সতী সাধ্বী নারীর জীবনে সিঁথির সিন্দুর সব চাইতে গর্বের ধন; রাজধানীর সামাজিক জীবনে ফ্রেণ্ডস কলোনীতে বাস করা তার চাইতে অনেক বেশী গর্বের, অনেক বেশী সম্ভ্রমের। ডিপ্লোম্যাটিক এনক্লেভের ছেলেমেয়েরা অশোকা হোটেলে সাঁতার কাটতে যায়, জিমখানা ক্লাবে টেনিস খেলে, কিন্তু ফ্রেণ্ডস কলোনীর ছেলেমেয়েদের এত বিড়ম্বনা সহ্য করতে হয় না। সামনের লনের বাঁ দিকে টেনিস কোর্ট, ভিতরের লনের ডান দিকে সুইমিং পুল অনেক বাড়ীতেই পাওয়া যাবে। সারা ফ্রেণ্ডস কলোনীতে একটি দোতলা বাড়ী নেই, কিন্তু কোন বাড়ীর দক্ষিণাই হাজার চারেকের নীচে নেই বললেই চলে। বাংলা সরকারের হেড এ্যাসিস্ট্যান্টের চাইতে এখানকার বাবুর্চির মাইনে বেশী, ডেপুটি সেক্রেটারীর চাইতে ভাল পোষাক পরে, অনেক ভাগ্যবান সেক্রেটারীর চাইতে বেশী দেশ ঘুরছে।
ফ্রেণ্ডস কলোনীর বাসিন্দাদের নাম খবরের কাগজের প্রথম পাতায় পাওয়া যায় না। মাঝে-মাঝে আইন-আদালতের কলমে বা কোম্পানীর নোটিশের মধ্যে পাওয়া যায়। এরা অনেকেই মন্ত্রীদের বক্তৃতা পড়েন না, কিন্তু ফিনান্স মিনিষ্ট্ৰী বা উদ্যোগ ভবনের আণ্ডার সেক্রেটারীদের জন্মদিন পালন করেন লুকিয়ে লুকিয়ে।
রাজধানী দিল্লীতে যখন ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের তীর্থক্ষেত্র ছিল তখন গলফ, লিঙ্ক জোড়বাগ–ডিফেন্স কলোনী–ডিপ্লোম্যাটিক এনক্লেভ বা ফ্রেণ্ডস কলোনর জন্ম হয়নি, তিন-চার কি পাঁচ হাজার টাকা বাড়ী ভাড়া দেবার প্রশ্ন ওঠেনি। দেশের হাওয়া বদলের সঙ্গে সঙ্গে, সোস্যালিজমের ঝড় ওঠবার পর ডিপ্লোম্যাটিক এনক্লেভ ফ্রেণ্ডস কলোনীর সৃষ্টি হলো, হাজার-হাজার টাকা বাড়ী ভাড়া দেবার খদ্দেরেরও অভাব ঘুচল।
দিল্লীর সমাজ-জীবনের এ হেন ফ্রেণ্ডস কলোনীতে মিঃ কাপুরও বাস করতেন। যাঁরা দূর থেকে তাকে দেখেছেন, দেখেছেন ফ্রেণ্ডস কলোনীর জীবনকে, তারা জানেন, বিশ্বাস করেন কাপুর সাহেবের জীবনে শুধু আনন্দের বন্যা বয়ে গেছে। দিল্লীর মানুষ বিশ্বাস করে ফ্রেণ্ডস কলোনীর জীবনে কোন দুঃখ, কোন হতাশা, কোন দীর্ঘ নিঃশ্বাস থাকতে পারে।
কিন্তু ফ্রেণ্ডস কলোনীর কাপুর সাহেব জীবনের শেষ দিনগুলিতে চোখের জলের বন্যা বইয়েছেন, বুকের মধ্যে অসহ্য জ্বালা উপলব্ধি করেছেন। শুধু কি তাই? মানুষ দেখলে ভয় পেয়েছেন, সুন্দরী যুবতী দেখলে শিউরে উঠেছেন, মদের গেলাস দেখলে ছুটে পালিয়েছেন। রাত্রিতে ঘুমিয়েও শান্তি পাননি কাপুর সাহেব। ঘুম ভেঙ্গে মনে পড়েছে অতীত দিনের স্মৃতি। তিরিশ বছরের অতীত স্মৃতির জমাট বাঁধা অন্ধকার ভেদ করে ঘরে এসেছেন রায়বাড়ীর ছোট-বৌ………
…বিলেত থেকে ফেরার পর আমাকে বর্ধমান, চট্টগ্রাম, বরিশাল ঘুরিয়ে প্রথম ইণ্ডিপেন্টে চার্জ দিল খুলনায়। আজকের মত তখনকার দিনে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটদের অত ঝামেলা পোহাতে হতো না। আইন শৃঙ্খলা করাই ছিল প্রথম ও প্রধান কাজ। খুলনায় এসব ঝামেলা একটু কমই ছিল এবং প্রথম কয়েকটা মাস ভালই কাটল। কিন্তু তারপর এক অতি বর্ধিষ্ণু গ্রামে পর পর দুটি খুন হওয়ায় পরিস্থিতি বেশ একটু জটিল হলো। গোয়েন্দা বিভাগের তদন্তে মনে হলো স্বদেশীওয়ালাদের কাজ নয়। সরকার ঠিক নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। আমার উপর আদেশ হলো একটু ব্যক্তিগত নজর রাখতে। কমাস আরো কেটে গেল।
এরপর একদিন নিমন্ত্রণ এলো ঐ গ্রামের উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী সভায় সভাপতিত্ব করতে। নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম। ঠিক করলাম ঐ গ্রামে কয়েক দিন থাকব, কিন্তু কাউকে জানালাম না।
যথারীতি অন্যান্য ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটদের মতো আমারও থাকার ব্যবস্থা হলো রায়বাড়ী। মহাসমারোহে আমাকে অভ্যর্থনা করা হলো। কয়েক হাজার গ্রামবাসীর সামনে বায়বাড়ীর তিন বাবু ও তিন গিন্নী আমাকে নতুন জামাই-এর চাইতেও অনেক বেশী সমারোহে বরণ করলেন। ছোটবাবু বেশ সৌখীন মানুষ; সন্ধ্যার পর একটু নাচ-গানেরও আয়োজন করেছিলেন।
পরের দিন সকালে পুরস্কার বিতরণী সভায় সভাপতিত্ব করলাম। সভার শেষে স্কুলের জন্য সরকারী তহবিল থেকে পাঁচ হাজার টাকা দান করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করায় গ্রামের আপামর সাধারণ আমার মহানুভবতায় মুগ্ধ হলো।
বিকেলবেলায় গ্রাম দেখতে বেরুলাম। সবাই ভেবেছিলেন সন্ধ্যার আগেই আমি শহরের দিকে রওনা হবে। কিন্তু বেড়িয়ে এসে জানালাম, গ্রামটাকে ভালবেসে ফেলেছি। কদিন থেকে যাব। রায়বাবুদের বললাম, তাছাড়া পর পর দুটি দারোগা খুন হওয়ায় গ্রামের লোকের মনে একটু আতঙ্ক দেখা দিয়েছে, সুতরাং আমি থাকলে হয়তো তাদের আস্থা ফিরে আসবে।
মুহূর্তের মধ্যে দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে নিলাম। মনে হলো ছোটবাবু ও ছোট গিন্নীর কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে। কিন্তু মুখে অবশ্য সবাই অত্যন্ত সন্তোষ প্রকাশ করলেন।
কাপুর সাহেব তার অতীত জীবনের কথা বলতে গিয়ে একটু পায়চারী করে নিলেন। একটু হাসলেন, একটু ভাবলেন, একটু যেন তলিয়ে গেলেন।…
জানো জার্নালিস্ট, ছোটবাবু জমিদারীর জরুরী কাজে গ্রামান্তরে গেলেন সে রাত্রে। যাবার সময় ছোট-বৌকে বিশেষ করে অনুরোধ করে গেলেন আমার দেখাশুনা করতে।
