“আজকে কি ভাত দেবে না শিওর?” “একশোবার দেবো না, হাজারবার দেবো না। তোমার মত জামাইকে অনাহারে মেরে ফেলা উচিত বুঝলে?” “আশ্চর্য! আমি ইনকাম করি বলেই কিন্তু ঘরে খাবার আসে।” “তুমি আবার আমাকে ভাতের খোঁটা দিচ্ছো? ছোটলোক! পাশের বাসার ভাবীকে গিয়ে চাল কিনে দাও আর বল ভাত রেঁধে খাওয়াতে।”
হাসনাতের আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না। এই মহিলা তার জীবনটা নরক বানিয়ে রেখে দিয়েছে। আজকে ছুটির দিন। কোথায় ঘরে একটু আরাম করবে উলটো সকালের পর থেকে এই বেয়াদব বউ মন চায় তাই বলছে। হাসনাতের অপরাধ হলো সকালে গোসলের পর বারান্দায় গামছা শুকোতে দিতে গিয়ে সে পাশের বাসার সুন্দরী ভাবীর সাথে হাসিহাসি মুখে কথা বলছিলো। মিলির ধারণা হয়েছে ওরা দুজন চোখের ইশারাতেও কথা বলছিলো। মিলির মেজাজ গেছে গরম হয়ে।
বিয়ের প্রথম দুই তিন বছর তার মনে হতো হাসনাতের মত চরিত্রবান ছেলে দুনিয়ায় আর একটি নেই। কিন্তু এরপরের পাঁচ বছরে হাসনাতের চরিত্র গেছে চরম অধঃপতনে। দুজন মিলে রিকশায় কোথাও যাচ্ছে বাচ্চাদুটোকে নিয়ে। হাসনাত তাকিয়ে থাকবে অন্য রিকশায় বসা সুন্দরী কোনো মেয়ের দিকে। শপিংমল, শিশুপার্ক, রাস্তাঘাট এমন কোনো জায়গা নাই তার জামাই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকবে না মেয়েদের দিকে! সেদিন বড় ছেলের স্কুলে গিয়ে ছেলের মিসের সাথে সে কি গালগল্প এই লোকের। গা জ্বলে যাচ্ছিলো মিলির। এখন আরেক উৎপাত হলো পাশের বাসায় নতুন আসা এক মহিলা। হাসনাত বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে। লাঞ্চ আজ হোটেলেই করা লাগবে। বাসায় মিলি আজ পোলাও রেঁধেছিলো। আরাম করে এতক্ষণে পোলাও খাওয়ার কথা হাসনাতের।
কিন্তু কপাল খারাপ। পাশের বাসার ভাবীর সাথে কথা বলার সময় মিলি দেখে ফেলেছে। নতুন আসা এই ভাবীকে বড্ড ভালো লাগে হাসনাতের। কি সুন্দর চেহারা, মোলায়েম কণ্ঠস্বর! তার বউয়ের মত বাজখাই গলা না! বউয়ের কথা মনে আসতেই জোর করে ভাবনা থেকে সরিয়ে দিলো মিলিকে। এখম ভাবীকে নিয়েই ভাববে। পাশের বাসার বারান্দায় প্রথম যেদিন ঐ ভাবীকে দেখে হাসনাত, ভাবীটা ভেজা চুল শুকাচ্ছিলো বাতাসে। টিয়া রঙের শাড়ি পরা ছিলো। পরে জেনেছে ওনার নামও টিয়া। মিলির চোখ এড়িয়ে প্রায় আলাপ জমাতো হাসনাত ঐ ভাবীর সাথে। কথা বলে জেনেছে ঐ ভাবীর বর বিদেশ থাকে। মহিলা ফ্ল্যাটে একাই থাকে।
হাসনাত অবাক হয়েছে এই ভেবে যুবতী স্ত্রীকে কেউ একা রাখে এভাবে ফ্ল্যাটে। সে হলে কি পারতো! পরমুহূর্তেই আবার মিলির কথা মনে আসলো। অবশ্য মিলিকে একা বঙ্গোপসাগরে ফেলে আসলেও মনে হয় হাঙর, তিমিও ছোঁবে না এই মহিলাকে ভয়ে, অন্য পুরুষ তো দূরের কথা! মিলির কথা ভাবলেই মেজাজ সপ্তমে ওঠে হাসনাতের। অথচ ঐ ভাবী! কি শান্ত, স্নিগ্ধ। চোখে কেমন অসহায় দৃষ্টি। কি যেন দুঃখ পুষে রেখেছে বুকে! আচ্ছা কিসের দুঃখ ওনার! খুব জানতে ইচ্ছে করে হাসনাতের। যাবে নাকি একবার! হাসনাত ভাবতে থাকে। বাসায় তো কেউ থাকে না ওনার।
টিয়ার ফ্ল্যাটে বসে আছে হাসনাত। এই ফ্ল্যাটে সে আগেও এসেছে। আগে এক ব্যাংকার তার স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে থাকতো এখানে। সেই ভাবীর আবার মিলির সাথে খুব খাতির ছিলো। খুব বদ মহিলা ছিলো সেই ব্যাংকারের বউ। তার জামাই তাকে স্বর্ণের নেকলেস, শাড়ি কিছু গিফট করলেই মিলিকে দেখাতে চলে আসতো। আর মিলি সেসব দেখে হাসনাতের জীবনটা অস্থির করে তুলতো। ঐ ব্যাংকার গত মাসে বাসাটা ছেড়ে চলে গেছে। হাসনাতের জান বেঁচেছে!
