একটা বাবু চাই

একটা বাবু চাই

রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। পাশ ফিরে তাঁকিয়ে দেখি নীলা পাশে নেই। বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি রাত তিনটা দশ বাজে। এত রাতে নীলা কোথায় গেল? ওয়াস রুমেও তো নেই। বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় চলে গেলাম,না এখানেও নেই। ছাদে যায়নি তো? নাহ,ছাদে একা একা এত রাতে তো যাবার কথা না। এমনিতেই ওর একটু বেশি ভয়। তবুও আমি ছাদে যাবার জন্য পা বাড়ালাম। ছাদে উঠে দেখি নীলা এক কোণে বসে আছে। আমি আস্তে আস্তে ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

– নীলা!
– (মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো)
– কী ব্যপার এত রাতে একা একা তুমি ছাদে কী করছো?
– নীল আমার কিছু ভালো লাগছে না।
– কেন,কী হয়েছে তোমার?
– নীল আমাকে একটা বাবু এনে দিবা?

আমার না একা একা আর ভালো লাগে না। আশে পাশের মানুষের মুখে নিজের নামের সাথে আর অপায়া,বন্ধা নামটা শুনতে ইচ্ছে করে না। নীল দেও না,আমাকে একটা বাবু এনে। আমি আর কখনো তোমার কাছে কিচ্ছু চাইবো না। আমি নীলার কাছ থেকে এমন কথা শুনে নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। নীলাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দিলাম।

– নীলা,ডাক্তার বলেছে তো আমাদের বাবু আসবে। শুধু একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে।
– আর কত,আর কত ধৈর্য ধরে থাকলে একটা বাবু পাবো বলো? আজ পাঁচ টা বছর ধৈর্য ধরে আছি। আমি যে আর পারছি না নীল।
– নিচে চলো নীলা।

নীলার প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে আর জানা নেই। আমিও এই পাঁচ বছর ধরে নীলার প্রশ্নের উত্তরে মিথ্যে আশা দিয়া আসছি। আমি যে মিথ্যে আশা দিতে দিতে আজ বড্ড ক্লান্ত। নীলা ও হয়তো বুঝতে পেরেছে আমার কাছে আর কোন উত্তর নেই।

নীলা আমার বুকে মাথা গুজে ফুঁপিয়ে কান্না করছে আর আমি নীলার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পড়ানোর চেষ্টা করছি। নীলা ইদানীং বাচ্চাদের মত আচরণ করছে। আমি অফিসে থাকাকালীন একটা পুতুল নিয়ে সারাদিন বসে থাকে। পুতুলটার মাথায় বিলি কেটে দিবে কখনো,কখনো মাথা আঁচড়িয়ে দিবে আবার কখনো নতুন নতুন জামা পড়াবে।
এই তো গতকাল আমি অফিসে কাজ করছি তখন আমাকে ফোন করে বললো,নিলুর (পুতুল) জন্য চুলের ব্যান কিনে নিয়ে যেতে।

আর বচ্চাদের মতো আচরণ করবেই বা না কেন। দীর্ঘ পাঁচ টা বছর একটা কষ্ট,ব্যথা বুকে গেঁথে রেখেছে। নীলার সাথে আমার পরিচয় একটা রেস্টুরেন্ট-এ। প্রথম যখন ওকে দেখলাম তখন আমি যে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলাম,আমি নিজেই জানি না। ও যখন আমার সামনের টেবিলে বসে খাচ্ছিল,আমি তখন ওর খাওয়া দেখছিলাম। আল্লাহ এত সুন্দর করে ওকে তৈরি করেছে যে,যে কেউ একবার দেখলে আর চোখ ফিরিয়ে নিতে পারবে না। এই যে মিস্টার,এমন করে তাঁকিয়ে আছেন কেন? নীলার ডাকে আমার হুস ফিরলো।

