মগবাজারের মোড়ে স্কুটার থেকে নেমে আমি পকেট থেকে তিনটা দশ টাকার নোট বের করে স্কুটার ড্রাইভারের হাতে দিলাম। ড্রাইভার নোট তিনটার দিকে একনজর দেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, পঁয়ত্রিশ টাকা ভাড়া।
আমি অবাক হয়ে বললাম, পঁয়ত্রিশ টাকা?
স্কুটার ড্রাইভার তার পান খাওয়া দাঁত বের করে একগাল হেসে বলল, জে। পঁয়ত্রিশ টাকা।
আপনি না ত্রিশ টাকায় রাজি হলেন?
ড্রাইভার তার মুখের হাসি আরো বিস্তৃত করে বলল, জে না। রাজি হই নাই।
সে কী! আমি রেগে উঠে বললাম, আপনি পঁয়ত্রিশ টাকা চেয়েছিলেন। আমি বললাম, ত্রিশ টাকায় যাবেন? আমার স্পষ্ট মনে আছে আপনি মাথা নাড়লেন।
স্কুটার ড্রাইভার ভুরু কুঁচকে বলল, মাথা নেড়েছিলাম?
হ্যাঁ।
স্কুটার ড্রাইভার মুখ গম্ভীর করে তার মাথাটা নেড়ে দেখিয়ে বলল, এইভাবে?
হ্যাঁ। এইভাবে।
ড্রাইভারের মুখের গাম্ভীর্য সরে সেখানে আবার মধুর হাসি ফুটে উঠল। সে তার সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বলল, সেটা অন্য ব্যাপার।
অন্য কী ব্যাপার?
গত রাতে বেকায়দা ঘুম গেছিলাম তাই ঘাড়ে ব্যথা।
ত্রিশ টাকা ভাড়ার সাথে ঘাড়ে ব্যথার কী সম্পর্ক বুঝতে না পেরে আমি অবাক হয়ে বললাম, ঘাড়ে ব্যথা?
জে। রগে টান পড়েছে। সকালবেলা গরম সরিষার তেলে রসুন দিয়ে মালিশ করেছি। একটু পরে পরে মাথা নাড়ি তখন ঘাড়ের এক্সারসাইজ হয়।
তার মানে তার মানে- আমি রেগে গিয়ে কথা শেষ করতে পারি না, কিন্তু স্কুটারওয়ালা একেবারেই বিচলিত হয় না। মুখে আরো মধুর হাসি ফুটিয়ে বলল, আমি মাথা নাড়লাম ঘাড় ব্যথার কারণে আর আপনি ভাবলেন ত্রিশ টাকায় রাজি হয়েছি। হা-হা-হা-
আমি হতবুদ্ধি হয়ে স্কুটারওয়ালার দিকে তাকিয়ে রইলাম-ত্রিশ টাকার জায়গায় পঁয়ত্রিশ টাকা ভাড়া দিতে আমার যে একেবারে জীবন চলে যাবে তা নয়, কিন্তু কেউ যে এরকম একটা অদ্ভুত কাণ্ড করতে পারে আমার বিশ্বাস হয় না। স্কুটারওয়ালা তার কেনে আঙুলটা কানে ঢুকিয়ে নির্মমভাবে কান চুলকাতে চুলকাতে বলল, আজকাল কি ত্রিশ টাকা স্কুটার ভাড়া আছে? নাই। চাক্কা ঘুরলেই চল্লিশ টাকা। আপনাকে দেখে মনে হল সোজাসিধে মানুষ, তাই মায়া করে বললাম পঁয়ত্রিশ টাকা
মায়া করে বলেছেন পঁয়ত্রিশ টাকা? আমার নাকি ব্লাড প্রেসার বেশি, ডাক্তার বলেছে রাস্তাঘাটে রাগারাগি না করতে-তাই অনেক কষ্ট করে মেজাজ ঠাণ্ডা রেখে বললাম, মায়া করে আর কী কী করেন আপনি?
আমার কথা শুনে মনে হল স্কুটার ড্রাইভারের মুখে একটা গভীর বেদনার ছাপ পড়ল। সে মাথা নেড়ে বলল, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না স্যার? আপনার মুখে একটা মাসুম মাসুম ভাব আছে-দেখলেই মায়া হয়। আমার কথা বিশ্বাস না করলে এই আপাকে জিজ্ঞেস করেন।
স্কুটার ড্রাইভার কোন আপার কথা বলছে দেখার জন্য মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম, আমাদের দুইজনের খুব কাছেই শাড়ি পরা একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে কিছুটা মোবাইল ফোন কিছুটা ক্যালকুলেটরের মতো একটা যন্ত্র। সেই মেয়েটি কিংবা মহিলাটি মনে হল খুব মনোযোগ দিয়ে আমার সাথে স্কুটার ড্রাইভারের কথাবার্তা শুনছে। ড্রাইভার তাকে সালিশ মানার পর সে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছে।
কী ঠিক বলেছে? ডাক্তারের কড়া নির্দেশ তাই আমি কিছুতেই গলার স্বর উঁচু করলাম না, আমার চেহারাটা মাসুম মাসুম সেইটা, নাকি আমার ওপরে মায়া করে সে স্কুটার ভাড়া বেশি নিচ্ছে সেইটা।
মেয়েটা আমার কথায় উত্তর না দিয়ে বলল, ইন্টারেস্টিং!
কী ইন্টারেস্টিং?
আপনি ভাব করছেন যে আপনি রাগেন নি-কিন্তু আসলে আপনি খুব রেগে গেছেন। পাঁচ টাকার জন্য মানুষ এত রাগ করতে পারে আমি জানতাম না।
আমি গলার স্বর একেবারে বরফের মতো ঠাণ্ডা করে বললাম, আপনি কেমন করে জানেন যে আমি রাগ করছি?
মেয়েটা কিছুটা মোবাইল ফোন কিছুটা ক্যালকুলেটরের মতো দেখতে যন্ত্রটা আমাকে দেখিয়ে বলল, আমার ভয়েস সিন্থেসাইজার বলে দিচ্ছে। আজকেই প্রথম ফিল্ড টেস্ট করতে বের করেছি। এক্সেলেন্ট কাজ করছে। এই দেখেন।
মেয়েটা কী বলছে বুঝতে না পেরে আমি হা করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটা উৎসাহ নিয়ে বলল, প্রত্যেকটা মানুষের ভোকাল কর্ডের কিছু ন্যাচারাল ফ্রিকোয়েন্সি থাকে। মানুষ যখন রেগে যায় তখন কয়েকটা ওভারটোন আসে। এই দেখেন আপনার মেগা ওভারটোন-যার অর্থ আপনি রেগে ফায়ার হয়ে আছেন।
একজন মানুষ বিশেষ করে একজন অপরিচিত মেয়েমানুষ যদি একটা যন্ত্র দিয়ে বের করে ফেলে আমি রেগে ফায়ার হয়ে আছি তখন রেগে থাকা ঠিক না-তাই আমি প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলাম মেজাজটাকে নরম করার জন্য। স্কুটার ড্রাইভার এই সময় আবার তাগাদা দিল, স্যার, ভাড়াটা দিয়ে দেন আমি যাই।
মানুষের মেজাজ কতটুকু গরম হয়েছে বের করে ফেলার আজব যন্ত্রটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি হাসি হাসি মুখে বলল, দিয়ে দেন। ড্রাইভার সত্যি কথাই বলছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কেমন করে জানেন?
মেয়েটা হাতে ধরে রাখা যন্ত্রটা উঁচু করে বলল, আমার ভয়েস সিন্থেসাইজারের ফিল্ড টেস্ট হচ্ছে। মিথ্যা কথা বললে হায়ার হারমনিক্স আসে। এই দেখেন ড্রাইভারের গলার স্বরে কোনো হায়ার হারমনিক্স নাই।
হায়ার হারমনিক্স কী, সেটা না থাকলে কেন মিথ্যা কথা বলা হয় না এই সব নিয়ে অনেক প্রশ্ন করা যেত কিন্তু আমার আর তার সাহস হল না। মানিব্যাগ থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে ড্রাইভারের দিকে এগিয়ে দিলাম। স্কুটারের ড্রাইভার উদাস উদাস ভাব করে বলল, ভাংতি নাই স্যার-ভাংতি দেন।
আমি কী বলতে কী বলে ফেলব আর এই আজব যন্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা সেখান থেকে কী বের করে ফেলবে সেই ভয়ে আমি হাত নেড়ে বললাম, ঠিক আছে পুরোটাই রেখে দেন।
ড্রাইভার অবাক হয়ে বলল, পুরোটাই রেখে দেব?
হ্যাঁ।
স্কুটার ড্রাইভার মুখে খুব অনিচ্ছার একটা ভঙ্গি করে টাকাটা পকেটে রেখে বলল, আপনি যখন বলছেনই তখন আর কী করা স্যার, রাখতেই হবে। আমি কিন্তু এমনিতে কখনোই এক পয়সা বেশি রাখি না। যত ভাড়া তার থেকে এক পয়সা বেশি নেওয়া হচ্ছে হারাম খাওয়া। হারাম খাওয়া ঠিক না হারাম খাওয়ার পর সেই হারাম রুজি দিয়ে শরীরের যে অংশে রক্ত-মাংস তৈরি হয় সেই অংশ দোজখের আগুনে পোড়ে শিক-কাবাবের মতো।
স্কুটার ড্রাইভার দোজখের আগুনের বর্ণনা দিতে দিতে তার স্কুটার স্টার্ট দিয়ে রাস্তায় নেমে গেল। ক্যালকুলেটর এবং মোবাইল ফোনের মতো দেখতে যন্ত্রটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি তার যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ চিৎকার করে বলল, এই যে হায়ার হারমনিক্স আসছে। তার মানে এই ব্যাটা মিথ্যা কথা বলেছে! স্কুটারওয়ালা-এই স্কুটারওয়ালা
কিন্তু ততক্ষণে স্কুটার ড্রাইভার তার স্কুটার নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে। মেয়েটা রাগ রাগ মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখছেন ব্যাটা ধড়িবাজের কাজটা? ডাটা প্রসেস করতে একটু সময় নেয় তার মাঝে হাওয়া হয়ে গেল। ব্যাটা ফাজিল-
আমি হাত নেড়ে বললাম, যাক। পাঁচ টাকাই তো
মেয়েটা হাত ঝাঁকিয়ে বলল, মিথ্যা কথা বলে পাঁচ টাকা কেন পাঁচ পয়সাও নিতে পারবে না।
আমি একটু ভয়ে ভয়ে মেয়েটার দিকে তাকালাম, রাগী মহিলাদের আমি খুব ভয় পাই। বিশেষ করে রাগী নারীবাদী মহিলারা খুব ডেঞ্জারাস হয়। ছাত্রজীবনে আমাদের সাথে ডালিয়া নামে একটা মেয়ে পড়ত, তাকে একবার ঢ্যালঢ্যালা ডালিয়া ডেকেছিলাম, সেটা শুনে তার নারীবাদী বান্ধবী আমাকে দেওয়ালে চেপে ধরে পেটে ঘুসি মেরেছিল। ঘুসি খেয়ে বেশি ব্যথা পাই নি কিন্তু পুরো প্রেস্টিজ ধসে গিয়েছিল। মেয়েদের হাতে মার খায় মানুষটা দেখতে কেমন তা দেখার জন্য আর্টস ফ্যাকাল্টি থেকে ছাত্রছাত্রীরা চলে আসত।
মেয়েটা তার যন্ত্রটির দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল- আমি চলে যাব না থাকব বুঝতে পারলাম না। কিছু একটা বলার দরকার কিন্তু কী বলব সেটাও বুঝতে পারলাম না। মানুষের সাথে মোটামুটি আমি কথাবার্তা চালিয়ে যেতে পারি কিন্তু মেয়েদের বেলায় খুব সমস্যা হয়। অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলার জন্য তার বয়সটা জানলে খুব সুবিধা হয় কিন্তু মেয়েদের বয়স আন্দাজ করা খুব কঠিন। একবার একটা পার্টিতে একটা মেয়ের থুতনি ধরে আদর করে বলেছিলাম, খুকি তুমি কোন ক্লাসে পড়? মেয়েটা ঝটকা মেরে আমার হাত সরিয়ে বলেছিল, ফাজলেমি করেন? আমি ইউনিভার্সিটির টিচার। শুনে আমার একেবারে হার্টফেল করার অবস্থা। একেবারে দুধের শিশুদের ইউনিভার্সিটির টিচার বানালে সেই ইউনিভার্সিটিতে কি পড়াশোনা হতে পারে? আরেকবার এক বাসায় গিয়ে মোটাসোটা এক ভদ্রমহিলাকে বললাম, আন্টি, আংকেল কি বাসায় আছেন? সেই ভদ্রমহিলা ভ্যা করে কেঁদে দিল, বলল, এ্যা এ্যা-আমি মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ি-আমাকে এই মানুষটা আন্টি ডাকে! এ্যা এ্যা এ্যা- সেই থেকে আমি কখনোই কোনো মেয়ের বয়স আন্দাজ করে বের করার চেষ্টা করি না। এখানেও এই মহিলার কিংবা মেয়ের বয়স কত অনুমান করার কোনো চেষ্টা না করে, শুধুমাত্র আলাপ চালানোর জন্য বললাম, খুব মজার যন্ত্র। তাই না?
মেয়েটা ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, হুঁ।
আমি গলার স্বরে একটা দার্শনিকতার ভাব এনে বললাম, বিজ্ঞানের কত উন্নতি হয়েছে-একটা যন্ত্র দিয়ে মনের অনুভূতি বের করে ফেলা যায়। কী আশ্চর্য!
মেয়েটা আবার বলল, হুঁ।
বিদেশ থেকে এনেছেন বুঝি যন্ত্রটা? কত খরচ পড়েছে?
মেয়েটা আমার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল, তারপর বুকে থাবা দিয়ে বলল, এইটা আমি তৈরি করেছি।
আমি চমকে উঠলাম, বলে কী মেয়েটা! আবার ভালো করে তাকালাম মেয়েটার দিকে, আমার সাথে ঠাট্টা করছে নাকি? মেয়েটার চোখে-মুখে অবিশ্যি ঠাট্টার কোনো চিহ্ন নেই- বলা যেতে পারে এক ধরনের রাগের চিহ্ন আছে। আমাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল, কী হল? আমার কথা বিশ্বাস হল না?
আমি তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বললাম, না-না বিশ্বাস হবে না কেন? অবশ্যই বিশ্বাস হয়েছে।
তা হলে এরকম চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছেন কেন?
চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছি নাকি? আমি চোখগুলো ছোট করার চেষ্টা করে এমন একটা ভান করার চেষ্টা করতে লাগলাম যেন রাস্তাঘাটে এরকম খ্যাপা টাইপের একটা মেয়ে যে নাকি ভয়ংকর যন্ত্রপাতি তৈরি করে তার সাথে দেখা হওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।
মেয়েটা বলল, হ্যাঁ, আপনি চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছেন। আপনি মনে মনে কী ভাবছেন সেটাও আমি জানি।
কী ভাবছি?
আপনি ভাবছেন এই মেয়েটা নিশ্চয়ই মিথ্যে কথা বলছে। মেয়েরা কি আবার কখনো সায়েন্টিস্ট হতে পারে? সায়েন্টিস্ট হবে ছেলেরা। তাদের মাথায় হবে উসকোখুসকো চুল, তাদের থাকবে কাঁচা-পাকা বড় বড় গোঁফ। তারা হবে আপনভোলা। তাদের চোখে থাকবে বড় বড় চশমা, তারা ঠিকমতো নাওয়া-খাওয়া করবে না, ভুশভুশে কাপড় পরে উদাস উদাস চোখে তারা ঘুরে বেড়াবে। ঠিক বলেছি কি না?
আমি বললাম, না, মানে ইয়ে-বলছিলাম কী-মানে ইয়ে
ঠিক তখন পাশে একটা শোরগোল শুরু হল, দেখলাম একজন লিকলিকে শুকনো মানুষ একজন ইয়া মুশকো জোয়ান মানুষের কলার ধরে রিকশা থেকে টেনে নামিয়ে আনছে, দুইজনই চিৎকার করে হাত-পা নাড়ছে যেন পারলে একজন আরেকজনকে খুন করে ফেলবে। খ্যাপা টাইপের মেয়েটি তার হাতের যন্ত্রটি সেদিকে উঁচু করে ধরল এবং আমি দেখতে পেলাম শোরগোল শুনে মেয়েটির চোখ উত্তেজনায় চকচক করতে শুরু করেছে। তার ভেতরে সে আমার দিকে আঙুল তুলে বলল, কিন্তু আপনি ভুল। ভুল ভুল ভুল। ছেলেরা যে কাজ পারে মেয়েরাও সেই কাজ পারে। বরং আরো ভালো করে পারে। মেয়েরা প্রাইম মিনিস্টার হতে পারে, ডাকাতও হতে পারে। মেয়েরা হাউজ ওয়াইফ হতে পারে আবার পকেটমারও হতে পারে। ডাক্তারও হতে পারে মার্ডারারও হতে পারে। এস্ট্রোনট হতে পারে, সন্ত্রাসীও হতে পারে। মেয়েরা স্টুপিড হতে পারে আবার সায়েন্টিস্টও হতে পারে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে নিজের চোখে দেখেন
বলে মেয়েটা তার ব্যাগের ভেতর থেকে একটা কার্ড বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আবার তার যন্ত্রের দিকে তাকাল। পাশে শোরগোল তখন আরো জমে উঠেছে, মানুষ দুইজন তখন হাতাহাতি প্রায় শুরু করে দিয়েছে, তাদের ঘিরে বেশ একটা ভিড় জমে উঠেছে। মেয়েটা তার মাঝে ঠেলেঠুলে তার যন্ত্র নিয়ে ঢুকে গেল, মনে হয় যখন কেউ মারামারি শুরু করে তখন তাদের গলার স্বরে কী রকম ওভারটোন হয় সেটা ফিল্ড টেস্ট করতে চায়।
মানুষের ভিড়ের সাথে মিশে গিয়ে মেয়েটা যখন চলে গেল তখন আমি তার কার্ডটার দিকে তাকালাম। ভেবেছিলাম সেখানে তার নাম ঠিকানা টেলিফোন এইসব থাকবে কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখলাম সেখানে কিছু ইংরেজি অক্ষর লেখা। অনেকগুলো ডাব্লিউ, অনেকগুলো ফুলস্টপ এবং পড়তে গেলে দাঁত ভেঙে যাবার অবস্থা। এটা কি কোনো সাংকেতিক নাম-ঠিকানা আমার যেটা রহস্যভেদ করতে হবে? মেয়েটা কি আমার বুদ্ধি পরীক্ষা করে দেখতে চাইছে? আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। কী করব বুঝতে না পেরে আমি কার্ডটা আমার পকেটে রেখে দিলাম।
.
আমার যখন টাকাপয়সা নিয়ে কোনো সমস্যা হয় তখন আমি আমার অর্থনীতিবিদ এক বন্ধুর সাথে কথা বলি, যখন রোগশোকের কোনো ব্যাপার হয় তখন কথা বলি এক ডাক্তার বন্ধুর সাথে, রান্নাবান্না এবং খাওয়াদাওয়া নিয়ে কথা বলতে হলে আমি আমার ছোট খালার সাথে কথা বলি, ধর্ম নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে আমি রাজাকার টাইপের এক মৌলবাদী বন্ধুকে ফোন করি (সে যেটা বলে ধরে নেই তার উল্টোটা হচ্ছে সত্যি) এবং বুদ্ধি সংক্রান্ত কোনো ব্যাপার থাকলে আমি আমার ভাগ্নে বিল্টুর সাথে কথা বলি। আজকালকার যে কোনো বাচ্চার বুদ্ধি আমাদের থেকে অনেক বেশি আর বিল্টু তাদের মাঝেও এককাঠি সরেস। আমার অ্যাপার্টমেন্টে এসে একবার দেখে বাথরুমে সিংক থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে। সে চোখের পলকে মুখ থেকে চিউয়িংগাম বের করে সিংকের ফুটো সেরে দিয়েছিল। দুটো কাগজ ক্লিপ করার জন্য স্ট্যাপলার খুঁজে পাচ্ছি না, সে চিউয়িংগাম দিয়ে দুটো কাগজ লাগিয়ে দিল। একবার তার সমবয়সি একজনের সাথে ঝগড়া হয়েছে তখন পিছন থেকে বিল্টু তার চুলে চিউয়িংগাম লাগিয়ে দিল। চাদির কাছাকাছি প্রায় ছয় ইঞ্চি জায়গা কামিয়ে সেই চিউয়িংগাম সরাতে হয়েছিল। শুধুমাত্র চিউয়িংগাম দিয়েই সে এত কাজ করতে পারে পৃথিবীর অন্য সব জিনিসের কথা ছেড়েই দিলাম। এখন তার বয়স বারো। যখন সে বড় হবে তখন কী কী করবে চিন্তা করেই আমি মাঝে মাঝে আনন্দে এবং বেশিরভাগ সময়ে আতঙ্কে শিউরে শিউরে উঠি।
কাজেই মগবাজারের মোড়ে সেই খ্যাপা মহিলার দেওয়া কার্ডটির কোনো মর্ম উদ্ধার করতে না পেরে আমি একদিন বিল্টুর কাছে হাজির হলাম। সে একটা কম্পিউটারের সামনে বসে বসে কী একটা টাইপ করছে এবং মুচকি মুচকি হাসছে। বিল্টু যখন মুচকি মুচকি হাসে তখন আমি খুব ভয় পাই। তাই ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী রে বিল্টু? তুই এরকম ফ্যাকফ্যাক করে হাসছিস কেন?
আরাফাতের কাছে একটা ভাইরাস পাঠালাম। এক নম্বরি ভাইরাস- হার্ড ড্রাইভ ক্র্যাশ করে দিবে।
সে কী বলছে তার কোনো মাথামুণ্ডু আমি বুঝতে পারলাম না। শুধুমাত্র তার মুখের হাসিটি দেখে বুঝতে পারলাম কাজটা ভালো হতে পারে না। তাই মুখে মামাসুলভ একটা গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বললাম, কাজটা ঠিক হল না।
বিল্টু আমার দিকে না তাকিয়ে কম্পিউটারে কিছু একটা টাইপ করতে করতে বলল, তুমি এসব বুঝবে না মামা।
কেন বুঝব না? আমাকে কি গাধা পেয়েছিস নাকি?
বিল্টু আমার কথার উত্তর না দিয়ে কম্পিউটারে টাইপ করতে লাগল, ইঙ্গিতটা খুব স্পষ্ট আমাকে সে গাধাই মনে করে। আমি তাকে আর না ঘাঁটিয়ে পকেট থেকে সেই কার্ডটা বের করে তাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এইটা কী জানিস?
বিল্টু কম্পিউটারে টাইপ করতে করতে চোখের কোনা দিয়ে একবার কার্ডটার দিকে তাকাল, কিন্তু কোনো কথা বলল না। আমি একটু অধৈর্য হয়ে বললাম, কী হল? কিছু বলছিস না কেন?
বিল্টু তবুও কথার উত্তর না দিয়ে কম্পিউটারে খুটখাট করতে থাকে এই যন্ত্রটা মনে হয় আসলেই শয়তানের বাক্স। বিল্টু ছেলেটা দুষ্টু এবং পাজি ছিল কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে দুষ্ট, পাজি এবং বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে। আমি তার মেজো মামা-তাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, সে সেই কথাটার উত্তর পর্যন্ত দিচ্ছে না। কানে ধরে একটা রদ্দা দিলে মনে হয় সিধে হয়ে যাবে। কিন্তু আজকালকার ছেলেমেয়েদের কানে ধরে রদ্দা দেওয়া যায় না। আমি নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, কী হল? কথা কানে যায় না? একটা জিনিস জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দিবি না?
বিল্টু তার কম্পিউটারে খুটখাট বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মামা, তুমি যে জিনিসটা জিজ্ঞেস করেছ তার উত্তর দিলে তুমি বুঝবে না।
আমি বুঝব না?
বিল্টু মাথা নাড়ল, না। তুমি কিছু জান না, বোঝ না-শুধু ভান কর যে সবকিছু জান আর বোঝ।
আমি রেগে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, বিল্টু তার সুযোগ দিল না, বলল, তোমার কার্ডে যেটা লেখা আছে সেটা হচ্ছে একটা ইন্টারনেট ওয়েবসাইটের ইউ. আর. এল। তুমি কিছু বুঝলে?
আমি আমতা-আমতা করে বললাম, না, মানে ইয়ে
তার মানে তুমি বোঝ নাই।
তাই বলে তুই বলবি না?
আমি ভাবছিলাম তোমাকে দেখিয়ে দিই।
কীভাবে দেখাবি?
সেটাও তুমি বুঝবে না। তার চাইতে তুমি মেজাজ গরম না করে দাঁড়িয়ে থাক- এক্ষুনি কম্পিউটারে এসে যাবে।
ক-কম্পিউটারে এসে যাবে? আমি অবাক হয়ে বললাম, কোথা থেকে আসবে? কেমন করে আসবে?
বিল্টু হতাশভাবে মাথা নাড়ল, বলল, তুমি বুঝবে না মামা, শুধু শুধু চেষ্টা করে লাভ নাই।
কম্পিউটারে হঠাৎ করে কিছু ছবি চলে এল আমি অবাক হয়ে দেখলাম একটি ছবি হচ্ছে সেই খ্যাপা মেয়েটির, বিদঘুটে একটা যন্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, এখানে কোথা থেকে এল এই মেয়ে? কী আশ্চর্য!
বিল্টু গম্ভীর হয়ে বলল, মামা তুমি পরে আশ্চর্য হয়ো। এখন যেটা দেখার দেখে নাও। গত মাসে আমার ইন্টারনেট বিল কত হয়েছিল জান?
ইলেকট্রিক বিল, টেলিফোন বিলের কথা শুনেছি কিন্তু ইন্টারনেট বিল আবার কী জিনিস? কম্পিউটারে আরো ছবি আর লেখা বের হতে থাকে। কোনটা ছেড়ে কোনটা পড়ব বুঝতে পারছি না। বিল্টু বলল, তাড়াতাড়ি মামা। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, তাড়াতাড়ি করাবি না তো? আমি তাড়াতাড়ি কিছু করতে পারি না।
সেটা আমি জানি। তুমি হচ্ছ আমাদের ঢিলেঢালা মামা।
ফাজলেমি করবি না।
তার চাইতে বলো তুমি কী চাও আমি বের করে দিই।
আমি বিদঘুটে যন্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখিয়ে বললাম, এই যে দেখছিস মেয়েটা এই মেয়ে হচ্ছে একজন খ্যাপা সায়েন্টিস এই মেয়ের নাম ঠিকানা টেলিফোন নাম্বারটা দরকার।
সেটা আগে বলবে তো! বিল্টু তার কম্পিউটারে খুটখাট করতে করতে বলল, তুমি হচ্ছ পুরান মডেলের মানুষ-সেই জন্য তোমার নাম-ঠিকানা দরকার! আজকাল মানুষ আর নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে না।
তা হলে কী ব্যবহার করে?
ই-মেইল।
আমি হাত ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, আমার ই-মেইল উ-মেইলের দরকার নেই- আমার দরকার নাম-ঠিকানা।
ঠিক আছে বাবা ঠিক আছে– বলে বিল্টু একটা কাগজে কিছু একটা লিখে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এই যে তোমার নাম-ঠিকানা। তুমি এখন বিদায় হও মামা। তুমি বড় ডিস্টার্ব কর।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন মামাদের পিছনে ঘোরাঘুরি করতাম। তারা মাঝে মাঝে ধমক দিয়ে বলতেন, ভাগ এখান থেকে, ডিস্টার্ব করবি না। এখন আমার ভাগ্নে আমাকে বলে তাকে ডিস্টার্ব না করতে! আস্তে আস্তে দুনিয়াটা কী হয়ে যাচ্ছে?
.
বাসাটা খুঁজে বের করতে আমার কালো ঘাম ছুটে গেল, যারা বাসার নম্বর দেয় তারা নিশ্চয়ই গুনতে জানে না। গুনতে জানলে কি কখনো বাহাত্তরের পর ছেচল্লিশ তারপর ঊনআশি হতে পারে? বাসাটা কিছুতেই খুঁজে না পেয়ে মোড়ের পান-সিগারেটের দোকানে জিজ্ঞেস করলাম, মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম কোনো লাভ হবে না কিন্তু দেখলাম কমবয়সি দোকানদার একবারেই চিনে ফেলল, চোখ বড় বড় করে বলল, ও সায়রা সাইন্টিস্টের বাসা?
আমি অবাক হয়ে বললাম, সায়রা সায়েন্টিস্ট?
ও! আপনি জানেন না বুঝি? মানুষটা তার সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বলল, আপা হচ্ছেন ওস্তাদ মানুষ। কালা ছগীরকে একদিন কী টাইট না দিলেন!
টাইট?
