নিঝুম রাত।গভীর অন্ধকার চারিদিক।এই রোডের ল্যাম্পপোস্টটা নষ্ট হয়ে গেছে হয়তো। একে তো নিরিবিলি রাস্তা,তার উপর আবার আজ এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার।এর চাইতে বেশি অস্বস্তিকর আর কি বা হতে পারে? হঠাৎ একটা কুকুর ডেকে ওঠায় প্রায় লাফিয়ে উঠলো মিশি। হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক বেড়ে গেলো।আরেকটু হলে হয়তো হার্ট বাইরেই বেরিয়ে আসতো। রাত ১০টার বেশি বাজে।এমন একটা রাস্তায় এতো রাতে অন্ধকারে এরকম পরিস্থিতিতে একটা মেয়ের যে কী রকম শোচনীয় অবস্থা হতে পারে সেটা তো আর বলে বুঝানোর অপেক্ষা রাখে না। যতরকম দোয়া মনে আসছিলো সবগুলো বিড়বিড় করতে করতে সামনে এগোতে থাকলো মিশি।
আজকের মতো কোনোভাবে আল্লাহর নাম নিয়ে ভালোয় ভালোয় বাসায় পৌঁছাতে পারলে হয়। নিশাতের কাল পরীক্ষা।ওকে পড়াতে পড়াতে কখন যে ১০টা বেজে গেলো টেরই পেলো না ও।ভাইটা বলেছিলো ওর জন্য দুটো খাতা নিয়ে যেতে।কিন্তু এতোক্ষণে তো নিশ্চয়ই লাইব্রেরীটাও বন্ধ করে দিয়েছে। ইশ্,আজকে কী ভুলটাই না করে ফেললো ও। ক্ষুধার জ্বালায় আর পা ও চলছে না যেনো,সেই সকালে দুটো বিস্কুট আর এক কাপ চা খেয়েছে।তারপর আজ সারাদিন না খেয়ে আছে।এখন আর সত্যিই সহ্য করা যাচ্ছে না।সত্যিই ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
এই তো বাড়ির কাছাকাছিই পৌঁছে গেছে l নিঃশব্দে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো ওর ভিতর থেকে। কিন্তু বাড়ির গেটের সামনে গিয়েই আবার থমকে দাঁড়ালো মিশি।ওটা কী দেখা যাচ্ছে দূরে? একটা আগুন একা একা নড়াচড়া করছে কীভাবে? ছোটবেলায় শুনেছে রাতের বেলা ভূত প্রেত নাকি ঘুরে বেড়ায়।আর দূর থেকে দেখতে নাকি এরকম আগুনের মতো লাগে। ঘাম দিতে লাগলো ওর।বুকে ফুঁ দিয়ে কোনোমতে এক দৌঁড়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গিয়ে দরজা ধাক্কাতে লাগলো।ভাই দরজাটা খুলে দিতেই ভেতরে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো মিশি।
–এতোক্ষণ কোথায় ছিলি?
–বাবা কাল তো নিশাতের পরীক্ষা।তাই পড়াতে পড়াতে কখন এতো রাত হয়ে গেলো বুঝতেই পারি নি।
–তুই যে সত্যি বলছিস সেটা কী করে বিশ্বাস করবো আমি?
–মানে বাবা?কী বলছো এসব তুমি?
–হ্যা,ঠিকই বলছি। বল,কার সাথে ছিলি এতো রাত অব্দি? বাবা,তুমি দয়া করো চুপ করে।তুমি কী চেনো না তোমার মেয়েকে? তুমি তো জানোই আমি কেমন।
–চুপ কর মুখে মুখে অযথা তর্ক করবি না।আর ভুলটা তো আমারই।আমি তো ভুলেই গেছিলাম যে তোর মতো এমন বিচ্ছিরি মেয়েকে পছন্দই বা করবে কে? বাবার কথা শুনে চোখের জল আর আটকে রাখতে পারলো না মিশি।বাবার সামনে থেকে সরে বারান্দায় চলে গেলো। ও জানেনা ওর দোষটা কোথায়? গায়ের রঙটা তো সৃষ্টিকর্তারই দান।তবুও কেন এই কালো রঙের জন্য হাজারটা কথা শুনতে হয় ওকে?