এই মাসের শুরুতে এই ফ্ল্যাটে এসেছে এই টিয়া ভাবী। এই ভাবীটাকে কেন যেন মিলি পছন্দ করে না, এভোয়েড করে। মিলির সন্দেহ মহিলাটা ভালো না। মিলিই প্রথম তাকে এই মহিলার ব্যাপারে বলেছিলো। বলেছিলো “এক মহিলা এসেছে পাশের বাসার, আমার কেমন সন্দেহ হয়। আমি তো মহিলা, মহিলা কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ আমি চিনি।”
মিলি তো একটা সন্দেহপরায়ণ মহিলা। তাকেও তো কত সন্দেহ করে অকারণ। টিয়া শোল মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ালো হাসনাতকে। এত মজার রান্না! মিলি জীবনে পারবে? টিয়া থেকে জানলো তার স্বামী গত এক বছর তার খোঁজ নেয় না। টাকাও পাঠায় না। গ্রামে থাকতো সে। স্বামীর খোঁজ পেতে শহরে এসেছে পাড়ার এক দেবরের সাহায্যের জন্য। দেবর তাকে আশ্বাস দিয়েছে বরের কাছে পাঠিয়ে দেয়ার। টিয়া কত ভালোবাসে স্বামীকে, আর তার বউটা!
হাসনাত ঘরে ফিরে আসে রাতে। মিলি বাচ্চাদের পড়াচ্ছে। হাসনাতকে বেশ ফুরফুরে দেখাচ্ছে। মিলির সন্দেহ হয়। পাশের বাসার ঐ মহিলার কাছে যায় নি তো! আজকাল অফিস শেষে প্রায় হাসনাত দেরী করে ফেরে। মিলির মনে অনিশ্চয়তা বাড়ে। অদ্ভুত এই পুরুষেরা! বিয়ের পরপর মিলিকে চোখে হারাতো হাসনাত। আর এখন! মিলিই তার চক্ষুশূল! বাচ্চাদুটোর মুখ চেয়ে সংসার করছে মিলি। অসহ্য লাগে তার এই সংসার। বিবাহিত পুরুষের কাছে সব রমণীই সুন্দর, নিজ স্ত্রী ছাড়া!
মিলি আয়নার সামনে দাঁড়ায়ম মুখে বয়সের হালকা বলিরেখা পড়েছে। পেটে জমেছে মেদ। কাজ করতে কররে ডান হাতের তালু খুব অমসৃণ হয়ে গেছে, খসখসে, রুক্ষ। তবু শেষ যৌবনেও তার চেয়ে কম বয়সী টিয়ার চেয়ে নিজেকে সুন্দরীই লাগছে মিলির। তাহলে হাসনাত কেন তাকায় না তার দিকে! পুরনো হয়েছে তাই?
আচ্ছা, হাসনাতকে নিয়ে এত অস্থিরতায় কেন ভোগে সে! ছাপোষা একটা লোক। মাসশেষে টাকা নিয়ে আসে চাকরী করে কিছু। সে টাকা মিলির হাতে তুলে দিয়ে তার দায়িত্ব শেষ। বাজারটাও মিলিকে করতে হয়। হাসনাতেরও তো বয়স বেড়েছে, ভুঁড়ি বেড়েছে, কমেছে মাথার চুল। তবু কেন এত হারানোর ভয় মিলির? হাসনাতকে কেন হারাতে চায় না মিলি? ভালোবাসা? নাকি নিরাপদ জীবন হারানোর ভয়? হাসনাতের সন্ধ্যেগুলো দারুণ কাটে। মিষ্টি একটা টিয়াপাখির সাথে আড্ডা দিয়ে। এখনো সব স্বপ্ন লাগে তার। এই তেইশ বছরের তরুণী মেয়েটা তার মত সাতত্রিশের পুরুষের দিকে এত মুগ্ধ চোখে তাকায়! আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে ওঠে হাসনাতের। টিয়ার বাসায় একদম ফার্নিচার নেই। হাসনাত ঠিক করেছে আগামী মাসে ওকে একটা খাট কিনে দেবে।
হাসনাতের খুব ইচ্ছে করে টিয়াকে নিয়ে পালিয়ে যেতে। কিন্তু কোথায় পালাবে! অত সাহসী হতে পারে না হাসনাত। ভীতু হয়ে পড়ে। টিয়ার হাত ধরে ওর খুব সাহসী হতে ইচ্ছে করে। অজান্তেই টিয়ার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে হাসনাত। টিয়া নির্ভরতার চোখে তাকায়। গভীর রাতে ঘরে ফিরে তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে মিলির পাশে শুয়ে পড়ে হাসনাত। গভীর ঘুমে স্বপ্ন দেখে লাল বেনারসি পরিয়ে টিয়াকে ঘরে নিয়ে এসেছে সে। কিন্তু মিলির লাল অগ্নিমূর্তি তাদের ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না। ঘুমের ঘোরেই চিৎকার করে হাসনাত, “আমাদের ঘরে ঢুকতে দাও!”