– না,মনে আসলে,,,,
– পাগল নাকি। কী না,মানে মনে করছেন? কাউকে কখনো খেতে দেখেন নাই জীবনে?
– দেখেছি,কিন্তু,,,,
– কিন্তু,কী?
– আপনাকে তো কখনো খেতে দেখি নাই।
– আজব মানুষ তো আপনি। কেউ খাচ্ছে এতে দেখার কী আছে?
– আছে আছে,আপনি বুঝবেন না।
– দেখেন,আমি খাওয়ার সময় কেউ আমার দিকে তাঁকিয়ে থাকলে আমি খেতে পারি না। আমি কিন্তু বিরক্ত বোধ হচ্ছি।

– বারে,আপনার খাওয়া যদি কেউ দেখলে বিরক্ত হন,তাহলে রেস্টুরেন্ট-এ আসছেন কেন? বাসায় দরজা লাগিয়ে একা একা খেতে পারেন না?
– সেই কৈফিয়াত তো আমি আপনাকে দিব না।
– আমিও আপনার দিকে তাঁকিয়ে থাকবো। কেন তাঁকালাম সেই কৈফিয়াত আমিও আপনাকে দিব না।
– আপনি তো একটা বদের হাড্ডি।
– তা আমি জানি।

– আমার রাগ সম্পর্কে আপনার কোন ধারনা নেই। আমি রেগে গেলে মানুষও খুন করে ফেলতে পারি।
– ওওওও,তা কয়টা খুন করছেন জীবনে?
– বলছি না,আমি আপনাকে কোন রকম কোন কৈফিয়াত দিতে পারবো না।
– আহ,এমন করছেন কেন? আপনি দেখতে যেমন সুন্দরী,ঝগড়াটাও কিন্তু তেমন সুন্দর করতে পারেন।
– আমি মোটেও ঝগড়া করছি না। আপনিই নিজে থেকে আমার সাথে ঝগড়া করছেন।
– আপনার সাথে ঝগড়া করতে কিন্তু আমার বেশ ভালোই লাগছে।
– তাতে আমার বয়েই গেছে। আপনি থাকেন আপনার ঝগড়া নিয়ে,আমি চললাম।
– আরে আরে কোথায় যাচ্ছেন? নামটা তো বলে যান।
– আমার নাম বলতে ঠেকা পরে নাই। বাই।

আজব মেয়েরে বাবা। জীবনে তো অনেক মেয়ে দেখেছি কিন্তু এমন সুন্দরী ঝগড়াটে মেয়ে দেখি নাই। আমিও বাসায় চলে আসলাম। সকালে কলেজ যাবার জন্য বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ পাশে তাঁকিয়ে দেখি নীলা।

– আরে মিস ঝগরাটে যে।
– এই এই আপনি আমাকে ঝগড়াটে বলছেন কেন।
– বাস চলে আসছে,চলেন বাসে উঠে কথা বলি।
– আমি আপনার সাথে একই বাসে যাবো না।
– না গেলে আপনারই ক্ষতি আমার কিছু হবে না। দেরি হলে আপনারই হবে।
– উঁহ, পাশে সরেন বাসে উঠতে দেন।

বাসে বসে নীলার সাথে অনেক কথা বললাম। কী করে,কোথায় থাকে,কে কে আছে। আমিও তার সাথে শেয়ার করলাম,সেও আমার সাথে শেয়ার করলো।তারপর নাম্বার আদান প্রদান,বন্ধুত্ব। এক সময় বন্ধুত্বটা গড়িয়ে ভালোবাসায় রূপ নিলো। এভাবেই আমার আর নীলার দিন যাচ্ছিল। একসময় আমার আর নীলার পরিবার আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিয়ে,আমাদের বিয়ে দিয়ে দিলো। তারপর থেকে দুষ্টু মিষ্টি ভালোবাসা দিয়ে আমাদের দিনকাল যাচ্ছে। আমাদের কোন কিছুর অভাব নেই। অভাব শুধু একটা বাবু’র। নীলা আর আমি সকালে নাস্তার টেবিলে বসে আছি। নীলা আমাকে খাইয়ে দিচ্ছে আর আমিও নীলাকে খাইয়ে দিচ্ছি। এই নিয়মটা শুরু থেকে হয়ে আসছে আমাদের ভিতরে এবং শেষ পর্যন্ত থাকবে।

