-আঙ্কেল! ফুসকাতে আরেকটু ঝাল দিয়েন।
-আমাকে ছোটো ছোটো ফুসকা দিবেন না,বড়বড় গুলা দিবেন।
-আঙ্কেল,আমার আর রিন্টুর চটপটি। গরম গরম দিবেন। আর উপরে মচমচে ফুচকা দিবেন কিন্ত। পোতা পোতা (চুপসে যাওয়া) গুলো দিবেন না।
-আরে বাবা,থামো থামো তোমরা। ওই বেঞ্চিটায় গিয়ে বসো। আমি বানাইয়া ছুটকুরে দিয়া পাঠায় দিমু।
আমরা চুপচাপ গিয়ে ফুসকার ভ্যানের পাশে রাখা ছোট্ট টুলটায় বসে পরতাম। ফুসকা আঙ্কেলের ছেলে কিছুক্ষন পর এসে আমাদের সবার প্লেট দিয়ে যেতো। সেই সময়ে এখনকার স্কুলের বাচ্চাদের মতো পকেটে টাকা নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম না কেউই। মা টিফিন সাথে করেই দিয়ে দিতো। খুব অসুবিধে হলে বাবা হাতে দশটা টাকা দিয়ে বলতেন, “কিছু খেয়ে নিস। আবার রাস্তার কিছু খাস না যেনো! কেক বা বিস্কুট খেয়ে পানি খাবি।” আর আমি,”জ্বি,আব্বু বলে টাকা নিয়ে চলে আসতাম!” হাতে টাকা পেলে সেদিন আর আমায় দেখতো কে!
অপেক্ষায় থাকতাম কখন টিফিনের ঘন্টা দেবে। ঘন্টা দেয়ার সাথে সাথে দৌড়ে গেটের বাহিরে চলে আসতাম। তখনকার সময়ে দশটাকা অনেক জিনিস। মোটামুটি ক্লাস ফাইভের বাচ্চার পেট ভরার মতো যথেষ্ট অ্যামাউন্ট! সব কিছু বাদ দিয়ে মনটা আকুঁপাঁকু করতো রাস্তার ধারের ঐ ফুসকা-চটপটির জন্যে। ফুসকার ভেতর কেবল আলুভর্তা ঠাসা আর একটু লেবু-তেতুলের পানি দেয়া থাকতো। তাও যে কি জাদু ছিলো সেই পাঁচ টাকার প্লেটে,কে জানে!
স্কুলের গেটের সামনেই বসতো ফুসকা চাচার দোকান। রাস্তার অপজিটে এক ঝুপরিতে তাদের বাসা ছিলো। চাচা একটা ভ্যানে করে রোজ ফুসকা আর চটপটি নিয়ে চলে আসতো রাস্তার এপাশে,আমাদের স্কুল গেটের পাশে। চাচার সঙ্গি ছিলো তার ছেলে ছোটু। ছেলেটা আমাদের সমবয়সিই ছিলো। রোগা হ্যাংলা,কালো রঙের একটা বাচ্চা। ঢিলেঢালা হাফপ্যান্ট পরে সে ভ্যাবলার মতো ভ্যানের পাশে দাড়িয়ে রইতো। তার পরনে কদাচিৎ ফুটোফাটা স্যান্ডু গেঞ্জি দেখা যেতো। তার কাজ ছিলো যারা টুলে আর বেঞ্চে বসে তাদেরকে তাদের চাহিদামতো প্লেট দিয়ে আসা এবং নিয়ে আসা।
সেদিন বৃহঃস্পতি বার ছিলো। আমাদের চারটা পিরিয়ড এর পর ছুটি। পরেরদিন শুক্রবার দেখে আব্বুর কাছ থেকে অনেক ইনিয়েবিনিয়ে দশটা টাকা নিয়ে আসলাম। আমার বাবা আবার এ বিষয়ে স্ট্রেটকাট। তার ধারনা বাচ্চাদের হাতে টাকা দিলে বাচ্চারা চোর হয়ে যায়। তাও আমার ঘ্যানঘ্যানানি আর আমার আম্মুর প্যানপ্যানানি শুনে আব্বু দিয়েই দিলো সেদিনকে দশটাকার নোটটা! নিয়মমতো চার পিরিয়ড পর ছুটি। দৌড়ে গেলাম চাচার ফুসকার ভ্যানের সামনে। গিয়ে দেখি কি ভীড়! আমরা চাচাকে জানান দিয়ে বেঞ্চিতে বসে পরলাম।
– আংকেল ভীড় কমলে আমার একপ্লেট ফুসকা।
-আংকেল আমার ফুসকায় ঝাল কম।
-হ,হ আম্মাজানেরা। আপনারা বসেন ওইখানে। আগে এই হাতগুলায় পুরন করি!