সবার কথা না হয় ছেড়েই দিলো কিন্তু ছোটবেলা থেকে বাবার এই কথাগুলো সত্যিই আর সহ্য হয় না ওর।
ছোটবেলা মা মারা যাওয়ার পর থেকেই ও একা হয়ে পড়েছে।লেখাপড়াটাকেই বেছে নিয়েছিলো একমাত্র সম্বল হিসেবে।কিন্তু ক্লাস টেনে থাকতে বাবার রোড অ্যাক্সিডেন্টে বাম পা টা হারানোর পর থেকে ৩জনের এই সংসারের হালটা ওকেই ধরতে হয়। ভাইটা ওর থেকে ১০বছরের ছোট।সংসারের বড় মেয়ে হিসেবে এই বিপদে পরিবারের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেয়া ছাড়া আর কিই বা করার ছিলো ওর। তারপর থেকেই ক্লাস শেষ হওয়ার পর থেকে সন্ধ্যে অব্দি একের পর এক টিউশনি করিয়ে সংসার চালায় মিশি l প্রতিদিন কতোটা কষ্টই না করতে হয়।কিন্তু বাবা কোনোদিনও খারাপ ছাড়া একটু ভালো ব্যবহার করেন না ওর সাথে। এরকম ভাগ্য নিয়ে খুব কম মেয়েই জন্মায়।
আচমকা বারান্দা থেকে নিচের দিকে চোখ গেলো ওর।তখন যে গোল ছোট একটা আগুন নড়াচড়া করতে দেখেছিলো সেটা এখনও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এবারে মিশি একটু ভালো করে লক্ষ্য করলো,তারপর বুঝতে পারলো যে বাড়িওয়ালার ছেলে রনি ওটা। ওই ছেলের তো আবার রাত জেগে নেশা করার অভ্যেস আছে।তাই ওখানে বসে সেই থেকে সিগারেট টানছে।আর তখন ভয়ের চোখে এটা দেখে কী ভয়ই না পেয়েছিলো ও।ভাবতেই ভীষণ হাসি পেলো। তাছাড়াও ভূত হলেই বা কী হতো? ভূত হয়তো ওর মতো কালো মেয়েকে দেখে নিজেই ভয় পেয়ে পালিয়েই যেতো।যাই হোক,কালো হওয়ার এই একটা সুবিধে তো আছে।
এসব ভাবতে ভাবতে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো ও।একটু আগের ক্ষুধা এখন আর নেই।সকালে উঠে আবার ভার্সিটিতে যেতে হবে।শুয়ে চোখ বুজতেই সারাদিনের ক্লান্তিতে মুহুর্তেই ঘুমিয়ে পড়লো মিশি। সকাল সকাল উঠে হালকা নাস্তা করেই ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো মিশি। আজ ওর মাস্টার্স পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবে।সারাটা জীবনের সব কষ্টের ফলটা আজকেই পাবে ও।তবু ভীষণ ভয় হচ্ছে ওর।হাত পা বারবার ঠান্ডা হয়ে আসছে। আজ ভার্সিটিতে ঢোকার সাথে সাথে অবাক হয়ে গেলো মিশি। যেই ছেলে মেয়েগুলো ভার্সিটির প্রথম দিন থেকে ওকে দেখলে হাসাহাসি করে,ওর কালো রঙ আর সাধারণ গেটআপ দেখে যারা পৈচাশিক হাসি হাসতো আর প্রতিনিয়ত ওকে অপমান করতো আজকে সেই প্রত্যেকটা ছেলে মেয়ে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কারোও মুখ থেকে কোনো কথা বেরোচ্ছে না,এমনকি চোখের পলক পর্যন্ত পড়ছে না কারো।
মিশি কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।নোটিশ বোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সবাই সরে গিয়ে জায়গা করে দিলো ওকে। মিশি রেজাল্টটা দেখে কেঁদে ফেললো।ও বিশ্বাস করতে পারছে না এখনও।কিন্তু এটাই সত্যি,ভার্সিটিতে টপ করেছে ও।হাইয়েস্ট মার্কে। আজ ও পেরেছে ওর এতোদিনের অপমানের যোগ্য জবাব দিতে।ছুটতে ছুটতে ও বেরিয়ে গেলো ভার্সিটি থেকে।বাবা আর ভাইকে সুখবরটা দেওয়ার আগপর্যন্ত ওর শান্তি নেই l বাড়িতে গিয়েই বাবার পা ধরে সালাম করলো মিশি।
–কী হয়েছে?