জে। মানুষটা উৎসাহ নিয়ে বলতে শুরু করল, আপার এই রকম একটা যন্ত্র আছে, দেখে মনে হয় মোবাইল টেলিফোন। সেই যন্ত্রে টিপি দিলেই ইলেকটিরিক বের হয়। কালা ছগীর বুঝে নাই, নেশা করবে টাকা নাই, আপার ব্যাগে ধরে দিছে টান।
তারপর?
আপা বলছে খামোস! তারপর যন্ত্রে দিছে টিপি। ইলেকটিরিক দিয়ে কালা ছগীরের জান শেষ। খালি কাটা মুরগির মতো তড়পায়- দৃশ্যটা চিন্তা করে মানুষটা আনন্দে হাসতে থাকে।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, সেই আপার বাসাটা কোথায়?
সোজা চলে যান, তিন বাসা পরে হাতের ডানদিকে দোতলা বাসা, সবুজ রঙের গেইট। মানুষটা একটা চোখ ছোট করে বলল, তয় একটা জিনিস সাবধান।
কী জিনিস?
আপার সাথে কুনু দুই নম্বুরি কাজ করার চেষ্টা করবেন না। করলে কিন্তু মানুষটা হাত দিয়ে গলায় পোঁচ দেবার মতো ভঙ্গি করে বুঝিয়ে দিল আপা আমাকে খুন করে ফেলবে।
আমি বললাম, না, করব না। কোন এক নম্বুরি কাজ করারই সাহস পাই না, দুই নম্বুরি কাজ করব কেমন করে-তাও সাধারণ একজন মানুষের সাথে না, খ্যাপা একজন বিজ্ঞানীর সাথে? যে শুধু বিজ্ঞানী না, মহিলা বিজ্ঞানী এবং যে যন্ত্রে টিপ দিয়ে কালা ছগীরকে পর্যন্ত কাবু করে ফেলে!
এবারে বাসাটা খুঁজে পেতে কোনো সমস্যা হল না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেল টিপে দিলাম, মনে হল ভেতরে কোথাও একটা বিচিত্র শব্দ হল। আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করি, চাপা একটা ভুটভট শব্দ হচ্ছে, কিসের শব্দ বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ করে একটা বিকট শব্দ হল এবং সাথে সাথে একটা মেয়ের গলা শুনতে পেলাম, মনে হল রেগে গিয়ে কাউকে বকাবকি করছে। আমি ইতস্তত করে আবার বেলে চাপ দিতেই খুট করে দরজা খুলে গেল, কালিঝুলি মাখা একটি মাথা উঁকি দিয়ে আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল।
মগবাজারের মোড়ের সেই মেয়েটিই, তবে তাকে দেখতে এখন সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগছে। সেদিন শাড়ি পরেছিল, আজকে পুরুষ মানুষের মতো একটা ওভারওল পরেছে। তার অনেকগুলো পকেট আর সেই পকেট থেকে নানা সাইজের ক্রু ড্রাইভার, প্লয়ার্স, রুলার, পেন্সিল, ফ্ল্যাশলাইট, সন্ডারিং আয়রন এইসব বের হয়ে আছে। কোমরে বেল্ট, সেই বেন্ট থেকে একটা বড় হাতুড়ি ঝুলছে। মেয়েটির মাথায় টকটকে লাল রঙের একটা রুমাল বাধা, শুধুমাত্র সেটা থাকার কারণেই তাকে দেখতে একটা মেয়ের মতো লাগছে, ঠিক করে বললে বলতে হয় একটা জিপসি মেয়ের মতো। আমি মেয়েটির কালিঝুলি মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে আমতা-আমতা করে বললাম, আমাকে চিনতে পারছেন? আমি মানে ইয়ে-ঐ যে সেদিন মগবাজারে
মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, চিনেছি–আসেন, ভেতরে আসেন। আমি তখনই বুঝেছিলাম আপনি আসবেন।
কেমন করে বুঝেছিলেন?
আপনার চোখ দেখে। আপনার চোখে ছিল অবিশ্বাস। আপনি ভেবেছিলেন আমি মিথ্যে কথা বলছি। তাই আপনি নিজের চোখে দেখতে চেয়েছিলেন। ঠিক বলেছি কি না?
আমি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললাম না-না-না। আপনি একেবারেই ঠিক বলেন নি। আমি আপনাকে কখনোই অবিশ্বাস করি নি। আসলে ইয়ে মানে সত্যি কথা বলতে কি-
ঠিক তখন ভিতরে আবার ভুশ করে একটা শব্দ হল এবং আমার মনে হল সারা ঘরে ডালে ফোড়ন দেওয়ার মতো একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। সায়রা মাথা নেড়ে কেমন যেন হতাশ হবার ভঙ্গি করে পা দিয়ে মেঝেতে একটা লাথি দিল। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, কী হয়েছে?
আমার যন্ত্রটার সেফটি ভাল্ব কাজ করছে না, একটু প্রেসার বিল্ড আপ করলেই লিক করছে। গন্ধ পাচ্ছেন না?
আমি মাথা নাড়লাম, ইতস্তত করে বললাম, কিন্তু গন্ধটা তো কেমন যেন ডালে ফোড়ন দেওয়ার মতো-
হ্যাঁ, এটা ডাল রান্না করার মেশিন।
ডাল রান্না করার মেশিন? আমি অবাক হয়ে বললাম, ডাল রান্না করতে মেশিন লাগে?
ব্যবহার করলেই লাগে। সায়রা কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এবারে লেকচার শুরু করে দেন-মেয়েরা কিছু পারে না, তাদের চিন্তাভাবনা রান্নাঘরের বাইরে যেতে পারে না-হ্যাঁনো তেনো
আমি হাত নেড়ে বললাম, না না, এটা আপনি কী বলছেন! আমি সেটা কেন বলব? তবে_
তবে কী?
এত জিনিস থাকতে আপনার ডাল রাঁধার মেশিন তৈরি করার আইডিয়া কেমন করে হল?
সেটা আপনারা বুঝবেন না।
চেষ্টা করে দেখেন, বুঝতেও তো পারি।
আপনারা-পুরুষ মানুষেরা মেয়েদেরকে রান্নাঘরে আটকে রাখতে চান। ভাত রাঁধ, ডাল রাধ, মাছ মাংস সবজি রাঁধ-আপনাদের ধারণা রান্নাবান্না করাই আমাদের একমাত্র কাজ। সেজন্য আমি রান্না করার মেশিন তৈরি করছি।
রান্না করার মেশিন?
হ্যাঁ। ডাল দিয়ে শুরু করেছি। আস্তে আস্তে সবকিছু হবে। সকালে উঠে সুইচ টিপে দেবেন, দুপুর বেলা সবকিছু রান্না হয়ে যাবে। ভাত ডাল মাছ মাংস। মেয়েদের তখন। রান্নাঘরে আটকা থাকতে হবে না।
আমি মাথা চুলকালাম, যুক্তিটার মাঝে কিছু গোলমাল আছে মনে হল কিন্তু এখন সেটা নিয়ে কথা বলা মনে হয় ঠিক হবে না। আমি ইতস্তত করে বললাম, আমি আসলে এসেছিলাম
সায়রা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, কী বলছিলেন যেন?
আসলে ইন্টারেস্টিং মানুষ দেখতে, তাদের সাথে কথা বলতে আমার খুব ভালো লাগে। পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ হচ্ছে বোরিং। খায়-দায়, চাকরি করে আর ঘুমায়।
আমি ইন্টারেস্টিং?
অবিশ্যি। ডাল রান্না করার মেশিন আবিষ্কার করছে সেরকম মানুষ বাংলাদেশে কতজন আছে?
সায়রা মুখটা গম্ভীর করে বলল, আমি ভেবেছিলাম কাজটা সহজ হবে। কিন্তু আসলে মহা কঠিন। টেম্পারেচার ঠিক হওয়ার আগে যদি ডাল ঢেলে দেওয়া হয়- কথা শেষ হবার আগেই আবার ভুশ করে একটা শব্দ হল এবং এবারে সাথে সাথে সারা ঘরে একটা পোড়া ডালের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। সায়রা মাথা নেড়ে বলল, একটু দাঁড়ান। মেশিনটা বন্ধ করে দিয়ে আসি।
আমি আসি আপনার সাথে?
আসবেন? আসেন।
আমি সায়রার পিছু পিছু গেলাম, বড় একটা ঘরের মাঝামাঝি বিশাল একটা যন্ত্র। নানারকম পাইপ বের হয়ে আছে। মাঝখানে নানারকম আলো জ্বলছে এবং নিবছে। স্বচ্ছ একটা জায়গায় হলুদ রঙের কিছু একটা ভুটভাট করে ফুটছে। একপাশে একটা টিউব দিয়ে কালো ধোঁয়ার মতো কিছু একটা বের হচ্ছে। সায়রা কোথায় টিপে ধরতেই নানা রকম শব্দ করে যন্ত্রটা থেমে গেল এবং ঘরের মাঝে এক ধরনের নৈঃশব্দ্য নেমে এল। ঠিক তখন মনে হল কে যেন খিকখিক করে হাসছে। সায়রা পিছনে ফিরে ধমক দিয়ে বলল, খবরদার হাসবি না এরকম করে। সাথে সাথে হাসির শব্দ থেমে গেল। আমি মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালাম, কেউ নেই ঘরে, কার সাথে বলছে মেয়েটি?
আমি সায়রার দিকে তাকিয়ে বললাম কার সাথে কথা বলছেন?
সায়রা মনে হল আমার প্রশ্নের ঠিক উত্তর দিতে চাইছিল না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইতস্তত করে বলল, জরিনির সাথে।
জরিনি? জরিনি কে?
ইঁদুর। ঐ যে দেখেন
আমি পিছনে তাকিয়ে দেখি একটি ছোট খাঁচা এবং সেখানে একটা ছোট নেংটি ইঁদুর ঠিক মানুষের মতো দুই হাত বুকে ভাজ করে দুই পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। কানে দুল এবং গলায় মালা। শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে হল ইঁদুরটার মুখে ফিচলে এক ধরনের হাসি। আমি অবাক হয়ে জরিনির দিকে তাকিয়ে বললাম, এই ইঁদুরটা হাসছিল? ইঁদুর মানুষের মতো হাসতে পারে?
পারে না। জরিনি মাথা নাড়ল, ইঁদুরের ভোকাল কর্ড ছোট, শব্দ বের হয় অন্যরকম।
কিন্তু আমি যে হাসতে শুনলাম?
হাসির শব্দ টেপ করা আছে। যখন হাসার ইচ্ছে করে তখন সুইচ টিপে দেয়। বেটি মহা ফাজিল হয়েছে। যখনই আমার কিছু একটা গোলমাল হয় তখন ফ্যাকফ্যাক করে হাসে।
আমি অবাক হয়ে সায়রার দিকে তাকালাম, কী বলছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ করে মনে হতে থাকে মেয়েটার হয়তো একটু মাথা খারাপ। সায়রা আমার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা দেখে বলল, আমার কথা বিশ্বাস করলেন না?
আমি বললাম, মানুষ একটা জিনিস বিশ্বাস করে কিংবা অবিশ্বাস করে কথাটা বোঝার পর। আপনি কী বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
সায়রা মাথা নাড়ল, বলল, বোঝার কথা না!
একটু বুঝিয়ে দেন।
সায়রা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আবার কাউকে বলে দেবেন না তো?
আপনি না করলে বলব না। কিন্তু মানুষকে বলার জন্য এর চাইতে মজার গল্প আর কী হতে পারে?
যত মজারই হোক আপনি কাউকে বলবেন না।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ঠিক আছে বলব না।
সায়রা ইঁদুরটার দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে ইঁদুরটা দেখছেন, এটার আই কিউ একশ বিশের কাছাকাছি। যার অর্থ এর বুদ্ধি আমাদের দেশের মন্ত্রীদের থেকে বেশি। আপনি বলতে পারেন সেটা খুব বেশি না-কিন্তু একটা ইঁদুরের জন্য সেটা অনেক। এটা অনেক শব্দ বুঝতে পারে কথা বলতে পারে না কিন্তু সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে মোটামুটি বুঝিয়ে দিতে পারে। আমি মোটামুটি কিছু শব্দ তৈরি করে মাইক্রো সুইচে সাজিয়ে দেব বলে ঠিক করেছিলাম কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হবে না।
কেন?
ছেমড়ি মহা ফাজিল। খাবার দিতে একটু দেরি হলেই ধমকাধমকি শুরু করে দেয়!
আমি ঢোক গিলে বললাম, তাজ্জবের ব্যাপার। কোথায় পেলেন এই চিজ?
সায়রা আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, পাব আবার কোথায়? আমি তৈরি করেছি।
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম তৈরি করেছেন? ইঁদুর তৈরি করা যায়?
ইঁদুর তৈরি করি নি। ইঁদুর তো ইঁদুরই-সেটা আবার তৈরি করে কেমন করে! এর বুদ্ধিটা তৈরি করেছি।
আমি মাথা চুলকে বললাম, কেমন করে তৈরি করলেন?
সেটা অনেক লম্বা ইতিহাস। সায়রা সেই ইতিহাসের সমান লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বলতে পারেন, এটা হচ্ছে দ্রুত এবং নিয়ন্ত্রিত বিবর্তন। বিবর্তন কী জানেন তো?
আমি মাথা চুলকে বললাম, একটু একটু জানি।
একটু জানলেই হবে। পৃথিবীর যত প্রাণী আছে, যত জীবজন্তু আছে সবার মিউটেশন হয়। নানা কারণে সেই মিউটেশন হতে পারে-রেডিয়েশন, এনভায়রনমেন্ট বা অন্যান্য ব্যাপার। সেই মিউটেশনের কারণে কোনো কোনো প্রাণী হয় ভালো-কোনো কোনোটা হয় খারাপ। যেটা খারাপ হয় সেটা টিকে থাকতে পারে না-যেটা ভালো সেটা পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে টিকে থাকতে পারে। এভাবে বিবর্তন এগিয়ে যায়-ধীরে ধীরে জীবজন্তু পরিবর্তন হয়। সেটা হতে লক্ষ বছর লেগে যায়।
সায়রা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি এই বিবর্তনের ব্যাপারটার মাঝে দুটো জিনিস করেছি। এক : মিউটেশনের জন্য প্রকৃতির ওপর নির্ভর না করে হালকা ডোজ রেডিয়েশন দেওয়া শুরু করেছি এবং দুই : বেছে বেছে যারা সুপিরিয়র তাদের রিপ্রোডিউস করেছি। রেডিয়েশনের জন্য একটা খুব হালকা সিজিয়াম ওয়ান থার্টি এইট সোর্স ব্যবহার করেছি। সায়রা থেমে গিয়ে বলল, কাউকে বলে দেবেন না যেন!