– নীল,আমি আজকে কিছু মার্কেট করবো। তুমি অফিসে যাবার সময় আমাকে একটু শপিং মলে নামিয়ে দিয়ে যেও।
– এখন কেন? আগামীকাল আমার অফিস বন্ধ,আগামীকাল একসাথে যাবানি।
– না,আমি আজকে যাবো।
– আচ্ছা ঠিক আছে,চলো।

নীলাকে শপিং মলে নামিয়ে দিয়ে আমি অফিসে চলে গেলাম। আজ আমার অফিসের কাজে মন বসছে না। কেমন জানি লাগছে। অফিসের কাজ করছি এমন সময় আমার ফোন বেজে উঠলো। ফোন রিসিভ করলাম।

– হ্যালো,কে বলছেন?
– আপনি কি নীল চৌধুরী বলছেন?
– হ্যাঁ,কিন্তু আপনি কে?
– আমি ওসি মারুফ বলছি। আপনি একটু থানায় আসেন তো।
– কেন ওসি সাহেব কোন সমস্যা?
– হ্যাঁ,একটু সমস্যা আছে। আপনি থানায় আসেন তারপর বলছি। আমি অফিসের কাজ রেখে থানা চলে গেলাম। আমি ওসি সাহেবের রুমে ঢুকে ওসি সাহেবকে বললাম,,

– আমি নীল চৌধুরী। কী সমস্যা ওসি সাহেব?
– নীলা কি আপনার স্ত্রী?
– হ্যাঁ,কী হয়েছে নীলার?
– আপনার স্ত্রী আজ সকালে শপিং মল থেকে একটা বাচ্চা চুরি করেছে।
– কী যাতা বলছেন আপনি? আমার স্ত্রী কখনো এমন কাজ করতে পারে না।
– শান্ত হন নীল। আমরা প্রমাণ ছাড়া কারোর ওপর কখনো দোষারপ করি না।

আপনার স্ত্রী আজ শপিং করছিল তখন তার পাশে আারেকটা মহিলা তার দুই বছর এর একটা মেয়েকে নিয়ে শপিং করছিল। ঐ মহিলাটা তার বাচ্চার হাত ছেড়ে দিয়ে একটা শাড়ী দেখছিল ঠিক সেই সুযোগে আপার স্ত্রী ঐ বচ্চাটাকে কোলে নিয়ে শাড়ীর দোকান থেকে বেরিয়ে যায়। তারপর ঐ মহিলাটা তার বাচ্চাকে না দেখতে পেয়ে জোরে জোরে তার বাচ্চার নাম ধরে ডাকতে শুরু করে। তখন আশ পাশের লোক জড়ো হয়,তখন ঐ মিহিলা তার মোবাইল ফোন থেকে তার বাচ্চার ছবি সবাইকে দেখায়। সবাই ঐ ছবিটা দেখে আশে পাশে খুঁজতে থাকে। তখন শপিং মলের বাহিরে আপনার স্ত্রীকে ঐ বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে রিক্সায় উঠতে দেখে ফেলে একজন। এবং সাথে সাথে আপনার স্ত্রীকে ধরে আমাদের ফোন করে। আমরা যেয়ে আপনার স্ত্রীকে থানায় নিয়া আসি।

এই দেখেন,যে শাড়ীর দোকানটা থেকে আপনার স্ত্রী বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে যায় তার ভিডিও ফুটেজ। আমি ভিডিও ফুটেজটা দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। নীলা এমন কাজটা কী করে করতে পারলো। অবশ্য দোষটা আমরই,কারণ আমিই যে ওকে একটা বাবু এনে দিতে পারি নাই। আমি ওসি সাহেবকে সবকিছু খুলে বললাম। ওসি সাহেব ব্যপারটা বুঝতে পারলেন। নীলাকে ছেড়ে দিলো। আমি ওসি সাহেবের রুম থেকে বের হবার সময় ওসি সাহেব আমাকে পিছন থে ডাক দিল।

– জ্বী বলুন।
– আপনার স্ত্রীকে ভালো একজন মানুষিক ডাক্তার দেখান,যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমি শুধু হ্যাঁ সূচক মাথা নারিয়ে ওসি সাবের রুম থেকে চলে আসলাম।
– নীলা তুমি আজ এমন কাজটা করার আগে একবারও ভাবলে না,পরে কী হতে পারে?
– নীল আমি লোভ সামলাতে পারি নাই। আমি বেশ রাগের সাথে নীলাকে বললাম,,,

