে এই কথা শোনার আগে আমার মৃত্যু হলেই বেশি ভালো হতো। কি করে বুঝাই এই পাগলীকে তার কাছে যেই প্রণয়টুকু পাই তা কোন স্ত্রীর পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। নিজেকে সামলে, মাথা নিচু করে শুধু বললাম
– উনি আমাকে যেই সুখ দেয় তা তোমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয় নুড়ি।
-তুমি যদি প্রতিজ্ঞা কর আর কখনো এখানে আসবে না। তাহলে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিবো অয়ন। নতুবা আমি আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো।
-তোমার যা ইচ্ছা তুমি করতে পারো। কিন্তু আমি এখানে আসবোই।
নুড়ি আমার দিকে শুকনো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হয়তো কিছু বলার ভাষা পাচ্ছেনা। সেদিনের ঘটনার পর আর বাসায় ফেরা হয়নি আমার। আজ তিনদিন পরে বাসায় এসে দেখি নুড়ি বাড়িতে নেই। টেবিলের উপরে পেপার ওয়েট দিয়ে রাখা ডিভোর্স পেপার। দীর্ঘ এই সম্পর্ক শুধু ১টি সিগনেচারে শেষ হতে পারে না। তাই কিছু না ভেবেই সাইন করে দিলাম। বিষণ্ণ মনে হাটতে হাটতে চলে আসলাম পতিতালয় এর সামনে। দারোয়ান কিছুতেই ভেতরে ঢুকতে দেবে না। দারোয়ানের সাথে ধাক্কাধাক্কির এক পর্যায়ে ভিতর থেকে কিছু গুন্ডা মতোনলোক দৌঁড়ে এসে মেরে গেটের বাহিরে বেড় করে দেয় আমাকে।
এতো কিছুর পরেও পতিতালয় কর্তিপক্ষকে দোষ দেয়া যাচ্ছে না। এই শহরে ব্যবসা করতে হলে তাদের ম্যাজিষ্টেট এর আদেশ মানতেই হবে। আর নুড়ির শুধু একটি প্রশ্ন, “কে এই মহিলা? কি কারণে আমি কিশোর বয়স থেকে এখানে আসি? কি সম্পর্ক তার সাথে আমার?” পাগলীটাকে কি করে বুঝাই “কোন সন্তানের পক্ষেই তার মায়ের খারাপ পরিচয় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়।” কাঁটা তারের বেড়ার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছি। কপাল ফেটে রক্ত পরছে অনর্গল। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে
– “মা-আ-আ-আ!!!!! আমি এসেছি মা-আ-আ!!!! তোমাকে এক নজর দেখেই চলে যাবো মা। দিনে একবার তোমাকে না দেখতে পারলে আমার খুব কষ্ট হয় মা-আ-আ।