আমি বললাম, সেটা নিয়ে আপনি চিন্তা প্রবেন না-কী বলছেন সেটার মাথামুণ্ডু আমি কিছু বুঝি নি। সিজি আম আর ফজলি আমের মাঝে কী পার্থক্য সেটাও আমি জানি না।
সায়রা বিজ্ঞানীদের খুঁতখুঁতে স্বভাবের কারণে বিরক্ত হয়ে বলল, এটা কোনো আম না। এটা হচ্ছে এক ধরনের এলিমেন্ট। সিজিয়াম। আর সিজিয়াম ওয়ান পার্টি এইট হচ্ছে রেডিও একটিভ এলিমেন্ট। যাই হোক যেটা বলছিলাম, রেডিয়েশন দিয়ে মিউটেশন করে আমি অনেকগুলো ইঁদুরের বাচ্চা দিয়ে কাজ শুরু করলাম। সবগুলোকে একটা খাঁচায় রেখে তাদের একটা বুদ্ধির পরীক্ষার মাঝে ফেলে দিলাম। যে ইঁদুর একটা ছোট বলকে ঠেলে একটা গোল গর্তের মাঝে ফেলতে পারবে সে ভালো খাবার পাবে। বেশিরভাগই বুদ্ধির পরীক্ষায় ফেল করল-যারা পাস করল তাদের নিয়ে ইঁদুরের সংসার শুরু হল। আবার লো ডোজ রেডিয়েশন, আবার বাচ্চাকাচ্চা এবং বাচ্চাকাচ্চার ওপর আবার নতুন করে বুদ্ধির পরীক্ষা, এবার পরীক্ষা আগের থেকেও কঠিন। ছোট একটা ত্রিভুজকে তিনকোনা একটা গর্তে ফেলতে হবে আর ছোট একটা চতুর্ভুজকে চারকোনা একটি গর্তে ফেলতে হবে।
সায়রা নিশ্বাস নেবার জন্য একটু থামতেই আমি বললাম, ইঁদুরে ত্রিভুজ চতুর্ভুজ বুঝতে পারে? আমিই তো পারি না।
সায়রা গলা নামিয়ে বলল, আস্তে আস্তে বলেন। জরিনি বেটি শুনতে পেলে দেমাগে মাটিতে পা পড়বে না! যাই হোক যেটা বলছিলাম, বুদ্ধির পরীক্ষায় এবারে যেগুলো পাস করল আবার সেগুলোকে নিয়ে নতুন ইঁদুরের সংসার! আবার তাদেরকে নতুন রেডিয়েশন ডোজ-নতুন মিউটেশন নতুন বুদ্ধির পরীক্ষা! বুঝতে পেরেছেন?
যারা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনে তারা বিশ্বাস নাও করতে পারে কিন্তু আমি সত্যি সত্যি টেকনিকটা বুঝে গেলাম। চোখ বড় বড় করে বললাম, এভাবে অনেকবার করে ইঁদুরদের আইনস্টাইনকে বের করে ফেলেছেন?
মেয়েটি ফিক করে হেসে বলল, বলতে পারেন ইঁদুরদের আইনস্টাইন। শুধু একটা সমস্যা
কী সমস্যা?
বুদ্ধির পরীক্ষা যখন কঠিন থেকে কঠিন হতে লাগল তখন পরীক্ষায় পাস করতে লাগল অল্প অল্প ইঁদুর। সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষায় পাস করেছে মাত্র একটা ইঁদুরী।
ইঁদুরী?
হ্যাঁ। মানে মেয়ে ইঁদুর। তার সাথে সংসার করবে সেরকম বুদ্ধিমান ছেলে ইঁদুর আর পাওয়া যাচ্ছে না। কাজেই আমি আর আগাতে পারছি না। একটা মেয়ে ইঁদুরী নিয়ে বসে আছি। সেই ইঁদুরী মহা ফাজিল, আমার সাথে এমন সব কাণ্ড করে সেটা আর বলার মতো নয়!
কী কাণ্ড করে সেটা না বলে মেয়েটা খুব একটা হতাশার ভঙ্গি করে মাথা নাড়তে লাগল। আমি এবারে ইঁদুরের খাঁচাটার দিকে এগিয়ে গেলাম, ছোট একটা নেংটি ইঁদুর দুই হাত বুকে ভাজ করে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখে তড়াক করে ভেতরে ঢুকে গেল। সেখানে ছোট একটা ঘরের মতো, তার দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে টুক করে লাইট জ্বালিয়ে দিল। একটু পরে শুনলাম ভিতর থেকে একটা হিন্দি গানের সুর ভেসে আসছে, লটপট লটপট সাইয়া সাইয়া কাহা…।
সায়রা আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, আপনাকে নতুন মানুষ দেখেছে তো তাই একটু রঙ দেখাচ্ছে!
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, হঠাৎ করে অন্য পাশ দিয়ে একটা দরজা খুলে গেল আর একটা খেলনা গাড়িতে করে ইঁদুরটা বের হয়ে এল-ধাচার চারপাশ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে সেটা আবার ভেতরে কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায়। হিন্দি গান বন্ধ হয়ে এবারে ইংরেজি গান ব্রু হয়ে গেল। সায়রা বলল, চলেন এখান থেকে যাই। আপনি যতক্ষণ থাকবেন ততক্ষণ এই বেটি ঢং করতেই থাকবে!
আমি বললাম, কানে দুল পরেছে। গলায় মালা?
কানের দুলটি আমি পরিয়েছি-ওটা আসলে একটা মাইক্রোওয়েভ ট্র্যাকিং ডিভাইস। মালাটা নিজেই পরেছে। চলেন বের হই।
আমি একেবারে হতবাক হয়ে মেয়েটার পিছু পিছু বের হয়ে এলাম, নিজের চোখে না দেখলে এটা বিশ্বাস করা একেবারে অসম্ভব ব্যাপার! একটা ইঁদুরকে যদি এরকম বুদ্ধিমান করে ফেলা যায় তা হলে মানুষকে কী করে ফেলা যাবে?
সায়রা সায়েন্টিস্টের বাসা থেকে আমি সন্ধেবেলা ফিরে এলাম। আসার আগে আমি আমার ঠিকানা আর টেলিফোন নম্বর দিয়ে বললাম, যদি জরিনিকে নিয়ে কিংবা অন্য কোনো কিছু নিয়ে কিছু একটা ঘটে আমাকে জানাতে। সায়রা আমার কাছে জানতে চাইল আমার ই-মেইল অ্যাড্রেস কী-শব্দটা বিল্টুর কাছে শুনেছি কিন্তু ব্যাপারটা কী আমি সেটাই জানি না। তাই আমতা-আমতা করে বললাম যে, খোঁজখবর নিয়ে তাকে নিশ্চয়ই জানাব।
.
আমার জটিল সমস্যা হলে আমি বিল্টুর কাছে যাই, কাজেই এবারেও আমি বিল্টুর কাছে হাজির হলাম এবারেও দেখি সে কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। আমাকে দেখে তার মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হওয়ার বদলে কেমন যেন ফিউজড বাল্বের মতো নিবে গেল। শুধু তাই নয়, মুখটা প্যাঁচার মতো করে বলল, ,আমা, তুমি আবার এসেছ?
আমি একটু রেগে উঠে বললাম তোরা এমন হয়েছিস কেন? আমরা যখন ছোট ছিলাম মামারা এলে কত খুশি হতাম, তোরা আমাদের দেখলেই মুখটা ব্যাজার করে ফেলিস!
তোমাদের মামারা নিশ্চয়ই তোমাদের সাথে অনেক মজার মজার জিনিস করত- তোমরা শুধু সমস্যা নিয়ে আস। বলো এখন তোমার কী সমস্যা।
আমি ভাবলাম বলি যে কোনো সমস্যা নেই, এমনিতে তাকে দেখতে এসেছি। কিন্তু সেটা বলে আরো সমস্যায় পড়ে যাব। তাই সত্যি কথাটাই বললাম, ঠিক আছে যা। তোর কাছে আর সমস্যা নিয়ে আসব না। এই শেষ।
বলো।
ই-মেইল জিনিসটা কী? তার অ্যাড্রেস কেমন করে পেতে হয়?
বিল্টু এমন ভাব করতে লাগল যেন আমার কথা শুনতেই পায় নি, কম্পিউটারে খুটখুট করতে থাকে। আমি গলা খাকারি দিয়ে বললাম, শুনেছিস আমার কথা?
শুনছি। বলে যাও।
আর এই জিনিসটার নাম ই-মেইল কেন? এটাকে অ-মেইল বা আ-মেইল, না বলে ই-মেইল কেন বলে?
বিল্টু কম্পিউটারে খুটখুট করতে থাকে। আমি মাথা চুলকে বললাম, এইটা কি রেলওয়ের ব্যাপার? কোনো মেইল ট্রেনের সাথে যোগাযোগ আছে? কোনো স্টেশনের ঠিকানা? তা হলে স্টেশনটা কোথায়?
বিল্টু চোখের কোনা দিয়ে একবার আমাকে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ছিমছাম পরিষ্কার মহিলারা তেলাপোকা দেখলে মুখটা যেরকম করে, তার মুখটা হল অনেকটা সেরকম। আমি বললাম, কী হল? মুখটা এরকম প্যাঁচার মতো করছিস কেন?
আমার অনুরোধ তুমি এইসব ব্যাপার নিয়ে কখনো কারো সাথে কথা বলবে না। আর যদি বলতেই চাও, খবরদার কোনোভাবে বলবে না তুমি আমার মামা। যদি বলো-
আমি গরম হয়ে বললাম, যদি বলি?
যদি বলো তা হলে আমার সুইসাইড করতে হবে। তুমি কি চাও তোমার একটা ভাগনে মাত্র বারো বছর বয়সে সুইসাইড করে ফেলুক?
কেন? তোকে সুইসাইড করতে হবে কেন?
যে মামা মনে করে ই-মেইল একটা মেইল ট্রেন তার ভাগনেদের সুইসাইডই করা উচিত। বিল্টু আমার দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল, মামা, তুমি কি আফগানিস্তানে থাক? কোনোদিন পত্রিকা পড় না? রাস্তাঘাটে হাঁটো না? দুনিয়ার খবর রাখে এরকম একজন মানুষকেও চিনো না? তোমার হয়েছেটা কী?
আমি চোখ পাকিয়ে বললাম, দেখ, বেশি পাকামো করবি না। একটা জিনিস জিজ্ঞেস করেছি জানলে বল, না জানলে সোজাসুজি বলে দে জানি না। এত ধানাইপানাই কিসের?
মামা। আমি মোটেই ধানাইপানাই করছি না। ধানাইপানাই করছ তুমি। যাই হোক তোমার সাথে কথা বলা হচ্ছে সময় নষ্ট করা। তোমাকে যদি জিজ্ঞেস করি কম্পিউটার কয় রকম, তুমি কী বলবে জান?
কী বলব?
তুমি বলবে দুই রকম। এক রকম হচ্ছে কম-পিউটার আরেক রকম হচ্ছে বেশি-পিউটার। কথা শেষ করে বিল্টু খুব একটা রসিকতা করে ফেলেছে এরকম ভান করে দাঁত বের করে হি হি করে হাসতে লাগল।
আমার এমন রাগ হল সেটা আর বলার মতো নয়, ইচ্ছে হল ঘাড়ে ধরে একটা দাবড়ানি দেই। আজকালকার ছেলেপিলেরা শুধু যে ফাজিল হয়েছে তা নয়, বড়দের মানসম্মান রেখেও কথা বলতে পারে না। আমি গম্ভীর হয়ে মেঘের মতো গর্জন করে বললাম, ঠিক আছে। তুই যদি আমাকে বলতে না চাস বলিস না। তুই ভাবছিস আমি এটা অন্য কোনোখান থেকে জানতে পারব না?
বিল্টু এবারে একটু নরম হয়ে বলল, আহাহা-মামা, তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন? আমি তোমাকে বলছি ই-মেইলটা কী। এটা অ আ ই-এর ই না, এটা ইলেকট্রনিক-এর ই। ই মেইল হচ্ছে ইলেকট্রনিক মেইল। অর্থাৎ কাগজে লিখে খামে ভরে স্ট্যাম্প লাগিয়ে চিঠি না। পাঠিয়ে কম্পিউটার আর নেটওয়ার্ক দিয়ে যে চিঠি পাঠানো যায় সেটাই হচ্ছে ই-মেইল। ই-মেইল পাওয়ার জন্য আর পাঠানোর জন্য যে ঠিকানা ব্যবহার করে সেটা হচ্ছে ই-মেইল অ্যাড্রেস। এখন বুঝেছ?
পুরোপুরি বুঝতে পারলাম না কিন্তু তবুও সবকিছু বুঝে ফেলেছি এরকম একটা ভান করে বললাম, বুঝেছি।
বিল্টু এক টুকরা কাগজে কুটকুট করে কী একটা লিখে আমাকে দিয়ে বলল, এই নাও।
এটা কী?
তোমার ই-মেইল অ্যাড্রেস।
আমার ই-মেইল অ্যাড্রেস? কোত্থেকে এল?
আমি তৈরি করে দিলাম।
তুই তৈরি করে দিলি? কখন তৈরি করলি? কেমন করে তৈরি করলি?
এই তো এখন। তোমার সাথে কথা বলতে বলতে।
আমি বিল্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম সে আমার সাথে ঠাট্টা করছে কি না-কিন্তু মুখে ঠাট্টার চিহ্ন নেই, সব সময় মুখে যে ফিচলে হাসি থাকে সেটাও নেই-বেশ গম্ভীরভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আমতা-আমতা করে বললাম, তুই কেমন করে তৈরি করে দিলি? তুই কি পোস্টমাস্টার নাকি যে সবাইকে ই-মেইল অ্যাড্রেস তৈরি করে দিবি?
বিন্দু চোখ উল্টিয়ে বলল, তোমাকে সেটা বোঝানো খুব কঠিন মামা। চেষ্টা করে লাভ নেই। তুমি ই-মেইল কী জানতে চেয়েছিলে, আমি সেটা তোমাকে বলে দিলাম, একটা তৈরিও করে দিলাম! এখন তুমি সারা পৃথিবীতে যে কোনো মানুষের কাছে ই-মেইল পাঠাতে পারবে আবার সারা পৃথিবীর যে কোনো মানুষের কাছ থেকে ই-মেইল পেতেও পারবে।
কত টাকা লাগে ই-মেইল পাঠাতে?
কোনো টাকা লাগে না। ফ্রি। ইন্টারনেট থাকলেই পারবে।
ফ্রি? আমার বিশ্বাস হল না, পৃথিবীতে আবার ফ্রি বলে কিছু আছে নাকি! বললাম, ফ্রি হবে কেমন করে?