মিলির ধৈর্যের সব বাঁধ ভেঙে গেছে। আজ সন্ধ্যায় পাশের বাসার ঐ মহিলার সাথে কফিশপে হাতেনাতে ধরেছে সে হাসনাতকে। ব্যাগ গুছাচ্ছে মিলি। বাচ্চাদের নিয়ে আজই আপার বাসায় চলে যাবে সে। তারপর টিকিট করে সোজা শ্রীমঙ্গলে মায়ের কাছে। হাসনাত অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে। এভাবে ধরা পড়ে যাবে সে ভাবেনি। মিলি শ্রীমঙ্গল চলে গেলে ওকে ফিরিয়ে আনার জন্য আবার যেতে হবে। টাকা নষ্ট হবে কিছু। মিলিকে বাধা দেয়ার মত সাহস সে পাচ্ছে না এখন। তবু দুর্বল গলায় বলে, “মিলি, আমার কথাটা একটু মিলির অগ্নিদৃষ্টি থামিয়ে দেয় তাকে। মিলি চলে যায় বাচ্চাদের নিয়ে এই রাত্রিবেলাই।
ফাঁকা বাসা হাসনাতকে কেমন সাহসী করে তোলে। বারান্দায় যায় সে। ওপাশের বারান্দায় টিয়া দাঁড়িয়ে আছে। খয়েরি শাড়ি, কপালে কালো টিপ, যেন অপ্সরী। হাসনাতের আহবানে টিয়া চলে আসে হাসনাতের ফ্ল্যাটে। আজ রাতের জোছনা চিরসুন্দর হবে। টিয়া নিজ হাতে শোল মাছ রান্না করেছে। খেতেখেতে হাসনাত শেষবারের মত ভয় পায়, “মিলি ফিরে আসবে নাতো!”
হাসনাত যখন চোখ খোলে তখন সে হাসপাতালের সফেদ বিছানায়। আজ তিনদিন পর ওর জ্ঞান ফিরেছে। মিলি আর বাচ্চারা আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে আছে। কাঁদতে কাঁদতে লাল হয়ে গেছে মিলির চোখ। ঘরে থাকা সাত ভরি বিয়ের গহনা ও পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে কে যেন হাওয়া হয়েছে। কড়া ঘুমের ঔষধে তিনদিন জ্ঞান ছিলো না হাসনাতের। পুলিশ এসে মিলিকে জিজ্ঞেস করেছিলো জানে কিনা কে করেছে এই কাজ।
মিলি বলেছে সে জানে না। যদিও সে জানে। পাশের বাসার মহিলা নাকি সে রাত থেকেই উধাও। বাড়িওয়ালার ভাড়া বাকি রেখেই পালিয়েছে। মিলি পুলিশকে বলে নি কিছুই, বলে নি সাংবাদিককেও। সে চায় নি হাসনাতের সম্মানহানি হোক, সে চায় নি নিউজ হোক, “গৃহকর্ত্রীর অনুপস্থিতিতে গৃহকর্তাকে অজ্ঞান করে স্বর্ণ ও টাকা নিয়ে পালিয়েছে পাশের বাসার ভাবী!” হাসনাতকে এতটাও চরিত্রহীন ভাবেনি কখনো মিলি। ঐ পাপটাকে ঘরে আনবার সময় হাসনাত একটাবারও ভাবলো না তার নিষ্পাপ পবিত্র দুটো সন্তান এ ঘরেই বড় হচ্ছে! মিলি তার সন্তানদের এই লোকের কাছে আর বড় হতে দেবে না।
হাসনাত সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরে। অবাক চোখে দেখে ঘরে মিলি আর বাচ্চাদের কোনো জিনিশ নেই। তবে কি মিলি আলাদা হতে চায়! মিলি টিকিট কেটে ফেলেছে। আপার বাসা থেকে সব জিনিস নিয়ে বের হবে এমন সময় ছোট মেয়েটা জিজ্ঞেস করে খুশীখুশী মুখে, “মা, আমরা বাবার কাছে যাচ্ছি?” মিলির সব ভাবনা কেমন এলোমেলো হয়ে যায়, অসহায় লাগে, ভেঙে পড়ে একা বাঁচবার আত্মপ্রত্যয়।
হাসনাত দ্রুত তৈরি হয়। মিলিদের ফেরাতে হবে। তড়িৎ গতিতে বের হয় বাসা থেকে। সব ভুল এবার শুধরে নেবে সে। হঠাৎ পাশের বাসার মেইন গেইটে একটা টিনের উপর একটা লেখার দিকে চোখ পড়তেই ভীষণ অস্বস্তি লাগে হাসনাতের, বড় হরফে লেখা আছে, “টু-লেট”।