– তোমার যদি এতোই লোভ তাহলে আমাকে বলতে,আমি এতিম খানা থেকে তোমার জন্য একটা বাচ্চা এনে দিতাম। আর রোগটা তো আমার না,রোগটা হচ্ছে তোমার। যার এমন রোগ আছে তার বাবু নিয়ে স্বপ্ন দেখার কোন অধিকার নেই। নীলা আমার দিকে ছলছল চোখে তাঁকিয়ে বললো,,,,

– নীল স্বপ্ন দেখা দোষের কিছু না। আমি অফিসে কাজ করছি তখন আমার খুব কাছের বন্ধু সাগর আমাকে ফোন করে বললো,,,
– নীল আমি একটা ভালো ডাক্তার এর খোঁজ পেয়েছি। তুই ভাবিকে নিয়ে চলে আয়।
– ডাক্তার তো এতো বছর দেখিয়ে আসলাম,কোন ফল তো পলাম না। আর ডাক্তার দেখিয়ে লাভ নেই সাগর।
– আমার বিশ্বাস এই ডাক্তার ভাবিকে দেখালে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তুই বাহানা না করে ভাবিকে নিয়ে চলে আয়।
– আচ্ছা আমি আসতেছি।

ডাক্তার নীলাকে সব রকম টেস্ট করলো। আমাকেও কিছু টেস্ট করতে বললো।আমি নীলাকে বাসায় রেখে আসলাম,টেস্ট করার পরে। আমি রিপোর্টগুলো করিয়ে নিয়ে ডাক্তার এর চেম্বারে বসে আছি।

– নীল সাহেব,আমি আপনাকে কিছু ঔষধ লিখে দিচ্ছি আপনি ঠিকমতো খেলেই আশা করি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
– আমি খাবো মানে?
– সমস্যা যেহেতু আপনার সেহেতু ঔষধ তো আপনাকেই খেতে হবে।
– কিন্তু আমি যে এতদিন আমার স্ত্রীকে ডাক্তার দেখালম,আমি তো জানি সমস্যা আমার স্ত্রী’র।
– রিপোর্টগুলো দেখান তো আগের।
– এই যে আগের রিপোর্টগুলো।
– রিপোর্টে তো আপনার সমস্যর কথা লেখা আছে। আমি ডাক্তার এর কাছ থেকে বাসায় চলে আসলাম।

– নীলা চলো তো আগের সেই ডাক্তর এর কাছে।
– কেন,কী হয়েছে?
– সমস্যা আমার আর আগের ঐ ডাক্তার বললো,সমস্যা তোমার।
– আমি ঐ ডাক্তারকে বলতে নিষেধ করেছি সত্যটা বলতে।
– মানে,কী বলছো তুমি এই সব?
– হ্যাঁ,আমি যা বলছি ঠিকই বলছি। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি তোমার সমস্যার কথা বলে।
– উফফ নীলা,তুমি আমাকে আগে বললে তো আমি নিজেকে ডাক্তার দেখাতাম।
– লাভ হতো না,

কারণ আগের ডাক্তার বলেই দিয়েছে আমাকে,তমি আর কোন দিন বাবা হতে পারবে না। আমি তোমার কাছ থেকে কথাগুলো লুকিয়ে রাখতে রাখতে এতদিনে আমি পাগল হয়ে গেছি প্রায়। মাঝে মাঝে যখন কষ্টগুলো নিজের বুকে চেপে রাখতে খুব কষ্ট লাগতো,তখন তোমাকে বাবু এনে দিতে বলতাম। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিও নীল।

– তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছো কেন? ক্ষমা তো আমি তোমার কাছে চাইবো। কারণ তুমি যে এতদিন নিজের ভিতরে কষ্ট চেপে রেখেছো তা শুধু আমার জন্যেই। শেষের ডাক্তার দেখানোর পরে আজ আমাদের একটা ছেলে হয়েছে। তার নাম ‘মেঘ’।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত