“আপনার জন্য খুশির সংবাদ আছে জয়সাহেব।আপনি খুব শিগগিরি বাবা হতে চলেছেন।আপনার স্ত্রী অন্তঃ সত্ত্বা!”
ডাক্তারের এই ২ লাইনের কথা টা শুনে আমার মাথায় যেন পুরো আকাশ ভেংগে পড়ল।এমন একটা ভুল কিভাবে করতে পারলাম আমি???
রাত্রির দিকে তাকালাম, ও আমার মুখের ভাষা বুঝতে পেরে শোয়া অবস্থাতেই মাথা ঘুরিয়ে নিল।আমি কিছু না বলে ডাক্তার কে বাইরে নিয়ে দিয়ে আসলাম, তারপর উনাকে একপাশে ডেকে নিয়ে বললাম”স্যার,আপাতত এই খবর টা একটু চেপে যান প্লিজ।আমাদের একটু প্রব্লেম আছে এই ব্যাপারে। আপনি প্লিজ এই কথা টা কাওকে বলবেন না!”
উনি কিছুটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন,আমি পকেট থেকে ১০০০ টাকার ১ টা নোট তার দিকে এগিয়ে দিলাম। “আপনি চিন্তা করবেন না স্যার, এবরশন টা আপনার ক্লিনিক ই করাব আমি! ” উনি অবাক চোখে টাকাটা নিয়ে কিছু একটা বুঝে মাথা ঝাকিয়ে চলে গেলেন।
আমি আবার ঘরে ফেরত আসলাম,রুম এর কাছাকাছি আসতেই রাত্রির চাপাকান্না এর শব্দ আমার কানে এসে ধাক্কা দিল।আমি কিছুক্ষন এর জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।মেয়েটা অনেক শক্ত মনের মানুষ।এই ২ বছরে ওকে কখন ই কান্না করতে দেখি নি।কিন্ত আজ!!! “আমায় প্লিজ ক্ষমা করে দিন, আমায় আরকয়েক্টা মাস সময় দিন। এখন ই বের করে দিবেন না প্লিজ।আপনার পায়ে পড়ছি,আমি কথা দিচ্ছি এই বাচ্চাটা আমি নষ্ট করে ফেলব।আপনি জাস্ট ৩ মাস সময় দিন আমায়, চাকরি টা হয়ে গেলেই আমি আপনাকে মুক্ত করে দিব।প্লিজ, আমায় এখন ই বের করে দিবেন না!”
“আপনি জানতেন,তাই না??” রাত্রি কিছুক্ষন আমার দিকে বড় বড় চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে।ওর মুখ দিয়ে কিছুই বের হচ্ছিল না! “কি ব্যাপার একটা প্রশ্ন করেছি, উত্তর ত দিবেন নাকি” “ওও হুম না মানে আপনি ত কখন ও আমায় তুই ছাড়া কিছু বলেন নি,তাই!” আমি রাত্রির দিকে তাকালাম, ওর হাতে পায়ে অনেক কাটা কাটা লাল লাল দাগ।আজ ই মনে হয় প্রথম বারের মত চোখে পড়ল, ওর গায়ে এত দাগ আসল কোথা হতে?? ও হ্যা মনে পড়েছে। আমি ই ত দাগ গুলোর আসল কারন, হুম আচ্ছা আমি কি খুব খারাপ করেছি ওর প্রতি???
“আর হ্যা আমি কিছুটা সন্দেহ করেছিলাম।আসলে সেদিন আপনি কিছু টা পাগলের মত আচরণ করছিলেন অফিস থেকে আসার পর।আপনাকে শান্ত করতেই!!” রাত্রির চাপা কান্না আবার শুরু হয়ে গেল। আমার কেমন জানি সবকিছু অসহ্য লাগতে শুরু করল।এর কারন টা কি রাত্রির প্রতি আমার অন্যায় নাকি রাত্রির আজ এই অবস্থা। কারন টা আসলেই কি তার কোন পার্থক্য ই করতে পারছিলাম না।
উঠে দাড়ালাম, ওর দিকে চেয়ে বললাম,”কাল রেডি হয়ে থাকবেন।ক্লিনিক এ আজ ই কথা বলে রাখব।কাল ই এবরশন টা করিয়ে ফেলব!” রাত্রি আমার কথা শুনে কিছুটা চমকে উঠল।ভেজা চোখে আস্তে আস্তে বলল,”আচ্ছা” আমি ওর উত্তর টা শুনে রুম থেকে বের হয়ে গেলাম।তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে বাইরে আসলাম,মন টা আজ বড্ড বিষন্ন হয়ে গিয়েছে আমার।কিন্ত এরপর ও বারবার মন টা কে বুঝাতে লাগলাম,আর ত মাত্র ৩ টা মাস।আমি আমার সব প্ল্যান ভেস্তে যেতে দিতে পারি না।কখন ই না,,,,,,
