রাতুলের সিগারেটের তৃষ্ণা হচ্ছে। বেনসন অ্যান্ড হেজেস সিগারেটের একটা প্যাকেট সব সময় ওর কাছে থাকে। দামি সিগারেট, দাম সম্ভবত তের টাকা। এই টাকা দিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একটা গোটা ডিম খেয়ে ফেলা যায়। এই শহরে কারো কারো জন্য ওটুকুই রাতের খাবার। একটা গোটা ডিম, ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি – এক রাতের রেশন। আবার কারো কারো এক রাশ ধোঁয়া গিলতে খরচ হয় ওই তের টাকা। অদ্ভুত এই শহর, অদ্ভুত এখানকার জীবন। বীভৎস হিসেবনিকেষের বেড়াজালে বন্দি মনুষ্যত্বের বসত এই শহরে।
আমি নিতান্তই ভদ্র গোছের ছেলে; মোটামুটি নিরীহ শ্রেণির। আমার কাছে সর্বোচ্চ নেশা হলো বেশি করে চিনি দেয়া এক কাপ দুধ চা। মাঝেমধ্যে দোকানদারকে বলে আধা চামচ অতিরিক্ত কনডেন্স মিল্ক মিশিয়ে নেয়ার মধ্যেই আমার সাহসের সবটুকু প্রকাশ পায়। সিগারেট খাওয়া তো দূরে থাক, গন্ধও সহ্য হয় না আমার। আশেপাশে দেড়শ মিটারের মধ্যে কেউ সিগারেট ধরালে খুকখুক করে কাশতে থাকি আমি।
এখন রাত প্রায় একটা। এত রাতে আমার বাইরে থাকার কথা না। নিজের বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে আরাম করে শুয়ে থাকার কথা। ঘুম না আসলে দুটো ডরমিকাম খেয়ে লম্বা হয়ে বিছানায় পড়ে থাকবো, আপনাআপনি নাক ডাকা শুরু হবে। কিন্তু আজকের রাতটা ভিন্ন। রাতুলের সাথে আমিও বাইরে আছি, বসেছি শাহীন মামার চায়ের দোকানে। শাহীন মামার দোকান রাত দেড়টা পর্যন্ত খোলা থাকে, রাতুলের মতো ছেলেদের সিগারেটের তৃষ্ণা মেটানোই এত রাতে উনার প্রধান কাজ। সে কাজ উনি করেন ক্লান্তিহীনভাবেই।
রাতুল একটা বেনসন ধরিয়েছে। অন্য সময় হলে আমি প্রবল আপত্তি জানিয়ে ওকে দূরে পাঠিয়ে দিতাম। কিন্তু এখন সে পরিস্থিতি নেই। রাতের পর রাত না ঘুমানো রাতুল সিগারেটে সুখটান দেবে, চোখমুখ কুঁচকে আমাকে সহ্য করে যেতে হবে সেটা।
রাতুলের সমস্যা গুরুতর। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে এই প্রেমিক পুরুষ মোটামুটি আত্মহত্যা করার কাছাকাছি পর্যায়ে চলে গিয়েছে। আমি চেয়ে চেয়ে ওর অবস্থা দেখি শুধু, বলার মতো কিছু খুঁজে পাই না। সে লেখক মানুষ। প্রতি বছর বইমেলায় অটোগ্রাফ-ফটোগ্রাফের জন্য তাকে ঘিরে ধরে উচ্ছ্বসিত তরুণীর দল। সে তার সদ্য বিক্রি হওয়া বইয়ে অণুকবিতা লিখে খসখস শব্দে স্বাক্ষর করে দেয়। আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখি। হিংসেও হয় কিছুটা। শ্যামলা গায়ের রঙ আর গড়পড়তা বাঙালি চেহারা নিয়েও স্রেফ কলমের জোরে তার তরুণী ভক্তের অভাব নেই। এদের অনেকের সঙ্গেই ওর সম্পর্ক নিছক লেখক-পাঠকের নয়; বরং সেই গণ্ডি পেরিয়ে বন্ধুত্বের চৌকাঠ মাড়িয়ে আরো খানিকটা এগিয়ে যাওয়া সম্পর্ক। সেই রাতুল তার দীর্ঘ দিনের প্রেমিকার সাথে বিচ্ছেদের পর এমন ভাবে ভেঙে পড়বে, সেটা রীতিমতো অভাবনীয়। যে ছেলের হাত অজস্র তরুণীর নেশাঘোর হাত ছুঁয়েছে, একটা মাত্র মেয়ের জন্য তার এমন মরোমরো দশা হবে কেন?