একটু পরেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। গ্রামের দুচারজন গণ্যমান্য ব্যক্তি কাপুর সাহেবের সঙ্গে আলাপ করে বিদায় নিলেন।
ছোট-বৌ নিজে তদারক করে কাপুর সাহেবকে ডিনার খাইয়ে বিদায় নিলেন। যাবার সময় বলে গেলেন, আমি ঐ বারান্দার কোণার ঘরে থাকব। যদি কোন দরকার হয়, বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ডাকবেন।
-না না কিছু দরকার হবে না, আপনি এবার বিশ্রাম নিতে যান।
হাসিমুখে হাত জোড় করে নমস্কার করে ছোট-বৌ বিদায় নিলেন। বারান্দার ঝড় লণ্ঠনগুলো নিবিয়ে দিয়ে চাকরবাকরের দলও বিদায় নিলো। আরো কিছুক্ষণের মধ্যে সারা জমিদার বাড়ীই নিঝুম হয়ে পড়ল। সারা দিনের অসংখ্য মানুষের কলকোলাহল রাত্রির নিস্তব্ধতার মধ্যে হারিয়ে গেল।
টিপটিপ বৃষ্টি আর জলো-হাওয়ার বেশ একটু ঠাণ্ডা আমেজ ছিল সে রাত্রে। ঘুমটা বেশ জমে উঠেছিল, কিন্তু হঠাৎ ভয়ে চমকে উঠলেন কাপুর সাহেব। সারা আকাশ ভরে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। পায়ের দিকের জানলা দিয়ে একঝলক আলো ছড়িয়ে পড়ল সারা ঘরে।
কাপুর সাহেব ধড়মড় করে উঠে বসলেন, প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার? আপনি?
সে রাত্রের প্রতি মুহূর্তের কাহিনী শোনার নয়, শোনাবারও নয়। প্রখ্যাত জমিদার রায়বাড়ীর ছোট-বৌ সেদিন সে রাত্রে ধীরে ধীরে কিভাবে তার দেহের, মনের, সংস্কারের, ঐতিহ্যের বন্ধন খুলে দিয়ে ছিলেন, সে কাহিনীর পূর্ণ বৃত্তান্ত আজও বলতে গেলে কাপুর সাহেবের গলা শুকিয়ে আসে, চোখ-মুখ-কান লাল হয়ে ওঠে।
আমার দিক থেকে দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে নিলেন কাপুর সাহেব। ছোট টিবেটিয়ান কুকুরটাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে করতে বললেন, জার্নালিস্ট, তুমি আমার ছেলের বয়সী, মুশকিল সেইখানে…
কয়েক মুহূর্তের জন্য আবার একটু তলিয়ে গেলেন কাপুর সাহেব।
…ধীরে ধীরে তিলে তিলে একটু ছোঁয়া, একটু হাসি, একটু আদর, একটু ভালবাসার খেলা খেলে ছোট-বৌ আমাকে গ্রাস করল। আমার সমস্ত কাণ্ডজ্ঞান পুড়ে ছারখার হয়ে গেল, আমার বিদ্যা-বুদ্ধি, ন্যায় অন্যায় জ্ঞান বিদায় নিল।
ভোরবেলায় হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে নিজের বিছানায় ছোট-বৌকে দেখে চমকে উঠলেন কাপুর সাহেব। ছোট বৌ কিন্তু চমকে ওঠেনি।
…ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব, এ বাড়ীর কর্তারা নিজের বাড়ীতে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে সারাদিন ভালবাসার অভিনয় করেন কিন্তু সন্ধ্যার অন্ধকার হতে না হতেই খাঁচা ছেড়ে উড়ে যায়। একটু মুচকি হেসে বলেছিল, কিন্তু এ বাড়ীর গিন্নীরাও সন্ন্যাসিনী নয়।
দুপুরবেলায় খাওয়া-দাওয়া করেই শহরে যাবার পরিকল্পনা ছিল কাপুর সাহেবের, কিন্তু সুরমা-মাখা বাঁকা চোখের হাসি দিয়ে ছোট বৌ তাঁর সব পরিকল্পনা বানচাল করে দিয়েছিলেন। আরো কটি রাত্রি রায়বাড়ীর অতিথিশালায় ছিলেন তিনি। রাত্রির অন্ধকারে দেহের, মনের সমস্ত বন্ধন যখন শিথিল হয়েছিল, তেমনি এক দুর্বল মুহূর্তে ছোট-বৌ বলেছিলেন, রাত্রের অন্ধকারে যখন আমরা শিকারের খোঁজে বেরিয়ে থাকি, তখন কোন বাধা-বিপত্তি গ্রাহ্য করা সম্ভব হয় না। রায়বাড়ীর বাবু বা গিন্নীদের হাতে দুচারজন ভাগ্যবান প্রজার স্বর্গবাস হওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়।
কাপুর সাহেব একথার তাৎপর্য বুঝেছিলেন; বুঝেছিলেন ইদানীংকালের দুটি খুনের রহস্য। দুর্বলতাবোধ করেছিলেন রহস্য উদ্ধারের কাজে এগুতে।
সেই হলো শুরু।
পরবর্তী কালে কর্মব্যপদেশে প্রায় সারা ভারতবর্ষ ঘুরেছেন কাপুর সাহেব। অর্থ, প্রতিপত্তি, মর্যাদার জন্য কাঙাল হয়ে কত অসংখ্য মানুষ এসেছেন তাঁর কাছে। একটা লাইসেন্স, পারমিট, বে-আইনী কাজ করে অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জনের জন্য মানুষকে অমানুষ হতে দেখেছেন তিনি। প্রথম প্রথম বিবেক বিদ্রোহ করেছে, মন সায় দেয়নি। ছোট-বৌ-এর স্মৃতিকে নিতান্তই একটা দুর্ঘটনা বলে মনে করেছিলেন কাপুর সাহেব। সে স্মৃতি তিনি মুছে ফেলেছিলেন মন থেকে। নিষ্ঠাবান স্বামীরূপে, স্নেহশীল ও দায়িত্বশীল পিতারূপে তিনি সারা সংসারের প্রিয় হয়েছিলেন। কিন্তু দিনে দিনে, তিলে তিলে অদৃশ্য ক্ষয়রোগের মতো সমাজের মানুষ তার সমস্ত সুখ কেড়ে নিয়েছে, আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে সারা সংসারে। স্ত্রীর ভালবাসা, পুত্রের শ্রদ্ধা হারিয়েছেন তিনি।
কাপুর সাহেব বারান্দা থেকে লনে নেমে একটু পায়চারী করে গোটাকতক ক্রিসানথিমাম্ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিলেন মাটিতে।
…তুমি ভাবতে পারবে না জার্নালিস্ট, মানুষ অর্থের জন্য, নারীর জন্য কত নীচ, কত জঘন্য, কত অশ্লীল হতে পারে। ইন্সপেকশনের জন্য বেরিয়ে ডাকবাংলোয় আশ্রয় নিয়েছি, বিশ্রাম নেবার জন্য ফরেস্টে গিয়েছি, নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে বন্ধুর বাড়ী গিয়েছি, সব জায়গায় ব্যবসা দারের দল আমার জন্য একটি নৈবেদ্য প্রস্তুত রেখেছে। মন বিদ্রোহ করেছে, কিন্তু দেহকে সংযত করতে পারিনি। রাগে-আক্রোশে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় এইরকম আগুন নিয়ে খেলা খেলতে খেলতে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। আর হারালাম নিজের সংসার। আমার স্ত্রী পুত্রকে নিয়ে বিদায় নিলেন আমার সংসার থেকে। সে আজ বিশ বছরের কথা। এই বিশ বছরে আমি যতটা তলিয়ে গেছি, যতটা নীচে নেমেছি, আমার পুত্র ঠিক ততটাই উঁচুতে উঠেছে। ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে সে আজ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে সিনিয়র লেকচারার, কিন্তু তাকে নিয়ে আমার গর্ব করার কোন অধিকার নেই।
কাপুর সাহেব গড় গড় করে আরো অনেক কথা বলেছিলেন। আমি থামাতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারিনি।
…অনেক জায়গা ঘুরে শেষে দিল্লীতে এসে ভেবেছিলাম একটু স্বস্তি পাব, নিজেকে রক্ষা করতে পারব। কিন্তু অদৃষ্ট বিরূপ; ভারত বর্ষের সর্বত্র রাত্রের অন্ধকারের সুড়ঙ্গপথে সবার অলক্ষ্যে লুকিয়ে-চুরিয়ে যে কারবার, যে লেন-দেন হয়, রাজধানী দিল্লীতেই সেই লেন-দেন প্রায় প্রকাশ্যে হবার অফুরন্ত সুযোগ।
লিয়াজো অফিসার আর থার্ডপার্টিদের কৃপায় লাঞ্চ-ডিনার ককটেল রিসেপশনের অভাব নেই। এদের অনেকের কৃপায় সন্ধ্যার স্তিমিত আলোকে জোড়বাগ-গলফ লিঙ্ক–ডিফেন্স কলোনী–সুন্দর নগরের অনেক ফ্ল্যাটে, বিংশ শতাব্দীর অপ্সরীদের আবির্ভাব হয়।
কাপুর সাহেব বলতেন, পারভারশনের মধ্যে একটা আকর্ষণ আছে, পৈশাচিক আনন্দের মধ্যে একটা নেশার আমেজ পাওয়া যায়। তার সঙ্গে আছে অর্থ। এই ত্র্যহস্পর্শের টানে নেমে এসেছে সর্বস্তরের নারী।
রাজধানী দিল্লীর নৈশ অভিযানের অন্যতম নায়ক ছিলেন আমাদের কাপুর সাহেব। কিন্তু হঠাৎ একদিন দীর্ঘদিনের ইতিহাসের মোড় ঘুরল, কাপুর সাহেবের কাহিনীর ওপর যবনিকা নেমে এলো।
পর পর তিন দিন ছুটি ছিল। ডেরাডুনে চাওলাদের অতিথিশালায় তিনটি দিন উপভোগ করার জন্য মিঃ চাওলার সঙ্গে কাপুর সাহেব ভোরবেলায় চলে গেলেন ডেরাডুন। লাঞ্চের পর বিশ্রাম করে সন্ধ্যার মুখোমুখি ফিয়েটে করে দুজনে চলে গেলেন মুসৌরী। ডিনার খেয়ে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় দশটা বেজে গেল। চাওলা সাহেবের গাড়ী গেট দিয়ে ঢুকতে না ঢুকতেই হঠাৎ লাইট ফিউজ হয়ে গেল।
কাপুর সাহেবের সন্তোষ বিনোদনের জন্য একটি নৈবেদ্যের আয়োজন করেছিলেন বুদ্ধিমান চাওলাসাহেব। গাড়ী থেকে নেমে বারান্দায় উঠতেই তিনি মিহি সুরে দুজনকে অভ্যর্থনা করলেন। চাঁদের আবছা আলোয় চাওলাসাহেব পরিচয় করিয়ে দিলেন, কমলা, মীট মাই গুড এ্যাণ্ড রোমান্টিক ফ্রেণ্ড ববি কাপুর! ঐ আবছা আলোতেই তিনজনেই দু-এক পেগ হুইস্কী খেয়ে একটু গল্পগুজব করলেন।
