আমি কৃষ্ণা। জন্মের সময় বাবা মা খুশির হওয়ার তুলনায় গায়ের রঙটাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন কি না! তাই নামটাও রাখা হয়েছে রঙের উপর ভিত্তি করে! ছোটবেলায় বাবা মায়ের চিন্তা এটা হতো না আমি বড় হয়ে কি হবো, বরং তারা এটা চিন্তা করতেন কোন কোন উপায় অবলম্বন করে আমাকে দাঁড়কাক থেকে ময়ূর রূপে অবতীর্ণ করা যায়।
ছোটকাল থেকে ঘষাঘষির কমতি ছিলো না। ফেয়ার এন্ড লাভলী বস্তার উপর বস্তার শেষ করা হয়েছিল বছর সাতে পড়তে পড়তে। ক্রিমের বিজ্ঞাপনে মডেল পরিবর্তন করা হলো, একমাসে ফর্সা হওয়ার মেয়াদ কমিয়ে এক সপ্তাহে আনা হলো, নতুন আনা মডেলটি ক্রিম দিন দুই ব্যবহার করে আকর্ষণীয়া হয়ে উঠলো। কিন্তু আমার অবস্থা কোনো পরিবর্তন হলো না। আমি সেই কৃষ্ণবর্ণই রয়ে গেলাম।
ছোট বয়সে আমার গায়ের রঙের প্রতি বাবা মা মারাত্মক গুরুত্ব দিয়েছিলেন বলে কখনো জানতে পারেননি আমি স্কুলে সেরা ৫ জনের মধ্যে ১ম ছিলাম। ক্লাস থ্রিতে পড়াকালীন আমার ছোট ভাই রুদ্রের জন্ম হলো। ফুটফুটে দেবশিশুর মত চেহারা। আহ্লাদের দাঁড়িপাল্লা ওর দিকে ঝুঁকে গেল। আমি ছিটকে পড়লাম সহজ স্বাভাবিক জীবন থেকে।
বন্ধুবান্ধবের সাহচর্যের জন্যেও গায়ের রঙটা জরুরী। ক্লাস ওয়ান থেকে থ্রি পর্যন্ত আমার কোনো বন্ধুবান্ধব ছিল না। যারা পাশে বসতো তারাও প্রায় গা এড়িয়ে চলতো। এক ম্যাম ছিলেন। তিনি বকাঝকা দিয়ে স্টুডেন্টদের আমার পাশে বসাতেন। খেলাধুলার আশপাশ দিয়ে যেতে পারি নি। এখনো জানিনা কাবাডি কিভাবে খেলে, কানামাছি খেলতে কেমন মজা হয়, লুকোচুরি খেলায় কোন কোণা গুলোয় লুকিয়ে হাঁক মারতে হয়। পড়াশুনার জন্য অঢেল সময় পেয়েছিলাম বলেই হয়তো মনটা পুরোপুরি সেদিকে দিয়েছি। ক্লাস ফোরে ওঠার পর কিছু কিছু বন্ধুবান্ধব জুটেছিল। যদিও এরা ঘুরঘুর করতো পরীক্ষার আগমুহূর্তে।
আমি বেড়ে উঠার আগেই আমার মস্তিষ্কে অলিখিতভাবে এটি স্থাপন করা হচ্ছিলো যে, আমার রঙ ময়লা, অতএব বিশ্বে যা কিছু সুন্দর ও রুচিশীল তাতে অবশ্যই আমার অধিকার নেই এবং আমার ভালোবাসা পাওয়ারও যোগ্যতা নেই। যদিও ক্লাসের স্যার ম্যামরা অজানা কারণে আমাকে পছন্দ করতেন। তাদের প্রতি দায়িত্ববোধ দেখে তারা অন্য যেকোনো শিক্ষার্থীর তুলনায় আমার মতামতের গুরুত্ব দিতেন। ফলাফলস্বরূপ আমি হতাম অন্যান্যদের চক্ষুশূল। ক্লাসমেটদের অবজ্ঞা, অবহেলা এবং দৌরাত্ম্যে জীবন খালি নরক হওয়া বাকি ছিল।
মেট্রিকে স্কুলে হাইয়েস্ট মার্কস নিয়ে যখন বাসায় ফিরলাম তখন দেখি বাবা মা খুব খুশি। আমি ভেবেছিলাম আমার রেজাল্টের খবর হয়তো পেয়ে গেছে। পরে মা হাসিমুখে আমায় মিষ্টি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ”মিষ্টি খা, রুদ্র এ যাত্রায় পাশ করে গেছে। অংকে যা দূর্বল ছিল। ভয়ে ছিলাম এ বার ফেল না করে বসে আবার!” মা বাবা রুদ্রকে নিয়ে মেতে রইলেন।
কলেজে ভর্তি হলাম। এখানেও যথারীতি নিজের পড়াশুনোটাকেই একমাত্র ধ্যান জ্ঞান করে চলতে লাগলাম। কুশলাদি বিনিময়ের জন্য দু একজন মেয়ে বন্ধু হয়েছিল বটে! তবে ওসব ওই ‘হাই,হ্যালো’ র মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এর বাইরে কারো কোনো গোপন কথার সাক্ষী আমায় হতে হত না। কখনো জমিয়ে আড্ডা দেয়া কি জিনিস তা বুঝিনি। ক্লাসরুমে কথা বলার দায়ে কখনো দাঁড়িয়ে থাকার অভিজ্ঞতাও হয়নি।