–বাবা আজ আমার রেজাল্ট বেরিয়েছে?
–তো কী খবর?পাশ করেছিস তো নাকি?
–হ্যা বাবা,আমি ভার্সিটিতে টপ করেছি।
–মানে? কী বলছিস এসব?
–হ্যা বাবা,আমি পেরেছি।আমি পেরেছি প্রমাণ করতে।তোমার ছেলেকে নিয়ে দেখা সব স্বপ্ন আমি মেয়ে হয়ে পূরণ করতে পেরেছি বাবা।
মিজান সাহেবের চোখে আজ প্রথমবারের মতো তার মেয়ের জন্য জল আসলো।তবে এ চোখের জল দুঃখের নয় গর্বের। যে মেয়েকে তিনি ছোটবেলা থেকে কালো বলে অবহেলা করেছেন আজ সেই মেয়েই কিনা তার মুখ সবার সামনে উজ্জ্বল করলো।সত্যিই আজ ভীষণ আনন্দ হচ্ছে তার। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে তিনি কাঁদতে লাগলেন।
মিশির আজ আর কোনো কষ্ট নেই।এতোগুলো বছরের সব কষ্ট আজ মুছে গেছে ওর মন থেকে।ও আর কোনো অভাব থাকতে দেবে না বাবা আর ভাইয়ের জীবনে। দেখতে দেখতে ৩টা বছর কেটে গেছে।মিশি এখন একটা কলেজের ইংরেজীর অধ্যাপক।কালো মেয়েটার বিয়েও হয়ে গেছে। স্বামী ব্যাংকার।একটা ছোট বেবিও আছে। ওদের নিজের একটা দোতলা বাড়ি আছে।কোনো কিছুরই অভাব নেই এখন আর। ওর বাবাও এখন খুব ভালোবাসে ওকে।সারাদিন একমাত্র নাতনিকে নিয়ে কাটিয়ে দেয়। ছোট ভাইটাও বেশ বড় হয়ে গেছে।কলেজে পড়ে এখন।
আজ হঠাৎ পুরোনো স্মৃতিগুলো নিয়ে ভাবতে থাকলো মিশি। তখন মা যাওয়ার পর লেখাপড়াটাকে আঁকড়ে না ধরলে এখন হয়তো ও কোনো গ্রামের গৃহবধূ হয়ে পড়ে থাকতো। যেখানে উঠতে বসতে কালো রঙের জন্য হাজারটা খোঁটা শুনতে হতো।কিন্তু না সেরকমটা হতে দেয়নি ও।নিজের ভাগ্যটাকে নিজের হাতে গড়েছে।লেখাপড়াকে সঙ্গি করেই আজ ও এতোদূর। শিক্ষা থাকলে কখনো মানুষ পিছিয়ে থাকতে পারে না।এখন ওর যোগ্যতাই সব।গায়ের রঙের জন্য আর কোনো কথা শুনতে হয় না মিশিকে এখন।সবাই প্রচুর শ্রদ্ধা আর সম্মান করে ওকে।এটাই তো জীবন।স্বপ্ন না দেখলে কখনো বড় হওয়া যায় না।স্বপ্ন আর সেটা সফল করার জন্য কঠোর অধ্যবসায়ই গড়ে দিয়েছে ওর এই সুন্দর ভবিষ্যৎ।প্রতিটা মানুষের জন্য এ যেন এক চরম দৃষ্টান্ত।পূর্ব দিগন্তের লাল আলোর দিকে দৃষ্টি গেল মিশির,উদীয়মান লাল সূর্যের মধ্যে যেন নিজেকেই খুঁজে পেল নতুন করেl