হ্যাঁ মামা ফ্রি। বিশ্বাস না হলে দেখো একটা ইমেইল পাঠিয়ে। কোথায় পাঠাবে বলো।
আমি পকেট থেকে সায়রা সায়েন্টিস্টের সেই কাগজটা বের করে দিলাম, বিল্টু সেখান থেকে দেখে কম্পিউটারে খুটখুট করে কিছু একটা লিখে বলল, বলো তুমি কী লিখতে চাও।
আমি বললাম, যেটা লিখব সেটাই চলে যাবে?
হ্যাঁ, ইংরেজিতে লিখতে হবে। বলো।
আমি কেশে গলা পরিষ্কার করে ইংরেজিতে বললাম, প্রিয় সায়রা সায়েন্টিস্ট, আমার শুভেচ্ছা নেবেন-
বিল্টু কিছু না লিখে বসে রইল। আমি বললাম, লিখছিস না কেন?
তুমি আগে বলে শেষ কর।
পুরোটা মনে থাকবে তোর?
তুমি আগে বলো তো?
আমি আবার কেশে গলা পরিষ্কার করে ইংরেজিতে বলতে প্রু করলাম, প্রিয় সায়রা সায়েন্টিস্ট, আমার শুভেচ্ছা নেবেন। আশা করি কুশলেই আছেন। আপনি সেদিন আমার ই মেইল অ্যাড্রেস জানতে চেয়েছিলেন। শুনে সুখী হবেন যে, আমার একটি ই-মেইল অ্যাড্রেস হয়েছে। আপনাকে সেই অ্যাড্রেস থেকে একটি ই-মেইল পাঠাচ্ছি। এটি পেলে আমাকে জানাতে দ্বিধা করবেন না। তা হলে আমি বুঝতে পারব আপনি আমার ই-মেইলটি পেয়েছেন। আপনার সুস্বাস্থ্য এবং সাফল্য কামনা কছি। ইতি আপনার গুণমুগ্ধ জাফর ইকবাল।
বিল্টু খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা নিশ্বাস ফেলে খুটখুট করে কিছু একটা লিখে ফেলল। আমি বললাম, কী লিখেছিস?
তুমি যেটা বলেছ।
আমি তো কত কী বললাম তুই তো লিখেছিস মাত্র একটা শব্দ। আমি কি তোকে একটা শব্দ বলেছি?
বিল্টু আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, মামা, এটা ফ্রি সেই জন্য তোমাকে উপন্যাস লিখতে হবে না। ই-মেইলে মানুষ কখনো ভ্যাদর ভ্যাদর করে না। কখনো ফালতু একটা শব্দও বলে না! তুমি যে এত কিছু বলেছ তার মাঝে একটা কথাই জরুরি। সেটা হচ্ছে ই-মেইলটা পেয়েছ কি না জানাও। আমি সেটাই এক শব্দে লিখেছি। একনলেজ এর আগে-পিছে কিছু দরকার নাই।
নাম লিখবি না?
নাম নিজে থেকে চলে যাবে।
শুভেচ্ছা দিবি না?
ই-মেইলে কেউ বাজে কথা লিখে না।
শুভেচ্ছা বাজে কথা হল?
বিল্টু গম্ভীর গলায় বলল, ই-মেইলে শুভেচ্ছা বাজে কথা। মানুষ শুধুমাত্র কাজের কথা লিখে। বানানগুলো পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত
আমি গরম হয়ে বললাম, আমার সাথে ফাজলেমি করবি না। যা যা বলেছি সবকিছু লেখ।
বিল্টু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কেন খামোখা লিখব? তোমার ই-মেইল চলে গেছে।
আমি আঁতকে উঠে বললাম, চলে গেল মানে কখন গেল? কীভাবে গেল?
আমি পাঠিয়ে দিয়েছি। এতক্ষণে যেখানে যাবার কথা সেখানে চলে গেছে।
আমি কিছুক্ষণ বিল্টুর দিকে চোখ পাকিয়ে থাকলাম। মানুষের চোখ থেকে সত্যিকার আগুন বের হলে এতক্ষণ এই ফাজিল ছেলেটি পুড়ে কাবাব হয়ে যেত। কী করব বুঝতে না পেরে আমি তাকে সেখানে রেখে রান্নাঘরের দিকে রওনা দিলাম, আমার বোনকে মনে হয় জানানো উচিত যে তার ছেলে এখনই পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
আমার বোন চুলোর ওপর ডেকচিতে কী একটা ঘাঁটাঘাঁটি করছিল। আমাকে বলল, না খেয়ে যাস নে। রান্না প্রায় হয়ে গেছে।
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, আর খাওয়া!
কোনদিন থেকে তুই খাওয়ার ওপর এরকম দার্শনিক হয়ে গেলি?
না তা হই নি। আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, বিল্টুর সাথে একটু কথা বলছিলাম।
আমার বোন ডেকচির ভেতরের জিনিসটাকে ঘাঁটতে ঘাঁটতে বলল, বিল্টু হতভাগার কথা আর বলিস না। দিন-রাত কী একটা শয়তানের যন্ত্র আছে কম্পিউটার সেটা নিয়ে পড়ে থাকে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ নাওয়া নাই খাওয়া নাই পড়াশোনা নাই খেলাধুলা নাই-চব্বিশ ঘণ্টা এই কম্পিউটার।
আমি নাক দিয়ে একটা শব্দ করলাম।
বুঝলি ইকবাল, আমি অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। এই শয়তানের বাক্স আমি গুড়ো করে ফেলে দেব।
আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, ঠিকই বলেছ আপা। ব্যাপারটা মনে হয় একটু কন্ট্রোল করা দরকার।
আমার বোন ডেকচির জিনিসটা ঘাঁটাঘাঁটি বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুই-ই পারবি।
কী পারব?
বিল্টুর এই নেশা ছুটাতে। তোকেই দায়িত্ব দিচ্ছি। এক ধমক দিয়ে সিধে করে দে
আমি চমকে উঠে বললাম, আমি?
হ্যাঁ। ওকে বোঝা যে এটা হচ্ছে শয়তানের বাক্স। এটা যারা ব্যবহার করে তারা হচ্ছে বড় শয়তান!
বড় শয়তান?
হ্যাঁ!
আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখন বিল্টু তার ঘর থেকে চিৎকার করে বলল, মামা! তোমার ই-মেইলের উত্তর এসেছে!
আমার বোন কোমরে হাত দিলে বলল, কী বলছে পাজিটা? তোর ই-মেইল আসছে? তোকেও ভজিয়ে ফেলেছে? তুইও বিল্টুর সাথে তাল দিচ্ছিস? ঘরের শত্রু বিভীষণ?
বোনের চোখ লাল হওয়ার আগেই আমি সুড়ুৎ করে রান্নাঘরের দরজা থেকে সরে গেলাম। বিল্টুর কাছে যেতেই সে কম্পিউটারের মনিটরের দিকে দেখাল, সেখানে তিনটা ইংরেজি শব্দ, জরুরি। দেখা করুন।
আমি অবাক হয়ে বললাম, এর মাঝে উত্তরও চলে এসেছে?
হ্যাঁ।
কেমন করে হতে পারে এই মাত্র না পাঠালি?
হ্যাঁ মামা, ই-মেইল তো আর কেউ ঘাড়ে করে নেয় না, নেটওয়ার্ক দিয়ে যায়। তাই দেরি হয় না। সাথে সাথে চলে যায়।
কী তাজ্জবের ব্যাপার! কয়দিন পরে শুনবে, ছবি চলে যাচ্ছে। কথা চলে যাচ্ছে। টেলিভিশনের মতো কথা বলছে।
কয়দিন পরে না মামা, সেটা এখনই করা যায়। আম্মুকে কিছুতেই পটাতে পারছি না একটা ছোট ভিডিও ক্যামেরা কিনে দিতে তা হলে ভিডিও কনফারেন্স করা যেত!
খেয়াল করি নি কখন আমার বোন এই ঘরে চলে এসেছে। আমাদের দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার দিয়ে বলল, কী বললি? আমাকে পটাতে পারছিস না? এখনো জিনিস কেনা বাকি আছে? একেবারে ফতুর হয়ে গেলাম, তারপরেও শখ যায় না। একজনকে নিয়ে পারি না এখন দুইজন জুটেছে? দুইজনে মিলে ষড়যন্ত্র হচ্ছে? শয়তানের বাক্স নিয়ে মামু-ভাগ্নের শয়তানি?
আমি বললাম, না-না আপা! তুমি কী বলছ এটা? ষড়যন্ত্র কেন হবে?
ষড়যন্ত্র নয় তো কী? মামু-ভাগ্নে দুইজনে মিলে গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করছিস? ভাবলাম তুই অন্তত আমার ঝামেলাটুকু বুঝবি-আমার জন্য একটু মায়া হবে। আর শেষ। পর্যন্ত তুইও বের হলি ঘরের শত্রু বিভীষণ?
আপা খেপে গেলে তার মুখে একেবারে মেইল ট্রেন চলতে থাকে–আমি কিছুক্ষণেই কাবু হয়ে গেলাম। জরুরি কাজ আছে বলে এক-দুইবার উঠে যেতে চেষ্টা করেছি কিন্তু কোনো লাভ হল না, আপা হুঙ্কার দিয়ে বলেছে তোর জরুরি কাজ আছে? আমাকে সেই কথা বিশ্বাস করতে বলিস? জীবনে তোকে দিয়ে কোনো কাজ হয়েছে? জরুরি কাজ ছেড়ে দে-সাধারণ একটা কাজও কখনো তোকে দিয়ে হয়েছে? বাজার করতে দিলে পর্যন্ত পচা মাছ কিনে নিয়ে আসিস। ডিমের হালি কত জানিস না। দেশের প্রেসিডেন্টের নাম জানিস না–
কাজেই আমাকে বসে থাকতে হল। আপা টেবিলে খাবার দিতে দিতে বলল, খেয়ে তুই বিল্টুকে নিয়ে বের হবি।
আমি বিষম খেয়ে বললাম, বি-বিল্টুকে নিয়ে বের হব? আমি?
হ্যাঁ। এই ছেলেকে এই শয়তানের বাক্স থেকে দূরে সরাতে হবে।
আমি আমতা-আমতা করে বললাম, দূরে কোথায় সরাব?
সেটা আমি কী জানি? মামারা ভাগ্নেদের নিয়ে কত আনন্দ করে, মজা করে সেসব করবি। চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাবি। শিশুপার্কে নিয়ে যাবি।
বিল্টু আঁতকে উঠে বলল, চিড়িয়াখানা? শিশুপার্ক? সর্বনাশ!
সর্বনাশের কী হল?
আমার স্কুলের বন্ধুরা যদি খবর পায় আমি চিড়িয়াখানা গেছি কিংবা শিশুপার্কে গেছি, তা হলে তারা আমার সাথে কথা বলবে ভেবেছ?
কেন কথা বলবে না?
মনে করবে আমি ন্যাদা ন্যাদা বাচ্চা!
আপা বলল, সেটা তোর আর তোর এই নিষ্কর্মা অপদার্থ মামার মাথাব্যথা। খেয়ে তোরা এই বাড়ি থেকে বের হবি। রাত নয়টার আগে আমি তোদের দেখতে চাই না।
আমি দুর্বলভাবে আপত্তি করার চেষ্টা করলাম, আপা ভাতের চামচ দিয়ে ডাইনিং টেবিলে ঘটাং করে মেরে আমাকে থামিয়ে দিল।
.
কাজেই দুপুরবেলা আমি বিল্টুকে নিয়ে বের হলাম। বিল্টুর মুখ শুকনো, আমার মুখ আমি দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু নিশ্চয়ই আমশি মেরে আছে। রাস্তার মোড় থেকে একটা রিকশা নিয়েছি। রিকশায় উঠে দুইজনের কেউই কথা বলছি না, অনেকক্ষণ পর বিল্টু একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সব দোষ তোমার মামা।
কেন, আমার কেন হবে?
তুমি যদি ই-মেইলের কথা না বলতে তা হলেই আজকের এই সর্বনাশটা হত না।
সর্বনাশ? কোন জিনিসটাকে সর্বনাশ বলছিস?
এই যে তোমার সাথে আজকে সারা দিন থাকতে হবে।
আমি এভাবে বিল্টুর থেকেও একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, মামার সাথে থাকা তোর কাছে সর্বনাশ মনে হচ্ছে?
সর্বনাশ নয় তো কী? তুমিই বলল, তুমি কী ইন্টারেষ্টিং জিনিস করতে পার, বলো?
আমরা দুইজনে মিলে একটা সিনেমা দেখতে পারি। অনেক দিন থেকে আমি সিনেমা দেখি না। সিনেমা হলে বসে সিনেমা দেখার মজাই অন্যরকম।
বিল্টু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মামা, তুমি দুনিয়ার কোনো খবর রাখ না। তাই না?
কেন?
এই সপ্তাহে যে দুইটা সিনেমা রিলিজ হয়েছে তুমি তার নাম জান?
না, জানি না। কেন, কী হয়েছে?
একটার নাম হচ্ছে কিলিয়ে ভর্তা, অন্যটার নাম হচ্ছে টেংরিতে লেংড়ি। কাহিনী শুনতে চাও?।
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, দেশটাতে হচ্ছেটা কী? সিনেমা হচ্ছে একটা শিল্পমাধ্যম। তার নাম কিলিয়ে ভর্তা?
বিল্টু বলল, মামা তুমি আসলে খুব ভালো আছ, দেশের কোনো কিছু জান না, খবরের কাগজ পড় না, মহানন্দে আছ।
তা হলে চল চিড়িয়াখানায় যাই।
না মামা। চিড়িয়াখানায় সব জন্তু-জানোয়ার বাথরুম করে রেখেছে, দুর্গন্ধে কাছে যাওয়া যায় না।
তা হলে শিশুপার্কে যাবি?
বিল্টু চোখ কপালে তুলে বলল, শিশুপার্কে? আমি? আমি কি শিশু নাকি?
শিশু নয় তো কী? তোর কী এমন বয়স?
বিল্টু মাথা নেড়ে বলল, মামা তুমি জান না। শিশুপার্কে যায় বয়স্ক মানুষেরা, যাদের বুদ্ধি কম শিশুদের সমান।
পার্কে যাবি?
গতকালকেই পার্কে দুইটা ছিনতাই হয়েছে।
তা হলে কোথায় যাবি?
বিল্টু চোখ নাচিয়ে বলল, এলিফেন্ট রোডে একটা কম্পিউটারের দোকান আছে।
আমি শিউরে উঠে বললাম, সর্বনাশ! আপা একেবারে খুন করে ফেলবে না?
বিল্টু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তা হলে আর কী করব? রিকশাতেই বসে থাকি রাত নয়টা পর্যন্ত।
আমি খুব দুশ্চিন্তার মাঝে পড়ে লাম, বারো বছরের একটা ছেলেকে নিয়ে সময় কাটানোর মতো কোনো বুদ্ধিই বের করতে পারব না? অনেক চিন্তা করে বললাম, আমার একজন বন্ধু আছে। যা সুন্দর ক্লাসিক্যাল গান গায়!
বিল্টু শিউরে উঠল। আমি বললাম, একজন আর্টিষ্ট বন্ধু আছে তার বাসায় যাবি? মডার্ন আর্ট করে-
বিল্টু মাথা নাড়ল, বলল, মডার্ন আর্ট দেখলে ভয় করে।
পরিচিত একটা ভণ্ডপীরের বাসায় যাবি? যা ভংচং করে, দেখলে তোর তাক লেগে যাবে
বিল্টু এবারে খানিকটা কৌতূহল দেখাল কিন্তু ভিতরে গিয়ে পায়ে ধরে সালাম করতে হবে শুনে শেষ পর্যন্ত বেঁকে বসল। তখন আমার সায়রা সায়েন্টিস্টের কথা মনে পড়ল। বললাম, একজন সায়েন্টিস্টের কাছে যাবি?
কোন সায়েন্টিস্ট?
ঐ যে আজকে ই-মেইল পাঠিয়ে দেখা করতে বলেছে।
কী আবিষ্কার করেছে?
অনেক কিছু। দেখলে হাঁ হয়ে যাবি। সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হচ্ছে একটা ই- হঠাৎ আমার মনে পড়ল আমি সায়রাকে কথা দিয়েছি তার বুদ্ধিমান ইঁদুরী জেরিনির কথা কাউকে বলব না। কথা শেষ না করে থেমে গেলাম।
বিল্টু পেটে খোঁচা দিয়ে বলল, কী? বলো।
বলা যাবে না।
কেন?
এটা সিক্রেট। আমি সায়রাকে কথা দিয়েছি কাউকে বলব না।
এই প্রথমবার বিল্টুর চোখ কৌতূহলে জ্বলজ্বল করতে থাকে। খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, চল যাই সায়রা সায়েন্টিস্টের কাছে।
আমি আর বিল্টু তখন সায়রা সায়েন্টিষ্টের বাসার দিকে রওনা দিলাম। যদি রওনা না দিতাম তা হলে পৃথিবীর ইতিহাসই হয়তো অন্যরকম করে লেখা হত।
.
বাসায় গিয়ে কয়েকবার বেল টিপলাম কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল। আবার টিপব না চলে যাব যখন বুঝতে পারছিলাম না, তখন হঠাৎ খুট করে দরজাটা খুলে গেল। খুব অল্প একটু দরজা ফাঁক করে সায়রা আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, ঢুকে পড়েন। তাড়াতাড়ি।
দরজার এক ইঞ্চি ফাঁক দিয়ে কেমন করে আস্ত একটা মানুষ ঢুকতে পারে আমি বুঝতে পারলাম না। আমি ইতিউতি করছিলাম কিন্তু তার মাঝে বিন্দু দরজা টেনে ফাঁক করে ভিতরে ঢুকে গেছে। সায়রা মহা সর্বনাশ হয়ে গেছে এরকম ভান করে একেবারে হা হা করে উঠল এবং তার মাঝে আমিও ভিতরে ঢুকে গেলাম এবং সাথে সাথে সায়রা ঝপাং করে দরজা বন্ধ করে দিল। আমি অবাক হয়ে সায়রার দিকে তাকালাম, তাকে দেখাচ্ছে হলিউডের সিনেমার নায়িকাদের মতো। পিঠে যন্ত্রপাতি বোঝাই ব্যাকপেক, হাতে বিদঘুটে একটা অস্ত্র, কানে হেডফোন, মাথায় একটা টুপি এবং সেই টুপির ওপরে পাখার মতো একটা যন্ত্র আস্তে আস্তে ঘুরছে। সায়রার চুল উসকোখুসকো, চোখর নিচে কালি, গায়ে কালিঝুলি মাখা একটা ওভারঅল, শুধু মেয়ে বলে মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি নেই। আমি খানিকক্ষণ অবাক হয়ে সায়রার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, কী হয়েছে?
সায়রা সারাক্ষণই ইতিউতি তাকাচ্ছে আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, সায়রা-কী হয়েছে?
সর্বনাশ হয়ে গেছে।
সর্বনাশ? আমি শুকনো গলায় বললাম, আপনার ডাল রান্নার মেশিনে কিছু গোলমাল?
সায়রা হাত নেড়ে বলল, আরে না! ডাল রান্নার মেশিনের কথা ছেড়ে দেন।
তা হলে?
আমার কথার উত্তর দেবার আগেই হঠাৎ করে মনে হল সায়রা তার হেডফোনে কিছু শুনতে পেল, সাথে সাথে তার চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেল। সে হঠাৎ ঘুরে ছুটে যায় হাতের বিদঘুটে অস্ত্রটার ট্রিগার টেনে ধরে এবং সেখান থেকে বজ্রপাতের মতো একটা বিদ্যুৎ ঝলক বের হয়ে আসে, ঘরের ভেতরে একটা পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে সাথে সাথে। বিল্টু চমকে উঠে আমার পিছনে লুকিয়ে আমার হাত খামচে ধরল ভয়ে। সায়রা মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, এই ঘরেই আছে এখন। পরিষ্কার সিগন্যাল পাচ্ছি।
আমি ভয়ে ভয়ে সায়রার দিকে তাকালাম, মনে হতে থাকে মেয়েটা হয়তো পাগলটাগল হয়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে আপনার?
আমার কিছু হয় নি। জিজ্ঞেস করেন, পৃথিবীর কী হয়েছে!
আমি শুকনো মুখে বললাম, কী হয়েছে পৃথিবীর?
পৃথিবীর মহাবিপদ।
কেন?
জরিনি পালিয়ে গেছে।
তাই বলেন! আমি বুক থেকে আটকে থাকা নিশ্বাসটা বের করে দিয়ে বললাম, সেটা নিয়ে এত ঘাবড়ানোর কী আছে?
সায়রা হুঙ্কার দিয়ে বলল, কী বললেন আপনি? জরিনি পালিয়ে গেছে এবং সেটা নিয়ে ঘাবড়ানোর কিছু নেই?
বিল্টু আমার হাত টেনে বলল, মামা জরিনি কে?
একটা ইঁদুর।
মনে হল সায়রা এই প্রথম বিল্টুকে দেখতে পেয়েছে, তার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, এইটা কে?
আমার ভাগনে। নাম বিল্টু। খুব বুদ্ধিমান–আইকিউ বলতে পারেন জরিনির সমান।
বিল্টু জিজ্ঞেস করল, মামা, ইঁদুর আবার বুদ্ধিমান হয় কেমন করে?
আমি মাথা চুলকে বললাম, সেটা বলা নিষেধ–তাই না সায়রা?
সায়রা হাত ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, আর নিষেধ! জরিনি পালিয়ে গিয়ে যে সর্বনাশ করেছে এখন আর গোপন করে কী হবে?
কেন সর্বনাশ কেন?
বুঝতে পারছেন না কেন?
আমি মাথা চুলকে বললাম, না।
সায়রা হতাশার মতো একটা ভঙ্গি করে বলল, কারণ জরিনি হচ্ছে একটা নেংটি ইঁদুরী-
বিল্টু বাধা দিয়ে বলল, ইঁদুরী?
আমি বিল্টুকে থামিয়ে বললাম, ব্যাকরণ বইয়ে পুংলিঙ্গ-স্ত্রীলিঙ্গ পড়িস নি? কুকুর কুকুরী, পিশাচ পিশাচী-সেরকম ইঁদুর ইঁদুরী। জরিনি হচ্ছে মেয়ে ইঁদুর-
কিন্তু বিল্টু আপত্তি করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, সায়রা তাকে সেই সুযোগ দিল না। বলল, নেংটি ইঁদুরের সাইজ মাত্র এতটুকু–তাদের শরীরের হাড়, জয়েন্ট পর্যন্ত ফ্লেক্সিবল। এক ইঞ্চির চার ভাগের এক ভাগ একটা ফুটো দিয়ে এরা বের হয়ে যেতে পারে। এদের অসাধ্য কোনো কাজ নেই। প্রতি বছর এরা কত কোটি টাকার ফসল নষ্ট করে জানেন?
আমি মাথা নাড়লাম, জানি না।
শুধু কি ফসল? জামাকাপড়, ঘরবাড়ি, গাছপালা-কিছু বাকি নেই। এরা ইচ্ছে করলেই সারা পৃথিবী দখল করে নিতে পারে, নিচ্ছে না শুধু মানুষের কারণে। মানুষ নেংটি ইঁদুরকে কন্ট্রোলের মাঝে রেখেছে।
সায়রা একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, এখন চিন্তা করুন জরিনির কথা–সে অসম্ভব বুদ্ধিমতী। আইকিউ এক শ কুড়ির কাছাকাছি। মানুষের সাথে সে পাল্লা দিতে পারে। পালিয়ে যাবার পর গত দুই দিন থেকে আমি তাকে পৃথিবীর সেরা যন্ত্রপাতি দিয়ে ধরার চেষ্টা করছি–ধরতে পারছি না। কপাল ভালো সে আমাদের কিছু করতে পারছে না, কারণ সে একা। কিন্তু
সায়রা হঠাৎ তার মুখ অসম্ভব গম্ভীর করে থেমে গেল। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু?
কিন্তু সে একা থাকবে না।
কেন একা থাকবে না?
কারণ জরিনি ঘরসংসার করবে। তার বাচ্চাকাচ্চা হবে। বুদ্ধির জিনিসটা কোন কমোজমে আছে জানি না, কিন্তু যেখানেই থাকুক তার বাচ্চাকাচ্চার মাঝে সেই বুদ্ধি ছড়িয়ে পড়বে। মানুষের হিসেবে জরিনি হচ্ছে কিশোরী বালিকা। অন্তত এক ডজন বাচ্চা হবে তার-সেখান থেকে ডজন ডজন নাতি-সেখান থেকে ডজন ডজন ডজন পুতি-বুঝতে পারছেন?
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, বুঝেছি একজন বুদ্ধিমান ইঁদুরী থেকে বারোটা বাচ্চা, চব্বিশটা নাতি, ছত্রিশটা পূতি-।
বিল্টু মাথা নাড়ল, বলল, না মামা। তুমি মনে হয় জীবনে অঙ্কে পাস কর নাই। এক ডজন বাচ্চা হলে নাতি হবে এক শ চুয়াল্লিশ আর পুতি হবে দেড় হাজারের মতো। সংখ্যাটা যোগ নয়-গুণ হবে।
সায়রা মাথা নাড়ল। বলল, ঠিক বলেছ। সঠিক সংখ্যা হবে এক হাজার সাত শ আটাশ। এই পুতিদের পূতি যখন হবে তাদের সংখ্যা হবে তিন মিলিয়ন। এখন চিন্তা করেন-ঢাকা শহরে তিন মিলিয়ন নেংটি ইঁদুর যাদের আইকিউ এক শ বিশ। চিন্তা করতে পারেন কী হবে?
আমি আমতা-আমতা করে বললাম, ইয়ে মানে
সকল খাবার তারা দখল করে নেবে। টেলিফোনের তার কেটে যোগাযোগ নষ্ট করে দেবে। ইলেকট্রিক কন্ট্রোল সিস্টেমের তার কেটে পাওয়ার সাপ্লাই নষ্ট করে দেবে। দেশে কোনো ইলেকট্রিসিটি থাকবে না। ফাইবার অপটিক লাইন কেটে নেটওয়ার্ক নষ্ট করে দেবে। যে কোনো যন্ত্রের ভিতরে ঢুকে টুক করে একটা তার কেটে যন্ত্রটা নষ্ট করে দেবে। কম্পিউটার অচল হয়ে যাবে। ট্রেন চলবে না–গাড়ি চলবে না। প্লেন ক্র্যাশ করে যাবে। দেশের মানুষ খেতে পাবে না। পাবলিক খেপে যাবে। দেশে আন্দোলন হবে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে- সায়রা কথা বলতে বলতে শিউরে উঠল।
আমি মাথা চুলকে বললাম, এটা থামানোর কোনো উপায় নাই?
সায়রা মাথা নাড়ল, বলল, একমাত্র উপায় হচ্ছে জরিনিকে শেষ করে দেওয়া। আর যদি শেষ করা না যায় তা হলে কোনোভাবে তাকে এই ট্যাবলেটটা খাইয়ে দেওয়া। সায়রা ছোট একটা ট্যাবলেট দেখাল, হলুদ রঙের লজেন্সের মতো।
বিল্টু জিজ্ঞেস করল, কী হয় এটা খেলে?
এটা একটা হরমোন ট্যাবলেট। এটা খেলে হরমোনের ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে যাবে, আর কখনো বাচ্চা হবে না।
বিল্টু বলল, ইঁদুর এত বড় ট্যাবলেট গিলতে পারবে? গলায় আটকে যাবে না?
এর মাঝে বাদামের গুড়ো, পনিরের টুকরো, মধু আর বিস্কুট মেশানো আছে। ইঁদুর খুব শখ করে খায়। কিন্তু জরিনিকে খাওয়ানোর জন্য ধরতেই পারছি না। জরিনি বেটি মহা ধুরন্ধর।
বিল্টু জিজ্ঞেস করল, এত যদি বুদ্ধিমান তা হলে এই বাসা থেকে পালিয়ে যাচ্ছে না কেন?
চেষ্টা করছে–পারছে না। পুরো বাসাটা আমি সিল করে রেখেছি। জরিনির কানে একটা রিং লাগানো আছে। সেটা আসলে একটা মাইক্রোচিপ–সেখান থেকে বারো মেগাহার্টজ-এর একটা সিগন্যাল বের হয়। সেই সিগন্যালটা থেকে আমি বুঝতে পারি সে কোথায় আছে। যেমন এই মুহূর্তে সে সার্কিট ব্রেকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে-
কেন?
সায়রার মুখ শক্ত হয়ে উঠল, বলল, নিশ্চয়ই কোনো বদ মতলব আছে। টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছে এখন নিশ্চয়ই ইলেকট্রিক লাইন কাটবে।
ইলেকট্রিক শক খেয়ে ছাতু হয়ে যাবে।
হবে না। বেটি মহা ধুরন্ধর। একটা পাওয়ার লাইনে ঝুলে ঝুলে কাটে, গ্রাউন্ড থেকে দূরে থাকে।
কথা শেষ হতে না হতেই ঘটাং ঘটাং করে কয়েকটা শব্দ হল এবং হঠাৎ করে ঘরবাড়ি একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল। সায়রা পা দাপিয়ে বলল, হতভাগীর কাজ দেখেছেন? কত বড় ধুরন্ধরাসরি আমাকে চ্যালেঞ্জ করছে।
আমি শুকনো গলায় বললাম, এখন কী হবে?
