”আমি বরাবরই চুপচাপ স্বভাবের ছিলাম। পড়ালেখাতে খুব ভালোও ছিলাম না কিন্তু কোনোমতে চবিতে চান্স হয়ে গেলো। ক্লাসে গেলেও কাউকে ঠিকমতো চিনতাম না। একদিন ক্যাম্পাসে বসে সিগারেট ফুকছিলাম। এমন সময় এক মেয়ে কোথা থেকে এসে সিগারেটটা মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে ফেলে দিয়ে কপট চোখে বললো, “এইসব ছাইপাঁশ মানুষ খায়? আর কখনো খাবি না এইসব” আমি প্রচন্ড অবাক হলাম। মেয়েটাকে চিনি না অথচ সে আমাকে তুই করে ডাকছে! আমার অবাক দৃষ্টিতে উপেক্ষা করে মেয়েটা চলে গেলো। তখন হাসিব এসে জিজ্ঞাসা করলো, “কি’রে কী হয়েছে?”
“মেয়েটা কে রে?”
“কোন মেয়ে?”
“ঐ যে আকাশী উড়না পরা মেয়েটা”
“ওহ! মৃন্ময়ীর কথা বলছিস? ওকে চিনিস না? ও তো আমাদের ক্লাসেই পড়ে। শত গুণে গুণান্বিত। যা.. ”
হইছে থাম বলে আমি হাসিবকে থামিয়ে দিলাম। মেয়েদের ব্যাপার ওর ভাঙা রেডিও ননস্টপ চলতেই থাকে। ক্লাসে গিয়ে মেয়েটাকে চোখে চোখে খুজলাম। দেখলাম ছেলেদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। ক্লাসের সবার সাথেই দেখি তার ভাব। সে যে খুব সুন্দরী এমন না। কিন্তু কোথায় যেনো একটা আকর্ষণীয় ভাব আছে।
এরকম একটা ঘটনার পরও আমি মৃন্ময়ীর সাথে কথা বলতে ইচ্ছেবোধ করিনি। সেও আর কথা বলেনি। আমি লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ছিলাম। মৃন্ময়ী এসে পাশে বসে সাবলীলভাবে বললো, “হাসান তোর নোটগুলো একটু দিতে পারবি?” যেনো আমি তার কতকালের বন্ধু! আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বললাম, “কবে লাগবে আপনার?” সে চোখ কপাল তুলে জিজ্ঞাসা করলো, “সে কী! আমাকে আপনি ডাকছিস কেনো? আমি কি তোকে আপনি ডাকছি? আমরা ক্লাসমেট। তুই করে ডাকবি। বুঝলি?” আমি কিছু না বলে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মৃন্ময়ী আবার বলে উঠলো, “অমন হ্যাবলাকান্তের মতো তাকিয়ে আছিস যে! কাল নোটগুলো মনে করে আনিস কিন্তু! ”
এভাবেই ছিলো আমাদের পরিচয়টা। মৃন্ময়ী অদ্ভুত একটা মেয়ে। একাই পুরো ক্লাস মাতিয়ে রাখে। ক্যাম্পাসে বসে সবাই আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ ঝুম বৃষ্টির আগমন। সবাই যেখানে বৃষ্টির ছিটেফোঁটা থেকে রেহাই পেতে ছাউনিতে ছুটছে সেখানে মৃন্ময়ী কোথা থেকে কাকভেজা হয়ে এসে আমার হাত ধরে টান দিয়ে বললো, “হাসান চল, টং দোকানে চা খাবো” আমি ওর হাত ধরে বৃষ্টিতে নেমে গিয়েছিলাম। তার পরেরদিন থেকেই ভার্সিটিতে কানাঘুষো শুরু হলো আমার আর মৃন্ময়ীর নাকি প্রেম প্রেম খেলা চলছে। মৃন্ময়ী তো শুনে হেসেই খুন! আমাকে বললো, “আচ্ছা হাসান, বলতো মানুষগুলো এতো বোকা কেন? তোর সাথে নাকি আমি প্রেম করবো।
হিহি” আমি কিছু বললাম না। চুপ করে থাকলাম। মৃন্ময়ী হঠাৎ নিজের মুখটা আমার কানের কাছে এনে ফিসফিসিয়ে বললো, “তবে তুই কিন্তু আমার কাছে স্পেশাল। আমার বেস্টফ্রেন্ড। বুঝছিস?” ওর নিঃশ্বাসের আওয়াজে আমার একটা অস্বস্তি ভাব অনুভূত হচ্ছিলো। কিন্তু এই অস্বস্তিতেও কোথায় যেনো এক ভালো লাগা! ক্লাস শেষে আমরা চলে যেতাম সিনেমা দেখতে। সিনেমা শেষে ফুচকা খেতাম। মৃন্ময়ীর সাথে যে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কত ফুচকা খেয়েছি তার হিসেব মেলা ভার! মৃন্ময়ীর এক অদ্ভুত বায়না ছিলো সবসময় ফুচকা বিল ও দিবে আর আমি দিবো আইসক্রিম বিল। মেয়েটা পাগল ছিলো বটে!