সেবার বন্ধুদের সাথে আমাদের কলেজ এর স্যার এর মেয়ের বিয়েতে গিয়েছিলাম।প্ল্যান ছিল জমিয়ে মজা করব।কিন্ত সেই বিয়েবাড়ি তে হঠাৎ করে ই বিষন্নের ছায়া নেমে আসল বরযাত্রী র এক্সিডেন্ট এর খবর শুনে। আর প্রতিটা গল্পের মত ই এই জায়গায় কাওকে হিরো হিসেবে আনা লাগে যে মেয়েটাকে বিয়ে করে সবাই কে দুশ্চিন্তার হাত থেকে বাচাবে।এই গল্পে আমি সেইজন ছিলাম, বলাই বাহুল্য আমার এটা হওয়ার কোন ইচ্ছা ই ছিল না।কিন্ত একদিকে স্যার এর মেয়ের জীবন আরেকদিকে স্যার এর heart attack। একজন মৃত্যশয্যায় থাকা মানুষকে আর কারো হোক আমার পক্ষে না করা সম্ভব হয় নি।মেয়েটা মানে রাত্রিকে আমি বিয়ে করে ছিলাম ঠিক ই তবে সেই যাত্রায় স্যার এর পক্ষে বাচা সম্ভব হয় নি।এরপর রাত্রি কে নিয়ে আমার বাসায় আসলাম।কিন্ত আমাদের মাঝে অনেক আগেই একটা শর্ত হয়ে গিয়েছিল।
পরিস্থিতি ঠান্ডা হবার পর মানে ৩ বছরের মাঝেই আমি ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিব।এই সময় রাত্রি এক্টা চাকরি খুজে আবার তার বাড়িতে ফিরে যাবে। তবে এই ২ বছর যে রাত্রির জন্য খুব একটা সুখকর হয় নি সেটা ওর গায়ে অসংখ্য মারের দাগ ই প্রমান করে। কিন্ত হাস্যকর বিষয় আমার এই বিষয়ে কোন কিছুই মনে নেই কখন কিভাবে রাত্রি এই দাগ গুলো পেয়েছিল।শুধু এটা জানতাম এর কারন একমাত্র আমি ই!! হঠাৎ একটা লোকের আওয়াজ এ আমি আবার স্মৃতির পাতা থেকে বাস্তবে ফিরে আসলাম।লোকটা ক্লিনিক এর একটা করিডোর ধরে প্রায় পাগলের মত হাউমাউ করে কাদছে।পিছনে ফিরে একবার তাকালাম,operation theatre এর সবুজ আলো টা আমায় জানান দিল যে রাত্রি এখন ও ভিতরে আছে!
আমি আশস্ত হয়ে আবার সেই লোক টার দিকে এগুলাম।সে তখন ও অসহায় এর মত শুধু কেদেই যাচ্ছে, কাছে গিয়ে যে কিছু জিজ্ঞাসা করব সেই অবস্থা ও তখন ছিল না।সে শুধু কেদেই যাচ্ছে!! পাশ দিয়ে যাওয়া একটা নার্স কে ডেকে জিজ্ঞাসা করতেই সে বলল লোক্টার ওয়াইফ নাকি একটা মরা বাচ্চার জন্ম দিয়েছে। তাই দুখে উনি কাদছে,মহিলাটা প্রায় ৮ বছর পর সন্তান সম্ভবা হয়েছিল!!!! বুকের মাঝে কোথায় যেন একটা চাপা ব্যাথা অনুভুত হলো। আমি আস্তে আস্তে আবার একটা চেয়ার ধরে বসে পড়লাম।মাথা থেকে পা পর্যন্ত কোন কারন ছাড়া ঝাকানো শুরু করল।মাথার মাঝে হাজারো প্রশ্নের মাঝে শুধু একটা প্রশ্ন ই বারবার উকি দিচ্ছে, আমি কি কোন ভুল করছি??আমি কি খুনি?? একটা নিরীহ প্রান কে হত্যা করার অধিকার কি আমার আছে??
হঠাৎ করে আমার কি যেন হলো,প্রায় পাগলের মত অপারেশন থিয়েটার এর দিকে দৌড়ানো শুরু করলাম, দরজা টা আটকানো ছিল ভেতর থেকে। কিন্ত প্রায় অনেক জোরে ধাক্কা দেয়াতে সেটা ভেংগে গেল!!ডাক্তার রা আমায় দেখে খুব অবাকক হয়ে গেল।তবে তাদের দেখে মনে হচ্ছিল তারা মনে হয় আগে থেকে একটা সমস্যায় ছিল! বেড এর দিকে তাকাতে ই রাত্রির অবাক দুচোখ জোড়া আমার চোখে পড়ল।মেয়েটা কাদতে কাদতে হাপিয়ে গেছে, সাদা বিছানায় বসে আছে ও।এখন ও কোন ধরনের অপারেশন ই শুরু হয় নি!!
আমি রাত্রির দিকে এগিয়ে গেলাম,ও প্রায় কান্না চোখে চোখে আমার দিকে হাতজোড়া তুলে ক্ষমার ভংগিতে বলল,”আমায় ক্ষমা করে দিন।আমায় আজ ই আপনি বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে পারেন।আর ডিভোর্স পেপার টা পাঠিয়ে দিয়েন আমি সাইন করে দিব কিন্ত আমার পক্ষে এই বাচ্চাটাকে নষ্ট করা সম্ভব হবে না” আমি আস্তে আস্তে রাত্রির কাপা কাপা শরীরে কাছে যেয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।একটা অনাগত স্পর্শ পেয়ে ওর শরীর আরো কেপে উঠল।
হঠাৎ করে মেয়েটা আবার কাদতে শুরু করল!!আমি ওর চোখের জল টা মুছে দিয়ে বললাম, “তোমার কাছে ত পিশাচ হয়েই আছি।কিন্ত আমার সন্তানের কাছে অন্তত একজন ভাল পিতা হওয়ার সুযোগ টা দিও!” রাত্রি অঝোরে কেদেই যাচ্ছে,,থামার কোন লক্ষন ই নেই।তবে কেন জানি মনে হচ্ছিল আজকের চোখের জলে কিছুটা সুখ ও গড়িয়ে গড়িয়ে ওর গাল বেয়ে পড়ছিল!!