সদ্য জন্মগ্রহণ করা বাচ্চাটাকে নিয়ে সবাই খুশি থাকলেও অনিতা বুঝতে পারে, তার শিশুটি অন্য শিশুদের তুলনায় খুব ই আলাদা এবং অস্বাভাবিক। কিন্তু অনিতা কাউকেই সেটা বলতে পারে না। প্রথম দিন ই অনিতাকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে আসা হয়। মাঝ রাতে যখন সবাই ঘুমাচ্ছিলো, অনিতা হঠাৎ একটা শব্দ শুনতে পেরে জেগে উঠে।
পাশে তাকিয়ে দেখে, তার পাশে ছোট বাচ্চাটি নেই। তাদের করিডোর এর দরজাটা খোলা। অনিতা যখন আস্তে আস্তে করিডোরে উঁকি দেয়, তখন সে দেখতে পায়, তার ছোট্ট বাচ্চাটা হাতে একটা চাকু নিয়ে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে এবং চাকুর বাট দিয়ে আস্তে আস্তে মেঝের উপর ঠুক ঠুক করে শব্দ করছে, হঠাৎ ই বাচ্চাটা অনিতার দিকে তাকিয়েই হি হি হি করে একটা হাসি দেয়। অনিতা সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে ওঠে।ঘরের সবাই যখন দৌড়ে আসে, তখন অনিতা ওর বাচ্চাটার দিকে আংগুল তুলে দেখিয়ে দেয়। কিন্তু ওর বাচ্চাটা তখন করিডোরে শিশুর মতই শুয়ে ছিলো।
সবাই অনিতাকে বকা বকি করে! এতটুকু বাচ্চাকে করিডোরে এনে কেন ফেলে রেখেছে এ জন্য। অনিতা সবাইকে বলে এইমাত্র কি কি দেখেছে তা সব। কিন্তু কথাগুলো কেউই বিশ্বাস করে না। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ওর শ্বাশুড়ি বাসায় ঢুকে। পিছনে পিছনে সবাই তাকে অনুসরণ করে। অনিতার স্বামী আসার সময় লক্ষ্য করে করিডোরের উপর একটা ছুড়ি পরে আছে।একটু খটকা লাগে তার কাছে। অনিতার শ্বাশুড়ি অনিতার কোলে বাচ্চাটা দিয়ে বলে ওকে দুধ পান করাতে।কিন্তু অনিতা ভয়ে কিছুটা কনফিউজড হয়ে পরে।
অনিতার কাছে বাচ্চাটা রেখে সবাই যে যার রুমে চলে যায়। কিছুক্ষন পর আবার অনিতার আর্তনাদ শুনে সবাই ছুটে আসে। এসে সবাই দেখে অনিতার বুক থেকে রক্ত বের হয়ে শরীর ভিজে গেছে। বাচ্চাটার মুখ ভর্তি রক্ত। অনিতা সবাইকে চেঁচিয়ে বলছে, এই বাচ্চাটা অস্বাভাবিক বাচ্চা, আমি একে চাই না।কিছুতেই চাই না। আমাকে মেরে ফেলবে ও। অনিতার এ রকম রিয়াক্ট ও পরিস্থিতি দেখে সে ঘরের সব মহিলারাই একটু ভড়কে গেলো।কিন্তু অনিতার শ্বাশুড়ি বলল যে, অনিতা পাগল হয়ে গিয়েছে। যে ছেলেটার দাঁতও উঠেনি।সে কিভাবে ওর শরীরে এত জোরে কামড় বসাবে!! অনিতার শ্বাশুড়ি বাচ্চাটা হাতে নেয়, তারপর কোলে নিয়ে বলে, এই বাচ্চাকে আমি বড় করব। তোমার মত একজন বদ্ধ পাগলের কাছে থাকলে হয়ত মারা ই যাবে বাচ্চাটা।অনিতার কাছ থেকে সেদিন বাচ্চাটি নিয়ে নেয় অনিতার শ্বাশুড়ি।
অনিতা তখনও ব্যাথায় কাতর ছিলো। এভাবে কেটে যায় কয়েকটি দিন। কিন্তু ওলট পালট হয়ে যায় বাসার ভেতরের। অনিতার শ্বশুড় ইদানীং খুব ভীত থাকে।এমনকি সে একা একা রাতে বাথরুমেও যায়না। খুব ভয় পায় আজকাল, হঠাৎ এ ভয় পাওয়ার কারণ হল সে যখন অনিতার শিশুটিকে কোলে নিয়ে খেলা করছিল,তখন হঠাৎ ই চিকন একটা কন্ঠ শুনতে পায়, বাবা, এই বাবা, তুমি ই তো আমার বাবা তাই না?? হিহিহিহি।
কথাটা শোনার সাথে সাথে হাত থেকে অনিতার বাবা ফেলে দেয় বাচ্চাটিকে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এটাই ছেলেটা হাত থেকে নিচে পরে গিয়েও হাসছিলো। যেনো সে ব্যাথাই পায় নি।ঘটনাটা দূর থেকে দেখে অনিতার শ্বাশুড়ি।ছুটে এসে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নেয় সে। অনিতার সাথে দেখা হলেই অনিতা তার শ্বাশুড়িকে বলে, ফেলে দিন বাচ্চাটাকে। ও স্বাভাবিক মানুষ না।প্লিজ ফেলে দিন ওকে।অনিতার শ্বাশুড়ি বলে, বৌ – মা, আমি তোমাকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিব, যদি দাদুভাইকে নিয়ে আর একবার এরকম কিছু বলো।অনিতা চুপ হয়ে যায়।
একদিন হঠাৎ সকালে অনিতার শ্বশুরের চিৎকার শুনে দৌড়ে আসে বাসার সবাই, এসে দেখতে পায় অনিতার শ্বশুর রুমের এক কোনায় হাত দিয়ে নাক মুখ ঢেকে বসে আছে।খাটের উপরে পরে আছে অনিতার শ্বাশুড়ির মৃত লাশ। আর তার পাশেই হাত পা ছুড়ে খেলা করছে শিশুটি। অনিতার শ্বাশুড়ির নাক মুখে যেনো এখনো কোনো একটা শংকার ছাপ। অনিতা চিৎকার করে উঠে, বলেছিলাম না, ও সবাইকে খুন করবে!! ও মানুষের সন্তান না। ও একটা ডেভিলস চাইল্ড, শুনলে না তো আমার কথা!! কথাটা বলেই দৌড়াতে দৌড়াতে বের হয়ে যায় অনিতা। ডাক্তার আসে, পুলিশ আসে। ফরেনসিক রিপোর্টে আসে হার্ট এট্যাক এ মৃত্যু হয়েছে তার। বাসায় বেশ বড়ো একটা সোরগোল পরে গেলেও কেউ শিশুটির দিকে আংগুল তুলে না।কারণ যে শিশুটি শক্ত বিছানায় ও শুতে পারেনা এখনো, সে কিভাবে কি করবে!! আর মৃত্যু হয়েছে হার্ট এট্যাকে।এটা কোন মার্ডার না।স্বাভাবিক মৃত্যু।
এভাবে চলে যায় কয়েকদিন।বাসার সব পরিবেশ আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে আসে। অনিতার আচরণ পাগলের মত হয়ে যায়। ওকে সামলাতে ওর বাবার বাড়ি থেকে বড় ভাই চলে আসে।অনিতার বড় ভাই একজন সাহিত্যিক মানুষ, সব কিছু যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু এই ভৌতিক শিশুর কথা শুনে তিনিও বিপাকে পড়েছেন, অনিতার শিশুর বাবা যে অনিতাত শ্বশুর, এই ঘটনা ছাড়া অন্য সব কিছুই তাকে খুলে বলা হয়েছে।সব শুনে তিনিও কিছুটা বিস্মিত। এর পর বাসায় অদ্ভুত অদ্ভুত কান্ড কারখানা ঘটতে শুরু করে। অনিতার বাসার অনেকেই রাতে অদ্ভুত সব শব্দ শুনতে পায়। তাদের বাসার জানালার গ্রীলের শক্ত লোহার দন্ড গুলো বাঁকানো পাওয়া যায়। বাসায় হঠাৎ হঠাৎ ই ঘটতে থাকে দুর্ঘটনা।এরকম আতংকের ভিতরেই কেটে যাচ্ছিলো দিন গুলো। একদিনের ঘটনা, হঠাৎ করেই আবারও হার্ট এট্যাক এ মারা যান অনিতার শ্বশুড়। এবার বাসার সবাই বাচ্চাটাকে নিয়ে ঘাবড়ে যায়।
সবাই ধরে ফেলে বাচ্চাটার মাঝে কিছু অশুভ শক্তি রয়েছে। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এই ভৌতিক বাচ্চাটাকে এতিম খানায় রেখে আসা হবে। কিন্তু অতটুকু বাচ্চা, এতিম খানা থেকে ফিরিয়ে দেয়। বাচ্চাটাকে বাসায় এনে অনাদরে অবহেলায় ও ভয়ে ফেলে রাখা হয় বাসার এক কোনায়। অনিতাও লুকিয়ে থাকে ভয়ে। অনিতার ভাই ঠিক করে আজ সে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখবে কি করে রাতের বেলা এই ভৌতিক শিশুটি, সারা রাত শিশুটির রুমের সামনে জেগে থাকে সে। জেগে থাকতে থাকতে হঠাৎ যখন সে ঘুমে ঢুলু ঢুলু অবস্থা, ঠিক তখনই বাচ্চাটার খল খলিয়ে হাসির আওয়াজ শুনে চমকে উঠে।
আস্তে আস্তে গিয়ে রুমের জানালায় উঁকি দিয়ে যা দেখে, তা সে কল্পনাও করতে পারে নি। বাচ্চাটা একটা কালো ছায়ামূর্তির উপর বসে খেলা করছে। বাচ্চাটার ভিতর যেন আনন্দের শেষ নেই, সে রকম কল কল খল খল আওয়াজ আসছে। সব ভয় দূর করে, মনের ভিতর সকল শক্তি চেপে হঠাৎ সে রুমে ঢুকে লাইট টা অন করে দেয়। তারপর যা দেখার সেটুকু দেখে লাইট টা অফ করে চলে যায় অনিতার রুমে। গিয়ে অনিতার বিছানায় কিছুক্ষন বসে থাকে। মনের ভিতর অনেক হিসেব কষার চেস্টা করে, তারপর এক সময় সব কিছুর সমাধান পায়। ফজরের আযান হচ্ছে। অনিতার বিছানায় অনিতার পাশেই শুয়ে আছে অনিতার ভাই। দুজনেই সজাগ। অনিতার ভাই ই প্রথম কথা শুরু করে।
– কেনো খুন করলি ওদের??
– আমি কাউকে মারি নি। যা করার ঐ বাচ্চাটাই করেছে।
– আমাকে বোকা বানাতে চাইলেও পারবিনা। ছোট থেকেই চিনি তোকে।।
– প্রমাণ আছে কোনো?? তাদের আমি ই খুন করেছি??
– হ্যাঁ।তোর ড্রয়ার থেকে পাওয়া, পেপ্ট্রিন ঔষধ। যেটা মানুষের হৃদক্রিয়া বন্ধ করে মানুষের হার্ট এট্যাক ঘটায়।এবং তারপর রক্তে এমন ভাবে মিশে যায়,যে পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট এ তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
– হ্যাঁ আমি ই খুন করেছি। আর তার কারণ ও ছিলো।
– কি কারণ??
– আমার শ্বশুড় এবং শ্বাশুড়ি দুজনে প্লান করে, আমাকে ধর্ষন করে।
আমার শ্বাশুড়ি যখন জানতে পারে , তার ছেলের সমস্যার কারণেই আমার বাচ্চা হচ্ছে না। তখন সে মানুষের সামনে তার মান সম্মান ধরে রাখার জন্য তার স্বামীর সাথে বসে ভয়ানক প্লান করে। অসুস্থ হওয়ার অভিনয় করে হাসপাতালে ভর্তি হয় সে।আর তখন বাসায় কেউ না থাকার সুবাদে, ঘুমের ভিতর আমার হাত পা বেঁধে আমাকে ধর্ষন করে আমার ই নিজের শ্বশুড়। আর এ সব কথা আমি জানতে পারি, যখন তারা নিজেরা আমার অগোচরে এগুলো আলোচনা করছিলো।
– তাহলে এই বাচ্চা শিশুটির উপর দোষ চাপালি কেনো??
– ও আমার বাচ্চা। ওর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য আমাকে খুব প্রয়োজন। এই খুনের সন্দেহে যাতে আমি না থাকি, তাই এতদিন এই নাটক গুলো করেছি।আমি প্রতিদিন রাতে গিয়ে ওকে দুধ খাইয়ে আসতাম। কেউ টের ও পেত না।
আমি ছিলাম সন্দেহের বাইরে।
– তাহলে কি আরো একটা খুন করে ফেলবি??
– হ্যাঁ যে মানুষটা সব জেনেও কোনো প্রতিবাদ করে নি, সে আমার স্বামী হওয়ার যোগ্য না।
পরদিন সকালে আরো একটা লাশ পাওয়া যায়, হার্ট এট্যাক এ মারা যাওয়া অনিতার স্বামীর লাশ। মিশন কম্পলিট।অনিতা তার ব্যাগ গুছিয়ে নেয়।সে সিদ্ধান্ত নেয় তার সন্তান কে বাবার বাড়ি থেকেই মানুষ করবে। একটা পাপ চক্র শেষ করে দিয়ে নিজের ভাইয়ের সাথে নিজের বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হয়ে পরে অনিতা।