সাহেব, মাইয়াডা না মইরা গেছে” কথাটা শুনেই জমির মিয়ার দিকে তাকালাম। উস্কোখুস্কো মুখ, চুলগুলো শুষ্ক, মুখে কয়েকদিনের না কাঁটা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। শরীরটা এই কয়েকদিনে বেশ খানিকটা ভেঙে পড়েছে।
-মারা গেছে? কিভাবে? এই তো কয়েকদিন আগেই না বললে যে, তোমার মেয়েটাকে স্কুলে ভর্তি করে দিতে গ্রামে যাবে।
জমির মিয়া আমার কথা শুনে মাথাটা নামিয়ে নিলো। তারপর বেশ কিছুক্ষণ ফ্লোরের ফুল তোলা কার্পেটে তাকিয়ে থাকলো আনমনে, খানিক বাদে একটা দীর্ঘতম শ্বাস ছেড়ে বললো,
– হো সাহেব, গেছিলাম তো। যাইয়া দেখি মাইয়াডা জ্বর বাঁধাইছিলো। ছোট মাইয়া তো! রোদে, পানিতে ভিজছিলো নাকি বউটা কইলো।
– আরে জ্বর আসলে হাসপাতালে নিতে, ডাক্তার দেখাতে।
– দেখাইছিলাম, ঐ যে আমাদের গ্রামের মতি ডাক্তার। কি যেন ঔষুধও তো দিছিলো। কইছিলো সকালের মধ্যেই নাকি ভালো হইয়া যাইবো। কিন্তু রাতটাই পার হইলো না।
এই কথার প্রতি উত্তরে যে কি বলবো বুঝে উঠতে বেশ খানিকটা সময় লাগলো। কিন্তু তার আগেই জমির মিয়া আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
– আমার মাইয়াটার খুব শখ আছিলো স্কুলে যাইবো, লেখা-পড়া কইয়া নাকি মানুষের মতন মানুষ হইবো। আমি যখন ছুটি নিয়া গ্রামে যাইতাম তখন কোলে বইসা মাইয়াটা কত কথা কইতো। আমি খালি শুনতাম আর হাসতাম। মাইয়াডার কথা শুনলে কলিজাডা ঠাণ্ডা হইয়া যাইতো গো সাহেব।
জমির মিয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। ওকে সান্তনা দেওয়ার জন্য কয়েকটা শব্দ দিয়ে একটা বাক্য সাজানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু বার বারই আমি ব্যর্থ। আমার জীবনে ব্যর্থতার শেষ নেই। এতদিনে মনে হলো জমির মিয়াকে সান্তনা দিতে না পারাটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারণ হলো না। শুধু বেরিয়ে আসলো দীর্ঘশ্বাস। এই দীর্ঘশ্বাস যেন আমাকে ধিক্কার দিয়ে বলছে, “তুমি অক্ষম, তুমি ব্যর্থ।” জমির মিয়া আবার বলতে শুরু করলো,
– আমি বলি কি সাহেব, মাইয়াডা মইরা গিয়ে ভালোই করছে। কি কন সাহেব? ভালো করে নাই?
হঠাৎ জমির মিয়ার এমন প্রশ্নে চমকে উঠলাম। ভালো করেছে? কি বলছে এইসব? একটু আগে তো জমির মিয়া বললো, মেয়েটার কথা শুনলো ওর কলিজা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। আবার বলছে মরে গিয়ে ভালোই করেছে?
– মানে?
ধরা গলায় কোনো মতে প্রশ্নটা করলাম। আমার কথায় জমির মিয়া একটু হাসলো। শব্দ বিহীন হাসি। এই হাসিতেই যেন একটা বাবার মেয়ে হারানোর কষ্ট লুকিয়ে আছে।
– হো সাহেব, ভালোই করছে। নিজের মা নাই তো, যত্ন অাদ্ধি পাইতো না। আমি যখন গ্রামে যাইতাম মাইয়াডা গলা জড়াই কইতো, ওরে শহরে আনোনের লাইগা। ওর মা নাকি খালি মারতো। একবার পিঠের একটা দাঁগ দেখাইছিলো। বাঁশের কঞ্চির দাঁগ আছিলো ঐইডা। খাইতে দিতো না, পরতে দিতো না। সৎ মা তো তাই।
জমির মিয়ার প্রথম স্ত্রী মারা গেছে বছর চারেক হবে বোধহয়। মেয়েটার মুখ তাকিয়ে আরেকটা বিয়ে করেছিলো। এটা আমি জানি। জমির মিয়াই গল্প করতো। ওর মেয়ে যে বার বার শহরে আসতে চাইতো সেটাও বলেছিলো। আমি বলেছিলাম, ” নিয়ে আসো সমস্যা কোথায়? বাবা-মেয়ে একসাথে থাকবে ক্ষতি কি? তাছাড়া মেয়েটা শহরে মানুষ হলে তো ভালোই তাই না?” আমার কথা শুনে জমির মিয়া হাসতো। আর হেসে হেসে বলতো, “না না গ্রামের মাইয়া শহরে আইসা কি করবো? তাছাড়া ও শহরের হালচাল বোঝবো না সাহেব। গ্রামেই থাকুক।” আমি আর কথা বাড়াইনি।
জমির মিয়ার দিকে একবার তাকালাম। একজন কর্মচারীর প্রতি দূঃখ হওয়াটা বেশ অস্বাভাবিকও বটে। ধনীরা দূঃখ প্রকাশ করবে তার থেকে উঁচু পর্যায়ের কারো জন্য। যেন সেই দূঃখ প্রকাশে লাভ হয়, পকেটে কিছু টাকা আসে। কিন্তু আমার পাশেই যে চেয়ারের হাতলটা ধরে বসে আছে সে একটা চাকর। আমার বাসাতে মাসিক কাজের বিনিময়ে কিছু টাকা পায়। তার জন্য বুকটা হু হু করে উঠবে কেন? কে হয় আমার ? নাকি এটাই…..। নাহ্ এটা যে কি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
-জানেন সাহেব, মাইয়াডার মরা মুখখানির দিকে তাকাই আছিলাম অনেকক্ষণ। মনে হইতেছিলো ঘুমাইতেছে, একটু পরই বুঝি উইঠা বসবো। কিন্তু কই আর উঠলো না। মইরাই গেছে তাই না সাহেব?
এবার আমি মাথা নাড়লাম।গরীবের দূঃখে কি বলতে হয় মুখে বলার মত শক্তি আমার হয়ে উঠেনি এখনো। তবে হ্যাঁ, কোনো ধনীর মেয়ে যদি মারা যেত তবে ব্যানার টাঙ্গিয়ে বেশ বড় করে একটা শোক সভার আয়োজন করতে পারি। এতে লাভ দুইটা। নিজের প্রচার আর পকেটে টাকা দুই আসতো। কিন্তু জমির মিয়া না না সে যা ইচ্ছে বলে যাক। আমি শুধু শুনে যাবো।
– হো সাহেব মইরাই গেছে।মাইয়াডার খুব শখ আছিলো ইস্কুলে যাইবো। ভর্তি টা করাইতে পারলে একটা শান্তি পাইতাম সাহেব। সেইডা আর হইলো না।বাদ দেন সাহেব। আপনি অফিসে যাইবেন না?
এবার একটু চমক ভাঙলো আমার। ঘড়ির দিকে একবার তাকালাম। এগারোটা বাজে। নিজের অফিস, এগারোটাই কি আর একটাই কি? গেলেই বা কি আর না গেলেই বা কি? তবুও যেতে হয়। কিন্তু কেন জানি আজ ইচ্ছে করছে না। এই নিচু শ্রেণীর মানুষটার কথা শুনতেই যেন ইচ্ছে করছে খুব। ওর দূঃখের কথা শুনে নিজের বুকের ভেতরে যে একটা পাথর জমে গেছে সেটা গলিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
জমির মিয়া কথা বলেই চলেছে। আঁধো আঁধো কথা কানে আসছে। মন আমার অন্য খানে।অনুভব করলাম চোখের কোণটা ভিজে উঠেছে। তার মানে আমি কাঁদছি? কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে তো। তবে সত্যি বলছি, বুকটা কেন জানি খুব হালকা লাগছে। এতটা হালকা আর কখনো লাগেনি। যেন একটা পাথর চাপা দেওয়া ছিলো এই বুকে,যা আজকে নামিয়ে ফেলা হয়েছে।