ঐ বেটি চলে ডালে ডালে আমি চলি পাতায় পাতায়। এই রকম একটা কাণ্ড করতে পারে আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল সেই জন্য একটা জেনারেটর রেডি রেখেছি। দুই মিনিটের মাঝেই সেটা চালু হয়ে যাবে।
আমরা আবছা অন্ধকারের মাঝে দাঁড়িয়ে রইলাম, শুনতে পেলাম কুটুর কুটুর শব্দ করে কিছু একটা ঘরের দেওয়ালের ভিতর দিয়ে ছুটোছুটি করছে। নিশ্চয়ই জরিনি-সায়রার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসেছে–কী হবে কে জানে? মিনিট দুয়েকের ভিতরে কোথায় জানি শব্দ করে জেনারেটর চালু হয়ে গেল সাথে সাথে ঘরে আলো জ্বলে ওঠে, নানা ধরনের যন্ত্রপাতি গুঞ্জন করতে প্রু করে। সায়রা উপরের দিকে তাকিয়ে বলল, কী জরিনিং ভেবেছিলি ইলেকট্রিক লাইন কেটে দিবি? এখন?
আমরা শুনতে পেলাম কিচকিচ শব্দ করে ইঁদুরটা কোথায় জানি ছুটে যাচ্ছে। বিল্টু জিজ্ঞেস করল, সায়রা খালা। জরিনি পালাল কেমন করে?
সায়রা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, সেটা আরেক ইতিহাস। জরিনি অনেক কায়দা করে পালিয়েছে।
কী রকম কায়দা?
প্রথমে ভান করল সে অসুস্থ। আস্তে আস্তে হাঁটে। ফেবারিট হিন্দি গান শোনে না। ভালো করে খায় না। শরীর এলিয়ে শুয়ে থাকে। আমি সমস্ত কিছু টেস্ট করে দেখি-কিন্তু কোনো রোগের চিহ্ন পাই না। ভাবলাম ব্যাপারটা হয়তো সাইকোলজিক্যাল। মন ভালো করার জন্য একটা ছোট টেলিভিশন সেট লাগিয়ে দিলাম, সাথে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির ভিডিও। কিন্তু কোনো লাভ হল না। একদিন সকালে উঠে দেখি জরিনি মরে পড়ে আছে। চার পা উপরে তুলে মুখ ভেংচি কেটে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। মুখের কোনায় সাদা ফেনা-চোখ বন্ধ। আমি আর কী করব, গ্লাভস পরে মরা ইঁদুরটাকে বের করে এনেছি। ভাবলাম কেন মারা গেল। সেটা পোস্টমর্টেম করে দেখি। একটা ট্রের উপরে রেখেছি। হঠাৎ করে সে লাফ দিয়ে উঠল তারপর ছুটে শেলফের উপর উঠে গেল- সায়রা থেমে একটা নিশ্বাস ফেলল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কী হল?
আমি পিছনে পিছনে ছুটে গেলাম। সেই বেটি উপর থেকে ধাক্কা দিয়ে একটা জাইলিনের বোতল আমার উপর ফেলে দিল। এই দেখেন কপালে লেগে কেমন ফুলে উঠেছে-
সায়রা তার মাথাটা আমাদের দিকে এগিয়ে দেয়। আমি এমনি দেখলাম বিটু একটু টিপে দেখল।
সায়রা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তারপর সে শেলফের একেবারে উপরের র্যাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অঙ্গভঙ্গি করে আমাকে ভেংচি কাটতে লাগল। কী বেয়াদবের মতো কাজ আপনি বিশ্বাস করবেন না।
ইঁদুর কেমন করে বেয়াদব হয় আমি বুঝতে পারলাম না কিন্তু এখন এটা জিজ্ঞেস করা মনে হয় ঠিক হবে না। সায়রা একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তারপর নিজের লেজটাকে একটা গিটারের মতো ধরে গান গাইতে লাগল-
গান গাইতে লাগল? ইঁদুর গান গাইতে পারে? তার ভাষায় গান :
কিচি কিচি কিচি কিচি ফু
কিচি মিচি কিচি মিচি
মিচি কিচি কু—
এইটা গান?
আমাকে বিরক্ত করার চেষ্টা আর কি! তারপর কী করল আপনি বিশ্বাস করবেন না।
কী করল?
তাকের উপরে ইথাইল অ্যালকোহলের একটা বোতল আছে, সেটা খুলে দুই ঢোক খেয়ে নেশা করে ফেলল।
নেশা?
হ্যাঁ। নেশা করে লাফায়-ঝাপায় ধাক্কা দিয়ে এটা ফেলে দেয়, সেটা ফেলে দেয়। সবচেয়ে ভয়ংকর কাজ কী করল জানেন?
বিল্টু আর আমি একসঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, কী?
রান্নাঘর থেকে একটা কাঠি বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে জ্বালিয়ে নেয় তারপর সেটাকে মশালের মতো করে ধরে স্লোগান দেয়। মশাল মিছিলের মতো।
স্লোগান? কী স্লোগান
সায়রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কিচমিচ করে কী একটা বলে–শুনে মনে হয় বলছে ধ্বংস হোক ধ্বংস হোক। সেটাই শেষ না-খানিকক্ষণ জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠিটা হাতে নিয়ে ঘোরাঘুরি করে উপর থেকে ছুঁড়ে দেয়। একবার খবরের কাগজের উপর পড়ে আগুন ধরে গেল তাই দেখে জরিনির কী আনন্দ।
আগুন ধরে গেল? আমি আঁতকে উঠে বললাম, সর্বনাশ!
সর্বনাশের আপনি দেখেছেন কী? সায়রা মুখ কালো করে বলল, যখন বুঝতে পারল আগুন দিয়ে সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া যায় তখন সে ইচ্ছে করে আগুন ধরানোর চেষ্টা করতে লাগল। অ্যালকোহলের একটা বোতল ধাক্কা দিয়ে ফেলে ভেঙে তার উপর জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি ফেলে দিল। সারা ঘরে তখন দাউদাউ আগুন। কী অবস্থা চিন্তা করতে পারবেন না। আরেকটু হলে ফায়ারব্রিগেড ডাকতে হত।
সর্বনাশ! আমি বললাম, কী ভয়ানক অবস্থা!
ভয়ানক বলে ভয়ানক। সায়রা মাথা নেড়ে বলল, এর মাঝে সে গোপনে তার গাড়িটা চুরি করে নিয়ে গেল সারা রাত গাড়ি করে টহল দেয়। একটু হয়তো অন্যমনস্ক হয়েছি-পায়ের তলা দিয়ে সঁই করে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির হর্নে কান ঝালাপালা।
সায়রার কথা শেষ হতেই মনে হয় আমাদের দেখানোর জন্য পঁ্যা পঁ্যা করে হর্ন বাজিয়ে জরিনি তার গাড়ি চালিয়ে একটা টেবিলের তলা থেকে বের হয়ে অন্য পাশে ছুটে চলে গেল। সায়রা তার অদ্ভুত অস্ত্র দিয়ে বজ্রপাতের মতো শব্দ করে বিদ্যুতের একটা ঝলক দিয়ে জরিনিকে কাবু করার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না।
বিল্টুর চোখ উত্তেজনায় চকচক করতে থাকে, হাতে কিল দিয়ে বলে, কী সাংঘাতিক!
হ্যাঁ। সায়রা বলল, আসলেই সাংঘাতিক অবস্থা। কলিংবেলের কানেকশনটা খুলে রেখেছি, যেই ঘুমাতে যাই কানেকশন দিয়ে বসে থাকে। সারা রাত বেলের শব্দে ঘুমাতে পারি নাই। কথা বলতে বলতে হঠাৎ সায়রার মুখ পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেল, চোখ বড় বড় হয়ে যায়, নাকের পাট ফুলে ওঠে, ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু জরিনি টের পায় নি কত ধানে কত চাল। কত গমে কত আটা। কঠিন একটা যন্ত্র দাঁড় করিয়েছি। জরিনি এখন কোথায় আছে আমি বলে দিতে পারি। কন্ট্রোলরুমে মনিটরে সবকিছু দেখা যায়। একা বলে পাজিটাকে শেষ করতে পারছিলাম না। এই জন্য আপনাকে খবর পাঠিয়েছিলাম।
আমি ঢোক গিলে বললাম, আমাকে কী করতে হবে?
সায়রা আমার হাতে বিদঘুটে অস্ত্রটা দিয়ে মেঘস্বরে বলল, জরিনিকে ঘায়েল করতে হবে!
আমি?
হ্যাঁ। আমি কন্ট্রোলরুম থেকে আপনাকে বলে দেব কোনদিকে যেতে হবে, আপনি সেদিকে যাবেন, যখন বলব ট্রিগার টেনে ধরতে তখন ট্রিগার টেনে ধরবেন-
আ-আমি?
আপনি না হলে কে করবে? পৃথিবীকে বাঁচানোর এই এত বড় একটা দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে।
কি-কিন্তু আমি আমতা-আমতা করে বললাম, আমি কখনো খুনখারাবি করি নাই। ভায়োলেন্স দেখতে হবে বলে খবরের কাগজ পড়া ছেড়ে দিয়েছি।
সায়রা বিরক্ত হয়ে বলল, এর মাঝে আপনি ভায়োলেন্স কোথায় দেখলেন? একটা নেংটি ইঁদুরকে ঘায়েল করা ভায়োলেন্স হল? যখন মশা মারেন তখন কি দুঃখে আপনার চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে?
আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম তখন বিল্টু বলল, সায়রা খালা আমাকে দেন- আমি পারব।।
সায়রা কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে বিল্টুর দিকে তাকিয়ে রইল এবং হঠাৎ করে তার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। বিল্টুকে দেওয়াই ঠিক। যতবার আমি ধাওয়া করি তখন অরিনি স্টোররুমে একটা চিপার মাঝে ঢুকে পড়ে সেখানে আপনি আপনার মোটা কুঁড়ি নিয়ে ঢুকতে পারবেন না। যদি কষ্ট করে ঢুকেও যান মাঝখানে গিয়ে আটকে যাবেন আপনাকে তখন টেনে বের করা যাবে না। জরিনি যদি বুঝতে পারে আপনি আটকে গেছেন তখন বড় বিপদ হতে পারে।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, কী রকম বিপদ?।
আপনার মাথার মাঝে কেরোসিন ঢেলে চুলে আগুন ধরিয়ে দিল। কিংবা ইলেকট্রিক তার এনে আপনার নাকের মাঝে ইলেকট্রিক শক দিল। কিংবা
আমি শিউরে উঠে বিদঘুটে অস্ত্রটা তাড়াতাড়ি বিল্টুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, থাক। থাক-আর বলতে হবে না। বিল্টুই যাক। সে-ই ভালো পারবে।
বিল্টু মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। আমি এরকম অস্ত্র দিয়ে প্রতিদিন গোলাগুলি করি।
সায়রা ভুরু কুঁচকে বলল, কোথায় গোলাগুলি কর?
কম্পিউটার গেমে। আজকেই গুলি করে এই বিশাল একটা ডাইনোসর মেরেছি। টি রেক্স।
ভেরি গুড। সায়রা তার কান থেকে হেডফোন খুলে বিল্টুকে লাগিয়ে দিয়ে বলল, এটা দিয়ে আমরা তোমার সাথে কথা বলতে পারব, তুমিও আমাদের সাথে কথা বলতে পারবে। মাথায় টুপিটা পরিয়ে দিয়ে বলল, এটা একটা রাডারের মতো। এটা মাথায় থাকলে তুমি আগেই সিগন্যাল পেয়ে যাবে। জরিনি তোমাকে পিছন থেকে অ্যাটাক করতে পারবে না।
বিল্টু অস্ত্র হাতে বলল, আমাকে অ্যাটাক করা এত সোজা না। আমার ধারেকাছে এলে একেবারে ছাতু করে দেব।
ভেরি গুড। এবার তা হলে তুমি যাও।
বিল্টু একেবারে যুদ্ধসাজে জরিনিকে ঘায়েল করতে এগিয়ে যেতে থাকে। সায়রা আমাকে বলল, আপনি আসেন আমার সাথে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায়?
কন্ট্রোলরুমে।
.
কন্ট্রোলরুমে বড় টেলিভিশনের স্ক্রিনের মতো একটা স্ক্রিন। তার আশপাশে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি নানা ধরনের শব্দ করছে। স্ক্রিনের মাঝামাঝি জায়গায় একটা লাল বিন্দু জ্বলছে এবং নিবছে। সায়রা বিন্দুটিতে আঙুল দিয়ে বলল এইটা হচ্ছে জরিনি। বসার ঘরে সোফার নিচে। কাছাকাছি আরেকটা সবুজ বিন্দু জ্বলছে এবং নিবছে, সায়রা আঙুল দিয়ে সেটা ছুঁয়ে বলল, আর এইটা হচ্ছে বিল্টু। আমাদের হিটম্যান।
সায়রা কাছাকাছি রাখা একটা মাইক্রোফোন টেনে নিয়ে বলল, হ্যাঁলো বিল্টু-আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?
স্পিকারে বিল্টুর কথা শুনতে পেলাম। শুনতে পাচ্ছি। রজার।
তোমার সামনে দশ ফুট গিয়ে ডানদিকে চার ফুট গেলে জরিনিকে পাবে।
টু ও ক্লক পজিশন?
রজার। টু ও ক্লক।
আমি সায়রার দিকে তাকিয়ে বললাম, টু ও ক্লক? মানে কী?
ঘরটাকে একটা ঘড়ির মতো চিন্তা করেন–ঠিক সামনে হচ্ছে বারোটা। দুইটা মানে হচ্ছে একটু সামনে একটু ডানে। বুঝেছেন?