কলেজে পড়ার সময়টায় প্রেম এসেছিল আমার জীবনেও। তখন আমি ঢিলেঢালা গ্যাবাডিন প্যান্টের সাথে হাটু অবধি নেমে আসা হাফহাতা শার্ট পরে কলেজে যাই। অফ পিরিয়ডে অতি সাবধানে মায়ের দেয়া টিফিন বক্স খুলে প্রায় নেতিয়ে যাওয়া পরোটা আর আলুভাজি খাই। বিকেলে বাসার ছাদে আধঘণ্টা হাঁটাহাঁটি করে মাগরিবের আজান হতে না হতেই আবার ঢুকে পড়ি ঘরে।
রাত বারোটা পর্যন্ত একটানা পড়াশোনা। সেই রসকষহীন আমার জীবনে প্রবল জলোচ্ছ্বাস নিয়ে এসেছিল সুস্মিতা। ভারতীয় নায়িকা সুস্মিতার মতোই স্মিত হাসিতে পাগল করেছিল আমাকে। তখন মনে হতো, ওর সেই হাসি মাখা ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে পুরো জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো। হয়তো পারতামও। কিন্তু সুস্মিতা আমাকে সে সুযোগ দেয়নি। এইচএসসি শেষ হওয়ার পরপরই ঢাকায় কোচিং করতে চলে যায় সে। যোগাযোগ কমে আসে আমাদের, ইচ্ছে করেই সে আর যোগাযোগ রাখেনি আমার সাথে। তারপর একদিন সোজা জানিয়ে দেয়, আমার মতো গেঁয়ো ভুতের সাথে সম্পর্ক রাখা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ইতি ঘটে আমাদের দেড় বছরের সম্পর্কের।
সেদিন বাড়ি ফিরে আমি জন্মের কাঁদা কেঁদেছিলাম। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, কখনোই কোনো মেয়ের প্রেমে পড়বো না। সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে চলেছি আজও। অবশ্য এভাবেও বলা যায়, রক্ষা করে চলতে বাধ্য হচ্ছি। আমার চাপা স্বভাবের কারণে যেচে বন্ধুত্ব করতে কেউই আসে না আমার সঙ্গে। রুমমেট হওয়ার সুবাদে একটুআধটু যা বন্ধুত্ব, সবই ওই রাতুলের সঙ্গেই। ক্লাস, পড়াশোনা, খাওয়াদাওয়া, ঘুম; আর রাতুলের সাথে মাঝেমধ্যে শাহীন মামার দোকানে বসে বেশি করে দুধ-চিনি দেয়া চা খেয়েই আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কেটে যাচ্ছে। ভালোই তো কাটছে!
তবে রাতুলের জীবন সম্ভবত আর ভালো কাটবে না। মুষড়ে পড়া ছেলেটাকে দেখে আমার মায়া হচ্ছে। একটা বেনসন শেষ করে সে দ্বিতীয়টা ধরিয়েছে। প্রেমিকার নোটবুকে চটপট কবিতা লিখে দিত সে। প্রেমিকাকে লেখা জন্মদিনের শুভেচ্ছাবার্তায় থাকতো অদ্ভুত কবিতার লাইন, ‘এখন তুমি যতোই থাকো ইবাদতে রত/ কসম খোদার মুছবে না সেই প্রথম চুমুর ক্ষত।’
এখন তার রাত কাটে হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে। কবিতার খাতায় প্রথম চুমু নিয়ে কবিতা লেখার বদলে এখন সে লেখে, ‘মন হারালাম, পঙ্গু হলাম, নষ্ট প্রেমের বোমায়/ আমায় দেখার অসুখ থেকে মুক্তি দিলাম তোমায়।’ আমি অর্থহীনভাবে শুধু চেয়ে থাকি। ওকে কিছু বলার চেয়ে কোয়ান্টাম মেকানিক্সে মনোযোগ দেয়াই বরং আমার জন্য ভালো। আমি সেটাই করছিলাম আজ রাতেও। রাতভর ছটফট করা রাতুল হঠাৎ আমায় বলে বসলো, ‘দীপ্র, চল। শাহীন মামার দোকান থেকে চা খেয়ে আসি। ঘরে বসে ভাল্লাগছে না আর।’ আমি মৃদু প্রতিবাদ করলেও, রাতুলের বিমর্ষ চোখের সামনে বেশিক্ষণ তা ধরে রাখতে পারলাম না। অগত্যা কোয়ান্টাম মেকানিক্স বোঝার চেষ্টায় ইস্তফা দিয়ে এই শীতের রাতে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
আকাশের দিকে মুখ করে রাতুল সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে। আমি চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে রাতুলের ধোঁয়া ছাড়া দেখছি গভীর মনোযোগে। সিগারেটের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উপরে উঠছে। নিকোটিনের অদ্ভুত এক শক্তি, দুঃখ-কষ্ট সব নিমেষেই দূরে সরিয়ে দিতে পারে। রাতুলের চোখে এখন পানি নেই, ধোঁয়ার স্পর্শ লেগে বরং শুকিয়ে আছে খানিকটা।
আমার চোখে পানি আসি আসি করছে। কেন করছে বুঝতে পারছি না। এমন অদ্ভুত বিষণ্ণতায় মোড়ানো রাতে আমার বুকের ভেতরটাও হঠাৎ ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করেছে। জগতের সকল মানুষই বোধহয় এমন। তীব্র একাকীত্বের সময়ে সবার বুকের ভেতরটাই এমন হুট করে ফাঁকা হয়ে যায়; নিঃসীম শূন্যতায় মনে পড়ে ফেলে আসা স্মৃতি। প্রচণ্ড হাহাকার ছুঁয়ে যায় ভেতর-বাহির।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলাম রাতুলের দিকে। আমাকে দেখে সে ছোট্ট করে হাসলো, তারপর সিগারেটটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘দিবি নাকি এক টান?’ আমি মৃদু হেসে মাথা নাড়লাম। নিকোটিনের যতো শক্তিই থাক না কেন, সেটা আমার সহ্য হবে না। সুস্মিতা আমাকে নিষেধ করেছিল; বলেছিল, ‘খবরদার এসব ছাইপাঁশ ভুলেও ছুঁয়ে দেখবে না!’ জানো সুস্মিতা, প্রচণ্ড কষ্টের এই সময়গুলোতেও আমি এসব ছাইপাঁশ খাই না। নষ্ট হচ্ছি আমি প্রতিনিয়ত, পচে-গলে যাচ্ছে আমার হৃদয়; তবু এসব ছাইপাঁশ আমার সহ্য হয় না। যে ঠোঁট ছুঁয়েছে তোমার ঠোঁট, সে ঠোঁটে এসব ছাইপাঁশ আমি কেমন করে ছোঁয়াতে পারি?