“শুনছো? বুশরাকে পাওয়া যাচ্ছেনা। সে মনেহয় কিডন্যাপ হয়েছে,” ফোনে এমন কথা শুনে ধড়মড়িয়ে উঠলাম ঘুম থেকে। সকাল বেলা ফোনের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। মেজাজ চরম খারাপ করেই ফোন রিসিভ করেছিলাম।
ফোন ধরেই দেখি বান্ধবী বুশরার আম্মুর ফোন। পুরোপুরি আনপ্রিপেয়ারড অবস্থায় বোম ফেললেম আমার উপর। আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললাম আন্টিকে, “বুশরাকে পাবেন কেন? কয়েকদিন আগেই তো বিয়ে দিয়ে পাঠালেন মেয়েকে।। জামাই তার বউরে নিয়ে গেলে একে কিডন্যাপিং বলেনা।”
আন্টি জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন। বললেন, “কেমন লোকের সাথে মেয়ের বিয়ে দিলাম আমার মেয়েকে রক্ষা করতে পারেনি সে! তারে আমি ছাড়বোনা! ” কথার মাঝখানে আন্টির হাত থেকে ফোন কেড়ে অন্য কে যেন বকবক শুরু করলো। কিছুক্ষণ পরে বুঝলাম সেটা বুশরার হাসবেন্ড জামশেদ। মেজাজ খারাপ হল খুব। সকাল সকাল কে চায় ব্যাঙ এর মত কণ্ঠ শুনতে? আবার তার কন্ঠ শুনে অবাক হলাম। বুশরা তো কালকে জামশেদ এর সাথে ঘুরতে বের হয়েছিল কয়েকদিন এর জন্য। শ্বশুড়বাসায় কি করে ও? সামথিং ইজ রং।
জামশেদ রাগান্বিত হয়ে বলল, “আরে কিডন্যাপ ওসব কিছু না। বুশরা বাস থেকে নেমে পালাইসে দেখ কার সাথে। আমি ঘুম দিয়েছি। ঘুম থেকে উঠে দেখি সে নাই।” মাথায় আগুন জ্বলে গেল ওর কথা শুনে। বুশরা পালাইলে আমাদের সাথে পালাবে। আর কার সাথে পালাবে সে? তার তো বয়ফ্রেন্ড ও নাই। আগের বয়ফ্রেন্ড রাফিকে তো সে নিজেই ঘটকালি করে তার বাসার কাজের মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছে। আন্টিকে বললাম, “আন্টি আপনারা কিছুক্ষণ থামেন আমরা আসছি। জামশেদ কে রিমান্ডে নিচ্ছি আমরা। ”
চারপাঁচজন বান্ধবী মিলে বুশরার বাসায় যেয়ে জামাই জামশেদ এর কলার ধরে তার উপর ইন্টারোগেশন চালাচ্ছি। জলজ্যান্ত মানুষকে কেমনে হারিয়ে ফেলে সে? বাস থেকে একটা মানুষ কেমন করে কিডন্যাপ হয় হাসবেন্ড থাকতে? আমরা এতদিন তাকে নিয়ে যাতায়াত করেছি তখন তো কিছু হয়নি। জামশেদ আমতা আমতা করে বলল, “বাসে উঠেই কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। উঠে দেখি বুশরা নাই। কখন নেমেছে কেউ জানেনা। দেখ সে পালিয়েই গিয়েছে। দিনদুপুরে বাসে কেউ কিডন্যাপ হওয়ার কথা না। লজ্জ্বায় আমি বাড়িতে না গিয়ে এখানে আসলাম। লোকে জানাজানি হলে মানসম্মান থাকবেনা।”
আমরা ঝাড়ি মেরে বললাম, “মিথ্যা কথা। ও পালালে ওর পালানোর অ্যারেঞ্জমেন্ট আমরাই করতাম। বিয়ের আগে কতবার বললাম যে পালিয়ে যা। সে শুনলোনা। তখন আমাদের কথা শুনলে আজকে কিডন্যাপ হতে হতনা। আমরা যে বান্ধবীকে একা একা রাস্তাও পার হতে দেইনি তুমি তাকে রেখে ঘুমালা কেমন করে? সবসময় চোখে চোখে রাখতে কি হয়?” জামশেদ কে আরেকটু ঝাড়ি মারতাম কিন্তু এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। দেখি বুশরার ফোন। দেখেই বলে উঠলাম, “সম, অন্বেষা জামশেদের কলার ধরে রাখ। এখনই চোর ধরা পড়বে”.
