:ট্রেনে উঠেই দেখি আমার উল্টো দিকে এক অসুস্থ্য বৃদ্ধ মাথা নীচু করে বসে আছেন। টিটিকে টিকিট দেখাতে না পেরে ভদ্রলোকের চোঁখে মুখে এতটাই অপরাধী ভাব যেনো এক, খুনের মামলার আসামী। টিটির অকথ্য ভাষার গালাগালি আমি tolarate করতে পারছিলাম না। একটু কর্কষ ভাষায় বলে ফেললামঃ “টিটি সাহেব ফাইনসহ কত? আমি দেবো।”
টিটি বললোঃ “আপনি দেবেন কেনো? ম্যাডাম”
আমিঃ “তাতে আপনার কি? টাকা নিয়ে রশিদ কেটে দিন।”
রশিদটা বৃদ্ধের হাতে দিয়ে বললামঃ “বাবা, রশিদটা রাখুন। পথে লাগতে পারে।”
কাঁদতে কাঁদতে বৃদ্ধ বললোঃ “বাবা তুমি আমার আমার মান সন্মান বাঁচালে।” পরিস্থিতি স্বাভাবিকের জন্য মৃদু হেঁসে বললামঃ “আপনি কোথায় থাকেন?”
বৃদ্ধ বললোঃ”সে এক ইতিহাস। আপনার কি শোনার সময় হবে?”
আমিঃ “অবশ্যই, বলুন।”
বৃদ্ধ বললোঃ “আমি পাইকপাড়া বশিরউদ্দিন স্কুলে B.Sc শিক্ষক ছিলাম।”
শিক্ষক শুনেই আমিঃ “স্যার, আমাকে তুমি করে বলবেন।”
স্যারঃ “বাইশ বছর পর স্যার শব্দটি শুনে চোঁখের পানি ধরে রাখতে পারলাম নারে বাবা।” টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বললামঃ “স্যার, আপনার গল্পটা বলুন।”
স্যারঃ”তিন বছর বয়সের যমজ দুটো ছেলে আর মেয়েটি জন্মের সময় ওদের মায়ের মৃত্য হলো। সন্তানদের দিকে তাঁকিয়ে আর বিয়ে করলাম না। পাইকপাড়ায় মাথা গুঁজার ঠাঁই করি। সন্তানদেরকে বাবা-মায়ের আদর দিয়ে বড় করলাম। বড় ছেলেটা বুয়েট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করলো। ছোট ছেলেটা মেডিক্যাল থেকে পাশ করলো।”
আমিঃ “মেয়েটিকে কি পড়ালেন?”
স্যারঃ “নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষজনের ধারনা মেয়েকে লেখা পড়া শিখিয়ে লাভ কি? পরের বাড়ী চলে যাবে। বরঞ্চ ছেলেকে সুশিক্ষিত করে তুললে বৃদ্ধ বয়সে একটু মাথা গুঁজার ঠাঁই হবে। আমরা খুব স্বার্থপর জাতিরে বাবা। মেয়েটি ইন্টারমিডিয়াট করার সাথে সাথে বিয়ে দিয়ে দিলাম। ছাত্রী ভালো ছিলো।”
আমিঃ “তারপর?”
স্যারঃ “ছেলে দুটোকে বিয়ে করালাম। ছেলে দুটোর অনুরোধে জমিটুকু বিক্রী করে বড় ছেলে আর ছোট ছেলে ফ্ল্যাট কিনলো।”
আমিঃ “মেয়েকে কিছুই দেন নাই?”
কাঁদতে কাঁদতে স্যারঃ “সেটাই একটা বিরাট ভুল। ছেলের বৌদের সিদ্ধান্ত প্রতি মাসের ১ হতে ১৫ বড় ছেলের বাসায় আর ১৫-৩০ ছোট ছেলের বাসা সুটক্যাস নিয়ে ছুঁটাছুটি। মেয়ে অবশ্য বহুবার বলেছে আব্বা আপনি আমার কাছে চলে আসেন। কোন মুখ নিয়ে যাবো? কতদিন যাবৎ বুকের বাম দিকটা ব্যাথা করছে।”
আমিঃ “ডাক্তার দেখাননি?”
মৃদু হেঁসে স্যারঃ “ডাক্তার আবার, ছোট বৌমাকে বললাম আর কয়েটা দিন থাকি। সে সুটকেসটা বাহিরে ফেলে দিয়ে ইংরাজীতে বললো See you next month। বড় ছেলের বাসায় গিয়ে দেখি তালা মারা। দাড়োয়ান বললো ওরা দু সপ্তাহের জন্য মালেশিয়া গেছে। তারা জানে নির্ধারিত সময়ানুযায়ী আমার আসার কথা। পকেটে বিষ কেনার পয়সাও নেই। তাই ভাবলাম মেয়েই শেষ অবলম্বন।”
আমিঃ “মেয়ে কি করে?”
স্যারঃ “স্বামীটা খুব ভালো। ওকে কম্পিউটার সায়েন্সএ পাড়িয়ে ওরা দুজনই প্রাইভেট ব্যাঙ্কে আছে।”
আমিঃ “আপনার মেয়ে যদি আপনাকে গ্রহণ না করে।”
স্যারঃ “মেয়ের পায়ে ধরে কান্না করলে। আমাকে তাঁড়িয়ে দেবে না।”
আমিঃ “এতো আত্মবিশ্বাস? মেয়ে কি জানে আপনি আসছেন।”
স্যারঃ “না, আমারতো মোবাইল নেই।”
আমিঃ “নম্বর দিন, কথা বলিয়া দিচ্ছি।”
স্যারঃ “না না বাবা, মোবাইলেতো মেয়ের পাঁ ধরে মাফ চাইতে পারবো না। পরে যদি নিষেধ করে দেয়।” আমি বলছি আপনার মেয়ে কনোদিন বাবা-মাকে তাঁড়িয়ে দেবে না। এক প্রকার জুড় করে ফোন ডায়রী দেখে স্পিকার অন করে ডায়াল করলাম
আমিঃ “হ্যালো, আপনি কি শাহানা?”
অপরপ্রান্তঃ “জ্বী, কে বলছেন?”
আমিঃ “একখানা সুখবর দেওয়ার জন্য ফোন করলাম।”
অপর প্রান্তঃ “কিসের সুখবর?”
আমিঃ “কিছুক্ষনের মধ্যে আপনার বাবা অর্থাৎ স্যার রেল স্ট্যাশনে পৌঁছাবেন।”
মেয়েটি চিৎকার দিয়ে বলে উঠলোঃ “এই শুনছো, আব্বা আসছেন। চলো আমরা স্ট্যাশনে যাই। কতদিন হয় আব্বাকে দেখি না। নিবিড় চল বাবা, তোর নানা ভাই আসছে, চল স্ট্যাশনে যাই।” কিছুক্ষন পর স্ট্যাশনে ট্রেনটি ধীর গতিতে চলছিলো। জানালা দিয়ে তাঁকিয়ে দেখলাম। ঘরের সাধারণ কাপড় পড়া স্বামী/সন্তানসহ এক নারী অধীর আগ্রহে তাঁকিয়ে যাত্রী খুঁজছিলো। তাঁকানো দেখেই বুঝে গিয়ে স্যারকে বললামঃ “আপনার মেয়ে?” স্যার বেশ নার্ভাস স্বরে বললোঃ “হো মা।”
আমি ইশারা দিতেই ওরা দরজার সামনে এসেই। স্বামী স্যারের ভাঙ্গা সুটকেসটা নিয়ে পাঁ ছুঁয়ে প্রণাম করলো। মেয়েটি বাবাকে জঁড়িয়ে ধরে কাঁদছিলো। স্যারের চোঁখ ভরা অশ্রু আমাকে বায় দিলো। ট্রেন ছুটতে লাগলো।মেয়ে,জামাই আর নাতি স্যারকে ধরে আস্তে আস্তে নিয়ে যাচ্ছে আর ট্রেনটির দিকে তাকাচ্ছিলো। মেয়েটির কান্না দেখে মনে হলো মা তাঁর হাঁরিয়ে যাওয়া সন্তানকে বহুদিন পর ফিরে পেলো। আকাশের দিকে তাঁকিয়ে ভাবছিলামঃ “আজ আমার বাবা বেঁচে থাকলে এই আনন্দের থেকে আমিও বঞ্চিত”