আমার এমন নিরামিষ জীবনে টোকা মারা প্রথম ছেলেটি হল মৃণাল। ক্লাসে ওর সাথে চোখাচোখি হয়ে যেত। পাশাপাশি কখনো একসাথে এসে পড়লে কেমন যেন উদভ্রান্ত হয়ে যেত। আমি সেদিন যেন আকাশ থেকে পড়লাম যেদিন ওর কাছ থেকে চিঠি পেলাম। মৃণাল আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চায়।
আমি ওকে না করতে পারিনি। এই এতগুলো বছর পর কেউ আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইছে। ব্যস,ওর সাথে কথা বলতে শুরু করে ক্লাসের মেয়েদের জ্বলুনি বাড়িয়ে দিলাম। সময়গুলো দারুণ কেটে যাচ্ছিলো।
এভাবে চলে এলো আমাদের পরীক্ষা। পরীক্ষায় মৃণালের সীট পড়েছে আমার পাশেই। দেখে খুশি হলাম। পরীক্ষার সময়টুকু অন্তত ওকে না দেখে থাকতে হবেনা। আমাকে দেখে মৃণালের আনন্দ যেন আর ধরে না। পরীক্ষায় ওকে যতটা পারলাম সাহায্য করলাম। কেবল খাতায় ধরে লিখে দেওয়া বাকি ছিল। স্যার ম্যামদের ওয়ার্নিংও কানে তুলছিলাম না। প্রায় প্রতিটি পরীক্ষায় স্যার ম্যামদের কুনজরে পড়লাম। কিন্তু মৃণালকে সাহায্য করে গেছি।
রেজাল্টের দিন দেখলাম মৃণাল হাইয়েস্ট পেয়েছে। খুশিই হয়েছিলাম। মৃণালের সাথে দেখা করতে গিয়ে শুনলাম সে বন্ধুদের বলছে, ‘কৃষ্ণাকে পটাতে জাস্ট এক সপ্তাহ লেগেছে। আমি তো জানতামই সীট প্ল্যানে ওর আশে পাশেই পড়ব। তাই ওকে আগে থেকেই পটিয়ে ফেলেছি যাতে পরে সন্দেহ করতে না পারে।’
এই ব্যাপারটা মনে এতই গভীরভাবে দাগ কেটেছিল যে আমি ছেলে জাতির উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেললাম। আর কখনো মায়ায় জড়াইনি। পড়াশুনা শেষ করে যখন জবের জন্য এপ্লাই করছিলাম, তখন আবারো মাথায় বদ্ধমূল ধারণা সৃষ্টি হল পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে কিছু থাকুক আর না থাকুক গায়ের চামড়াটুকু অন্তত কালো হওয়া যাবে না। আমি ইন্টারভিউ দিয়ে যখন চাকরী নিশ্চিত হবে এই ধারণা নিয়ে বের হতাম এবং পাশে থাকা সুন্দরী মেয়েটি কেঁদে কেঁদে এসে বলতো তার ইন্টারভিউ ভালো হয়নি অথচ সেই মেয়েটিই চাকরীর জন্যই মনোনীত হত তখন বুঝতাম মেধার চেয়েও সৌন্দর্যই বেশি গুরুত্ব পায়।
আমি খুবই নিম্নমানের ছোট একটা কোম্পানিতে প্রমোশনাল একটা জব পেলাম। নিজের মেধা আর পরিশ্রমের সর্বোচ্চটা দিয়ে কোম্পানিটাকে দাঁড় করালাম। সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে আমি আমার কোম্পানিকে শহরের এক নম্বর কোম্পানিতে পরিণত করলাম। আমার বাবা মা আমার এই সাফল্য চেয়ে চেয়ে দেখলেন। আজকে এই জায়গায় পৌঁছে আমি কৃষ্ণা তিনটি জায়গায় ধন্যবাদ দিতে চাই-
১. বাবা মায়ের কাছে – সেদিন আমার রেজাল্ট কার্ডে চোখ না বুলানোর জন্য, আমাকে আমার অবস্থান চিনিয়ে দেয়ার জন্য।
২. মৃণালকে – আমাকে তীক্ততা অনুভব করানোর জন্য। আমি সফল হওয়ার অন্যতম কারণের একটি ছিল আমি পরবর্তীতে সহজে আর কাউকে বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি এবং নিজের কাজ নিজেই শেষ করতাম পেছন থেকে ছুরি মারার ভয়ে।
৩. সমাজব্যবস্থাকে- যেখানে সন্তান জন্মের পর সুস্থ স্বাভাবিক হলো কি না তার চেয়েও বেশি গুরুত্ব রাখে তার গাত্রবর্ণ গ্রহণযোগ্য কিনা। পদে পদে তাকে বুঝিয়ে দেয়া সে আফ্রিকায় জন্মগ্রহণ না করে এদেশে বিনা অনুমতিতে কেন জন্মেছে!