পাশে দেখলাম ছোটু দাঁড়িয়ে আছে। চুপচাপ সবার খাওয়া দেখছে। আমার দেখে মনে হলো,ছেলেটার খিদে পেয়েছে। কেমন মুখ ছোট করে তাকিয়ে আছে।
-ছোটু,ফুসকা খাবি? তাকে এই কথাটা জিজ্ঞেস করতেই সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো! মনে হচ্ছিলো যেনো তাকে ফ্রিতে বিরিয়ানির প্লেট দেওয়া হচ্ছে।
-কি রে? খাবি? ছোটুর বাবা জিনিসটা খেয়াল করলেন। তারপর বলে উঠলেন,
-ও এসব খায় না। বাসায় গিয়ে ভাত খাইবো নে।
-এই ছেলের বাবা এত ভালো ফুসকা-চটপটি বানায় তবুও এই ছেলে এমন চিমসা কেনো!
-হ্যা ভাই। আমিও সেটাই ভাবি। আমার বাবার এমন একটা ফুসকার ভ্যান থাকলে আমিই সব সাবার করে দিতাম। হে হে হে হে আমরা নিজেদের মধ্যে এসব নিয়ে হাসাহাসি করছিলাম আর তখন আমাদের একজন ফুসকা চাচাকে জিজ্ঞেস করলো,
-চাচা,ছোটু স্কুলে যায় না?
-দিমু এইবার পেরাইমারিতে। ডেরেস ছাড়া ইস্কুলে যাইতে দ্যান না ছ্যারেরা। টাকা হাতে হইলেই ডেরেস নিয়া আসমু।
-ও যদি মেয়ে হতো আমার জামা পরতে পারতো। আমার অনেকগুলো জামা আছে।
-হ আম্মা। হের কপাল মন্দ আরকি! নাইলে কি আর পোলা হয়! চাচা,এই কথা বলে মিটিরমিটির করে হাসছিলেন।
-আঙ্কেল টক লাগবে। তারপর ছোটুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-যা তো। দৌড়ায় গিয়া বাসা থেইকা টকের বোতল নিয়া আয়। টক শেষ। ছোটু দৌড়ে গেলো রাস্তার ওপাশে। আর তখনই বিকট একটা শব্দ হলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম ফুসকা চাচা দৌড়ে চলে গেলেন। রাস্তায় সব মানুষ এক জায়গায় চলে আসলো। দেখলাম তারা মিলে একটা মিনি মাইক্রো কে ঘেরাও দিয়ে রেখেছে।
-ঐ শালা। চোখ কি হাতে নিয়া চলছ?
এই বলে ক’জন একটা লোককে এলোপাথারি কিলঘুসি দিচ্ছে। আমরা ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারলামনা। এতো গন্ডোগল যেন মুহুর্তেই শুরু হয়ে গেলো। পাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,আরে ঐ দিকে অ্যাকসিডেন্ট হইছে, অ্যাকসিডেন্ট।
-অ্যাকসিডেন্ট! আমরা দৌড়ে গিয়ে উঁকি মেরে দেখতে চাইলাম। নাহ মানুষ ঠেলে ভেতরে ঢোকার সাধ্য হলো না। তাও ঠেলে ঠুলে একটু সামনে এগিয়ে দেখলাম,রাস্তায় রক্তের ধারা।
-এ কি! এ তো ফুসকা আঙ্কেল! উনি কাকে জড়িয়ে ধরে আছেন? এমন চিৎকার করে কাঁদছেন কেনো?
