একজন অপরাজিতা

একজন অপরাজিতা

আমার ফুফু ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন একজন হিন্দুলোককে। এদিকে আমার চাচারা ছিলেন কনজারভেটিভ মুসলিম।উনারা পারতেন না তো ফুফুকে মেরে কুটে গাঙের জলে ভাসিয়ে দিতে। বাবাকে খুব অল্প বয়সেই হারিয়েছি। তাই বাবার কুলে কাছের লোক বলতে ছিলো আমার আট চাচারা। চাচারা শুধু আমাদের একটা কথাই বলতেন,” তোর ফুফীর কাছ থেকে দূরে থাকবি।বেশী পড়ালেখা কইরা শয়তান হইয়া গেছে। ” আমি ও আমার কাজিনরাও আমাদের ফুফুকে তাই শয়তান ভাবতাম। বছরে দু’একবার ফুফু দাদুবাড়ী আসলেও আমরা কেউ তার কাছে যেতাম না।

ফুফু আসতেন। তার ভাইদের পা ধরে কাঁদতেন। আর তার ভাইরা বলতো ,” আইছোস। বেড়া!খা!ঘুমা!তোর ভাগের জমিতে গিয়া ঘর তোল কোন সমস্যা নাই।কিন্তু ওই হারামজাদারে নিয়া আইলে খুন করমু।” আর আমার চাচীরা যদি ফুফুর হয়ে কোন কথা বলতেন তবে সেদিন কেয়ামত শুরু হয়ে যেতো।চাচারা একদল ; আর চাচীরা একদল। মাঝে দিয়ে রান্না বান্না বন্ধ। আর উঠোন জুড়ে থালা বাসন উড়োউড়ি করছে। প্রতিবেশীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের চাচা-চাচীদের বিশ্বযুদ্ধ দেখতো।

আমরা বাচ্চারা শিকার হতাম অনশন ধর্মঘটের। এক পর্যায়ে বাচ্চাদের অভুক্ত চেহারা দেখে চাচীরা চুলোয় আগুন জ্বালাতেন।কিন্তু আমার চাচারা কখনো হার মানেন নি। যতোবারই ফুফু আসতেন;চোখের জলে বাপ-দাদার ভিটে ভিজিয়ে চলে যেতেন। এর মাঝে এক কোরবানীর ঈদে দাদুর ভিটেয় বসে গরুর মাংস কোপাচ্ছিলাম। এমন সময় একটা শাদা প্রাইভেট কার এসে থামলো। প্রাইভেট কার থেকে একজন ত্রিশ বত্রিশ বছরের যুবক নেমে বললো,” ঈদ মোবারক।” তা শুনে আমার বড় কাকা বলে উঠলেন,” তোরা বইছা আসোছ কেন?শালারে কুপা।” কিসের গরু কিসের কি?চাপাতি হাতে সবাই ছুটলাম ওই যুবকের পেছনে। এতোগুলো চাপাতি দেখে বেচারা গাড়ী রেখেই উল্টো ঘুরে দৌড়াতে শুরু করলো।

পরে জেনেছিলাম উনি আমার ফুফুর হাজবেন্ড।বেচারা! ঈদের দিন এসেছিলো ; ভেবেছিলো সব ভুলে তাকে আপন করে নিবে।উল্টো চাপাতির দৌড়ানি দিয়ে ভাগালো। এই ঘটনার পর বহু বছর কেটে গেছে। গ্রাম ছেড়ে আমাদের পরিবার শহরে শিফট হয়েছে।শহরে আসার পর ফুফুর বাসায় কয়েকবার গিয়েছি; তবে উনার হাজবেন্ডকে দেখি নি। কিছুদিন আগে ফুফুর মেয়ে লাকী কল দিয়ে বললো,” শান্তাইয়া! জলদি আয়!আম্মু কেমন জানি করছে।” শান্তাইয়া মানে হলো শান্ত + ভাইয়া। দু’টো মিলিয়ে একসাথে ডাকে শান্তাইয়া। আমি ছুটলাম ফুফুর বাসায়। গিয়ে দেখি ফুফু শুঁয়ে আছে। তার পাশে একজন চুলপাকা ভদ্রলোক বসা।আমি গিয়ে লাকীকে জিজ্ঞাসা করলাম,” এই মালটা কে?”

-” আমার আব্বু।”

কথাটা শুনেই রক্ত গরম হয়ে গেলো।লাকীকে চেঁচিয়ে বললাম,” এই কু** বাচ্চা ঘরে থাকলে আমারে ডাকবি না।” বলেই বের হয়ে যাচ্ছিলাম। ফুফু বিছানা থেকে অনেক কষ্ট করে ডাকতে লাগলো-” শান্ত!শুনে যা।” ফুফুর কণ্ঠে একটা করুণ আর্তনাদ ছিলো। তা সেদিন উপেক্ষা করতে পারি নি।আবার এসে ফুফুর বেডরুমের দরজার সামনে দাঁড়ালাম। তবে ভেতরে প্রবেশ করলাম না। চোখ গরম করে ওই লোকটাকে দেখতে থাকলাম। ইচ্ছে করছে এখনই চাপাতি এনে কুপিয়ে মাংসের কিমা বানাই। ফুফু চোখের ইশারা করতেই উনি বারান্দায় চলে গেলেন। আমি গিয়ে ফুফুর পাশে বসলাম। ফুফু উঠে বসলেন। এরপর ধীরে ধীরে আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,” তোর ফুফার উপর তোর অনেক রাগ?”

-” ফুফা? ওই হারামজাদা আমার ফুফা না। ওরে তো সামনের ঈদে জবাই দিমু।”

ফুফু হাসেন। আশ্চর্য! এতো অসুস্থতার মাঝে মহিলাটা হাসছে কি করে? ফুফু আবার বলেন,” তোর দাদা মারা যাবার পর; আমার ভাই এরা যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো। শুধু তোর বাবাই আমার কষ্ট বুঝেছিলো। তাই তো সবার চোখ রাঙানো উপেক্ষা করে আমায় শহরে পড়তে পাঠালো। প্রতি মাসে পড়াশোনা,থাকা খাওয়ার খরচা পাঠাতো।কিন্তু কপাল খারাপ হলে যা হয়। দু’বছর পর তোর বাবা মারা গেলো।” ফুফু এবার কথা বন্ধ করে চোখ মুছলেন।বাবার কথা শুনে মনটা একটু কেমন যেনো হয়ে গেলো।আমি জিজ্ঞেস করলাম, ” তারপর?”

-” তারপর আর কি?খরচা আসা বন্ধ হয়ে গেলো। একবার ভেবেছিলাম বাড়ী চলে আসি। কিন্তু তোর বাবাকে কথা দিয়েছিলাম- আমি একদিন সচিব হবো। তাই আর ফিরি নি। টিউশনি শুরু করলাম।কিন্তু তাতে হচ্ছে না। তাই ভাত খাওয়া ছেড়ে দিলাম।মুড়ির মোয়া কিনতাম। সকালে দু’টো খেতাম; দুপুরে দু’টো খেতাম; রাতে দু’টো খেতাম।” ফুফুর কথা শুনে কেন যেনো আমার চোখেই জল এসে পরলো। একটা জীবনে এতোটা স্ট্রাগল করা কি করে সম্ভব? ফুফু আবার বলতে লাগলেন,” তখন আমার বিসিএস এক্সাম চলছে। এমন সময় পরিচয় হয় সুদীপ্তর সাথে- মানে তোর ফুফা।” আমি আবার চেঁচিয়ে বলাম,” ওরে আমার ফুফা বলবেন না।”

ফুফু হাসলেন। হাসতে হাসতে আবার বললেন,” বাবা নেই। মাথার উপর কোন ছায়া নেই। ভাইরা যে যার মতো সংসার করছে। ঘর থেকে বের হলেই বখাটেদের মন্তব্য কিংবা মাঝ রাতে ঘরের দরজায় বাড়ীওয়ালার নক নক। আমি কি করবো? আমার আর সুদীপ্তের প্রেমের বয়স তখন আড়াই মাস।সুদীপ্তর চেম্বারে গিয়ে বললাম,- বিয়ে করতে হবে এখন। পারবে? ডাক্তারি এপ্রোনটা খুলে সুদীপ্ত বলেছিলো- আগে বলবে না? শেরওয়ানি পরে আসতাম।” ঘটনা এই অব্দি ঠিক ছিলো। বাকী ঘটনাতো আমার জানা। কিন্তু নাহ! আমার ধারণা ভুল। সবচেয়ে বেশী শকড হলাম যখন ফুফু বললেন,” আমার আর সুদীপ্তর ডিভোর্স হয়েছে প্রায় পনেরো বছর হলো।” ফুফুর কথা শুনে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। আমি হা করে তাকিয়ে আছি ফুফুর মুখের দিকে। লাকীর বয়স ষোল কি সতেরো হবে। তাহলে লাকীর জন্মের পর পরই ডিভোর্স? আমি জিজ্ঞেস করলাম,” কি বলছেন এসব?”

-” লাকীর জন্মের বছর খানেক পর জানতে পারি সুদীপ্তর আরেকজন স্ত্রী আছে। সেই ঘরে দু’টো বাচ্চাও আছে। ”

-” ডিভোর্স দিলে ও এখানে কি করে?”

-” আমার আত্মমর্যাদা ওকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে; কিন্তু আমার হৃদয়টা ওকে বারবার কাছে ডাকে। সে একজন মিথ্যেবাদী, প্রতারক, ভণ্ড অথচ তার ভালবাসা পুরোটাই সত্য। এটা এমন এক দোটানা- যা বাচঁতেও দেয় না; মরতেও দেয় না।তাইতো ধুঁকে ধুঁকে বাঁচছি অথবা ধুঁকে ধুঁকে মরছি।” আমার চোখটা জলে চিকচিক করছে।একটা অসহায় নারী? কি করে এখনো নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে। আগে আমি ভাবতাম- আমার ফুফু সচিব। আবার তার হাজবেন্ড ডাক্তার। তাই তার কোন কষ্ট নেই। কিন্তু আজ মনে হলো তার যা কষ্ট আছে তার ছিটেফোঁটাও আমাদের নেই।

ফুফু আবার বললেন,” সুদীপ্ত চেয়েছিলো আমার জন্য ওর আগের স্ত্রীকে ডিভোর্স দিতে। আমি রাজী হই নি। আমি চাইলেই পারতাম একটা সুখী সংসার গড়তে। আমরা দু’জন; আমাদের দু’জন। কিন্তু আমি তা করি নি। থাক না কারো সিঁথিতে সিঁদুর ; আমার না হয় কপাল পুড়লো।” স্বান্তনা দেবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। কি স্বান্তনা দেবো? একটা মানুষ যার আটটা ভাই বেঁচে আছে,একজন স্বামী ছিলো,একজন প্রেমিক আছে ; অথচ তিনি একা। সম্পূর্ণ একা। আমি বললাম,” ফুফু আমি যাই।”

-” দুপুরে খেয়ে যাবি। আর সুদীপ্তকে কিছু বলিস না। লাকীর কল পেয়ে দেখতে এসেছে।উল্টোপাল্টা ভেবে আবার চাপাতি নিয়ে দৌড়াস না।” ফুফুর কথা শুনে আমি হাসি। আর ভাবি- এবার ঈদে দাদুবাড়ী গিয়ে সব চাচাদের একজন অপরাজিতার গল্প শুনাবো।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত