বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে গিয়ে আলাদা এক রুমে বসে আলাপের প্রায় শেষ দিকে মেয়েটা পলাশকে জিজ্ঞেস করলো :- ফুটবলে আপনি কোন দল সাপোর্ট করেন?
পলাশ:- “ব্রাজিল।”
মেয়ে:- “ওইযে 7up খাওয়া দলটা?”
বলেই শুরু হয় মেয়েটির কুটকুট হাসি। আকর্ণবিস্তৃত হাসি হাতে চেপে ধরতে ব্যর্থ হয়ে সোফার কুশন মুখে ধরে শরীর ঝাঁকিয়ে হাসতে থাকে মেয়েটি। সে কী হাসি! কিছুক্ষণ পরপর হাসি থামিয়ে পলাশকে জিজ্ঞেস করে “আপনি 7up খান?” “খুব ঝাঁজ তাইনা?” এসব বলে বলে তাচ্ছিল্যের সাথে হাসছে। মেয়েটির সামনে বসে থাকতে শুধু বিরক্তই না, অসহ্য লাগছে পলাশের। কিছু না বলেই রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো পলাশ। বাসায় এসে সাফ জানিয়ে দেয় যে, এই মেয়ের সাথে সংসার কেন? এক টেবিলে বসে চা পান করলেও কাপ পিরিচ ভেঙে খানখান হয়ে যাবে।
কিন্তু পলাশের বিধি বাম! পলাশের বড় চাচার কোটিপতি বন্ধুর একমাত্র মেয়ে সিনথিয়া। রূপে, গুণে, শিক্ষা ও শালীনতায় অনন্য এক মেয়ে সে। বিয়েতে রাজি না হওয়ার উল্লেখযোগ্য কোনো কারণ দর্শাতে পারেনা পলাশ। মেয়ে আর্জেন্টিনা ফুটবল টিম সাপোর্ট করে, বিয়ে ভাঙার জন্য এটা মোটেই কোনো স্বাস্থ্যকর কারণ হতে পারেনা । তাই বাধ্য হয়েই সিনথিয়াকে বিয়ে করতে হয় পলাশের।
সংসার শুরু হয় দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ফুটবল টিম সাপোর্টারের। এক টেবিলে বসে শুধু চা’ই না, রুটি-কলা, ভাত-বিরিয়ানী, ফিন্নি-পায়েস, ফ্রাইড-বয়েল্ড প্রায় সব ধরনের খাবারই খাচ্ছে ওরা। কিন্তু কাপ পিরিচ বা বাসন কোসন ভাঙেনি আজ অবদি।
তবে হ্যা,,,,,ছাদে হাঁটার সময়, বেলকনিতে কফি হাতে চেয়ারে বসে গল্প করার সময়, রিক্সায় করে শপিং এ বা দাওয়াতে যাওয়ার সময়, গভীর রাতে একবালিশে শুয়ে স্বপ্ন বুনার সময় ‘7up এর ঝাঁজ’ ও ‘৩২ বছরের অপেক্ষা’র প্রসঙ্গ উঠে আসেই। কিন্তু এসব কিছু অনাবিল মোলায়েম পরশ ও ঘর্মাক্ত আরামদায়ক ক্লান্তির মুহূর্তের কাছে অতি নগণ্য ও খুনসুটির উপকরণ মাত্র। ভালোবাসা যেন এতে পূর্ণতা পায়।
শুরু হলো ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপ। উভয় দলের প্রতিটা ম্যাচের আগেই তাদের দুজনের প্রেডিকশন হয় দু’মেরুর শেষ সীমানা। ব্রাজিলের খেলার আগে সিনথিয়া বলে “আজকেও 7up খাবে ব্রাজিল”। আর আর্জেন্টিনার ম্যাচের আগে পলাশ বলে “আরজিতেনা আর জিতবে কেন? আরো ৩২ বছর যাক”!
ম্যাচ শেষে দেখা যায় পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্য। ব্রাজিলের জয়ের আনন্দে পলাশ যখন বাচ্চা ছেলের মতো চিৎকার করে করে লাফায়, সিনথিয়া মুগ্ধ হয়ে তার হাসি দেখে। কী সুন্দর! কী সরল! কী পবিত্র! প্রাণ খুলে কিভাবে হাসে পলাশ। সিনথিয়া তার জীবনের বিনিময়ে হলেও তার স্বামীর এই হাসি আজীবন অম্লান রাখতে চায়। এই সমীকরণে ফুটবল টিম সাপোর্ট নিতান্ত’ই ক্ষুদ্র।
আর্জেন্টিনার ম্যাচে লিউনেল মেসি যখন গোল পায়, এক চিৎকার দিয়ে চোখে জল নিয়ে আসে সিনথিয়া। ভেজা চোখে খুশিতে পাশে বসা পলাশকে জড়িয়ে ধরে সিনথিয়া। পলাশ আর ছাড়েনা। মনে মনে বিধাতার কাছে কামনা করে পলাশ, “প্রতিটা ম্যাচেই মেসি গোল পাক! সারাজীবনই সিনথিয়ার চোখে থাকুক আনন্দের অশ্রু!
কোয়ার্টার ফাইনালে ২-১ গোলে ব্রাজিল হেরে যায় বেলজিয়ামের কাছে। পলাশের চোখ রক্তের মতো লাল। চুপ করে টিভির স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে সে। পলাশের চোখের দিকে তাকিয়ে সিনথিয়ার বুক ফেটে যাচ্ছে কান্নায়। অনেকক্ষণ কেউই কথা বলেনা। সোফা থেকে উঠে বেসিনে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয় সিনথিয়া। পলাশের পাশে বসে তার মাথাটা বুকে শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
“কী আসে যায় ব্রাজিলের হেক্সা মিশন আর কখনোই পূরণ না হলে? আর্জেন্টিনা আর কখনোই না জিতলে? বা পৃথিবীতে আর ফুটবল খেলা’ই না থাকলে? তুমি আর আমি তো আছি! আমরা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসার ম্যাচ খেলে জীবনটা কাটিয়ে দেব। আমরাই হবো একে অপরের বিশ্বকাপ। ভালোবেসে বেঁচে থাকাটাই শাশ্বত, ফুটবল নয়!
(আমরা অনেকেই এই বিশ্বকাপটাকে বিনোদনের অনেক ঊর্ধে নিয়ে গিয়েছিলাম। যা মোটেই শ্রেয় ছিলোনা। আসুন সব ভেদাভেদ ভুলে আমরা মনুষত্ব্য ও বন্ধুত্বের দ্বার পুণঃ উন্মোচিত ও প্রসারিত করি।)