আমি কিছু বুঝলাম না কিন্তু সেটা বলতে লজ্জা লাগল, তাই জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললাম, বুঝেছি। বুঝেছি।
সায়রা মাইক্রোফোনে বলল, বিল্টু। ডানদিকে সোফার নিচে লুকিয়ে আছে। ডাইভ দাও।
আমরা স্ক্রিনে দেখতে পেলাম সবুজ বিন্দুটা একটু ডাইভ দিল কিন্তু লাল বিন্দুটা তিন লাফে সরে স্ক্রিনের কোনায় চলে এল। সায়রা বলল, বিল্টু জরিনি এখন ফাইত ও ক্লক পজিশনে।
এইটার মানে কী আমি বুঝতে পারলাম না কিন্তু বিল্টু ঠিকই বুঝল, দেখলাম সবুজ বিন্দুটা আবার লাল বিন্দুটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু লাভ হল না–জরিনি মহা ধুরন্ধর। ঠিক শেষ মুহূর্তে লাফিয়ে সরে গেল।
প্রায় আধঘণ্টা এরকম লুকোচুরি খেলা হল। আমি যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছি তখন হঠাৎ করে শুনতে পেলাম সায়রা দাঁতের ফাঁক দিয়ে আনন্দের একটা শব্দ করল। আমি বললাম, কী হয়েছে?
এবারে বাছাধন আটকা পড়েছে।
আটকা পড়েছে?
হ্যাঁ–এখান থেকে পালানোর জায়গা নেই। যাকে বলে একেবারে অন্ধ গলি! সায়রা মাইক্রোফোনে মুখ লাগিয়ে বলল, বিল্টু! এইবারে আটকানো গিয়েছে।
রজার।
টুয়েলভ ও ক্লক। শার্প।
রজার।
উবু হয়ে ঢুকে যাও। ছয় ফুট দূর থেকে শুট কর।
বিল্টু খানিকক্ষণ পর উত্তর করল, ভিতরে অন্ধকার।
তোমার কোমরে সুইচ আছে। জ্বালিয়ে নাও।
বিল্টু নিশ্চয়ই জ্বালিয়ে নিল, কারণ শুনতে পেলাম সে বলছে, এবারে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
জরিনিকে দেখেছ?
দেখেছি।
শুট কর।
আমরা কন্ট্রোলরুমে বসে একটা বজ্রপাতের মতো শব্দ শুনতে পেলাম। সায়রা নিশ্বাস আটকে রেখে বলল, ঘায়েল হয়েছে? হয়েছে?
বুঝতে পারছি না।
আমরা দেখতে পেলাম জরিনির লাল বিন্দুটি একই জায়গায় আছে-বির সবুজ বিন্দু এগিয়ে যাচ্ছে। দুটি খুব কাছাকাছি চলে এল–আবার বজ্রপাতের মতো শব্দ হল। লাল বিন্দুটি কয়েকবার কেঁপে উঠল। সায়রা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, এবারে একেবারে শেষ! বাঁচার কোনো উপায়ই নেই।
আমরা দেখতে পেলাম লাল বিন্দু এবং সবুজ বিন্দু খুব কাছাকাছি। সায়রা মাইক্রোফোনে জিজ্ঞেস করল, কী অবস্থা বিল্টু?
বিল্টু কোনো উত্তর করল না। সায়রা আবার জিজ্ঞেস করল, বিল্টু কী অবস্থা?
বিল্টু এবারেও কোনো উত্তর করল না। শুধু দেখলাম লাল বিন্দু এবং সবুজ বিন্দু খুব কাছাকাছি। সায়রা একটু দুশ্চিন্তিত হয়ে ডাকল, বিল্টু। তুমি ঠিক আছ তো?
জি ঠিক আছি।
মিশন কমপ্লিট?
কমপ্লিট। জরিনি ছ্যাড়াবেড়া হয়ে গেছে। কানের সাথে একটা রিং ছিল শুধু সেটা আছে। আর কিছু নাই।
সায়রা জিব দিয়ে চুকচুক শব্দ করে বলল, হাইভোল্টেজে ভস্মীভূত হয়ে গেছে শুধু মাইক্রোওয়েভ ট্যাগটা আছে।
বিল্টু জানতে চাইল, ওটা কি নিয়ে আসব?
হ্যাঁ নিয়ে এস। সায়রা হঠাৎ একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল।
কিছুক্ষণের মাঝেই বিল্টু ফিরে এল। যদিও বুঝতে পারছিলাম এরকম বুদ্ধিমান নেংটি ইঁদুর ছাড়া পেয়ে যাওয়া পৃথিবীর জন্য খুব বড় বিপদের ব্যাপার। তারপরেও এরকম চালাক-চতুর ইঁদুরটা এভাবে মারা গেল চিন্তা করে আমার খুব খারাপ লাগছিল। বিদঘুটে অস্ত্র হাতে ইঁদুরকে মেরে ফেলা আমার কাছে মানুষ মেরে ফেলার মতো বড় অপরাধ মনে হতে লাগল। আমি সায়রার মুখের দিকে তাকালাম-এত বড় একটা বিপদ থেকে সারা পৃথিবী রক্ষা পেয়েছে কিন্তু তার মুখে এখন আর সেরকম আনন্দ দেখা যাচ্ছে না। শুধু বিল্টুর চোখে-মুখে ঝলমলে আনন্দ–ছোট বাচ্চারা মনে হয় একটু নিষ্ঠুর হয়।
পরিবেশটা কেমন জানি ভার ভার হয়ে রইল। জরিনির কানে যে রিংটা ছিল সায়রা অনেকক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, জরিনি বেটি মাপ করে দিস আমাকে। আমি দেখলাম সায়রার চোখ ছলছল করছে।
আমি আর বিল্টু যখন সায়রার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসছি তখন হঠাৎ করে বিল্টু বলল, সায়রা খালা-
উঁ।
আপনি হলুদ রঙের একটা ট্যাবলেট দেখিয়েছেন না– যেটা খেলে ইঁদুরের বাচ্চাকাচ্চা হয় না?
হ্যাঁ। কী হয়েছে সেটার?
আমাকে একটা ট্যাবলেট দেবেন?
কেন কী করবে?
আমাদের বাসায় কয়দিন থেকে খুব ইঁদুরের উৎপাত। এটা ফেলে রাখব-ইঁদুর খেয়ে ফ্যামিলি প্ল্যানিং করবে। আর ইঁদুরের বাচ্চা হবে না।
সায়রা একটা নিশ্বাস ফেলে টেবিলের উপর থেকে একটা কৌটা বের করে একটা ট্যাবলেট বের করে বিল্টুর হাতে দিয়ে বলল, নাও। জরিনির জন্য তৈরি করেছিলাম-সেই যখন নেই এই ট্যাবলেট দিয়ে আমি আর কী করব? সায়রা একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল- জরিনির শোকে বেচারি হঠাৎ করে খুব কাতর হয়ে গেছে।
.
আমি আর বিল্টু রিকশা করে যাচ্ছি। রাত সাড়ে আটটার মতো বাজে–নয়টার ভিতরে বাসায় পৌঁছে যাব। রিকশাটা টুকটুক করে যাচ্ছে, বেশ সুন্দর একটা ঝিরঝিরে বাতাস দিচ্ছে। বিল্টু অনেকক্ষণ কোনো কথা বলছে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা বিল্টু, তুই যে এতটুকুন একটা ইঁদুরের বাচ্চাকে এভাবে গুলি করে মারলি তোর খারাপ লাগল না?
কেন? খারাপ লাগবে কেন?
ইঁদুর হলেও তো একটা প্রাণী। বিশেষ করে এরকম বুদ্ধিমান একটা প্রাণী। আইকিউ মানুষের সমান।
বিল্টু মাথা নাড়ল, বলল, না, মামা। আমার একটুও খারাপ লাগছে না।
একটুও না?
না। একটুও না। বরং খুব ভালো লাগছে।
আমি একটু অবাক হয়ে বিল্টুর দিকে তাকালাম, এইটুকুন ছেলে এরকম নিষ্ঠুর? জিজ্ঞেস করাম, তোর ভালো লাগছে?
হ্যাঁ। কেন জান?
কেন?
এই দেখ। বলে বিল্টু তার পকেটে হাত দেয় এবং সাবধানে হাতটা বের করে আনে, সেখানে জরিনি পিছনের দুই পায়ের উপর ভর দিয়ে বসে আছে। সেটি চুকচুক করে একবার বিল্টুর দিকে আরেকবার আমার দিকে তাকাল। বিল্টু জরিনির মাথায় আঙুল দিয়ে আদর করে বলল, তোমার কোনো ভয় নেই জরিনি। আর কেউ তোমাকে মারতে পারবে না।
জরিনি সম্মতি জানিয়ে মাথা ঝাঁকাল। আমি অবাক হয়ে একটা চিৎকার দিয়ে রিকশা থেকে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম। অনেক কষ্ট করে নিজেকে সামলে বললাম, জ-জ-জরিনি মরে নি?
উঁহু। বিল্টু দাঁত বের করে হেসে বলল, কথা বলতে পারলে জরিনি বলত-আমি মরি নি!
কিন্তু, কিন্তু আমি আমতা-আমতা করে বললাম, আমরা স্পষ্ট শুনতে পেলাম তুই গুলি করেছিস!
ফাঁকা গুলি করেছি উপরের দিকে। তখনই জরিনি বুঝতে পারল আমি বাঁচাতে এসেছি। চোখ টিপে হাত দিয়ে ডাকতেই সুড়ুৎ করে চলে এল। কান থেকে রিংটা খুলে তাকে পকেটে রেখে দিয়েছি। একটুও শব্দ করে নি!
এখন যদি তোর হাত থেকে পালিয়ে যায়?
কেন পালিয়ে যাবে? আমি আর জরিনি এখন প্রাণের বন্ধু! তাই না জরিনি?
জরিনি ঠিক মানুষের মতো মাথা নাড়ল। বিলটু বলল, তা ছাড়া আমি সায়রা খালার কাছ থেকে হলুদ ট্যাবলেট নিয়ে এসেছি। সেটা এখন খাইয়ে দেব।
কীভাবে খাওয়াবি?
এই যে এইভাবে। বলে বিল্টু পকেট থেকে হলুদ ট্যাবলেটটা বের করে জরিনিকে জিজ্ঞেস করল, খিদে পেয়েছে?
জরিনি মাথা নাড়ল। বিল্টু তার হাতে ট্যাবলেটটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, নাও খাও।
জরিনি কুটকুট করে খেতে থাকে, আমি রুদ্ধশ্বাসে সেদিকে তাকিয়ে থাকি, সমস্ত পৃথিবীর একটা মহাপ্রলয় থেকে উদ্ধার পাওয়া নির্ভর করছে এই ট্যাবলেটটা খেয়ে শেষ করার ওপরে।
.
সপ্তাহ খানেক পরে বোনের বাসায় বেড়াতে গিয়েছি–বোন আমাকে দেখে বলল, বুঝলি ইকবাল। তোকে সব সময় আমি অপদার্থ জেনে এসেছি। কিন্তু তুই দেখি ম্যাজিক করে দিলি।
কী ম্যাজিক?
বিল্টুর মাথা থেকে কম্পিউটারের ভূত দূর করে দিয়েছিস। সেই যে সেদিন কয়েক ঘণ্টার জন্য নিয়ে গিয়েছিলি কীভাবে বুঝিয়েছিস কে জানে। ম্যাজিকের মতো কাজ হয়েছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। এখন দেখি দিন-রাত ঘরে দরজা বন্ধ করে হাতের কাজ করে।
হাতের কাজ?
হ্যাঁ। ছোট ছোট চেয়ার-টেবিল তৈরি করেছে। একটা ছোট বিছানাও। সেদিন দেখি একটা খেলনা গাড়ির মাঝে কীভাবে কীভাবে ব্যাটারি দিয়ে একটা ইঞ্জিন বসাবে। দিন-রাত দেখি ব্যস্ত।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। লাইব্রেরি থেকে বই এনে বেশ পড়াশোনাও করে।
কীসের ওপর বই?
জন্তু-জানোয়ারের ওপর বই। শুরু করেছে ইঁদুরের বই দিয়ে।
আমি কেশে গলা পরিষ্কার করে বললাম, ও আচ্ছা!
আর কী একটা হয়েছে দুই চোখে বিড়াল দেখতে পারে না। বাসায় কোথা থেকে একটা হুলো বিড়াল এসেছিল, নিজে সেটাকে ধরে বস্তায় ভরে বুড়িগঙ্গার ঐ পারে ফেলে এসেছে।
আমি খুব অবাক হবার ভান করলাম। আপা অবিশ্যি হঠাৎ মুখ কালো করে বললেন, তবে
তবে কী?
এই বাসাটার কিছু একটা দোষ হয়েছে।
দোষ?
হ্যাঁ।
কী দোষ?
সেদিন দেখি সিলিং থেকে একটা জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি নিচে পড়ল।
জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি?
হ্যাঁ। একেবারে অবিশ্বাস্য ব্যাপার। আর কোনো মানুষ নেই জন নেই মাঝরাতে হঠাৎ করে কলিংবেল বাজতে থাকে।
কী আশ্চর্য!
বোন মুখ গম্ভীর করে বললেন, ভালো একটা বাসা পেলে জানাবি–এই দোষে পাওয়া বাসায় থাকতে চাই না।
ঠিক আছে আপা, জানাব।
বোনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিল্টুর সাথে দেখা করতে গেলাম। অন্যবারের মতো আমাকে দেখে মুখ কালো করে ফেলল না বরং তার মুখ পুরোপুরি এক শ ওয়াট না হলেও মোটামুটি চল্লিশ ওয়াট বাল্বের মতো জ্বলে উঠল। আমি গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, জরিনির কী খবর?
বিল্টু ফিসফিস করে বলল, ভালো। তবে
তবে কী?
খুব মেজাজ গরম। পান থেকে চুন খসলে রক্ষা নাই। সেদিন একটু বকেছি তখন ম্যাচ নিয়ে সিলিঙে উঠে গেল। তারপর
জানি। আপা বলেছে।
তার সাথে না খেললে সারা রাত কলিংবেল বাজায়।
কী খেলিস?
দাবা। ওপেনিং মুভ যাচ্ছেতাই
ও।
খুব ভয়ে ভয়ে আছি মামা, কোন দিন না আম্মুর কাছে ধরা পড়ে যাই। আম্মু কম্পিউটারকে যত ঘেন্না করে ইঁদুরকে তার চেয়ে এক শ গুণ বেশি ঘেন্না করে।
আপাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। নেংটি ইঁদুরকে ভালবাসার কারণ আছে?
বিল্টু ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, শ-স-স-স, জরিনি শুনলে খবর আছে!
শেষ খবর অনুযায়ী সায়রা সায়েন্টিষ্টের ডাল রাঁধার যন্ত্রের কাজ প্রায় শেষ। জরিনি আসলে মারা যায় নি শুনে সে খুব খুশি হয়েছে। বিল্টুকে সে রাখতে দিয়েছে তবে কঠিন একটা শর্ত আছে-কোথা থেকে পেয়েছে কাউকে বলতে পারবে না!
বিল্টুর তাতে সমস্যা নেই–সে যে একটা নেংটি ইঁদুর পেয়েছে সেই কথাটিই এখনো কেউ জানে না। আমি ছাড়া।