লাউডস্পিকার অন করলাম। দেখি বুশরা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “প্রত্যাশা, আমার কি হবে?” আমি ধমক দিয়ে বললাম, “কই তুই? তুই নাকি পালিয়েছিস। আমাদের বলিসনি কেন? ” বুশরা বলল, “আরে না! ব্রেকটাইমে গাড়ি থামিয়েছিল। আমার বাথরুম লেগেছিল। আমার ‘উনি’ দেখি খুব শান্তিমত ঘুমাচ্ছে। তাই নিজে থেকেই নেমে গেলাম ওয়াশরুমে। ফিরে এসে দেখি সে সিটে নাই। ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমে গেছে মনে করে সিটেই বসে থাকলাম। কখন ঘুমিয়েছি ঠিক নাই। ঘুম থেকে উঠে দেখি রংপুরে চলে এসেছি। উনার নাম্বারও মনে নাই আমার। আল্লাহই জানে ও কই!!!” বুশরা হিস্টিরিয়াগ্রস্তদের মত কাঁদতে থাকে।
সবাই কনফিউজড হয়ে গিয়েছে। জামশেদ কনফিউজড হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সমতা, অন্বেষা কনফিউজড হয়ে গিয়েছে যে জামশেদ এর কলার ছাড়বে কি ছাড়বে না, আমি কেমন করে বুশরাকে ঝাড়ি দিবো তা নিয়ে কনফিউজড হয়ে গিয়েছি। অনেক কষ্টে বললাম, “বুদ্ধি কই বেচে এসেছিস? একা একা নামলি কেন বাস থেকে? আর অন্য বাসে উঠেছিস খেয়াল করবিনা? তোরে নিয়ে কি করব? আচ্ছা যেখানে আছিস ওখানেই থাক। আমরা এসে নিয়ে যাবো।”
বুশরা বলল, “বুদ্ধিশুদ্ধি না বেচলে জামশেদ এর মত লোকের সাথে সংসার করব কেমন করে? আর বাসওয়ালাদেরও দোষ আছে। একই ডিজাইন এর বাস করে কেন? যে কারো ভুল হতে পারে ” আমরা ফোন রাখলাম। অন্যরা জামশেদ কে নিচে নামালো। এরপর সবাই মিলে বুশরা কে উদ্ধার করতে গেলাম রংপুর। ঢাকার বাসের বদলে কেউ কেমন করে রংপুরের বাসে উঠে? যাক বাবা সে তো আর পালায়নি! আমাদের না জানিয়ে পালাবে এত বড় বিট্রেয়াল কেমন করে সহ্য করব?”
বুশরাকে আনতে আনতে পরেরদিন সন্ধ্যা হয়ে গেল। আজকে ওদের বাসাতেই থাকবো। জামাই জামশেদ কে পাঠিয়েছি বারান্দায় শোয়ার জন্য। বুশরা তাকে কয়েকবার দেখতে গিয়েছিল বলে তাকে বেঁধে রেখেছি খাটের সাথে।
আন্টি জামাই এর জন্য খাবার নিয়ে আসছেন একটু পর পর। বলাই বাহুল্য একটাও ততদূর পর্যন্ত পৌছায়নি।
দুইদিন আগে আসা মানুষের উপর এত দরদ।
আমরা যে স্কুললাইফ থেকে তাকে মানুষ করলাম সেটা কিছু না? বুশরার বাড়ি বানানোর সময় আমাদের জন্য আলাদা রুম বানাতে বলেছিলাম। আমাদের কথা শুনলে আর জামাইকে বারান্দায় থাকতে হতনা। সে ওই গেস্টরুমে থাকতো আর আমরা বুশরা কে নিয়ে গল্প করতাম যাই হোক। আজকাল কে শোনে কার কথা! সে দিনদুপুরে বুশরাকে হারিয়ে ফেলেছে। এতটুকু পানিশমেন্ট তার প্রাপ্য। বারান্দায় মশার কয়েল রেখে এসে আমরা আবার নিজেদের কাজে মনোযোগ দিলাম। মনে অদ্ভুত প্রশান্তি!