-“আব্বা,তোমার ইস্কুলের ডেরেস কালকাই আনমু। চোখডা খোল বাপজান। তর মায়েরে কি কমু আমি? চোখ খোল বাপ কেউ একটা গাড়ি ডাকো,আমার বাপ কথা কইতাছেনা।” এই বলে ফুসকা আঙ্কেল কাকে যেনো কোলে নিয়ে দৌড়াতে থাকলেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ কোথাথেকে কিছু লোক এসে আমাদের ধমক দেয়া শুরু করলো।
-তোমরা স্কুলের বাইরে কি? যাও ভেতরে যাও। নাহলে হেডমাস্টারকে ডেকে আনবো বললাম।
ভয়ে স্কুলের ভেতর চলে আসলাম। এক লহমায় ফুসকার দোকানের সবাই গায়েব হয়ে গেলো। বেঞ্চির উপড় রাখা ব্যাগ নিয়ে আমরা হাঁটা শুরু করলাম।
-ফুসকার টাকা দিবি না?
-আঙ্কেল তো নাই।
-আঙ্কেল আসলে কালকে দিয়ে দেবো। সবাই পাঁচটাকা রেখে দিবি। খরচ করবি না কিন্ত। টাকা না দিলে কিন্ত আল্লাহ পাপ দিবে।
ওদিন খুব হতাশ হয়েই আধখাওয়া ফুসকা ছেড়ে দিয়েই বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। রাস্তায় রক্ত দেখে খুব ভয় পেয়ে দু’দিন টানা স্কুলেই যেতে পারিনি। দু’দিন পর স্কুলে গিয়ে ফুসকার ভ্যানটা আর দেখতে পাই নি। ফুসকা চাচাকেও না। পরে সবার কাছে শুনেছিলাম, ফুসকাওয়ালার ছেলে গাড়ি চাপা পরে মারা গেছে আর ফুসকার দোকানীও দোকানটা উঠিয়ে নিয়েছে। এরপর যতদিন স্কুলে ছিলাম,ফুসকা চাচাকে আর দেখিনি।
আজ এই কথা মনেও পরতো না। নিয়মমতো অফিস থেকে বাসাতেই তো ফিরছিলাম। রোজই এই সময়ে বাসায় যাই। ওসব ফুসকা টুসকা এখন আনহাইজেনিক ফুড আমার কাছে। রাস্তার ধুলো বালি কে খাবে পয়সা খরচ করে? এখন আমি বার্গার খাই। ম্যাকারনি খাই। ওসবের কথা মনেও পরেনা। কিন্ত হঠাৎই দেখলাম,রাস্তার পাশে একজন জরাজীর্ণ লোক ভিক্ষে করছে। আমায় দেখেই হাতটা বাড়িয়ে বললো,”দুইটা টাকা ভিক্ষা দেন মা গো!” না,আমি তাকে চিনতে ভুল করিনি। এই লোকটার আমার কাছে পাঁচ টাকা পাওনা। টাকাটা দেয়া হয়নি। আমি ব্যাগ থেকে দুটো পাঁচশ টাকার নোট বের করে লোকটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, -“এ গুলা রাখেন।” লোকটা নোট দুটো দেখে বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। বুঝলাম সে হতভম্ব হয়ে গেছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-আমায় চিনতে পেরেছেন চাচা?
সে বললো, “না তো আম্মা। কেডা আপনি?” আসলেই এতবছর পর কিকরেই বা চিনবে সে আমায়। অনেক হাতের ভীড়ে এই ছোট্ট হাতটা মনে রাখবেও বা কিকরে। কিন্ত তার বানানো ফুসকা চটপটি না খেলে যে আমার দিনটাই খারাপ যেতো তা তো আমি ভুলতে পারিনা!
-না। কেউ না। টাকাটা রাখেন চাচা। দোয়া করিয়েন।
-আল্লায় ভালো করুক মা গো! ভালো করুক।
আমি টাকাটা দিয়ে বাড়ির পথে হাঁটতে লাগলাম। আর ভাবতে লাগলাম,কি লাভ পরিচিত হয়ে? তারপর আবার তার ফুসকার দোকানের কথা মনে হবে,মনে হবে তার মৃত ছেলেটার কথা। থাকনা। কিছু সময় পরিচিত না হওয়াই মঙ্গলের। পুরনো ঘা খুঁচিয়ে আর কি লাভ!