ইতিমধ্যে চাকর-বাকরের দল ছুটাছুটি করেও, একটা ইলেকট্রিক মিস্ত্রী জোগাড় করতে পারল না। কাপুর সাহেব টিপ্পনী কেটে বললেন, দি ইলেকট্রিসিয়ান উইল নট টার্ন আপ বিফোর টু-মরো মর্নিং।
কয়েক মিনিট বাদেই টেলিফোন বেজে উঠল। এক বন্ধু সন্দর্শনের জন্য চাওলাসাহেব বিদায় নিলেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসার। বিশ বছর আগে হলে কাপুর সাহেব বিশ্বাস করতেন, ইলেকট্রিসিয়ান এসে আলো জ্বালাবে আর চাওলাসাহেব আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরবেন। আজ জানেন, এ-সবই মিথ্যে, সবই উপলক্ষ্য মাত্র।
লনে বসে আরো পেগ দুই হুইস্কী খেয়ে নিলেন দুজনে। তার পরের কাহিনী নতুন কিছু নয়। বাকী রাতটুকুর জন্য কমলার বুকে আশ্রয় নিলেন কাপুর সাহেব।
ভোরবেলার দিকে ঠাণ্ডার আমেজ লাগায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুমে অচৈতন্য প্রায় বিবস্ত্র কমলাকে পাশে দেখে চমকে উঠলেন কাপুর সাহেব। খুব ভাল করে দেখে নিলেন। হ্যাঁ, কপালের কাটা দাগটা ঠিকই আছে, বাঁ দিকের গালের তিলটাও। কাপুর সাহেবের সারা শরীরটা কেঁপে উঠল। বিন্দু বিন্দু ঘামে সারা শরীরটা ভিজে উঠল। কমলার গলা পর্যন্ত একটা চাদর টেনে দিয়ে খুব ভাল করে সারা মুখটা দেখে নিলেন। প্রায় বছর দশেক আগে দেখেছিলেন এই মুখ, বড় পছন্দ হয়েছিল। আদর করে ঘরে তুলে এনেছিলেন এক অনুজ প্ৰতিমের বধুরূপে।…ভাইয়ের থেকেও বেশি, দু যুগের ওপর তাঁরই কাছে থেকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই ছেলে। সংসারের বিচিত্র গতিতে আর দেখা হয়নি। কোন সন্দেহের কারণ ছিল না, তবুও আলতো করে হাতের আংটিটা দেখলেন, ভ্যানিটি ব্যাগটা দেখে নিলেন। সব সংশয়ের অবসান।
হাতের কাছে রিভলবার থাকলে নিশ্চয়ই গর্জে উঠত। হয়তো দুটি প্রাণই দেহছাড়া হতো। কিন্তু তা হয়নি। কাপুর সাহেব চোরের মতো লুকিয়ে পালিয়ে এসেছেন দিল্লী। চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে ফ্রেণ্ডস কলোনীর বাড়ীতে বন্দী করেছেন নিজেকে।
মাঝে মাঝে আমি গিয়েছি। টুকটাক কথাবার্তা। কিন্তু তার সংযত আচরণের মধ্যেই কেমন যেন একটা চঞ্চলতা লক্ষ্য করেছি। বড় অসহায় মনে হয়েছে কাপুর সাহেবকে। তারপর আর কদিন যেতে পারিনি। কাজের চাপে টেলিফোন করাও হয়নি।
সেদিন শনিবার। পার্লামেন্ট নেই। ভেবেছিলাম একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমোবো। কিন্তু ভোরবেলায় ঘুম ভাঙাল কাপুর সাহেবের চাকর রামলোচন সিং। গাড়ী নিয়ে ছুটে গেলাম। আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো, বাবুজী, সাহেব দাবাই পিকে গুজর গ্যায়া।