এভাবেই চলছিলো আমাদের সময়গুলো। মৃন্ময়ীর সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার পর আমি পড়ালেখাতে মনোযোগী হয়ে উঠলাম। অবদানটা মৃন্ময়ীরই। মাঝরাতে ফোন দিয়ে বলতো, “এই তুই নোট কমপ্লিট করেছিস তো?” না করলে ওর হাতে চড়, কিল ছিলো নিত্যদিনের ঘটনা। একটা সময় আমি বুঝতে পারলাম আমার ভিতর অন্যরকম একটা পরিবর্তন আসছে। আমি মৃন্ময়ীর প্রতি যেনো নেশাসক্ত হয়ে উঠলাম। ঘুম থেকে উঠে ওর মুখ দেখতে ইচ্ছে করতো। ক্লাসে বারবার ওকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করতো। ও যখন কথার মাঝে আনমনে আমাকে ছুঁয়ে দিতো আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যেতো। আমি বুঝতে পারছিলাম আমি বন্ধুত্বের নিয়ম ভাঙতে চলেছি। এটা উচিত ছিলো না। কিন্তু আমি কখনো এটা প্রকাশ করবো না বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। মৃন্ময়ীর জন্য ভালোবাসা থাকবে আমার হৃদয়ের গহীনে লুকায়িত।
আমাদের সেমিস্টার ফাইনাল শেষে দীর্ঘ একটা ছুটি পড়লো। ক্যাম্পাস বন্ধ। মৃন্ময়ীর সাথে দেখা হয় না। আমার ভেতরে হাহাকার লাগে। কোথায় যেনো এক শূণ্যতা! কারণে অকারণে ও’কে কল দিলেও কথা খুঁজে পেতাম না। ও হঠাৎ দেখা করতে চাইলো কি নাকি জরুরি কথা আছে। ভাবি নি সেই জরুরি কথাগুলো আমার জীবনের মোড়টাই পালটে দিবে। মেয়েরা প্রকৃতির নিয়ম অনুসারেই দেখা করতে গেলে আগে আসে। আমি আধঘণ্টা আগে গিয়েও দেখলাম মৃন্ময়ী দাঁড়িয়ে আছে উল্টোদিকে মুখ করে। ওর দৃষ্টি নদীর পানিতে। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী বলতে এমন জরুরি তলব তোর?” মৃন্ময়ী আনমনে হয়ে বললো, “আমায় বড্ড ভালোবাসিস না?”
এরকম কিছু শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। নিজেকে ধাতস্থ করতে পারলাম না। আমি যথেষ্ট চেষ্টা করেছি যাতে ও কিছু বুঝতে না পারে। কিন্তু তার পরেও! একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম। মৃন্ময়ী পানির উপরই দৃষ্টি রেখে বলতে লাগলো ,” তুই মুখে না বললেও আমি বুঝি জানিস। আমার স্পর্শে তোর যে শিহরণ তা আমি অনুভব করতাম ভীষণভাবে। অনেকবার চেয়েছি তোকে ছুবো না তাকাবো না তোর চোখে। কিন্তু পারিনি বিশ্বাস কর। বারবার তোকে ছুঁয়ে দিয়েছি শিহরণটা অনুভব করতে। আমাকে অন্য ছেলে ফ্রেন্ডদের সাথে দেখে তোর চোখে যে অসহায় দৃষ্টি ফুটে উঠতো তা আমি উপেক্ষা করতে পারতাম নারে। কষ্ট হতো ভীষণ রকমের। ইদানীং কি যে হয়েছে জানিস? ইচ্ছে করে তোর কাঁধে মাথা রেখে হারিয়ে যাই কোনো কল্পরাজ্যে। তোর বুকে খুঁজে নিই এক ফোঁটা সুখের জলোচ্ছ্বাস। কিন্তু বিধাতা যে সবাইকে সব সুখ দেয় নারে। আমি তো শুধু তোর ভালো বন্ধু হয়ে থাকতে চেয়েছিলাম। তবে কেন বিধাতা এরকম অনুভূতি দিলো বলতে পারিস? বিধাতা অর্ধম সহ্য করবে না অথচ অর্ধমের অনুভূতি দেয়। কী আজব!”
আমি অবাক হয়ে দেখলাম মৃন্ময়ী কাঁদছে। মেয়েটাকে আমি কখনো কাঁদতে দেখিনি। কান্না করলে নাকি মেয়েদের খুব সুন্দর লাগে। কিন্তু মৃন্ময়ীকে সুন্দর লাগছে না। অসহায় লাগছে যেটা আমি সহ্য করতে পারছি না। আমার গলায় কথা আটকে আসছিলো। অনেক চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারছিলাম না। মৃন্ময়ী আমার দিকে তাকিয়ে হয়তো তা বুঝেছিলো। হঠাৎ কী হলো! ঝড়ের বেগে মৃন্ময়ী আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। কতক্ষণ পর ছেড়ে দিয়ে নাক টেনে বললো, “মাফ করে দিস রে! যে সম্পর্ক সমাজ, পৃথিবী কেউ মেনে নিবে না সেই সম্পর্ক গড়ে আমরা একা লড়ে টিকে থাকতে পারবো নারে! এই পৃথিবী বড্ড বেশি স্বার্থপর রে। তাই আমি তোর দৃষ্টির অগোচরে চলে যাচ্ছি। তোর মনের ঠিক যতটা কাছে আছি আমি ঠিক ততটাই দূরত্বে থাকবো দৃষ্টির। আমার নিজের জন্য হলেও আমাকে এই দূরত্ব বাড়াতেই হবে।
অন্যদের মতো বলবো না তুই আমাকে ভুলে যা। ভালো থাকিস। আমি চাই তোর হৃদয় কোণে আমার জায়গাটা আমৃত্যু থাক। অন্তত আমাদের মন দুটো তো ভালোবাসার প্রশান্তি পাক। মনের খবর তো সমাজ জানবে না বাধা দিতেও আসবে না। আসছি আমি। আর কখনোই হয়তো দেখা হবে না আমাদের” কথা শেষ হতেই মৃন্ময়ী এক প্রকার ছুটেই আমার কাছ থেকে পালিয়ে গেলো। আমার কানে বারবার প্রতিধ্বনি হচ্ছিলো “আমাদের হয়তো আর কখনোই দেখা হবে নারে!” যাকে একনজর না দেখলে দম বন্ধ হয়ে আসে। তার সাথে আর কখনো দেখা হবে না? এটা কল্পনাতেও তো আমি ভাবতে পারিনি। আমি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে মৃন্ময়ীর চলে যাওয়া দেখেছিলাম ফেরাতে পারিনি তাকে। সমাজ, নিয়মরীতি সব কিছুর শেকল ভেঙে দৌড়ে যেতে পারিনি মৃন্ময়ীর কাছে।”’
এরপর আর কিছু লেখা নেই। ডায়েরির পেইজগুলো উল্টেপাল্টে দেখলো আরাফ। নাহ আর লেখা নেই। ডায়েরিটা পেয়েছে ওর ছোট চাচ্চুর ড্রয়ারে। ছোট চাচ্চু বন্ধুর মতো। তাই আর অনুমতি নেয়নি। ডায়েরি পড়তে পড়তে প্রায় মাঝরাত হয়ে গেছে। আরাফের অস্থির লাগছে এটা পড়ে। ও হাসানের ঘরে গেলো। হাসান তখনো জেগে আছে। আরাফ পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। হাসান আরাফকে দেখে চমকে উঠে বললো, “তোর চোখ লাল কেন? কি হয়েছে?”
আরাফ ধরা গলায় বললো, “তুমি এতোটা যন্ত্রণা ভিতরে চেপে রেখে কীভাবে এতো স্বাভাবিক আছো?” “কী বলছিস তুই?” “মৃন্ময়ী আন্টির জন্য তোমার খুব কষ্ট হয় তাই না? এইজন্য-ই এতো রাত জাগো, সিগারেট খাও” আরাফের কথায় ধাক্কা লাগে হাসানের। অবাক হয়ে তাকায়। আরাফ ডায়েরি দেখিয়ে বলে, “আমি সব পড়েছি।
তোমার অনুমতি নেইনি। আমি বুঝতে পারিনি এরকম কিছু থাকবে। স্যরি, চাচ্চু” হাসান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “কষ্ট হয় কি’না জানি নারে। একটা শূণ্যতা গ্রাস করে। তার চোখ না দেখতে পারার হাহাকার জাগে। তবে এখন আর দম বন্ধ লাগে না। মানিয়ে নিয়েছি যেমনটা সবাই মানিয়ে নেয় আর কী!” “আন্টিও তো তোমায় ভালোবাসতো তবে ছেড়ে কেন গেলো?” হাসান সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে বললো, “ঐ যে অধর্ম! তার সিঁথি রাঙানোর ক্ষমতা আমার ছিলো না। আমি তো তিনবার কবুল বলাতে সীমাবদ্ধ আর সে রাঙা সিথিতে”