মাকে হারিয়েছি সেই ছোট বেলায়। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সৎ মায়ের সংসারে অন্যান্য ভাই বোনদের সাথে বেড়ে উঠি কিছুটা অযত্নে আর অবহেলায়। হুট করেই প্রেম আসে আমার জীবনে। আমি ভালোবেসে ফেলি অভিকে। আমিও সুখের সংসার সাজাতে চেয়েছিলাম ভালোবাসার মানুষটার হাতটা আঁকড়ে ধরে। বিয়েও করেছিলাম সেই মানুষটাকে।
ভালোবাসলে তাকে জীবনে পেতে হয়। আর না পেলেই শুরু হয়ে যায় ব্যার্থতার গল্প গুলো। কেউ কাউকে ছেড়ে চলে গেলে বা অন্যত্র বিয়ে করলে শুরু হয়ে যায় একপক্ষীয়ভাবে তাকে দোষারোপ করা। কিন্তু কেউ কারো অপারগতা মানতে বা বুঝতে রাজী নয়। যাই হোক কথায় আছে ভালোবাসার মানুষটাকে জীবনে পেলে নাকি তখন ভালোবাসাটা আর থাকে না। থাকে শুধু সেই মানুষ টা। কি লাভ সেই মানুষটা থেকে। একসময় সেই ভালোবাসাহীন মানুষটা বিরক্তির কারণ হয়ে উঠে। আমার জীবনে ও ঠিক এমনটাই ঘটেছে। বড্ড ভালোবেসে বিয়ে করেছি অভিকে। অভি একটা ভালো চাকরী ও করে। তার পরিবার ও মোটামুটি স্বচ্ছল। কিন্তু মা মরা এই আমাকে তার পরিবার প্রথম থেকেই অবজ্ঞা করতে থাকে। নতুন বৌ হিসেবে অভি আমাকে তার মা বাবার কাছে রেখে সে তার কর্মস্থলে চলে যায়।
অভির মা বাবাকে কখনো পর ভাবিনি। আপন ভেবে… সমস্ত সংসারের কাজ নিজ হাতে করতাম। কার কখন কি প্রয়োজন সব সামলে নিতাম। বাসন মাজা, কাপড় ধোয়া, রান্না করা একটা সংসারে কি এমন কাজ নেই সব নিজ হাতেই করতাম। কাজ করতে কোন ক্লান্তি আসতো না। ভাবতাম আমার নিজেরই তো সংসার। নিজের পরিবার। অভির মা বাবা কি আমার মা বাবা নয়। তাদেরকে আপন করে নিতে যথাসাধ্য চেষ্টার ত্রুটি রাখিনি। কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় ছিলো না। তারা আমায় আপন ভাবতে পারে নি। পরের মেয়েকে আপন করে নিতে তাদের রাজ্যের দ্বিধা ছিলো। কারণে অকারণে, উঠতে বসতে খোঁটা দিতো। কি করে তাদের সোনার টুকরা ছেলেকে বশ করলাম।
কেনই বা তার গলায় ঝুলে পড়েছি। কেন আমার বাবা মোটা অংকের যৌতুক দেয় নি। ভরি ভরি অলংকার গড়িয়ে দেয় নি। বলতাম বাবার যা সামর্থ্য ছিলো তাতো দিয়েছো। আরো অনেক কিছুই দিবে বলেছে আস্তে আস্তে। কিন্তু তারা সেসব কথায় কান না দিয়ে যা তা ব্যবহার করতো আমার সাথে। আমাকে খালি হাতে বিদায় করার জন্যই নাকি অভির পেছনে লেলিয়ে দিয়েছে। সব শুনতাম.. আর কান্না করতাম। নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ। মনের কথা বলার মত কেউ ছিলো না। তাই নিজে কেঁদে আবার নিজেই উঠে গিয়ে সংসারের কাজে মন দিতাম। অভি যখন বাড়ীতে দুই একদিনের জন্য আসতো এসব বলে ঝামেলা বাড়াতে চাইতাম না। কিন্তু… যখন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো। অভিকে সব বললাম।
অভি তার মা বাবাকে বুঝিয়ে বললো। তারা যেন এসব ব্যবহার না করে আমার সাথে। অভি যতদিন বাড়ীতে থাকতো তারা আমার সাথে ভালো ব্যবহারই করতেন কিন্তু অভি চলে যাওয়ার পর তাদের পূর্বের আচরণ শুরু হতো। এর মাঝেই আমি প্রেগন্যান্ট হলাম। তাদের কাছে কখনোই ভালো ব্যবহার পাই নি। অভিটাও যেন দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে। মা বাবার সাথে সুর মিলিয়ে আমাকে কথা শোনায়। এতোদিন স্বামীর ভালোবাসা আমার মনের সব ক্ষতকে সারিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু এখন অভির এসব আচরণ কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মত এসে হৃদয়টাকে ক্ষত বিক্ষত করছে। অভি তো সব জেনে শুনেই আমাকে বিয়ে করেছে। তবে কেন এখন এসব কথা। এরপর প্রায় ই অভি আমার গায়ে হাত তুলতে থাকে। একজন মানুষকে যতটা শারীরিক মানসিক যন্ত্রণা দেয়া যায়। তাই করতে থাকে সবাই মিলে।
অসুস্থ শরীর নিয়ে পুরো সংসারের কাজ করা তার উপর সবার কটু কথা জীবনটা কে যেন বিষিয়ে তুলেছিলো। তারপরও পেটের অনাগত সন্তানের কথা ভেবে সব মেনে নিয়েছিলাম। আমার কোল জুড়ে আমার ছোট্ট মা মনি এলো। এতেও সবাই অখুশি। ছেলে হলো না কেন? দায়টা যেন আমারি। মেয়েটা আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। সংসারে খাচ্ছি, থাকছি এটাই যেন বিরাট কিছু। সবাই যেন আমাদের দুইজনের উপর করুণা করছে। অভিটা পুরোপুরি পালটে গেছে। ঠিকমত খোঁজ খবর নেয় না। মাসে, ছয়মাসে বাড়ী আসে। সে আসলেই তার বাবা মা রাজ্যের অভিযোগের ভান্ডার খুলে বসেন। অভির অত্যাচার শুরু হয়ে যায়। অভির অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বাড়তেই থাকে। হায়রে ভালোবাসা!!!
এসব দেখলে ভালোবাসাও স্বয়ং লজ্জায় মুখ লুকোবে। কিছুদিন পর খবর পেলাম অভির কর্মস্থলে এক মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। বিয়েও করতে চলেছে। কাঁদলাম। ছোট্ট সোনামণিকে বুকে জড়িয়ে ধরে ইচ্ছেমত কাঁদলাম। বাবাকে ডেকে আগের অত্যাচার আর এখনকার ঘটনা সব কিছুই জানালাম। আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না। শত হোক বাবার প্রথম সন্তান ছিলাম। সেই হিসেবে কিছুটা টান, মায়া তখনো অবশিষ্ট ছিলো। একদিন খবর পেলাম। আমার স্বামী তার সেই প্রেমিকা নামের মেয়েটিকে বিয়ে করে সুখে সংসার শুরু করেছেন শহরে। এটাই দেখার বাকী ছিলো।
লাত্থি মারতে ইচ্ছে করলো সেই ভালোবাসাকে, যে ভালোবাসা সময়ের সাথে ফুরিয়ে গিয়ে প্রয়োজন হয়ে যায়। সেই প্রয়োজন শেষ হলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। জলে চোখ ভিজে উঠলো। মেয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে উঠে দাঁড়ালাম। অনেক সহ্য করেছি এই সংসারে। একদিন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে ভেবে সব অত্যাচার অবিচার মেনে নিয়েছিলাম। তার পরিণতি আজ এই হলো। বাবার সংসারে এসে উঠলাম। দুই দিন পর অভি এলো। তার বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের মাঝে কথা কাটাকাটি হলো। এক পর্যায়ে তেড়ে এসে আমাকে অনেক মারলো। বাবা এসে থামালেন। তিনি অভিকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন আমার মেয়ে আর তোমার সংসার করবে না। অভি ফিরে গেলো। কেউ বুঝিয়ে আর কোন লাভ হলো না আমাদের।
আমার আর অভির ডিভোর্স হয়ে গেলো। এর মাস ছয়েক পরে একদিন আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসলো। তারা সব জেনে শুনেই এলো। আমাকে তাদের পছন্দ হয়েছে। বিয়েটাও হয়ে গেলো। আমি আর অমত করিনি। আমার আর আমার মেয়ের জন্য একজন অভিভাবকের খুব প্রয়োজন ছিলো। যা হয়েছে ভালোর জন্য ই হয়েছে হয়তো। এই লোকটা খুবই ভালো। সংসার, আমার আর আমার মেয়ের খুব খেয়াল রাখেন। আমার খুব যত্ন নেন। আমাদের একটা ছেলেও হয়েছে। কানায় কানায় সুখে পরিপূর্ণ আমার এই সংসার। শুনেছি… অভির সেই সংসারটা টেকেনি। তাদের একটা মেয়েও হয়েছিলো। মেয়েটাকে ফেলে অভির স্ত্রী চলে গেছে।
অভি আবার বিয়ে করেছে। তবে সারাক্ষণই সংসারে অশান্তি। আমরা কখনো কখনো মানুষ চিনতে ভুল করি। ভুল মানুষকে ভালোবাসি। তবে সেই ভুলের মাশুল সারাজীবন বয়ে বেড়ানোর চেয়ে সেই জীবন থেকে বিদায় নেয়াই শ্রেয়। হয়তো আরো ভালো কিছু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। মাঝে মাঝে আমার স্বামীকে দেখে মনে হয় মানুষ কি করে এতোটা ভালো হতে পারে। আরেকবার ভুল করে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে খুব এই মানুষটা কে…